2 of 3

দিয়ে যাওয়া

দিয়ে যাওয়া

মেঝেতে পাতা বিছানায় শোয়া বিজনের একদম অভ্যেস নেই, গায়েপিঠে খুব বেদনা হয়ে যায়। অথচ এই ঘরে যে ছোট ডিভানটা রয়েছে তাতে দুজনের কুলোবে না। আর একটা খাট কিনতে হবে, বাইরের লোকজন এলে মুশকিলে পড়তে হয়। অবশ্য এর আগে এমন কেউ আসেনি যে নিজেদের শোয়ার খাট ছেড়ে দিয়ে ওদের বাইরের ঘরের মেঝেতে শুতে হয়েছে। বিজন মুখ। ফিরিয়ে দীপাকে দেখল, শোয়ার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে ওর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। যেন এইরকম শক্ত মেঝেতে শুতে ও আজন্ম অভ্যস্ত। দীপা কি অদ্ভুতভাবে সবকিছু মানিয়ে নিতে পারে! ওর বিয়ের আগের স্বাচ্ছন্দ্য আর এখনকার অভাবটভাবগুলোর মধ্যে যেন কোনও ফাঁকা জায়গা নেই। যেসব মেয়েরা প্রেম করে বিয়ে করে তাদের মনের জোর বোধ হয় খুব জোরালো হয়ে যায়।

এতদিন যে কথাটা মনে হয়নি, ওদের এই দু-ঘরের ছোট্ট ফ্ল্যাটটাকে খুব ছোট মনে হচ্ছে এখন। মাত্র বছর দেড়েক ওদের বিয়ে হয়েছে, এখনও ভালো করে ঘরদোর সাজানো হয়নি। জিনিসপত্রে ঘর জুড়ে আছে, কিন্তু তবু সেই দেশলাই বাক্সের উপমাটাই বার বার মনে আসছে। বিছানা ছেড়ে উঠল বিজন, বড্ড গরম হচ্ছে। এ-ঘরে ফ্যান নেই। ওদের যাবতীয় সম্পত্তি পাশের ঘরে, ওদের শোয়ার ঘরে। আলো না জ্বেলে ভেতরের বারান্দায় এল ও। দরজা খোলার সময় শব্দ বাঁচাতে গিয়েও জোর শব্দ হল। মাঝরাত্রে শব্দগুলোর প্রাণশক্তি যেন বহুগুণ বেড়ে যায়। কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেতে-খেতে মনে হল পাশের ঘরেও ফ্যান ঘুরছে না। চিরকাল হাতপাখা চালিয়ে ফ্যানের হাওয়া দাদুর একদম সহ্য হয় না। ছেলেবেলায় দেখেছে, ঘুমোতে ঘুমোতে দাদুর একটা হাত পাখাটাকে ঠিক নেড়ে যেত। কী মনে হল, বিজন ওদের শোয়ার ঘরে উঁকি দিল। দরজা বন্ধ করেননি দাদু। পরদার ফাঁক দিয়ে ঘরটা বেশ দেখা যায়। ও-পাশের জানলা দিয়ে ফিকে চাঁদের আলো ওদের খাটের বাজুতে এসে পড়েছে। সাদা ধপধপে বিছানায় দুই পা সোজা করে দাদু শুয়ে আছেন। দাদুর গায়ের রং অসম্ভব ফরসা, এই নব্বই বছরেও রঙটা মরেনি। জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে গিয়ে কি রূপময় লাগছে এই মুহূর্তে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘরে ফিরে এল বিজন। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে ও বুঝতে পারল দীপা জেগে আছে। বিজন বলল, ঘুমোওনি?

পাশ ফিরে শুয়ে দীপা বলল, বড্ড গরম, ঘাড় গলা একদম জবজব করছে।

বালিশের পাশ থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা হাতড়ে একটা সিগারেট বের করলে বিজন। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে চট করে ঘুম আসতে চায় না। এই সময় সিগারেট খেতে মন্দ লাগে না। দেশলাইটা জ্বালতেই অন্ধকার ছিটকে সরে গিয়ে আবার ছুটে এল। শুয়ে-শুয়ে সিগারেটের টান দিয়ে বিজন বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?

ধুৎ, দাদুর জন্যে তো আলাদা করে কিছু করতে হচ্ছে না। প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, এখন দেখছি একদম মাটির মানুষ। তারপর একটু চুপ করে থেকে আদুরে গলায় বলল, এই, আমাকে একটা টান দাও!

হাত সরিয়ে নিল বিজন, না, তোমার অভ্যেস হয়ে যাবে। বাঙালি মেয়ের সিগারেট খাওয়া কি। তারপর আবার কী ভেবে দীপার হাতে সিগারেটটা দিয়ে দিল ও। মাঝে-মাঝে দীপার মাথায় এরকম ভূত চাপে। টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা দিয়ে যেতে বললে নিজেই ধরিয়ে এনে দেয়। এ নিয়ে অনেক ঠাট্টা করেছে বিজন। ব্যাপারটা সবটাই মজা দীপার কাছে। দীপার কাছ। থেকে ফেরত নিতে নিতে বিজন বলল, এসময় তোমার পেটে নিকোটিন যাওয়া ঠিক নয়, বুঝলে?

কেন?

পেটের ভিতর যিনি আছেন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন!

সঙ্গে-সঙ্গে বিজনের কোমরে প্রচণ্ড চিমটি কাটল দীপা। প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল বিজন, দীপা চাপা গলায় বলল, বদমাস!

খানিকবাদে দীপা বলল, আমাদের এই সতুবদ্যিটা একদম বোগাস, সামান্য কাটা ঘায়ের জন্যে ইঞ্জেকশন দিতে চায়, বোঝো! ওদের পাড়ার ডাক্তার এস. কে. রায়কে দীপা ঠাট্টা করে সতুবদ্যি বলে। সামান্য জ্বরজারি হলেও ইঞ্জেনশন ছাড়া কথা বলে না। অল্প পয়সায় চট করে অসুখ সেরে যায় বলে রুগি উপচে পড়ে। বেশির ভাগই গরিব গেরস্ত মানুষ। সেই সতুবদ্যির কাছে দাদুকে। নিয়ে গিয়েছিল দীপা। দিন সাতেক আগে দাদুর বাঁ হাতের আঙুলের ফাঁকে ঘাটাকে আবিষ্কার করেছিল ও। দাদু বলেছেন, বেশ কদিন থেকেই ওটা হয়েছে, সারছে না কিছুতেই। দীপা দু একটা মলম দিয়ে কমাতে না পেরে আজ সতুবদ্যির কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সতুবদ্যি সব দেখেশুনে একটা ইঞ্জেকশানের কোর্স কমপ্লিট করতে বলেছিল। দীপা আপত্তি করায় একজন স্কিন স্পেশালিস্টকে দেখাতে বলেছে। বিজন অবশ্য এতটা গুরুত্ব দিতে রাজি নয় ব্যাপারটাকে। কিন্তু দীপার আবার ডাক্তার দেখানো ব্যারাম আছে। সামান্যতেই ফটফট করে। ও-ই ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে ডক্টর নাগের সঙ্গে। চাঁদনিতে বসেন ভদ্রলোক, দীপার বাবার বন্ধু, ফিসটিস কম নেবেন বোধ হয়। অবশ্য দাদুর জন্য খরচা করতে ও পিছু-পা নয়। উনি এসেছেন আজ নদিন হল। প্রথমদিন বাজারে গিয়ে ও খুব বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল। এমনিতে ওদের। সংসারে আলু পেঁয়াজ আর আড়াইশো মাছ কিনলে দিব্যি চলে যায়। বেশি রান্নাবান্নার ঝামেলা করতে চায় না দীপা। কলকাতার মেয়েরা বিয়ের আগে বড় একটা হেঁসেলের ধারে ঘেষেও না। দাদু আসছেন খবর পেয়ে তো ওর নাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। অবশ্য দাদু মাছ মাংস ডিম খান না। এই নব্বই বছর বয়সে ওঁর গলার খাদ্যনালি ছোট হয়ে এসেছে। শক্ত কিছু খেতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। একদম গলানো ভাত ডাল আর একটা সেদ্ধ হলেই চলে যায়, তবে দুধটা চাই। ছেলেবেলায় দাদুকে রোজ শীতকালে এক জামবাটি পায়েস খেতে দেখেছে বিজন। এখানে অবশ্য জামবাটি নেই। শ্যামবাজার থেকে কিনে আনা কাঁচের বাটিতে পাতলা করে পায়েস বেঁধে দেয় দীপা বিজনের কথামতো, খেয়ে বুড়োর কি ফুর্তি।

এই সময়ে দীপার এতটা খাটুনি উচিত নয়। কিন্তু দাদু যখন নিজে থেকেই এখানে আসার কথা লিখলেন তখন দীপাই যেন বেশি খুশি হয়েছিল। ওদের এই বিয়েটা বিজনের বাড়ির লোক সহজ চোখে নেননি। এমনকী বিজনের বাবাও অমত করেছিলেন প্রথমটায়। একমাত্র এই ঠাকুরদার চাপে সবাইকে মেনে নিতে হয়েছে। মেনে নেননি কেউ, নিলে ছেলের সংসার গুছিয়ে দিতে কেউ কেউ আসতই। শিলিগুঁড়ি থেকে কলকাতার দূরত্ব আর কতটুকু? কিন্তু এই দেড় বছরে ওরা। কেউ আসেননি বিজনের কাছে। মনে-মনে একটা দুঃখ ছিল ওর। বোধ হয় দীপা ব্যাপারটার জন্যে নিজেকে দায়ী করত, মুখ ফুটে বিজনকে অবশ্য বলেনি। তা সেই দাদু আসছেন শুনে যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গিয়েছিল ওরা। ওদের এই কলকাতার বাড়িতে দাদুর আসা মানে ওদের সব। অভাব পূর্ণ হয়ে যাওয়া। এই ফ্ল্যাটটা দোতলায়। যোগাযোগ ছিল বলে খুব সস্তায় পেয়ে গিয়েছিল বিজন। দক্ষিণ খোলা এই ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনেই ছোট একটা পার্ক আছে। মোটামুটি ওদের পক্ষে স্বৰ্গই বলা যায়। দাদু যেদিন কলকাতায় এলেন বিজন একাই যেতে চেয়েছিল স্টেশনে। দীপা বাড়িতে থাকলে দাদুর খাবার-দাবার জল গরম রাখতে পারবে। কিন্তু দীপা শোনেনি সে কথা। জোর করে সেই ভোররাত্রে প্রায় প্রথম ট্রাম ধরে স্টেশনে ছুটেছিল। অত ভোরে কখনও বেরনো হয় না। বেশ লাগছিল ট্রামে যেতে-যেতে। কলকাতার চেহারাটা ভোরবেলায় একদম অন্যরকম হয়ে যায়। যদিও বিজন দাদুর চিঠিতে জেনেছিল উনি একাই আসছেন তবু ঠিক বিশ্বাস করেনি। এখন শিলিগুঁড়ি থেকে এক রাত্রেই কলকাতা চলে আসা যায় কিন্তু দাদুর এই বয়সে একা আসাটা ভাবা যায় না। ট্রেনটা যখন এল প্ল্যাটফর্মে ঠিক তখনি ওরা দাদুকে দেখতে পেল। দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন ওদের দেখে। বয়সে শরীর প্রায় কুঁজো হয়ে এসেছে কিন্তু ট্রেন থামামাত্রই যেভাবে নেমে এলেন তাতে বয়সটাকে বোঝা যায় না। ওরা প্রণাম করতেই দুই হাত বাড়িয়ে ওদের আঁকড়ে ধরলেন দাদু, তারপর চোখ বন্ধ করে বুক ভরতি বাতাসটাকে ছেড়ে দিলেন আরামে। দাদু একা এসেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল বিজন, তার আগেই দাদু। বললেন, জোর করে চলে এলাম দিদিমণি, তুমি আমাকে দুটো ভাতেভাত খাওয়াতে পারবে তো? তারপর বিজনের দিকে বুড়ো আঙুল নেড়ে দীপাকে বললেন, একে আমার বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না বাপু! বিজন দাদুর কাঁধ থেকে কাপড়ের ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। পরে দেখেছে গোটা তিনেক কাপড় আর দুটো লংক্লথের পাঞ্জাবি, দুটো গেঞ্জি, একটা ব্রাহ্মী তেল, একটা চিরুনি নিয়ে দাদু সটান চলে এসেছেন। এতক্ষণ লাঠিটা কনুইতে ঝোলানো ছিল, এবার এক হাতে লাঠি অন্য হাতে বিজনকে ধরে উনি স্টেশন পেরিয়ে এলেন। ট্যাক্সিতে উঠে বললেন, তোমাদের কলকাতার যা গল্প শুনি–আমি থাকতে পারব তো? তারপর হেসে বললেন, তা তোমাদের ঘরের মধ্যে তো আর কলকাতা ঢোকেনি–কি বলো?

দীপা বড়-বড় চোখ মেলে দাদুকে দেখছিল। বিয়ের পর ওরা যখন বউভাতে শিলিগুঁড়ি গিয়েছিল তখন দাদুর সঙ্গে খুব বেশি কথা হয়নি। ওদের শিলিগুঁড়ির বাড়িতে দাদুর সঙ্গে কাকারা থাকেন। বিজনের বাবা দাদুর বড় ছেলে, সারাজীবন রেলে চাকরি করে যাচ্ছেন। এখন রিটায়ার করার মুখে গৌহাটিতে পোস্টেড। ছেলের বউভাতে বিজনের মাকে নিয়ে যেন কদিন শিলিগুঁড়িতে বেড়িয়ে গেলেন। যা কিছু আয়োজন সব দাদুই ভার নিয়েছিলেন। দাদু রিটায়ার করেছেন প্রায় তিরিশ বছর হল। সারাজীবন চাকরি করে যে অর্থ সঞ্চয় করেছেন তা তিরিশ বছর থাকতে পারে না। কিছু শেয়ার কেনা ছিল চা-বাগানে–তার সামান্য ডিভিডেন্ড আর শখানেক পেন্সনের। টাকায় দাদুর চলতে হয়। কাকারাই সংসার চালান কিন্তু বিজন দেখেছে ওর কিছু ব্যাপার হলে দাদু কোথা থেকে টাকা এনে দরাজহাতে খরচ করেন। প্রায় চার বছর বয়সে দাদুর সঙ্গে শিলিগুঁড়ির নতুন বাড়িতে চলে আসে ও। বাবা-মাকে ছেড়ে সেই চার বছর বয়স থেকে প্রতি মুহূর্তে ওর মানসিকতায় দাদু জড়িয়ে ছিলেন। নিজের ছেলেদের বদলির চাকরির জন্যে বোর্ডিং এ রেখে মানুষ করেছেন কিন্তু নাতিকে কখনও চোখের আড়াল হতে দেননি। বউভাতের দিন। সবার সামনে দীপাকে আশীর্বাদ করতে গিয়ে বলেছিলেন, কখনও বোকা হবে না, ওকে চোখে। চোখে রাখবে, যেমন আমি রেখেছিলাম। এখন থেকে বি জ্বর দায়িত্ব তোমার ওপর।

বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে দাদু বললেন, ওরে বাবা, তোমরা দোতলায় থাক নাকি! আমার যে উঠতে বড় অসুবিধে হবে।

দীপা বলেছিল, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে ধরে-ধরে নিয়ে যাচ্ছি।

দাদু বললেন, তা ধরো ক্ষতি নেই, কিন্তু তোমার নিজের শরীরেই তো রক্ত নেই বাপু। মেয়েমানুষের শরীরে রক্ত না থাকলে সন্তান জড়ভরত হয়ে যায়। লজ্জায় মাথা নিচু করেছিল

দীপা। আড়চোখে বিজনের দিকে তাকিয়েছিল, দাদুর চোখে কি এর মধ্যেই ও ধরা পড়ে গেছে। বিজন দাদুকে দেখছিল। ঠিক সেইরকম আছেন। একটুও পালটাননি। সোজা কথা একদম মুখের ওপর সোজা বলে দেওয়ার জন্য আত্মীয়স্বজনের কাছে এই মানুষটি বড় অপ্রিয়।

দোতলায় উঠতে বেশ কয়েকবার দাঁড়াতে হল। ওদের ফ্ল্যাটে ঢুকে দীপা দাদুকে শোয়ারঘরে নিয়ে গেল, আপনি আগে বিশ্রাম করুন, তারপর জামাকাপড় ছাড়বেন।

শোয়ারঘরে ঢুকে দাদু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেওয়ালে বিজনের ছোটবেলার একটা ছবি ছিল। দাদুর হাত ধরে হাঁটছে। ছবিটা দেখে দাদু চোখ বড় করলেন, ওরে বাবা, আমার ছবি দেখছি এখানে! তারপর আস্তে আস্তে বললেন, দ্যাখো দিদিমণি, বি জ্বর মুখটা কেমন পালটে গেছে, আমি কিন্তু একই রকম আছি–কি বলো? ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল বিজন কথাটা শুনে। হঠাৎ, কি সহজে, সেই ছেলেবেলাটা ওর বুকের মধ্যে একছুটে চলে এসে সমস্ত শরীরে একটা কান্নার কাঁপুনি ছড়িয়ে দিল। বিজন পা টিপে টিপে বসার ঘরে চলে এসেছিল।

মাঝরাত্তিরে অন্ধকার বেশ চোখ-সওয়া হয়ে যায়। যদিও এ-ঘরে চাঁদের আলো এখনও আসেনি তবু মুখ ঘুরিয়ে বিজন দীপার মুখ দেখতে পেল। এর মধ্যে কোন ফাঁকে ওর চোখ বন্ধ হয়ে। গেছে। বেচারার খুব খাটুনি যাচ্ছে। এখন দুপুরবেলায় একদম ঘুমোয় না, শুধু দাদুর সঙ্গে বকবক করবে! বুড়োদের এমনিতে ঘুমটুম কম হয় কিন্তু এ-সময় দীপার তো ঘুমননা উচিত। অবশ্য হিসেবমতো এখনও প্রায় সাড়ে চার মাস দেরি আছে। এর মধ্যে দুবার চেক-আপ করিয়ে এনেছে। বিজন। সব ঠিক আছে, শুধু রক্তাল্পতার অভিযোগ। একগাদা ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তার, খেলে তো কাজ হবে! বিজন আর ওকে ডাকল না। আর কঘণ্টা পরেই তো ভোর হবে। তখন এমনিতেই বেচারার ঘুম ভেঙে যাবে। পাঁচটা বাজার সঙ্গে-সঙ্গে ওদের দরজায় শব্দ করেন দাদু! আজন্ম। দেখে আসছে ও ব্যাপারটা। ছেলেবেলায় ভোররাত্রে দাদু ওকে বিছানা থেকে টেনে তুলতেন। ঘুমে চোখ এঁটে থাকত, তাতেই জলের  ঝাঁপটা দিতে বলতেন। শীত-গ্রীষ্ম বলে কিছু ছিল না। প্রচণ্ড শীতের ভোরে মাথায় বাঁদুরে-টুপি সারা শরীর পশমে জড়িয়ে দাদুর হাত ধরে ওকে। দৌড়তে হত। দাদু এত জোরে হাঁটতেন যে না দৌড়লে তাল রাখতে পারত না বিজন। তখনও আবছা অন্ধকার জড়ো হয়ে থাকত গাছের মাথায়। মহানন্দার ধার দিয়ে দাদু ওকে নিয়ে চলে। যেতেন সেই পিলখানা অবধি। সেই সূর্য উঠল, আকাশ সোনায়-সোনায় ভরে গেল, ব্যস, দাদু থেমে গেলেন। দুহাত জড়ো করে তিনবার জয়গুরু বলে প্রণাম করতেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে নদী দেখত বিজন। সেই ভোরবেলায় ঠান্ডা বাতাসে নদীর ওপর দিয়ে একরাশ মায়াময় কুয়াশা। গড়িয়ে-গড়িয়ে যেত। সূর্যের আলো পড়তেই জলের শরীর থেকে ধোঁয়ার সুতো মাথা চাড়া দিয়ে যেন আকাশটাকে ধরতে চাইত। সমস্ত বাল্যকাল এইভাবে সকালগুলো কেটেছে। যেদিন বৃষ্টি হত সেদিন খুব খুশি হত বিজন। বৃষ্টির ভোরে দাদু তাকে ডাকতেন না। বিরাট ছাতাটা মাথায় নিয়ে গামবুট পরে একাই বেরিয়ে পড়তেন উনি। সূর্য ওঠার আগেই যদি বৃষ্টি থেমে যায়! আর মনে-মনে প্রার্থনা করত বিজন যেন রোজ-রোজ ভোরে বৃষ্টি হয়।

কলকাতায় এসে প্রথম ভোরেই এইসব স্মৃতি বিজনের মনে পড়ে গেল। ভোরবেলায় দরজায় শব্দ শুনে দীপার ঘুম ভেঙেছিল আগে। বিজনকে ঠেলে তুলতে ও দরজা খুলে দেখল দাদু দাঁড়িয়ে। আছেন। সাজগোজ হয়ে গেছে, হাতে লাঠিটা। দীপা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায় যাচ্ছেন দাদু?

একটু বেড়িয়ে আসি ভাই। দরজা খোলা থাকবে কিনা, তোমাদের ঘুম ভাঙাতে হল।

বিজন বলল, এখানে তো কাছেপিঠে নদী নেই, গঙ্গা তো অনেকটা দূর।

নদীর কি দরকার হয় সবসময়? দাদু হাসলেন।

না, তবে আপনি কি একা-একা হাঁটতে পারবেন, রাস্তাঘাট খোঁড়া, গাড়িঘোড়া আছে। বিজনের ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না কলকাতায় দাদুর এই মর্নিং-ওয়াকের ব্যাপারটা। কিন্তু এর মধ্যেই দীপা চট করে শাড়ি পালটে চলে এসেছে, এসে দাদুর হাত ধরল, চলুন, আমরা ঘুরে আসি।

দাদু কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, হুম, আমার চেয়ে তোমার এতে উপকার হবে বেশি, বুঝলে?

সিঁড়ি দিয়ে প্রায় অন্ধকারে ঠুকঠুক করে দাদুকে নিয়ে নামতে-নামতে ঘাড় ঘুরিয়ে হঠাৎ দীপা চেঁচিয়ে বলল, এই, হিটারে জল গরম করে রেখো, আমি এসে চা করব।

কথাটা কানে আসতেই ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল বিজন। এমনিতে এটা কিছু নয়। সংসারের অনেক কাজে ও দীপাকে সাহায্য করে। কিন্তু দাদুর সামনে একথা দীপা না বললেই পারত। বেচারা জানে না ওদের বাল্যকালে বাড়ির পুরুষরা এইসব কাজ করলে তাদের স্ত্রৈণ বলা হত। বিস্ময়ে বিজন দেখল, কথাটা শুনেও দাদু পিছন ফিরে ওকে দেখলেন না। বরং দীপার সঙ্গে গল্প করতে-করতে নেমে গেলেন। লজ্জা পাওয়ার জন্য নিজেকে নির্বোধ বলে মনে হল বিজনের এবার।

এখন প্রতিদিন ভোরে দীপা দাদুর সঙ্গে মর্নিংওয়াকে যাচ্ছে। ভোর পাঁচটায় দাদু এসে দরজায় শব্দ করলেই দীপা তড়াক করে উঠে পড়ে। ওরা বেরিয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে আবার ঘুমুতে চেষ্টা করে বিজন। কিন্তু একা-একা শুয়ে ঘুমোনোর অভ্যেসটা এই দেড় বছরে কেমন করে যে চলে গেছে–কিছুতেই ঘুম আসে না। আশ্চর্য, দাদু এখন ওকে মর্নিং ওয়াকে সঙ্গী হতে বলেন না।

পরদিন অফিসে যাওয়ার আগে দাদুকে ডাক্তার নাগের কাছে নিয়ে যাওয়া নিয়ে দীপার সঙ্গে কথা বলে নিল বিজন। ওর অফিস ধর্মতলায়। সেখান থেকে এত দূরে ফিরে এসে আবার চাঁদনিতে ফিরে যেতে প্রচুর সময় লেগে যাবে। তার চাইতে বরং দীপা যদি ট্যাক্সি নিয়ে ওখানে চলে যায় তাহলে বিজন অফিস থেকে পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে সরাসরি চেম্বারে চলে যেতে পারে। অন্যসময় হলে দীপা রাগ করত। বলত, সব ঝক্কি বিজন ওর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। ঝগড়াঝাঁটির সময় বলেই ফেলে, তুমি খুব স্বার্থপর। কিন্তু এখন প্রস্তাবে ও দ্বিমত করল না। ঠিক হল ডাক্তারের কাছ হয়ে ওরা কালীঘাট মন্দিরে যাবে। দাদুকে টুকটাক করে কলকাতা দেখানো হচ্ছে। আজ এই সুযোগে কালীঘাট হয়ে যাবে। আর এখন বিজন হঠাৎ আবিষ্কার করল, এত বছর ও কলকাতায় আছে, কখনও কালীঘাট যাওয়ার কথা মনে আসেনি। মানুষ নিজের হাতের তালুর দিকে সবচেয়ে কম সময় তাকায়।

অফিস থেকে বেরিয়ে বিজন চৌরঙ্গিটা হেঁটে এল। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। দূরত্বটা এত সামান্য যে মিনিট দশেকের মধ্যে ও চাঁদনিতে পৌঁছে গেল। জায়গাটায় ভিড়ভাট্টা বেশি। ফলওয়ালাগুলো রাস্তা জুড়ে চিৎকার করছে। হকারদের জ্বালায় নিশ্চিন্তে ফুটপাথ ধরে হাঁটা মুশকিল। নম্বর মিলিয়ে একটা গাড়িবারান্দাওয়ালা বাড়ির সামনে দাঁড়াল ও। দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির পাশে অনেকগুলো মেনপ্লেটের মধ্যে ডক্টর নাগের নাম দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্ত হল বিজন। দীপারা নিশ্চয়ই এখনও আসেনি। ট্যাক্সি পেলে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই অবশ্য আসার কথা। বিজন সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশে সতর্ক চোখ রেখে সিগারেট ধরাল। সারাগায়ে অদ্ভুত ধরনের পাঁচড়ার মতো ঘা নিয়ে এক ভদ্রলোক আস্তে-আস্তে ওপরে উঠে গেলেন। নিশ্চয়ই ডক্টর নাগের কাছে এসেছেন। হঠাৎ ও খুব বিরক্ত হয়ে পড়ল দীপার ওপর। খামোকা একটা বুড়ো। লোককে নিয়ে এইসব চর্মরোগগ্রস্ত রোগীর সঙ্গে বসাতে চাইছে দীপা! রোগ-রোগ বাতিকটা বোধ হয় ওর মা ওকে দিয়েছেন। শাশুড়ির কথা মনে করলেই নিম্নাঙ্গে বাত, পেটে আমাশা, উইন্ড এবং অম্বল, রক্তচাপের হ্রাসবৃদ্ধি মনে পড়ে। বিজন নিজে ডাক্তারদের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত নয়। কিন্তু ও দেখেছে, এই কলকাতার সবরকম বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে চেনে এমন লোকের অভাব নেই। সেখানে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করলে শুনতে হয়, সেকি, ডক্টর মিত্রকে চেনেন না! কলকাতায় ওর চেয়ে বড় গাইনি কেউ নেই। অথবা, ডা: সেনের নাম শোনেননি? কি বললেন, ইন্ডিয়ার টপ হার্ট স্পেশালিস্ট। মেয়েলি কোনও অসুখ অথবা বুকের ব্যামো না থাকলে কেন যে ওদের চিনতে হবে বুঝতে পারে না বিজন। এই ব্যাপারে দীপা অবশ্য খবরাখবর রাখে। টপাটপ ডাক্তারদের নাম বলে দিতে পারে।

খানিকবাদেই ওরা এসে গেল। ট্যাক্সির বিল মিটিয়ে দিয়ে দাদুর হাত ধরে বিজন গাড়িবারান্দার তলায় চলে এল। চারপাশে এত লোকের চিৎকার, দ্রুত চলাফেরা, রিকশাওয়ালাদের ঘণ্টির শব্দ–দাদু কেমন বোকা হয়ে গেছেন। দীপা বলল, কতক্ষণ এসেছ?

বিজন বলল, মিনিট পাঁচেক। তুমি ওই সিঁড়িটা দিয়ে এগিয়ে যাও, আমি দাদুকে নিয়ে আসছি।

সিঁড়িটা প্রায় খাড়াই হয়ে উঠে গেছে। এক পা করে উঠে দাদুকে দাঁড়াতে হচ্ছে। উঠতে-উঠতে বললেন, এইসব বাড়িগুলো কবেকার বিজু?

সিমেন্টওঠা সিঁড়ির ধাপে চোখ রেখে বিজন হাসল, ক্লাইভের আমলের হবে!

কিন্তু দেখছ কি শক্ত গাঁথুনি! এরা সিঁড়িতে আলো দেয় না কেন? দাদু এক হাতে লাঠিতে ভর দিয়ে অন্য হাতে বিজনকে নিয়ে উঠেছিলেন। বিজন উত্তর দিল না। কলকাতায় অনেক কিছু স্বাভাবিক ঘটনা আছে যা প্রথম চোখে মেনে নেওয়া যায় না। কলকাতায় প্রথম পড়তে এসে। হোস্টেলের ঘরে ছয়জনকে শুতে হবে ভেবে ওর কান্না এসে গিয়েছিল। শিলিগুঁড়ির স্বাচ্ছন্দের জীবনে এরকম অভ্যাস ওর ছিল না। এখন তো এটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।

ওপরে উঠে বিরাট চাতাল, তাকে ঘিরে ইউ-শেপে ঘরগুলো সাজানো। ডক্টর নাগের চেম্বারটা দেখতে পেল বিজন। বেশ ভিড় এই সন্ধেবেলায়। ওদের দেখে দীপা এগিয়ে এল, আপনি একটু বসুন দাদু। একজন পেসেন্ট ভেতরে আছেন, তারপরেই আপনাকে ডাকবে।

বিজন দেখল বসার ঘরটা বেশ বড়। অনেক চেয়ার ছড়ানো। মাঝখানে একটা কাঠের গোল টেবিলে কিছু ইংরেজি হিন্দি পত্রিকা রাখা আছে। কাগজের রং দেখে বোঝা যায় ওগুলো কয়েকমাস আগে ছাপা হয়েছে। ভিজিটার্স তো রোজ পালটাচ্ছে তাই পত্রিকাগুলো পুরোনো হয় না।

একটা সোফার অর্ধেকটা খালি পেয়ে দাদুকে নিয়ে বসল বিজন। ভেতরে ডাক্তারের চেম্বার। সুইং ডোরটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল দীপা। আর কেউ ঢোকার আগেই ও চান্স নেবে। আশেপাশে তাকিয়ে বিজনের কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। এই ঘরের অর্ধেক মানুষ সুনয়। গায়ের চামড়ায় নানারকম রোগ কিলবিল করছে। ওর সামনের চেয়ারে এক ভদ্রলোক মুখ নামিয়ে কাগজ পড়ছেন। বিজন লক্ষ করল ভদ্রলোকের ঘাড়, গলা কাঁঠালের মতো উঁচু-উঁচু হয়ে আছে। অস্বস্তিটা ক্রমশ বাড়তে লাগল বিজনের। এই সব স্কিন ডিজিস কি সংক্রামক নয়? এই যে চেয়ারে ও। বসছে সেখানে একটু আগে যদি এই ধরনের রোগগ্রস্ত কেউ বসে থাকেন তবে বিজনের তো তা হতে পারে।

হঠাৎ দাদু বললেন, বিজু, তুমি ডাক্তার হলে পারতে।

অন্যমনস্ক ছিল বিজন, ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী বলছেন?

সেইসময় ভেতরের দরজা খুলে এক মহিলা আর পুরুষ বেরিয়ে এলেন। দীপা বলল, এসো। বলে কাউকে কিছু না বলতে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে একটু গুঞ্জন উঠল ঘরে, হয়তো যাঁরা আগে এসেছেন তাঁরাই বিরক্ত হলেন। বিজনের অস্বস্তি হচ্ছিল, দীপা মাঝে-মাঝে এমন সব ব্যাপার করে ফেলে। অবশ্য এখানে যাঁরা অপেক্ষা করছেন তাঁরা দাদুর মতোনব্বই পেরোননি। সে হিসেবে নিশ্চয়ই দাদুকে ওঁরা ক্ষমা করে দিতে পারেন।

চেম্বারে ঢুকে বিজন ডক্টর নাগকে দেখতে পেল। বয়স হয়েছে নিশ্চয়ই সত্তরের কাছাকাছি। সাদা হাফ হাতা জামা, মুখটা হাসি-হাসি। দীপা এগিয়ে এসে দাদুকে ধরে চেয়ারে বসাল, মুখোমুখি। দুপাশে আরও দুটো চেয়ারে বিজনরা বসল। দীপা বলল, আমাদের দাদু।

ডক্টর নাগ হাতজোড় করে নমস্কার করতে দাদু ঝুঁকে পড়ে সেটার সম্মান দিলেন। এই একটা ব্যাপারে দেখেছে বিজন, মাঝে-মাঝে ওর বিরক্তিও লেগেছে, সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে। আসছে, দাদু কোনও সম্মানীয় মানুষ অথবা ব্রাহ্মণ কেউ হলে তা তার বয়স যাই হোক না কেন নমস্কার করার সময় প্রায় ঝুঁকে পড়ে শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। এক সময় মনে হত এটা একধরনের। ক্রীতদাস-মনোবৃত্তি। দীর্ঘকাল ব্রিটিশ রাজত্বে থেকে চরিত্রের মধ্যে এসে গেছে। এখন ডক্টর। নাগকে প্রায় প্রণামের ধরনে নমস্কার করাটা ওর ভালো লাগল না। ডক্টর নাগ বললেন, বলুন কী হয়েছে আপনার? কথা বলার সময় এক ধরনের স্নেহ ঝরে পড়ে, কানে বেশ আরাম দেয়।

দাদু হাতটা সামনে গিয়ে এলেন। বিজন এইবার দেখল বাড়ি থেকে বেরুবার সময় দীপা। ব্যান্ডেজ দিয়ে আঙুলের ফাঁকটা ঢেকে দিয়েছে। ডক্টর দাগ দীপাকে ইঙ্গিত করতে দীপা হাতটা টেনে নিয়ে ব্যান্ডেজটা খুব সতর্ক হাতে খুলে নিল। টেবিলল্যাম্পের মুখটা ঘুরিয়ে আলোটা হাতের ওপর ফেললেন ডক্টর নাগ। তারপর মনোযোগ দিয়ে দুই আঙুলের মাঝেখানের ঘাটা দেখতে লাগলেন। বিজন এই চড়া আলোয় দাদুর হাতের চামড়া-শিরা দেখছিল। পোস্ট। অফিসের সিলের মতো সময় তার চিহ্ন দিয়ে ঘিরে ফেলেছে দাদুকে। হঠাৎ ডক্টর নাগ জিজ্ঞাসা করলেন, কত বয়স হল আপনার?

দাদু বললেন, এইট্টিন এইট্টিফোরে জন্ম আমার।

মুখ তুলে তাকালেন ডক্টর নাগ, শরীর তো দেখছি বেশ ভালো। তারপর একটা লম্বাটে বাক্স খুলে পঁচের মতো জিনিস বের করলেন হাতটাকে ছড়িয়ে দিন তো, আঙুলগুলো স্প্রেড করুন–হ্যাঁ! তারপর সেই সূচটাকে ঘায়ের কাছাকাছি চামড়ার ওপর ফোঁটাতে লাগলেন, লাগছে?

দাদু চোখ বন্ধ করে কিছুটা ভেবে বললেন, না তো!

আরও জোরে বিদ্ধ করে প্রায় ফিসফিসিয়ে ডক্টর নাগ বললেন, এবার!

দাদুর হাতটা সামান্য নড়ে উঠল, এবার যেন লাগছে, কিন্তু আরও লাগা উচিত ছিল। ডক্টর নাগ সোজা হয়ে বসে দাদুর মুখের দিকে তাকালেন খানিক, তারপর উঠে এসে টেবিলল্যাম্পটাকে। দাদুর মুখের ওপর ঘুরিয়ে দিলেন। বিজনের হঠাৎ মনে হল, কোনও নাটকের চূড়ান্ত দৃশ্যে যেন লাইটম্যান ফোকাস ফেলল। ডক্টর নাগ দাদুর জিভ দেখলেন, ঝুঁকে পড়ে নাক আর কান দেখলেন। তারপর দাদুর অজান্তে কানের লতিতে সেই সঁচটা সামান্য ফুটিয়ে দিলেন। বিজন দেখল দাদুর শরীরে কোনও প্রতিক্রিয়া ঘটল না।

পাশের বেসিনে হাত ধুয়ে এসে ডক্টর নাগ সিগারেট ধরালেন। এবার টেবিলল্যাম্পটা তাঁর সামনে মুখ ফেরানো। কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে থাকলেন ডক্টর নাগ। বিজনের মনে হল ওঁকে কেমন। অন্যরকম লাগছে। দীপার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন ভদ্রলোক। তারপর প্রেসক্রিপশন-প্যাডটা টেনে নিয়ে অনেক ভেবেচিন্তে লিখে গেলেন। বিজন লক্ষ করেনি দীপা কখন ব্যাগ থেকে টাকা বের করে হাতে রেখেছিল, এখন ও টাকাটা টেবিলের ওপর রেখে একটা পেপার-ওয়েট চাপা। দিয়ে দিল। ডক্টর নাগের হাবভাবে বিজন একদম স্বস্তি পাচ্ছিল না। দাদুর দিকে ও তাকাল। ও দেখল দাদু মুখ তুলে দেওয়ালে টাঙানো রামকৃষ্ণের ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন।

প্রেসক্রিপশনটা দীপার দিকে ভাঁজ করে এগিয়ে দিয়ে ডক্টর নাগ বললেন, অফ হ্যান্ড বলা মুশকিল, আপনারা ওঁকে ইমিডিয়েটলি একবার ট্রপিক্যালে নিয়ে যান। ওরা কারেক্ট ডায়োগনিসিস করবে। তবে আমার মনে হয় ওরা আমাকেই সমর্থন করবে। তারপর দাদুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তো বাইরে থাকেন, না? তা যে ওষুধ ইঞ্জেকশন দিলাম এগুলো নিয়মিত ব্যবহার করুন, ঠিক হয়ে যাবে। তবে কলকাতায় আর বেশিদিন থাকা বোধহয় উচিত। হবে না। বাইরের জলহাওয়া শরীরকে অনেকখানি হেল্প করে।

হঠাৎ বিজন দেখল দীপার হাত থরথর করে কাঁপছে। ওর মুখ সাদা হয়ে গেছে হঠাৎ, চোখ বন্ধ করে ফেলেছে ও, নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে প্রাণপণে। দাদুও লক্ষ করছেন ব্যাপারটা। বিজন কিছু বলার আগেই জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে দিদিমণি?

হঠাৎ দীপা একদম শান্ত হয়ে গেল, বিজনের দিকে একবার তাকিয়ে দাদুকে বলল, কিছু না, আপনি এবার চলুন, অনেকে অপেক্ষা করছে।

ওরা উঠে বাইরে বেরিয়ে এল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে দাদু জিজ্ঞাসা করলেন, আমার কী হয়েছে? ডাক্তার কী বললেন?

তেমন কিছু নয়। দীপা মুখ ফিরিয়ে নিল।

নিচের ফুটপাথে আসতেই ওরা আকস্মিকভাবে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল। কোনও পেসেন্ট হয়তো এইমাত্র এল ট্যাক্সিটায়। দাদুকে নিয়ে দীপা পেছনে বসল, বিজন সামনে। ট্যাক্সিওয়ালা কোথায় যাবে জিজ্ঞাসা করায় দাদু বলল, বাড়ি ফিরে চল বিজু, কালীঘাট না হয় অন্যদিন হবে।

বিজন ঘুরে বসে হাত বাড়াল দীপার দিকে, প্রেসক্রিপশনটা দাও। ব্যাগ খুলে প্রেসক্রিপশনটা নিস্পৃহের মতো এগিয়ে দিল দীপা। বিজন সামনের দিকে ফিরে বসে ড্যাশবোর্ডের আলোয়

কাগজের ভাঁজ খুলে ধরল। ডাক্তাররা যে কেন হাতের লেখাগুলো ভালো করে না! ও আজ অবধি যত হাতের লেখা দেখেছে তার মধ্যে বোধহয় ডক্টর নাগের হাতের লেখাই সবচেয়ে খারাপ। গাড়িটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতে ও মুখ তুলে তাকাতেই বোম্বাইয়ের একজন নায়িকাকে খুব লাস্য মাখানো চোখে ওর দিকে তাকাতে দেখল। সিনেমা হলের সামনে লোক গিজগিজ করছে। সামনে সারিবদ্ধ গাড়ি। সিনেমা হলের আলোয় প্রেসক্রিপশনটা পড়তে লাগল বিজন।

মুহূর্তে বুকের মধ্যে ধক করে উঠল ওর। সমস্ত শরীর জুড়ে একটা হিমস্রোত চলকে-চলকে উঠল যেন। শব্দ দুটোর ওপর চোখ রেখে ওর চোখ ফেটে জল এসে গেল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে বিজন পাথরের মতো বসে রইল। এখন ট্যাক্সিটা চলছে। ধর্মতলা স্ট্রিটের দু-পাশের জনতা দোকানপাট বিজনের চোখে কোনও কিছুর ছায়া পড়ছিল না। শুধু বুকের মধ্যে শব্দ দুটো ক্রমশ ওজন বাড়িয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। প্রেসক্রিপশনটা আবার একবার দেখে ভাঁজ করে ফেলল বিজন। ডক্টর নাগ তাঁর স্নেহময় গলায় শব্দ দুটো কিভাবে উচ্চারণ করতেন? কেমন লাগত শুনতে–ড্রাই লেপ্রসি!

এই সময় দাদুর গলা শুনতে পেল বিজন, প্রেসক্রিপশনে কী লিখেছে বিজু? বিজন মুখ তুলে। সামনের দিকে তাকাল। ড্রাইভারের সামনে রাখা আয়নায় ও হঠাৎ দাদুকে দেখতে পেল। দুটো হাতে লাঠিটা মুঠোয় ধরে তার ওপর গাল চেপে দাদু আয়নাটার দিকে চেয়ে বিজনের মুখ দেখছেন। চোখাচোখি হতে চোখ সরিয়ে নিল বিজন। দাদু বললেন, কুষ্ঠ হলে শুনেছি শরীরের সাড় চলে যায়, তবে কি আমার কুষ্ঠ হয়েছে?

দাদুর গলার স্বরের মধ্যে এমন কিছু ছিল, বিজন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। দুহাতে মুখ ঢেকে বাচ্চা ছেলের মতো হু-হুঁ করে কেঁদে ফেলল ও।

অনেকক্ষণ দাদু কিছু কথা বললেন না। কান্না একটু সামলালে বিজন শুনতে পেল, দিদিমণি, আমার কান নাক কি ফুলে গেছে মনে হচ্ছে, লালচে-লালচে লাগছে?

কোনওরকমে দীপা বলল, আমার তো মনে হচ্ছে না।

শরীরটা সিটের ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে দাদু আপনমনে বললেন, এই এতগুলো বছর বেঁচে থাকলাম কি এই জন্যে।

ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে বিজন দেখল দাদু বেশ সোজা হয়ে লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে ওপরে উঠে যাচ্ছেন। পেছনে দীপা। এর আগে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অন্তত উনি দীপার হাত ধরতেন, নইলে হাঁটু কাঁপে, কিন্তু এখন তাঁকে আরও শক্ত মনে হল।

ওপরে এসে বিজন শোওয়ার ঘরে ঢুকল না। দীপা এসে বলল, দাদু একটু একা থাকতে চাইছেন। আর রাত্রে শুধু দুধ খেতে চাইছেন।

বিজন কিছু বলল না। দীপা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাথরুমে চলে গেল। ওর যাওয়ার ধরনটা ভালো লাগল না বিজনের।

বিজন জানালার পাশে বসে সিগারেট ধরাল। এখান থেকে সামনের পার্কের একটা কোণ দেখা যায়। ইলেকট্রিক আলোর তলায় বসে একটা ফুচকাওয়ালা ভিড় জমিয়ে বিক্রি করে যাচ্ছে। কয়েকজন পরিচিতমুখ বৃদ্ধ বেঞ্চিতে বসে। বাচ্চারা যে যার বাড়িতে ফিরে গেছে। পার্কটা এখন একদম শান্ত, চুপচাপ। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে একসময়  ঝাঁপসা হয়ে গেল পার্কটা, ও যেন স্পষ্ট দেখতে পেল লাঠি হাতে দাদু দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন আর সাত বছরের ছোট্ট বিজন দৌড়ে দৌড়ে তাঁর সঙ্গে তাল রাখতে চাইছে। দাদুর কথা মনে হলেই এই ছবিটা ওর সামনে চলে আসে। আরও ছোটবেলায় দাদুর গায়ের গন্ধ না পেলে ওর ঘুম আসত না। মানুষ তার ছেলেবেলার কোন সময় অবধি স্মৃতিতে রাখতে পারে? বিজন খুব  ঝাঁপসাভাবে একটা দৃশ্য দেখে, সে দাদুর কোলে বসে আছে, সামনে থালায় অনেক কিছু সাজানো। দাদু হেসে উঠে বললেন, ও কলম ধরেছে, তার মানে লেখক হবে, রবিঠাকুর হবে। ওটা কি ওর অন্নপ্রাশনের ঘটনা? তা কি মনে রাখা যায়? কিন্তু ও জানে দাদুর সামনে দাঁড়ালে দাদু ওর মনের প্রত্যেকটা স্তর চিনতে পারেন। যেমন চোখ বন্ধ করে কোনও রাজমিস্ত্রি নিজের হাতে গড়া চারতলা বাড়ির প্রতিটি ইট চিনে নিতে পারবে। দীপাকে বিয়ে করার সময় এই মানুষটি তার বিরাট হাত দিয়ে সমস্ত বাধা আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলেন।

কুষ্ঠ হলে মানুষ মারা যায়? নিশ্চয়ই যেত কখনও। কিন্তু এখন, এখন তো কত ওষুধ বেরিয়েছে। ওর মনে আছে একবার দাদুর সঙ্গে বর্ষাকালে তিস্তা পেরুচ্ছিল বিজন। নৌকোয় গাদাগাদি করে মানুষ বসে। মাথার ওপর বর্ষার মেঘ ঝুলে আছে। ভিজে হাওয়ার দাপটে ছুটন্ত ঢেউগুলোর ফাঁক। দিয়ে নৌকো নিয়ে যাচ্ছিল মাঝি। যাত্রীরা কেউ কথা বলছিল না। মাঝে মাঝে বুড়ো হলের মাঝি আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠছিল, তিস্তা মাইকি জয়! টলমলে নৌকোয় দাদুর কোমর জড়িয়ে বসেছিল বিজন। বুকের মধ্যে শিরশিরানি ভয়। হঠাৎ নৌকোটা খুব বড় একটা ঢেউ-এর মাথায় চড়ে বসে প্রায় কাত হয়ে পড়ল। অনেকখানি জল ছিটকে এল ওদের গায়ে। গেল-গেল চিল্কারের সঙ্গে বিজন দেখল একটা লোক তাদের পিছন থেকে ঝুপ করে জলে পড়ে গেল, আর একটু হলেই নৌকোর তলায় চলে যেত সে, দাদু চকিতে হাত বাড়িয়ে তার জামা ধরে ফেললেন। তারপর অনেক কষ্টে যখন তাকে ওপরে টেনে আনলেন দাদু, তখন শিউরে উঠেছিল বিজন। লোকটার নাক কান গলে গেছে। মাথায় চুল নেই। আঙুল না থাকায় নৌকো ধরে বসতে পারেনি। ওর মনে পড়ল নৌকোতে ওঠার সময় সে ঘোমটা দিয়ে বসেছিল। বোধ হয় কাউকে নিজের চেহারা দেখাতে চায়নি। আর দাদু যখন তাকে টেনে তুলেছিলেন তখন কেউ তার সাহায্যে হাত বাড়াতে চায়নি। তিস্তার জলে হাত ধুয়ে দাদু বলেছিলেন, মহাপাপের ফল কি এত তাড়াতাড়ি মেটানো যায়!

কথাটার মানে তখন বোঝেনি বিজন। এখন এই সন্ধেবেলায় পার্কের ওপাশে বাড়িগুলোর মাথায় আসা চাঁদের দিকে তাকিয়ে সেই লোকটাকে পরিষ্কার মনে পড়ে গেল। এখন ও জানে কুষ্ঠ কোনও মহাপাপের ফল নয়। কিন্তু দাদু তখন কথাটা কী বিশ্বাসে বলেছিলেন? এই পৃথিবীতে ঈশ্বরের সৃষ্টি করা শরীর নিয়ে যারা স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারে না তারা নিশ্চয়ই খুব দু:খী। কিন্তু যে কোনও ব্যতিক্রমের পেছনেই তো কারণ থাকে। দাদু কি তাকেই মহাপাপ বলেছিলেন? ও। হঠাৎ দেখতে পেল দাদু তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। দাদুর দিকে তাকিয়ে ও চোখ দুহাতে ঢেকে ফেলছে। ওঁর নাক নেই, কান নেই, হাতের আঙুল খসে গেছে। ঠোঁটের আড়াল না থাকায় দাঁতগুলো বীভৎস লাগছে, দাদু বলছেন, চলো হে, সূর্যপ্রণাম করে আসি।

খুট করে আলোটা জ্বলে উঠতে চমকে উঠল বিজন। দীপা ঘরে এসেছে কখন, অন্ধকারে বসে আছ?

বিজন দেখল, দীপার চেহারাটা একদম পালটে গেছে এই কয় ঘণ্টায়। এবং এতক্ষণ পরে এই প্রথম দীপার পেটের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ নাড়া খেল ও। ডক্টর নাগ প্রেসক্রিপশনে আন্ডারলাইন করে লিখেছেন, একদম সংক্রামক নয়। কিন্তু কিছু কি বলা যায়?

খুব আস্তে-আস্তেবিজন বলল, কি যে হয়ে গেল!

দীপা বলল, একা বসে থেকো না। দাদু না চাইলেও তোমার ও-ঘরে যাওয়া উচিত। আমি ওঁর দুধ নিয়ে যাচ্ছি। তুমি নিজেকে শক্ত করো।

দীপা চলে গেলে বিজন দাদুর ঘরে এল। দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখতে পেল জানালার ধারে চেয়ারে দাদু বসে আছেন। মুখ বাইরের দিকে ফেরানো। পায়ের শব্দে মুখ ফেরালেন, কে বিজু, এসো। না, না বিজু তুমি খাটে বসো না।

প্রায় একটা চাপা আর্তনাদ করল বিজন, দাদু!

আমি চলে গেলে এই ঘর হোয়াইটওয়াশ করে নিলে ভালো করবে। বিছানার চাদর-টাদরগুলো ফেলে দিলে ভালোই, নইলে লাইজলে ধুয়ে নিও। ধোপার বাড়ি দিও না। আর কাল সকালে গিয়ে শিলিগুঁড়ির টিকিট কিনে এনো। ট্রেনে না পাও প্লেনে। আমি টাকা দেব। দাদু খুব স্পষ্ট গলায় কথাগুলো বলে গেলেন।

কালই চলে যাবেন? কথাটা বলতে গিয়ে বিজন চমকে উঠল। ও কি মনে-মনে দাদুর চলে যাওয়া চাইছে? নইলে প্রশ্নটা করার সময় হঠাৎ এক ধরনের স্বস্তি চলকে উঠল কেন ওর মনে? নিজেকে এই মুহূর্তে ভীষণ ছোট মনে হল ওর।

দাদু ওর মুখের দিকে তাকালেন, হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমার শিলিগুঁড়িতে যাওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু ডাক্তার তো আপনাকে ট্রপিক্যালে দেখাতে বলেছে। ওখানে দেখানোর আগে আপনার অসুখটা সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বিজন বলল।

দাদু হাসলেন, ধরো তোমার ট্রপিক্যাল পরীক্ষা করে বলল এটা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের লেপ্রসি, ভীষণ সংক্রামক, তুমি কী করবে?

বিজন কোনও উত্তর দিল না। দাদু আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। এই কয়েক ঘণ্টায় মানুষটার চেহারা কেমন যেন বদলে গিয়েছে। ওদের বংশে নাকি এত দীর্ঘ সময় কেউ বাঁচেনি। বোটানিকসের সেই গাছটার মতো হয়ে গেল ব্যাপারটা। মূল শেকড় থেকে যে কাণ্ড বেরুল তার অজস্র শাখা এবং তা থেকে প্রশাখা–সবই মাটিতে শিকড় নামিয়ে দিয়ে মজবুত হল। এখন মূল শেকড়ে যখন ঘুণ ধরল, শুকিয়ে গেল, তখন তাকে চেনা গেল না, প্রয়োজন হল না।

হঠাৎ দাদু বললেন, বিজু, আমার জন্যে তোমার কষ্ট হচ্ছে?

উত্তর দিতে পারল না বিজন। এ কথা জোর করে চেঁচিয়ে বলা যায় না।

দ্যাখো, আমার এই শরীরটার বয়স তো অনেকদিন নব্বই পেরিয়ে গেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে আমি আমার শরীরটার কত রকম চেহারা দেখলাম। নিজের শরীরের জন্য এক সময়। ভীষণ মায়া হত। তারপর রোদ জল ঝড়ে এই শরীরটার ওপর শ্যাওলা পড়তে দেখলাম। তা সেটা বোধ হয় ষাট বছর বয়স হবে। দেখলাম শরীরের চামড়া কুঁচকে যাচ্ছে। হাতের গলিগুলো কেমন ঢিলে হয়ে গেল। তখন তুমি সেই চার বছরের বিজু। কচি-কচি হাত-পা, গাল টিপলেই রক্ত ছুটে আসে। তোমাকে বুকে নিয়ে যখন ঘুমোতাম তখন নিজের শরীরটার কথা মনে থাকত না আর। তোমাকে আমি একটু-একটু বড় করে তু লোম। নিজের কথা মনে থাকল না আর। অতীতের কথা ভাবলেই তো বর্তমানের জন্য কষ্ট হয়। আমার নিজের দশ-বারো বছরের চেহারাটার কথা মনে এলেই তোমার দিকে তাকাতাম। তুমি তো আমার শরীরের আদল পেয়েছ। আমার আপশোস থাকত না। শুনেছি সাধক যাঁরা, তাঁরা নিজের শরীর ছেড়ে অন্যের শরীরে প্রবেশ করে ঘুড়ে বেড়ান। আমার তো সে ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু মনে-মনে তোমার যৌবনকে আমার বলে ভাবতে একটুও কষ্ট হত না। এটা যে কি ধরনের তৃপ্তি তুমি বুঝবে না। এখন এই শরীরের জন্য আমার একটুও কষ্ট নেই। আমি তো বড়জোর দুতিন বছর বাঁচতাম। এই জীর্ণ। শরীরটায় কুষ্ঠ হোক আর নাই হোক কি এসে যায় তাতে! তুমি তো সুস্থ হয়ে বেঁচে আছ, বিজু তুমি বেঁচে থাকা মানেই আমার বেঁচে থাকা। একনাগাড়ে বলা কথাগুলো শেষদিকে যেন ভারী হয়ে আসতে লাগল। দাদু যেন ওজন বইতে না পেরে হাঁপাচ্ছিলেন। তারপর আবার বললেন, মনে করে কাল টিকিট নিয়ে এসো। শিলিগুঁড়িতে না গেলে আমি একটুও স্বস্তি পাচ্ছি না। বিজন। দেখল দীপা এক গ্লাস দুধ আর মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকছে। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল না বিজন।

মেঝেতে পাতা বিছানায় শোয়া কোনও ব্যাপার নয়, বিজন মড়ার মতো পড়েছিল। আজ রাত্রে ওর খাওয়া হয়নি তেমন, খাওয়ার ইচ্ছেটাই শরীরে ছিল না। দীপা কী করছে কে জানে। এখন রাত অনেকটা হবে। দীপা ওর দিকে পাশ ফিরে হাতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। বিজন। জানে দীপা ঘুমোয়নি। দাদুর ব্যাপার নিয়ে দীপা কোনও কথা বলছে না। অবশ্য আলাদা করে বলার মতো সময়ও পায়নি। বেচারা যে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে এটা বোঝা যায়। আজ রাত্রে দাদুর ঘা-টা ড্রেস করে মলম লাগিয়ে দেওয়া হল না। রোজ দীপাই করত। এমনিতেই ওর ঘেন্নাপিত্তি কম। আজ কি ওর খেয়াল হয়নি না সাহস পায়নি!

হঠাৎ দীপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কী হবে?

বিজন এইরকম প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করছিল, ধৎ, একটা ডাক্তার কোনও টেস্ট না করেই বলে দিল লেপ্রসি আর সত্যি হয়ে গেল–এটা কি সম্ভব! কত পরীক্ষা করে তবে বোঝা যায়, ডাক্তারটাকে আমার ভালো লাগছে না!

কিন্তু দাদু তো একদম নার্ভাস হলেন না। এমনকী আবার পরীক্ষা করাবার কোনও আগ্রহ নেই। আমার হঠাৎ মনে হল উনি জানতেন। দীপা বলল।

কি যা-তা বলছ? বিজন প্রতিবাদ করল, জেনে-শুনে কি উনি আমার কাছে আসবেন! দীপা কোনও উত্তর দিল না প্রথমটায়, তারপর বলল, আমার বাড়ির লোকেরা কী ভাববে কে জানে! ডাক্তার নাগ কি না বলে ছাড়বেন!

এই ব্যাপারটা ভাবেনি বিজন। দীপার আত্মীয়স্বজন এমনকী বিজনের নিজের বাড়ির লোকেদের কী প্রতিক্রিয়া হবে? দাদুকে কি কাকারা একঘরে করে দেবে? নাকি কোনও হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে?

বিজন বলল, ডাক্তার তো বলেছে সংক্রামক নয়।

কেউ বিশ্বাস করে! চট করে জবাব দিল দীপা, আমার জন্যে নয়, এই পেটেরটার জন্যে ভয় হচ্ছে গো।

তুমি তো খুব শক্ত মেয়ে, এত ভয় পাও কেন? বিজন নিজের সঙ্গে যেন কথা বলল।

নিজের জন্যে আমি ভয় পাই না।

দাদু কালই চলে যেতে চাইছেন।

আমি আর পারছি না। তারপর ফিসফিস করে বলল, এ বাড়ি তুমি ছেড়ে দাও, এখানে থাকার সাহস আমার নেই।

বিজন এক হাত বাড়িয়ে দীপাকে জড়িয়ে ধরল। কেমন ঠান্ডা দীপার শরীর।

দীপা, তুমি খুব ভালো মেয়ে, প্লিজ, দাদু যেন না বুঝতে পারেন কিছু!

হঠাৎ দীপা বলল, আচ্ছা, দাদু এটাকে এত স্বাভাবিকভাবে নিলেন কেন?

বিজন বলল, একটা বয়সে এলে মানুষ সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নেয়।

অন্ধকারে মাথা নাড়ল দীপা, আমার মনে হল দাদু যেন জানতেন। কিছু মনে করো না, তোমাদের বংশে কি কারও কখনও এরকম হয়েছিল?

আমাদের বংশে? কথাটা বলে পাথরের মতো হয়ে গেল বিজন। সমস্ত শরীর নিরক্ত হয়ে গেল হঠাৎ। দীপা কি এটাকে বংশানুক্রমিক রোগ বলে ভাবছে? কোনওদিন কারও মুখে তো এই। রোগের কথা শোনেনি? এই রোগ রক্তের সঙ্গে মিশে থাকে? দীপার পেটে যে এসেছে তার কথা এই জন্যে ভাবছে দীপা?

বিজু, তুমি বেঁচে থাকা মানেই আমার বেঁচে থাকা। কথাটা হঠাৎ মনের মধ্যে ছুটে এল। বাড়ির লোকে বলত দাদুর সব কিছু নাকি ও পেয়েছে। সব কিছু?

দীপার শরীরের ওপর নিঃসাড়ে পড়ে থাকা হাতটা সরিয়ে আনল বিজন। তারপর জানালা দিয়ে চুঁইয়ে আসা জ্যোৎস্নায় চোখ রেখে বলল, আমি জানি না। তারপর জুড়ে দিল, এই প্রথম শুনলাম।

চুপচাপ শুয়ে থাকতে-থাকতে এক সময় বিজন বুঝল দীপা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর জন্যে খুব কষ্ট হল বিজনের। বেচারা এখনও ছেলেমানুষ। এই অবস্থায় পড়লে হয়তো বিজনও একই প্রশ্ন। করত। কাল দাদু চলে গেলে ঘরদোর লাইজলে ধুয়ে নিতে হবে। হেসে ফেলল বিজন, মানুষের মন কীভাবে ধুয়ে মুছে সাফ করা যায়!

শেষ পর্যন্ত ঘুম এল না ওর। বিজন জানালায় উঠে বসে সিগারেট ধরাল। জ্যোৎস্নার রং ফিকে হয়ে আসছে। সামনের পার্কটায় একটা ভিখিরি গোছের লোক কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। এখন কোথাও কোনও শব্দ নেই। কলকাতা মাঝে-মাঝে কেমন শান্ত হয়ে যায়। দীপার দিকে তাকাল। ও।  ঝাঁপসা অন্ধকারে ওকে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। ঘুম এল না বিজনের। দীপার। সমস্ত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ গায়ে মেখে-মেখে হাওয়ারা এবার বিজনকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যাওয়া আসা শুরু করল।

মাঝরাত্রি পেরোলে শব্দরা বড় শক্তিশালী হয়। খুট শব্দটা যত সতর্কেই হোক না কেন, বিজনের কান এড়াল না। কিন্তু এখন তো ঠিক মাঝরাত্তির নয়। বসে-বসে ঢুলুনি এসেছিল বিজনের, শব্দটা শুনে চটকা ভেঙে বাইরে তাকাল। আকাশের চেহারাটা দুহাতের মুঠোয় আদর করে ধরে রাখার মতন। দীপা এখনও ঘুমোচ্ছ সেই একই ভঙ্গিমায়। বিজন উঠে সন্তর্পণে দরজা খুলল। চোর ফোর আসতে পারে।

বাইরে পা বাড়াতেই থমকে দাঁড়াল ও। পাশের ঘরের দরজা সন্তর্পণে বন্ধ করছেন দাদু। এই  ঝাঁপসা অন্ধকারেও ওঁর সাদা পাঞ্জাবি দেখা যাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়াতেই বিজনের সঙ্গে চোখাচোখি হল ওঁর। লাঠিটা মাটি থেকে সামান্য ওপরে তুলে এগিয়ে এলেন কয়েক পা, তোমার এখানে লাস্ট মর্নিং ওয়াকটা করেই আসি, কি বলো?

বিজন ভাবতে পারেনি আজ, কালকের ওই ঘটনার পর দাদু এত সহজে মর্নিং ওয়াক করতে বেরুতে পারেন। ও অবাক হয়ে তাকাতে গিয়ে লাস্ট শব্দটার কথা ভাবল। দাদু আজ চলে যাবেন। বলে কি লাস্ট মর্নিং ওয়াকের কথা বললেন? নাকি আত্মহত্যার নিজেকে শেষ করে দেবেন। বলে এমন চোরের মতো বেরিয়ে যাচ্ছিলেন!

বিজন বলল, এখনও তো ভোর হয়নি!

দেরিও নেই। তুমি আমাকে রাত চিনিও না। বাইরের দরজার কাছে এগিয়ে দাঁড়ালেন দাদু, দিদিমণিকে আজ আর কষ্ট দিও না। আমি একাই ঘুরে আসি।

দাদুকে দরজা খুলে সিঁড়িতে দাঁড়াতে দেখে বিজন বাইরে বেরিয়ে এল।

বাইরে থেকে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল ও, আমি আপনার সঙ্গে যাব।

সে কি! দরজা খোলা রইল, দিদিমণি একা থাকতে–

কিছু হবে না।

তা ছাড়া তোমার অভ্যেস নেই–।

চলুন। দাদুর কনুই ধরল বিজন।

এখন সিঁড়িতে বেশ অন্ধকার। অত্যন্ত সাবধানে পায়ে-পায়ে দাদুকে নিচে নামিয়ে আনল বিজন।

রাস্তায় এখন ঠান্ডা হাওয়া বইছে। চারধারের বাড়িগুলো ভীষণরকম চুপচাপ। পার্কের ঘাসে ইলেকট্রিক আলো ক্যাটকেটে হলদে নিয়ে মুখথুবড়ে আছে। এত ভোরে অনেকদিন ওঠা অভ্যেস নেই ওর। অবশ্য আজকে ঠিক ওঠা বলা যায় না।

দাদু বললেন, এসো, এই রাস্তায় পায়চারি করি।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল বিজন, দাদু, আজ নদীর ধারে যাব।

নদী! বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকালেন, সে কত দূর?

বেশিদূর না। আমি অবশ্য কোনওদিন যাইনি। বিজন দাদুকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। পালাপার্বণের দিন এই রাস্তা দিয়ে মেয়েদের গঙ্গাস্নানে যেতে দেখেছে ও।

বিজন সামনে হেঁটে যাচ্ছে, পেছনে লাঠি হাতে দাদু। ফুটপাথে লাঠির শব্দ উঠছে। এই নির্জন শেষরাত্রে শব্দটা শুনতে-শুনতে বিজন হাঁটছিল। বড় রাস্তায় এসে একটা রিকশাওয়ালাকে দেখতে পেল বিজন। কেমন হেলতে-দুলতে যাচ্ছে। যাওয়া-আসার কড়ারে ওর রিকশা নিল ও। বাড়ি। ফিরে ভাড়া দেবে। দিনের প্রথম সওয়ারি নিয়ে রিকশা ছুটছিল গঙ্গার দিকে। রাস্তায় এখন দু-একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারের চুবড়িটা এখনও উপুড় করা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিজনের বুকের মধ্যে হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল। এই আকাশটাকে অনেকদিন দেখেনি ও। সেই বাল্যকালে অথবা কৈশোরে মহানন্দার ধার দিয়ে দাদুর পেছন-পেছন ছুটে যেতে-যেতে ওই আকাশটাকে দেখতে পেত ও।

গঙ্গার পাড়ে এসে ওরা রিকশা থেকে নামল। দাদু বললেন, বাঃ। একবুক শান্তির মতো এপার ওপার জুড়ে থাকা জলেরা ঢেউ তুলে-তুলে যায়। বিজন দেখল দাদু বেশ শক্ত মানুষের মতো। লাঠি দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন নদীর পাড় ধরে। বিজন তাল রাখতে পারছিল না। সেই ছোটবেলায় যেমনটি হত। আকাশ রং পালটে যাচ্ছে এখন। পুবদিকটা সদ্য জন্মানো বাচ্চার মতো লাল। হাতের মুঠো খুলছে। খানিক বাদেই মুঠো-মুঠো সোনা ছুঁড়ে-ছুঁড়ে দেবে আকাশময়। সেই বাহ্মমুহূর্তে দাদু দাঁড়িয়ে গেলেন পুবমুখখা। বিজন জানে এখন সূর্যস্তোত্র পাঠ করবেন তিনি।

বিজন দেখল, নদীর শরীর থেকে এখন ধোঁয়ারা সুতোর মতো উঠে যাচ্ছে না আকাশের দিকে, যেমনটি মহানন্দায় হত। হয়তো সব নদীর চরিত্র সমান নয় অথবা এখন সেই ঋতু নয়। হঠাৎ ও শুনল দাদু ডাকছেন, বিজু! দুহাতের মুঠোয় লাঠিটাকে ধরে দাদু বললেন, দেখছ, রাতটা কেমন খসে-খসে পড়ছে! আমরা বলি ভোর হচ্ছে। আমার শরীর যদি খসে-খসে পড়ে তখন তুমি

কী বলবে বিজু! বড় ভার জমে যাচ্ছে ভাই। এই এতগুলো বছরের ভার। তবু তো অভিজ্ঞতার শেষ হয় না। তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি, আমার এতগুলো বছর শুধু তোমাকে দিয়ে গেলাম। আমায় তো কেউ দেয়নি।

সোনার কড়াইটার এখন উপুড় হয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। জলের ওপর কচি কলাপাতার ছায়া মাখামাখি হতে শুরু হল। দাদু বললেন, গায়েমুখে রোদ মাখো বিজু, এই রোদে কখনও ঘাম হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *