1 of 2

দিনকাল – রমাপদ চৌধুরী

দিনকাল – রমাপদ চৌধুরী

আমাদের বড় মেয়েকে নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। সে একটু ঠাণ্ডা প্রকৃতির, ছেলেবেলা থেকেই একটু বেশি লাজুক, এবং আমাদের দু’জনেরই খুব বাধ্য ছিল। তার বি এস-সি পরীক্ষার ফল বের হওয়ার আগেই হঠাৎ একটি ভাল যোগাযোগ হয়ে গেল, অরুণা বললে ছেলেটি চমৎকার, তার বাড়ির পরিবেশটিও আমার পছন্দ হয়েছিল, আমি অরুণার সামনেই একদিন রুবিকে ডেকে জিগ্যেস করলাম, এ বিয়েতে তোর মত আছে তো রুবি? রুবি বিষম লজ্জিত মুখ করে আমার সামনে থেকে পালিয়ে গেল। পরে অরুণার কাছে শুনলাম সে নাকি বলেছে, আমার আবার মত কি, মেয়ের কিসে ভাল বাবা-মা ছাড়া আর কেউ বোঝে নাকি! শুনে আমার সত্যি খুব ভাল লেগেছিল। সৌভাগ্য আমাদের, ওরা সুখী হয়েছে।

আমার একমাত্র ছেলে অন্তুর বয়েস এখন একুশ। অন্তুর ভাল নাম নিরুপম। ও যখন স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকলো তখন ওকে দেখে নিতান্তই বালক মনে হতো। অন্তু কখনো কখনো আমাদের লুকিয়ে চুলকাটার সেলুনে দাড়ি কামিয়ে আসতো, আমরা বুঝতে পারতাম, এবং ওর এই বড় হওয়ার চেষ্টা দেখে আমি ও অরুণা চোখাচোখি ভাবে নিঃশব্দে হাসতাম। ঐ বয়েস তো একদিন আমারও ছিল, তখন কি করে যে নিজেকে পূর্ণবয়স্ক যুবক ভাবতাম জানি না। আমার যতদূর মনে পড়ে প্রায় ঐ বয়সেই আমি প্রথম প্রেমে পড়ি। এবং সেটাই আমার জীবনের প্রথম ও শেষ প্রেম। সে-সব দিনের কথা অরুণা কিছুই জানে না, জানলেও ও খুব একটা বিচলিত হতো বলে মনে হয় না। তবু আমার সেই কলেজ-জীবনের পরিচ্ছন্ন প্রেমটুকুকে বিশুদ্ধ রাখার জন্যেই অরুণার কাছে তার কোন আভাস কোনদিনই দিইনি। এমনকি আমার কখনো কখনো মনে হয়েছে সেই পরম বঞ্চনা ও চরম আঘাতের কথা কাউকে বলতে গেলে এই বাহান্ন বছর বয়সেও হয়তো আমার চোখের পাতা ভিজে যেতে পারে।

অন্তুকে নিয়ে সে-জন্যেই আমার দুর্ভাবনার শেষ ছিল না। যৌবনের সেই হঠকারিতার পর থেকে প্রেম আমার কাছে একটি বিভীষিকা। তিরিশ-বত্রিশ বছর কেটে গেছে, সমস্ত স্মৃতি এখন ঝাপসা, কিন্তু প্রেমের মধ্যে, বিশেষ করে ব্যর্থপ্রেমের মধ্যে কি অসহনীয় কষ্ট, কি দুরন্ত জ্বালা, তা আমার আজও মনে আছে। আছে বলেই অন্তুকে নিয়ে আমার এত ভাবনা।

রুবি, অন্তুর চেয়ে দু বছরের বড়। তার ফলে রুবির সঙ্গে কলেজে যে মেয়েরা পড়তো তাদের দু-একজন আমাদের বাড়ি আসতো। তারা কিন্তু কেউই অন্তুকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনতো না। আমাদের কাছে অবশ্য সেটুকুই ছিল সান্ত্বনা। আমি হাসতে হাসতে অরুণাকে একদিন বলেছিলাম, ভাগ্যিস রুবি ওর ছোট বোন নয়। শুনে অরুণা অবাক হয়ে হেসে ফেলেছিল।—কি যে বলো, প্রেম কি আর সস্তা নাকি!

আমি বলতে পারতাম না যে প্রেম খুব সুলভ নয় বলেই আমার এত ভয়।

আসলে অন্তুকে আমরা দুজনেই যে খুব ভালবাসি, দু’জনেই যে তার জন্যে খুব গর্বিত, এটাই শেষ কথা নয়। আমরা তাকে রুবির মতই সুখী দেখতে চেয়েছিলাম। এবং প্রেম সম্পর্কে আমার নিজের আতঙ্ক আমি নিশ্চয়ই অন্তুর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইনি। আমি মনে মনে এমন একটা উদার চিন্তাকেও লালন করেছি যে অন্তু যদি কোন মেয়েকে ভালবাসে, তাকে বিয়ে করতে চায়, তা হলে আমি সম্মতি দেবো তো নিশ্চয়ই, এমনকি অরুণার মনে কোন দ্বিধা থাকলেও আমি তা দূর করে দেবো। প্রকৃতপক্ষে প্রেমে আমার কোন ভয় ছিল না, ভয় ছিল ব্যর্থপ্রেমে।

আমার সমবয়স্ক সহকর্মীদের কয়েকজনকে আমার রীতিমত বৃদ্ধ মনে হতো। অথচ আমি নিজে কিছুতেই আমার নিজের বয়েসকে অনুভব করতে পারতাম না। সেজন্য সমবয়স্কদের সঙ্গে আমার তেমন মেলামেশা ছিল না। তাদের আলোচনায় আমি কোনো আকর্ষণ বোধ করতাম না, তাদের সুখ-দুঃখ আমাকে স্পর্শ করতো না। কারণ চিন্তাভাবনা বা মানসিকতায় আমি এখনো যুবক। বাহান্ন বছরের যুবক। চাকরি থেকে অবসর নিতে আর ক’ বছর বাকি আছে সে হিসেব একদিন অন্যের মুখে শুনে আমি বিষণ্ণ বোধ করেছিলাম। তবে আমার সেই সহকর্মীর মত বিব্রত বোধ করি নি। কারণ লেখাপড়ায় অন্তু খুব উজ্জ্বল না হলেও তার পরীক্ষার ফল কখনো তার বুদ্ধিদীপ্ত মুখখানিকে আমার চোখে নিষ্প্রভ করে দেয় নি। অন্তু চিরকালই অত্যন্ত উৎফুল্ল চরিত্রের ছেলে। এবং অত্যন্ত কোমল স্বভাবের। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিব্রত হবার কারণ ছিল না।

পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অন্তু স্বাভাবিক ব্যবহার করতো। সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে কখনো কখনো সে রাস্তায় যখন কথা বলতে বা কোন বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করতো তখন তার মধ্যে কোন জড়তা থাকতো না। অল্প বয়স থেকেই সেই মেয়ে-কটির সঙ্গে সে বড় হয়েছে, রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছে, একদল হয়ে সরস্বতীপুজো করেছে। সুতরাং তাদের মধ্যে কারো সম্পর্কে অন্তুর কোন দুর্বলতা আছে কি না আমি অকারণেই কখনো কখনো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। কখনো মনে হয়েছে তেমন কোন সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পারলে আমি খুশিই হবো, অরুণার সঙ্গে ভাগাভাগি করে সেই মজাটুকু উপভোগ করবো।

অন্তু যেবার পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটে ভর্তি হলো সেই বছর আমি প্রথম নিজেকে একটু বয়স্ক মনে করতে পারলাম। রুবির বিয়ের সময় এই অনুভূতিটা আসেনি, বরং মনে হয়েছিল রুবির বিয়েটা আমাকে জোর করে বয়স্কদের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। কিন্তু ছেলে বড় হলে নিজেরই বুড়ো হতে ইচ্ছে করে।

একবার অরুণার সঙ্গে পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছিলাম, সঙ্গে অন্তু কিছুতেই যেতে চায় নি, তবু অরুণা তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল একালের জামাইদের পছন্দ জানতে এবং রুবির জন্য শাড়ি বাছার কাজে সাহায্য পাবে বলে। সেখানে ভিড়ের মধ্যে লাজুকভাবে ও যে-দুটি মেয়ের দিকে একপলক তাকিয়ে দেখেছিল আমি সে-দুটি মেয়েকে লক্ষ করেছিলাম। এবং অন্তুর রুচি ও পছন্দ দেখে খুশি হয়েছিলাম।

তাই প্রথম যেদিন ওর কাছে একটি টেলিফোন এলো, আমি ভয় পাই নি। ভীষণ মজা পেয়েছিলাম।

টেলিফোন তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই একটি মধুর মেয়েলি কণ্ঠ জিগ্যেস করলো, নিরুপম আছে?

আমি বললাম, না, সে একটু বাইরে গেছে, এক্ষুনি ফিরবে।

আমি প্রথমটা বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম। আমাদের সময়ে কোন মেয়ে এভাবে টেলিফোন করেনি। মেয়েদের গলা শোনার জন্যে অন্যের বাড়ি থেকে আমরা তিনটি বন্ধু একবার টেলিফোন এক্সচেঞ্জে সময় জানতে চেয়ে ফোন করেছিলাম, অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান অপারেটর মিষ্টি গলায় জবাব দিয়েছিল এটুকুই মনে আছে। সেকালে অটোমেটিক টেলিফোন ছিল না, অপারেটর বেশিরভাগই ছিল অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান।

যে মেয়েটি নিরুপমের খোঁজ করছিল, তার নাম জিগ্যেস করতে আমার সঙ্কোচ হলো, তা ছাড়া আমি একটু বেশি বেশি নরম গলায় উত্তর দিলাম। কারণ আমি শুনেছিলাম আজকাল ঐ বয়সের ছেলেদের অনেক মেয়ে বন্ধু থাকে, আমি বিস্মিত হয়েছি বা অপছন্দ করছি কোনক্রমে জানতে পারলে মেয়েটি নিশ্চয় কলেজে তা রাষ্ট্র করে নিরুপমকে লজ্জায় ফেলবে।

তাই আমি মেয়েটিকে জিগ্যেস করলাম, নিরুপম ফিরে এলে তাকে কি কিছু বলতে হবে?

মেয়েটি এক নিমেষের জন্যে কি যেন ভাবলো, তারপর বললে, না, আমিই আবার ফোন করবো।

মেয়েটি নাম বললো না বলেই আমার মনে ঈষৎ খটকা লাগলো।

কিছুক্ষণ বাদেই নিরুপম এলো। আমি সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করে বললাম, তোর ফোন এসেছিল, এখনি আবার রিং করবে বলেছে।

আমার মনে হলো নিরুপম একটু অস্বস্তি বোধ করলো।

মিনিট পনেরো বাদে টেলিফোন বেজে উঠলো আবার। নিরুপম রিসিভার তুললো। আমি সে-ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলাম, যাতে নিরুপম না মনে করে আমি তার দিকে কান পেতে আছি।

মেয়েটির এই ফোন করার ঘটনাটা আমার বাহান্ন বছরের মনে তোলপাড় আনলো, শুধু কৌতুকই নয়, রোমাঞ্চের স্পর্শও ছিল ঘটনাটিতে। আমি অরুণাকে এক সময় সে-কথা বললাম, যদিও আমার মনে দ্বিধা এবং ভয় ছিল যে অরুণা হয়তো ঘটনাটিকে সহজভাবে গ্রহণ করেতে পারবে না। অরুণা কিন্তু অবাক হয়ে সশব্দে হেসে উঠলো, হাসি থামলে ওর মুখের ওপর একটা মুগ্ধভাব ফুটে উঠলো। আমার মনে হলো ছেলের জন্য অরুণার কোন দুশ্চিন্তা নেই, ও যেন একটু গর্বই বোধ করছে। এবং ঠিক তখনই আমার নিজেরও মনে হলো আমিও একটু গর্বিত বোধ করছি।

মেয়েটি টেলিফোনে অন্তুকে কি বলেছিল আমার জানার কথা নয়। তার নাম হয়তো অন্তুকে জিগ্যেস করলেই জানতে পারতাম। কিন্তু আমি কিছুই জানতে চেষ্টা করি নি, যদিও আমার সে-বিষয়ে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। ফলে, কল্পনায় তিন-চারটে একালের সুন্দর সুন্দর নাম নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করেছিলাম, এবং ভেবে নিয়েছিলাম মেয়েটি নিশ্চয়ই অন্তুর সঙ্গে কোন নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা করার কথা বলেছে। কারণ, আমার মনে আছে, তখন অন্তুর কলেজে পর পর তিন দিন ছুটি ছিল।

একটি মেয়ে আমার একুশ বছরের ছেলেকে বাড়িতে টেলিফোন করেছে—এই ছোট্ট ঘটনাটি আমার মনে এমনই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল যে আপিসের দু-একজন সহকর্মী বন্ধুকে না বলে পারি নি। তারা কেউ এ ঘটনার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছে, কেউ একটি প্রেমোপাখ্যান শোনার মত মুখভাব করে তা উপভোগ করেছে এবং তাদের নিজেদের যৌবনকাল কিভাবে বঞ্চিত হয়েছে তা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। বলা অপ্রয়োজন যে আমিও সেই কপট দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সুর মিলিয়েছি।

এর পর অন্তুর কাছে আরো কয়েকবার আরো ঘন ঘন মেয়েলি গলার টেলিফোন এসেছে। সে-সব সময়ে কখনো আমি নিজেই রিসিভার তুলেছি, কখনো অরুণা। তখন আর আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা ‘মজা’ নয়, বরং কখনো কখনো মনে হয়েছে অন্তু আমাদের যেন উপেক্ষা করছে, কিংবা যথেষ্ট শ্রদ্ধা করছে না। তা না হলে সে নিশ্চয় তার বান্ধবীদের বাড়িতে ফোন করতে নিষেধ করে দিতো। অন্তু যে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেকদিন আগে থেকেই সিগারেট খাওয়া ধরেছে আমি জানতাম, তার পকেটে একখানা চিঠি পোস্ট করার জন্যে রাখতে গিয়ে দেশলাই দেখেছিলাম একদিন। আরেকদিন ও বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পরই আমি ঢুকতে গিয়ে একরাশ ধোঁয়া এবং সিগারেটের গন্ধ পেয়েছিলাম। এই বয়সে সিগারেট খাওয়াকে আমি খুব দোষের মনে করতাম না, কিন্তু সেজন্যে অন্তু আমার চোখের সামনে টেবিলে সিগারেটের প্যাকেট রাখলেও সহ্য করতে হবে এতখানি উদার আমি হতে পারি নি। ও অবশ্য তা করেও নি কোনদিন এবং সম্ভবত ঐ বয়সে পুরো প্যাকেট সিগারেট কেনায় ওরা অভ্যস্তও হয় না। আমি নিজে ঐ বয়সে খুচরো একটি সিগারেট কিনে দোকানের দড়িতে ধরিয়ে নিতাম। সে যাই হোক, ঘন ঘন টেলিফোন আসা আমার কাছে প্রায় চোখের সামনে সিগারেট ধরানোর শামিল মনে হতো।

প্রথম দিকে ব্যাপারটা উপভোগ করলেও অরুণার কাছেও এটা আর কৌতুক রইলো না। দেখতাম, অরুণাও বিরক্ত হতো, এবং আমি জানতাম বিরক্তিটা আসলে ওর রাগ। ‘জানি না,‘নেই’ বা বলতে পারি না গোছের উত্তর দিয়ে ও কোন কোনদিন রিসিভার নামিয়েও দিয়েছে।

আমি ঘরে বসে থাকলে অন্তু টেলিফোনে কাটা-কাটা কথা বলতো, অস্পষ্টভাবে উত্তর দিতো, এবং আমার তা শুনে বেশ মজা লাগতো।

—মেয়েটা কে রে? বেশ বিরক্তির সঙ্গেই একদিন অরুণা ওকে জিগ্যেস করেছিল। আমি তখন অন্তুর চোখের দিকে তাকাতে পারি নি।

কলেজের দু-একটি মেয়ের নাম অরুণার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, কারণ তাদের কথা অন্তু সেদিনই অরুণাকে হাসতে হাসতে বলেছিল। তাদের কথা বলার সময়ে অন্তু এমন ভাব করলো যেন তারা নিতান্তই নাবালিকা এবং নির্বোধ, বোকার মত কথা বলে এবং অন্তু যেন তাদের গ্রাহ্যই করে না।

অরুণা একদিন হাসতে হাসতে আমাকে বললো টুকটুক মেয়েটিই তো ওকে বেশি ফোন করে, জিগ্যেস করলাম কেমন দেখতে, অন্তু নাক সিঁটকে যা বর্ণনা দিলো, কোন ভয়ই নেই।

টুকটুক নামটা আমি আগেও একদিন শুনেছিলাম। তার ভালো নাম যে ঋতা তাও অরুণা বলেছিল। আর আমি অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, কলেজের মেয়েদের ডাকনামে পরিচিত হওয়া এ আবার কোন ধরনের আধুনিকতা! রুবি সেদিন এসেছিল, বললে, তুমি বাবা এক্কেবারে সেকেলে। আমাদের সময়েও সব ছিল—মিনি দত্ত, টুলি মিত্র, ফুচু সান্যাল।

কিন্তু অন্তু টুকটুকের রূপের যে বর্ণনা দিক না কেন, একদিন আপিস থেকে ফিরতেই অরুণা চায়ের কাপ রেখে হাসতে হাসতে বললে, ছেলের তোমার কপালে অনেক দুঃখ আছে।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কেন?

অরুণা হাসলো, বললে, সেই টুকটুক! সে আজ এসেছিল।

তারপর একটু থেমে বললে, কি মিষ্টি চেহারা তুমি ভাবতে পারবে না, আর কি ভালো যে মেয়েটা। অন্তু কিনা ওকে দেখে নাক সিঁটকোয়!ও ছেলের তা হলে কোন মেয়েই পছন্দ হবে না।

আমি বললাম, ছেলের বউ করার জন্যে তাকে বুঝি তোমার খুব পছন্দ হয়েছে?

অরুণা হেসে ফেলে বললে, তা বলছি না, কিন্তু সেদিন যে অন্তু বললে, টুকটুক দেখতে তেমন ভালো নয়! এর চেয়েও সুন্দর মেয়ে কি ওর কপালে জুটবে নাকি!

আমার মনে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে খটকা লাগলো। আমার মনে হলো টুকটুক সম্বন্ধে আমাদের যাতে কোন সন্দেহ না হয়, সেজন্যেই ঐ মিষ্টি চেহারার মেয়েটাকে অন্তু খাটো করে দেখাবার চেষ্টা করেছে। টুকটুককে দেখার জন্যে আমার তখন খুবই আগ্রহ, আমি ফিরে আসার আগেই ওরা দুটিতে চলে গেছে শুনে আমার খারাপ লাগলো। ভাবলাম, আরেকটু আগে কেন আসিনি।

এর দিনকয়েক পরেই দুপুরের দিকে আপিস থেকে বেরিয়েছি ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম জমা দিয়ে আসতে, হঠাৎ মেট্রোর নিচে অন্তুকে দেখলাম, সঙ্গে রীতিমত সুশ্রী একটি মেয়ে। স্লিম চেহারা, এক মাথা শ্যাম্পু করা হাল্কা চুল। চোখ দুটি⋯সত্যি কথা বলতে কি, মেয়েটিকে একনজরে দেখে নিজেই আমি উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিলাম,পাছে অন্তু আমাকে দেখে ফেলে। অর্থাৎ, লজ্জা যেন আমারই।

আমি অরুণাকে এসে ফিসফিস করে বর্ণনা দিলাম মেয়েটির আর অরুণা বললো, বা রে, ঐ তো টুকটুক।

টুকটুককে ভালো করে দেখার, কাছে বসে তার সঙ্গে কথা বলার আমার ভীষণ ইচ্ছে হতো। এবং আমার সবচেয়ে বড় কৌতুহল ছিল তাকে দেখে বা তার সঙ্গে কথা বলে মেয়েটিকে যাচাই করে নেবার। আমার ধারণা ছিল, তার সঙ্গে কথা বলে আমি তার ভিতরের চরিত্রটি আবিষ্কার করতে পারবো এবং সেই সঙ্গে ধারণা করে নিতে পারবো সে সত্যিই অন্তুকে ভালোবাসে কি না। কারণ, টুকটুক যথেষ্ট সুশ্রী বলেই আমার সেই পুরনো ভয়টা মাঝে মাঝেই বুকের মধ্যে উঁকি দিতো। আমার কেবলই আশঙ্কা হতো শেষ অবধি অন্তু না সেই চরম আঘাতটা পেয়ে বসে।

পুত্রসন্তান যুবক হয়ে উঠলে বাহান্ন বছর বয়সের বাপকেই সব সময়ে তটস্থ থাকতে হয়। আমি মাঝে মাঝে আপিস ছুটির পর সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে চৌরঙ্গির দু’একটি রেস্টোরেন্টে গিয়ে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতাম, কোনদিন বা শ্রান্ত ক্লান্ত বোধ হলে তাদের সঙ্গে আউটরাম ঘাটের দিকে বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে বায়ুসেবনের জন্যে বেড়াতে যেতাম। অস্বীকার করবো না, বাহান্ন বছর বয়সেও আমার বুকের ভেতরটা যুবক রয়ে গেছে বলেই আমি ঐসব সুদৃশ্য জায়গায় বেড়াতে গিয়ে কখনো কখনো সুদৃশ্য রমণীর দিকেও কয়েক পলক তাকিয়ে দেখেছি। কিন্তু ঐসব স্থানগুলি প্রেমের তীর্থস্থান জানতাম বলেই আমার বেড়ানোর জায়গাও সঙ্কীর্ণ হয়ে গেল। কারণ, আমার তখন একটাই আতঙ্ক, কোথাও না ওদের দুটিকে, অর্থাৎ অন্তু ও টুকটুককে দেখে ফেলি। ওদের কোনদিন যদি লজ্জায় ফেলি, আমাকে দেখতে পেয়ে ওদের সুন্দর সন্ধ্যা যদি নষ্ট হয়, তাহলে আমার আর অনুশোচনার যেন শেষ থাকবে না।

এই সময়েই অন্তুদের কলেজে পুজোর ছুটি হলো।অরুণার কাছে শুনলাম, টুকটুক তার বাবা-মা’র সঙ্গে দিল্লি বেড়াতে যাচ্ছে। টুকটুক নিজেই নাকি তাকে বলে গেছে।

অরুণা বললে, ছেলেটা একেবারে অমানুষ। আমার সামনেই টুকটুক বললে, নিরুপম, চিঠি দেবো, উত্তর না দিলে দেখবে মজা। অন্তু কি বললে জানো? বললে, রিপ্লাই কার্ড দিও, আর নয়তো এখনই খাম পোস্টকার্ডের পয়সা দিয়ে যাও। সত্যি সত্যি ওর কাছ থেকে দুটো টাকা নিলো, আমার বকুনিতে কানই দিলো না।

টুকটুক যে দিল্লি চলে গেছে তা কয়েক দিন পরেই টের পেলাম। কারণ, অন্তুর নামে যে চিঠিখানা এলো, তার ঠিকানা দেখেই বোঝা গেল সেটি কোন মেয়ের লেখা। আমি সে চিঠি নিজেই রেখে দিলাম, নিজেই অন্তুর হাতে তুলে দিলাম, অরুণাকে জানতেও দিলাম না। কারণ আমার ভয় ছিল, অরুণা সে চিঠি খুলে পড়তে পারে, বা পড়ার পর ছিঁড়ে ফেলে দিতে পারে। ফলে, ওদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি ঘটতে পারে। এবং মা বা বাবা সে-চিঠি পড়েছে বা নষ্ট করেছে জানতে পারলে অন্তু তখন নিশ্চয় আমাদের ঘৃণা করতে শুরু করবে।

কিছুদিন পরে অরুণার কাছে শুনলাম টুকটুক ফিরে এসেছে। ফিরে এসেই সে নাকি অরুণাকে ফোন করেছিল। অরুণা বললে, যাই বলল, টুকটুক আমাদের খুব ভালোবাসে, চিঠি পায়নি ক’দিন অন্তুর কাছ থেকে, খুব ভাবনা হয়েছিল তার, বাড়ি ফিরেই ফোন করে জিগ্যেস করলো, আমরা কেমন আছি।

সত্যি সত্যিই টুকটুককে একদিন দেখলাম। দেখলাম মানে তাকে আমিই ডেকে আনলাম।

আমাদের ফ্ল্যাটখানা তিনতলায়, সামনে একটুখানি ব্যালকনি আছে। সেদিন শরীরটা বিশেষ ভালো ছিল না, বছর শেষ হয়ে আসছে অথচ ক্যাজুয়েল লীভ পাওনা অনেক, ইচ্ছে করেই আপিস যাইনি। বিকেলে হঠাৎ শুনলাম, নিচে রাস্তা থেকে কোন একটি মেয়ে চিৎকার করে কাকে ডাকছে। দু’বার শোনার পরই মনে হলো মেয়েটি অন্তুকে ডাকছে। আমি ব্যালকনিতে বেরিয়ে দেখি নিচে রাস্তায় টুকটুক চিৎকার করে ডাকছে, অন্তু, অন্তু! ও তখন তিনতলার দিকে চোখ তুলে ডাকছিল, আমাকে দেখেই লজ্জা পেল। ও হয়তো সুট্ করে সরে পড়তো, মাথা নামিয়ে নিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে, তাই আমি ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে, তুমি ওপরে এসো, এসো না!

মেয়েটি সিঁড়ির দিকে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে মুখে হাসি আর লজ্জা ছড়িয়ে উঠে এলো, আমি তখন সিঁড়ির মাথায়।

আমি বললাম, তুমি টুকটুক, না?

টুকটুক ঘাড় কাত করলো। আর আমি বললাম, অন্তু না থাকলে ওপরে বুঝি আসা যায় না?

অরুণাও ততক্ষণে এসে পড়েছে, হেসে বললে, সে কথা বোলো না, আমার সঙ্গে তো ও কতদিন এসে গল্প করে গেছে।

আমি টুকটুককে সামনে বসিয়ে নানান গল্প শুরু করে দিলাম। আমি প্রায় তার সমবয়স্ক হবার চেষ্টা করলাম। হাসলাম এবং হাসালাম। আমি নিজেকে যথেষ্ট মডার্ন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলাম।

টুকটুক চলে যাবার পর আমি অরুণাকে বললাম, যদি সত্যি সত্যি তেমন কিছু হয়, ভালোই হয়, কি বলো?

অরুণা মৃদু হেসে বললে, মেয়েটা ভীষণ ভালো, তাই না?

আমরা রাত্রে অন্ধকারে শুয়ে শুয়েও অন্তু এবং টুকটুককে নিয়ে কোন কোনদিন চাপা গলায় আলোচনা করেছি, আমাদের চোখকে ফাঁকি দেবার যখনই ওরা চেষ্টা করেছে, আমরা হেসেছি। কখনো কখনো আমরা স্বপ্নও দেখেছি।

এরপর ক্রমে ক্রমে সমস্ত ব্যাপারটা কেমন সহজ এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। টুকটুক ফোন করলে আমি যদি রিসিভার তুলতাম তাহলে ও আগে আমার খবরাখবর নিতো, অরুণার, আর তারপর আমি নিজেই বলতাম, ‘ধরো, অন্তুকে ডেকে দিচ্ছি, কিংবা ‘অন্তু তো এখনো ফেরেনি, কলেজে যাওনি তুমি?’ টুকটুক যখন বাড়িতে আসতো, আমি থাকলেও কখনো সটান অন্তুর ঘরে চলে যেতো, কখনো রান্নাঘরে অরুণার কাছে, আবার অন্তুর ঘরে যাবার আগে এক মিনিট দাঁড়িয়ে কোন কোনদিন আমার সঙ্গে কথাও বলতো।

মাঝখানে হঠাৎ কি যে হয়েছিল আমি জানি না, বেশ কিছুদিন টুকটুক আসতোও না, ফোনও করতো না। সেই সময়ে আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। অরুণাকে জিগ্যেস করেছিলাম, টুকটুকের কি খবর বলো তো? অরুণা বললে, ঝগড়া করেছে, আবার কি। এত বলি, একদিন আসতে বলিস, কেবল এড়িয়ে যায়।

শুনে আমার মনটা দমে গেল। আমার বিশ্বাস হলো না। আমি মনে মনে ভয় পেলাম। আমি ভাবলাম, যে আতঙ্কটা আমার মনের মধ্যে বরাবর উঁকি দিয়েছে, সেটাই বোধ হয় সত্যি হলো। আমার কেবল ইচ্ছে করতো, আগের মতই অন্তুর ঘর থেকে ওদের দু’জনের সশব্দ হাসি বা হট্টগোল বা তুচ্ছ ঝগড়াঝাঁটি ভেসে আসুক। একটা কাঠের বাজনা শুনেছিলাম ছেলেবেলায়, ওদের কথা-কাটাকাটি ঠিক তেমনি মিষ্টি লাগতো।

আমি সে-সময় অন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতাম। ও মাঝেমাঝেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যেত, একটু খিটখিটেও হয়েছিল। খাবার টেবিলে বসে আমি লক্ষ করতাম, ওর খিদে ঠিক আগের মতো নেই। আমি কি করবো ঠিক করতে পারতাম না, আমি শুধু মনে মনে চাইতাম, ও যেন আঘাত না পায়, কষ্ট না পায়।

তখন গরমকাল, অন্তু বললো, বাবা, চলো না এবার দার্জিলিং যাই।

আমি ভাবলাম, কলকাতা ওর কাছে এখন একটা যন্ত্রণা। ও এখান থেকে পালাতে চাইছে। পালাতে।

আমি অরুণাকে বললাম, তাই চলো, অন্তু যখন বলছে⋯

আমি অরুণাকে বললাম, দোষ তোমারই। তুমি প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে বাড়িয়ে দিলে, অথচ শেষরক্ষার কথা ভাবলে না।

অন্তুর জন্যে আমার ভীষণ কষ্ট হতো, অনেক রাত অবধি আমার ঘুম আসতো না। অরুণাও তার ব্যথা তার কষ্ট চেপে রেখেছিল, হঠাৎ একদিন রাত্রে কেঁদে ফেলে বললো, আমার কিছু ভালো লাগছে না। একটু থেমে হঠাৎ বললে, আচ্ছা আমি যদি টুকটুকদের বাড়ি যাই? আমি নিষেধ করলাম। বললাম, ওঁদের কাউকে তো আমরা চিনি না। কি জানি কি মনে করে বসবেন ওঁরা, তা ছাড়া অন্তু জানলে রেগে যাবে, ওর হয়তো সম্মানে লাগবে।

শেষ অবধি তাই দার্জিলিঙেই আমরা গেলাম। ক্যাপিটল সিনেমার কাছেই হোটেল কুণ্ডুতে গিয়ে উঠলাম। সেদিনই বিকেলে বেড়াতে গেলাম ম্যালে।

আমরা কেউই দেখতে পাইনি, টুকটুক ছুটে এলো একমুখ হাসি নিয়ে। অন্তু, তুমি? গ্র্যাণ্ড হয়েছে, কাকাবাবু, আপনারাও এসেছেন। বলে তার বাবা-মা ভাই-বোনদের দিকে ফিরে তাকালো। আমাদের ডেকে নিয়ে গেল।

আলাপ হলো সকলের সঙ্গে। বোঝা গেল অন্তুকে ওঁরা খুব ভালো করেই চেনেন, অন্তু ওঁদের বাড়ি অনেকবার গেছে।

টুকটুকের বাবা খুব সজ্জন, মা বেশ মিশুকে।

প্রতিদিন সকাল-বিকেল আমাদের দেখা হতো, কখনো ম্যালে বেড়াতে এসে, কখনো দোকানে বাজারে, কখনো দল বেঁধেই আমরা এখানে-ওখানে যেতাম। কিন্তু অন্তু আর টুকটুক সব সময়ে আলাদা। হয় ওরা আমাদের সকলের পিছনে পিছিয়ে যেতো, কিংবা তড়বড় করে অনেক আগে আগে চলে যেতো। আবার এক একদিন ওরা দুজনেই একেবারেই দলছাড়া হয়ে কোথায় যেতো কে জানে!

আমি অরুণাকে বললাম, যাক বাবা, ঝগড়া মিটে গেছে।

অরুণা বললে, ঝগড়া না ছাই।

—তার মানে? আমি বুঝতে পারলাম না অরুণা কি বলতে চায়।

অরুণা হাসলো।সব প্ল্যান, সব প্ল্যান করে এসেছে, বুঝতে পারছে না। তা না হলে হঠাৎ দার্জিলিং আসতে চাইবে কেন অন্তু।

ওদের দু’জনকে দেখে আমরা দু’জনে আবার হাসাহাসি করলাম। আর অরুণা বললে, দুটিতে বেশ মানায় কিন্তু।

একদিন আমরা অতটা ওপরে উঠতে পারিনি, মাঝপথেই থেমে গিয়েছিলাম, আর অন্তু-টুকটুক অনেকখানি ওপরে উঠে গিয়ে একটা বিশাল পাথরের ওপর বসেছিল। ওদের দুজনের বসার ভঙ্গিটি ছিল ছবির মতো। ওরা খুব হাসছিল আর গল্প করছিল।

সেদিকে তাকিয়ে আমি ফিসফিস করে অরুণাকে বললাম, দ্যাখো দ্যাখো, ঠিক যেন মেড ফর ইচ আদার।

অরুণা হেসে উঠে বললে, সত্যি!

দার্জিলিং থেকে ফিরে এলাম খুব একটা খুশি মন নিয়ে। সমস্ত বুকের ভেতরটা যেন ভরাট। মনে হলো জীবনে এত সুখী আমি কখনো হইনি। অন্তুও ট্রেনে আসবার সময় উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল, ওয়াণ্ডারফুল, দার্জিলিং এত সুন্দর ভাবতেই পারিনি। আমি আর অরুণা চোখ-চাওয়াচাওয়ি করে হাসি চেপেছিলাম।

কলকাতায় ফিরে এসে আবার সেই অসহ্য গরম, অন্য দিকে মন দেবার জো’টি ছিল না। তবু এরই মাঝে আমি সহকর্মী বন্ধুদের কাছে দার্জিলিঙের ঘটনা সবিস্তার বলেছি, বলে আনন্দ পেয়েছি, আর কপট আক্ষেপের গলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছি, ‘আরে মশাই, কি নির্লজ্জ, কি সাহস মেয়েটারও, আমরা যেন বাবা-মা নই, স্রেফ অচেনা পাবলিক।’

বন্ধুরা মজা পেয়েছে, সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, এখনকার হালচালই ওরকম, কি আর করবো, আমরাও সহ্য করে যাচ্ছি। তাদের মধ্যে দু-একজন আবার গোঁড়া, বাহান্নতেই বৃদ্ধ, তারা দোষ দিয়েছে আমাকে, ‘আশকারা দিয়ে দিয়ে আপনারাই তো ছেলেমেয়েদের মাথা খাচ্ছেন।’

আমি মনে মনে হেসেছি। এবং আমি মনে মনে স্বপ্ন দেখেছি। তারা তাদের ছেলেদের জন্যে অনেক কিছু চাইতো, ভালো রেজাল্ট, ভালো চাকরি, উন্নতি, আরো কত কি। আমার চাওয়া শুধু একটিই। অন্তু যেন সুখী হয়, অন্তুর এই একুশ বছরের স্বপ্নমাখা নরম বুকে যেন কেউ আঘাত না দেয়। এই বয়সেই সে যেন আমার মতো ভেঙে না পড়ে। আমার একুশ বছরের মতো।

অরুণার কাছে শুনেছিলাম, টুকটুক আবার এসেছিল একদিন, সারা দুপুর অন্তুর ঘরে বসে গল্প করেছে, অরুণা আচার রোদে দিয়েছিল, চেয়ে নিয়ে চেটে চেটে খেয়েছে।

সারা দুপুর ঘরের মধ্যে বসে গল্প করার কথায় আমার একটু ভয় হতো, একটু অস্বস্তি। ঐ বয়েসটাকে বিশ্বাস করতে পারতাম না আমি, ভাবতাম শেষে কিছু একটা⋯পরমুহূর্তে মনে হতো ওরা এত খারাপ হবে না, আমাদের মনটাই খারাপ।

রুবি একদিন এসে বললে, জানো মা, তোমার জামাই বলছিল অন্তুর নাকি আজকাল খুব পাখা গজিয়েছে।

অরুণা হেসে বললে, তা আর কি করা যাবে, দিনকালই যে বদলে গেছে।

রুবি বললে, আমার বেলায় তো খুব কড়া শাসন ছিল তোমার।

সত্যি কথা বলতে কি, রুবিকে আমরা একটু আগলে আগলেই রাখতাম। কিন্তু রুবি তো সুখী হয়েছে।

পরে শুনলাম, রুবি বলেছে অরুণাকে, তোমার জামাই দেখেছে, একটা ছিপছিপে মেয়েকে নিয়ে কি একটা হোটেল থেকে বেরুচ্ছে। (অরুণা বললে) তোমাকে বলিনি, ভেবেছিলাম চোখের ভুল, সেদিন দুপুরে⋯

অরুণা হঠাৎ অন্তুর ওপর রেগে গেল। আমাকে বললে, এভাবে বেশিদিন ভালো নয়, বিয়েটিয়েই যদি করতে চায় করুক না।

কিছু একটা ঘটে যেতে পারে এই ভয় তারপর থেকে আমাকে পেয়ে বসলো। যদি কিছু ঘটে, আমি ভাবতাম, তা হলে আমাদের প্রশ্রয়ই তার জন্যে দায়ী। আবার ভাবতাম, অত ভয়ের কি আছে, ওরা বিয়ে করতে চাইলে টুকটুকের বাবা নিশ্চয় আপত্তি করবেন না। তিনি তো আরো মডার্ন।

তবু ভয় হতো বলেই অরুণাকে বলেছিলাম, অন্তুকে স্পষ্ট করে জিগ্যেস করতে। তবে পাস করার আগে, কোন চাকরি না পেয়ে ওর বিয়ে করার কথা আমি ভাবতাম না।

ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ টুকটুক একদিন এসে হাজির।—নিরুপম আছে কাকাবাবু?

আমি ওকে দেখে বেশ খুশি হয়ে উঠেছিলাম। বললাম, না।

টুকটুক সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছিল, আমি বললাম, নিরুপম ছাড়া কি আর কারো সঙ্গে কথা বলতে তোমার ভালো লাগে না? আমরা বুড়ো হয়েছি বলে কি তোমাদের সঙ্গে কথা বলতেও পারি না!

টুকটুক মাথা নিচু করে লাজুক হাসলো।

আমি বললাম, বসো এখানে।

ও চুপটি করে সামনের চেয়ারে বসলো। বড় লম্বা ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে।

আমি বললাম, কি খবরটবর বলো তোমার। অন্তু এখুনি ফিরবে, ওকে ওষুধ কিনতে পাঠিয়েছি।

টুকটুক মাথা নিচু করেই বললে, খবর একটা আছে কাকাবাবু। মৃদু সলজ্জ হেসে বললো, আমার বিয়ে।

বিয়ে? আমার বুকের মধ্যে কেউ যেন দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলো। মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠলো।—কবে? কোথায়? কি করে ছেলেটি?

আমি ঠিক কি প্রশ্ন করেছিলাম, আমার নিজেরই মনে নেই।

টুকটুক ব্যাগ থেকে একখানা চিঠি বের করে দিলো, আমি পড়লাম, কিন্তু কিছুই মাথার মধ্যে ঢুকলো। সব অক্ষরগুলো ঝাপসা লাগলো। আমার বুকের মধ্যে একটা অসহ্য ব্যথা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার ভিতরটা কেবল বলতে লাগলো, এ কি হলো, এ কি হলো!

কোনরকমে মুখে হাসি এনে বললাম, ভালো ভালো।

আর টুকটুক উঠে বললো, আমি এক্ষুনি ঘুরে আসছি। নিরুপমকে একটু থাকতে বলবেন কাকাবাবু।

টুকটুক চলে গেল, আর তখনই অরুণা এসে বললে, টুকটুকের গলা শুনছিলাম না?

আমি অরুণাকে সব বললাম, অরুণা আমার সামনে এসে বসলো, আমরা পরস্পরের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হওয়ার পর নিঃশব্দে চোখ নামিয়ে বসে রইলাম। ফিসফিস করে বললাম, এই বয়সে, বেচারী, প্রথম থেকেই আমার এই এক ভয় ছিল।

অরুণা বললে, এইটুকু ছেলে, ও সহ্য করবে কি করে।

আমার সত্যি সত্যি কান্না পাচ্ছিল। আমার নিজের একুশ বছর বয়সের সেই আঘাতটার কথা মনে পড়ছিল। অন্তু ফিরে এসে ওষুধটা দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল, আমি ওকে কিছুই বলতে পারলাম না। এমনকি টুকটুক এসেছিল বা থাকতে বলেছে সে-কথাও বলতে পারলাম না।

মিনিট কয়েক পরেই টুকটুক ফিরে এলো, আমি ওকে অন্তুর ঘর দেখিয়ে দিলাম ইশারায়, শুধু বললাম, আছে।

আমি আর অরুণা অন্তুর ঘরের দিকে তাকাতে পারলাম না। শুধু চুপ করে বসে রইলাম আতঙ্কে অপেক্ষায়। যেন এখনই একটা ভূমিকম্প হয়ে যাবে। অন্তুর বুকের মধ্যে এখনই একটা ভূমিকম্প হবে!

হঠাৎ একটা হট্টগোল ভেসে এলো ওর ঘর থেকে। চিৎকার, উল্লাস, হইহই। ‘তুমি একটা ইডিয়ট, অন্তুর গলা। ‘নিরুপম, ভালো হবে না বলছি, তুমি না হলে⋯⋯’

আমি অরুণার চোখের দিকে তাকালাম। অরুণা আমার চোখের দিকে তাকালো।

একটু পরেই অন্তু আর টুকটুক বেরিয়ে এলো।

অন্তু চিৎকার করছে, আচ্ছা বাবা, মা, তুমি বলো, স্টুপিড বলবো না ওকে? ওর পরশু বিয়ে, একটা বন্ধুকেও এখনো নেমন্তন্ন করেনি।

টুকটুক সাক্ষী মানলো অরুণাকে।—আচ্ছা কাকিমা, আমি কাল পরশু দু-দুবার ফোন করিনি?নিরুপম তুমি বাড়িতে থাক নাকি কোন সময়ে!

ওরা দু’জনে বেরিয়ে গেল বন্ধুদের নেমন্তন্ন করতে।

আমরা চুপ করে বসে রইলাম। পরস্পরের চোখের দিকে তাকালাম একটু অবাক হয়ে।

অরুণা হঠাৎ বললে, তুমি এবার নিশ্চিন্ত হলে তো!

বললাম, জানি না, বুঝতে পারছি না।

১৩৭৭ (১৯৭০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *