দাদা হওয়ার দাম
যদি কোনও অচেনা পাড়ায়, কেউ হঠাৎ এসে, তোমার সামনে হাতটাত কচলে দাদা-টাদা বলে খুব ভক্তি করতে থাকে আর তোমাকে দুটো সিঙাড়া আর একটা ডাবের জল খাওয়াতে চায়, তা হলে তুমি কী করবে? কিছুই করবে না, শুধু প্রাণপণে ছুট লাগাবে সেখান থেকে। যত জোরে পারো।
কারণ, দাদা হওয়ার দাম অনেক। অন্তত বারো টাকা।
সেদিন একটা কাজে বেরিয়ে কাজটাজ সেরে, বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় হঠাৎ–আরে দাদা যে!
চেয়ে দেখি, এক ভদ্রলোক! বয়সে আমার চেয়ে বড়ই হবেন, মাথায় আমার চাইতেও বড় টাক, মুখে সরু গোঁফ। ছিটের হাফ শার্ট আমার দিকে তাকিয়ে খুব মিঠে হাসছেন।
দাদা হঠাৎ এ-পাড়ায়?
আশ্চর্য হয়ে বললাম, একটু কাজে এসেছিলাম। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
আমাকে চেনবার কী আছে? আমি অত্যন্ত সামান্য লোক–চুনোপুঁটি। দাদাকে কে না চেনে? বাপরে কত বড় লোক।-বলেই ঢিপ করে আমাকে প্রণাম। আমি, করেন কী, করেন কী-বলেও সামলাতে পারলাম না।
আপনাকে দেখলাম, পেন্নাম করলাম, আহা-দিনটা আমার সার্থক হয়ে গেল। দাদা, আপনারাই তো দেশের গৌরব, আমাদের মাথার মণি।
সত্যি কথা বলতে কী, কেমন ভ্যাবাচ্যাকা লেগে গেল। তোমাদের জন্যে দুটো একটা গল্প আমি লিখে থাকি বটে, কিন্তু আমি যে এমন একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার, এত বড় দিকপাল, এ-খবরটা তো আগে জানা ছিল না। বরং পত্রিকার সম্পাদকেরা প্রায়ই নাক-টাক কুঁচকে আমাকে বলেন, কী যে আজেবাজে গপ্পো লেখেন মশাই, কোনও মানে হয় না। তাই একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, বোধহয় ভুল করছেন। আর কাউকে ভেবে
ভুল করব? আপনাকে? হেঁঃ, কী যে বলেন। লম্বা নাক, ওই খাড়া খাড়া কান, ওই একটা কালচে দাঁত, চাঁদি আর কপাল জুড়ে এই টাক, ভুল করব? এরকম মার্কামারা চেহারা দুজনের আছে নাকি দুনিয়ায়?
ভক্তি করেই বলছেন লোকটি, কিন্তু খাড়া কান, কালচে দাঁত, মাথায় টাক নিজের সম্বন্ধে এসব বর্ণনা শুনতে ভালো লাগল না, কারই বা লাগে? আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আচ্ছা–আচ্ছা, ঠিক আছে, বড় খুশি হলাম। কিন্তু ওই যে আমার বাস আসছে, আমি যাই।
সে কী কথা!–ভদ্রলোক খপ করে আমার হাত চেপে ধরলেন–বাস অনেক আসবে, অনেক যাবে। কিন্তু আপনি তো আর বার বার আসবেন না আমাদের পাড়ায়। আর এলেও কোন্ ফাঁকে সুট করে চলে যাবেন, টেরও পাব না। আসুন–আসুন, একটু বসবেন আমাদের ক্লাবঘরে বাচ্চাদের একটু দর্শন দেবেন।
বাচ্চাদের দর্শন দেব–আমি কে? আমি কি তারাশঙ্কর বাঁড়ুজ্জে, প্রেমেন মিত্তির, না শিবরাম চক্রবর্তী? না মৌমাছি, না স্বপনবুড়ো? আমার লেখা বাচ্চারা কখনও পড়ে কি না, তাতেই সন্দেহ আছে। তবু মনে মনে লোভ হল। হঠাৎ খামকা এরকম একটা খাতির পেয়ে গেলে আর কার খারাপ লাগে, তাই বল?
কিন্তু আমার খেয়াল ছিল না, লোভে পাপ এবং পাপে—
পাপে নিদেনপক্ষে বারো টাকা খেসারত।
ছুটির দিন, খুব একটা তাড়া ছিল না বলে চলে গেলাম লোকটির সঙ্গে। কাছেই কাঁচা ড্রেনের পাশে টালির চাল-দেওয়া একটা ঘর, বাইরে তোবড়ানো সাইনবোর্ডে লেখা : তরুণ সভা।
দাদা, ভেতরে পা দিন। আহা, আজ আমাদের ক্লাব ধন্য হল।
ঢুকে গেলাম তরুণ সভায়। কোথায় বাচ্চা? ঘরের ভেতরে আট-দশটি তরুণ মুখে বেশ দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে মাদুর পেতে বসে জন-চারেক তাস খেলছিল, কজন আড্ডা দিচ্ছিল, দুজন আবার সিগারেটও খাচ্ছিল। দুটো কাঁচ-ভাঙা আলমারি রয়েছে তাতে কয়েকটা থিয়েটারের নাটকও দেখতে পেলাম।
ভদ্রলোক ধমক দিলেন, কাকে ধরে এনেছি–দেখছিস না তোরা? এর মতো মানী লোকের সামনে সিগারেট খাচ্ছিস? ফেলে দে–ফেলে দে। বন্ধ কর তাস শিগগির।
আচ্ছা করে শেষ টান দিয়ে দুজনে সিগারেট দুটো বাইরে ফেলে দিল। বাকিরা ধীরেসুস্থে তাস গুছিয়ে তুলল। আর সবাই মিলে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইল আমার দিকে।
ভদ্রলোক আবার একটা ধমক দিলেন। হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কী? এত বড় একটা গ্রেটম্যান এলেন–তোদের ক্লাব ধন্য হয়ে গেল, আর দাদাকে বসতেও দিচ্ছিস নে?
হুড়মুড়িয়ে কোনখান থেকে একটা টিনের চেয়ার টেনে আনলেন। বাধ্য হয়ে বসে পড়লাম তাতে। ক্যাঁচোর-ম্যাচোর করে আওয়াজ হল খানিকটা, আমি ভাবলাম ভেঙে না পড়ে।
তারপর সেই দাড়িওলা বাচ্চার দল আমার চারিদিকে ঘিরে দাঁড়াল আর সামনে হাত জোর করে রইলেন আমার চাইতে বয়সে বড়, মুখে সরু গোঁফ, গায়ে ছিটের শার্ট, টাক মাথা সেই লোকটি। তরুণদের কথা থেকে জানলাম, তাঁর নাম ন্যাপাদা।
ন্যাপাদা বললেন, একটু চা আনাই দাদা
বললাম, না না–এই গরমে—
তা হলে একটা ডাব? দুটো সিঙাড়া?
ব্যস্ত হবেন না, কিছুই দরকার নেই।
আরে তাও কি হয়?-ন্যাপাদা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আপনার মতো গ্রেটম্যানকে কিছু না খাইয়ে ছেড়ে দিতে পারি? লোকে বলবে কী আমাদের? না, আমরাই শান্তি পাব দাদা? এই ভ্যাবলা, চটপট চলে যা। হরেকেষ্টর পানের দোকান থেকে একটা ডাব আর খোকনের দোকান থেকে দুটো সিঙাড়া নিয়ে আসবি।
পয়সা?
পয়সা কী রে? দাদা এসেছেন পাড়ায়, পাড়া ধন্য। তাঁর সেবার জন্যে আনবি, এসব তো ওরা ফ্রি দেবে। যদি না দেয়
ভ্যাবলা আস্তিন গুটিয়ে বলল, দেবে না মানে? তরুণ সভাকে ওরা হাড়ে হাড়ে চেনে। বলেই ধাঁ করে বেরিয়ে গেল।
বললাম, দেখুন, এ-সব হাঙ্গামা
হাঙ্গামার কিছু নেই দাদা, কিসসু না। ওরা সব পাড়ার লোক-আমাদের আপনার জন, দোকান লুট করে আনলেও কিছু বলবে না। আপনি কিছু ভাববেন না ও-সমস্ত। হেবো–দাদাকে একটা গান শুনিয়ে দে না ততক্ষণ।
হেবো তৎক্ষণাৎ রেডি। কোত্থেকে একটা পুরোনো হামোনিয়াম টেনে এনে গান গাইতে বসে গেল। সেটা আবার বেসুরো, একটা রিড টিপলে দুরকম আওয়াজ বেরোয়।
কিন্তু হেবো বেপরোয়া। সেই হার্মোনিয়াম বাজিয়েই সে চাঁচাছোলা গলায় হিন্দী ফিলিমি টাইপের গান ধরে দিল একটা–আরে বন বন মে চিড়িয়া
সে কী গান! শুনে মনে হচ্ছিল, এক ছুটে একেবারে চিড়িয়ার মোড় পর্যন্ত পালিয়ে যাই। কিন্তু আমাকে ঘিরে তখন তরুণবৃন্দ একেবারে চক্রব্যূহ। বসে বসে ঘামতে লাগলাম আমি।
এর মধ্যে একটা ডাব আর শালপাতায় দুটো সিঙাড়া এসে গেল। দাদা–একটু খান ন্যাপাদা বললেন।
কী করি, খেতে হল ডাব। কেমন নোনতা লাগল ডাবের জলটা। সিঙাড়া দুটোও বাসি, ভেতরে আবার পচা আলু। দাদার অনারে যত রদ্দিমাকা জিনিস ফ্রিতে চালিয়ে দিয়েছে।
কিছু বলতে পারলাম না, তাই খেতে হল। তারপর তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, বড় আনন্দ হল ভাই, আজ চলি।
হাঁ হাঁ, যাবেন বইকি, নিশ্চয়ই যাবেন। আপনাকে কি ধরে রাখতে পারি আমরা? সে-পুণ্যি কি আর করেছি দাদা।–ন্যাপাদা ভীষণভাবে হাত কচলাতে লাগলেন : যাবেন যদি, তাহলে যাওয়ার আগে আমাদের একটা বাণী দিয়ে যান।
বাণী?
হাঁ। আপনার মুখের বাণী। তাই আমাদের আদর্শ হবে দাদা, হবে তরুণ সভার পথের-পথের, হেবো মনে করিয়ে দিল : পাথেয়।
হুঁ। পাথেয়। বলুন দাদাবলুন, সেই পাথেয়ই দিন আমাদের।
তা–একটা ডাব আর দুটো সিঙাড়া খাওয়ার পরে একটুখানি পাথেয় দিতে কার আর খারাপ লাগে? তা ছাড়া লেখক হিসেবে আমাকে তো কেউ পাত্তাই দেয় না বাণী দেবার এমন সুবর্ণ সুযোগ পেলে ছাড়া যায় সেটা? গলা খাঁকারি দিয়ে আমি শুরু করলাম :
মনে রাখতে হবে, আমাদের হওয়া দরকার, মানে, জাতির উন্নতি করতে হলে আগে চাই মনুষ্যত্ব। চাই সেবা–চাই ইয়ে–মানে বল–মানে চাই ত্যাগ। জয় হিন্দ।
চটপট ক্ল্যাপ পড়ে গেল। ন্যাপাদা বললেন, ইস, দাদা কী ফাইন বক্তৃতা দেন। হেবো, লিখে নে–লিখে নে–এসব দামী কথা লিখে রাখতে হয়। একবার হারিয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না।
কিন্তু বাণী হেবো লিখল না। সে ভ্যাবলা-ট্যাবলার সঙ্গে কী যেন ফিসফাস করছিল আর আড়ে আড়ে তাকাচ্ছিল আমার দিকে।
ন্যাপাদা বললেন, কী আবার ফুসফাস করছিস তোরা?
ভ্যাবলা বললে, না–মানে, দাদার কাছে একটা নিবেদন আছে, কিন্তু লজ্জা করছে।
আরে দাদার কাছে আবার লজ্জা কিসের? ঘরের লোক। কী বলবি বল না–বলে ফেল–
ঘাড় চুলকে ভ্যাবলা বলল, মানে ইয়ে–আমাদের ডায়মণ্ডহারবারে পিকনিক আছে তো আসছে রবিবারে। গোটা কুড়ি টাকা কম পড়ছে, দাদা যদি একটু হেলপ করতেন–
শোনবামাত্র মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল আমার।
ন্যাপাদা বললেন, কুড়ি টাকা? মোটে কুড়ি টাকা? দাদা কত বিরাট লোক, তা জানিস? হাত ঝাড়লেই অমন কত কুড়ি টাকা ঝরে পড়ে। তা ছাড়া আমাদের আপনার লোক–কত ভালোবাসেন। আমি হলে তো একশো টাকা চাইতাম রে।
একশো টাকা! ডাবের জল আর পচা আলুর সিঙাড়া আমার গলায় উঠে এল। পালাবার রাস্তা খুঁজলাম, আমাকে ঘিরে দাড়িওলা তরুণদের চক্রব্যূহ। ন্যাপাদা আবার আধ হাত দূরেই দাঁড়িয়ে। এতক্ষণে টের পেলাম লোকটি বেশ গাঁট্টাগোট্টা–আমাকে জাপটে ধরলে ছিটকে পালাতে পারব না।
গলগল করে ঘাম ঝরতে লাগল গা দিয়ে। ঠোঁট চেপে বললাম : বারো, বারো টাকা আছে আমার কাছে।
বারো টাকা, মোটে বারো টাকা?–অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন ন্যাপাদা : দাদার মতো গ্রেটম্যান
আমি মোটেই গ্রেটম্যান নই, নিতান্ত গরিব কেরানি– আর্তনাদ করে বললাম, বিশ্বাস না হয় পকেট সার্চ করুন, আর বোধহয় আনা কয়েক খুচরো আছে, বাসে করে বাড়ি তো ফিরতে হবে।
ছি ছি দাদা, আপনাকে অবিশ্বাস? আপনার মতো মহামানবকে? দিন তা হলে, এদের ভালোবেসে বারোটা টাকাই দিন। খুচরোটা থাক। নে রে-গ্রেটম্যানের দান মাথায় তুলে নে। দাদার অনারে এই বারো টাকায় দুসের ভালো খাসির মাংস হয়ে যাবে তাদের।
তারপর দাদাগিরির বারো টাকা দাম দিয়ে, একটু ফাঁক পেয়ে–সোজা ছুটে এসেছি রাস্তায়। আর সামনে যে বাস পেয়েছি, উঠে বসেছি তাতে। পটলডাঙার বদলে এ বাস আমাকে পাতিপুকুরে নিয়ে যায় তো যাক, না হয় চার মাইল হেঁটেই বাড়ি ফিরব, কিন্তু তরুণ সভার ধারে কাছেও আর নয়।
এবং–এবং পরে যদি রাস্তায় কোনও অচেনা লোক আমাকে দাদা বলে ফের আলাপ জমাতে আসে, তাহলে স্রেফ যে খুনোখুনি হয়ে যাবে একথাটা আগেই জানিয়ে রাখলাম।