দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ২৩

তেইশ

বুকে হাত দিয়ে বিছানায় বসে ব্রজ মণ্ডল জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। পুঁটির মায়ের সঙ্গে ঘরে ঢুকে বনবিহারী বললেন, ‘শুয়ে পড়ুন, চিৎ হয়ে শোন।’

‘পারছি না!’ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল ব্রজ মণ্ডল, ‘ব্যথা, বুক ভেঙে যাচ্ছে।’

প্রায় জোর করেই বেঁটে মানুষটাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন বনবিহারী। তারপর স্টেথো বুকে বসাতেই বুঝতে পারলেন হার্টের অবস্থা ভালো নয়। এখনই ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করা উচিত। পুঁটির মায়ের দিকে তাকালেন তিনি।

‘কি হয়েছে ডাক্তারবাবু?’ পুঁটির মায়ের গলায় উদ্বেগ।

‘এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ওঁকে!’

‘হাসপাতালে! এখন তো ঘাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে! কি হবে?’

ব্যাগ খুলে একটা সরবিটেট ট্যাবলেট বের করে ব্রজ মণ্ডলের জিভের তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে বনবিহারী বললেন, ‘আশেপাশের মানুষদের এখনই ডেকে আনুন। ওঁকে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে দেখতে হবে কি করে পাথরপ্রতিমায় পৌঁছনো যায়।’

পুঁটির মায়ের চিৎকার এবং কান্নায় কয়েক মিনিটের মধ্যে ভিড় জমে গেল। বনবিহারী তাদের কি করণীয় বুঝিয়ে বললে কোথাও থেকে একটা খাটিয়া জোগাড় করে এনে তারা ব্রজ মণ্ডলকে তার ওপর শুইয়ে নিয়ে চলল নদীর দিকে।

বনবিহারী চলছিলেন সঙ্গে। নদীর গায়ে পৌঁছে দেখলেন চারধার নিস্তব্ধ। কোনও ভটভটি চলছে না। নদীর গায়ে সেগুলো বাঁধা আছে লোকশূন্য অবস্থায়। এমনকি দাঁড়টানা নৌকোও নেই। ব্রজ মণ্ডলের প্রতিবেশীরা চিৎকার-চেঁচামেচি করেও ভটভটির ড্রাইভারদের খোঁজ পেল না। এদিকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বেশ জোরে চিৎকার করে থেমে গেল ব্রজ মণ্ডল। কেউ একজন বলে উঠল, ‘যাঃ মরে গেল।’

বনবিহারী দ্রুত পরীক্ষা করলেন। পুঁটির মা হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘না। বেঁচে আছে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু—।’

হঠাৎ রতন এগিয়ে এল সামনে, ‘ডাক্তারবাবু!’

বনবিহারী তাকালেন, ‘বলো।’

‘যদিও হুকুম নেই রাত্রে লঞ্চ চালু করার তবু আপনি যদি বলেন তাহলে ওকে ওপারে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।’ রতন বলল।

‘বেশ। তাই করো। কৈফিয়ৎ যদি দিতে হয় আমি দেব।’

হাসপাতালে গেলেন না বনবিহারী। ব্রজ মণ্ডলের প্রতিবেশীরাই তাকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। ফিরে এলেন রতনদের সঙ্গে তিনি। কিন্তু লঞ্চ থেকে নামার পর আবার অস্বস্তি ফিরে এল। পুঁটির মা-ব্রজ মণ্ডল এখন বাড়িতে নেই। খালি বাড়িতে মামণি সন্তানকে নিয়ে একা রয়েছে। যে ঘটনা মামণি ঘটাতে চলেছিল সেটা যদি আবার শুরু হয় তাহলে তিনি কি করবেন? অন্ধকারে নির্জন পথে হাঁটতে-হাঁটতে তিনি মন স্থির করে নিলেন। তাঁকে শক্ত হতে হবে। প্রচণ্ডভাবে শাসন করতে হবে মেয়েটাকে। অনেক হয়েছে। ওর জন্যে নিজের জায়গা ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু আর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও কাজ তিনি করতে রাজি নন।

সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এলেন তিনি। ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখলেন বিছানার মাঝখানে সন্তান অঘোরে ঘুমাচ্ছে কিন্তু মামণি নেই।

বাথরুম এবং বারান্দা ফাঁকা। বিছানার মাঝখানে চোখ-বন্ধ-শিশুকে হঠাৎ খুব অসহায় বলে মনে হচ্ছিল বনবিহারীর। কোথায় গেল ওর মা? নীচে নেমে এলেন তিনি।

বাইরের পৃথিবী এখন ঘুটঘুটে অন্ধকারে মোড়া। খেয়াল হতে আবার ওপরে উঠে টর্চ নিয়ে আসলেন। আশেপাশে সেই টর্চের আলো ফেলেও কোনও মানুষের মূর্তি চোখে পড়ল না। কোথায় যেতে পারে মামণি? এসময় নদী পেরিয়ে পাথরপ্রতিমায় যাওয়া সম্ভব নয়। যে ছেলেটার সঙ্গে রতন ওকে কথা বলতে দেখেছিল সে এ-পাড়ে এসেছিল বটে কিন্তু তাকেও তো ফিরে যেতে দেখা গেছে।

চল্লিশ মিনিট খোঁজাখুঁজির পরে ঘাটের কাছে আসতেই হাঁক শুনলেন, ‘কে যায়?’

‘আমি। ডাক্তার।’ সাড়া দিলেন তিনি।

‘ডাকতার! ও, লঞ্চের ডাক্তার?’ প্রশ্ন যে করছিল তাকে দেখা যাচ্ছিল না।

‘হ্যাঁ।’

‘বেড়াতে বেরিয়েছেন নাকি! খুব ভুল করেছেন। কয়েক রাত হল খুব সাপের উপদ্রব হয়েছে ল্যাজে পা না পড়লেও ছোবল মারে। একেবারে মরণ-ছোবল।’

‘আপনি কে ভাই?’

‘জগৎপতি হালদার। এই ছোট্ট মুদির দোকানটা আমার। রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসে না। এই জেগে জেগে চোখ ব্যথা হয়ে গেলে ভগবান যদি শেষরাতে একটু ঘুম এনে দেন তাহলেই আমি কৃতার্থ।’ লোকটি বলল।

‘দয়া করে কাল সকালে একবার আসবেন। আপনার এটা একটা অসুখ, চিকিৎসা করলে সেরে যাবে।’ তারপর একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কখন থেকে ওখানে বসে আছেন?’

‘সেই সন্ধে বরাবর। দোকান বন্ধ করে আর কোথাও যাই না।’ তারপর গলা অন্যরকম করে বলল, ‘তাহলে ব্রজ চলল?’

‘চলল মানে?’

জ্ঞানহীন শরীর হাসপাতালে গেল, ওই অবস্থা থেকে ফিরে আসা কপালের জোর না থাকলে সম্ভব নয়। বেচারার বংশটাও লোপ পেয়ে গেল।’

‘আমার বিশ্বাস উনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন।’

বনবিহারী এবার উলটোপথ ধরলেন। মামণি যদি এই পথে গিয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই জগৎপতি হালদারের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। সেক্ষেত্রে জগৎপতি নিশ্চয়ই খবরটা তাঁকে দিত। অল্পবয়সি মেয়ে একা অন্ধকারে ঘুরছে দেখলে ওর কৌতূহল অবশ্যই বেড়ে যেত।

যেদিক দিয়ে রামগঙ্গায় বাস ঢোকে সেদিকে এগিয়ে গেলেন বনবিহারী। একটু পরেই বসতি শেষ, গাছপালা এবং দুপাশে মাঠ। সতর্ক হয়ে হাঁটছিলেন তিনি যাতে সাপের ছোবল না খেতে হয়। টর্চের আলো ফেলে ফেলে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে ফিরে এলেন তিনি। সন্তানের ঘুম যদি ভেঙে গিয়ে থাকে, না, বাড়ির কাছে এসেও কান্নার শব্দ শুনতে না পেয়ে সিঁড়িতে টর্চের আলো ফেলেই দাঁড়িয়ে গেলেন। মামণি বসে আছে ওখানে।

ওর সামনে গিয়ে বনবিহারী কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’

টর্চের আলো মুখে পড়ায় দু-হাতে মুখ ঢাকল মামণি। বনবিহারী আলো নিভিয়ে বেশ জোরে বললেন, ‘ওইটুকু বাচ্চাকে একা ঘরে ফেলে রেখে যাওয়া যে অন্যায় তা তুমি জানো না? তুমি না ওর মা? যাও, ওপরে যাও।’

অন্ধকারে মামণির মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন না বনবিহারী। কিন্তু মেয়েটা যে তাঁকে পাত্তা দিচ্ছে না এটা টের পাচ্ছিলেন। পেয়ে রাগ হল তাঁর। এগিয়ে গিয়ে ওর কনুই-এর ওপরটা ধরে এক হ্যাঁচকায় টেনে তুললেন, ‘ওপরে ওঠ।’

মামণি হাত ছাড়িয়ে গটগট করে ওপরে উঠে গেল।

বনবিহারী কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে মন স্থির করে নিলেন। না, তিনি কোনওভাবেই প্রশ্রয় দেবেন না। তেমন কিছু যদি আবার ও শুরু করে তাহলে দু-একটা চড় মারতে দ্বিধা করবেন না। ওপরে উঠে এলেন তিনি। সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলেন।

মামণি রতনদের দিয়ে যাওয়া বাণমাছ আর রুটি নিয়ে খেতে বসে গেছে। বনবিহারী হাতমুখ ধুয়ে পোশাক বদলে ঘরে ফিরলে ওর খাওয়া হয়ে গেল। এঁটো থালা তুলে নিয়ে বাইরে গিয়ে ধুয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। তারপর ফিরে এসে শুয়ে পড়ল সন্তানের ওপাশে।

যে মেয়ে ওই কাণ্ড করার পর ছেলেকে একা ফেলে রেখে অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল, সে বকুনি খেয়ে ঘরে ফিরে খেতে বসতে পারে? মাথা নাড়লেন বনবিহারী। তারপর টিফিন ক্যারিয়ারের দিকে তাকালেন। অনেকক্ষণ থেকেই খিদে-খিদে পাচ্ছিল কিন্তু এখন খাওয়ার ইচ্ছেটা আচমকা চলে গেল। একগ্লাস জল খেয়ে আলো নেভাতে গিয়েও নেভালেন না। অন্ধকারে মামণির সঙ্গে থাকতে সাহস হচ্ছিল না তাঁর।

সন্তানের এপাশের বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন তিনি। আঃ। শরীর এত ক্লান্ত যে বিছানার স্পর্শ পেতে মনে হল এর চেয়ে আরাম পৃথিবীতে নেই। কাল সকালে মালতীর অপারেশন হবে। সেখানে একবার যাওয়া দরকার। চোখ বন্ধ করলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মামণির কথা মনে এল। তাঁকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল একের পর এক। মালতীর বুক পরীক্ষা করার সময় তাঁর মনে কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি। কিন্তু মামণি যখন তার জামার বোতাম খুলেছিল তখন তাঁর সমস্ত শরীরে কাঁটা ফুটেছিল। তিনি জানেন তখন অদ্ভুতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। পড়ছিলেন বলেই মামণিকে তিনি বয়সের ব্যবধানের কথা বলছিলেন। তার মানে যদি বয়সের ব্যবধান না থাকত তাহলে তিনি সানন্দে ওকে প্রহণ করতেন। মামণি যখন জানতে চাইল তিনি ওকে বিয়ে করবেন কিনা তখন তাঁর রক্তে যে জোয়ার উঠেছিল তার অস্তিত্বের কথা তিনি সারাজীবনে জানতেন না। পুঁটির মা এসে তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তার মানে তাঁর অবচেতনে মামণির জন্যে আকাঙ্খা তিলতিল করে জমা হয়েছে? কি অন্যায় কথা! ভাগ্যিস পুঁটির মা এসেছিল নইলে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারতেন না তিনি।

হঠাৎ অস্পষ্ট শব্দ হল। তাড়াতাড়ি চোখ খুললেন তিনি। খুলে অবাক হয়ে দেখলেন সন্তান উপুড় হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ফোকলা মুখে হাসিটাকে এত স্বর্গীয় দেখাল যে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ওকে কোলে তুলে নিলেন তিনি। কিন্তু কোলে তোলামাত্র কেঁদে উঠল সন্তান। তাকে ঠান্ডা করতে পারছিলেন না বনবিহারী। মামণি উলটোদিকে মুখ করে শুয়ে আছে। বিরক্ত হয়ে বিছানায় নামিয়ে দিতেই কান্না থেমে গেল। দুটো হাত ছুড়তে-ছুড়তে উপুড় হয়ে শব্দ করে হাসল সে। তারপর সাঁতরাবার চেষ্টা করল। মাঝে-মাঝেই তাঁর দিকে তাকিয়ে হেসে উঠছে সন্তান। হাসির শব্দ একটু-একটু করে জোরাল হচ্ছে। বনবিহারী বুঝতে পারলেন তাঁকে খেলার সঙ্গী হিসেবে চাইছে সন্তান। এই ছেলে যতক্ষণ না ঘুমাবে ততক্ষণ তাঁর পরিত্রাণ নেই।

সকালে বনবিহারীর ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি লাফিয়ে উঠতেই হাসির শব্দ শুনলেন। তাকিয়ে দেখলেন চা বানাতে বানাতে মামণি তার অদ্ভুত শব্দের হাসি হাসল। তাঁকে ওইভাবে লাফিরে উঠতে দেখেই যে ওর হাসি পেয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সন্তান এখন ঘুমে কাদা হয়ে আছে। খুব জ্বালিয়েছে ছেলেটা।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে পোশাক বদলে বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হয়ে মামণির হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে বনবিহারী নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, মাথা ঠান্ডা হয়েছে?’

মামণি মুখ নামাল। ঠোঁটের কোণে হাসির কুঞ্চন।

চা খেয়ে বনবিহারী বললেন, ‘আজ একটু ভাত ডাল করে নিও। কালকের মাছ তো আছেই। নীচের ব্রজবাবুর অবস্থা কীরকম জানি না। ওঁর স্ত্রী তো হাসপাতালে। তোমাকে একা থাকতে হবে। সাবধানে থেকো।’

বাধ্য বালিকার মতো ‘মাথা নাড়ল মামণি।

লঞ্চে উঠে রতনের কাছ থেকে কাগজটা পেলেন বনবিহারী। পরেশ মণ্ডল কাল দিয়ে গিয়েছিল। আজ তেঁতুলতলার ঘাটে ক্যাম্প হবে। ওখানকার মানুষদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জায়গাটা কত দূরে?’

‘বেশিদূরে না। মিনিট চল্লিশ লাগবে।’ রতন বলল।

‘বাঃ। দশটায় ক্যাম্প শুরু, তার মানে হাতে অনেক সময় আছে। ওখানে যাওয়ার আগে পাথরপ্রতিমা ঘুরে যাব। মালতীর আজ অপারেশন হবে। তাছাড়া কাল রাতে যাকে পৌঁছে দিয়ে এলাম তার অবস্থা কীরকম জেনে নেওয়া যাবে।’ একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এর জন্যে কি তোমার লঞ্চের তেল খুব বেশি খরচ হবে?’

দ্রুত মাথা নাড়ল রতন, ‘ছি-ছি। কী বলেন। চলুন।’

ব্রজবাবুর অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তার সন্দেহ করছেন ওঁর হার্টের রক্তচলাচলে বাধা পড়ছে। অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা দরকার। অবিলম্বে কলকাতার হাসপাতলে ওকে নিয়ে যাওয়া দরকার। ইসিজির রিপোর্ট ভালো নয়। বনবিহারী দেখলেন খবর পেয়ে ইতিমধ্যে ব্রজবাবুর কয়েকজন আত্মীয় এসে গেছেন। তাঁরাই ওকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার তোড়জোর করছেন। হাসপাতালের বারান্দায় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিল পুঁটির মা। বনবিহারীকে দেখে এগিয়ে এল সে, ‘হুট করে চলে আসতে হল, আপনি তো দেখেছেন। এখন ওকে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছি। আপনি আছেন বলে ভরসা, একটু বাড়িঘরের দেখাশোনা করবেন।’

‘নিশ্চয়ই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

বনবিহারী অবাক হলেন। এক রাত্রে ভদ্রমহিলা কীরকম বদলে গিয়েছেন। গতরাত্রে যাঁকে খুব অসহায় বলে মনে হচ্ছিল আজ তিনি স্থির, অনেক বেশি বাস্তব।

ডাক্তার বলেই এই সময় মালতীর বেডের কাছে যাওয়ার অনুমতি পেলেন বনবিহারী। গলায় ঝোলানো স্টেথোটা অনেক সমস্যার সমাধান করে দেয়। নার্স বলল, ‘ওটি প্রায় রেডি হয়ে গিয়েছে। মিনিট পনেরো পরে পেশেন্টকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু আপনি একবার অফিসে দেখা করে আসুন।’

অফিসের কেরানি বলল, ‘অপারেশনের আগে টাকা জমা দেওয়া এই হাসপাতালের নিয়ম। আমরা আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।’

বনবিহারী ফাঁপরে পড়লেন। তিনি কলকাতার অফিস থেকে অনুমতি পেয়েছেন কিন্তু সেখান থেকে টাকা কবে আসবে খোঁজ নেননি। একটু ভেবে বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি একবার সুপারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সুপার তাঁর ঘরেই ছিলেন। বনবিহারী তাঁর সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। সুপার সমস্যাটা শুনলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই মহিলা কি আপনার আত্মীয়?’

‘না। এনজিও-র হয়ে ক্যাম্প করতে গিয়ে ওর অবস্থা দেখে নিয়ে এসেছি।’

‘অপারেশনের খরচ কে দেবে?’

এনজিও।

‘আপনি গ্যারান্টার হতে পারবেন?’

‘অবশই। তিনদিনের মধ্যে টাকা না এলে আমি নিজে দিয়ে দেব।’

ভদ্রলোক বললেন, আপনি আমাকে অবাক করেছেন। ঠিক আছে, যান, আমি বলে দিচ্ছি। আপনি দয়া করে সইসাবুদ করে দিন।’

অফিসে ফিরে টাকার গ্যারান্টি নিয়ে সই করলেন বনবিহারী। অপারেশনের জন্যে যে বন্ডে সই করতে হয় সেটাও তাঁকে দিয়ে করানো হল। বনবিহারী অবাক হয়ে দেখলেন মালতীর সঙ্গে আসা লোকটা ধারেকাছে নেই।

এরপরে মালতীর বেডের কাছে গেলেন তিনি। পাশে টুল টেনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছ?

মালতী কথা বলল না, তার চোখ উপচে জল গড়াল।

‘কেঁদো না। অপারেশনের পর তুমি ভালো হয়ে যাবে।’

চোখ মুছল মালতী, ‘ভালো হয়ে গেলে কি হবে?’

‘মানে?’

‘আমার মরে যাওয়াই উচিত।’

‘ছিঃ। এসব কথা বলা অন্যায়। তোমাকে এখনও অনেক বছর বাঁচতে হবে।’

শ্বাস ফেলল মালতী, ‘আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’

‘বলো।’

‘আমার কি একটা বুক কাটবে?’

‘হ্যাঁ। যে বুকে টিউমার হয়েছে সেটা বাদ দিয়ে দেওয়া হবে।’

‘না।’ চিৎকার করে উঠল মালতী, ‘ওদের বলুন দুটো বুকই কেটে বাদ দিতে।’

‘সেকি? কেন?’

‘সেই চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স থেকে এই বুকের জন্যে আমি জ্বলছি। এরা আমার শত্রু। একটা যদি থেকে যায় তাহলে তার দিকেও পুরুষগুলো হাত বাড়াবে। পায়ে পড়ি, ওদের বলুন দুটোকে বাদ দিতে।’

মালতীর কান্নাজড়ানো কথার মধ্যেই দুটো লোক এল স্ট্রেচার নিয়ে। বলল, ‘যেতে হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *