দাদা
এক যুবক একটি চিঠি লিখেছেন। তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে এম. এ. পড়ছেন। চিঠিটি আমার কাছে যুগদিশারী। আমরা প্রবীণের দূরবিনে জগৎ দেখি। দু:খ পাই। অবক্ষয়ের কথা বলি। ‘হায়, হায়’ করি। ‘গেল গেল’ করি। তখন নবীনরা বলেন, এ ব্যাধির নাম জেনারেশন-গ্যাপ। ওর যাওয়ার সময় হয়েছে। সব কটা বুড়ো একসঙ্গে মরলে দেশটা ঝকঝকে হবে। শানের মেঝেতে শ্যাওলা। কিন্তু এই যুবকটিরও ভালো লাগছে না বর্তমান কালের গতিপ্রকৃতি।
বাংলা পড়ছেন বলে, সকলেই তাঁকে নিরুৎসাহ করছেন এই বলে, ‘বিজ্ঞানের যুগ, ওসব বাংলা নিয়ে পড়া বিলাসিতা।’ প্রশ্ন হল, বাংলা তা হলে কেউ পড়বে না! বিজ্ঞানের যুগে বাংলা পড়া উচিত নয়। ছাত্রটিকে সবাই নিরুৎসাহ করছেন, ‘তোমার কিছু হবে না।’ অর্থাৎ সেই দিন আসছে, সংস্কৃতের মতো বাংলাও হয়ে যাবে ডেড-ল্যাঙ্গোয়েজ। বাঙালির ছেলে বাংলা সাহিত্য পড়বে না, খিচুড়ি ভাষায় কথা বলবে। আর বিজ্ঞানচর্চা করবে। রাশি রাশি বৈজ্ঞানিকের বিপুল গুঁতোগুতি। আজ হাতি বাগান থেকে রকেট উঠল, পঞ্চা চলে গেল চাঁদে। পরশু পঞ্চা ধপাস করে পড়ল রাজভবনের ছাদে। তৃষ্ণার্ত খোকা মাকে বলছে, ‘মাম্মি, মাম্মি’! এক গেলাস এইচ টু ও জলদি জলদি।’
আমাদের বিজ্ঞান এখন ভূত-প্রেতের বিরুদ্ধে, ভগবানের বিরুদ্ধে দ্বি-বাহু লড়াইয়ে নেমেছে।
গাছ-গাছড়ার ওষুধ, শেকড়ের নির্যাস, ওঝা, ঝাড়ফুঁক-কুসংস্কার। উন্নত, বৈজ্ঞানিক-চিকিৎসাই চিকিৎসা। হাতুড়ে হাটাও। গ্রামে-গঞ্জে ঝকঝকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সর্বত্যাগী সেবাপরায়ণ বৈদ্যকুল। প্রেমের পুত্তলী সেবিকা বাহিনী। কলকাতায় অত্যাধুনিক হাসপাতাল। মোড়ে মোড়ে নার্সিংহোম। কলেজের ছাত্রী হসপিট্যালের বৈঠকখানায় বসে বসে মারা গেলেন। স্যালাইনের বোতলে ছত্রাক। জলে আর্সেনিক। ডাক্তারবাবুদের বৈজ্ঞানিক-অহংকার। বিলেতে সেমিনার। বিশ্বভ্রমণ। গরিব রোগীরা ‘ভ্যারিটেবল নুইসেনস’। বড়লোকেরা দুধেল গরু। চেন্নাইয়ে চিকিৎসার জন্য গেলে অভিমান। গাছতলায় রোগী পড়ে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজছেন। ‘টার্মিন্যাল’ রোগীর নাক থেকে অক্সিজেন খুলে আর একজনের নাকে গোঁজা হল। সিলিন্ডার শূন্য। উগ্রচণ্ডা মেজাজ—’অপেক্ষা করুন। ডাক্তারবাবুদের সেমিনার হচ্ছে।’
‘মরে যাচ্ছি যে!’
‘ডেথ সার্টিফিকেট ফ্রি।’
বিজ্ঞান মানে, কম্পিউটার। লক্ষ্য আমেরিকা। এদেশের গবেষণা? কেউ জানে না। এ দেশের, এ কালের নামকরা বিজ্ঞানী? হয়তো আছেন। প্রেসিডেন্ট কালাম সাহেব লিখছেন, I had seen from very close quarters the decay and disintegration that go with management through closed-door consultations and secret manipulations. হন্তদন্ত মিটিং, রুদ্ধদ্বার শলাপরামর্শ, গোপনে কলকাঠির নাড়ানাড়ি। বিজ্ঞানের গঙ্গাযাত্রা।
সেই যুবক লিখছেন, ‘এ কেমন সময়ে আমরা জন্মালাম। আমাদের স্বামীজি নেই। লেখায় রবি ঠাকুর নেই, নিবেদিতা নেই। খালি সারা রাজ্যের মধ্যে অসংখ্য দাদা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কলেজে ঢুকলাম। কোথা থেকে দাদা এসে বললে, ‘ভোটে দাঁড়া, নইলে খোমা পালটে দেব।’ দাঁড়ালুম। জিতলুম। বললে, নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাক। ম্যালা কাজ দেখাতে যাস নে। যা করার আমরা করব। তা দাদারা করবেন—হপ্তায় একদিন কলেজ করিডর দিয়ে ঘুরে ঘুরে—আমাদের দাবি মানতে হবে—ধুড়ুম ধাড়াম ধুম, দুটো বেঞ্চি ভাঙা হয়ে গেল। বললে, চলো ভাই, বহুদিন প্রিন্সিপ্যাল পেটানো হয়নি।
হাওড়ার অয়ন ভাবছে—বাইশ বছরের যুবক। সামনে পড়ে আছে জীবনের দীর্ঘ আঁকা-বাঁকা পথ। জীবিকা নেই, সুরক্ষা নেই। নিরাপত্তা নেই। পাশে কেউ দাঁড়াবে না। মহাপুরুষরা দেওয়ালে লেখা বাণী। ক্ষমতার কমিটি প্রয়োজন মতো তুলবে ফেলবে।
আজ রবীন্দ্রনাথ তো কাল স্বামীজি। প্রচার যন্ত্রের মোবিল। ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষের নাকে ‘পলিউশান মাক্স।’ একদমে উচ্চারণ—’ঠাকুর-মা-স্বামীজি’। ফতুয়া-পাঞ্জাবি-পাজামা। প্রবচন শোনেন, হাই তোলেন। ওয়ান পাইস ফাদার মাদার।
ধর্মের পেট ফাঁপছে। গীতার উদগার। মঞ্চে দাঁড়িয়ে শিশুটি স্বামীজির বাণী মুখস্থ বলছে। পিতা, মাতা ডিডিও ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখছেন। স্বজন মহলে গর্ব প্রকাশ করছেন—’মনে হচ্ছে তিনি এসে গিয়েছেন। নেক্সট ‘বিশ্ব ধর্মসভার’ ডেটটা বলতে পারো? বড় হলে হাইট কী দাঁড়াবে বলতে পারো? পাগড়ি আর পোশাকটা তৈরি করে রাখি।’
‘কী বলবে?’
‘কেন শিকাগো লেকচার পুরো মুখস্থ।’
একজন বললেন, ‘কানে কানে বলি! আমি রামকৃষ্ণ হয়ে গিয়েছি।’
‘সে কী? কী সর্বনাশ! কীভাবে বুঝলেন।’
‘যেই হাই তুলি, হাতটা আটোমোটিক আকাশের দিকে উঠে যায়। একেবারে সমাধির ভঙ্গি। জল খেয়ে ঢেঁকুর তুলি, আওয়াজে মা, মা। ভয়ে শুয়ে পড়ি। কী থেকে কী হয়ে যাবে বাবা! কিছুই হল না, ক্যানসার হয়ে গেল, বউকে বলেছি—সমাধি হলেই কাতুকুতু দেবে।’