দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ১৭

সতেরো

ব্রজ মণ্ডল ভাড়া দিয়েছে তার বাড়ির দোতলা। সেখানে শোওয়ার ঘর, একটা তক্তাপোশ আর তোশক রয়েছে। পেছনের বারান্দা ঘিরে রাখা হয়েছে রান্নার ব্যবস্থা করতে। স্নান বা টয়লেটের বন্দোবস্ত নীচে।

দোতলায় উঠে এলেন বনবিহারী। ঘরে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। তক্তাপোশের ওপর নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে মা ও ছেলে। একটা চাদর পাতা হয়েছে তক্তাপোশের ওপর। খুব হাওয়া ঢুকছে ওপাশের জানলা দিয়ে। বনবিহারী চিন্তায় পড়লেন। রাতের খাবারের কি ব্যবস্থা করা যায়! তালে-গোলে রান্নার কোনও জিনিস কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হয়নি। কাল সকালে এখান থেকে কিনে নিতে হবে। কেরাসিন তেল পাওয়া গেলে আপাতত স্টোভেই চলে যাবে। কিন্তু মামণি ওই রান্না ঠিকঠাক পারবে তো? কালীচরণ উনুন ধরিয়ে সবকিছু হাতের সামনে সাজিয়ে দিলে এক-আধটা পদ রেঁধে ফেলা যায় কিন্তু দু-বেলা নিয়ম করে রান্নাবান্না ওর দ্বারা কি সম্ভব হবে? বাচ্চাটাও একটু একটু করে বাড়ছে। মায়ের দুধ ছাড়াও গরুর দুধের স্বাদ ওকে পাইয়ে দিয়েছিল কালীচরণ। সেটারও ব্যবস্থা করতে হবে।

বনবিহারী ঠিক করলেন আজ কেনা খাবার খাবেন। লঞ্চ ঘাটের কাছে কয়েকটা দোকান দেখেছিলেন। কিছু না পান মিষ্টি আর দুধ কিনে আনলেই হবে।

‘ডাক্তারবাবু আছেন নাকি?’

নীচ থেকে গলা ভেসে এল। বনবিহারী ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মুখে দাঁড়ালেন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে টিমটিমে কিছু আলো। নীচে নামতেই সেই আলোয় ব্রজ মণ্ডলকে দেখতে পেলেন।

ব্রজ মণ্ডল বলল, ‘আজ্ঞে বলছিলাম কি, গিন্নি জিজ্ঞাসা করছেন মাছের ঝোল আর ভাত হলেই চলবে না সঙ্গে ডালতরকারি লাগবে?’

দ্রুত মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘একি! আপনারা কেন ব্যস্ত হচ্ছেন! আজকের রাতটা মিষ্টি খেয়ে চালিয়ে নেব। কাল সকালে জিনিষপত্র কিনে নিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করব।’

‘তা তো ভালোই। কিন্তু আমার বাড়িতে এসে প্রথম রাতে শুধু মিষ্টি খেয়ে থাকবেন, তা কি হয়? তাছাড়া পরেশ মণ্ডল বলে গেছে আপনি যতদিন না গুছিয়ে নিতে পারছেন ততদিন রাত্রে আমার এখান থেকে খাবার যাবে। দিনের বেলায় লঞ্চে রান্না হবে। আপনি কোনও সঙ্কোচ করবেন না।’ ব্রজ মণ্ডল বলল।

‘সঙ্কোচ তো হবেই ব্রজবাবু। আত্মীয়তা দূরের কথা, চেনাজানাও নেই, ভাড়াটে হয়ে আপনার বাড়িতে এসেছি, খামোকা খরচ বাড়াব কেন?’ বনবিহারী বললেন।

এইসময় ব্রজ মণ্ডলের স্ত্রী, পুঁটির মায়ের গলা ভেসে এল, ‘বাইরে দাঁড়িয়ে এসব কথা না বলে ঘরের ভেতর বসে বললেই তো হয়।’

‘ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসুন, ভেতরে আসুন।’ ব্রজ মণ্ডল ঘরে ঢুকল।

‘ওপরে ওরা ঘুমাচ্ছে, দরজা খোলা।’

‘নিশ্চিন্তে থাকুন। রামগঙ্গায় চুরি করে কেউ পালাতে পারেনি আজ পর্যন্ত। কালজিরে নদীতে ডুবে মরতে হয় তাকে। আর আপনার ওখানে দামি কিছু থাকলেও চোর তার সন্ধান নিশ্চয়ই পায়নি। আসুন।’

অতএব ঘরের ভেতরে এলেন বনবিহারী। তক্তাপোশে বসিয়ে ব্রজ মণ্ডল বলল, ‘এই সেদিনও এসব জায়গা ছিল পাণ্ডববর্জিত। ওই ঘাট পার হতে লোকে এখানে পা দেয়। ইলেকট্রিকের জন্যে কত জনদরখাস্ত দেওয়া হল, কোনও কাজ হয়নি। আপনার আগে কোনও ডাক্তার তার ফ্যামিলি নিয়ে এখানে আসেনি। মাস ফুরাবার আগেই তারা পালিয়ে গেছে। অথচ অসুখ-বিসুখ তো লেগেই আছে। তাই পরেশ মণ্ডল যখন বলল আপনি ফ্যামিলি নিয়ে আসছেন তখন বিশ্বাস করতে পারিনি।’

‘কেন?’

‘কেন আসবেন এখানে?’ ছেলেছোকরা ডাক্তার হলে আসার কারণ থাকে। শহরে রুগি পায় না, পসার নেই, এসব জায়গায় এসে হাত পাকাতে চায়। কিন্তু আপনার তো বয়স হয়েছে। পরেশ মণ্ডল বলল আপনি ডাক্তার হিসেবেও ভালো। তাই আসার কারণটা বোধগম্য হয়নি।’ ব্রজ মণ্ডল হাসল।

‘কোনও রহস্য নেই। সারা জীবন পয়সা নিয়ে ডাক্তারি করেছি। এই এন জিও-র বিজ্ঞাপন দেখে মনে হল গরিব মানুষের উপকার করি। বিনা পয়সায় চিকিৎসা শুরু করলে বেঁচে থাকব কি করে? তা এঁরা একটা মাসোয়ারা দেবেন আর আমি মনের সুখে রুগি দেখতে পারব, তাই চলে এলাম।’ বনবিহারী হাসলেন। আজকাল মিথ্যে বলতে আগের মতো অসুবিধে হয় না।

‘ভালো করেছেন। কিন্তু পরেশ মণ্ডল বলছিল আপনি লঞ্চে করে দুপাশের জঙ্গলের মধ্যে যে গ্রামগুলো আছে সেখানে গিয়ে রুগি দেখবেন। আপনার কোম্পানি সেইজন্যে আপনাকে এনেছে। রামগঙ্গা বা পাথরপ্রতিমার রুগি দেখবেন না তাই কি?’

‘দেখুন ওঁরা যে জন্যে আমাকে ডেকেছেন সেই কাজটা আগে করতেই হবে। তাই বলে আমার অবসর সময়ে এখানকার কোনও অসুস্থ মানুষ যদি আসে তাহলে আমি মুখ ফিরিয়ে কি নিতে পারি?’

‘বাঃ। ভালো। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।’

পুঁটির মা ঘরে এল, ‘আমি তোমাকে বলেছিলাম, দেখলেই বোঝা যায় ওঁর মন খুব বড়। নইলে কেউ বোবা মেয়েকে আশ্রয় দেয়?’

ব্রজ মণ্ডল মাথা নাড়ল, ‘খুব বেদনার কথা। আপনি যখন বাইরে গিয়েছিলেন তখন পুঁটির মা ওপরে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল অত সুন্দর মেয়েটা নাকি বোবা। পুঁটির মায়ের কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি।’

পুঁটির মা হাসল, ‘না না। দুটো প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। বাচ্চাটাকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ও কি তোমার ছেলে? তাতে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছে। আর জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি রান্নাবান্না জানো তো? সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে না বলেছে।’

‘সেকি!’ ব্রজ মণ্ডল বলল, ‘রান্না না জানলে চলবে কি করে? তুমি ওকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিও।’

‘ও নিয়ে ভেবো না। মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছে যখন তখন ঠিক শিখে যাবে রাঁধতে। ওহো, তখন থেকে কথাই বলে যাচ্ছি, চা খাবেন?’ পুঁটির মা জিজ্ঞাসা করল।

‘না, না। চায়ের নেশা আমার নেই। আচ্ছা—!’

বনবিহারী আর মিষ্টির সন্ধানে না গিয়ে ওপরে উঠে এলেন।

আজ দুপুরের খাওয়া হয়েছিল বেশ দেরিতে। পরেশ মণ্ডলের ইচ্ছে ছিল সবাই লঞ্চে গিয়ে খাবে। কিন্তু বাচ্চাটাকে কাশতে দেখে বনবিহারী আর ওকে বের করতে চাননি। লঞ্চের রান্না খাবার পরেশ বাড়িতে পাঠিয়েছিল। প্রচুর মশলা দেওয়া রান্না। বনবিহারীর খেতে খুব অসুবিধে হয়েছিল কিন্তু মামণি বেশ চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছিল।

দুটো তক্তাপোশ বোধহয় জোগাড় করতে পারেনি পরেশ, একটা পাঠিয়েছে, সঙ্গে তোশক-বালিশ। কাল থেকে রান্না করতে হবে। এর ওর বাড়ি থেকে খাবার এলে তারা ক্রমশ ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাইবে। মামণির সঙ্গে কথা বলবেন তিনি।

বারান্দায় উঠে বাঁ-দিকে তাকাতেই কালজিরে নদীর একাংশ চোখে পড়ল। এই অন্ধকারে জল দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা ডিঙি নৌকো হ্যারিকেন জ্বালিয়ে জলের ওপর দিয়ে চলে যেতে নদীর অস্তিত্ব বোঝা গেল। সুন্দরবনের নদীতে কামট, কুমির গিজগিজ করছে বলে এতকাল শুনেছেন। নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন। মাতলা, বিদ্যেধরীর মতো ভয়ংকর নদী সুন্দরবনে আছে, কালজির বোধহয় তাদের তুলনায় বেশ শান্ত।

ঘরে ঢুকেই দৃশ্যটি দেখলেন। মা এবং ছেলেটর ঘুম ভেঙে গেছে। ছেলের পাশে বসে মামণি অপলক তাকিয়ে আছে। ছেলেও মাকে দেখার চেষ্টা করছে। মাঝে-মাঝে পা ছুড়ছে। তারপর তার গলায় একটু কান্না ফুটতে মা তাকে কোলে তুলে নিল। এবার ছেলে শান্ত। বনবিহারী বললেন, ‘তোমাদের দুজনের দেখছি একটা ব্যাপারে বেশ মিল।’

মামণি চোখ তুলে উৎসুক ভঙ্গিতে তাকাল।

‘কারও তো খিদে পাচ্ছে বলে মনে হয় না।’

মামণি হাসল। তারপর ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা শূন্যে উঁচিয়ে মুখের মধ্যে পুরে বের করে নিল। বনবিহারী বললেন, ‘এটা তোমারই দোষ। নিজের জন্যে না বলতে পারো ছেলের দুধের কথা আমাকে মনে করিয়ে দাওনি কেন?’

মামণি আঙুল তুলে ছোট্ট টুলের ওপর প্লেটে ঢাকা বাটি দেখিয়ে দিল। তার পাশে ফিডিং বোতল রয়েছে।

‘বাঃ। কিন্তু দুধ পেলে কি করে?’

মামণি হাতের ইশারায় নীচের তলা বুঝিয়ে দিল।

বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘ঠিক আছে। আজ প্রথম দিন। ওদের সাহায্য নিতে হচ্ছে। কিন্তু কাল থেকে আর নয়। নিজেদের যা যা দরকার তা সকাল থেকেই গুছিয়ে নিতে হবে।’ তক্তাপোশের এক কোণে এসে বসলেন বনবিহারী, ‘দুটো ডাল-ভাত আর একটু মাছের ঝোল, তুমি রাঁধতে পারবে না?’

image10.jpg

সঙ্গে সঙ্গে মামণি ঠোঁট মোচড়াল। তার গলা দিয়ে একটা অবোধ্য শব্দ বের হল। হাতের ইশারায় সে পেছনের কাউকে ডেকে আনার কথা বলল। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কালীচরণের কথা বলছ?’

সঙ্গে সঙ্গে একগাল হাসল মামণি। হেসে মাথা নাড়ল।

‘কালীচরণ এলে ওখানকার বাড়িঘর কে দেখবে? আমরা কেন এতদূরে চলে এলাম তা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ?’ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে নিজের বুকে হাত রেখে মামণি বোঝাল সে জানে তার জন্যেই বনবিহারীকে চলে আসতে হয়েছে।

‘তুব আমি কালীচরণকে চিঠি লিখব। কয়েকদিনের জন্যে নাহয় এসে ঘুরে যাক সে। কিন্তু তুমি যদি রান্না না করো তাহলে আমাদের লঞ্চের খাবার খেতে হবে রোজ। ওই রান্না আমার বেশিদিন সহ্য হবে না।’ বনবিহারী বললেন।

আবার কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থাকার পর মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মামণি। খুশি হলেন বনবিহারী।

দরজার বাইরে শব্দ হল। পুঁটির মায়ের গলা পাওয়া গেল, ‘খাবার এনেছি।’

বনবিহারী উঠতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই বাচ্চাটাকে তুলে বনবিহারীর কোলে শুইয়ে দিয়ে মামণি ছুটল দরজার দিকে। পুঁটির মায়ের হাত থেকে একটা সসপ্যান আর বড় বাটি নিয়ে ইশারায় ভেতরে আসতে বলল সে। পুঁটির মা বলল, ‘না, এখন আর ভেতরে যাব না। প্লেট তো ধোয়া আছে, কুঁজোর জল আছে তো? না থাকলে ওঁকে বলছি ভরে দিয়ে যেতে।’

মামণি কয়েকবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে বোঝাল। কুঁজোয় জল আছে। পুঁটির মা একগাল হেসে চলে গেল।

এখানে সন্ধের আয়ু বড় কম। ঝুপ করে রাত নেমে যায়। একেই জায়গাটা চুপচাপ, রাত নামলে সে নৈঃশব্দ্য প্রবল হয়ে ওঠে। মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে চিলতে রারান্দায় দাঁড়িয়ে বনবিহারী দেখলেন রামগঙ্গায় দু-তিনটে আলো এখনও টিমটিম করছে। খামোকা রাত না জেগে এখানকার লোকজন রাতের খাওয়া সেরে বিছানায় চলে গেছে. মামণি নীচ থেকে ঘুরে বেরিয়ে আসামাত্র ব্রজ মণ্ডলের গলা শুনলেন, ‘গিন্নির রান্না কেমন?’

‘ভালো, খুব ভালো।’

‘ওরা তো বাঙাল। বাপের দেশ ছিল বরিশালে। যাই বলুন, বাঙালরা ঘটিদের চেয়ে অনেক ভালো রাঁধে।’

সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে পুঁটির মায়ের গলা ভেসে এল, ‘ঝাল লাগেনি তো?’

‘না না। চমৎকার খেলাম।’

‘আমাদেরও খাওয়া শেষ।’ ব্রজ মণ্ডল বলল, ‘এখানে রাত নটাই প্রায় মাঝরাত। কিছু দোকানদার আর তাসুড়ে ছাড়া লোক খুঁজে পাবেন না। কিন্তু আপনাদের একটা সমস্যা যে এখন হবে!’

বনবিহারী বুঝতে না পেরে অপেক্ষা করলেন।

‘ওই ছোট তক্তাপোশে তিনজন তো কিছুতেই হবে না।’

‘না না, তিনজন কেন, মা-ছেলের তো হয়ে যাবে। আর একটা তক্তাপোশ না পাওয়া পর্যন্ত আমি নীচেই শোব।’ বনবিহারী বললেন।

‘পরেশ মণ্ডল যখন নিজে দুটো জোগাড় করতে পারল না তখন আমাকে বলতে পারত। বিদেশ-বিভুঁইতে এসে আপনি মাটিতে শোবেন, এ কেমন কথা। পুঁটির মা বলছিল, বাচ্চাটার যদি রাত্রে কান্নাকাটির অভ্যেস না থাকে তাহলে ওকে নিজের কাছে নিয়ে শুতে পারে।’ ব্রজ মণ্ডল বলল।

‘না না, তার কোনও দরকার হবে না। আচ্ছা চলি।’ বনবিহারী দ্রুত ওপরে উঠে এসে দাঁড়াতেই ব্রজ মণ্ডলের গলা শুনতে পেলেন, ‘পুঁটি, পুঁটি, এই পুঁটি! আর কতক্ষণ জেগে থাকব?’

পুঁটির মায়ের গলা শুনতে পেলেন, ‘তুমি শুয়ে পড়ো, আমি দেখছি।’

‘একটা ছেলেকে দুপুরে ঘুরঘুর করতে দেখেছি। তার সঙ্গে বোধহয়—!’

‘তোমাকে অত ভাবতে হবে না। ওই যে, এসে গেছে। আয় পুঁটি।’

বনবিহারী বারান্দা থেকে উঁকি মেরে দেখলেন একটি সাদা বেড়াল লণ্ঠনের আলোর আওতায় এসে মিঁয়াও বলে জানান দিল।

তাহলে পুঁটির মায়ের নামকরণ এই কারণে। মহিলা নিঃসন্তান, বেড়ালকেই সন্তান ভেবে নিয়েছেন।

ঘরে ঢুকে তাঁর চোখ বড় হল। মেঝেতে বিছানা করে ফেলেছে মামণি। এবং সেখানে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বনবিহারী প্রতিবাদ করলেন, ‘একি! তুমি ওকে নিয়ে নীচে শোবে নাকি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার।’

ওই প্রসঙ্গে না গিয়ে মামণি বাচ্চাটাকে তুলে ধরল ওপরে, বনবিহারীকে নিতে বলল ইশারায়। বনবিহারী বাচ্চাটাকে কোলে তুলতেই অস্ফুট শব্দ বের হল গলা থেকে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বনবিহারীকে দেখছে। শিশু। বনবিহারী ওকে মুখের কাছে এনে বললেন, ‘কি? চোখে ঘুম নেই?’

শিশু নিঃশব্দে হাসল। এই হাসি দেখে মন ভালো হয়ে গেল বনবিহারীর। ঈশ্বরের হাসি নিশ্চয়ই এর চেয়ে পবিত্র নয়। এবার এর একটা নাম দেওয়া দরকার। ঝট করে কয়েকটা নাম মাথায় চলে এলেও বনবিহারী চটজলদি সিদ্ধান্ত নিলেন না। তক্তাপোশের ওপর বসে শিশুর মুখ থেকে দৃষ্টি সরাতেই থতমত হয়ে গেলেন তিনি। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে পোশাক বদলাচ্ছে মামণি। রাতে শোওয়ার কামিজটা ইতিমধ্যে পরে ফেলেছে কিন্তু হাঁটুর নীচে কিছু নেই। ছাড়া পোশাকগুলো ভাঁজ করে রেখে মামণি এগিয়ে এসে হাত বাড়াল শিশুর জন্যে।

বনবিহারী বিরক্ত হলেন, ‘তুমি এই ভাবে ঘুমাবে নাকি?’

হাত শূন্যে ঘোরাল মামণি যার অর্থ তাতে অসুবিধে কোথায়?

‘খারাপ দেখাচ্ছে! লোকে দেখলে কুকথা বলবে। পাজামা-টাজামা যা আছে তা পরে নাও। কালই দুটো পা ঢাকা সেমিজ গোছের কিছু কিনে আনব।’

মামণি হাত নেড়ে জিজ্ঞাসা করল, এই ঘরে লোক কোথায় যে দেখে কুকথা বলবে? ছেলেকে তক্তাপোশে শুইয়ে দিয়ে সে নীচের বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

মহা ম্যাসাদে পড়লেন বনবিহারী। তাঁকে যদি বাচ্চাটার পাশে শুতে হয় তাহলে সারারাত জেগে থাকতে হবে। কেবলই মনে হবে ও জলবিয়োগ করে ভিজে একসা হয়ে আছে। তিনি মামণিকে কয়েকবার ডাকলেন। সে কোনও সাড়া দিল না।

বিছানায় শোওয়ামাত্র বাচ্চা চোখ বন্ধ করল। অতএব বাধ্য হয়ে বাচ্চার বিছানা মেঝে থেকে তুলে তক্তাপোশে এনে তার ওপর ওকে শুইয়ে দিলেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে রান্নার জায়গায় গিয়ে পোশাক পালটে হ্যারিকেনের দিকে তাকালেন। সারারাত হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাখা ঠিক নয়। কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু ওটা নিভিয়ে দিলে অন্ধকারে কিছু দেখা যাবে না। হ্যারিকেনটা রান্নার জায়গায় নিয়ে গিয়ে আলো একেবারে কমিয়ে রেখে দিলেন। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল বটে কিন্তু একটা আবছা আলো তার সঙ্গে মিশে রইল।

শিশুর পাশে সন্তর্পণে শুয়ে পড়লেন বনবিহারী। সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে অপূর্ব আরাম ছড়িয়ে পড়ল। সেই ভোরবেলায় শরীরটা বিছানা ছাড়ার পর আর বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। এখন ঘুম পাচ্ছে কিন্তু অঘোরে ঘুমালে চলবে না। শিশুর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কোনও বাচ্চাকে কোলের পাশে নিয়ে কখনও ঘুমাননি। তাই বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর। ঘুমের ঘোরে যদি ওর শরীরে তাঁর শরীরের চাপ পড়ে তাহলে আর দেখতে হবে না। একেবারে তক্তাপোশের কিনারে নিয়ে গেলেন শরীরটা। কিন্তু ক্লান্তি এত প্রবল ছিল যে ঘুম চলে এল আচমকা।

কিন্তু সেই ঘুম ভাঙল। ঠিক কতক্ষণ পরে তা বনবিহারী জানেন না। চোখ খুলতেই মনে হল চারধারে কুয়াশা। আর সেই কুয়াশার আড়াল থেকে কারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না ভেসে আসছে। প্রথমে ভাবলেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু কান্না যখন নীচ থেকে আসছে তখন আর স্বপ্ন বলে মনে হল না। উঠে বসলেন বনবিহারী। বুঝতে পারলেন মামণি কাঁদছে। এবং এই প্রথম অনুভব করলেন যারা কথা বলতে পারে না তারা কান্নার সময় স্বাভাবিক মানুষের মতো কাঁদতে পারে। খুব নীচু গলায় তিনি ডাকলেন, ‘মামণি?’

কোনও সাড়া এল না, ফোঁপানিও থামল না।

বিপাকে পড়লেন বনবিহারী। গোটা পৃথিবীর কোথাও কোনও শব্দ নেই। নীচু গলায় কথা বললেও দূরের মানুষ শুনতে পাবে। এক্ষেত্রে কান্নার আওয়াজ তো আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। বনবিহারী তক্তাপোশ থেকে নেমে মামণির পাশে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে ওর মাথায় হাত রাখলেন, ‘কি হয়েছে? কাঁদছ কেন? মন খারাপ লাগছে?’

উত্তর এল না। কিন্তু কান্নাটা একটু মিইয়ে গেল। বনবিহারী বললেন, ‘এই জায়গাটা বোধহয় তোমার ভালো লাগছে না। দেখি, কি করা যায়।’

অন্ধকারেই মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল। মামণি, ঠিক কথা নয়।

বাধ্য হয়ে ওর মাথার পাশে বসে মাথায় হাত রাখলেন বনবিহারী, ‘তাহলে কি জন্যে কষ্ট পাচ্ছ তা আমাকে বল।’

হঠাৎ এদিকে পাশ ফিরে দু-হাত দিয়ে বনবিহারীকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কোলের ওপর মাথা তুলে স্থির হয়ে গেল মামণি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *