দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ৭

সাত

শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলেন বনবিহারী। খানিকটা জল পেটে যেতেই আবার সে চোখ বন্ধ করেছে। কি নির্মল প্রশান্তি তার গালে, চিবুকে। এই শিশু আজ জানতেও পারল না সে মাতৃহারা হল। ওর মা যে আর ফিরে আসবে না এ ব্যাপারে বনবিহারীর কোনও সন্দেহ নেই।

বনবিহারীকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে কালীচরণ বলল, ‘উঠুন। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেল।’

বনবিহারী তাকালেন, ‘কালীচরণ, এই শিশুর কি হবে?’

‘যার কেউ নেই তার জন্যে ভগবান আছেন। তিনিই একে দেখবেন। আর ও তো ভালো জায়গায় যাচ্ছে, আদরেই থাকবে।’

ঘণ্টাখানেক বাদে এই বাড়ির সব আলো নিভে গেলেও শিশুর ঘরে একটা নীচু শক্তির আলো জ্বলছিল। বনবিহারী আজ এই ঘরের খাটে, শিশুর শরীর বাঁচিয়ে শুয়েছিলেন। তাঁর ঘুম আসছিল না।

আজ পর্যন্ত তিনি কোনও জটিলতায় জড়াননি। সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত রুগি দেখতে দেখতে বিয়ের বয়সও কাটিয়ে দিয়েছেন। বিয়ে করে একজন ভদ্রমহিলাকে জীবনে আনলে দিনগুলো জটিল হয়ে যেত বলে এখন তাঁর মনে হয়। এই গঞ্জের মানুষের পাশে নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছেন তিনি। একটা ভালো হেলথ সেন্টার হলে এখানকার মানুষ উপকৃত হবে। সেটা প্রায় সম্ভব হতে চলেছে। এছাড়া তাঁর কোনও দুশ্চিন্তা নেই। হঠাৎ ওই বোবা মেয়েটি তাঁর জীবনটাকে অন্যরকম করে দিয়ে গেল। এরা তাঁর মনে বাৎসল্যরস এনে দিয়েছে। শিশুর মুখের দিকে তাকালে মনে বড় মায়া জাগে! উলটোদিকে পুলিশ যদি জানতে পারে তাহলে তারা তাঁকে উগ্রপন্থীদের সাহায্য করার অপরাধে জেলে পুরবে। একজন ডাক্তার এবং মানুষ হিসেবে তিনি কর্তব্য করেছেন এই যুক্তি পুলিশ মানবে না।

চোখ বন্ধ করলেন বনবিহারী। গত দু’বছর ধরে পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশে এই যে আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠেছিল, এখন সেটা অনেকটাই স্তিমিত। প্রচুর ভালো ছেলে মারা গিয়েছে পুলিশের গুলিতে। এই একাত্তরের শেষে এসে তাঁর কেবলই মনে হয় এইসব মেধাবী ছেলেগুলো কি নিজেদের ভবিষ্যত, আন্দোলনের ভবিষ্যত কি হবে তা জানত না?’

ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেয়েছিল কোনও যুদ্ধ না করে। নিরানব্বুই ভাগ ভারতবাসী মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেনি। স্বাধীনতা দরকার এই বোধ অনেকেরই ছিল না। যদি থাকত তাহলে আজাদ হিন্দ বাহিনী যখন এগিয়ে আসছিল তখন লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী এগিয়ে যেত তাদের স্বাগত জানাতে। খাওয়া-পরার মধ্যেই যাদের জীবনের শান্তি তাদের অনেকেই বলেছে, ব্রিটিশ আমল ভালো ছিল। যেহেতু মহাত্মা গান্ধী পুরোভাগে ছিলেন তাই কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল। স্বাধীনতার কুড়ি বছর পর পশ্চিম বাংলায় তাদের সরিয়ে বিরোধীরা একত্রিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কিছুদিনের জন্যে। এই দুই দলের শাসন ব্যবস্থা অসন্তুষ্ট করেছিল যাদের তারা বিপ্লব চাইল। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কাঠামো পালটাতে চাইল চিনের আদর্শে। প্রথম প্রথম সাধারণ মানুষ এদের বুঝতে চাইল, কেউ কেউ মনে মনে সমর্থন করেছিল কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হল এদের পক্ষে বিপ্লব আনা অসম্ভব।

বিপ্লব কি কারও বা কোনও দলের পক্ষে এই ভারতবর্ষে করা সম্ভব? এত বড় দেশের এতগুলো প্রদেশের মানুষের ভাষা, আচার, ব্যবহার, ভাবনায় এত পার্থক্য যে সবাই এক হয়ে আন্দোলনে নামবে তা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। তাছাড়া পাইপগান বা পেটো নিয়ে শিক্ষিত মিলিটারিদের সঙ্গে লড়াই করা যে আত্মহত্যার সামিল সেটা যখন একটা শিশুও বুঝতে পারে তখন এই ছেলে-মেয়েগুলো ঘর ছাড়ে কোন উন্মাদনায়?

একাত্তর সাল শেষ হতে বেশি দেরি নেই। বনবিহারী শ্বাস ফেললেন। আজ থেকে দশ বছর পরে এই ছেলেগুলোর কথা ভারতবর্ষের মানুষ মনে রাখবে কিনা সন্দেহ।

অন্ধকারে সাইকেলটা পিচের রাস্তা ছেড়ে চা-বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। এখন পথ মসৃণ নয়। এবড়ো-খেবড়ো মাটির ওপর বুনো ঘাস। সাইকেলের চাকা লাফাচ্ছিল খুব। শেষ পর্যন্ত সাইকেলের রডে বসে থাকা মামণি প্রতিবাদ করল। তার মুখ থেকে গোঙানি বেরিয়ে এল। জোরে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে নাড়াতে লাগল সে।

ছেলেটি বলল, ‘কি হচ্ছে? পড়ে যাব এরকম করলে।’

কিন্তু মামনি নাছোড়বান্দা। সাইকেল থামতেই সে নেমে পড়ে পেটে হাত দিয়ে উবু হয়ে বসল। এখানে যেটুকু আলো তা দূরের তারাদের শরীর থেকে চুঁইয়ে নামছে। তাতে দুটো মানুষের শরীর স্পষ্ট হচ্ছে না। ছেলেটি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হল তোর? শরীর খারাপ লাগছে?’

মামণি মাথা নেড়ে পেটে হাত দিল। বোঝাল, পেটে ব্যথা করছে।

‘একটু বেশি ঝাঁকুনি লেগেছে। বোধহয় পেটের নাড়ি এখনও ভালো করে শুকোয়নি। আচ্ছা, আর একটু কষ্ট কর। সামনের ঝরনা পেরুলেই জঙ্গলের পথ। ওখানে উঁচু-নীচু নেই। ঝাঁকুনি লাগবে না।’ ছেলেটি বলল।

উত্তরে মামনি মাথা নাড়ল। সে যাবে না!

‘তার মানে? তুই এখানে বসে থাকবি?’ ছেলেটি চেঁচাল।

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মামণি।

‘আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল। শোন, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারি তত আমাদের মঙ্গল। একবার জঙ্গলে ঢুকে যেতে পারলে রাতারাতি এই থানার এলাকার বাইরে চলে যেতে পারব। ওঠ!’

মামণি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না। চুপচাপ বসে রইল।

ছেলেটি সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে মেয়েটার পাশে এসে বসল। নরম গলায় বলল, ‘বাচ্চার জন্যে মন কেমন করছে?’

প্রশ্নটা শোনামাত্র মামণি মাথা নেড়ে জানাল করছে।

হাসল ছেলেটি, ‘ধ্যুস। ক’দিন আগেও তুই ওটাকে দেখিসনি। ওর জন্যে মন খারাপ করার কোনও মানে আছে? ধর কারও পেটে টিউমার হয়েছে। ডাক্তার সেটা অপারেশন করে বের করে দিল। এও সেরকম। টিউমারটার জন্যে কারও মন খারাপ হয়? বোকা মেয়ে! চল, আস্তে আস্তে যাব।’

মামণি এবার রেগে গেল। যে ধ্বনি তার গলা থেকে ছিটকে এল তাতে রাগ স্পষ্ট। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর মতলব কি বল তো?’

মামণি মুখ ফিরিয়ে নিল উলটোদিকে।

ছেলেটি কয়েক সেকেন্ড দেখল, তারপর দু-হাতে মামণিকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। মামণি অবাক হয়ে তাকাতে ছেলেটি বলল, ‘তোকে ছেড়ে আমি যেতে পারি না। শোন, আমি তোকে ভালোবাসি। ভগবান মানি না, কিন্তু পুলিশ আর সবাইকে মেরেছে তোকে-আমাকে মারতে পারেনি যখন তখন আমাদের একসঙ্গে থাকা উচিত।’

শুনতে শুনতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল মামণি। প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে ছেলেটিকে ঠেলে ফেলে সে উঠে দৌড়তে শুরু করল। কোথায় যাচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করল না। ছেলেটা সামলে নিল দ্রুত। তারপর মামণির পেছনে দৌড়াতে লাগল।

চায়ের বাগানের মধ্যে ছুটতে গিয়ে নালায় পা পড়ে হোঁচট খেল মামণি। কিন্তু উঠে দাঁড়াবার আগেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটি। দু-হাতে শক্ত করে ধরে হিসহিস করল, ‘আমার কথা কানে যাচ্ছে না? তোর জন্যে এতদিন এখানে ঝুঁকি নিয়ে পড়ে থাকলাম, এই জন্যে? অ্যাঁ!’

নিস্তেজ হয়ে গেল মামণি। তার তলপেটে ব্যাথা তীব্র হচ্ছিল। মুখ নীচু করে মামণির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল ছেলেটি। কয়েক সেকেন্ড। তারপর তার হাত উঠে এল বুকের ওপর। নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে সে মরিয়া হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে প্রতিবাদের গোঙানি ছিটকে বেরুল মুখ থেকে। অর্ধভুক্ত, জঙ্গলে কাটানো ছেলেটির শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় মামণি তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারল নিজের শরীর থেকে। ছেলেটি আবার হাত বাড়াতে যেতেই পাশে পড়ে থাকা একটা বড় পাথর দু-হাতে তুলে সজোরে ছেলেটার দিকে ছুড়ে দিল মামণি। তারপর দৌড়ে চলে এল সাইকেলটার কাছে। তার পেটে যন্ত্রণা হচ্ছিল। শ্বাস নিতে নিতে পেছন ফিরে তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখতে পেল না। খোলা রাতের আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে সে জান্তব গলায় কেঁদে উঠল। সেই শব্দে চা বাগানের শেডটি থেকে কয়েকটা পাখি ভয় পেয়ে ডেকে উঠেই থেমে গেল।

পেট চেপে ধরে ধীরে ধীরে পা ফেলল মামণি। মেঘ জমছিল আকাশে, তারারা নিভল।

ঝিমুনি এসেছিল বনবিহারীর। আচমকা সম্বিত ফিরতে দেখলেন শিশু কাঁদছে। তাড়াতাড়ি ওকে শান্ত করতে চেষ্টা করতেই বুঝলেন বেচারা জলবিয়োগ করে ভেজা তোয়ালেতে শুয়ে থাকতে চাইছে না। সেটা পালটাতে না পালটাতেই বৃষ্টি নামল। কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙেছিল কালীচরণের। এঘরে এসে সে দেখল ডাক্তারবাবু শিশুকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।

কালীচরণ বলল, ‘এখন আবার দুধ গরম করতে হবে।’

‘কেন? বনবিহারী তাকালে।

‘বুঝতে পারছেন না? ওর খিদে পেয়েছে।’

‘ও। তাড়াতাড়ি কর।’

‘হয়ে গেল। এভবে চললে দিনরাত এক হয়ে যাবে।’

ঠিক তখনই আওয়াজ ভেসে এল। বনবিহারীর মনে হল ঝড়ে কোনও খোলা জানলা নড়ছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোনও জানলা খুলে গেছে দ্যাখো।’

‘জানলায় শব্দ হচ্ছে না।’ কান পাতল কালীচরণ, ‘বাইরের দরজায় বোধহয় শব্দ হচ্ছে। কিন্তু ওখানে তো হাওয়া আসবে না। যাই দুধ গরম করি।’

এবার আওয়াজটা প্রবল হল। কালীচরণ দরজায় পৌঁছে বলল, ‘মনে হচ্ছে, কেউ এসে দরজায় শব্দ করছে।’

চকিতে থানার ও.সি.-র মুখ মনে পড়ল বনবিহারীর। এত রাত্রে একমাত্র পুলিশের পক্ষেই আসা সম্ভব। তাহলে নিশ্চয়ই ওরা ধরা পড়ে গিয়েছে। ধরতে পারলে পুলিশ ওদের পেট থেকে কথা বার করবেই। মামণি বোবা হতে পারে কিন্তু ছেলেটি কতক্ষণ মুখ বন্ধ রাখবে?

বনবিহারী বুঝলেন তাঁর আর কিছু করার নেই। এই বাড়ির পেছন-দ্বার দিয়ে পালানো যায় কিন্তু পালিয়ে তিনি কোথায় যাবেন? তাঁর যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। তার চেয়ে সোজা ধরা দেওয়াই ভালো। তারপর চেষ্টা করবেন নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে। ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবে। শিশুটির কান্না তখনও থামছিল না। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তিনি খাট থেকে নেমে বললেন, ‘কালীচরণ, আমি যদি এখানে না থাকি তাহলে তুমি ওকে ততদিন দেখবে যতদিন শম্ভু এসে না নিয়ে যায়!’

‘মানে? আপনি কোথায় যাবেন?’ কালীচরণ অবাক।

নিজেকে শক্ত করে হাঁটলেন বনবিহারী। বৃষ্টির শব্দ, কান্নার আওয়াজ তাঁর এই হেঁটে যাওয়ার মুহূর্তে আবহসঙ্গীতের মতো কাজ করছিল।

দরজা খুলতেই বিদ্যুতের ঝলসানিতে চোখ বন্ধ করতে হল। চোখ খুলে প্রথমে কাউকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলেন তিনি। দ্বিতীয়বারের বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেলেন দরজার একপাশে একটি মানুষ কুঁকড়ে পড়ে আছে। ঝুঁকে দেখতে গিয়ে তৃতীয় বিদ্যুৎ সাহায্য করল। চিৎকার করে মামণিকে দু-হাতে তুলে নিলেন বনবিহারী। সমস্ত শরীর ভিজে গেছে মেয়েটার। জ্ঞান হারিয়েছে।

কালীচরণ ছুটে এসে দরজা বন্ধ করল। মেয়েটাকে নিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকে খাটে শুইয়ে দিয়ে বনবিহারী হাঁপাতে লাগলেন। একটি পূর্ণবয়স্কা যুবতীর শরীর বহন করার মতো শক্তি তাঁর শরীরে ছিল না। ওকে তোলার সময়ে নিজের বয়স ভুলে গিয়েছিলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘ওর গায়ের ভেজা কাপড় বদলে দাও।’

‘আমি?’ আঁতকে উঠল কালীচরণ, ‘না না। আমি ওসব পরাতে জানি না। তাছাড়া আমার পরানো ঠিক নয়। আপনি ডাক্তার, আপনি পরান। আমি দুধ গরম করে আনছি।’ টুক করে সরে গেল কালীচরণ।

জ্ঞানহীন যুবতী শরীরে পোশাক খুলে নতুন পোশাক পরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা হল না বনবিহারীর। ভেজা পোশাক তিনি কোনওরকমে শরীরমুক্ত করতে পারলেন। তাড়াতাড়ি একটা কম্বল ওই নগ্ন শরীরের ওপর ছড়িয়ে দেওয়ার ফাঁকে তিনি জীবনে প্রথমবার নারীর যৌবন দেখতে পেয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্যে আড়ষ্ট হলেন। খুব দ্রুত নিজেকে সামলে মামণির ভেজা চুল থেকে জল মুছে নিয়ে তাকে কয়েকবার ডাকলেন। কোনও সাড়া নেই। যদিও নাড়ি সচল, বুকের স্পন্দন বোঝা যাচ্ছে, একটা চামচ টেবিলে পড়েছিল। সেটা নিয়ে আসতে গিয়ে দেখলেন শিশুটি কান্না থামিয়ে স্থির হয়ে তাকাবার চেষ্টার করছে। কি আশ্চর্য ব্যাপার! এতক্ষণ যে কেঁদে অস্থির হয়েছিল, সে কি মায়ের গন্ধ পেয়ে গেছে?

দাঁতে দাঁত লেগেছিল। অনেক চেষ্টায় দুটো পাটিকে আলাদা করতে পারলেন বনবিহারী। দুই গালে মৃদু চড় মেরেও হুঁশ ফিরল না। তখন খাট থেকে নেমে নিজের জুতোর পেছনের অংশ আগুনে সামান্য পুড়িয়ে সেটা মামণির নাকের সামনে ধরলেন। উৎকট গন্ধ শরীরে যেতেই অস্ফুট শব্দ উচ্চারণ করল মামণি।

কালীচরণ বোতলে গরম দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিলেন বনবিহারী। তারপর নিপল ঢুকিয়ে দিলেন মামণির মুখে। কালীচরণ অবাক হল, ‘ওকি করছেন! বাচ্চার দুধ মাকে দিচ্ছেন কেন?

‘দুধটা এখন ওর দরকার। তুমি আবার দুধ গরম করে আনো।’

একটু একটু করে দুধের বোতল অর্ধেক খালি হতেই চোখ মেলল মামণি। কয়েক সেকেন্ড লাগল তার, চিনতে পেরে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।

বনবিহারী বললেন, ‘আর কোনও ভয় নেই। তুমি তোমার ছেলের কাছে ফিরে এসেছ। আমি তোমাকে আর কোথাও যেতে দেব না।’

 সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠতে যাচ্ছিল মামণি। সম্ভবত ছেলে শব্দটা কানে যেতেই এই পরিবর্তন। শরীর থেকে কম্বল সরে গেছে, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত কিন্তু সেটা তার খেয়ালে নেই। জোর করে তাকে শুইয়ে দিয়ে কম্বল কাঁধ পর্যন্ত ঢেকে দিলেন বনবিহারী। তারপর শিশুকে তুলে মায়ের বুকের কাছে পৌঁছে দিলেন। শিশুকে জড়িয়ে ধরল মা। শিশু মাতৃদুগ্ধ পান করতে লাগল প্রবলভাবে। কালীচরণ কৌটোর দুধ গরম করে ঘরে ঢুকতে বনবিহারী বললেন, ‘এখন ওটার প্রয়োজন হবে না।’

পরদিন সকালেও বৃষ্টি। এরমধ্যে মামণি কোনওমতে বোঝতে পেরেছে যে তার পেটে ব্যথা হচ্ছে। বনবিহারী তাকে জিজ্ঞাসা করেননি ছেলেটা কোথায় নিয়ে গিয়েছিল তাকে। সে ফিরেই বা এল কীভাবে! কারণ তাঁর ধারণা এসব ইঙ্গিতে বোঝানো সম্ভব না। ব্যথা উপশমের ট্যাবলেন তিনি দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্রাম নিয়েও যদি ব্যথা না কমে তাহলে সদরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করানো ছাড়া উপায় নেই।

সকালে মামণি একবার উঠেছিল পোশাক পরে বাথরুমে গিয়েছিল পেট চেপে ধরে পায়ে পায়ে। ব্যথার ওষুধ খাওয়ার পর সে গভীর ঘুমে আছন্ন। শিশু কেঁদেছে এবং কালীচরণ তাকে সামলেছে।

বেলা দশটায় বৃষ্টি থামলে বনবিহারী ঠিক করলেন এবার চেম্বারে যাবেন। কালীচরণকে ডেকে বললেন, ‘ও যখন ঘুম থেকে উঠবে উঠুক, ডাকতে হবে না। আর সেই ছেলেটা যদি ফিরে আসে তাহলে দরজা খোলার দরকার নেই।’

কালীচরণ মাথা নাড়ল, ‘ও এলে আমি ওর মাথা ভাঙব।’

‘কিছু করতে হবে না। দরজা না খুললেই হল। চেম্বারে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। রাত জেগে শরীরটা ঢিসঢিস করছে।’ বনবিহারী বললেন।

‘না গেলেই তো হয়। দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে নিন না?’

‘না। কখনও সকালে চেম্বার বন্ধ থাকে না, রুগিদের অসুবিধে হবে। তাছাড়া লোকে ভাবতে পারে আমার হয়তো শরীর খারাপ হয়েছে।’

বৃষ্টি থামলেও ছাতা সঙ্গে নিলেন বনবিহারী। নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মনে হল এতদিনের জীবনটা আচমকা এই ক’দিনে কীরকম বদলে গেল। এই মেয়েটা, যাকে তিনি মামণি বলে ডাকছেন, কোন অজানা জায়গা থেকে এসে তাঁকে জড়িয়ে ফেলল। ভোরে ওষুধ খাওয়ার পর থেকে যন্ত্রণা কমে যাওয়ার ও এখন মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে যখন তখন ব্যথার কারণটা খুব উদ্বেগজনক নয়। কিন্তু ওই ব্যথাটাই বা হল কেন? ছেলেটা ওকে যেভাবে নিয়ে গিয়েছিল তা তিনি মানতে পারেননি। ভয়ে মুখ বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু ও ফিরে এসেছে দেখে তিনি খুশি হয়েছিলেন খুব। অতবড় শরীরটাকে পাঁজাকোলা করার কথা তা না হলে ভাবতেও পারতেন না। কিন্তু ও ফিরে আসায় আর একটা সমস্যা বাড়ল। শম্ভু শিশুটিকে ওর আত্মীয়র কাছে তুলে দেবে দত্তক হিসেবে। তাঁর কথাতেই শম্ভু রাজি হয়েছে। এখন শম্ভুকে তিনি কী বলবেন? মা তো শিশুকে আর কিছুতেই কাছ-ছাড়া করবে না! মাথা নাড়লেন বনবিহারী। এত ঝামেলায় তিনি কখনও পড়েননি।

‘ডাক্তারবাবু।’ চিৎকার ভেসে আসতেই বনবিহারী দেখলেন, ডানদিকের বাড়ির দরজায় একজন মহিলা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন।

‘বলুন।’ এগিয়ে গেলেন বনবিহারী, ‘উনি কেমন আছেন?’

‘সদরের হাসপাতালে আছে। বলছে আজ ছেড়ে দেবে। এলে আপনি এসে একবার দেখে যাবেন?’ মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘নিশ্চয়ই। আমি বিকেলে চেম্বারে যাওয়ার সময় ঘুরে যাব।’

হাঁটতে শুরু করলেন বনবিহারী। দুলাল বিশ্বাস ক্যানসারে ভুগছিলেন। তাঁকে হাসপাতাল ছেড়ে দেবে মানে কি ওরা আর রাখতে চাইছে না!

চেম্বারে ভিড় ছিল। এসেই রুগি দেখতে বসে গিয়েছিলেন বনবিহারী। এখন সর্দিজ্বর হচ্ছে খুব। আবহাওয়ার পরির্বতনের কারণেই হচ্ছে।

বেলা সাড়ে বারোটায় পুলিশের জিপ তাঁর চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বড়বাবু নেমে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আপনাকে একটু বিরক্ত না করে উপায় নেই।’

তখনও তিনজন রুগি ছিল অপেক্ষাতে। বনবিহারী বললেন, ‘বলুন।’

‘আপনাকে আধঘণ্টার জন্যে একটু যেতে হবে আমার সঙ্গে।’

‘কোথায়?’

‘আসুন। বলছি।’

রুগিদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে তাদের অপেক্ষা করতে বলে বনবিহারী বড়বাবুর সঙ্গে জিপে উঠলেন। জিপ ছুটল চা-বাগানের দিকে।

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন বলুন তো?’

‘চা বাগানে। ঘণ্টাখানেক আগে খবরটা পেয়ে ছুটে এসেছিলাম। দেখে মন শান্ত হল। খুব উদ্বেগে ছিলাম এতদিন। এখন আর আমার এলাকায় কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু নিশ্চন্ত হতে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’ বড়বাবু হাসলেন।

বনবিহারী তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলেন।

‘একটা ডেডবডি পাওয়া গিয়েছে। চা-বাগানের মধ্যে। যে ছেলেটাকে আমরা এতদিন খুজছিলাম, মনে হচ্ছে ওটা তারই লাশ। আপনি তো ওকে দেখেছেন, কথা বলেছেন। তাই আপনাকে দিয়ে ভেরিফাই করাতে চাইছি।’

চিনতে অসুবিধে হল না। চিৎ হয়ে পড়ে থাকা শরীরটাকে চারজন সেপাই পাহারা দিচ্ছে। মাথা থেঁতলে গেছে কিন্তু মুখ অবিকৃত। বনবিহারী শনাক্ত করলেন।

বড়বাবু বললেন, ‘বাঁচালেন মশাই। কিন্তু ওর সঙ্গে রিভলভার থাকা সত্ত্বেও ও এভাবে মারা পড়ল কেন? কে ওকে খুন করতে পারে?’

বনবিহারীর শ্বাস কয়েক মুহূর্তের জন্যে বুকের মধ্যে আটকে রইল।

বড়বাবু বললেন, ‘যে-ই করুক, সে আমাদের উপকার করেছে। উগ্রপন্থীদের চ্যাপ্টারটা এই লাশ পাওয়ার পরে ক্লোজ করে দেব।’ রক্তমাখা পাথরটাকে পুলিশ লাশের সঙ্গে তুলে নিল।

বনবিহারী দুশ্চিন্তায় পড়লেন। ওই পাথরে কি পুলিশ ফিঙ্গার প্রিন্ট খুঁজবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *