দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ২২

বাইশ

নৌকোটা উলটে গেল। একটা মানুষকে নিয়ে বাঘ জলে পড়ল। নৌকোয় আর যে দুজন ছিল তারা বৈঠা দিয়ে আঘাত করতে লাগল বাঘটাকে। রতন লঞ্চের মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছিল ওই পাড়ে। সেই আওয়াজে বাঘ বোধহয় ভয় পেল। মানুষটাকে ছেড়ে সাঁতরে পাড়ে উঠে পড়ল। বনবিহারী স্পষ্ট দেখতে পেলেন তাকে। পাড়ে উঠে শরীর ঝাঁকিয়ে জল ঝেড়ে ফেলে লহমার মধ্যে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। তাহলে একেই বলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! লঞ্চ যে পর্যন্ত যেতে পারে সেই পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেল রতন। ততক্ষণে জল থেকে আহত সঙ্গীকে লোক দুটো টেনে তুলেছে নৌকোয় সোজা করে। হিরো চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, ‘মরে গেছে নাকি?’

একজন মাথা নাড়ল, ‘না না, বেঁচে আছে। আমার ছেলেটাকে বাঁচান ভাই।’ নৌকো এগিয়ে আসতে লাগল লঞ্চের দিকে। রাঁধুনি সোনা উঠে এসেছিল ওপরে। বলল, ‘সর্বনাশ!’

হিরো বলল, ‘বলে সর্বনাশ! মরে গেলে বেঁচে যেত ছেলেটা। কথায় বলে বাঘে ছুঁলে সর্বনাশ। না মরলে ভুগবে ছয়মাস ধরে তারপর আধমরা হয়ে বেঁচে থাকবে।’

নৌকো চলে এসেছে লঞ্চের গায়ে। প্রৌঢ লোকটি হাতজোড় করল, ‘হাসপাতালে নিয়ে গেলে বেঁচে যাবে বাবা। দয়া করে নিয়ে চল।’

হিরো বলল, ‘ডাক্তারবাবু রুগি দেখতে বেরিয়েছেন। সেই কাজ ফেলে আবার পাথরপ্রতিমায় ফিরে যাই কি করে বল? যদি বেঁচে থাকে তাহলে ওবেলায় ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে পারি।’

শব্দ করে কেঁদে উঠল প্রৌঢ়, ‘মরে যাবে। ও বাবা, আমার ছেলে মরে যাবে।’

রতন রেলিং-এ দাঁড়িয়ে ছিল, বলল ‘কই, ছেলেটাকে দেখি।’

বনবিহারী দেখলেন প্রৌঢ় সরে দাঁড়াল। নৌকোর গর্তে শুয়ে আছে ছেলেটা।

রতন বলল, ‘ও তো মরেই গেছে। স্থির হয়ে গেছে।’

সঙ্গে সঙ্গে প্রৌঢ় প্রতিবাদ করল, ‘না না, মরেনি। বুকের ভেতর শব্দ হচ্ছে। বাঘ ওর কাঁধ কামড়ে ধরেছিল, মাথা বা বুকে কামড় দিতে পারেনি।’

রতন এবার বনবিহারীর দিকে তাকাল, ‘কি করবেন ডাক্তারবাবু?’

‘এরকম ক্ষেত্রে তোমরা কি করো?’ বনবিহারীর জিজ্ঞাসা করলেন।

কোনও স্থির কিছু নেই। তবে বাঘে কামড় দিলে তাকে হাসপাতালেই পৌঁছে দেয় সবাই। বনদপ্তর থেকে চিকিৎসার ভার নেয়।’ রতন জানাল, ‘সবাই যা করে তাই কর।’

‘কিন্তু কোম্পানিকে জানাতে হবে। মণ্ডলদাকে তো রিপোর্ট পাঠাতে হয়।’

নিশ্চয়ই। আজ কেন কাজ হল না তা তো জানাতেই হবে। মালতীর জন্যেও তো আমাদের দেরি হয়ে গেল। না হলে এই ঘটনাটা আমাদের সামনে ঘটত না।’

তা অবশ্য। কিন্তু মালতীর ব্যাপারটা মণ্ডলদাকে না বলাই ভালো।’ বলে চেঁচিয়ে সঙ্গীদের বলল, ‘ওকে লঞ্চে নিয়ে আয় সবাই। সাবধানে আনবি।’

লঞ্চে আনার পর দেখা গেল ছেলেটার কাঁধ থেকে ইতিমধ্যে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেলেও এখনও সেটা বন্ধ হয়নি। ক্ষতস্থান মুছিয়ে হিরো সেখানে তুলো চাপা দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। বনবিহারী নাড়ি পরীক্ষা করলেন। খুব দুর্বল। ছোটুকে বললেন দুটো ইনজেকশনের নাম, আছে কিনা! ছোটু ছুটল। ততক্ষণে লঞ্চের মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে রতন। কপালগুণে ইনজেকশনগুলো পাওয়া যেতে পুশ করে দিলেন বনবিহারী। লঞ্চ বেশ দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে পাথরপ্রতিমার দিকে।

এর মধ্যে সোনা দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। বনবিহারীর খিদে পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছেলেটির বাবাকে খাওয়ানো গেল না। ওর যে সঙ্গী নৌকোয় ছিল সে লঞ্চে ওঠেনি। নৌকো নিয়ে ফিরে গেছে। বনবিহারী জেনেছেন যে ওরা কাঁকড়া ধরতে জঙ্গলে যাচ্ছিল। এখানে মানুষ কি ভয়ংকরভাবে বেঁচে থাকে!

খেতে বসার আগে বনবিহারী মামণির কেবিনে গেলেন। বিছানার ওপাশে ঘুমিয়ে আছে সন্তান। মাথার কাছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে মামণি পা ছড়িয়ে। একটা হাত মুখের ওপর চাপা দিয়ে রেখেছে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাঘটাকে দেখেছ?’

মামণি হাত সরাল না।

‘সুন্দরবনের বাঘকে বাইরের মানুষ খুব কমই দেখতে পায়। তুমি দ্যাখনি আজ?’

মামণি নির্বিকার। বনবিহারী বললেন, ‘মন খারাপ কেন?’

মামণি পাশ ফিরে বসল। বনবিহারী একটু দাঁড়িয়ে ফিরে এলেন। খাওয়া শেষ করে ছাদে উঠে গেলেন বনবিহারী। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। নদীর দু-ধারে গাছেরা গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। নিশ্চয়ই ওর মধ্যে মৃত্যুদূতেরা বসে আছে। তিনি শুনেছেন রাতের বেলায় মাঝনদীতে নোঙর করা লঞ্চে বাঘ উঠে আসে সাঁতার কেটে। নিঃশব্দে ঘুমন্ত মানুষকে তুলে নিয়ে যায়। জল থেকে এতটা ওপরে বাঘ কি করে ওঠে? লাফাবার সময় তো পায়ের নীচে শক্ত কোনও সাপোর্ট চাই। সোনা এল, ‘ডাক্তারবাবু!’

বনবিহারী তাকালেন। সোনা বলল, ‘দিদি খেতে চাইছেন না কিছুতেই।’

‘তোমরা খেয়ে নাও। ওর হয়তো খিদে নেই।’

‘আপনি যদি একবার বলেন—!

‘তাতে কোনও লাভ হবে না।’

রতন এসে দাঁড়াল, ‘খবর দিয়ে দিলাম। বনদপ্তর থেকে লোক আসবে ঘাটে।’

‘কীভাবে খবর দিলে?’

‘কেন? আমাদের ওয়াকিটকিতে। থানায় জানিয়ে দিয়েছি।’

পাথরপ্রতিমায় পৌঁছবার আগেই দেখা গেল লঞ্চঘাটায় ভিড় জমেছে। অর্থাৎ বাঘের আক্রমণের কাহিনি ছড়িয়ে গেছে। বনদপ্তরের লোকজন, পুলিশ এবং হাসপাতালের স্ট্রেচার ছেলেটাকে তুলে নিয়ে গেল। সঙ্গে ওর বাবা। কাউকে বাঘ জখম করলে সরকার থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে শুনলেন বনবিহারী।

এখন দুপুর তিনটে বাজে। রতনকে অপেক্ষা করতে বলে মাটিতে নামলেন বনবিহারী। খোঁজখুঁজির পরে টেলিফোন বুথটাকে পেয়ে ভেতরে ঢুকলেন। পকেটের ছোট ডায়েরিতে নাম্বার লেখা ছিল। তা দেখে ডায়াল করলেন। দ্বিতীয়বারে লাইন পেলেন তিনি। এনজিওর খোদ মালিককে চাইলেন নিজের পরিচয় দিয়ে। একটু অপেক্ষার পরে গলা শুনতে পেলেন, ‘নমস্কার ডাক্তারবাবু। কোনও সমস্যা হয়েছে?’

‘দুটো ঘটনা আপনাকে জানানো দরকার। আজ মৃদঙ্গভাঙা নদী ধরে কাজে যাচ্ছিলাম আমরা। চোখের সামনে কাঁকড়া ধরতে আসা একটা নৌকোর ওপর বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে একটি ছেলেকে ভয়ঙ্কর-ভাবে আহত করেছে। ওকে বাঁচাবার জন্যে আজকের কাজ বাতিল করে পাথর প্রতিমার হাসপাতালে নিয়ে এলাম আমরা।’ বনবিহারী বললেন।

‘অনেক ধন্যবাদ। ঠিকই করেছেন আপনি। আমরা তো মানুষের জন্যে কাজ করছি। তবে আপনি কেন কষ্ট করে ফোন করলেন! এর জন্যে অন্য লোক তো আছে।’

‘আমি আর একটি ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি।’

‘বলুন।’

‘এর আগের দিন বহুদূরের একটি গ্রামে পেশেন্ট দেখতে গিয়ে একজন মহিলার ব্রেস্টে টিউমার হয়েছে দেখে তাকে পাথরপ্রতিমার হাসপাতালে ভরতি করে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয় অবিলম্বে অপারেশন না করলে ওর প্রাণসংশয় হবে। হাসপাতালের ডাক্তার আমার সঙ্গে সহযোগিতা করছেন। কিন্তু মহিলাটি এত দরিদ্র যে ওর পক্ষে অপারেশনের খরচ মেটানো সম্ভব নয়। অথচ গ্রামে ফিরে গেলে ওর মৃত্যু অবধারিত। এই অপারেশনের জন্যে হাজার পাঁচেক টাকা খরচ হবে। আমাদের এনজিও থেকে কি টাকাটা দেওয়া যেতে পারে? মহিলা এখন হাসপাতালে ভরতি আছেন।’

‘ডাক্তারবাবু, আমরা দূরের গ্রামগুলোতে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছি। অপারেশন বা কোনও জটিল চিকিৎসার দায় বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া এরকম দায়িত্ব আমরা কতজনের ক্ষেত্রে নিতে পারি বলুন?’

‘তাহলে আমি একটা আবেদন করছি। আপনি যদি আমাকে ওই টাকা অগ্রিম হিসেবে দেন তাহলে আমি পাঁচ মাসে তা শোধ করে দেব। আপনারা আমরা মাইনে থেকে মাসে হাজার টাকা করে কেটে নেবেন। এটা কি সম্ভব?’

‘আপনি আপনার পকেট থেকে টাকা দিতে চাইছেন?’

‘আমি যদি ওকে পরীক্ষা না করতাম তাহলে নিশ্চয়ই দিতে চাইতাম না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ওর ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হয়েছে। পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে। সেক্ষেত্রে অপারেশন করলে বাঁচার সুযোগ থাকছে।’

‘ঠিক আছে। আপনি আমাকে অবাক করলেন ডাক্তারবাবু। এটা এনজিও থেকে নয়, আমরা অন্য ফান্ড থেকে টাকাটার ব্যবস্থা করছি। তবে ব্যাপারটা গোপন রাখবেন।’

‘অনেক ধন্যবাদ।’ টেলিফোন রেখে স্বস্তি হল বনবিহারীর।

লঞ্চ থেকে বাড়িতে ফেরার সময় সন্তানকে কোলে না নিয়ে মামণি গটগট করে হেঁটে এল। বাধ্য হলেন বনবিহারী শিশুকে বহন করতে। দরজায় পুঁটির মায়ের সঙ্গে দেখা। মামণিকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওমা! কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?’

মামণি জবাব না দিয়ে ওপরে উঠে গেল। পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে বনবিহারী হাসলেন, ‘মাথাটা গরম হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না।’

‘কেন? কি হয়েছে?’

‘বাচ্চা ঝামেলা করছিল, সামলাতে পারছিল না।’

‘একি কথা! বাচ্চারা তো ঝামেলা করবেই। মা যখন হয়েছে তখন তা সহ্য করতেই হবে।’

‘ঠিক হয়ে যাবে।’

ওপরে উঠে বনবিহারী দেখলেন মামণি দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় তালার চাবি তার কাছে নেই। চাবি খুললেন বনবিহারী। সঙ্গে-সঙ্গে ভেতরে ঢুকে ঘরে পরার জামা নিয়ে কলঘরে চলে গেল মামণি। সন্তান আবার কান্না শুরু করল। মামণির অপেক্ষায় না থেকে নিজেই জল গরম করে দুধ গুলে তাকে খাওয়ালেন বনবিহারী। এর মধ্যে মামণি কলঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিছানার একপাশে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়েছে।

দুধ খেয়ে সন্তানের ফুর্তি বেড়ে গেল। সে হাত-পা ছুড়ে খেলার চেষ্টা করতে লাগল বনবিহারীর দিকে তাকিয়ে। বনবিহারী মুখ থেকে আজগুবি শব্দ বের করলে সে শব্দ করে হাসতে লাগল। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পরে হাঁপিয়ে গেলেন বনবিহারী। কিন্তু উৎসাহে ভাটা পড়েনি সন্তানের।

বনবিহারী ডাকলেন, ‘মামণি! কি হয়েছে তোমার?’

মুখ না ফিরিয়ে শূন্যে হাত ঘোরাল মামণি, কিছু হয়নি।

‘কিছু যদি না হয়ে থাকে তাহলে ওইভাবে আছ কেন সারাদিন? দুপুরেও খাওনি কিছু। যা সত্যি তা বললে আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়।’

মামণি জবাব দিল না।

ক্রমশ সন্ধে নেমে এল। বনবিহারীর খুব রাগ হচ্ছিল। সকালে বেশ ছিল মামণি। পাথরপ্রতিমায় গিয়ে ওর এই অবস্থা হল। ওই লোকটার সঙ্গে কেন যে দেখা হল ওর! দেখা করে যখন ফিরছিল রতনের সঙ্গে তখনও মুখে হাসি ছিল। কিন্তু যেই তিনি একটু বকাবকি করেছেন অমনি সেই হাসি মুছে গেল!

রাত আটটা নাগাদ ঘুমাল সন্তান। আর তখনই বাইরে থেকে গলা ভেসে এল, ‘ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!’

দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বনবিহারী দেখলেন সোনা দাঁড়িয়ে আছে, পাশে রতন। রতন বলল, ‘পাথরপ্রতিমায় গিয়েছিলাম। আপনি বান মাছ খান?’

‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়লেন বনবিহারী।

‘খুব সস্তায় জ্যান্ত বান পেয়ে কিনে ফেলেছিলাম। সোনাকে বললাম মাংসের মতো করে রান্না করতে। আমাদের জন্যে অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে। তাই আপনাদের জন্যে নিয়ে এসেছি। সঙ্গে দশখানা রুটি আছে। হবে তো?’

‘খুউব হবে। কি বলে যে তোমাদের ধন্যবাদ দেব—!’

‘না না, একি বলছেন—! সোনা টিফিন ক্যারিয়ারটা দিয়ে দিল।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে থমকে দাঁড়াল রতন, ‘আর একটা কথা। আমি যখন মাছ কিনে ভটভটিতে ফিরে এলাম তখন দেখি রামগঙ্গার ঘাটে সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।’

‘কোন ছেলেটা?’

‘আজ হাসপাতালে দিদির সঙ্গে যে কথা বলছিল। আমি তার পরিচয় জানতে এগিয়ে যাওয়ার আগেই সে ভটভটিতে উঠে পাথরপ্রতিমায় চলে গেল।’

নিজেকে স্থির রাখলেন বনবিহারী। বললেন, ‘ঠিক আছে।’ ওরা চলে গেল।

অন্ধকার রামগঙ্গার দিকে তাকিয়ে বনবিহারী অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ! এই ছেলেটা কে? নিশ্চয়ই সে রামগঙ্গায় এসেছিল মামণির সন্ধানে। তারপরই তাঁর মনে হল, তিনি এত ভাবছেন কেন? পরিচিত কেউ তো দেখা করতে আসতেই পারে।

ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছিল। টিফিন ক্যারিয়ার নামিয়ে রেখে বনবিহারী আবার মামণিকে ডাকলেন। সে সাড়া দিল না। শেষ পর্যন্ত মায়া এল মনে। তিনি এগিয়ে গিয়ে মামণির পাশে বসলেন। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার ওপর রাগ হয়েছে?’

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ, তারপর আচমকা মামণি জড়িয়ে ধরল বনবিহারীকে। তারপর উঠে বসে দু-হাতে গলা জড়িয়ে ধরে আগ্রাসে চুমু খেতে লাগল একের পর এক। অপ্রস্তুত বনবিহারী নিজেকে ছাড়াতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত চাপা ধমক দিলেন তিনি, ‘এসব কি হচ্ছে? থামো!’

সবেগে মাথা নেড়ে না বলল মামণি। তারপর ঝটপট জামার বোতাম খুলে নিজেকে উন্মোচন করল। লণ্ঠনের আলো পড়ায় সেই জোড়া বুক এক রহস্যময়ী। অদ্ভুত গোঙানিতে কিছু বলতে চাইল মামণি। বনবিহারী উঠে দাঁড়াতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। মামণির শরীরের শক্তি যেন এখন অনেকগুণ বেড়ে গেছে। সে এক হাতে বনবিহারীর হাত জোর করে নিয়ে আসতে চাইছিল নিজের বুকের দিকে। সেই সঙ্গে সমানে গোঙানি বেরিয়ে আসছিল তার মুখ থেকে। বনবিহারীর মনে হল, মামণি বলছে, ‘আমি খারাপ, আমি খারাপ?’

‘না। তুমি খারাপ নও।’

চোখ নেড়ে সে জানতে চাইল, ‘তবে?’

‘দ্যাখো, আমার সঙ্গে তোমার এই সর্ম্পক হতে পারে না।’

মামণির মুখে প্রশ্ন ফুটল, ‘কেন?’

‘আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়।’

মাথা নাড়ল মামণি। বোঝাল সে এই যুক্তি মানে না।

বনবিহারী একটা হাত মুক্ত করতে পেরে ওর মাথা স্পর্শ করলেন, ‘শান্ত হও।’

হঠাৎ মামণি তাঁকে ছেড়ে দিয়ে খাট থেকে নীচে নামল। যেখানে বনবিহারীর জিনিস থাকে সেখানে গিয়ে কলম তুলে কাগজে কিছু লিখল। তারপর সেই কাগজটা নিয়ে হাসিমুখে বনবিহারীর সামনে এসে এক হাতে তাঁর চোখ বন্ধ করে দিল। তারপর হাত সরাতে বনবিহারী চোখ খুলতেই কাগজের লেখাটা দেখতে পেলেন, ‘আমাকে তুমি বিয়ে করবে?’

বুকের ভেতর দুরন্ত ঝরনা যেন খলবলিয়ে উঠল। মামণির বুক এখনও বন্ধনমুক্ত।

সমস্ত শরীরে জোয়ার আসছে, টের পেলেন বনবিহারী। ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হল। পুঁটির মায়ের গলা কানে এল, ‘ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু! শিগগির আসুন।’

তাড়াতাড়ি দরজার দিকে ছুটে যেতে যেতে বনবিহারী দেখলেন মামণি জামার বোতাম লাগিয়ে ফেলেছে। দরজা খুলতেই পুঁটির মা বলল, ‘তাড়াতাড়ি আসুন। ও কেমন করছে।’

ব্যাগটা নিয়ে নীচে দৌড়ালেন বনবিহারী। বেঁচে যাওয়ার স্বস্তি নিয়ে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *