দুই বুড়ো

দুই বুড়ো

দুই বুড়ো। একজন ছিয়াত্তর, একজন ঊনআশি। ঊনআশি সরকারি আমলা। ভূতপূর্ব। ছিয়াত্তর সরকারি কনট্রাকটর। ভূতপূর্ব। সরকারি কনট্রাকটর বলে তো কিছু সত্যি-সত্যি হয় না। তবে কোনো সময়ে সেটা হরেদরে হয়ে গিয়েছিল যে যোগসাজশে তারই ফলে আজ প্রাক্তন এম. এসসিপি.এইচ.ডি.-র সঙ্গে প্রায় এপাশ-ওপাশ একদা-ঠিকেদার দাবা খেলেন। দাবাতে যখন মাথা খেলে না তখন চাইনিজ চেকার, চাইনিজ চেকারেও যখন সুবিধে হয় না তখন লুডো। আমলা একদিন ভূতপূর্ব হয়ে যাবেন, সেটা জানা কথা। কিন্তু ঠিকেদার? বাঘ যেমন নরমাংসের স্বাদ পেলে চিরকালের জন্যে নরখাদক হয়ে যায়, ঠিকেদারও তেমন। ঠিকেদারির নিগঢ় রসের সন্ধান পেলে আর রিটায়ার করে না, আমরণ ঠিকেদারি করে যায়। তব ইনি রিটায়ার করতে বাধ্য হলেন কেননা আমলা মহোদয় রিটায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে রসের ফোয়ারাটি শুকিয়ে গেল। এখন কথায় কথায় মেজো সেজো অফিসার, কেরানিকুল, যে-যেখানে আছে ইনস্পেকশনের জুজু দেখায়, বিল আটকে দেয়। এতজনকে খুশি করতে হলে কি আর পড়তা পোষায়? সুতরাং সাম্রাজ্য ত্যাগ করে সরকারি ঠিকেদার মশাই বানপ্রস্থে গেলেন। সম্রাটপুত্ররা কেউ যোগ্য উত্তরাধিকারী হয়নি। সব এটা-সেটা চাকরিতে পেশায় ঢুকে গেল। কাজেই সাম্রাজ্যও আর রইল না। গোবি মরুভূমি হয়ে গেল। এই গোবি মরুভূমিতে একমাত্র সাহারা হলেন দত্তগুপ্ত। অর্থাৎ ভুবনমোহন দত্তগুপ্ত, প্রাক্তন আই.এ.এস।

দত্তগুপ্তরও আর কোনো সাহারা, কোনো মরূদ্যান নেই। ছেলেপিলে ক-টিকে যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত করার জন্য দত্তগুপ্ত সরকারি অর্থ ও সরকারি সুবিধে অকাতরে ব্যয় করেছেন। নাড় খেয়ে-দেয়ে নাড়গোপালরা সব ঘোষণা করলেন-উত্তরমেরু দক্ষিণমেরুতে পর্যন্ত থাকা যায়, কিন্তু এই হিন্দুস্তানের ন্যায় ওঁচা দেশে আর নয়। এঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন অভারতীয় নগরে-বন্দরে থানা গেড়েছেন। দত্তগুপ্তর একটি শোফার, তিনটি কাজের লোক, একটি বাড়ি। ঠিকেদার ঘোষদস্তিদারেরও অনুরূপ। তাঁর তিনটি বাড়ি, দুটি কাজের লোক, শোফার নেই, কেননা আর তিনি গাড়ি রাখেন না। এই তিনটি বাড়ি এবং দত্তগুপ্তর বাড়িটিও তিনিই সরকারি ঠিকের টাকা দিয়ে ভারি সুন্দর শক্তপোক্ত করে বানিয়ে নিয়েছিলেন। জমি ছাড়া বাড়িবাবদে খরচ তেমন কিছু হয়নি। বাড়িগুলির মোটা ভাড়া থেকে তাঁর জীবনধারণের অর্থ আসে। তিনি নিরামিষাশী, এখনও নিজের বাজার নিজে করেন,

পত্নী বেঁচে থাকতেও শখের রান্না করতেন। কৃপণও আছেন বেশ। দুটি ঠিকে লোক নিয়ে তাঁর দিব্যি চলে যায়। কথাবার্তায় মিছরি মাখানো, তাঁর নীচের তলার ভাড়াটেরাই অসুখে-বিসুখে তাঁর দেখাশোনা করে। দত্তগুপ্তর ব্যাপারস্যাপার আলাদা। তাঁর মোটা পেনশন আছে, সঞ্চিত অর্থের সুদ, ডিভিডেন্ড ইত্যাদি আছে। উপরন্তু তাঁর ছেলেমেয়েরা মাঝে মধ্যেই তাঁকে পাঁচশো কি হাজার ইউ-এস. ডলার, হাজার দেড়েক অস্ট্রেলিয়ান ডলার, একশো কি দুশো পাউন্ড এই রকমের গিফট পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঠিয়ে থাকে। তাঁর বাড়ির একতলাটিও একটি ব্যাংককে ভাড়া দেওয়া আছে। তিনি বেশ জমকালোভাবে থাকতে ভালোবাসেন। সপ্তাহে অন্তত তিনদিন শোফার-ড্রিভন ডিলাকস অ্যামবাসাডরে চড়ে হাওয়া খেতে বেরোন, কোনোদিন বাইপাসের দিকে, কোনোদিন ভিকটোরিয়া, কোনোদিন লেক, কোনোদিন আবার নিছক গঙ্গার ধার। বেড়ানোর সময়ে তাঁর সঙ্গী থাকেন ঘোষদস্তিদার। সন্ধেবেলা হলেই তাঁর একান্ত পানের আসর বসে। শ্রেষ্ঠ সরা, অর্থাৎ স্কচ হুইস্কি, তিন কি চার পেগ মেপে খান, সঙ্গে থাকে যথেষ্ট অনুপান সহপান। স্প্রিং চিকেন, মাটন, শাম্মি কাবাব, রসালো রেশমি কাবাব। মুচমুচে ভেটকিফ্রাই, তিববতি মোমো ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আসরে ঘনিষ্ঠ পারসিকদের অবারিত দ্বার। কিন্তু তিনজন, খুব জোর চারজন। দত্তগুপ্তর বৈঠকখানায় ঠিক যতজন ধরে। এখানেও স্বভাবতই ঘোষদস্তিদার নিয়মিত অতিথি।

সন্ধের আসরের পরেও ঘোষদস্তিদারকে সহজে ছাড়তে চান না দত্তগুপ্ত। আমলা সময়ের বহু না-বলা কথা তাঁর পেটে এখনও গজগজ করছে। কোন মন্ত্রীর কে কে প্রণয়িণী ছিল, কার কার তলে তলে অন্য পার্টির সঙ্গে যোগসাজশ, কতগুলো ধরকাপড় একেবারেই গট-আপ, কোন সেক্রেটারি ছিলেন গুপ্ত-হোমো, কোন পুলিশকর্তার সঙ্গে কোন রাজনৈতিক নেতার এক গেলাসের ইয়ারি। ইত্যাদি ইত্যাদি। তেত্রিশ বছরের চাকরিজীবনে এ রকম অজস্র সঞ্চয় তাঁর। তার ওপরে একাকিত্ব, নিজের পরিবার এবং পারিবারিক দায়িত্ব ও সমস্যার অভাব, উপরন্তু বার্ধক্যের এক কথা বার বার বলার অভ্যাস। সব মিলিয়ে সন্ধের পানের আসরের পর থেকে তিনি আরও চাঙ্গা এবং গপ্লে হয়ে ওঠেন। কে আর তাঁর ধৈর্যশীল শ্রোতা হবেন দ্বিতীয় বৃদ্ধ ঘোষদস্তিদার ছাড়া? পদলেহনের পুরোনো অভ্যাসটি ঘোষদস্তিদার এখনও ছাড়তে পারেননি। আর পারবেনও না। এক গল্প তিনশো তেত্রিশতম বার শোনার পরও তিনি একই রকম উৎসাহে ঘাড় নেড়ে যান। একই রকম সায় দেন, একই প্রতিক্রিয়া দেখান এবং একইভাবে দত্তগুপ্তর আত্মবিশ্বাস ও অহংকারের তৃপ্তিসাধন করেন।

দত্তগুপ্তর জীবন একেবারেই আড্ডা-নির্ভর ও অকর্মক। কিন্তু ঘোষদস্তিদারের তা নয়। তিনি তাঁর ঠিকেদারি অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। কোথাও চেনা-পরিচিত কারও বাড়ি বা ফ্ল্যাট হচ্ছে, সারাই-ঝালাই হবে এমত খবর যদি তিনি পান, তাহলে নানারকম কলাকৌশল করে ব্যাপারটার মধ্যে ঢুকে পড়েন।

চৌধুরী নাকি বাড়ি করছে? এ কি সেই সল্টলেকের পুরনো প্লটটায়? বা বা। এতদিনে সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে। তা, কাকে দিয়ে করাচ্ছে? সম্রাট? না তীর্থংকর? মনোতোষ গড়াই? চিনতে পারলুম না তো! ঠিকাছে, ঠিকাছে, ভালো বুঝেছে দিয়েছে। অন্য কিছু না, এইসব আননোন লোক কোথায় কী কমবেশি করে ফেলবে, মশলাপাতি কম দরের দেবে। কত পার্সেন্টেজ রাখবে—এগুলো…..ওই একটু আর কী! সতর্ক থাকা দরকার।

এই জায়গায় দত্তগুপ্ত তাঁর কতৃত্বব্যঞ্জক ভারী গলায় বলবেন, চৌধুরীকে বলো একবার শিবপদকে কনসাল্ট করে নিতে। গড়াইয়ের লোক কী দিচ্ছে না দিচ্ছে, শিবু যদি একবার চেক করে দেয়…

শিবুটি বলাবাহুল্য ঘোষদস্তিদার মশাই।

এইভাবে দুজনের পরিচিতদের লতায়পাতায় যে যেখানে আছে সব জায়গাতেই টোপ ফেলেন শিবপদ ঘোষদস্তিদার। কোনোটা লাগে, কোনোটা লাগে না। অন্য কিছু না, তাঁর এটা হবি, নেশা। নেশার জন্যে মানুষ কত অসাধ্যসাধন করে থাকে, শিবপদ আর এটুকু পারবেন না? টাকাপয়সার পরোয়া তিনি বড়ো একটা করেন না। তবে কাজে নামলে নয়-নয় করেও কিছু পকেটে এসেই যায়, তাই দিয়ে শিবপদ তাঁর বসতবাড়ি, দত্তগুপ্তর বসতবাড়ি, পারলে নিজের অন্যান্য বাড়ি সংস্কার করেন। ভাড়াটেরা খুশি হয়। শিবপদবাবুর মতো ল্যান্ডলর্ড আর হয় না, এঁরা বলাবলি করেন। দত্তগুপ্ত যতবার টাকাপয়সা হিসেব করে দিতে যান, শিবপদ বলেন, ও হবে এখন। আপনার কাজটা আগে হোক! কাজ হয়ে গেলে, দত্তগুপ্তর সম্পূর্ণ সন্তোষ সাধিত হলে তবে একবার সিমেন্ট বালি রং কাঠের ন্যূনতম বিলটি পেশ করেন শিবপদ। কাজেই দত্তগুপ্তর আস্থাভাজন হতেও তাঁর ঘর থেকে খরচ করতে হয় না।

দুই বুড়োর বোঝাপড়া যাকে বলে যোলো আনার জায়গায় আঠারোআনা। বন্ধুত্বে বেশ আঠা। একদিন দেখা না হলে দুজনেই বিরহের দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকেন। সেবার শিবপদের হল ভাইরাল ফিভার। তিনদিন দেখা নেই। দ্বিতীয় দিনেই ফোন তুললেন দত্তগুপ্ত।

কী হে শিব, জ্বর কত?

থার্মোমিটার তো বলছে দুই।

দুই জ্বরেই কাবু হয়ে পড়লে?

তা পড়লুম।

বলি খাওয়াদাওয়া বন্ধ নাকি? একটু করে চিকেন স্যুপ খেতে শুরু করো, বোস্টমগিরি কদিন বন্ধ থাক।

ওয়াক উঠবে যে!

নাক টিপে খেয়ে নাও। এসব রোগে ফুডটাই আসল। বুঝলে?

বুঝলুম।

আজকের কাগজটা দেখেছিলে?

এখনও সময় পাইনি।

বলছি শোনেনা। ওই তোমাদের সল্টলেক গো, হেরইনের ডেন ধরা পড়েছে। বাইরে থেকে ধর্মীয় আশ্রম, ভেতরে সব চরসে কুঁদ। মন্ত্রীর ছেলে, পুলিশ কমিশনারের মেয়ে, চিফ সেক্রেটারির বউ—তবে আর বলছি কেন? হাই-টেক ডেন। কত তার কায়দাকানুন, মেম্বারশিপ কার্ড, শাকাহারী রেস্তোরাঁ… ভেতরে এই ব্যাপার। আমাদের টাইমে…

গল্প শুরু হয়ে যাবে। দেড়টি ঘন্টা কাবার করে, তবে ফোন রাখবেন দত্তগুপ্ত।

আর দত্তগুপ্তর অসুখবিসুখ। হয়ই না বলতে গেলে। একবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে দেড়মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। সে সময়টা শিবপদকে দত্তগুপ্ত ভবনেই আস্তানা গাড়তে হয়েছিল।

ভুবনমোহন দত্তগুপ্তর কাছ থেকেই মঙ্গলদীপ বহুতলের তিনতলার দক্ষিণ পশ্চিমের ফ্ল্যাটটা শেষ অবধি বিক্রি হওয়ার সংবাদটা পেয়েছিলেন শিবপদ।

মঙ্গলদীপ হয়েছে বছর তিনেক। সব ভরতিও হয়ে গেছে। সাউথ-ওয়েস্টটাও হয়েই গিয়েছিল, কিন্তু ক্রেতা তিনকড়ি সান্যালের ওটাতে বাস করার ইচ্ছে ছিল না। সে এটা গেস্টহাউস বানাতে চাইছে খবর পেয়ে ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দারা রুখে দাঁড়াল। পাড়ার মাতববর ব্যক্তি হিসেবে ভুবনমোহনের সইসাবুদ সমর্থন এসবও তারা জোগাড় করে। সেই থেকেই ফ্ল্যাটটার খোঁজ রাখতেন ভুবনমোহন। তিনকড়ি অবশেষে ওটাকে বিক্রি করে দিয়েছে। কিনেছেন এক মহিলা। এই খরিদ নিয়েও বহু ঝামেলা। মহিলা অবিবাহিত না ডিভোর্সি কেউ জানে না। কিনেছেন, থাকবেন একা একা। এতে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের একটু খুঁতখুঁতুনি ছিল।

তাঁরা ভুবনমোহনের কাছে দরবার করেন।

একটা মিষ্টি গলা দুদিন অন্তর ভুবনমোহনকে ফোনে ডাকতে থাকে।

হ্যালো, দত্তগুপ্ত বলছি।

আমি ঋতা সেন বলছি, মঙ্গলদ্বীপ-এর তিনতলার সাউথ-ওয়েস্ট ফ্ল্যাটটাতে কি কোনো গোলমাল আছে? মানে ওনারশিপে?

কেন আপনি কাগজপত্র দেখেননি?

না, রেজিস্ট্রি তো এখনও হয়নি কিনা! দেখুন এসব কথা ফোনে হয় না। বাড়িতে আসুন।

সে তো খুব ভালো কথা। আমি আপনাকে বিরক্ত করতে সংকোচ বোধ করছিলুম।

অতএব মহিলা আসেন। বছর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মহিলা। চমৎকার চেহারাটি রেখেছেন। ইনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করেন। ঋতা সেনকে ফ্ল্যাটটি পাইয়ে দিলেন ভুবনমোহন। অর্থাৎ মঙ্গলদ্বীপ-এর বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। বোঝালেন—আপত্তির কোনো প্রয়োজন নেই। একলা মহিলা যাবেনই বা কোথায়! ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঋতার স্বভাবতই এখন ভুবনমোহন-নির্ভরতা চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে যায়। এখনও তিনি ফ্ল্যাটে আসেননি। কিন্তু অফিস ফেরত তিনি প্রায়ই ভুবনমোহনের এখানে টু মেরে যান, সঙ্গে থাকে কোনোদিন নিজের হাতে বেক করা কিছু সুখাদ্য, কিংবা ভালো রেস্তোরাঁ থেকে আনা কিছু

জিভে-জল, একদিন সসংকোচে এক বোতল আইরিশ-ক্রিম নিয়ে হাজির। আপনি লিকিয়র খান তো!

আরো না খাই তো তুমি এনেছ বলে খাব! অত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? একটু আধটু খাই বইকি! সারাজীবন খেতে হয়েছে চাকরির খাতিরে, এখন একটু না খেলে কি চলে মা?

তবে ভুবনমোহন শুধু উপহার নিতেই জানেন না, দিতে জানেন বিলক্ষণ। একদিন ঋতা সেনকে তিনি একটি প্যাকেট এগিয়ে দেন।

কী এটা, মেসোমশাই!

এখন, ঋতা তাঁকে মেসোমশাই কেন বলে ভুবনমোহন তা বুঝতে পারেন না।

মাসিটি থাকতেন তো তাঁর মেসো হওয়া সাজত। কিন্তু মাথা নেই অথচ মাথাব্যথা! বাই হোক, মেয়েদের মন আর মেয়েদের জিভ, একবার ভেবে বা না ভেবে যখন জিভের জগায় এনে ফেলেছে তখন আর ফেরানো যাবে না।

ভুবনমোহন বললেন—দ্যাখোই না খুলে।

প্যাকেট খুলতে একটি চমৎকার দক্ষিণী শাড়ি বেরিয়ে পড়ল।

কেমন, পছন্দ হয়?

কার জন্য বলুন।

তোমার জন্যে, আবার কার জন্যে।

সে কী! ও মা! কেন?

কেন মেসোমশাই কি তোমাকে একটা সামান্য উপহার দিতে পায়ে না? এই শাড়িটি পরে তুমি গৃহপ্রবেশ করবে।

বিমর্য হয়ে ঋতা বলল, আর গৃহপ্রবেশ। জানলা দরজার রং নেই। ভেতরে সুষ্ঠু ন্যাড়া প্লাস্টার অফ প্যারিস। বাথরুমে আয়না নেই, ফ্লাশ কাজ করছে না। ছুটি পড়ক, মিস্ত্রি খাটাবার সময় পাই, তারপরে ওসব ভাবা যাবে।

এই কথা! আগে বলোনি কেন? তোমাকে মিস্ত্রি খাটাতে হবে কেন? আমার লোক জানা আছে। নিশ্চিন্তে ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে দাও। গুছিয়ে সব করে দেবে। কিছু ভাবতে হবে না।

হবি তো হ, শিবপদ ঘোষদস্তিদার ধোপদুরস্ত হয়ে ঠিক এমনি শুভক্ষণেই প্রবেশ করলেন।

নাও ঋতা, তোমার মিস্ত্রিমশাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করো। ডক্টর শিবপদ ঘোষদস্তিদার।

হঠাৎ খামোখা ডক্টরটা ভুবনমোহন একটা মজার মেজাজেই যোগ করেছিলেন, কিন্তু এতে দুটি কাজ হল। এক শিবপদ কেন কে জানে বেজায় খুশি হয়ে গেলেন,

আর দুই ঋতা সেন শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে গেল।

সে কী? উনি মানে… আমি তো কিছুই… অত সংকোচের কারণ নেই। শিবপদ একজন শখের ইনটিরিয়ার ডিজাইনার। তুমি ওর সাহায্য নাও। তোমার উঁচ সুতো থেকে খাট আলমারি পর্যন্ত সব ব্যবস্থা ওই করে দেবে।…।

ঘোষদস্তিদারের জালে মাছ পড়ল। অনেক দিন পর।

ঘষ ঘষ ঘষ ঘষ,—চলল ঘষামাজা, নারকোল দড়ি, শিরীষ কাগজ, পাথর, অ্যাসিড, প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান, মোজেইকের মিস্ত্রি, ঝালমিস্ত্রি, রঙের মিস্ত্রি, ছুতোর … কাজ কি একটা। মাসখানেকের মাথায় ঋতা সেনের ফ্ল্যাট ঝকঝক করতে লাগল। শুধু রং পালিশই নয়। সেখানকার যেটি সেখানে সেটি ফিট করে দিয়েছেন শিবপদ। গৃহপ্রবেশ হয়ে গেল।

সন্ধেবেলা। দৈনিক আসরে শিবু অনুপস্থিত। রাত দশটা নাগাদ ফোন যায়।

কী হল শিবু। আজ যে বড়ো এলে না।

আর বলবেন না, কতকগুলো লাইটের শেড কিনতে এজরা স্ট্রিটে গিয়েছিলুম। ফেরার পথে মহামিছিল। তিনটি ঘন্টা বসে বসে বাড়িই ফিরেছি সাড়ে আটটা।

শেড কার? ঋতার বাড়ির?

আজ্ঞে।

এখনও শেষ হয়নি?

এই খুচখাচ।

দ্বিতীয় দিন উপস্থিত হন শিবপদ। আসরে আজ ভালো বোতল বেরিয়েছে। খাঁটি ভদকা। সঙ্গে বড়ো বড়ো চিংড়ি মাছ ভাজা, ব্যাটারে ডুবিয়ে বেশ মুচমুচ করে।

বাঃ মাছগুলো তো জববর।

ঋতা দিয়ে গেল খানিক আগে। প্রায়ই দিচ্ছে—উদাস গলায় বলেন ভুবনমোহন।

বারণ করি, শোনে না। তা দিক। দিতে যদি তার ভালো লাগে। ও… তোমার তো আবার চলবে না… অমৃতে অরুচি। মনেও ছাই থাকে না। ওরে অ রামহরি শিবুবাবুর জন্যে কী ভেজেছিস দিয়ে যা না।

কদিন বাদ দিয়ে শিবপদবাবু খুরখুর করে ঢুকছেন।

কী হল ছক পাডুন!

ভুবনমোহন মুখ গোঁজ করে বসে আছেন।

গোঁসা কেন? আরে এই নিন। আমি পাড়ছি। বলুন কী নেবেন? সাদা?

দ্যাখো শিবু ইচ্ছেমতো আসবে-যাবে ওভাবে গেমের কনাটিনুয়িটি থাকে না।

কী করব বলুন, একা মহিলা, একটা ভার নিয়েছি। না তো করতে পারি না।

 কেন? কী হল?

ওই আজকাল উঠেছে না। ফেং শুই।

সে আবার কী?

আর বলেন কেন? এদিকে বাস্তু শাস্ত্র, ওদিকে ফেং শুই। আজ মিস্তিরি ডেকে নর্থের দেয়াল থেকে সাউথ দেয়ালে আলমারি সরাই। পশ্চিমে নাকি বাথরুম চলবে না। আরে সারা বাড়িতে পশ্চিমে পর পর টয়লেট। তো কী করি, কোন ম্যাঙ্গো লেনের ঠিকানা, রিপন লেনের ঠিকানা, খুঁজে খুঁজে এক আলুওয়ালিয়া বাস্তু বিশেষজ্ঞ আর চ্যাং সায়েব ফেং শুই এক্সপার্ট এদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া, জিনিস কেনা, লাগানো, ক-দিন দাদা এই করেছি। বাড়ি যাবার সময় পাইনি।

বলো কী? মঙ্গলদীপেই ছিলে নাকি?

না, তা আর কী করে থাকি! ঘোষদস্তিদার হাসেন। সারাদিন মিস সেনকে নিয়ে ঘোরা…

খাওয়াদাওয়া কোথায় করলে?

চমৎকার চমৎকার মাদ্রাজি, গুজরাটি শাকাহারী রেস্তোরাঁ খুলেছে ওদিকে, চলুন একদিন আপনাকে নিয়ে যাব।

আমাকে নিয়ে কি আর শাকাহারী ভালো লাগবে শিব!

খোঁটা দিচ্ছেন! হঠাৎ কেমন খিচিয়ে ওঠেন শিবপদ। যেন ভেতর থেকে কে একটা কী একটা দাঁতে নখে বেরিয়ে আসতে চাইছে।–নিজে যখন মৌজ করে চিংড়ি ভাজা খান! শিব খ্যাঁক করে বলেন।

তুমি তু-তুমি… তো-তোমার এত বড়ো সাহস! ভুবনমোহন রেগে তোতলাতে থাকেন।

শিবপদ অবশ্য ক্ষমা চান। আবার আসর বসে। গেলাস চলে। দাবার ছক পড়ে। লুডোর কাটাকাটি হয়। কিন্তু আবার একদিন খিচিয়ে ওঠেন, না শিবপদ নয়, ভুবনমোহন। তিনিও অবশ্য ক্ষমা চান। এরপর বোতল খোলে, চাট আসে, দাবার দান পড়ে। কিন্তু আবার একদিন খিঁচ, এবার শিবপদ।

এইভাবেই একদিন দুই বুড়োর মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *