দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ৯

নয়

দরজা খুলে বনবিহারী দেখলেন একজন বয়স্কা মহিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন!’

‘আমি আপনার পাশের বাড়ির শিবশংকরের শাশুড়ি।’ সুনয়নী মাথা দোলালেন।

‘ও! কোনও সমস্যা—?’

‘না না। কাল থেকে কোমরে খুব ব্যাথা লাগছে, উঠতে বসতে খচ করে উঠছে। মেয়ে বলল, পাশের বাড়িতে আপনি আছেন, দেখিয়ে নিতে।’ সুনয়নী মিথ্যে কথাগুলো মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে সাহস পেলেন না।

‘ও! আপনি বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমার চেম্বারে যাবেন। আমি দেখে দেব।’

‘চেম্বারে? বাব্বা! অতদূরে যেতেই পারব না। হাঁটতে গেলেও লাগছে।’

‘একটা রিকশা নিয়ে নেবেন। বাড়িতে আমি কোনও পেশেন্ট দেখি না। আচ্ছা, নমস্কার। প্রায় মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন বনবিহারী।

ততক্ষণে ঘরে ঢুকেছিল কালীচরণ। এবার ফিসফিস করে বলল, ‘সর্বনাশ।’

‘সর্বনাশের কি হল?’ বনবিহারী বাথরুমের দিকে এগোচ্ছিলেন।

‘মিথ্যে কথা, একদম মিথ্যে কথা কাল বিকেলেও ওঁকে সেজেগুজে চা বাগানের দিকে বেড়াতে যেতে দেখেছি। আজ সকালেও বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। কোমরে ব্যথার বাহানা নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল।’ কালীচরণ বলল।

‘কি লাভ? একজন মধ্যবয়সি মহিলা বানিয়ে রোগের কথা বলতে আসবেন কেন? মনটাকে দিন দিন ছোট করে ফেলছ তুমি।’ বকলেন বনবিহারী।

‘আমি মন ছোট করছি? আচ্ছা বলুন তো এইসময় কোনও বাড়ির মা-পিসি অমন সাজগোজ করে পাশের বাড়িতে যায়? ওকে কি দেখে আপনার মনে হল ডাক্তারের কাছে অসুখের কথা বলতে এসেছে না নেমন্তন্ন খেতে এসেছে?’ কালীচরণ খেঁকিয়ে উঠল।

‘নেমন্তন্ন!’

‘উঃ! খোঁজ নিতে এসেছিল। আপনি যদি বাইরের ঘরে বসে ব্যথার ফিরিস্তি শুনতেন, উনি কানখাড়া করে থাকতেন আর কারও গলা শোনার জন্য। নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন এই বাড়িতে নতুন মানুষ এসেছে। এই বাচ্চাটাও হয়েছে তেমনি। খিদে পেলেই মরাকান্না কাঁদতে আরম্ভ করে।’ কালীচরণ ভেতরে চলে গেল।

বাথরুমে যাচ্ছিলেন হাত-পা ধুতে, যাওয়া হল না। একটা চেয়ারে বসে পড়লেন বনবিহারী। শিশুর কান্না তো মুখ চাপা দিয়ে থামানো যায় না। এই বাড়ি থেকে সেই কান্না ভেসে এলে প্রতিবেশীরা কৌতূহলী হবেনই। কালীচরণের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ভদ্রমহিলা কোমরের ব্যথা না বলে যদি জিজ্ঞাসা করতেন, আপনার বাড়িতে বাচ্চা এসেছে নাকি তাহলে কী জবাব দিতেন? শিবশংকর তো এই ঘরে এসে গল্প করে গেছে কতবার। সে-ও তো ভেতরে গিয়ে দেখতে পারে। চেষ্টাচরিত্র করে মামণিকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব কিন্তু কোনও শিশুকে নয়। কোলে ওঠার বয়স হলেই বাইরে বেরুতে চাইবে। বেশি চাপাচাপি করে রাখলে লোকের মনে অন্যরকম সন্দেহ হবে। মাথা নাড়লেন বনবিহারী। না, সেটা হতে দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু কি পরিচয় দেওয়া যায় ওদের?

কালীচরণ ঘরে এল বাজারের ব্যাগ হাতে। বলল, ‘জলখাবার দিয়ে যাব?’

‘অ্যা!’

‘কি হল? এভাবে বসে আছেন কেন?’

‘না ভাবছি ওদের এভবে লুকিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না। আজ বাদে কাল লোকে জানতেই পারবে। তার চেয়ে—।’ কালীচরণের মুখের দিকে তাকালেন বনবিহারী, ‘আচ্ছা, যদি বলা হয় মামণি আমার পিসতুতো দিদির মেয়ে। বিধবা হয়েছে বলে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারছে না। ওর ভাইরাও রাখতে চাইছে না বলে এখানে এসেছে। কি মনে হয়? লোকে বিশ্বাস করবে?’

কালীচরণ বলল, ‘আপনি তো বেশ গল্প বানাতে পারেন! যা বলবেন তা থেকে নড়া চলবে না। ওর শ্বশুরবাড়ি কোথায় ছিল, মায়ের বাড়ি কোথায় সব ভেবেচিন্তে বলতে হবে। যারা শুনবে তারা যদি বিশ্বাস না করে তো আমাদের কিছু করার নেই। যান মুখ-হাত ধুয়ে নিন। আপনাকে জলখাবার দিয়ে হাটে যাব। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

‘সে কোথায়?’

‘তিনি এতক্ষণ রান্নাঘরে ছিলেন। আমার লুচি ভাজা দেখছিলেন। এখন চানে ঢুকেছেন।’ কালীচরণ ফিরে গেল রান্নাঘরে।

জলখাবার খেয়ে নিজের খাটে শরীর এলিয়ে দিলেন বনবিহারী। শোয়ার পর মনে হল সকাল থেকে বাচ্চার কান্না শুনতে পাননি। ভাবলেন একবার ওদের ঘরে গিয়ে দেখে আসবেন। তখনই পালবাবুর কথা মাথায় ফিরে এল। লোকটাকে নিয়ে কি করা যায়? একজন ষাট বছরের লোক সারাজীবন অনেক ভোগ করেও ক্ষান্ত হল না? এখনও তার নারীসঙ্গ পাওয়ার বাসনা? তাঁকে ভায়াগ্রা আনিয়ে দিতে বলেছে। এই বলাটা ব্ল্যাকমেইল করা ছাড়া আর কিছুই নয়। জেনেশুনে সেটা মেনে নেবেন কি করে?

আবার না মেনে নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাঁকে জেলে যেতে হবে। মামণিকেও। ওই বাচ্চাটার কি হবে? ভেবে কুল পাচ্ছিলেন না বনবিহারী। একমাত্র পথ হল মামণিকে বাচ্চা সমেত কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া। তারপর পুলিশ যদি জানতে পারে তাহলে কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। পায়ের শব্দ হল, চোখ খুললেন বনবিহারী।

মামণি দাঁড়িয়ে আছে খাটের পাশে। হাসছে। দীর্ঘাঙ্গিনী মেয়েটির পরনে লাল শাড়ি। বনবিহারীর কাছে থেকে টাকা নিয়ে কালীচরণ গত সপ্তাহে ধুপগুড়ি থেকে কিনে এনেছিল। সেই শাড়ি পরেছে আজ।

আবার হাসল মামণি। তারপর একটা আঙুল ব্লাউজের হাতার মধ্যে ঢুকিয়ে দেখাল এটা বড় হয়েছে।

বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘কালীচরণের কাণ্ড। ঠিক আছে, আর এক সাইজ ছোট নিয়ে আসতে বলব। তোমাকে শাড়িতে খুব ভালো দেখাচ্ছে।’

লজ্জা পেল না মেয়েটা। উলটে এক পাক ঘুরে নিল।

একটু সরে গেলেন বনবিহারী, ‘বসো এখানে।’

মামণি বসল। তার কপালে ভাঁজ পড়ল বনবিহারীর মুখ দেখে।

‘তুমি যাদের সঙ্গে ছিলে তাদের পুলিশ মেরে ফেলেছে। হয়তো যে তোমার সন্তানের বাবা সে-ও বেঁচে নেই। কিন্তু তাতেও শান্তি হল না। চ-বাগানের ভেতর যে ছেলেটার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল তার খুনিকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছে এখন। এ বাড়িতে কোনও মেয়ে বা শিশু যে কখনও ছিল না তা সবাই জনে। পুলিশ যদি জানতে পারে ওই দলে একটি মেয়ে ছিল তাহলে তোমার বিপদ হবে। তাছাড়া যার গাড়িতে তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম সে খবরটা ফাঁস করে দিতে পারে। তাই তোমার আর এখানে থাকা উচিত নয়। তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন সেটা বলো।’ বনবিহারী তাকালেন।

মামণি মাথা নাড়ল। হাত নেড়ে বোঝাল তারা কেউ নেই।

‘তুমি কার কাছে ছিলে? কাকাদের কাছে?’

মাথা নাড়ল মামণি, না।

‘তাহলে মামার বাড়িতে?’

‘সঙ্গে সঙ্গে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মামণি।

‘ও।’ বনবিহারী একটা সূত্র পেয়ে উঠে বসলেন, ‘মামার বাড়ির ঠিকানাটা লিখে দাও। আমি তোমাদের সেখানে পৌঁছে দেব।’

দ্রুত মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল মামণি। বোঝাতে চাইলেন বনবিহারী কিন্তু কিছুতেই মানতে চাইল না সে।

‘বেশ। তাহলে অন্য জায়গায় আমি ব্যবস্থা করছি।’ গম্ভীর গলায় বললেন বনবিহারী।

সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল মামণি। বনবিহারীর কোলের ওপর মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তার মাথাটা এপাশ-ওপাশ করছে।

আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকলেন বনবিহারী। কান্নার শব্দ বাড়ছে। বনবিহারীর ভয় হচ্ছিল আওয়াজটা বাইরে গেলে যে কেউ শুনতে পাবে। তিনি মামণির মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে চাইলেন। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হল না। ভয় বাড়তে লাগল বনবিহারীর। শেষ পর্যন্ত তিনি বলতে বাধ্য হলেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকে কোথাও যেতে হবে না।’

সঙ্গে সঙ্গে মাথা স্থির হয়ে গেল, কান্নাও বন্ধ। কয়েক সেকেন্ড পরে ধীরে ধীরে মুখ তুলল মামণি। চোখের জলে গাল ভিজে গেছে। সেই অবস্থায় সন্দেহ দৃষ্টিতে বনবিহারীর ডান হাত নিজের হাতে ধরে মাথা ঝাঁকাল। অর্থাৎ সত্যি তো!

বনবিহারী বললেন, ‘হ্যাঁ।’

আচমকা বনবিহারীর গলা দু-হাতে জড়িয়ে ধরে টুক করে ওঁর গালে চুমু খেয়ে দৌড়ে চলে গেল মামণি এই ঘর থেকে।

বনবিহারী হতভম্ব। শ্বাস স্থির হয়ে গিয়েছিল তাঁর। এই পঞ্চাশ উত্তীর্ণ বয়সে এই প্রথম কোনও যুবতী তাঁর গালে চুমু খেল। শরীরের সব শক্তি যেন এক লহমায় উধাও হয়ে গিয়েছে। এবং তারপরেই একটা অপরাধবোধে আক্রান্ত হলেন তিনি। ছি ছি। এটা কি হল? ঠিক সময়ে বিয়ে করলে এর বয়সি একটা মেয়ে থাকত তাঁর। মেয়েটা কি পাগল? কিছুদিন আগে যার জন্যে ও মা হয়েছে সে নেই জেনেও শোকে ভেঙে পড়েনি। এখন তাঁর গালে চুমু খেল? ও যদি ভেবে থাকে আর পাঁচটা পুরুষের মতো বনবিহারীও সহজলভ্য তাহলে এক মুহূর্ত এখানে থাকতে দিতে পারেন না তিনি। আজ যেটা শুরু হল সেটা তো ক্রমশ আরও বাড়তে পারে। ভাবতেই কণ্টকিত হলেন তিনি। হাতের চেটো দিয়ে গাল মুছলেন।

খাট থেকে নামতেই দ্বিতীয় ভাবনাটা মাথায় এল। একেবারেই সারল্য থেকে মামণি তাঁকে চুমু খেতে পারে। না যেতে চাওয়ার আবদার পূর্ণ হয়েছে ভেবে আনন্দের আতিশয্যে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। এবং কাজটা যে খারাপ, ঠিক নয়, এই বোধ ওর ছিল না। তাঁর নিজের মনে কু থাকায় তিনি খারাপ ভাবে নিচ্ছেন। ব্যাপারটাকে এভাবে ভাবতেই লজ্জিত হলেন বনবিহারী।

বাইরের দরজায় শব্দ হচ্ছিল। ভেতর থেকে বন্ধ করে কালীচরণ খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে হাটে গিয়েছে। বনবিহারী ঘরগুলো পেরিয়ে এসে দরজা খুললেন। একজন মাঝবয়সি মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ডাক্তারবাবু আছেন?’

‘কি দরকার বলুন?’

‘ওঁকেই বলব।’

‘আমিই ডাক্তার।’

‘ওহো।! নমস্কার। নমস্কার। আমি শম্ভুর জামাইবাবু। ও আমাকে খবর পাঠিয়েছিল। আজ এখানে এসে শুনলাম ওকে জরুরি কাজে মালিককে নিয়ে শহরে যেতে হচ্ছে। বিকেলে ফিরবে। ততক্ষণ তো অপেক্ষা করতে পারব না। ওই আপনার চেম্বারের ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলল। সেখানে গিয়ে দেখলাম চেম্বার বন্ধ। তাই ঠিকানার খোঁজ নিয়ে এখানে চলে এলাম। ভেতরে গিয়ে বসতে পারি?’

‘আপনার নাম?’

‘হরিপদ দাস।’

‘আসুন।’

ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে হরিপদ বললেন, ‘শম্ভু নিশ্চয়ই আমাদের কথা বলেছে। বহু বছর বিয়ে হয়ে গেল। আমাদের কোনও সন্তান হচ্ছে না। অথচ ডাক্তার বলছেন আমার বা আমার স্ত্রীর কোনও দোষ নেই। বুঝতেই পারছেন সংসারে সন্তান না থাকলে কীরকম খাঁ-খাঁ লাগে চারধার। তাই ভেবেছিলাম কোনও ভালো বংশের বাচ্চাকে দত্তক নেব। খোঁজও পেয়েছি কাল কিন্তু সেটি মেয়ে। মেয়ে মানেই বিশ-বাইশ বছর পর পরের ঘরে চলে যাবে। তা শম্ভু খবর দিল আপনার কোনও আত্মীয় এবং তার স্ত্রী গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে কিন্তু তার দু-মাসের বাচ্চা অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে। বাচ্চাটাকে দেখাশোনা করার কেউ নেই বলে আপনি আপনার কাছে নিয়ে এসেছেন। আপনি নাকি চাইছেন কোনও ভালো পরিবার ওকে দত্তক নিক। এই বাচ্চা কি ছেলে?’ হরিপদ জিজ্ঞাসা করলেন।

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন বনবিহারী।

‘বাঃ। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে! আপনি আমার সম্পর্কে যদি খোঁজখবর নেন তাহলে কোনও খারাপ কথা শুনতে পাবেন না। কার বাড়িতে বাচ্চা যাচ্ছে তা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন। তবে একটা অনুরোধ, আমরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়া, শম্ভু এবং আপনার বাইরে যেন আর কোনও পঞ্চম ব্যক্তি এটা না জানে।’

‘কিন্তু আপনি বাচ্চাটাকে নিয়ে গেলে পাড়া-প্রতিবেশীরা তো প্রশ্ন করবে।’

‘সে তো ঠিকই। তাই ঠিক করেছি স্ত্রীকে আগামী পাঁচ-সাত মাস কলকাতায় পাঠিয়ে দেব। পাঁচজনকে বলব ওর শরীরে সন্তান এসেছে কিন্তু এতদিন বাদে এসেছে বলে ডাক্তার বলেছেন কলকাতায় নিয়ে গিয়ে রেগুলার চেক আপে থাকতে। দুই-আড়াই মাস পরে সবাইকে জানিয়ে যাদেব যে ওর ছেলে হয়েছে। শুনেছি আপনার কাছে যে আছে তার বয়স এখনও একমাস হয়নি। দু-মাসের বাচ্চার সঙ্গে পাঁচ মাসের বাচ্চার কি পার্থক্য হবে।’

হরিপদ হাসলেন। যেন দারুণ পরিকল্পনা করেছেন।

‘এ তো ভালো কথা হরিপদবাবু। কিন্তু শম্ভু বোধহয় জানে তাই আপনাকে বলেনি।’

‘কি বলুন তো?’

‘আমার আত্মীয়টি মারা গিয়েছে কিন্তু তার স্ত্রী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর বেঁচে গেছে। শুধু দুর্ঘটনার কারণে ওর কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে।’

‘অ্যাঁ!’

‘না তাতে কোনও অসুবিধে নেই। ওই বাচ্চাকে মানুষ করার সামর্থ্য ওর নেই। আপনি দত্তক নিতে চাইলে নিতেই পারেন। শুধু—!’

‘শুধু?’

‘কোনও মা কি তার বাচ্চাকে ছেড়ে থাকতে পারে? যদি তাকেও নিয়ে যান তাহলে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়। মেয়েটি শিষ্ট, ভদ্র। শুধু কথা বলতে পারে না এই যা।’

‘কি আশ্চর্য! লোকে কি বলবে?’ সোজা হয়ে বসলেন হরিপদ।

‘পাঁচজনকে বলবেন কলকাতা থেকে ছেলেকে দেখাশোনা করার জন্যে আয়া এনেছেন।’ বনবিহারী বললেন।

হরিপদ দাস একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘না ডাক্তারবাবু। গাইবাছুর একসঙ্গে নিয়ে যেতে পারব না। আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ, আয়া রাখার ক্ষমতা নেই।’

‘ওর মায়ের জন্যে খাওয়াপরা ছাড়া কোনও খরচা করতে হবে না আপনাকে।’

‘মায়ের বয়স কত?’

‘কত হবে। বড় জোর চব্বিশ।’

‘দেখতে শুনতে?’

‘ভালো। বেশ ভালো।’

‘ওরে ব্বাবা! অসম্ভব।’

‘কেন?’

‘আমার স্ত্রীকে তো আপনি কখনও দ্যাখেননি। সবসময় আমাকে সন্দেহ করেন। তারপর যদি বাচ্চার মাকে নিয়ে যাই তাহলে জীবন নরক হয়ে যাবে। সবসময় সন্দেহ করবেন আমি তার সঙ্গে ফস্টিনস্টি করছি।’

‘মেয়েটি কথা বলতে পারে না হরিপদবাবু।’

‘কথা কে চায়? শরীর, মেয়েমানুষের শরীর হল তাদের শত্রু। অন্য মেয়েমানুষও সেটা সহ্য করতে পারে না। না ডাক্তারবাবু, শুধু বাচ্চা পেলে আমি ওকে নিয়ে যেতাম। আপনি ওর মাকে বুঝিয়ে বলুন।’ হরিপদ বললেন।

‘চেষ্টা করেছি, সক্ষম হইনি।’ মাথা নাড়লেন বনবিহারী।

‘ঠিক আছে। বাড়ি গিয়ে গিন্নীকে বলি। মনে হয় রাজি হবেন না। আসলে কি জানেন, অজ্ঞাতপরিচয় বাচ্চাকে তো দত্তক নিতে পারি না। হয়তো বাপ খুনি ছিল, বড় হয়ে দেখব এটাও তাই হয়েছে। রক্ত তো কথা বলে এক্ষেত্রে সেই ভয় ছিল না। আচ্ছা!’ হরিপদ উঠে বেরিয়ে যেতে যেতে দাঁড়ালেন।

‘একটা অনুরোধ করব। বাচ্চাটাকে দেখা যাবে?’

‘আপনি স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে মন স্থির করুন। বাচ্চাটা বেশ হেলদি। ওকে নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই।’ বনবিহারী এগিয়ে গেলেন।

হরিপদকে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করতে করতে দেখতে পেলেন কালীচরণ হাট থেকে ফিরছে। ঘরে ঢুকে সে বলল, ‘যা সন্দেহ করেছিলাম তাই। মতির মায়ের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞাসা করল আমাদের বাড়ি থেকে বাচ্চার কান্না সে শুনতে পেয়েছে। আমি আর কী বলব, বললাম, ডাক্তারবাবুর দূরসম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন এসেছে। বাচ্চাটা তাদেরই। সে বিশ্বাস করল।’

‘বাঃ খুব ভালো বলেছ। তাহলে তো সমস্যা চুকে গেল।’

‘না যায়নি। জিজ্ঞাসা করলাম একথা তুমি আর কাউকে বলেছ নাকি? প্রথমে ন্যাকামি করল। ওমা, একটা বাচ্চা কাঁদছে আর আমি তার কথা বলে বেড়াব নাকি! শুধু তোমাদের পাশের বাড়ির নতুন মাসিমা জানতে চাইল তাই বলেছি। বুঝলেন। শুনেই বুড়ি ছুটে এসেছে কোমরের ব্যথার ভান করে।’ কালীচরণ বলল। ভদ্রমহিলাকে তোমার বুড়ি বলে মনে হয়েছে?’

‘নয়তো কি! অতবড় মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে, বুড়ি নয় তো কি ছুঁড়ি?’ ভেতরে যেতে যেতে কালীচরণ বলে গেল, ‘আজকাল অবশ্য যেভাবে শাড়ি পরে কে বুড়ি আর কে ছুঁড়ি দেখলে বোঝা যায় না।’

শম্ভুর জামাইবাবুকে বিদায় করে খুশি হলেন বনবিহারী। যদি মামণি না থাকত তাহলে তিনি মানুষটিকে নিরাশ করতেন না। কিন্তু ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছেয় হোক তিনি মামণিকে কথা দিয়ে ফেলেছেন। এখন মনে হচ্ছে সেটা দিয়ে ভালো করেননি। ভেতরের ঘরে গেলেন বনবিহারী। বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে মামণি। কোনও আড়াল-আবডাল নেই। প্রচণ্ড লজ্জা পেয়ে সরে এলেন বনবিহারী।

মেয়েটি মন্দ রাঁধে না। কালীচরণ যে হাটে গিয়ে মাংস কিনে এনেছে তা তিনি জানতেন না। রেডমিট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। বহু মাস খাওয়া হয়নি বলে আজ খেলেন। তার আগে কালীচরণ যথারীতি ঢেঁকির শাক রাঁধতে গিয়ে ধেরিয়েছে। পাথরঠোকা বা ছিলামাছ মোটামুটি। এসব জিনিস মায়ের হাতে কি দারুণ খুলত।

খাওয়ার টেবিলে একাই খেতে বসেছিলেন তিনি। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সে কোথায়?’

‘বাচ্চার কাছে। ঘুম পাড়াচ্ছে।’

মাংস পাতে ঢাললেন বনবিহারী। ভাতে ঝোল মেখে মুখে দিতেই বুঝলেন ওই রান্না কালীচরণের কর্ম নয়। স্বাদে-গন্ধে অপূর্ব হয়েছে। আর একটু ভাত চেয়ে নিলেন।

কালীচরণ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন খাচ্ছেন মাংস?’

‘তোমার হাত এত ভালো হল কি করে?’

‘এটা আমি করিনি। মামণি করেছে।’

‘অ।’

‘কোনোদিন ভাত নেন না, আজ নিলেন যে!’

‘নাঃ। সত্যি ভালো রেঁধেছে মেয়েটা।’

এইসময় মামণি দরজায় এসে দাঁড়াতেই কালীচরণ বলল, ‘কাল থেকে তুমি রাঁধবে। তোমার হাতের রান্না খাওয়ার পর বাবু আমার রান্না খাবেন না।’

সঙ্গে-সঙ্গে হাত নেড়ে যা বলল তা শুধু গোঙানি শোনাল।

বনবিহারী বললেন, ‘এসো, খেতে বসো।’

মাথা নাড়ল মামণি। তারপর আঙুল নেড়ে নিজেকে আর কালীচরণকে দেখিয়ে দিল। অর্থাৎ সে কালীচরণের সঙ্গে খাবে।

কালীচরণ বলল, ‘দেখুন মেয়ের কাণ্ড! আমি যে এ বাড়ির কাজের লোক তাও বোঝে না। আচ্ছা জ্বালায় পড়লাম।’

দুপুরের পর হাটের চেহারা বদলে যায়। শাক-সবজি, মাছের দোকান উধাও হয়ে যায়। তার বদলে বসে চুড়ি, সাবান স্নো, মেয়েদের মাথার ফিতে থেকে অন্যান্য সাজগোজের জিনিসের দোকান। এসময় আদিবাসী মেয়েরা দলে দলে আসে সেগুলো কিনতে। বনবিহারী দেখতে দেখতে হাঁটছিলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল একটি চাকাওয়ালা ভ্যানের ওপর। সেখানে রঙবেরঙের কাচের চুড়ি সাজানো। এগিয়ে গিয়ে নীল আর সোনালি রঙের একডজন চুড়ি কিনে ফেললেন। দরাদরি করলেন না। কারণ তিনি প্রকৃত দর জানেন না। ঠোঙায় মোড়া চুড়িগুলো পকেটে পোরার পর চারপাশে তাকালেন। না। পরিচিত কেউ নেই।

আজ চেম্বারে কোনও পেশেন্ট নেই। যে ছেলেটি দরজা খোলা-বন্ধ করে সে জানাল, ‘সকালে এগারোজন এসেছিল। বিকেলে আপনি আসেন না বলে কেউ আসেনি। আমি বলে দিয়েছি কাল আসতে।’

বনবিহারী চুপচাপ বসে নতুন ওষুধের লিটারেচার পড়ছিলেন। কত কি ভালো ওষুধ বেরিয়েছে। সেগুলো নোট করছিলেন। হঠাৎ একটা রিকশা চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়াল। বনবিহারী মুখ তুলে দেখলেন শিবশংকরের শাশুড়ি রিকশা থেকে নামছেন। নামার সময় ভদ্রমহিলাকে বেশ স্বচ্ছন্দ বলে মনে হল। রিকশা দাঁড় করিয়ে চেম্বারে আসার সময় তিনি খোঁড়াতে শুরু করলেন। দরজায় এসে বললেন, ‘ব্যথাটা আরও বেড়েছে ডাক্তারবাবু।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *