দুই আর দুয়ে চার
ভবেশবাবুর রকে সকাল বিকেল বুড়োদের আড্ডা। বড় রাস্তা পুব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। পুবে জরাজীর্ণ অবহেলিত হাসপাতাল, বাস রাস্তা। পশ্চিমে গঙ্গা। সাবেককালের বাঁধানো ঘাট। পরিত্যক্ত জেটি। দু-কদম আরও এগোতে পারলে শ্মশান। হুসহুস করে চিতার ধোঁয়া উঠছে তো উঠছেই আকাশে। ঘোঁত ঘোঁত করে শূকর ঘুরছে। একটা ছবি তোলার দোকান। আদ্যিকালের টি স্টল। মানুষের সময়ের সীমানা যেন এই অঞ্চল। ধোঁয়া হয়ে মানুষ এখানে আকাশের দিকে উঠে যায়।
সময়টা সকাল। রকের মালিক ভবেশবাবুর পরনে সাদা ড্রিলের ঝলঝলে প্যান্ট, গোলগলা ফতুয়া। মুখে সব সময়েই একটা চুরুট থাকে। কদাচিৎ সেই চুরুট ধোঁয়া ছাড়ে। সামান্য ব্রঙ্কাইটিস মতো আছে। মাঝে মাঝেই কাশি। মুখটা লম্বাটে। খাড়া নাক। নাকের তলায় ঝুলো গোঁফটাকে ঢেকে রেখেছে। এক সময় বনবিভাগে চাকরি করতেন। এখন বাঘের গল্প বলেন।
ইংরেজি কাগজের হাওয়া মেরে ভবেশবাবু রকে নিজের বসার মতো জায়গার ধুলো পরিষ্কার করে সকালটা একবার ভালো করে দেখে নিলেন। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রাস্তার উলটোদিকে একসার খোলার ঘর। একটা তেলেভাজার দোকান। সেই স্বাস্থ্যবতী কালো মেয়েছেলেটি বেসন ফেটাচ্ছে। কত্তা লুঙ্গি আর তেলচিটে গেঞ্জি পরে কড়ায় তেল ঢালছে। মহিলাটিকে দেখতে বেশ ভালোই লাগে। চটক আছে।
ভবেশ বসে কাগজটা মেলে ধরলেন। অ্যায় সেই এক খবর। এনসেফেলাইটস ডেথ টোল রাইজেস টু ফোরটিন। খুবই ভাবনার কথা। এদিকেও ভীষণ মশা হয়েছে। নতুন নতুন রোগের আমদানি হচ্ছে। ভবেশ ফ্যালফ্যাল করে খবরটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর তাকালেন দোকানের মহিলাটির দিকে। ঠোঁট দুটো একটু পুরু পুরু। নাকটা সামান্য ভোঁতা। তা হলেও মুখের সঙ্গে বেশ মানিয়ে গেছে। হাত দুটো বেশ গোল গোল।
সন্তোষ আসছে। ছড়ি ধরেছে। ফর শো। ব্যাটা গেজেটেড অফিসার ছিল। সিল, তকমা, চাপরাশি, এক সময় অনেক লেজুড় ছিল, এখন ছড়ি। গট গট করে হাঁটছে। পায়ে ক্যাম্বিশের জুতো। ধুতি, পাঞ্জাবি। ইউনিয়ান জ্যাক এখনও গায়ে লেগে আছে। মুখটা যেন টেগার্ট সাহেবের সেকেন্ড এডিশান। হোম ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতে-করতে রিটায়ার করেছে।
সন্তোষকুমার রকের সামনে এসে এমনভাবে থামলেন কেউ যেন হল্ট বলেছে। মার্চ করছিলেন, ঝপ করে থেমে পড়লেন। ছড়িটা পায়ের কাছে দুবার ঠুকলেন। ঘোড়ার পা ঠোকা। রকের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ালেন। শরীরটাকে ধীরে ধীরে ব্যাক করতে-করতে রকের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে সাবধানে বসলেন। পায়ের ফাঁকে ছড়ি। হাতলের ওপর দুটো হাত। পা দুটোকে ঝিনঝিন করে বেশ কিছুক্ষণ নাচিয়ে নিলেন। তারপর হঠাৎ জিগ্যেস করলেন,
‘এদিকে খেজুর রস পাওয়া যায়?’
‘খেজুর রস?’ ভবেশ অবাক হলেন হঠাৎ খেজুর রস?’
‘ভেরি গুড ফর কিডনি।’
‘কেন তোমার কিডনি ট্রাবল দিচ্ছে?’
‘দিতে পারে। দিস ইজ দি এজ।’
‘ও সব গ্রামের দিকে পাওয়া যায়। ডাবেরও সেম অ্যাকশান।’
‘ছুঁতে পারবে না। একটার দাম দেড় টাকা। আধ গেলাস জল। নট ফর এ রিটায়ার্ড পার্সন, ফর কালেয়ার্স।’
‘তা হলে প্লেন অ্যান্ড সিমপল চিনির জল।’
‘সুগার বেড়ে যাবে। এই হল সুগারের বয়েস!’
‘তোমার দেখছি ড্যাঙায় বাঘ জলে কুমির?’
‘শুধু আমার কেন তোমারও।’
‘আরে আমি একটা বাঘ মারা মানুষ। অত সহজে কাবু হব না।’
‘বাঘই মারো আর সিংহই মারো, শিয়রে শমন, ডেজ আর নাম্বারড।’ সন্তোষ দার্শনিকের মতো হাসতে লাগলেন। কাদের বাড়ির একটি বউ চলেছে সেজেগুজে। ফিকে হলুদ শাড়ির আঁচল উড়ছে। দুজনেরই কথা বন্ধ হয়ে গেল। দু জোড়া চোখ ডান দিক থেকে বাঁদিকে ঘুরতে লাগল, মহিলা বাসরাস্তার দিকে চলেছেন। উঁচু জুতো, খাটো ব্লাউজ, টানটান শাড়ি। সন্তোষ জিগ্যেস করলেন,
‘কাদের বাড়ির বউ? বেশ স্মার্ট?’
‘মনে হয় আমাদের গণেশের বড় ছেলের বউ।’
‘ও সেই লাভ অ্যাফেয়ার্স। গণেশ আজকাল বড় একটা আসে না।’
‘সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বোধহয়।’
‘ওর আবার সংসার কী?’
‘এই পুত্র, পুত্রবধূ, গিন্নির বাত, অম্বল, নিজের ডায়াবিটিস।’
‘ওই শেষেরটা ধরো, বাকি সবকটা ছেড়ে দাও।’
‘না হে না পুত্রবধূ নাকি খুব বাবা বাবা করছে। বেয়াই আবার ডাক্তার। বেয়াই উঠে পড়ে চিকিৎসা করছে।’
‘ছেলে তো পাইলট।’
‘পাইলট নয় রেডিও অফিসার। মোটা মাইনে।’
দূরে নড়বড় নড়বড় করতে-করতে জগদীশবাবু আসছেন। মুখে খিলি চারেক পান জর্দা দিয়ে ঠাসা। পেশায় উকিল। বসে গেলেই হয়। অভ্যাসে চালিয়ে যাচ্ছেন। তেমন মক্কেল নেই তবু কোর্টে যাওয়া আসা। সিভিল লাইনটা বোঝেন ভালো। জগদীশ এসেই বললেন ‘দেশটা উচ্ছন্নে গেল। আজকের কাগজ দেখেছ। ব্রড ডেলাইটে ছেনতাই। তোমার হোম ডিপার্টমেন্ট ডিফাঙ্কট হয়ে গেছে।’
মুখে পান। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। পান ছিটকোচ্ছে। দাঁড়িয়েছেন সন্তোষের সামনে। তিনি ভবেশের কাগজ দিয়ে পানের ছিটে বাঁচাবার চেষ্টা করতে-করতে বললনে,
‘সাত সকালেই মুখে পান পুরেছ কেন?’
‘হ্যাবিট।’
‘ব্যাড হ্যাবিট। দাঁতগুলো তো সব গেছে।’
‘হ্যা হ্যা এখনও মাংস চিবোই। কীসের জোরে জানো, এ চিউইং টোব্যাকোর জোরে।’
‘এই অসময়ে কে তোমাকে পান সেজে দেয়?’
জগদীশ বসতে-বসতে বললেন, ‘কে আবার, আমার ইস্ত্রী, ফুলশয্যার রাত থেকে তাকেও তো ধরিয়েছি। তিনি এখন আমার ওপর যান। খল দাঁত বের করে তোবড়া গালে যখন হাসে না মাইরি মনে হয় সাক্ষাৎ তাড়কা রাক্ষুসী।’
হুস করে ধুলো উড়িয়ে একটা গাড়ি বেরিয়ে গেল। ভবেশ আর সন্তোষ নাকে চাপা দিলেন। জগদীশের ভ্রূক্ষেপ নেই। ভবেশ বললেন, ‘লাট সাহেব গেল।’
জগদীশ চটে গেলেন, ‘লাট সায়েব বলছ কেন?’
‘কেন বলব না? ও তোমার প্রফেশানের লোক বলে গায়ে চড়াক করে লেগে গেল। ওরকম ব্যারিস্টার কলকাতাটাকে ধরে ঝাঁকালে ছারপোকার মতো টপাটপ পড়বে। অত অহঙ্কার কীসের। পাড়ার রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে যেতে পারে না? ভুউস করে যেতে হবে কেন?’
‘এ তোমার হিংসের কথা ভবেশ। গাড়ি গাড়ির মতোই যাবে। গাড়িটা আবার নতুন।’
‘মক্কেল মারা পয়সা।’
‘একটা মক্কেল ধরা আর মারার মেহনত জানলে ওকথা বলতে না। মি লর্ড মি লর্ড করে আমি শালা ফোকলা হয়ে গেলুম।’
‘তুমি তো হবেই। দেশ থেকে জমিদারি উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তোমার সিভিল সাইড কানা হয়ে গেছে। বাপ ঠাকুরদা নেহাৎ কিছু প্রপার্টি রেখে গিয়েছিলেন বলে এখনও পান মুখে দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছ।
‘একে বলে পার্সোনাল অ্যাটাক।’
সন্তোষ দুজনকে থামিয়ে দিলেন, ‘আহা চুপ করো না বাপু। কে একজন গাড়ি হাঁকিয়ে গেল তোমরা দুজনে ঝগড়া করে মরছ।’
জগদীশ চ্যাকর চ্যাকর করে মুখের পান চিবিয়ে একটা ঢোঁক গিলে বললেন, ‘তুমি আর মধ্যস্থতা করতে এসো না, তোমার কথা বলার মুখ নেই। তোমার হোম ডিপার্টমেন্ট ইওর হোম, ওয়ার্থলেস। রোজ দশটা করে খুন গোটা বারো করে ডাকাতি। শ’খানেক ছিনতাই। রেপ, মার্ডার, ডেকয়েটি। পুলিশ নিস্ক্রিয়। কাল আমাদের পাড়ায় কী হয়েছে জানো? ডু ইউ নো?’
‘আমাকে বলছ কেন? আমি আজ সাত বছর রিটায়ার করে বসে আছি। নিজের হোমই সামলাতে পারছি না দেশের হোম। কাল আবার কী হল।’
‘কেলোর কীর্তি। নিধুর মেয়ের বিয়ে ছিল জানো?’
‘কোন নিধু?’
‘আরে আমাদের স্যাকরা নিধু। সেই নিধুর বাড়িতে রাত আটটার সময় গান পয়েন্টে ডাকাতি হয়ে গেল। একেবারে সর্বস্বান্ত। নান টু প্রাোটেকট। এটা দেশ না মগের মুল্লুক। কে উত্তর দেবে?’
‘ভালো হয়েছে, উৎপাতের ধন চিৎপাতে গেছে। সারা জীবনে কম সোনা মেরেছে। এক একবার এক একটা ডিজাইন ওঠে আর আমার বউ দৌড়োয়। পুরোনো গয়না ভেঙে নতুন করাতে। এই করে আমার বিশ ভরি এখন পনেরোয় এসে ঠেকেছে।’
‘শুনলে, শুনলে তোমরা সন্তোষের কথা! কেমন কায়দা করে শুনিয়ে দিলে ঘরে কত সোনা আছে। তোমার ঘরে কত আছে হে ভবেশ?’
‘আমার সব লকারে। এই বাজারে বাড়িতে কেউ সোনা কি হার্ড ক্যাশ রাখে?’
‘আহা সেই লকারেই কত আছে বলো না।’
‘জানি না ভাই, ওসব হল গিয়ে মেয়েদের ব্যাপার।’
‘হুঁ চেপে গেলে। তোমার অনেক আছে। এক এক ছেলের বিয়ে দিয়েছ আর ভরি ভরি লকারে পুরেছ। ছেলে হল ক্যাশ সার্টিফিকেট। ভাঙাও আর খাও।’
‘কত টাকা পেনসান পাই জানো! জানলে আর ও কথা বলতে না। আমি এখনও স্বাবলম্বী। ছেলে ভাঙিয়ে আমাকে কোনও দিনই খেতে হবে না। গডস প্রেস।’ ভবেশ, ঠোঁটে নেবা চুরুট লাগিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দূরে একটি মেয়ে আসছে। পরনে আধময়লা ফ্রক। হাতে একটা তেলের টিন। মেয়েটি রকের দিকেই আসছে। জগদীশ হেঁকে বললেন, কী রে মনা, তেলের টিন নিয়ে কোথায় চললি?’
‘আপনার কাছেই। পয়সা দিন। মা বললেন, এক কেজি সরষের তেল, ভেলি গুড় আর তেজপাতা আনতে।’
‘সে কি রে, এর মধ্যেই তেল ফুরিয়ে বসে আছে। তোর মার উচিত ছিল একটা তেলকলওয়ালাকে বিয়ে করা। সরষের তেলের দাম জানিস?’
মেয়েটির মুখের ভাবের কোনও পরিবর্তন হল না। জগদীশের সংসারে তেল চাই। মা বলে দিয়েছে। সে হুকুম তামিল করতে এসেছে। তার অতসব জানার কী দরকার। সন্তোষ একটু মুচকি হেসে বললেন,
‘তাই তো করেছে হে। তেলকলওয়ালা আর উকিলে তফাত কতটুকু—একজন সরষে পেষে আর একজন মক্কেল। দুটোই তৈলাক্ত জিনিস।’
জগদীশ ঘাড় ঘুরিয়ে সন্তোষকে আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, ‘তুলানাটা ঠিক সরকারি চাকরের মতোই হল। সরষে গাছে ফলে, মক্কেল গাছে ফলে না যে নাড়া দিলেই পড়বে। আর কি বলো, সারাজীবন বাকতাললা মেরেই কাটিয়ে দিলে।’
ভবেশ বললেন, ‘টাকা দিয়ে মেয়েটাকে ছেড়ে দাও না, শুধু শুধু বেচারাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছ কন?’
জগদীশ মেয়েটিকে বললেন, ‘তুই টিনটা আমাকে দিয়ে বাড়ি চলে যা। মাকে বলিস, আমি গিয়ে তেল দোব।’
মেয়েটি ইতস্তত করে বললে, ‘এখুনি লাগবে যে! আজ জামাইবাবু আসবেন। তেল গেলে তবে রান্না হবে।’
মেয়েটি যে দিক থেকে এসেছিল সেই দিকেই ফিরে গেল। জগদীশ বললেন, ‘ওই জন্যেই মেয়েদের বাপের বাড়ি আনতে নেই। আজকালকার জামাইগুলো এত ন্যাওটা হয়ে পড়ে, বউ ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারে না। ঘন ঘন আসছে। এই আসছে এই যাচ্ছে যেন রেলগাড়ির পিশটন। অন্য সময় শ্বশুর ব্যাটাকে মনে পড়ে না।’
সন্তোষ বললেন, এখন কেন, পুরাকালেও তাই ছিল। তোমার কথাই ভাবো না, বউ ছাড়া তুমি কদিন থাকতে পেরেছ!’
‘তুমিও ভাবো। তুমি এখন যা দেখাচ্ছ তার তো কোনও তুলনা নেই। দাঁত তোলাতে যাবে তোমার বউ ল্যাংবোট। প্রেসার মাপাতে যাবে বউ ল্যাংবোট। তুমি আর দয়া করে প্যাকোর প্যাকোর কোরো না। পিরিতি কাঁঠালের আটা।’
‘খুব বললে যা হোক। বুড়ো বয়েসে বউই তো অন্ধের যষ্ঠি, অন্ধের নাড়ি। দুটো চোখেই ক্যাটারাকট ফর্ম করে বসে আছে, হাই ব্লাড সুগার, বুড়ি সাহস করে একা ছাড়ে কোনও সাহসে! মরলে যে বেধবা হবে।’
ভবেশ কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘ও হে তোমার তেল, জামাই আসবে, ভালো মন্দ রান্না হবে। কর্তব্য কর্মটি সেরে এসো।’
জগদীশের হুঁস হল। পকেটে একটি নয়া পয়সা নেই। তেমন মক্কেলও নেই যে মেরে খাবেন। কেসপাতি এখন ভয়ানক কমে গেছে। শামলার রং দেখে উকিলের পসার বোঝা যায়। আজকাল সব ইয়াং প্র্যাকটিশনার জুটেছে। বেশিরভাগই বড়লোকের আইবুড়ো ছেলে। ভালো ভালো সিনিয়ারের আন্ডারে কাজ করে পাকাপোক্ত হচ্ছে। পেশায় মহিলারাও এসেছে। জাঁদরেল জাঁদরেল সব চেহারা। কারুর কারুর ঠোঁটের ওপর আবার সরু গোঁফের রেখা। হি ওম্যানের দল। বুড়ো জগদীশকে ঠেলা মারতে-মারতে বটতলার উকিল বানিয়ে দিয়েছে। দু টাকা ফি-এর এফিডেবিটের উকিল। রাস্তার মোড়ের শনিঠাকুরের পূজারি বামুনের স্ট্যাটাস।
যাই নগেনের দোকানে যাই। ব্যাটার কাছে দেনায় মাথা বিকিয়ে আছে। খাতায় লিখিয়ে লিখিয়ে আর কত জিনিস নেওয়া যায়। চারশো টাকা পাওনা হলে পঞ্চাশ ঠেকাই। বেজার মুখ করে নেয়। সাহস করে কিছু বলতে পারে না। যতই হোক বাপের আমলের বাঁধা খদ্দের। আহা একসময় তো আর এ অবস্থা ছিল না। বাড়িতে জুড়িগাড়ি ছিল। বৈঠকখানায় ঝাড়লণ্ঠন ছিল। টিন টিন মটকির ঘি যেত নগেনের বাপের দোকান থেকে। দোল দুর্গোৎসব হত। এখন সব ফিউজ হয়ে গেছে।
জগদীশ যখন রাস্তায় হাঁটেন দেখলেই মনে হয় আত্মভোলা মানুষ। এমন মানুষকে দিয়ে আইন ব্যাবসা হয় না। অথচ আইন খুব ভালোই জানেন। মুখে সবসময় পান থাক বলে এজলাসে কথা জড়িয়ে যায়। ফট করে একদিন মারা গেলে বড় ছেলেটা ভীষণ বিপদে পড়বে। দুটি ছেলে। এখন একটিতে এসে ঠেকেছে। মেজটার হঠাৎ যে কী হল, দুম করে সুইসাইড করে বসল। রাতে খাওয়াদাওয়া করে শুল, সকালে আর নেই, ফিনিশ। একবার ঘুণাক্ষরে কাউকে জানতেই দিলে না দু:খটা কী? আসলে ওই চাকরি-বাকরি না পাওয়ার দু:খ। দিনের পর দিন বেকার বসে থাকার দু:খ। এতদিনে কোথাও নিশ্চয়ই আবার জন্মেছিস। যেখানেই জন্মাস পশ্চিমবাংলায় আর জন্মাসনি। জন্মালেও বাঙালির ঘরে নয়। আবার আত্মহত্যা করতে হবে কিংবা বেঁচে মরে থাকতে হবে, ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। মাড়োয়ারি কিংবা গুজরাতি হোস।
বিধু আসছে, বিধু। বিধুর কোলে একটি টুকটুকে শিশু। জগদীশ জিগ্যেস করলেন, ‘এটি কে হে!’ ‘আর বলো কেন, এটি হল সুদের সুদ আমার নাতি। তা তুমি আড্ডা ছেড়ে চললে কোথায় টিন হাতে ঢ্যাং ঢ্যাং করে।’
‘আর বলো কেন, লোহারি বাঁধনে বেঁধেছে সাংসার। চলেছি সংসার। এতক্ষণ আড্ডাতেই ছিলুম। আসছি আবার—তুমি যাও।’
শিশুটি একটা হাত বাড়িয়ে বিধুর কোল থেকে জগদীশের দিকে ঝুঁলে পড়ে ত্যা, ত্যা করে উঠল। ফোকলা ভাবলা মুখ বেয়ে নাল পড়ছে। গলার কাছে বাঁধা ছোট বোতলে রুমালটা ভিজে উঠছে।’
জগদীশ বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ত্যা ত্যা।’
শিশুর হাত শূন্যে একটা খাবলা মেরে মুঠোয় খানিকটা হাওয়া ধরে আনল। আসলে জগদীশের গালে একটা খাবলা মারার ইচ্ছে ছিল; কিন্তু নাগালের বাইরে। মুখে একটা শব্দ করল আম। ওপরের ঠোঁটে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছে। কী রকম দুষ্টু দুষ্টু দেখাচ্ছে।
বিধু রকের দিকে চললেন। জগদীশ চললেন দোকানের দিকে। জগদীশের কানে ভেসে আসছে ত্যা ত্যা শব্দ। গান ধরেছে খোকা। আজকাল কানে একটা গান ভেসে আসে, ফুলের বনে গান ধরেছে ভিনদেশি এক ময়না।
আমারও একটা হবে। ছেলের নয় মেয়ের। আমারও তো সুদের সুদ। তবে নাতি হবে কি নাতনি হবে ঈশ্বরই জানেন। মনে হয় নাতিই হবে। মেয়েটার শরীরটা একটু শুকনো শুকনো হয়ে গেছে। নিজের বেলায় দেখেছি তো। ছেলে এলে মায়ের রস টানতে থাকে। সেদিন শেষ রাতে স্বপ্নও দেখলুম, মেজ ছেলে মায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, স্বপ্নেই চমকে উঠলুম, কী রে তুই! সে বললে, আমি আবার আসছি বাবা। ছাঁত করে ঘুমটা ভেঙে গেল। এই আসা কি সেই আসা। আবার নতুন করে শুরু করতে আসছিস! গত জীবনের ভুলভ্রান্তি সব মানে থাকবে তো! মাঝপথে আবার রণে ভঙ্গ দিয়ে চলে যাবি না তো!
জগদীশের মনটা খুব নরম হয়ে এল হঠাৎ। তেল, গুড়, কয়লা, খরচ সব হিসেব ভুল হয়ে গেল। চলুক চলুক এই ভাবেই চলুক। ছেঁড়া চটি টেনে টেনে। ইংরেজিতে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন জগদীশ। মনে মনে আওড়ালেন, ওলড অর্ডার চেঞ্জেথ ইলডিং প্লেস টু নিউ।
বিধু রকের আড্ডায় এসে প্রথমেই যে কথাটি বললেন তা হল, ‘বুঝলে চারদিকে ভীষণ হাম হচ্ছে।’
সন্তোষ অবাক হয়ে বললেন, ‘হাম হচ্ছে তো আমাদের কী! এই বয়সে আমাদেরও হাম হবে না কি!’
‘আরে বাবা, আমাদের হবে কেন? আমাদের হলে হামের বাবা হবে। বাচ্চাগুলোকে সামলাও।’
বিধু কোলের শিশুটি বারেবারেই বিধুর নাক খামচে ধরছে কচি কচি হাতে। মুখে সেই ত্যা ত্যা গান।
ভবেশ বললেন, ‘তুমি একে নিয়ে এলে! বসতে দেবে কি?’ ভবেশ ছেলেমেয়ে পছন্দ করেন না। বাঘমারা সংসারবিমুখ মানুষ।
বিধু বসতে-বসতে বলনেল, ‘জাস্ট এ ভ্যারাইটি। একও বলতে পারো। আমাদের সেকেন্ড চাইল্ডহুড আর এর হল ফার্স্ট চাইল্ড হুড। সিমপটমস দুয়েরই সমান।’
‘হিসিফিসি করিয়ে এনেছ?’
‘মা একবার করিয়ে দিয়েছে। তবে বিশ্বাস নেই। এদের তো ঘন ঘন ব্যাপার।’
‘তুমি বাপু আর একবার না হয় করিয়ে নিয়ে বসো। এখুনি রকে ছেড়ে দেবে লয়া বয়া।’
‘শিশুর পেচ্ছাপ গঙ্গাজল। তোমার বুঝি ঘেন্না করে? কিন্তু ভুলে যেও না ফ্রেন্ড, বুড়োদের প্রসটেট হলে কী হয় জানল তো? নলের মুখে প্লাসটিক ব্যাগ গেই ব্যাগে সারাদিন টিপুর টিপুর। নিজ হাতে ফ্যালো আবার ফিট করো। ফ্যালো আবার ফিট করো।’
‘এ তুমি কী বললে? নিজের জিনিস আর পরের জিনিস। নিজের জিনিসে ঘেন্না কীসের? সে তো শিবাম্বু।’
ভবেশ কথা বলতে-বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন। শিশুটি তাক করেই ছিল। খপাত করে মুখের চুরুটটা কেড়ে নিল। নেভা চুরুট, আগুনের ভয় নেই তবে তামাকের ভয় আছে। শিশুদের মজাই হল সব জিনিস মুখে। একটু টেস্ট করে দেখা চাই। বিধু ভবেশ দুজনেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন। ছোট্ট মুঠোয় পোড়া সিগার। হাতটা প্রায় মুখের কাছাকাছি। বিধু যতই চেষ্টা করেন ছাড়িয়ে নেওয়ার ছেলেটি ততই চিৎকার করতে থাকে। বিধু নিরুপায় হয়ে বললেন, ‘লাল মতো একটা কিছু দাও না হে, চশমার খাপটাপ, তা না হলে তো ছাড়ানো যাবে না।’
সন্তোষ বললেন, ‘লাল মতো কি পাই বলোতো। এই খবরের কাগজটা এই নাও দাদু, এই নাও।’ বিধু চুরুটটা অবশেষে কেড়ে নিতে পেরেছেন। নিলে কী হবে, ছেলে এদিকে হারানো জিনিসের রাগে বিধুর বুকে ঠিকরে ঠিকরে কাঁদছে। ভবেশ বললেন, উ:, কানের পোকা বের করে দিলে। মানুষের এই ফেজটা বড় বিশ্রী। বিধু তুমি কিন্তু সাবধান হও, এইবার হিসি করার চানস। খেপে বোম হয়ে আছে।
‘তোমার দেখছি হিসি আতঙ্ক হয়ে গেছে। করলে আমার কাপড়ে আগে করবে, সোক করে নেবে তোমার রকে কোনওরকম নুইসেনস হবে না।’
‘ওদের পেচ্ছাপে অ্যাসিড থাকে তা জানো কি?’
‘না ভাই অ্যানালিসিস করে দেখিনি কোনওদিন।’
‘হ্যাঁ থাকে। যেখানে পড়বে দাগ হয়ে যাবে। আজকাল সেন্ট পারসেন্ট মায়েদের অম্বলের রোগ। খবরটা জানো কি?’
‘অম্বল তো আমাদেরও হয়।’
‘আমরা তো আর কারুর রকে করছি না। হাইপারই হোক আর হাইপোই হোক এসে যায় না কিছু।’
বিধুর নাতি তখনও সমানে কেঁদে চলেছে। কিছুতেই সিগার হারাবার শোক ভুলতে পারছে না। গোল গোল দুটো পা কোলের ওপর আছড়াচ্ছে। সন্তোষ একটা পায়ের তলায় কুড়ুকুড়ু করে একটু সুড়সুড়ি দিলেন। ফলটা তেমন ভালো হল না। কান্নার দমক আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ মনে হল হাতের ছড়িটা তুলে দেখালে কেমন হয়। না বাবা শেষে ছড়িটাই হয়তো হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু এই কান্নাটা না থামলে আর তো বসা যায় না। সন্তোষ বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘সামলাতেই যখন পারবে না তখন একে ট্যাঁকে করে আসলে কেন?’
‘দাদু হও তারপর বুঝবে।’
‘বন্ধুদের বিরক্তি দেখে বিধু উঠে দাঁড়ালেন। একটু চলে বেড়ালে হয়তো থেমে যাবে। তিনি ক্রমান্বয়ে বলতে লাগলেন, ‘ওই দ্যাখো পাখি। গউ দ্যাখো গউ। কুকু। গাই, গাইই।’
জগদীশ ইতিমধ্যে তেল ম্যানেজ করে ফেলেছেন। নগেনের মুখে একটু রাগ রাগ ভাব। একটু আগেই জগদীশকে অযাচিত উপদেশ দিয়েছে। জ্যাঠামশাই খরচটা এবার একটু টানুন। হু হু করে বেড়েই চলেছে। আমার কি। শোধ তো আপনাকেই করতে হবে।
খুব সত্যি কথা। ভাববারাই কথা। কিন্তু কী করবেন। এইভাবে জোড়াতালি দিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। বড় ছেলেটা কিছুই তেমন সুবিধে করতে পারছে না। এল, এল, বি করে চুপচাপ বসে আছে। তেমন চালাক চতুর নয়। বড়ই ভালো মানুষ। আজকালকার সেয়ানাদের যুগে একেবারেই অচল। দোকানের একটা জারে কাগজে মোড়া মোড়া ললিপপ রয়েছে। জগদীশের চোখে পড়ল। বিধুর নাতিকে একটা প্রেজেন্ট করলে কেমন হয়। ফোকলা মুখে চুষে চুষে খাবে।
‘ললিপপ কত করে?’
নগেন অবাক হয়ে তাকাল ‘ললিপপ কী করবে?’
‘দাম বলো না।’
‘পঁচিশ পয়সা।’
যাক বাবা নগদ পঁচিশটা পয়সাই পকেটে আছে। জগদীশ একটা কিনে ফেললেন। বিধুর নাতি আমারও নাতি। দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলেন। অমূল্যর বড় মেয়ে একপাশ দিয়ে চলেছে। বুকের কাছে গোটাকতক ওষুধের শিশি। জগদীশ থমকে দাঁড়ালেন। অমূল্যর অসুখ। অনেকদিন রকে আসছে না। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। জগদীশ জিগ্যেস করলেন,
‘রেবা, বাবা কেমন আছে রে!’
শীর্ণ মুখ। কপালের ওপর চুলের গুছি ঝুলছে। ফরসা ডান গালে একটা কালো তিল। রেবা থমকে দাঁড়াল। মুখটা খুবই বিষণ্ণ। পোশাকের তেমন চটক নেই। দারিদ্র্যের হালকা হাতের অস্পষ্ট ছাপ। পায়ের চটি জোড়া ক্ষয়ে এসেছে। তবু রেবা হাসল। রেবার এই হাসিটির সঙ্গে জগদীশের দীর্ঘদিনের পরিচয়। শত দু:খেও হাসি যায় না। চোখের কোনে জল চিকচিক, ঠোঁটের কোণে হাসি। রোদ বৃষ্টির মতো। রেবা বললে,
‘তেমন ভালো নয় কাকাবাবু।’
দুজনে পাশাপাশে একই দিকে হাঁটতে লাগলেন। চলতে-চলতে জগদীশ বললেন,
‘একটুও উন্নতি নেই?’
‘উন্নতির চেয়ে অবনতিই বেশি। পেটে কিছুই আর সহ্য হচ্ছে না। বিছানায় শুলেই হাঁপানির টান। সারারাত পিঠে বালিশ দিয়ে ঠায় বসে থাকা।’
দুজনেই রকের কাছে এসে পড়েছেন। বিধু নাতি-কোলে পায়চারি করছেন। কান্নাটা একটু ভুলেছে। আপেলের মতো লাল গালে চোখের জলের দাগ। বিধুর কাঁধে মুখ রেখে আপন মনে ডান হাতের বুড়ো আঙুল চুষছে। সন্তোষ বাতাসে ছড়ি এঁকে এঁকে ভবেশকে কিছু বোঝাচ্ছেন। ভবেশের সেদিকে তেমন মন নেই। তিনি তাকিয়ে আছেন তেলেভাজার দোকানের দিকে। মেয়েছেলেটি উবু হয়ে বসে আছে। আধময়লা ডুরে শাড়ি পাছায় টানটান হয়ে আছে।
জগদীশ পকেট থেকে ললিপপটা বের করে এক হাতে কাঠি ধরে রেবার সামনে তুলে বললেন, ‘কাগজটা ছাড়িয়ে দাও তা।’ লাল টুকটুকে ললিপপ। জগদীশ বিধুর পেছনে দাঁড়িয়ে তার নাতির চোখের সামনে নাচাতে-নাচাতে বললেন, ‘এটা কে নেবে? এটা কে নেবে!’
একটা কচি হাত বিধুর পিঠের দিকে বেরিয়ে এল। ঠোঁটে ঠোঁট চাপা চাঁদের মতো একটা মুখ। গাল দুটো লাল। মসৃণ। কপালে গোল কাগজের টিপ একটু ছেতরে গেছে। জগদীশের গলা শুনে বিধু ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘কী দিচ্ছ!’
‘ললিপপ।’
‘মিষ্টি! দিও না, দিও না, ক্রিমি হবে। ইস লাল খুনখারাপি রং। জগদীশ একটু থতোমতো খেয়ে গেলেন। শিশু এবার একটা হাত বাড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তখনও জিনিসটা নাগালের মধ্যে আসেনি। জগদীশ বললেন,
‘মিষ্টি তো কী হয়েছে? এই বয়সে মিষ্টি না খেলে হাত পা ছোঁড়ার এনার্জি পাবে কোথা থেকে। আর রঙের কথা বলছ, লাল রঙই তো ওদের প্রিয়।’
জগদীশ ললিপপটা বিধুর নাতির হাতে ধরিয়ে দিলেন। বিধু আর একবার খুঁত খুঁত করে উঠলেন, ‘ওর মা না আবার রেগে যায়! মর্ডান মা। তাদের হালচালই আলাদা। বলে সরষের তেল গায়ে মাখলে স্কিন ডিজিজ হবে। আটচল্লিশ টাকা দামের বিলিতি অলিভ অয়েল এসেছে। দুধ খাওয়াবার আগে সব স্টেরিলাইজ করে নেয়।’
জগদীশের মনে হল স্তনবৃন্তটাও কি স্টেরিলাইজ করে নেয়। বিধুর এক পুরুষে বড় লোক। ইদানীং খুব ফুটুর ফুটুর করে। মাঝে মাঝে বেয়াইয়ের গাড়ি চেপে বেড়াতে টেড়াতে যায়। ছাত্রজীবনের বন্ধুরা জীবনের পথে চলতে-চলতে কী রকম সব পালটে গেছে। বহু বহু কাল আগে এই রকে বসেই ডেভিড কপারফিলডের আলোচনা হত। তখন কেউ বড়লোকের ছেলে কেউ গরিবের ছেলে। পার্থক্যটা এখন বোঝা যায় তখন তেমন বোঝা যেত না। আজ ঘুরতি চাকায় সব ওলটপালট হয়ে গেছে।
সন্তোষ বললেন, ‘যাও না বাড়ি গিয়ে মাল খালাস করে এসো না। মেয়েটাকেই বা শুধু শুধু দাঁড় করিয়ে রেখেছ কেন? এই তোর বাবা কেমন আছে রে?’
রেবা একটু দূরে উদাস মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। দু-পা সরে এসে বললে, ‘ভালো না।’
‘ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট হচ্ছে তো?’
‘ওই যেমন হয়।’
জগদীশ চলতে-চলতে বললেন, ‘আয় মা, চলে আয়।’
রেবাকে মা বলে জগদীশ বেশ তৃপ্তি পেলেন। এখন যা বয়স সব মেয়েকেই মা বলতে ইচ্ছে করে। তবে ওই তেলেভাজার দোকানের মেয়েছেলেটি! ও মা নয় মেয়েছেলে। দেখলেই শরীরটা কেমন করে ওঠে। মা দুটো আলুর চপ দাও তো! না, মুখ দিয়ে বেরোবে না। হ্যাঁ হ্যাঁ গরম আলুর চপ আছে? হ্যাঁ, এই ঠিক।
জগদীশের বাড়ি আগে। বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁক নিলেই রঙচটা হলদে বাড়ি। গলিতে ঢোকার আগে রেবাকে বললেন, ‘বাবাকে বলিস আমরা আসব।’
রেবা ঘাড় নেড়ে আচ্ছা বলে চলে গেল। জগদীশের মনে পড়ে গেল অনেক কাল আগের কথা। দোলের দিন। সবাই রং মেখে ভূত হয়ে রাস্তায় ঘুরছে। রেবা তখন ছোট্ট মেয়ে। বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে আছে।
‘বাবাকে বলো আমরা আসছি।’ অমূল্য সদর বন্ধ করে বসেছিল। শেষে ভবেশ পাইপ বেয়ে অমূল্যদের একতলার ছাদে উঠে নীচে নেমে সদর খুলে দিয়েছিল। অমূল্য তখন সবে বিয়ে করেছে। সে আসা আর এই আসা। এক খেলতে আসা, আর এক বিদায়ী মানুষকে দেখতে আসা। মন বলছে, অমূল্য আর বেশিদিন থাকবে না। হয়ে এসেছে। তেল ফুরিয়ে এসেছে। জীবনের দীপ নিবু নিবু।
জগদীশ ভেবেছিল বাড়ি ঢুকে রান্নাঘরের সামনে মালপত্তর নামিয়ে সংসারের খরচাপত্তর নিয়ে বউকে খুব শাসাবে কিন্তু মনটা কেমন উদাস হয়ে উঠেছে? কী হবে খেচাখেচি করে। আর ক’টা দিনই বা সংসারে আছে? একে একে উইকেট পড়তে শুরু করেছে। মৃত্যুর হাতে ফাস্ট বল।
‘এই নাও হে তোমার মালমশলা খাওয়াও তোমার জামাইকে।’
জগদীশের স্ত্রী সামনে ঝুঁকে পড়ে ডালে কাঠি দিচ্ছিলেন। বাড়িতে ব্লাউজ টলাউজ আর পরে থাকার প্রয়োজন বোধ করেন না। স্ত্রীর দেহের দিকে তাকিয়ে জগদীশের ভুলে যাওয়া একটা কবিতার লাইন তালগোল পাকিয়ে মাথায় এল। কবিতাটা বোধহয় কোনও ঝড়ে বিধ্বস্ত জাহাজকে লক্ষ্য করে লেখা, মাস্তুল তার ভেঙে পড়ে গেছে, দড়িদড়া গেছে ঝুলে। স্ত্রী উত্তর দিলেন।
‘জামাই আমার একলার নয় তোমারও।’
‘আমি ধরে এনেছিলুম, তুমি আদর দিয়ে বাবাজীবনের বারোটা বাজাচ্ছ!’
‘বারোটা বাজাচ্ছি? কীরকম?’
‘তোমার রূপ না থাকলেও রান্নার হাতটাত মারাত্মক। ওই রান্না বারে বারে খেলে রাঁধুনির প্রেমে পড়ে যাবে।’
‘দ্যাখো মুখ সামলে। অসভ্যতা কোরো না। তোমার তো অসভ্যতা করার বয়েস নেই। একসময় আমারও রূপ ছিল। ভুলে যেও না। তোমার পাল্লায় পড়ে আমার আজ এই অবস্থা। বেইমান। মনে নেই বাবা তোমাকে ঠাট্টা করে কী বলতেন, ব্যাটা আমার বিল্বমঙ্গল।’
‘এই মুহূর্তে বিল্বমঙ্গল হলে মন্দ হত না। বিল্বমঙ্গল অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তোমার এই ঝালরের মতো রূপ আর দেখতে হত না?’
‘তুমি এখান থেকে যাবে কি না। না খুন্তির ছ্যাঁকা লাগাব।’
‘তুমি একটা জামা পরবে কি না।’
‘সে আমি বুঝব, আমার ব্যাপার।’
জগদীশ চলে আসছিলেন।
‘শুনে যাও। হাত পাতো।’
জগদীশ হাত পেতে পেট মোটা একটা পটলের দোরমা নিলেন।
‘খেয়ে বলো পুরটা ঠিক জমেছে কি না।’
‘বেড়ে হয়েছে। ফাসক্লাশ।’
‘যাও এবার বেরোও।’
‘একটু চা।’
আর কিচ্ছু হবে না। তুমি দেখি খেতে পেলে শুতে চাও।’
‘সংসারের তাই তো নিয়ম। ভুলে যেও না একসময় আমিও জামাই ছিলুম। একটা বাড়িতে আমারও খুব আদর ছিল। এখনও আর একবার পিঁড়েতে বসতে পারি।’
‘তা পারো, তবে আমাকেই পাত্রী হয়ে আবার সাত পাকে ঘুরতে হবে।’
জগদীশ গুটি গুটি আবার রকে ফিরে গেলেন। যাওয়ার তো মাত্র দুটোই জায়গা। হয় এই রক না হয় এজলাশ। বিধুর নাতি ইতিমধ্যে বেশ জমিয়ে বসেছে। সারা রকে খুব হামা দিয়ে বেড়াচ্ছে। পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। বুড়োরা ব্যুহ তৈরি করে বসে আছেন। মাথায় মাথায় পাকা চুল। তোবড়া তোবড়া গাল। চুল-ফাটা খসখসে চামড়া তার মাঝে নিটোল একটি শিশু। আপেলের মতো গাল। মার্বেলের মতো চোখ। করমচার মতো ঠোঁট।
সন্তোষ হঠাৎ আবিষ্কার করলেন শিশুটির পায়ের সৌন্দর্য, ‘পা দুটো দেখেছে। তোমরা এর পায়ের গোড়ালি দুটো দেখেছ। যেন প্লাস্টিকের বেলুনে ভরা।’
সকলেই ঝুঁকে পড়ে গোড়ালি দুটো এগজামিন করলেন, ‘হ্যাঁ, তাই ত, তাই তো।’
ভবেশ চটি থেকে পা খুলে হাঁটুর ওপর তুলে নিজের গোড়ালিটা দেখতে-দেখতে বললেন,
‘প্রসেস শুরু হয়ে গেছে।’
‘কী প্রসেস হে!’
‘প্রসেস অফ ডিকে। মৃত্যু ধীরে ধীরে পায়ের গোড়ালি থেকে ওপর দিকে উঠে আসছে। আর আসবে না! কম বয়েস হল। পায়ের অবস্থা দ্যাখো! আর কত পথ হেঁটে এল! এর পা দুটো তো এখনও বাস্তবের জমি স্পর্শ করেনি। দুধের না।
সকলেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন, ‘ঠিকই, ঠিকই।’
জগদীশ শিশুটির হাতের আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে-করতে বললেন, হাতের আঙুলগুলো দেখেছ তোমরা। কেমন ফুলো ফুলো, নরম নরম, যেন তেলাকচু ফল!’
সকলেই আর একবার ঝুঁকে পড়লেন। ভবেশ বললেন, ‘নখ দেখেছ। একেবারে সমুদ্র থেকে তুলে আনা, সি-ফ্রেশ!’
সন্তোষ বললেন, ‘তা তো হবেই! এ হাত যে এখনও হাতিয়ার ধরেনি!’
বিধুর নাতি খলখল করে হামা দিয়ে সারা রকটা একবার গোল হয়ে ঘুরে এল, যেন দম দেওয়া নাড়ুগোপাল। মুখটা আকাশের দিকে, একটা হাত ওপরে তুলে কী একটা অদৃশ্য বস্তু মহাশূন্য থেকে ধরে আনার চেষ্টা করছে।
ভবেশ বললেন, ‘একটা ব্যাপারে কিন্তু আমাদের সঙ্গে মিল আছে, দাঁত নেই, ফোকলা।’
জগদীশ বললেন, ‘উঁহু, ফোকলা হলে কী হবে, মুখের ভেতরটা দেখেছ, লাল টুকটুক করছে, কেমন একটা পবিত্র দুধ দুধ গন্ধ। আর আমাদের মুখের ভেতরটা দেখ!’ জগদীশ হাঁ করতে যাচ্ছিলেন, বিধু হই হই করে উঠলেন, খুলো না খুলো না, কয়লার পিট দেখা যাবে।’
জগদীশ মুখটা বন্ধ করে ফেললেন। সত্যিই তাই, হাঁ করলে সবাই আঁতকে উঠবে। ভাঙা ভাঙা ঝুলকালো দাঁত। জিভে ছ্যাতলা। ভেতরটা বীভৎস হয়ে আছে।
বিধু নাতিকে কোলে টেনে নিলেন, বড় আদরের পুতুল একটি। ‘এবার উঠি ভাই। ব্যাটাকে মায়ের কোলে জিমমা করে দি।’ বিধু উঠে পড়লেন। নাতিকে কাঁধে ফেলে এগিয়ে চলেছেন।
ভবেশ বললেন, ‘একসময় আমরাও এইরকম ছিলুম। কত সাল মনে পড়ে উনিশশো দশ এগারো হবে। কী ছিলুম কী হয়েছি। আচ্ছা বাঘ কি হরিণেরও এইরকম হয়!’
‘তুমিই ভালো বলতে পারবে। ফরেস্ট অফিসার ছিলে তো!’ সন্তোষ ছড়ি ঠুকতে-ঠুকতে বললেন।
জগদীশ বললেন, ‘চলো না একবার অমূল্যকে দেখে আসি।’
ভবেশ একটু খুঁত খুঁত করে উঠলেন, ‘অসুস্থ মানুষকে কেন বিরক্ত করবে!’
‘বিরক্ত কি হে, নি:সঙ্গ মানুষটাকে একটু সঙ্গ দিলে ভালোই লাগবে। কতদিন এই রকে আসেনি, মজার মজার কথা বলেনি। আমাদেরও তো একটা কর্তব্য আছে।’
‘তা আছে। চলো তা হলে।’
ড্যম্প লাগা অন্ধকার ঘর। পিঠে দুটো বালিশ দিয়ে অমূল্য শুয়ে আছেন। নোনা ধরা দেওয়ালে মা কালীর ছবি। তার তলায় ঘোমটা টানা অমূল্যর স্ত্রীর ছবি। গোটাকতক টিনের চেয়ার এপাশে ওপাশে। একটু ধলো পড়া টেবিল। তার ওপর খালি চায়ের কাপ। তলানিটায় সর পড়ে গেছে। দু-চারটে ফয়েল মোড়া ওষুধের বড়ি। বিছানায় চাদরটা ময়লা ময়লা। সারা ঘরে অসুখ অসুখ গন্ধ, দারিদ্র্যের গন্ধ। অমূল্যের অবস্থা দেখে তিন বন্ধুরই মুখে কথা সরছে না।
অমূল্য শির ওঠা কঙ্কালের মতো একটা হাত তুলে বললেন, ‘তোমরা এলে তাহলে। বসো বসো। কেউ তো আর আসে না।’
তিনজনে ভয়ে ভয়ে বসলেন। মৃত্যু যাকে ধরছে তার সামনে বসতে বড় অস্বস্তি লাগে।
জগদীশ বললেন, ‘না, রোজই ভাবি আসব তবে বুঝতেই পারো সকলেই আমরা জড়িয়ে পড়েছি। সময় পাওয়া বড় শক্ত।’
ভবেশ বললেন, ‘তা ছাড়া আমি অন প্রিন্সপল বারে বারে এসে রুগিকে বিরক্ত করতে চাই না। অসুস্থ মানুষকে নির্জনে থাকতে দিতে হয়।’
অমূল্য ম্লান হেসে বললেন, ‘তা ঠিক। সাফার ইন আইসোলেশান। তোমরা ভালো আছ তো।’
‘আর এ বয়সে যেমন থাকা উচিত।’ তিনজনে প্রায় সমস্বরে একই কথা বললেন।
রেবা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। এতক্ষণ বোধহয় সংসারের কাজে ব্যস্ত ছিল ভেতরে। কপালের ঘামে দু গাছা চুল আটকে আছে।
‘আপনারা চা খাবেন কাকাবাবু?’
সন্তোষ আর ভবেশ দুজনেই স্প্রিঙের মতো লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘না, না, চা নয়, এই অসময়ে চা নয়।’
বলার ধরনেই বোঝা যায় অসুখের অপরিচ্ছন্ন ঘরে বসে চা খেতে দুজনেরই আপত্তি। জগদীশ বললেন, ‘অসুবিধে না হলে আমি একটু খাব।’
রেবা চলে গেল। সন্তোষ অমূল্যকে জিগ্যেস করলেন, ‘এখন কেমন বুঝছ! একটু ভালো!’
‘দেখতেই পাচ্ছ। সারারাত জেগে জেগে ঘড়ির শব্দ শুনি। সময় ছুটে পালাচ্ছে। হঠাৎ একদিন থেমে যাবে।’
ভবেশ হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার চলছে কীভাবে?’
একটা হাত শূন্যে তুলে অমূল্য বললেন, ‘জানি না ভগবান চালাচ্ছেন।’
জগদীশের মনে হল তারা যেন ডেথ সেলে বসে আছে। কথা হচ্ছে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত আসামির সঙ্গে। বিচারক রায় দিয়ে এজলাস ছেড়ে চলে গেছেন। জল্লাদ ফাঁসির দড়িতে তেল মাখাতে শুরু করেছে।
সন্তোষ বললেন, ‘তুমি বড্ড বেশি ভেঙে পড়েছ। ভেঙে পড়লে চলবে? খেলা ফুরোবার আগেই তুমি মনে করছ খেলাঘর ভেঙে পড়ছে।’
অমূল্য হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘নো মোর এ্যাডভাইস মাই ফ্রেন্ডস। আমার অবস্থায় পড়লে তোমরা কী করতে! যার জীবন তার জীবন! কোনটার সঙ্গে কোনটা মিলবে না। ডেসটিনি। যে যেমন বরাত করে আসে!’
ভবেশ বললেন, ‘ও নো নো। বরাত কিছু নয় আসলে বিক্রমের অভাব। বাঘের বিক্রমে বাঁচতে হবে। কুমায়ুনের ফরেস্টে দেখেছি তো, গুলি খেয়েছে তবু তেড়ে এসেছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুঝে যাওয়ার ক্ষমতা। খাঁচার জোর চাই, থাবার জোর চাই, নখের ধার চাই।’
অমূল্য হাসলেন, ‘বাঘের সমাজ আর মানুষের সমাজ। বাঘকে মেয়ের বিয়ের ভাবনা ভাবতে হয় ভবেশ! ডাক্তার ডাকার আগে ফিয়ের টাকা গুণে গুণে রাখতে হয়! রোজ সকালে হাঁড়ি চাপাবার ভাবনা ভাবতে হয় বন্ধু! হয় না। আমার চোখের আলো নিবে আসছে। জীবনের কথা আর ভাবি না। শুধু একটাই ভয়, ওপরে গিয়ে হয়তো স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে তখন যদি জিগ্যেস করে মেয়েটাকে কার কাছে রেখে এলে? তখন কী উত্তর দোব! বলব তিরিশ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারিনি বলে পথের পাশে একলা ফেলে রেখে এসেছি। দ্যাট উইল বি মাই অ্যানসার?’
জগদীশ হাঁটুর ওপর হাত রেখে বললেন, ‘নো দ্যাট উইল নট বি ইওর অ্যানসার। তুমি বলবে আমি জগদীশের কাছে তোমার মেয়েকে রেখে এসেছি। সেই জগদীশ যে পকপক করে চব্বিশ ঘণ্টা পান খায়, হল হল করে কথা বলে, রঙা চটা কালো কোট গায়ে আলিপুর কোর্টের বটতলায় সারা দুপুর বসে থাকে। বলবে সেই জগদীশের ছেলের বউ করে রেখে এসেছি।’
রেবা চা নিয়ে এসেছে। সামনে ঝুঁকে পড়ে জগদীশকে চা দিচ্ছে। জগদীশের মনে হল পুত্রবধূর হাত থেকে চা নিচ্ছে। চায়ের কাপটা হাতে নিতে-নিতে বললেন।
‘কী রে মা, আমার ছেলে বুড়োকে চিনিস?’
রেবা ঘাড় নেড়ে হাসল।
‘পছন্দ হয়।’
রেবা ছুটে পালাল।
অমূল্য আর একটু সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলেন। মানুষটির শরীরে আর কিছু নেই। হাড় কখানা সম্বল। গলকমম্বলটা ঠেলে উঠেছে। একসময় এই মানুষটিই কত শক্ত সমর্থ ছিলেন। ছাতা মাথায় সারা দুপুর রোদে দাঁড়িয়ে জনমজুর খাটাতেন।
‘তুমি নেবে জগদীশ, আমার মেয়েটাকে?’ অমূল্যের গলা কাঁপছে, ‘কিন্তু আমি যে কিছু— খরচ করতে পারব না। আমার যে কিছুই নেই। অসুখে সব শেষ হয়ে গেছে।’
জগদীশ চা খেতে-খেতে বললেন, ‘তোমার মেয়ে আছে আমার ছেলে আছে। ওপরে বিধাতা আছেন ভবিতব্য আছে। আর কী চাই অমূল্য।’
অমূল্যর চোখে জলে এসে গেছে।
‘তুমি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছ।’
‘দুর্বল তো হয়েইছি, যত দিন যাচ্ছে সেন্টিমেন্টও প্রখর হচ্ছে। কথায় কথায় চোখে জল এসে যায়। পৃথিবীটা যত শুকিয়ে আসছে আমার ভেতরেও তত জল জমছে।’ অমূল্য হাতের চেটোয় চোখের জল মুছলেন।
বাইরের রাস্তায় হরিধ্বনি শুনে সকলেই উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন। খুব জোর চলেছে, সরবে, বলো হরি হরিবোল। তিন বন্ধুই রাস্তার দিকের জানালায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
‘কে গেল, কে গেল?’
ঠিক বোঝা গেল না, যুবক কি বৃদ্ধ, স্ত্রী না পুরুষ? খই ছড়াতে-ছড়াতে শ্মশানের দিকে হনহন করে চলেছে। তিন জনে জানালার কাছ থেকে সরে এসে বিমর্ষ মুখে অমূল্যর দিকে তাকালেন। কুকুর যেমন শব্দ শুনে কান খাড়া করে থাকে অমূল্যর মুখে চোখের চেহারাও ঠিক সেইরকম হয়ে গেছে। সব কথাই শেষ। এরপর আর কোনও কথা চলে না।
‘আমরা এখন যাই, তুমি বিশ্রাম করো।’
‘অমূল্য খুব ক্ষীণ গলায় ডাকলেন, জগদীশ।’
জগদীশ বিছানার পাশে সরে এসে বললেন, ‘কিছু বলবে?’
আমি দেখে যেতে পারব তো? মেয়েটার মাথার সিঁদুর আমি দেখে যেতে পারব তো?’
জগদীশ বন্ধুর কঙ্কালসার হাত দুটো নিজের হাতে চেপে ধরে বললেন, ‘সে বিশ্বাস আমার আছে।’
তিনজনে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। রোদমাখা হু হু হাওয়া। কালো পিচের রাস্তায় সাদা খই উড়ছে। মাথার ওপর নীল আকাশ। সন্তোষ হঠাৎ ছড়ি ঠুকতে-ঠুকতে হেসে উঠলেন। জগদীশ জিগ্যেস করলেন,
‘হাসছ কেন?’
‘খুব ভালো চাল চেলেছ হে, একেই বলে উকিলের বুদ্ধি।’
জগদীশ অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কেন?’
‘ কেন? একমাত্র মেয়ে, বাড়িটা তো তোমার ছেলেরই হয়ে যাবে। রাস্তার ধারে বাড়ি, একটু মেরামত করে নিলেই ভ্যালুয়েশন কত দাঁড়াবে জানো?’
সন্তোষ আর ভবেশ ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেছেন। জগদীশ থমকে দাঁড়িয়ে।
‘তোমরা বুঝি এই ব্যাখ্যাই করলে?’
মুখ না ফিরিয়েই সন্তোষ বললেন, ‘দুই আর দুয়ে চারই হয় জগদীশ। সোজা হিসেব।’
খই বাঁচিয়ে-বাঁচিয়ে জগদীশের দুই বাল্যবন্ধু টুকটুক করে এগিয়ে চলেছেন। জগদীশ পকেট থেকে পানের ডিবে বার করে মুখে দু খিলি পান পুরে ক্যাচর ম্যাচর করে চিবোতে শুরু করলেন!