দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ১৯

উনিশ

ছোটু এসে বলল, ‘তেঁতুলতলার ঘাট এসে গেছে। আপনি ওপরে যাবেন?’

বনবিহারী মাথা নেড়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে দাঁড়াতেই দেখলেন লঞ্চ পাড়ের দিকে এগোচ্ছে। এদিকের জঙ্গল বেশ পাতলা। পেছনে বাঁধের মতো উঁচু জমি। বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে না কিন্তু বাঁধের এপাশে জনা পঁচিশেক মানুষ তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাশে দাঁড়িয়ে ছোটু বলল, ‘উঃ, আজ দেখছি পেশেন্টের সংখ্যা বেড়ে গেছে।’

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওরা, সবাই পেশেন্ট?’

‘হ্যাঁ। নইলে আধ-মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে নদীর ধারে কেউ আসবে না।’

লঞ্চ পাড়ের কাছাকাছি গিয়ে থেমে গেল। এদিকে জল কম, কাদা বেশি। পাড় এবং লঞ্চের মধ্যে অন্তত দশ হাতের ব্যাবধান। বনবিহারী দেখলেন গৌরাঙ্গ আর হিরো লঞ্চের ওপর থেকে লম্বা কাঠের পাটাতন নামিয়ে সেতু তৈরি করার চেষ্টা করল। কিন্তু দেখা গেল তখনও হাতখানেক জায়গা ভরাট হচ্ছে না। ওদের চেঁচামেচিতে পাড় থেকে দুটো লোক জলে নেমে পাটাতন শক্ত করে ধরল।

ছোটু বলল, ‘আস্তে আস্তে ওটার ওপর দিয়ে হেঁটে নেমে যান ডাক্তারবাবু। কোনও ভয় নেই। শেষটায় একটু লাফিয়ে নামতে হবে। দু-ধারে কোনও রেলিং নেই, তিন ফুট চওড়া পাটাতনটার ওপর হাঁটা মানে সার্কাসের তারে হাঁটার মতো বলে মনে হল বনবিহারীর। তাঁকে ভরসা দিতে হিরো একটা চেয়ার কাঁধে তুলে স্বচ্ছন্দে হেঁটে শেষ অবধি চলে গিয়ে পাড়ের একজনের হাতে চেয়ারটা ধরিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল।

অগত্যা পা বাড়ালেন বনবিহারী। জলের দিকে না তাকিয়ে গুটিগুটি চলে এলেন শেষ পর্যন্ত। এক হাত লাফাতে কোনও অসুবিধে হল না। মুখ ফিরিয়ে লঞ্চের দিকে তাকালেন। সারেঙ রতন দাঁত বের করে হাসছে। মামণিকে দেখতে পেলেন না তিনি। নিশ্চয়ই ছেলের পশে শুয়ে পড়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে।

চেয়ারে বসলেন বনবিহারী। তাঁর বাঁ-দিকে সোনা। সোনার হাতে খাতা। ডানদিকে ওষুধের বড় বাক্স নিয়ে ছোটু দাঁড়িয়ে গেল।

লোকগুলো প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিল। সোনা চেঁচাল, ‘আপনারা সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়ান : লাইন দিয়ে। না-হলে নতুন ডাক্তারবাবু আপনাদের কাউকে দেখবেন না।’

ধীরে-ধীরে মানুষগুলো লাইনে দাঁড়ালে দেখা গেল দুজন মানুষ মাটির ওপর হাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে। তারা যে খুব অসুস্থ এবং লাইনে দাঁড়াবার শক্তি নেই বুঝে বনবিহারী প্রথমজনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

‘কি হয়েছে আপনার?’ জিজ্ঞাসা করতেই বুঝলেন মানুষটির নিত্যদিন আহার জোটে না। হাড়জিরজিরে শরীরে কোনও প্রতিরোধক্ষমতা নেই। মুখ তুলল লোকটা। ফ্যাকাশে চোখ, শুকনো ঠোঁট। চিঁচি করে বলল, ‘পেটে ব্যথা, খুব ব্যথা।’

পেটে আঙুল চেপে পরীক্ষা করতে হলে লোকটাকে মাটির ওপর শোয়াতে হয়। কাজটা সোনাই করে দিল। জীবনে অনেক রুগি দেখেছেন বনবিহারী কিন্তু এভাবে কাউকে দ্যাখেননি। পরীক্ষা করে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না বনবিহারী। এখনই আলট্যাসোনোগ্রাফ করা দরকার। তিনি ছোটুকে বললেন, ‘ওকে হাসপাতালে ভরতি করতে হবে। আমাদের লঞ্চে নিয়ে যাওয়া যাবে?’

ছোটু বলল, ‘অনেক দিনের পেশেন্ট। আগের ডাক্তারবাবুও দেখেছেন। না খেয়ে না খেয়ে পেটের ভেতর ঘা হয়ে গেছে। হাসপাতালে ভরতি করালে ওর ওষুধ কিনে দেবে কে? দেখাশোনা করার জন্যেও কেউ যাবে না।’

ভেবেচিন্তে ওষুধ দিলেন যাতে ব্যথা কমে, পেটের ভেতরের ঘায়ে প্রলেপ পড়ে। তারপর পকেট থেকে কুড়িটা টাকা বের করে লোকটির হাতে দিয়ে বললেন, ‘কদিন চিড়ে ভালো করে ভিজিয়ে জলে চিনি দিয়ে চারবার খাবে।’

দ্বিতীয় লোকটির সর্বাঙ্গ কাঁপছে। অসুখটা বুঝতে পেরে হতাশ হয়ে নার্ভের ওষুধ দিতে বললেন ছোটুকে।

শেষ পেশেন্টকে দেখে উঠতে দুপুর গড়িয়ে শেষ। বেশির ভাগের ক্ষেত্রে অসুখ আন্দাজে ঠিক করতে হচ্ছে। রক্ত বা পায়খানা পরীক্ষা অথবা এক্সরে করাবার কথা এরা চিন্তাও করতে পারে না। এখান থেকে নদী বেয়ে অতদূরে যাওয়ার ক্ষমতাও কারও নেই। আর ওই পরীক্ষা ছাড়া সঠিক রোগ নির্দ্ধারণ করা অসম্ভব।

উঠে দাঁড়াতেই একটি মেয়েমানুষ এগিয়ে এল। বোধহয় কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছিল সে। এর চেহারা দেখলে বোঝা যায় দু-বেলা ভালো খেতে পায়। রঙিন শাড়িও ময়লাটে নয়। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে?’

মুখ নামিয়ে মেয়েমানুষটি বলল, ‘আমার বাঁ-দিকের বুকের ভেতর কিছু হয়েছে। টিপলেই শক্ত মতো কিছু আঙুলে ঠেকছে।’

‘কতদিন হয়েছে।’

‘দু-মাস।’

‘কতখানি জায়গা?’

‘এক সিকি।’

‘তুমি হাসপাতালে যাও। ওখানে মেয়ে ডাক্তার আছেন। না দেখে তো কোনও চিকিৎসা করা যাবে না।’ বনবিহারী বললেন।

‘আপনি ওষুধ দিন।’

‘আমি কি করে দেব?’

‘কেন? আপনি তো ডাক্তার।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু তোমার যেখানে হয়েছে তা তুমি আমাকে দেখাবে কি করে?’

‘ওদের সরে যেতে বলুন। আমি দেখাচ্ছি।’

ছোটু বলল, ‘ডাক্তারবাবু দিদিকে বলুন দেখতে।’

দিদি! ফাঁপরে পড়লেন বনবিহারী। মামণি কি বুঝবে? তাছাড়া ব্যাপারটা ওকে বোঝাতেই হিমশিম খেতে হবে। বোঝার পরেও ওটা টিউমার কিনা তা কোনও সাধারণ জ্ঞানের মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

শেষ পর্যন্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বললেন, ‘তোমরা ওকে লঞ্চে নিয়ে এসো।’ তারপর সহকর্মীদের সাহায্যে চলে এলেন লঞ্চের ভেতরে।

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে বাঁ-দিকের কেবিনে উঁকি মারলেন বনবিহারী। মা আর ছেলে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ডাকতে গিয়েও ডাকলেন না তিনি।

সোনা এসে দাঁড়াল। হেসে বললে, ‘দিদিকে ভাত খাইয়ে দিয়েছি।’

‘আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করেনি?’ বনবিহারী তাকালেন।

‘করেছিল। আপনি পেশেন্ট দেখছেন শুনে গা করল না। খাওয়া শেষ করে আবার শুয়ে পড়ল। অনেক বেলা হয়ে গেছে। আপনার ভাত দিয়ে দিই।’ সোনা বলল।

খেয়াল হল বনবিহারীর। এখন প্রায় চারটে বাজে। তিনি একা নন, ছোটু হিরো তো না খেয়ে আছে। নাঃ, এভাবে চলবে না। এখন থেকে বেলা বারোটার মধ্যে প্রথম লটের পেশেন্ট দেখে লাঞ্চব্রেক দিয়ে আবার দেড়টা থেকে পরের ঘাটে যেতে হবে।

ছোটু নেমে এল, ‘মেয়েছেলেটা এসেছে।’

সোনা খেপে গেল, ‘বসতে বল। ডাক্তারবাবু আগে ভাত খেয়ে নিক?’

মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘তোমরা খেয়ে নাও। ডাকো ওকে।’

মেয়েমানুষটি এগিয়ে এল।

বনবিহারী তাকে মামণি আর বাচ্চা যে কেবিনে শুয়ে আছে সেখানে ঢুকতে বললেন, ‘ওখানে গিয়ে দাঁড়াও। শব্দ করো না, ঘুম ভেঙে গেলে বাচ্চাটা কাঁদবে।’ কেবিনে উঁকি মেরে এসে মেয়েছেলেটি বলল, ‘ভেতরে তো ভালো করে দাঁড়াবার জায়গা নেই। আর কোনও ঘর নেই?’

‘আমার কোনও অসুবিধে হবে না।

তুমি ভেতরে গিয়ে জামার বোতাম খোলো। হিরো, গ্লাভস আছে?’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

হিরো বলল, ‘আছে।’

দ্রুত গ্লাভস এনে দিল সে। হাতে গলিয়ে কেবিনের দারজায় গিয়ে দাঁড়ালেন বনবিহারী। মেয়েমানুষটি তখন খাটে ঠেস দিয়ে জামার বোতাম খুলে শাড়ি সরাল। হতদরিদ্র এই বনভূমির মানুষগুলো যেখানে খাদ্যাভাবে শুকিয়ে গেছে সেখানে এমন উদ্ধত নিটোল স্তন কি করে মেয়েটি বহন করছে ভাবতে পারলেন না বনবিহারী।

‘কোন বুকে?’

আঙুলে বাঁ-বুক দেখানের সময় মেয়েমানুষটির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল।

যেন পেশেন্টের হাত-পা অথবা মাথা পরীক্ষা করছেন এমন ভঙ্গিতে বনবিহারী স্তন পরীক্ষা করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন ‘ব্যথা লাগছে?’

মেয়েমানুষটি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বলল।

ততক্ষণে বুঝে ফেলেছেন বনবিহারী, ‘জামা ঠিক করে নাও। বলে হাত থেকে গ্লাভস খুলে হিরোর হাতে দিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলেন।

অভিজ্ঞতা বলছে এক্ষুনি অপারেশন করা দরকার। টিউমার তো বটেই এবং সেটা বেশ বড়সড়ো। এক্সরে করলেই স্পষ্ট হবে। সেই টিউমারের চেহারা দেখলে তিনি আন্দাজ করতে পারবেন ওটা ম্যালিগন্যান্ট কিনা। বায়াপসি রিপোর্টের সঙ্গে তাঁর মতামতের খুব বেশি ফারাক হবে না।

ইতিমধ্যে সোনা তাঁর সামনে ভাতের থালা, ডাল, তরকারি আর মাছের ঝোল বাটিতে সাজিয়ে দিয়ে দিয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে বনবিহারী শরীরে অস্বস্তি এল। এই অবেলায় এতসব খেতে পারবেন না তিনি।

ছোটু এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তারবাবু, ওকে কী বলব?’

বনবিহারী মুখ তুলে দেখলেন মেয়েমানুষটি ঊর্ধ্বাঙ্গে আঁচল জড়িয়ে কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু ভাবলেন তিনি। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি নাম?’

‘মালতী।’

‘স্বামী কোথায়?’

‘বাঘ খেয়ে ফেলেছে।’

হোঁচট খেলেন যেন বনবিহারী। তারপর জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাড়িতে কে আছে?’

‘একজনের সঙ্গে থাকি। সেটা না থাকার মতন।’

‘কেন?’

‘ওই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, জিজ্ঞাসা করুন।’

সোনা বলল, ‘ডাক্তারবাবু খেয়ে নিন।’

‘আমি এত খেতে পারব না এখন। এই, তুমি কখন খেয়েছ?’

‘সেই সকালে। দু-মুঠো পান্তা।’

‘সোনা, ওকে অর্ধেক তুলে দাও। তোমরাও খেয়ে নাও।’ বনবিহারী বললেন।

ওঁর খাওয়া শেষ হওয়ার অনেক আগেই মালতীর খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। জল খেয়ে সোনাকে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা মুখ ধোও কোথায়?’

সোনা বাথরুম দেখিয়ে দিতে সে চলে গেল। সোনা নীচু গলায় বলল, ‘মেয়েমানুষটাকে খাবার না দেওয়াই ঠিক ছিল।’

সোনা, ও যদি এখানে পড়ে থাকে তাহলে আর মাসখানেকও বাঁচবে না।’

বনবিহারীর কথা শোনামাত্র সোনার মুখের চেহারা বদলে গেল, ‘ও ব্বাবা!’

হাত-মুখ ধুয়ে বনবিহারী ওপরে উঠে আসতেই সারেঙ রতন বলল, ‘আজ আর অন্য ঘাটে যাওয়া যাবে না ডাক্তারবাবু, রোদ সরে আসছে।’

বনবিহারী বললেন, ‘প্রথম দিন তো, একটু ভুলভ্রান্তি হয়ে গেছে। কাল থেকে আর হবে না।’

‘জোয়ার আসছে। আধঘণ্টার মধ্যে এখান থেকে সরতে হবে।’ রতন জানাল।

বনবিহারী পাড়ের দিকে তাকালেন। অসুস্থ মানুষগুলো বাড়ি ফিরে গেছে কিন্তু একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। জোয়ারের কারণে জল বেড়ে যাওয়ায় লঞ্চ এখন পাড়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। পাটাতনটা পাড়ের মাটি ছুঁয়েছে।

বনবিহারী লোকটাকে হাত নেড়ে কাছে ডাকতেই সে লেংচে লেংচে এগিয়ে এল। তাকে দেখেই প্রশ্নটা ছিটকে বের হল মুখ থেকে, ‘কি হয়েছিল তোমার?’

‘আজ্ঞে, বাঘের আদর খেয়েছিলাম যে!’

লোকটির বাঁ-দিকের মুখে কোনও মাংস নেই। চওড়া হাড়ের ওপর সেঁটে আছে। বোঝাই যায় অপারেশন হয়েছিল। বাঁ-দিকের কাঁধ-বুকেও অপারেশন করা হয়েছে। ফলে তার শরীরটা আর স্বাভাবিক নয়। এখন হাফপ্যান্ট পরে থাকায় হাঁটুর ওপরেও অপারেশনের দাগ দেখা যাচ্ছে।

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলে, ‘এসব কি করে হল?’

‘কপালে লেখা ছিল, হয়ে গেছে।’

রতন জোরে ধমক দিল, ‘অ্যাই ডাক্তারবাবুকে ঠিকঠাক বল।’

‘মধুর জন্যে গিয়েছিলাম। দলে ছিলাম পাঁচজন। আমার যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু বট বলল, কালী তুইও চল, রাজি হয়ে গেলাম। বট কে জানেন?’

রতন চেঁচাল, ‘ডাক্তারবাবু জানবে কি করে?’

‘ওই মালতীর বর। তা নৌকো খাড়িতে ঢোকার পর আমরা নামলাম। মাথার পেছনে মানুষের মুখ আঁকা মুখোশ পরে নিলাম। তারপর জলকাদায় হাঁটছি। বট মাসখানেক আগে যে গাছে চাক বাঁধতে দেখে এসেছে সেদিকে যেতে ভুল হচ্ছিল না। হঠাৎ দেখি সামনে তিনি। কি বলব ডাক্তারবাবু, মোষের চেয়ে বড় শরীর আমাকে লক্ষ করে লাফ দিচ্ছে বুঝে সঙ্গে সঙ্গে জলকাদায় শুয়ে পড়লাম। বাঘটা আমার ওপর দিয়ে গিয়ে পড়ল বটর ওপর। দাঁড়িয়ে থাকলে এখন—! যাক গে, বটর টুঁটি দাঁতে চেপে ও যখন লাফাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে তখন বাকি তিনজন পগার পার। বটটা মরে যাচ্ছে দেখে প্রাণের মায়া ভুলে লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বাঘের ওপর। বাঘটা বটকে ছেড়ে মারল আমার মাথায়, কাঁধে এক থাপ্পড়। ওইটুকুতেই আমাকে হাসপাতালে শুয়ে থাকতে হয়েছিল নয় মাস।’ লোকটা থুথু ফেলল সশব্দে, তারপর বলল, ‘আমি তো চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম কাদায়। বাঘটা ঘুরে এসে আমার পায়ে দাঁত বসাতে বুঝলাম আয়ু শেষ। এখনই মরে যাব। ব্যথার কষ্ট ভুলে গিয়ে চোখের সামনে বাঘের অণ্ডকোষ দেখতে পেয়ে ডান হাতে যতটা জোরে সম্ভব সেটা চেপে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাঘ পা থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে যেন আর্তনাদ করে উঠল। আমি কিছুতেই অণ্ডকোষ ছাড়ছিলাম না। কিন্তু প্রাণভয়ে মরিয়া হয়ে সে লাফ দিতেই আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।’ লোকটি হাসল।

‘তারপর?’ রতন জিজ্ঞাসা করল।

‘ওই তিনজন একটু পরে ভয়ে ভয়ে ফিরে এসে দ্যাখে আমি পড়ে আছি কিন্তু বট নেই। আমাকে নৌকোয় তুলে কিছুদূর আসতেই একটা লঞ্চের দেখা পেয়ে ওরা তুলে দিয়েছিল। সেই লঞ্চ আমাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়।’

‘ওই বাঘ ফিরে এসে তোমাকে না তুলে বটকে কেন নিল।’

‘ওই বাঘ ফিরে আসেনি ভাই। অণ্ডকোষ ফেটে যাওয়ায় মরে গিয়েছিল ওটা। ফরেস্ট ডিপার্টের লোক ওর শরীর নিয়ে আসে ওখান থেকে। বটকে নিয়েছে অন্য কোনও বাঘ। এখন ভাবি, আমাকে নিলেই পারত। এই ভাবে বেঁচে মরে থাকার চেয়ে তখন বাঘের পেটে গেলে ভালো হত।’

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বটর বউ মালতীকে তুমি বিয়ে করেছ?’

বটর লাশ দ্যাখেনি বলে মালতী বিধবা হতে চাইল না। সধবা হয়েই থাকল। একা থাকলে পাঁচ পুরুষ বিরক্ত করবে বলে জোর করল ওর বাড়িতে থাকতে হবে। বন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি। তাই বন্ধুর বউকে বাঁচাতে থেকে গেলাম। আমার নিজের তো সংসার ছিল না। গাঁয়ের সবাই জানে আমার শরীরে কিছু নেই। হাসপাতালে সব রেখে এসেছি। তাই কেউ কিছু বলে না।’ অদ্ভুত গলায় বলল লোকটা।

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কালী?’

‘আজ্ঞে কালীচরণ।’

‘শোনো, মালতী তোমার বউ হোক বা না হোক, তার সঙ্গে তুমি থাকো। ধরে নিচ্ছি ভাইবোনের মতো থাকো। মালতীর খুব বিপদ। তার বুকে টিউমার হয়েছে। এক্ষুনি অপারেশন করা দরকার। তুমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাও।’ বনবিহারী বোঝাবার ভঙ্গিতে বললেন।

‘ডাক্তারবাবু, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অজ্ঞান অবস্থায়। বাঘ আক্রমণ করেছে বলে হাসপাতালে আমার অপারেশন, চিকিৎসা হয়েছিল বিনা পয়সায়। কিন্তু মালতীকে তো বাঘ কিছু করেনি। ওর চিকিৎসার জন্যে তো পয়সা লাগবে। আমার তো কোনও সঞ্চয় নেই, শরীরে বলও নেই যে রোজগার করব। আমি কি করে ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাব?’ কালীচরণ বলল।

বনবিহারী রতনের দিকে তাকালেন। রতন বলল, ‘এরকম সমস্যা এখানকার ঘরে, ঘরে। এই যে আমরা ওষুধ দিচ্ছি এটা ওদের কাছে বিশাল ব্যাপার। ক’জনের দুঃখ দূর করা যায় বলুন।’

কথাটা ঠিকই। কিন্তু বনবিহারীর চোখের সামনে উদ্ধত স্তন ভেসে উঠল। ঈশ্বর নিজের হাতে যা গড়েন তা নিজেই নষ্ট করে দেন বারে বার। মালতীকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে মৃত্যু ওর শরীরে বাসা বেঁধেছে। এই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা যায়। হয় তো ভাগ্য ভালো হলে তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়াও সম্ভব। বনবিহারী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। রতনকে বললেন, ‘ওকে তুলে নাও।’

‘নিয়ে যেতে চান?’

‘হ্যাঁ। পাথরপ্রতিমার ব্লক হাসপাতালে অপারেশন হয়?

‘না বোধহয়। কাকদ্বীপের সরকারি হাসপাতলে হয় বলে শুনেছি।’

‘তাই যাবে। ওকে আসতে বলো।’

রতন ডাকতেই পাটাতনের ওপর দিয়ে লেংচে লেংচে উঠে এল কালীচরণ। পাটাতন সরিয়ে নিল গৌরাঙ্গ। রতন লঞ্চ নদীর ভেতর নিয়ে যেতে লাগল।

বুঝতে পেরে কালীচরণ চেঁচিয়ে উঠল, ‘একি! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

গৌরাঙ্গ গম্ভীর গলায় বলল, ‘চুপ! ডাক্তারবাবুকে প্রণাম কর। অনেক ভাগ্য করে এসেছিস বলে এই লঞ্চে যেতে পারছিস।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *