দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ২৭

সাতাশ

বনবিহারী মেয়েটি ও তার বাবাকে নিয়ে পাথরপ্রতিমায় নেমে গেলে রতন লঞ্চ নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। এর আগে কোনও ডাক্তার যা করেননি বনবিহারী তা করছেন দেখে বেশ আবেগে আক্রান্ত হয়েছিল লঞ্চের সব কর্মী। ওরা ঠিক করল এরকম দিন এলে, যখন কারও প্রাণ বাঁচাতে ডাক্তারবাবু পেশেন্টকে হাসপাতালে নিয়ে আসবেন, সেদিনের রিপোর্ট পরেশ মণ্ডলকে বিস্তারিত বলবে না। বরং যে গ্রামে গিয়েছিল লঞ্চ সেখানে বেশ ভালো কাজ হয়েছে তাই জানাবে। লঞ্চে পেশেন্ট বয়ে আনা যেহেতু নিয়ম নেই আর হেড অফিস সেটা মোটেই পছন্দ করছে না তাই সত্যি কথা বললে ডাক্তারবাবু বিপদে পড়বেন। হয়তো ওঁকে চলে যেতে বলা হবে। রতনরা ঠিক করল, ডাক্তারবাবুকে ওরা হারাতে চায় না। তাই ঝটপট ওরা পাথরপ্রতিমা থেকে লঞ্চ নিয়ে চলে এসেছিল।

বনবিহারী হাসপাতালের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলেন মালতীকে নিয়ে যাওয়ার সময় কালীচরণ টিপসই দিয়েছে। সেই লোকটা যে মালতীর সঙ্গে এসেছিল, সে এই হাসপাতাল চত্বরে পড়েছিল এতদিন। কিন্তু মালতীকে নিয়ে গেল কোথায়?

দ্বিতীয়ত, সেই ছেলেটির সন্ধান করতে গিয়ে হোঁচট খেলেন বনবিহারী। নাম জানেন না, কোথায় থাকে তাও না। দু-তিনজনকে চেহারার বর্ণনা দিয়েও কিছু জানতে পারেননি। সন্ধে নেমে গেছে। কাল এই মেয়েটির অপারেশনের জন্যে কত জমা দিতে হবে জানতে চেয়ে স্বস্তি বোধ করলেন। ওই টাকা এখনও তাঁর সঙ্গে আছে। মেয়েটির বাবা হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিল। তার সামনে গিয়ে বনবিহারী বললেন, ‘আর কোনও চিন্তা নেই। তোমার মেয়ে ভালো হয়ে যাবে। এখানকার ডাক্তারবাবুরা খুব ভালো অপারেশন করেছেন।’

‘সবই আপনার দয়ায় হল ডাক্তারবাবু।’ লোকটার গলার স্বর ভেজা।

‘এসব কথা বলবে না। এই নাও তিরিশটা টাকা রাখো। কিছু খেয়ে নিয়ে রাত্রে হাসপাতালেই থেকো। কয়েকদিনের মধ্যে এরা তোমার মেয়েকে ছেড়ে দেবে।’

টাকাটা লোকটার হাতে গুঁজে দিয়ে বনবিহারী যখন ঘাটে পৌঁছালেন তখন রাত বেড়ে গেছে। পারাপার বন্ধ হতে বেশি দেরি নেই। ভটভটিতে চেপে এপারে এসে ভাড়া দিতে গেলেন তিনি। ভটভটিওয়ালা দ্রুত মাথা নাড়ল, ‘না না। আপনাকে দিতে হবে না।’

‘সে কি? কেন?’

‘আপনার জন্যে ভটভটি ফিরি।’ লোকটা হাসল।

কিছুতেই রাজি হল না লোকটা।

বাড়ির কাছে পৌঁছে তাঁর ঘরে আলো জ্বলতে দেখলেন বনবিহারী। নীচে পুঁটির মায়ের ঘরে অন্ধকার। তার বন্ধ দরজার সামনে একটা লোক বসেছিল। তাঁকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানাল। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে?’

‘আজ্ঞে, আমি কালী।’

‘কালী মানে?’

‘ওই যে মালতীর সঙ্গে আপনার লঞ্চে এসেছিলাম—।’

অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হল না। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এখানে কি করছ?’

‘ওরা এখানে এল, আমিও চলে এলাম।’

‘কারা এখানে এসেছে?’

‘মালতী আর একটা দিদি।’ বলে লোকটা ওপরের দিকে আঙুল তুলল।

বিস্মিত বনবিহারী দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে দেখলেন দরজা খোলা। খাটে সন্তান বসে আছে। তার পাশে মালতী। নীচে খাবার বাড়ছে মামণি। শব্দ শুনে মালতী দরজার দিকে তাকিয়েই ঘোমটা টেনে খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। আর কি আশ্চর্য, সন্তান এই প্রথম বেশ জোরে একটি শব্দ উচ্চারণ করল।

মামণি মুখ তুলে তাকাল। তারপর মুখ নামিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে যা করছিল তা করে যেতে লাগল। মালতী ঘোমটার প্রান্ত এক হাতে ধরে রেখে নীচু গলায় বলল, ‘ডাক্তার ছেড়ে দিল। বলল, সাতদিন পরে দেখিয়ে যেতে। বিকেলে তো গাঁয়ে যাওয়া যায় না। গেলে সাতদিন পরে আসাও সম্ভব হত না। বোন দেখতে গিয়েছিল। ও বলল এখানে চলে আসতে।’

‘বোন?’ মুখ থেকে প্রায় অসাড়ে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।

চোখের ইশারায় মামণিকে দেখিয়ে দিল মালতী।

‘কিন্তু এখানে থাকবে কোথায়? ঘর তো মাত্র একটা।’ বনবিহারী বিরক্তি চেপে রাখলেন না, ‘তাছাড়া নীচে কালীচরণকেও দেখলাম।’

‘ও কাল সকালে চলে যাবে। মাছ ধরার টলারে মেয়েছেলে তোলে না, ওকে তুলবে।’

মামণি খাবারের প্লেট মালতীর হাতে তুলে দিয়ে নীচের দিকে ইঙ্গিত করল। সেটা বুঝে মালতী প্লেটটা কালীচরণকে দিতে নেমে গেল।

‘সারাদিন কোথায় ছিলে?’ বনবিহারী খাটে এসে বসলেন।

মামণি ঠোঁট ওলটাল। তারপর ইশারায় জানতে চাইল বনবিহারী এখন খাবেন কি না?’

রাগ হল বনবিহারীর। বললেন, ‘পাথরপ্রতিমায় গিয়েছিলে?’

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মামণি।

‘কারও সঙ্গে দেখা করতে?’

আবার একই ভঙ্গি করল মামণি।

‘ছেলেটা কে? কোথায় আলাপ তোমার সঙ্গে?’

মামণি উঠল। একটা কাগজে কলম দিয়ে কিছু লিখল। তারপর এগিয়ে ধরল বনবিহারীর সামনে। বনবিহারী পড়লেন, ‘আমি আপনার কেউ হই না। তাহলে এত চিন্তা কেন?’

‘যতক্ষণ তুমি আমার সঙ্গে আছ ততক্ষণ চিন্তা হবেই।’ কথাগুলো বলেই বনবিহারী সতর্ক হলেন। সন্তান তাঁর পায়ের কাছে চলে এসেছে হামাগুড়ি দিয়ে। তারপর তার চেষ্টা শুরু হল বনবিহারীর শরীর ধরে উঠে দাঁড়াবার। শেষ পর্যন্ত টলোমলো শরীরটাকে কোনওমতে খাড়া করল বনবিহারীর জামা আঁকড়ে ধরে। এবং এই সাফল্যে সে এত খুশি যে গলার শিরা ফুলিয়ে চিল-চিৎকার না করে পারল না। বনবিহারী তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরতেই নরম তুলতুলে স্পর্শ পেলেন। সেই স্পর্শে যে অদ্ভুত মাদকতা রয়েছে তা তাঁকে প্রভাবিত করল। তিনি সন্তানের গালে চুমু খেলেন।

ইতিমধ্যে মামণি আবার কিছু লিখেছে কাগজে। লিখে সামনে ধরেছে। মুখ ফিরিয়ে সেটা পড়লেন বনবিহারী, ‘আমার মাকে খবর দেওয়া হয়েছে।’

‘সেকি! আমাকে বলোনি তো?’

মামণি ইশারায় বোঝাল সে না, ওই ছেলেটি দিয়েছে।

বনবিহারীর আর কথা বলা হল না। কারণ মালতী প্লেট নিয়ে ফিরে এসেছে। মালতী বলল, ‘ঘাটে যে ছাউনি আছে সেখানে চলে যাচ্ছে ও। ওর থাকার জন্যে ভাবনা ভাবতে হবে না। আমি এই ঘরের মেঝেতে বিছানা করে নেব।’

এইসময় নীচ থেকে একটি সরু গলা ভেসে এল, ‘ডাকতারবাবু, ও ডাকতারবাবু।’

বনবিহারীর কপালে ভাঁজ পড়ল। সন্তানকে বিছানার মাঝখানে বসিয়ে দিতেই সে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল। মালতী ছুটে গেল তার কাছে। বনবিহারী সিঁড়িতে পা রেখে দেখলেন তিনটে লোক আধা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। হয় তো কেউ অসুস্থ হয়েছে, তাঁকে নিয়ে যেতে এসেছে এরা। সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁ, বলুন!’

সরু গলার লোকটি বলল, ‘নমস্কার ডাক্তারবাবু, ইনি বাবা মুর্শেদ। আপনি নিশ্চয়ই ওঁর নাম শুনেছেন?’

বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘না। আমি তো এখানে বেশিদিন আসিনি।’

লোকটা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বাবা মুর্শেদ তাকে ধমক দিল, ‘আঃ! আমি কি মুখ্যমন্ত্রী যে দেশের সবাই আমাকে চিনবে। নমস্কার ডাক্তারবাবু। আপনি এখানে এসে মানুষের জন্যে কাজ করছেন এই খবর আমি পেয়েছি। এখানে ডাক্তাররা এসেই পালাতে চায়। কত এল কত গেল! আর যত এন জি ও আছে তাদের ধান্ধা হল গরিব মানুষের উপকার করার নামে পয়সা কামানো। আপনার সম্পর্কে একেবারে অন্য কথা শুনছি। তাই আলাপ করতে এলাম।’

‘আমাকে কি কোনও পেশেন্ট দেখতে যেতে হবে।?’

‘না না। পেশেন্ট দেখার হলে এরাই আসত। আমার আসার দরকার হত না।’

‘ও। বলুন, কি করতে পারি?’

‘শুনলাম আপনি ক’দিন আগে একটি বউকে অপারেশনের জন্যে এনেছিলেন। অপারেশনের পর বউটি বেঁচে গেছে। আজ এমন একটা মেয়েকে দূরের গ্রাম থেকে এনেছিলেন অপারেশনের জন্যে যে না নিয়ে এলে সে আজই মারা যেত। কিন্তু এইসব অপারেশনের খরচ আপনার এন জি ও দেবে না। তাই তো?’

‘হ্যা। প্রথম কেসটায় দিতে রাজি হয়েছে, তার পরে নয়।’

‘অ। দেখুন, আমার হাতে মাঝে মাঝে টাকা এসে যায়। লোকের আপদে বিপদে আমি না বলতে পারি না। আজ যে মেয়েটির অপারেশন হয়েছে তার সব খরচ আমি দিতে চাই। কাল সকালেই ওটা হাসপাতালে পৌঁছে যাবে।’

‘কিছু মনে করবেন না, আপনার পরিচয় আমি জানি না।’

‘আমি সামান্য মানুষ। সুন্দরবনে থাকি। অশিক্ষিত। ওই যে বললাম, হঠাৎ হঠাৎ কিছু টাকা আমার হাতে এসে যায়। তখন আশেপাশের গরিব মানুষগুলো দু’বেলা খেয়ে থাকে।’ হাসল বাবা মুর্শেদ, ‘আচ্ছা চলি। হ্যাঁ, আর একটা কথা বলি। আপনি টাকার জন্যে চিন্তা করবেন না। দূরদূরান্তে গিয়ে যদি দ্যাখেন কারও চিকিৎসার প্রয়োজনে এখানে আনা দরকার, নিয়ে আসবেন। আমি আছি। এরা সবসময় আমাকে খবর দেবে। নমস্কার।’ অন্ধকারে ওরা মিলিয়ে গেল।

রাত্রের খাবার খেয়ে বনবিহারী দরজা বন্ধ করতে বলে সোজা লঞ্চে চলে গেলেন। রতনরা শুয়ে পড়েছিল। ডাকাডাকি করতে ছোটু এসে তক্তা ফেলে তাঁকে লঞ্চে উঠতে সাহায্য করল। অত রাত্রে তাঁকে আসতে দেখে সবাই বিছানা ছেড়ে উঠে এল।

বনবিহারী বললেন, ‘এত রাত্রে তোমাদের বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। ওই যে মালতী নামের মেয়েটি যার বুকের টিউমার অপারেশন করা হয়েছিল সে আমার ঘরে এসেছে। মামণিই নিয়ে এসেছে। এক ঘরে শোওয়া সম্ভব নয় বলে এখানে চলে এলাম। তোমরা যাও, শুয়ে পড়ো।’

রতন বলল, ‘ঠিক করেছেন। সোনা, ডাক্তারবাবুকে খাবার দে।’

বনবিহারী হাত নাড়লেন, ‘না না। আমি খেয়ে এসেছি।’

রতন বলল, ‘তাহলে একটা কেবিনে বিছানা করে দিতে বলি।’

ওরা বিছানা করে দিলে বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা রতন, তোমরা বাবা মুর্শেদ নামের কোনও মানুষকে চেনো?’

‘সর্বনাশ!’ রতন আঁতকে উঠল, ‘আপনি নামটা শুনলেন কি করে?’

‘কেন? লোকটা খারাপ?’

‘সুন্দরবনের বিখ্যাত ডাকাতদের একজন। তিনবার জেল খেটেছে। বিশাল দল ওর। এখন পুলিশ পর্যন্ত ওকে ভয় পায়।’ সোনা বলল।

‘পুলিশ ভয় পায় কেন?’

‘গরিব মানুষরা সবাই ওকে সাপোর্ট করে যে। পাঁচ মাইল দূরে পুলিশ দেখলে লোকে ওর কাছে খবর পাঠায় পুলিশ আসছে। যে তিনবার ধরা পড়েছে তা এই পাথরপ্রতিমা বা কাকদ্বীপে এসেছিল বলে।’ যেন রবিনহুডের গল্প শোনাচ্ছে এমন মুখ করে বলে যাচ্ছিল সোনা।

‘লোকটা তাহলে ব্যবসাদার নয়?

‘না ডাক্তারবাবু। পুলিশের চোখে ও একজন ডাকাত। তবে এমন একজন ডাকাত যাকে গঞ্জে না এলে পুলিশ ধরতে পারে না।’ সোনা বলল।

রতন হাসল, ‘আপনি লক্ষ করবেন আমরা সুন্দরবনের সব নদীতে যাই না। কয়েকটা নদীতে লঞ্চ বা ভটভটি নিয়ে গেলে বাবা মুর্শেদকে কর দিতে হয়। যারা যায় তারা খুশি মনে দেয় কারণ তাহলে অন্য কোনও ডাকাত দলের খপ্পরে পড়তে হয় না। আমাদের হেড অফিস যেহেতু কর দেবে না তাই ওদিকে যাওয়া নিষেধ। তাই এখানকার ওই সব ব্যবসায়ীদের ওপর বাবা মুর্শেদের রাগ আছে।’

বনবিহারী স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘আমাদের এটা একটা এন জি ও, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। লোকটির রাগ থাকা উচিত নয়।’

‘শুনেছি ও বলে হেড অফিস নাকি তলায় তলায় টাকা কামায়। সত্যিমিথ্যে জানি না। আমি তো সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি যেন ওর খপ্পরে না পড়ি। বিশাল দল ওর। নিন, শুয়ে পড়ুন।’ রতন বলল।

‘এই রামগঙ্গায় ও কখনও এসেছে বলে শুনেছ?’

‘না। এখানে এলে বিপদে পড়বে বলে ও আসবে না।’ রতন বলল।

আর কথা বাড়াননি বনবিহারী। কেবিনের ছোট্ট বিছানায় শুয়ে তাঁর মনে হল যে লোকটা এসেছিল সে সত্যিকারের বাবা মুর্শেদ তো? নাকি বাবা মুর্শেদ নিজে না এসে দলের কাউকে পাঠিয়ে ওই নাম বলতে বলেছে? নিরাপত্তার কারণে দ্বিতীয়টি হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু সঠিক বা মেকি যেই হোক, লোকটা যেন নিজের পরিচয় দিত। তা যে-ই হোক, কাল পাথরপ্রতিমার হাসপাতালে গেলে জানা যাবে বাচ্চা মেয়েটার অপারেশনের টাকা অন্য কেউ দিয়ে গেছে কিনা। যদি দেয় তাহলে তাঁকে ব্যাপারটাকে নিয়ে ভাবতে হবে। একটা মানুষ ডাকাতি করে, সেটা করতে গিয়ে নিশ্চয়ই খুনখারাপি করতে হয়। তার কানে খবর পৌঁছেছিল যে নতুন ডাক্তারবাবু পেশেন্টের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে লঞ্চে করে পাথরপ্রতিমায় নিয়ে এসেছেন। নিজের পয়সায় তার অপারেশনের ব্যবস্থা করেছেন। আগামীকাল যদি তাঁকে টাকা দিতে হত তাহলে তাঁর হাত প্রায় খালি হয়ে যেত। তবু ওইটুকু টাকার জন্যে একটা মেয়ের জীবন চলে যাবে তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। সন্ধেবেলায় হাসপাতালে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে হওয়া কথা ওই লোকটির কানে কি করে গেল? ও নিশ্চয়ই পাথরপ্রতিমার কাছাকাছি থাকে না। দূর জঙ্গলের মধ্যে কোনও গ্রামে বসে কথাগুলো শুনে চলে এসেছে? কীভাবে এল? ভটভটিতে এলে তো এখানে পুলিশের হাতে পড়ত? তাহলে যে এসেছিল সে আসল বাবা মুর্শেদ নয়। পাথরপ্রতিমায় থাকা কোনও লোককে পাঠিয়েছে বাবা মুর্শেদ। কেন পাঠাল? ডাকাতির টাকায় মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে পুণ্য করবে বলে? হয় তো। কিন্তু এরকম লোক যদি সংখ্যায় বেশি হত তাহলে ডাক্তারি করতে সুবিধে হত।

ঘুম আসছিল না বনবিহারীর। মামণির ব্যাপারটা মাথায় আসতেই তিনি উঠে বসলেন। তাঁর অনুমতি না নিয়েই মেয়েটা মালতীকে বাড়িতে নিয়ে এল? যেটুকু দেখেছেন তাতে মালতী বেশ ভাব করে ফেলেছে সন্তানের সঙ্গে। ক’দিন আগে যার অমন অপারেশন হল তার মধ্যে দুর্বলতার চিহ্ন দেখতে পাননি তিনি। কিন্তু মামণির ঠোঁটের কোণে হাসি দেখেছেন। যেন ব্যঙ্গের হাসি। এর মধ্যে কবে কখন ওরা মামণির মাকে খবর পাঠিয়েছে তা তাঁর জানা নেই। খবর পেয়ে যদি টান থাকে তাহলে ওর মা নিশ্চয়ই আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে চলে আসবেন এখানে। এসে মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইবেন ভদ্রমহিলা? কতদিন মামণি বাড়িছাড়া? এতদিন পরে কি টান থাকবে? কিন্তু মামণি ইশারায় বুঝিয়েছে ওই ছেলেটি খবর দিয়েছে। ছেলেটি কে? হঠাৎ গজিয়ে তার মাথায় এই চিন্তা কেন এল?

হঠাৎ বিপরীত ভাবনার ঢেউ মাথায় আসতে বনবিহারী একটু শান্ত হল। মামণির মা এলে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবেন তিনি। যে মেয়ে কুমারী অবস্থায় উগ্রপন্থীদের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, দু-আড়াই বছর পরে তাকে সন্তানসহ বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে সম্বন্ধ করে বিয়ে দিতে নিশ্চয়ই পারবেন না তিনি। বয়সে বেশ বড়, শুধু এই ত্রুটিটুকু যদি ভদ্রমহিলা উপেক্ষা করতে পারেন তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

প্রায় শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লেন বনবিহারী। খানিকটা নিশ্চিন্তে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *