দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ২৯

ঊনত্রিশ

ভটভটি থেকে পাথরপ্রতিমায় নেমে প্রথমে ঠাওর করতে পারলেন না বনবিহারী। কোথায় গিয়ে খোঁজ করলে ওদের পাওয়া যাবে! পাথরপ্রতিমা নেহাত ছোট্ট জায়গা নয়। রিকশাওয়ালা তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসতেই এগিয়ে গেলেন তিনি, ‘আচ্ছা, এখানে হোটেল ক’টা আছে?’

‘হোটেল? ডালভাতের হোটেল অনেক আছে। কোনটায় যাবেন?’

‘ডালভাতের নয়, থাকার হোটেল। বাইরের মানুষ এখানে এলে যেখানে রাত্রে থাকে!’

‘অ। তিন-চারটে আছে। কিন্তু আপনি তো লঞ্চের ডাক্তারবাবু, হোটেলে থাকবেন কেন?’

‘আমি থাকব না। কয়েকজন সেখানে উঠেছে, দেখা করতে যাব।’

রিকশায় উঠলেন বনবিহারী। যেতে যেতে দু’পাশে তাকিয়ে দেখছিলেন তিনি। যদি ওরা রাস্তায় থাকে। হেঁটেও তো যেতে পারে। কিন্তু এই সময় রাস্তা এমনিতেই ফাঁকা। যে কয়েকজন চলাফেরা করছে তাদের মধ্যে কোনও মহিলা নেই।

যে হোটেলে প্রথমে নিয়ে গেল রিকশাওয়ালা তার ম্যানেজার বললেন, ‘না মশাই, কেউ আসেনি। মেয়েছেলে তো নয়ই। এলেও জায়গা দিতে পারতাম না। একদম হাউসফুল।’

দ্বিতীয় হোটেলও একই কথা বলল।

হঠাৎ ছেলেটির কথা মনে হল বনবিহারীর। যে ছেলে মামণির সঙ্গে দেখা করত সে নিশ্চয়ই হোটেলে থাকে না। এই পাথরপ্রতিমায় তার একটা থাকার জায়গা আছে। সেখানে ওদের নিয়ে যায়নি তো? মালতীর কাছে মিছিমিছি হোটেলে উঠবে বলে এসেছে বিভ্রান্ত করতে। তাই যদি হয় তাহলে ওদের খুঁজে বের করার চেষ্টা বৃথা হয়ে যাবে। তাছাড়া মামণির মা কি একা অত দূর থেকে এসেছেন? নিশ্চয়ই সঙ্গে কেউ আছে। তাহলে সেই ছোকরা অন্তত তিনজনকে নিয়ে তুলেছে তার আস্তানায়। এই আস্তানাটার খবর কি করে পাওয়া যাবে!

রিকশাওয়ালা বলল।, ‘তিন নম্বর হোটেলটা ওই দিকে।’

মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘আমার মনে হয় ওরা হোটেলে ওঠেনি।’

‘কাদের কথা বলছেন?’

বনবিহারী মামণির কথা বললেন, বাকি তিনজনের একটা আনুমানিক বর্ণনা দিলেন।

‘তাহলে তারা চারজন। ঘাট থেকে রিকশা নিলে দুটো রিকশা ভাড়া করতে হয়েছে। ঘাটে গিয়ে খোঁজ করলে বেরিয়ে যাবে। যে দুজন ওদের রিকশায় তুলেছিল তারা তো এখনও ডিউটি করছে। চলুন ঘাটে যাই।’ রিকশাওয়ালাকে বেশ উজ্জীবিত দেখাচ্ছিল।

ডুবে যাওয়া মানুষ নাকি ঘাস ধরেও বাঁচতে চায়। রাজি হলেন বনবিহারী। রিকশাওয়ালা আবার তাঁকে ঘাটে নিয়ে এসে বলল, ‘আপনি ওই চায়ের দোকানে বসে চা খান, আমি খোঁজখবর নিয়ে আসছি।’

চায়ের দোকান ঢুকে চা এবং বিস্কুট চাইলেন বনবিহারী। তৈরি চা চলে এল বিস্কুটের সঙ্গে। সেগুলো খেতে খেতে হঠাৎ বনবিহারীর মনে হল কাজটা তিনি কেন করছেন? মামণি যদি এতদিন পরে তাঁকে কিছু না জানিয়ে চলে যেতে চায় তাহলে কেন তিনি তাকে খুঁজে বের করতে চাইছেন? ওর কাছে তাঁর কোনও পাওনা নেই, নিকট আত্মীয় সে নয়, বিপদের সময় আশ্রয় দিয়েছিলেন এইমাত্র। আজ সে তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাইছে, যাক না। তিনি কেন নিজেকে উপেক্ষিত মনে করছেন? মামণি হয়তো ক্ষণিকের উন্মাদনায় তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চেয়েছিল, তিনি রাজি হননি। আর হননি বলে তাঁদের মধ্যে দূরত্ব থেকেই গিয়েছিল। কোনও দায় যখন নেই তখন জানিয়ে গেলে সৌজন্য বজায় থাকত কিন্তু হয়তো সে ভেবেছে জানাতে গেলে তিনি আপত্তি জানাবেন। সেই পরিস্থিতি সে এড়াতে চেয়েছে।

এই অবধি ভেবে নদীর দিকে তাকালেন তিনি। এবং তখনই সন্তানের কথা খেয়াল হল। সন্তানকে নিয়ে তিনি কি করবেন? স্বর্গের অপ্সরাদের মনে স্নেহ-মায়া থাকে না, তারা অবলীলায় সন্তানের জন্ম দিয়ে মর্ত্যে ফেলে চলে যায়। প্রৌঢ় মুনি ঋষিকে সেই সন্তানদের দায়িত্ব নিতে হয়। মামণির সন্তানের দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে! ওই শিশুকে তো তিনি ফেলে দিতে পারেন না কিন্তু কি করে সেই দায়িত্ব নেবেন। তাঁকে কাজে বেরুতে হবে। সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে লঞ্চে ঘোরা যায় কিন্তু সেটা করলে হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। ওর মা কেন চলে গেল? তার সঙ্গে বনবিহারীর কি সম্পর্ক ছিল? কোথায় গেল সে? এখন পর্যন্ত কেউ, তাঁর সঙ্গে মামণির সম্পর্ক নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেনি। সবাই ভেবে নিয়েছে ডাক্তারবাবুর বোবা বোনকে তার স্বামী পরিত্যাগ করায় বেচারা দাদার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। এই ভাবনাটা ছিন্নভিন্ন হলে তিনি শ্রদ্ধার জায়গাটা আর ফিরে পাবেন না। ওই অবস্থায় এখানে থেকে কাজ করা কি সম্ভব হবে?’

‘নমস্কার ডাক্তারবাবু। আপনি এখানে বসে আছেন?’ পাশ থেকে একজন জিজ্ঞাসা করল।

তাকালেন, কিন্তু চিনতে পারলেন না ঠিক, বললেন, ‘একজনের সন্ধানে এসেছিলাম—।’ বলেই বুঝলেন বলাটা ঠিক হল না।

‘পাথরপ্রতিমার লোক?’

‘না না। তেমন কেউ নয়। ছেলেটির বাড়ি উত্তরবঙ্গে, কিছুদিন আগে এখানে এসেছে।’

‘নতুন মাস্টার?’

‘মানে?’

‘এখানকার প্রাইমারি স্কুলে একজন নতুন মাস্টার কিছুদিন আগে চাকরিতে এসেছেন। বেশি বয়স নয়। নতুন লোক কেউ এলে একটু খেয়াল রাখতে হয়, তাই জেনেছি।’

‘না না। সে ছেলে এতদূরে মাস্টারি পাবে কি করে?’

‘স্বজন পোষণ। সেক্রেটারির কাছে লাল পার্টির চিঠি নিয়ে এসেছিল বলে শুনলাম। তবে পাকা চাকরি নয়। এই মাস্টার কারও সঙ্গে মেশে না। আপনি যাকে খুঁজছেন সে যদি মাস্টারি করত তাহলে তো জানতেই পারতেন।’

‘তা তো বটেই।’

‘আপনার পেশেন্ট তো এখন ভালো আছে।’

‘কোন পেশেন্ট?’

‘ওই যে হাসপাতালে যাকে ভরতি করিয়েছেন, যার অপারেশন হল?’

চমকে তাকালেন বনবিহারী, এই লোকটি এসব কথা জানল কি করে?

‘আপনি কে?’

চায়ের দাম দিয়ে দিল লোকটা। বনবিহারীর চা-বিস্কুটের দামও জোর করে দিয়ে দিল। তারপর দোকানের বাইরে এসে নীচু গলায় বলল, ‘বাবা মুর্শেদকে আমিই আপনার বাড়িটা চিনিয়ে দিয়েছিলাম। পোস্ট অফিসে পিওনের চাকরি করি।’

বনবিহারী আবার তাকালেন। বাবা মুর্শেদের সঙ্গে অন্ধকারে এই লোকটি ছিল কিনা তা এখন ঠাওর করতে পারলেন না।

লোকটি বলল, ‘আজ এস আই, বোধহয় আপনাকে ধমকাতে গিয়েছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘বোকার হদ্দ।’

‘বোকা বলছেন, তাহলে খবরটা পেল কি করে?’

‘কেউ না কেউ চামচেবাজি করেছে। আপনাকে বলল বাবা মুর্শেদকে ধরার জন্যে সাহায্য করতে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি কি বললেন?’

‘আমি কিছু বলিনি।’

‘ভালো।’

এইসময় রিকশাওয়ালা ফিরে এল। লোকটিকে দেখে বলল, ‘কেমন আছেন দয়ালভাই?’

‘চলে যাচ্ছে তিনি যেমন চালাচ্ছেন।’ ওপরের দিকে আঙুল তুলল লোকটি।

রিকশাওয়ালা বলল, ‘মনে হচ্ছে রিকশায় ওঠেনি ওরা। তবে চারজন নয়, দুজন মহিলা, একজনের বয়স বেশি, অন্যজন কমবয়সি হেঁটে গেছে ভটভটি থেকে নেমে। ওদের সঙ্গে দুজন লোক ছিল, নতুন মুখ।’

বনবিহারী বললেন, ‘কীরকম বয়স?’

‘একজন যুবক, অন্যজন বৃদ্ধ।’ রিকশাওয়ালা বলল।

লোকটি শুনেছিল, জিজ্ঞাসা করল, ‘যুবকটিকে দেখতে কেমন?’

রিকশাওয়ালা বলল, ‘দাঁড়ান, হরিপদকে জিজ্ঞাসা করে আসি। ও-ই দেখেছিল।’ রিকশাওয়ালা চলে গেলে। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি একনজনকে খুঁজছিলেন তো?’

মাথা নাড়লেন বনবিহারী। তাঁর এসব আর ভালো লাগছিল না।

‘তাহলে এরা নয়। শুনলেন তো চারজন নেমেছে ভটভটি থেকে। দুজন আবার মহিলা।

‘উত্তরবঙ্গের ছেলে বলে আলাপ করার ইচ্ছে হয়েছিল। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এবার ফিরে যেতে হবে।’

রিকশাওয়ালা চলে এল। বলল, ‘ফরসা, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, কপালে কাটা দাগ আছে।’

‘কপালে কাটা দাগ?’ লোকটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘নতুন মাস্টারের কপালেও কাটা দাগ আছে।’ লোকটি রিকশাওয়ালাকে বুঝিয়ে দিল। প্রাইমারি স্কুলের পেছনে মাস্টারদের কোয়ার্টাস। সেখানে গিয়ে নতুন মাস্টারের খোঁজ করলে সবাই বলে দেবে। তারপর বলল, ‘বুঝলেন ডাক্তারবাবু, এই লোকটা একটু সন্দেহজনক। বাইরে থেকে চাকরি নিয়ে এখানে এসেছে, ওর নামে একটা চিঠিও আজ পর্যন্ত আসেনি। বাবা-মা না থাকতে পারে, এই বয়সের কোনও আত্মীয়স্বজন বন্ধু থাকবে না?’

রিকশাওয়ালা বলল, ‘চলুন, আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’

লোকটি বলল, ‘আমাকে এখন বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে। খুব ভালো লাগল আপনার সঙ্গে আলাপ করে।’ তারপর চায়ের দোকানের গায়ে দাঁড় করানো সাইকেলে বসে চলে গেল সোজা রাস্তায়। উৎসাহ পাচ্ছিলেন না। তবু রিকশায় উঠলেন বনবিহারী।

বন্ধ দরজায় শব্দ করলেন বনবিহারী। ভেতর থেকে একজন মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’

‘নতুন মাস্টার বাড়িতে আছেন?’

বনবিহারী জানতে চাইলেন।

‘না। নেই।’

‘আপনি একটু দরজাটা খুলবেন?’

কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে যে ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন তাঁর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। মহিলা সধবা। চেহারা দেখেই বোঝা যায় আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো।

‘নমস্কার।’ বনবিহারী হাত জোড় করলেন।’

‘নমস্কার।’ বলুন।’

বনবিহারীর লক্ষ করলে ভদ্রমহিলা দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, ‘আপনি, আপনারা বোধহয় আজই এখানে এসেছেন!’

‘আপনি যা বলতে এসেছেন সেটাই বলুন!’

‘বেশ বলি। একটি মেয়েকে তার ভয়ঙ্কর বিপদের দিনে আমি রক্ষা করেছিলাম। মানুষ হিসেবে যা করা উচিত তাই করেছি। কিন্তু তাকে রক্ষা করা যে অপরাধ তা আমি জানতাম না। যখন জানলাম তখন তাকে নিয়ে এখানে চলে এসেছিলাম যাতে পরিচিত কেউ খবরটা না পায়। মেয়েটি কথা বলতে পারে না। সম্ভবত সে আপনার মেয়ে।’ বনবিহারী খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বললেন।

‘ও। আপনি? আপনার সাহস তো কম নয়?’

‘বুঝতে পারলাম না।’

‘যথেষ্ট বয়স হয়েছে আপনার। শুনলাম ডাক্তারি করেন। উর্মি আপনার মেয়ের বয়সি। তার একটা ভুলের সুযোগ নিয়ে এতকাল কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেননি আপনি। পুলিশ জানতে পারলে জেলে পুরবে সেই ভয়ে এই সুন্দরবনে ওকে নিয়ে এসে গরু-ছাগলের মতো একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছেন। আমার উচিত ছিল আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। আমি তা না করে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছি। আর তার পরেও আপনি এখানে গাল ফুলিয়ে গল্প শোনাতে এসেছেন?’ ভদ্রমহিলা চাপা গলায় কিন্তু হিসহিসে স্বরে কথাগুলো বললেন।

নীরবে শুনছিলেন বনবিহারী, বললেন, ‘আপনার এই অভিযোগগুলো অসত্য। ওকে অমি কখনও অসম্মানিত করিনি।’

‘করেননি? মেয়েটা বোবা, কাউকে কিছু বলতে পারবে না। তার সুযোগ নেননি?’

‘নিতে চাইলে আমাকে এখানে আসতে হত না।’

‘মানে?’

‘ও আমাকে ছেড়ে আসত না।’

‘ছি ছি ছি। আপনার সঙ্গে ওর বয়সের তফাত কত জেনেও একথা বলছেন? তার ওপর কার না কার বাচ্চাকে ওর কোলে বসিয়ে ওকে বাঁধতে চেয়েছেন আপনি। ওই বাচ্চার মা কে আপনি জানেন কিন্তু তাই বলে একটা অবিবাহিতা মেয়েকে মা বানাবার চেষ্টা কোন সাহসে করলেন আপনি?’

‘আমি একবার মামণির সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘মামণি?’ ভদ্রমহিলা অবাক।

‘আপনার মেয়েকে আমি ওই নামেই ডাকতাম।’

ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন ভদ্রমহিলা, ‘লোকে কন্যাসম মেয়েকে মামণি বলে ডাকে। আপনি দেখছি সত্যি ভয়ংকর। মামণি বলছেন আবার তার সঙ্গে এক ঘরে শুয়েছেন। আপনি প্রমাণ করতে পারবেন যে আমার মেয়ে এখনও কৌমার্য হারায়নি?’

‘আমি তাকে আশ্রয় দেওয়ার আগেই সেটা সে হারিয়েছিল।’

‘মিথ্যে কথা। সুপ্রভাতের মতো ছেলে কোটিতে গুটিক হয়। নইলে এতসব জেনেও সে আমাদের খবর পাঠাত না এখানে আসার জন্যে। একসঙ্গে ছেলেবেলায় খেলাধুলা করেছিল। সেই ভালোবাসা থেকে আজ ও উর্মিকে বিয়ে করতে চাইছে। আপনি চলে যান এখান থেকে। নইলে আমরা থানায় গিয়ে বলব যে আপনি উর্মিকে কিডন্যাপ করে এখানে নিয়ে এসে আটকে রেখেছিলেন।’ ভদ্রমহিলা দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন।

‘দাঁড়ান। ও যে শিশুকে গর্ভে ধারণ করেছিল, জন্ম দিয়েছে, তাকে অবলীলায় ফেলে যেতে পারে না। আপনি মেয়েকে নিয়ে যান। শিশুটি কি অপরাধ করল, ওকে কেন বঞ্চিত করবেন?’

‘মিথ্যে কথা। ওটা উর্মির বাচ্চা নয়। আপনি মিথ্যে বদনাম দিচ্ছেন।’

‘জলপাইগুড়ির হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করলে এর প্রমাণ পাবেন।’

‘কি প্রমাণ পাব? ওখানে ওর নাম খাতায় লেখা আছে?’

থতিয়ে গেলেন বনবিহারী। সেদিন চটজলদি কিছু মাথায় না আসায় মামণি নাম দিয়েছিলেন তিনি। ড্রাইভারের বোন বলে খাতায় লেখা হয়েছিল। একমাত্র সেই নার্স বা ডাক্তার যদি মনে করতে পারেন তাহলেই মামণিকে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে, মিথ্যে পরিচয় দিয়ে প্রসব করানোর জন্যে।

ভদ্রমহিলা হাসলেন, ‘আপনি চলে যান। আর কখনও বিরক্ত করতে আসবেন না। মেয়েটাকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন বলে আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি।’

দরজা বন্ধ হয়ে গেল। হাঁটতে পারছিলেন না বনবিহারী। পা কাঁপছিল। তাঁকে ওই অবস্থায় এগিয়ে আসতে দেখে রিকশাওয়ালা দৌড়ে এসে হাত ধরল, ‘কি হয়েছে ডাক্তারবাবু?’

‘কিছু না।’

রিকশায় উঠতে বেশ কষ্ট হল। ঘাম হচ্ছে সারা শরীরে। এত অপমানিত তিনি কখনও হননি। ভদ্রমহিলার সব অভিযোগ ঠিক। কোনও প্রমাণ তাঁর হাতে নেই। গঞ্জের কেউ বলবে না তাঁর বাড়িতে একটি যুবতী প্রসবের পর বাস করেছে। কেউ বাচ্চাকে দ্যাখেনি, দ্যাখেনি মামণিকে। একমাত্র কাজের লোক কালীচরণ আর পালবাবুর ড্রাইভার শম্ভু সাক্ষী দিতে পারে। কিন্তু সাক্ষী দিলে শম্ভু বিপদে পড়বে বলে মুখ বন্ধ করে থাকবে। কালীচরণের কথা কেউ শুনবে না, ভাববে বনবিহারী ওকে শিখিয়ে দিয়েছেন। রিকশাওয়ালাকে একশোটা টাকা দিলেন তিনি। সে বলল, ‘এত টাকার ভাংতি তো নেই।’

‘লাগবে না। রেখে দাও।’

ভটভটিতে নদী পার হয়ে ওইটুকু পথকে যেন অন্তবিহীন বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। সিঁড়িতে পা রাখতেই সন্তানের কান্না কানে এল। প্রচণ্ড জোরে কাঁদছে ছেলেটা। মাথা ঘুরে গেল বনবিহারীর। সিঁড়িতেই বসে পড়লেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *