দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ২১

একুশ

রামগঙ্গা থেকে পাথরপ্রতিমা যেতে নদী পার হতে হবে। বনবিহারী চেয়েছিলেন কোম্পানির লঞ্চে না গিয়ে ভটভটিতে ওপারে যাবেন। কিন্তু রতন জানাল আজ বনবিহারীকে মৃদঙ্গভাঙা নদীতে ঢুকতে হবে। সতীর থান গ্রামে তাদের যাওয়ার কথা। তাই লঞ্চে পাথরপ্রতিমায় গিয়ে ওরা অপেক্ষা করবে। ডাক্তারবাবু যদি মালতীকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভরতি করিয়ে চলে আসেন তাহলে ভালো হয়।

সাত সকালে ঘুম ভেঙে গেলে বাচ্চাটা এমন চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল যে উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন বনবিহারী। বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়েছিলেন, ‘সন্তান! চুপ! একদম চুপ!’

সঙ্গে সঙ্গে কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বড় বড় চোখে তাঁকে দেখছিল সন্তান। দাঁত মাজা, বাথরুমে ঢোকার সময় যখনই ওর গলা থেকে কান্না বেরিয়েছে তখনই তিনি চাপা গর্জন করেছেন, ‘সন্তান!’ অমনি চুপ করে যাচ্ছিল শিশু। শেষ পর্যন্ত ওর দুধের কৌটো, বাটি ইত্যাদি ব্যাগে ভরে কোলে নিয়ে নেমেছিলেন দোতলা থেকে। কোনওদিকে না তাকিয়ে হাজির হয়েছিলেন লঞ্চের সামনে। পাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো লঞ্চ তখন বাতাসে ঈষৎ দুলছে। চেঁচিয়ে ডাকলেন, ‘ছোটু, ছোটু!’

বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পর ছোটু লঞ্চের দরজা খুলে এক হাত জিভ বের করেছিল। ওর নামানো তক্তার ওপর দিয়ে সন্তান এবং ব্যাগটাকে সামলে লঞ্চে উঠে এসে খুশি হলেন বনবিহারী। নাঃ, বয়স যাই হোক, তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য ঠিকই আছে।

জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সবাই উঠেছে?’

‘না। ঘুমোচ্ছে।’

‘ডাক সবাইকে। রোদ উঠে গেছে।’

ভেতরে ঢুকে চেয়ারে বসে বললেন বনবিহারী, ‘সোনাকে বল চা বসাতে।’

ছোটু সবার ঘুম ভাঙাল। দুই কেবিনের বন্ধ দরজায় শব্দ করল।

সন্তান তোয়ালের মধ্যে চুপচাপ শুয়েছিল। এই ধরনটা একটু অস্বাভাবিক। আজকাল সে সহজেই উপুড় হতে পারে সাঁতার কাটার মতো বিছানায় এগিয়ে যেতে পারে।

কেবিন খুলে মামণি বেরিয়ে কয়েক পা এগোতেই আচমকা চিৎকার শুরু করল সন্তান। সে তার মাকে দেখতে পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মুখে বিরক্তির ছাপ পড়ল মামণির। বনবিহারী ধমকালেন, ‘সন্তান! চুপ!’ সুইচ টিপলেই যেমন আলো নিভে যায় তেমনি কান্না থামিয়ে তাঁর দিকে তাকাল সন্তান।

মামণি অবাক হয়ে গেল। একটা ধমকেই চুপ করে গেল ও? সে নিজে ধমক দিতে পারে। কথা না বলতে পারলেও ধমকের ভঙ্গিতে আওয়াজ তুলতে পারে। সেই আওয়াজ বহুবার শুনিয়েছে ছেলেটাকে কিন্তু তখন তো কান্না বন্ধ করেনি।

ওকে অবাক হতে দেখে বনবিহারী হাসলেন, ‘বোধহয় নামটা ভালো লেগেছে।’

আঙুল নেড়ে মামণি বোঝাল যে সে কিছু বুঝতে পারছে না।

‘কাল রাত্রে ওর একটা নামকরণ করেছি। আর কোনও বাঙালির সম্ভবত এই নামটা নেই। সন্তান।’

মামণির ঠোঁট নড়ল। চারবার।

মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘না। সনাতন নয়। সন্তান। এবার বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ওকে দুধ খাওয়াও। এর মধ্যে সব আছে।’

অবাক চোখে কিছুক্ষণ বনবিহারীকে দেখে মামণি বাথরুমে চলে গেল।

চা খাওয়ার পর রতন এসে মৃদঙ্গভাঙা নদীতে যাওয়ার প্রোগ্রাম শোনাল।

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পাথরপ্রতিমার হাসপাতালে কোনও ডাক্তারকে চেনো?’

‘হ্যাঁ। চিনি।’

‘তাহলে তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।’

‘আমার যে ডিউটির সময় লঞ্চ ছেড়ে যাওয়া নিষেধ। কখন কি হয়!’

কথাটা মিথ্যে নয়।

রতন বলল, ‘ডাক্তারবাবু, একটা কথা বললে আপনি কিছু মনে করবেন না তো?’

‘না না। কি কথা?’

‘কোম্পানি গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে রুগি দেখে ওষুধ দেওয়ার কাজ করে। কোনও রুগি বেশি অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে ভরতি করার কথা বলতে হয়। আপনার আগে কোনও ডাক্তারবাবুই রুগিকে নিয়ে হাসপাতালে যাননি। ওটা রুগির লোকজনই করে। ওই কালীচরণ তো আছে। তাকেই বলুন মালতীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।’ রতন অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলল।

একটু ভাবলেন বনবিহারী, তোমার কি মনে হয় কালীচরণ কাজটা করবে?’

‘না করলে ওদেরই বিপদ হবে। মালতী মারা যাবে।’ রতন বলল।

‘মালতী মারা গেলে কালীচরণের কি ক্ষতি? সে তো ওর বউ নয়। তাছাড়া দুজনে একবস্ত্রে চলে এসেছে। পয়সাকড়িও সঙ্গে নেই। আমরা ওদের পাথরপ্রতিমায় নামিয়ে দিলে ওরা যেভাবে হোক গ্রামে ফিরে যাবে। চিকিৎসা করাবে না। তাহলে আমি ওদের এতদূর নিয়ে এলাম কেন?’ বনবিহারী বললেন।

‘দেখুন, আপনি যা ভালো মনে করেন!’ রতন বলল।

‘তুমি চিন্তা করো না, যদি প্রশ্ন ওঠে আমি তার জবাব দেব।’

সন্তানকে কোলে জোর করে শুইয়ে দুধ খাওয়াচ্ছিল মামণি, মালতী এসে দাঁড়াল কেবিনের দরজায়, ‘ওমা! কি সুন্দর! তোমার ছেলে বুঝি?

সন্তান ঘাড় ঘুরিয়ে মালতীকে দেখার চেষ্টা করল। মালতী তার দিকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি নাম তোমার?’

প্যাসেজ দিয়ে ছোটু যাচ্ছিল, বলে গেল, ‘সন্তান। একদম নতুন নাম।’

মালতী ডাকল, ‘সনতান?’

সন্তান ফিক করে হাসল। তা দেখে মামণি মুখ বেঁকাল, ‘হুঃ।’

মালতী বলল, ‘আমাকে দাও, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

মামণি জানে সেটা সম্ভব হবে না। এ ছেলে বনবিহারীর হাতেও খেতে চায় না। মালতীকে জব্দ করতে সন্তানকে ওর হাতে তুলে দিয়ে নীচে নেমে দাঁড়াল। মালতী খাটে বসল সন্তানকে কোলে নিয়ে। বাটি থেকে চামচে করে দুধ তুলে দিল ওর মুখে। অবাক হয়ে গেল মামণি। দিব্যি খেয়ে নিল শয়তানটা। একটুও চেঁচাল না। দ্রুত লঞ্চের ছাদে উঠে গেল মামণি।

লঞ্চ থেকে নেমে ভ্যান রিকশায় উঠে বনবিহারীর মনে হল, বেঁচে থাকা মানে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। তিনি দেখলেন রামগঙ্গার চেয়ে পাথরপ্রতিমা অনেক বেশি জমজমাট জায়গা। আজীবন যে গঞ্জে তিনি থেকেছেন সেখানে এমন বাহনে চড়লে রাস্তায় লোক অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাত। এখানে কেউ আমলই দিচ্ছে না। ভ্যানের মাঝখানে মালতী বসে আছে সন্তানকে কোলে নিয়ে। দুধ খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছে সে। দেখলে মনে হবে মা তার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মামণি বসেছে পা ঝুলিয়ে। বোঝা যাচ্ছে বেশ মজা পাচ্ছে সে।

রতনের কল্যাণে হাসপাতালের টিকিট দ্রুত হয়ে গেল। তারপর সে এসে বনবিহারীকে ডেকে নিয়ে গেল সার্জেনডাক্তারের কাছে। ডাক্তারের বয়স চল্লিশের নীচে। হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘আমি আপনার কথা শুনেছি। আপনাদের এনজিও খুব ভালো কাজ করছে। তবে লক্ষ করেছি বেশিরভাগ ডাক্তারবাবু এখানে বেশিদিন থাকেন না। বলুন, কি করতে পারি?’

বনবিহারী মালতীর সমস্যাটা জানালেন। ডাক্তার বললেন, ‘দেখুন, আগে এরকম কেস এলে আমরা ডায়মন্ডহারবারে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু গতবছর থেকে আমরাই এখানে অপারেশন করছি। তবে আমি এক্সরেটা ডায়মন্ডহারবার থেকে করানো পছন্দ করি। এটা সরকারি হাসপাতাল হলেও এরকম অপারেশনে যে খরচটা হয় তা পেশেন্ট পার্টি কি দিতে পারবে?’

‘বোধহয় না।’ বনবিহারী মাথা নাড়লেন।

‘তাহলে?’

‘যে গ্রাম থেকে ওকে আমি নিয়ে এসেছি সেখানে মানুষ দু-বেলা ভালোভাবে খেতে পায় না। তাছাড়া মেয়েটির স্বামী নেই। গ্রামের একজন সঙ্গে এসেছে। ওর পক্ষে টাকা জোগাড় করা অসম্ভব।’

‘তাহলে? আমাদের এখানে কোনও ফান্ড নেই যা থেকে সাহায্য পেতে পারে।’

মুষড়ে পড়লেন বনবিহারী। বললেন, ‘তাহলে তো ওকে ফিরে যেতে বলতে হয়। আর সেটা বলা মানে, বুঝতেই পারছেন ভাই, ওকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। একজন ডাক্তার হিসেবে তো বটেই, একজন মানুষ হিসেবে কি আমি সেটা বলতে পারি?’

‘আপনার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু এদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। মানবিকতার কথা ভেবে আমারা ক’জনকে সাহায্য করতে পারব?’ একটু ভাবলেন ডাক্তার, ‘একটা কাজ করুন না। আপনি আপনার এনজিওকে বলুন না সাহায্য করতে। আমি চেষ্টা করব যতটা কমে কাজটা করা যায়।’

বনবিহারী তাকালেন। এটা তাঁর মাথায় আসেনি। প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে লঞ্চ নিয়ে গিয়ে চিকিৎসাবাবদ কম টাকা খরচ করছে না এনজিও। ওঁদের সঙ্গে তাঁর যেটুকু কথা হয়েছে তাতে এখন মনে হচ্ছে রাজি করাতে পারবেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলে, ‘আনুমানিক কত খরচ হবে মনে হচ্ছে?’

‘অপারেশন এবং তার আগে-পরে মিলে অন্তত হাজার পাঁচেক।’

‘বেশ। আপনি ওকে আজই ভরতি করে নিন।’

‘আপনি আগে কথা বলুন। দেখুন রাজি হচ্ছে কিনা!’

রাজি না হলেও টাকাটার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ বনবিহারী উঠে দাঁড়ালেন। পাশে দাঁড়িয়ে রতন কথাগুলো শুনছিল। বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র সে নীচু হয়ে বনবিহারীকে প্রণাম করল। বনবিহারী অবাক হলেন, ‘একি! কী করছ?’

রতন মাথা নীচু করে বলল, ‘কিছু না।’

হাসপাতালের বারান্দায় মালতী সন্তানকে কোলে নিয়ে বসেছিল। তার একটু দূরে কালীচরণ। বনবিহারী মামণিকে দেখতে পেলেন না। একটু উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি মালতীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওর মা কোথায় গেল?’

মালতী মাথা নীচু করল, ‘জানি না।’

কিন্তু কালীচরণ সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে দেখাল, ‘ওই দিকে!’

হাসপাতালের সামনে মানুষের ভিড় সবসময় থাকে। কালীচরণের হাত যেদিকে নির্দেশ করছিল সেদিকে তাকিয়ে মামণিকে দেখতে পেলেন না বনবিহারী।

রতন বলল, ‘হয়তো নতুন জায়গা ঘুরে দেখছেন।’

বনবিহারী মালতীর দিকে তাকালেন, ‘তোমাকে আজই এখানে ভরতি হতে হবে।’

মালতী মাথা নাড়ল। সে রাজি।

বনবিহারী সন্তানকে ওর কাছ থেকে কোলে তুলে নিতেই সে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। তিনি বেশ জোরে ধমক দিলেন, ‘সন্তান! চুপ!’

হকচকিয়ে থেমে গেল শিশু। বড়-বড় চোখে করে বনবিহারীকে দেখতে লাগল।

কাগজপত্রে সইসাবুদ করে মালতীকে ভরতি করিয়ে দিলেন তিনি। তারপর পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে ওর হাতে দিয়ে বললেন, ‘অপারেশনের আগে যা যা প্রয়োজন হবে তা কালীচরণকে দিয়ে আনিয়ে নেবে। কালীচরণ, তুমি রোজ রাত্রে লঞ্চে গিয়ে ঘুমাবে। সকাল হলে হাসপাতালে চলে আসবে।’

‘কি করে আসব? নৌকার ভাড়া কোথায় পাব?’

‘পেয়ে যাবে।’

‘ডাক্তারবাবু—!’ নীচু গলায় বলল মালতী।

বনবিহারী তাকালেন। মালতী বলল, ‘আপনি এখানকার ডাক্তারকে যদি বলে দেন তাহলে খুব ভালো হয়।’

‘কী বলব? বনবিহারী অবাক হলেন।

‘ডানদিকটার সঙ্গে যেন বামদিকটাও কেটে ফেলে দেয়।’

চমকে উঠলেন বনবিহারী। সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন?’

‘আমার মতো মেয়েমানুষের জীবনে এদুটো যন্ত্রণা ছাড়া কিছু না। একটা পোকায় ধরেছে বলে বাদ যাবে। আর একটা রেখে দিলে যন্ত্রণাটা থেকে যাবে।’ মালতী বলল।

‘যিনি অপারেশন করবেন তিনি যা ভালো বোঝেন তাই করবেন।’ বেডের পাশ থেকে বেরিয়ে এলেন বনবিহারী সন্তানকে কোলে নিয়ে। ছেলেটা সেই যে চুপ করেছে আর মুখ খোলেনি। বাইরে এসে কোথাও দেখতে পেলেন না তিনি মামণিকে। শেষে রতনকে বললেন, ‘তুমি ওদিকটায় দ্যাখ, আমি এদিকে খুঁজছি।’

মিনিট পাঁচেক পরে বনবিহারী দেখলেন রতনের সঙ্গে মামণি ফিরে আসছে হাসিমুখে। একটু রেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’

মামণি হাত নেড়ে পেছনের দিকটা দেখিয়ে গোঙাল, তারপর হাসল।

রতন বলল, ‘পুরোনো, চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল দিদিমণির।’

‘কে? এই পাথরপ্রতিমায় ওর চেনা লোক কি করে থাকবে?’

প্রশ্নটা শুনে হাসল মামণি। তারপর মাথা দোলাল। ভাবখানা এমন যে বনবিহারী জানেন না এমন অনেকের সঙ্গে তার পরিচয় আছে।

লোকটা কোথায়?’

বনবিহারর জিজ্ঞাসা করলেন।

রতন বলল, ‘আমাকে দেখে ওই দিকে চলে গেল। ওকে অমি এর আগে কখনও দেখিনি। পাথরপ্রতিমায় বোধহয় নতুন এসেছে।’

বনবিহারী আর কথা বাড়ালেন না। রতনকে একটা ভ্যানরিকশা ডাকতে বললেন। এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গেছে। ভ্যানরিকশায় উঠে খেয়াল হল মামণি সন্তানকে নিজের কাছে নেয়নি। পা ঝুলিয়ে পেছনে সরে যাওয়া ভিড় দেখছে। একটু বিরক্ত হয়ে তিনি সন্তানকে ওর কোলে তুলে দিলেন।

মৃদঙ্গভাঙা নদী বেশ চওড়া। ঢেউগুলো যেন ছোবল মারছে। বর্ষার সময় যখন ঝড়বৃষ্টি হয় এই নদীতে লঞ্চ চালানো বন্ধ থাকে। বনবিহারী নীচের ঘরের চেয়ারে বসে জানলা দিয়ে নদীর জল দেখছিলেন। দেখতে দেখতে তাঁর মাথায় মালতীর সমস্যা চলে এল। যদি তাঁর এনজিওর পরিচালকরা দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে, যদি বলে তাদের কাজ প্রাথমিক চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ, অপারেশন সাহায্য করতে হলে এত পেশেন্ট দাবি জানাবে যা তাদের পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়, তাহলে তিনি কি করবেন? হাসপাতালের ডাক্তারকে যখন কথা দিয়ে এসেছেন তখন টাকাটা দেওয়ার দায়িত্ব অবশ্যই তাঁর। গঞ্জ হলে সমস্যা হত না। রামগঙ্গায় ব্যাঙ্ক নেই। সঙ্গে যে টাকা এনেছেন তা সামলে রাখতে হয়। মাইনে হাতে না পাওয়া পর্যন্ত ওই টাকায় চালাতে হবে। তিনি ঠিক করলেন কাল সকালে পাথরপ্রতিমা থেকে কলকাতায় ফোন করবেন। যদি ওরা টাকা দিতে না চায় তাহলে তাঁকে পাঁচহাজার অগ্রিম দিক। মাসে-মাসে মাইনে থেকে কেটে নিলে কোনও অসুবিধে হবে না।

হঠাৎ সন্তানের কথা মনে আসতেই তিনি চারপাশে তাকালেন। উঠে গিয়ে কেবিন দুটো দেখলেন, সেখানে ওরা নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছাদে গিয়ে দৃশ্যটি দেখতে পেলেন। রেলিং-এর ধারে সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে জল দেখছে মামণি। আর হিরো তাকে দু-হাত নেড়ে বলছে ওখান থেকে সরে যেতে। তাঁকে দেখতে পেয়ে হিরো বলল, ‘ওনাকে সরে আসতে বলুন ডাক্তারবাবু। বড় ঢেউ এত জোরে ধাক্কা মারে যে উনি সামলাতে পারবেন না। এখানে জলে পড়লে বাঁচানো যাবে না।’

হিরোকে কথা বলতে দেখে মুখ ফিরিয়ে তাকাল মামণি। তারপর গম্ভীর মুখে সন্তানকে কোলে নিয়ে বনবিহারীর পাশ দিয়ে নীচে নেমে গেল। স্বস্তি পেয়ে হিরো চলে গেল সারেঙ-এর ঘরে। কি হয়েছে মামণির? লোকটা কে? হঠাৎ মনে হল যে দলে মামণি ছিল এই লোকটা কি সেই দলের পরিচিত? উত্তর বাংলা থেকে পুলিশের নজর এড়াতে পালিয়ে এসেছে? সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলেন তিনি। মামণিকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে এখানে নিয়ে এসেছিলেন তিনি কিন্তু ওর দলের ফেউদের কথা ভাবেননি। হঠাৎ উলটোদিকের পাড়ের কাছে চিৎকার শুরু হতে বনবিহারী অবাক হয়ে দেখলেন বিদ্যুৎ-এর মতো একটা কিছু লাফিয়ে নেমে আসছে নৌকোর ওপর। আর্তনাদ শোনা গেল। ছুটে এল হিরো। চেঁচিয়ে উঠল, সে, ‘বাঘ, বাঘ!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *