দিন-দুপুরে – বুদ্ধদেব বসু
হাজরা রোডের মোড়ে ট্রামের জন্য দাঁড়িয়ে আছি, বেলা দুপুর। বালিগঞ্জের ট্রাম আর আসে না, এদিকে ভাদ্রমাসের রোদ্দুর পিঠে চড় চড় করে ফুটছে আলপিনের মতো। ওই এতক্ষণে কালীঘাটের পুল থেকে আস্তে আস্তে নামতে দেখা যাচ্ছে শ্রীযুক্ত ট্রামকে।
এমন সময় রাস্তা পার হয়ে ছোটো একটি মেয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনি কি ডাক্তার?’
ভাবতেই পারিনি মেয়েটি আমাকে কিছু বলছে, তাই কথাটা শুনেও গ্রাহ্য করলুম না। কিন্তু পরমুহূর্তেই মেয়েটি সোজা আমারই মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন, আপনি কি ডাক্তার?’
খুব অবাক হলুম, একটু যেন খুশিও—’কী করে বুঝলে?’
‘ওই যে আপনার পকেটে বুক দেখার যন্ত্র। দেখুন, আমার মা—র বড়ো অসুখ, আপনি কি একবার একটু দেখে যাবেন?’
মেয়েটি এমনভাবে কথাটা বলল যেন এটা মোটেও অদ্ভুত কি অসাধারণ কিছু নয়। আমি তো কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। এদিকে ট্রাম এসে গেছে, একটা ট্রাম ফসকালে এই দারুণ রোদ্দুরে আবার হয়তো পনেরো মিনিটের ধাক্কা।
মেয়েটি ভাঙা—ভাঙা গলায় কাতরভাবে আবার বলল, ‘চলুন না, যাবেন?’
ওসব কথায় কান না দিয়ে ট্রামে উঠে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হত সন্দেহ নেই, কিন্তু কেমন দোটানার মধ্যে পড়ে গিয়ে পা বাড়াতেই পারলাম না। ট্রামটা মোড় ঘুরে আমার চোখের ওপর দিয়ে ঘটর ঘটর করতে করতে বেরিয়ে গেল।
‘কোথায় তোমার বাড়ি?’
‘চেতলায়— এই কাছেই।’
‘কী হয়েছে তোমার মা—র?’
‘কী হয়েছে, জানি না তো। বড়ো অসুখ।’
‘কদ্দিন অসুখ?’
‘অনেক দিন। ডাক্তারবাবু, আপনি যাবেন তো?’
মেয়েটির ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেমন মায়া হল। ভাবলুম যাই না, দেখে আসি ব্যাপারটা।
‘ডাক্তারবাবু, আপনাকে তো টাকা দিতে পারব না’— মেয়েটি আরও কী বলতে গিয়ে ঢোক গিলে থেমে গেল।
‘আচ্ছা আচ্ছা, সেজন্য ভেবো না’, আমি তাড়াতাড়ি বললুম।
নতুন পাশ করে বেরিয়েছি, আত্মীয় বন্ধুমহলে ডাক—খোঁজ পড়ে মাঝে মাঝে, কিন্তু ভিজিট দশ টাকা যে মাসে পাই, সেই মাসেই খুব খুশি। এই তো বন্ধুর ছেলের নিরানব্বুই বুঝি জ্বর হয়েছে, ট্রামের পয়সা খরচ করে এসে তার প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে এতক্ষণ আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরছিলুম। তবু এই মেয়েটি যা হোক টাকার কথাটা মুখে আনল।
হেঁটে চললুম মেয়েটির সঙ্গে কালীঘাট পুলের দিকে। জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোমার মাকে আর কোনো ডাক্তার দেখেননি?’
‘ডাক্তার? না। মা বলেন, ডাক্তার দিয়ে কী হবে, এমনিই আমি ভালো হয়ে যাব। টাকা পাব কোথায়—’
‘তুমি কি আজ ডাক্তার খুঁজতেই বেরিয়েছিলে? আর কেউ নেই তোমার বাড়িতে?’
‘নাঃ, কে আর থাকবে? এক দাদা ছিল আমার, সে তো চটকলে কাজ করতে গিয়ে রেলে কাটা পড়ল। সেই থেকে আমি আর মা। বেশ ছিলুম আমরা— এর মধ্যে কেন অসুখ করল মা—র? ডাক্তারবাবু মা কদ্দিনে ভালো হবেন?’
আমি ডাক্তারি ধরনে হেসে বললুম, ‘সে এখন কী করে বলি?’
‘ডাক্তারবাবু, আজ সকাল থেকে মা যেন কেমন হয়ে আছেন— একবারও চোখ মেলে তাকান না। দেখুন বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে এতদূরে এসেছি, যদি কোনো ডাক্তার খুঁজে পাই, যদি আমার ওপর কোনো ডাক্তার দয়া করেন। ওই তো সব ওষুধের দোকান, ভেতরে পাতলুন পরা ডাক্তাররা বসে— আমার তো সাহস হয় না ভেতরে ঢুকতে। রাস্তার এদিক—ওদিক কেবলই ঘুরছি, এমন সময় আপনাকে দেখেই মনে হল আপনি আমাকে দয়া করবেন। মা সেরে উঠলে আপনি একদিন এসে খাবেন আমাদের বাড়ি। কী চমৎকার লাউয়ের পাতা দিয়ে মটরডাল রান্না করেন মা— ছি ছি, এটা কী বললুম, আপনারা কেন গরিবের বাড়িতে খেতে আসবেন? ডাক্তারবাবু, আপনার দয়া আমি কোনোদিন ভুলবো না।’
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?’
‘কিছু না। চলো।’
মুখে বললুম বটে, কিন্তু কালীঘাট পুল পর্যন্ত আসতে আসতেই মনে হতে লাগল এই মহৎ কাজের ভারটা না নিলেই পারতুম। এমন কত গরিব দুঃখী আছে। বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে ধুঁকতে মরছে, না খেয়ে তাদের সবার উপকার করতে গেলে নিজেরই—
পুল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলুম, ‘আর কতদূর?’
আমার প্রশ্নে নিতান্ত ব্যাকুল হয়ে মেয়েটি বললে, ‘এই তো— আর একটুখানি। আমার পয়সা নেই, তা হলে নিশ্চয়ই আপনাকে গাড়ি করে নিতুম। ওঃ, কত কষ্ট হল আপনার।’
‘বাঃ, এইটুকু হাঁটতে পারব না?’
অনেক গলিঘুঁজি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলুম। কলকাতার এ অঞ্চলে কোনোদিন আর আসিনি। সত্য বলতে, জায়গাটা ঠিক কলকাতাই নয়। একেবারেই পাড়া গাঁ, পুকুর, বন—জঙ্গল, কিছু পাকা বাড়ি, কিছু বা খড়ের ঘর। একটা অতি জীর্ণ শ্যাওলা ধরা, চুন বালি খসে পড়া একতলা পাকাবাড়ির সামনে মেয়েটি এসে বলল, ‘এই।’
ভিতরে ঢুকে দেখি, মেঝের ওপর মলিন বিছানায় একজন স্ত্রীলোক নিঃসাড় হয়ে শুয়ে আছে। চোখ তার আধো বোজা। খানিক পর—পর নিশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে।
মেয়েটি তার কানের কাছ মুখ নিয়ে ডাকলে, ‘মা মা।’
কোনো জবাব এল না।
‘মা মা, তোমার জন্য ডাক্তার নিয়ে এসেছি, চেয়ে দেখো। মা, এই ডাক্তারবাবু তোমাকে ভালো করবেন।’
চোখ দুটো একবার পলকের জন্য খুলেই আবার বুজে এল, একখানা হাত বুঝি একটু ওঠাবার চেষ্টা করল, অস্ফুট একটু আওয়াজ হয়তো বেরোলো গলা দিয়ে।
মেয়েটি বলল, ‘ডাক্তারবাবু, ভালো করে দেখুন, মাকে আজই ভালো করে দিন।’
কিছু দেখবার ছিল না। আর একটু পরেই নাভিশ্বাস শুরু হবে। তবু আমরা সব সময় একবার শেষ চেষ্টা করে থাকি।
তাড়াতাড়ি বললুম, ‘তুমি একটু বসো, আমি আসছি।’
মেয়েটি বলল, ‘ডক্তারবাবু, আপনি আবার আসবেন তো? আমার মা ভালো হবেন তো?’
‘এক্ষুনি আসছি ওষুধ নিয়ে,’ বলে আমি বেরিয়ে গেলুম।
ফেরবার সময় রাস্তাটা বোধ হয় একটু গোলমাল হয়েছিল। একটু ঘুর পথে এসে সেই বাড়ির সামনে দাঁড়ালুম। রোদ্দুরে ছুটোছুটি করে তখন আমি কানে পি পি আওয়াজ শুনছি। কিন্তু ডাক্তারের নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভাববার তখন সময় নয়। ভিতরে ঢুকতে ঠিক যেন পা সরছিল না, কে জানে গিয়ে কী দেখব। দরজাটা খোলা দেখে ঢুকলুম, কিন্তু ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম।
তবে কি আমি ভুল বাড়িতে এলুম? না, ওই তো সেই পুকুর, সেই সুরকির রাস্তা, ওই সুপারিগাছ। দেড় ঘণ্টা আগে এই ঘরটাতেই তো এসেছিলুম মেয়েটির সঙ্গে, কিন্তু মেয়েটি কোথায় তার মুমূর্ষু মা—ই বা কোথায় গেল? ঘরে জিনিসপত্র অবশ্য খুব কমই ছিল, কিন্তু যে ক—টা ছিল, সে ক—টাই বা কোথায়?
তবে কি ওর মা এর মধ্যেই মারা গেল, আর ওর মাকে নিয়ে চলে গেল কেওড়াতলাতে? এত অল্প সময়ের মধ্যে কী করে হতে পারে? ঘরে জিনিসপত্র অবশ্য কমই ছিল, একটা লন্ঠন, দু—একটা থালা—বাটি, সেগুলো…?
আস্তে আস্তে আমি বাইরে এসে দাঁড়ালুম। তবে কি সমস্ত জিনিসটাই আমার চোখের ভুল… মনের ভুল? এই রোদ্দুরে কি আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল? এই তো আমি ঠিক দাঁড়িয়ে, আমার পকেটে ইনজেকশন, সব ঠিক আছে— নাকি আমি ভুল করে অন্য বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছি?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। মাথার ওপরে যে আগুন ঝরছে সে খেয়ালও নেই। চারদিকে ছবির মতো সব চুপচাপ। হঠাৎ দেখি টাকপড়া একটি আধ—বয়সি লোক আমার পাশে এসে কখন দাঁড়িয়েছে। কোনোখানে কেউ ছিল না, হঠাৎ কি লোকটা মাটি ফুঁড়ে উঠে এল? তার দিকে তাকাতেই সে বলল, ‘কি মশাই বাড়িখানা কিনবেন নাকি?’
‘আপনার বাড়ি বুঝি?’
লোকটা ঠোঁট উলটিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আইনত আমারই। কপালে দুর্ভোগ থাকলে খণ্ডাবে কে? কোথাকার এক বিধবা পিসি, জন্মে দু—বার চোখে দেখিনি মশাই— সংসারে কেউ কোনোখানে নেই। আইনের প্যাঁচে ঘুরতে ঘুরতে বাড়িখানা এসে পড়ল আমারই ঘাড়ে, আর বলেন কেন, এমন কপাল নিয়েও আসে মানুষ। পিসে টেসলেন তিরিশ বছরে, কুড়ি বছরের ছেলেটা রেলে কাটা পড়ল। পিসি যখন স্বগগে গেলেন, ভাবলুম ভালোই হল। একটা মেয়ে ছিল— ‘হঠাৎ থেমে গিয়ে অন্যরকম সুরে লোকটা বলল, ‘ওসব লোকের কথায় কান দেবেন না মশাই, একদম বাজে কথা।’
আমি কথা বলার জন্য হাঁ করলুম, কিন্তু আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবার আগেই লোকটা বলে চলল, ‘ওই তো এক ফোঁটা বারো বছরের মেয়ে, তা মা—টা যেদিন অক্কা পেল, পরদিন ও দিব্যি কড়িকাঠ থেকে ঝুলো পড়ল। একখানাই শাড়ি ছিল পরনে, সেটা দিয়ে কর্ম সারল। কী ডেঁপো মেয়ে মশাই! থাকলে আমরা একটা বিয়ে—টিয়ে দিয়ে দিতুম। বাড়িখানা ছিল তিন পুরুষের, একরকম চলে যেত। তা লোকে যা বলে সব বাজে কথা মশাই— হ্যাঁ, ভূত না হাতি! আপনি তো এডুকেটেড লোক, আপনিই বলুন, এসব কথায় কি কান দিতে আছে? নিতে চান তো বাড়িটা খুব সস্তায় ছাড়তে পারি। সবসুদ্ধ পাঁচশো টাকা। আচ্ছা, হরে দরে চারশোই দেবেন, যান। জলের দলে পাচ্ছেন, জমিটুকু তো রইল, আপনি ইচ্ছেমতো বাড়ি তৈরি করে নেবেন।’
অতি ক্ষীণস্বরে আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘ক—দিনের কথা এটা?’
‘কোনটা? এই পিসির… তা দু—বছর হবে। পিসির জন্য কোনো ভাবনা ছিল না মশাই, মেয়েটার জন্য বাড়িটার এমন বদনাম হয়েছে যে, পাঁচ টাকাতেও কেউ ভাড়া নেয় না। এদিকে ট্যাক্সো তো গুণতে হচ্ছে আমাকেই। কী বিপদে পড়েছি, গিলতেও পারি নে, উগরাতেও পারি নে। আমি গরিব মানুষ আমার ওপরে এ জুলুম কেন? থাকি কাঁচড়াপাড়ায়। রোজ রোজ এসে যে তদবির করব তারও উপায় নেই। আপনি নিন না বাড়িটা কিনে। আচ্ছা, কী দেবেন আপনিই বলুন… বলুন না।’