দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ১০

দশ

বনবিহারী বললেন, ‘বসুন।’ শরীরে যন্ত্রণা নিয়েও ভদ্রমহিলা রিকশায় উঠেছেন, নেমেছেন, মুখে মেকআপ করেছেন যাতে ওঁকে সুন্দরী দেখায়। হেসে ফেললেন বনবিহারী। ডাক্তারি পড়ার সময়ের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। তাঁদের একজন অধ্যাপক ছিলেন যিনি রসিকতা পছন্দ করতেন। একদিন ক্লাসে বললেন, ‘অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তোমাদের। মাথা ঠান্ডা করে তৎক্ষণাৎ একটা সমাধান করে ফেলতে হবে। ধরো একজন মহিলার প্রসববেদনা উঠেছে। তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে লেবাররুমে। হঠাৎ ওই যন্ত্রণার মধ্যেও মহিলা অনুরোধ করতে লাগলেন, তাঁকে একটা চিরুনি আর পাউডার পাফ দিতে। নার্স অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, এই সময় ওসবের কি দরকার? ভদ্রমহিলা বললেন, চুল না আঁচড়ালে আর মুখে না পাউডার দিলে আমাকে বিশ্রী দেখায়, আমার স্বামী বলেছেন। প্লিজ আমাকে দিন। নার্স রেগে গিয়ে বলল, এখানে আপনাকে কে দেখতে আসছে?

উঃ মাগো, বলে ব্যথা সামলে ভদ্রমহিলা বললেন, পেট থেকে যে বের হবে সে তো কখনও আমাকে দ্যাখেনি। এই চেহারায় প্রথম দেখলে কি খারাপ ভাববে বলুন তো! ছি ছি।

নার্স ডাক্তারের দিকে তাকাল। ডাক্তার কী বলেছিলেন বল তো?’

প্রফেসারের প্রশ্নের জবাব দিতে সবাই আকাশ-পাতাল ভেবেছিল। অধ্যাপক হেসে বলেছিলেন, ‘ডাক্তার বলেছিলেন, ম্যাডাম, আপনার কোনও চিন্তা নেই। জন্মাবার পর শিশুর দৃষ্টিশক্তি তৈরি হতে অনেকটা সময় লাগে। ও আপনাকে দেখতেই পাবে না।’

গল্পটা অনেক বছর পরে মনে পড়তেই হেসে ফেললেন বনবিহারী।

টেবিলের উলটোদিকে বসে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি আর আপনি হাসছেন ডাক্তারবাবু?’

‘না না। আপনার কথা ভেবে নয়। নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে হাসলাম। ভগবানের দেওয়া শরীরে মানুষ অসুখবিসুখ তৈরি করে নেয়। আমরা ডাক্তাররা সেই অসুখ সারাতে চেষ্টা করি, কিন্তু কোনও-কোনও অসুখ কিছুতেই বশ্যতা মানে না।’ বনবিহারী বললেন।

‘তার মানে, আপনি বলছেন, আমি কিছুতেই সারব না?’

‘না। তা বলিনি। আপনার দুই হাঁটুতে বাত হয়েছে। নিয়মিত ওষুধ খেলে কষ্ট কম পাবেন। অবশ্য—!’

‘অবশ্য কি?’

‘দুটো হাঁটু পালটে ফেললে আর কষ্ট থাকবে না।’

‘হাঁটু পাল্টাব?’

‘হ্যাঁ! অপারেশন করে দুই লাখ টাকা খরচ। কলকাতায় যেতে হবে।’

‘উরে ব্বাবা! অত টাকা আমি পাব কোথায়?’ আঁতকে উঠলেন ভদ্রমহিলা।

‘আজ ব্যথাটা কোথায় বেশি?’

‘কোথায় নয়! দুই পায়ে, হাঁটুতে, কোমরে। চলতে ফিরতে পারছি না। একটা কিছু করুন ডাক্তারবাবু, এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’

‘আপনি একটু হাঁটাহাঁটি করার চেষ্টা করুন।’

‘ধরুন, আপনার মেয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার বাড়ি পর্যন্ত?’

‘অসম্ভব! এই এখন বারান্দা থেকে মোড়ায় পা দিয়ে রিকশায় উঠেছি, আর আপনার এখানে কোনওমতে নামলাম।’

‘তাহলে তো মুশকিল হয়ে গেল।’ বনবিহারী গম্ভীর গলায় বললেন।

‘কেন? কি হয়েছে ডাক্তারবাবু।’

‘থাক ও কথা। আপনার ব্লাড সুগার আছে?’

‘না।’ মাথা নাড়লেন ভদ্রমহিলা।

‘ভালো। আপনাকে ওষুধ লিখে দিচ্ছি। কিছুদিন খেয়ে দেখুন।’ একটা প্যাড নিয়ে লিখতে গিয়ে থামলেন বনবিহারী, ‘নামটা—?’

‘সুনয়নী দত্তগুপ্ত।’

একবার তাকিয়েই মুখ নামাতে নামাতে দেখলেন সুনয়নী কপাল থেকে চুল সরাচ্ছেন আলতো আঙুলে। ওষুধ লিখে দিয়ে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি, কোনটা কখন খেতে হবে।

‘এখানে এসব পাওয়া যাবে?’

‘বোধহয় যাবে। নইলে জামাইকে বলবেন শহর থেকে আনিয়ে দিতে।’

‘আমি ওষুধ খেয়ে হাঁটতে পারব তো?’

‘আপনি এখনই একটু কষ্ট হলেও হাঁটতে পারবেন।’

‘আপনি এত কাঠ কাঠ কথা বলেন কেন?’

‘সত্যি কথা আপনার কাছে কাঠ কাঠ বলে যদি মনে হয় তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আপনি আমার বাড়িতে তো নিজের পায়ে হেঁটে এসেছিলেন।’

‘মরিয়া হয়ে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে—।’

‘ওইরকম মরিয়া চেষ্টা সকাল-বিকেল করুন।’

‘বেশ। তাই করব। মরে গেলেও করব।’

‘আপনি তাতে উপকৃত হবেন সুনয়নীদেবী।’

‘ওমা! আবার দেবী কেন? আমি আপনার চেয়ে বয়সে কত ছোট। চোদ্দো বছরে বিয়ে হয়েছিল, পনেরোতে মেয়ে এল। মেয়ের বয়স এখন সাতাশ। তাহলে আমি বিয়াল্লিশ। এই বয়সে কেউ এত ব্যথা পায়? বলুন! ও হ্যাঁ, কি সমস্যার কথা বলছিলেন? আমি কি সাহায্য করতে পারি?’

‘আমার এক ভাগনিজামাই বিদেশে গেল বছর দুয়েকের জন্যে। বোন তো নেই। তাই আমার কাছে ভাগনি আর তার বাচ্চাকে রেখে গেল। ভাগনির গলায় একটা অপারেশন হয়েছিল। কথা বলা নিষেধ। আমি আর কালীচরণ বাচ্চাটাকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। ভাবছি একটা আয়া রেখে দেব।’ বনবিহারী কথাগুলো সাজাতে চেষ্টা করলেন।

‘ওমা! তাই! বাচ্চা আমার খুব ভালো লাগে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দু-বেলা গিয়ে দেখে আসব। মেয়ে তো বাড়ির কোনও কাজ আমাকে করতে দেয় না।’

‘কি করে দু-বেলা আসবেন? আগে সেরে উঠুন, ব্যথা কমুক। তারপর না হয়—! ঠিক আছে, কেমন আছেন তা জামাইকে দিয়ে বলে পাঠাবেন।’

সুনয়নী উঠে দাঁড়ালেন, ‘আপনাকে কত দিতে হবে?’

‘কিছু না। আপনি প্রতিবেশী। তাছাড়া মুখ ফুটে উপকার করার কথা তো বলেছেন। ক’জন আজকাল বলে! নমস্কার।’

‘জামাই কেন, ভালো থাকলে আমি নিজেই আপনাকে বলে আসব।’

সুনয়নী যত কষ্ট করে রিকশা থেকে নেমেছিলেন তত কষ্ট করে উঠলেন না। বনবিহারী ওঁর চলে যাওয়া দেখলেন। এছাড়া কোনও উপায় ছিল না। মামণিকে নিয়ে চিন্তা নেই, কালীচরণকে শিখিয়ে দিতে হবে। এই মিথ্যেটা যদি প্রতিবেশীদের কৌতূহল মুছে দেয় তাহলে এটাই চলুক। একটু সবল হলে শিশুটিকে তো ঘরের ভেতর আটকে রাখা যাবে না। তাই একটা মাটি তৈরি থাক।

ভাগনির গল্পটা মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়বে কয়েকদিনের মধ্যে। সুনয়নী কতটা বিশ্বাস করলেন তা বড় কথা নয় কিন্তু তিনি খবরটা চেপে রাখতে চাইবেন না, এটা পরিষ্কার। নিজেকে একটু হালকা লাগল বনবিহারীর। একটা ছোট্ট মিথ্যে যদি খুব বড় উপকারে লাগে তাহলে তার সাহায্য নেওয়াতে অন্যায় নেই।

ছেলেটিকে ডেকে চেম্বার বন্ধ করতে বলে বাইরে পা বাড়াতেই পুলিশের জিপটা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। ও.সি. ড্রাইভারের পাশে বসে তাঁকে হাত নেড়ে দাঁড়াতে বললেন। তারপর নীচে নেমে এসে বললেন, ‘শুনেছিলাম আপনি রবিবারের বিকেলে চেম্বারে বসেন না। আপনার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে যাচ্ছিলাম। দূর থেকে দেখতে পেলাম চেম্বার খোলা, আজ হঠাৎ নিয়ম ভাঙলেন যে?’

বনবিহারী বললেন, ‘সকালে আসতে পারিনি। শরীর ভালো ছিল না।’

‘ডাক্তার হয়েও যদি আপনার শরীর খারাপ হয় তাহলে আমরা কোথায় যাব।’

ডাক্তারও তো রক্তমাংসের মানুষ।’

‘তা অবশ্য। তবে লোকে তো আপনাকে ভগবানের কাছাকাছি ভাবে।’

কথাগুলো যে বলার জন্যে বলা তা বুঝে বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হঠাৎ আমার বাড়িতে যাচ্ছিলেন! আবার কি হল?’

‘খুব বিপদে পড়েছি ডাক্তারবাবু।’ ও.সি. বললেন।

‘আপনি বিপদে পড়েছেন?’ বনবিহারী অবাক।

‘হ্যাঁ। একটা কিছু করতে না পারলে নির্ঘাত সাসপেন্ড হয়ে যাব আমি।’ বেশ করুণ হয়ে যাচ্ছিল বড়বাবুর মুখ।

আশেপাশে যারা হেঁটে যাচ্ছিল তারা ও.সি.-কে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে দেখে কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। তল্লাটের মানুষের ধারণা ওই ও.সি. অতি ভয়ংকর অফিসার।

‘আপনি কি চেম্বারের ভেতরে বসে কথা বলবেন?’

‘চেম্বারে? না না, পাবলিক আসা-যাওয়া করবে। তার চেয়ে আপনার বাড়িতে বসে কথা বলি। সেখানে তো আপনার চাকর ছাড়া তৃতীয় ব্যাক্তি নেই।’

‘আছে। মানে আজই এসেছে। আমার ভাগনি, ভাগনিজামাই আর তাদের বাচ্চা।’

‘কোথায় থাকে তারা?’

‘মা-মালদা।’ নামটা চট করে মাথায় আসছিল না বনবিহারীর।

‘আর আসার সময় পেল না! ঠিক আছে, গাড়িতে উঠুন। ফাঁকা জায়গা তো অনেক পাওয়া যাবে। ডাক্তারবাবু, আপনার সাহায্য না পেলে আমি শেষ হয়ে যাব।’

জিপে ওঠার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু উঠতে হল।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে জিপ চলে এল জঙ্গলের ধারে নদীর গায়ে। আশেপাশে কোনও মানুষ নেই। শুধু দূরে ঘাস খেতে আসা গরুদের গলায় ঘণ্টি বাজছে।

ড্রাইভারকে একটু ঘুরে আসতে বললেন ও.সি.। সে চলে গেলে বনবিহারীর দিকে তাকিয়ে ও.সি. বললেন, ‘জ্যান্ত মানুষের চেয়ে তার ভূত বেশি ডেঞ্জারাস হয় একথা আগে জানতেন?’

বনবিহারী বললেন, ‘এরকম কথা এখনও জানি না।’

‘ওই যে ছেলেটি যার লাশ চা-বাগানের ভেতরে পড়েছিল তার পরিচয় আমি জানতাম না। লাশ তো আমি সদরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম পোস্টমর্টেম করার জন্যে। আজ সকালে এসপি সাহেব ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ডাইরেক্ট আই.পি.এস.। বয়স বেশি নয়। বললেন, ছেলেটির খুনিকে দিন সাতেকের মধ্যে খুঁজে বের করতে হবে।’

বুকের ভেতরে একটা চিনচিনে অনুভুতি হল বনবিহারীর। শুকনো গলায় বললেন, ‘ও।’

‘কেন জানেন? ওই ছোকরা, যার লাশ দেখে খুশি হয়ে ভেবেছিলাম আমার এই এলাকায় আর অশান্তি হবে না, সে-ব্যাটা মন্ত্রীর ভাইপো। মন্ত্রী নিজের ভাইপোকে কব্জায় রাখতে পারেনি, খুন হয়ে গেছে বলে খুনিকে শাস্তি দিতে চান।’

‘ছেলেটা যে ওইরকম উগ্রপন্থী হয়ে গিয়েছিল তা মন্ত্রী জানতেন না?’

‘শুনলাম, জানতেন না। কলেজ হোস্টেলে থেকে ও কি করছে তা বাড়ির কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু ছেলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বেশ ভেঙে পড়েছে বলে মন্ত্রীকাকা নির্দেশ দিয়েছেন সাতদিনের মধ্যে খুনিকে ধরা চাই। এখন আপনি বলুন, আমি কোথায় খুনিকে খুঁজে পাব!’ ও.সি. মাথা নাড়লেন।

‘আমি—আমি কি করে জানব—!’

‘আপনি তো দেখেছেন ছেলেটাকে একটা বড় পাথর ছুড়ে মারা হয়েছে। ওই পাথর তো দুর্বল মানুষ ছুড়তে পারে না।’ ও.সি. তাকালেন।

‘হ্যাঁ। তা তো বটেই।’

‘অথচ ওর সঙ্গে যার ঝামেলা হয়েছিল সে পুরুষ নয়।’

‘অ।’ বুকের ব্যথাটা বোধহয় আর একটু বাড়ল বনবিহারীর।

‘পাথরের গায়ে যে ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে সেটা মেয়েদের হাতের। এর মধ্যে আমি আর একবার স্পটে গিয়েছিলাম। একটা জামার বোতাম চা গাছের নীচে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। ওই বোতাম ছেলেদের জামায় ব্যবহার করা হয় না। মেয়েটি যদি পাথরটা না ছুড়তে পারে তাহলে সে একা ছিল না। কিন্তু তাও তো মানা যাচ্ছে না। কারণ মন্ত্রীর ভাইপো ওকে রেপ করতে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছে। তৃতীয় ব্যক্তি থাকলে তাতে রেপের ব্যাপারটা কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাচ্ছে।’

‘তা তো বটেই।’ বনবিহারীর বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল।

‘আমার মনে হচ্ছে ওই মন্ত্রীর ভাইপো আর এই মেয়েটি বেশ পরিচিত। নইলে কোনও মেয়ে অত রাতে চা-বাগানের ভেতরে অচেনা ছেলের সঙ্গে কখনই যাবে না। সমস্যাটা এখানেও। ছেলেটা বাইরে থেকে এসে জঙ্গলে দলের সঙ্গে লুকিয়ে ছিল। স্থানীয় কোনও মেয়ের সঙ্গে এমন ভাব হওয়ার সুযোগ সে পেল কি করে যে ডাক পেলেই জঙ্গলে দেখা করতে যাবে! আপনাদের এই গঞ্জে সেরকম স্বাস্থবতী স্মার্ট আনম্যারেড মেয়ে আছে?’

‘আমি দেখিনি।’

‘দ্যাখেননি! তার মানে মেয়েটিও এখানকার নয়। বাইরে থেকে এসেছিল!’

‘আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।’

‘ঢুকছে না বললে আপনার কিছু হবে না। আমার চাকরিটা যাবে। এই মন্ত্রী খুব পাওয়ারফুল। যে করেই হোক একজন খুনিকে খুঁজে বের করতেই হবে আমাকে। আমার সমস্যাটা বুঝুন।’

‘হুঁ।’ মাথা নাড়লেন বনবিহারী।

‘আমি একটা খবর পেয়েছি।’ তাকালেন ও.সি.। সেই দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতরটা বাতাসবন্ধ হয়ে গেল বনবিহারীর।

‘ভেবেছিলাম সবক’টা উগ্রপন্থী মরে গেছে। উঁহু। একজন এখনও মরেনি। ক’দিন আগেই খবরটা পেয়েছিলাম। একজন তো কোনও ক্ষতি করতে পারবে না ভেবে মাথা ঘামাইনি। তাছাড়া এস.পি-র কাছে রিপোর্টও পাঠিয়েছিলাম সবাই খতম হয়ে গেছে বলে। আবার যদি বলি আর একজন বেঁচে আছে তাহলে আগের রিপোর্টটা ভুল হয়ে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ও ব্যাটাকে ধরা দরকার।’

একটু স্বস্তি পেলেন বনবিহারী, ‘অবশ্যই।’

‘আপনি তো বললেন অবশ্যই, কিন্তু ধরব কি করে? এত বড় জঙ্গল, তার ওপর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কীরকম ঠান্ডা মেরে আছে। ঠিকঠাক সহযোগিতা যেমন করছে না আবার মুখে না বলছে না। তাছাড়া যদি ছেলেটা টের পায় তাহলে এখান থেকে হাওয়া হয়ে যেতে কতক্ষণ! তখন আঙুল চুষতে হবে আমাকে। ডাক্তারবাবু, একটু বুদ্ধি দিন।’ ও.সি. বললেন।

বনবিহারী বললেন, ‘কি দেব বলুন তো! আমি কোনওদিন ডিটেকটিভ গল্পের ভক্ত ছিলাম না যে—!’

‘কিন্তু আপনি পারেন।’

‘আমি?’

‘আপনার কাছে একটা সত্যি কথা বলিনি ডাক্তারবাবু।’

‘কী কথা?’

‘সদর থেকে ফেরার সময়ে আমি আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম।’

‘আমার বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ। দরজা বন্ধ ছিল। আপনি বাড়ির ভেতরে আছেন ভেবে নক করেছিলাম। তৃতীয়বারের পর সম্ভবত আপনার কাজের লোক এসে দরজা খুলে আমাকে বলল, আপনি চেম্বারে চলে এসেছেন। তেষ্টা পেয়েছিল খুব তাই এক গ্লাস জল খাওয়াতে বললাম। সে জল আনতে গেলে একটা কচি বাচ্চা কেঁদে উঠল ভেতরের কোনও ঘর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে এদিকের ঘর থেকে একটি লম্বা, স্বাস্থ্যবতী যুবতীকে ছুটে যেতে দেখলাম। তারপরেই বাচ্চার কান্না থেমে গেল। জল খেয়ে সোজা চলে এলাম আপনার চেম্বারে।’ ও.সি. হেসে বললেন, ‘আমি জানতাম আপনার বাড়িতে চাকর ছাড়া আর কেউ থাকে না।’

‘মেয়েটি আমার ভাগনি। সে আর তার স্বামী এসেছে বাচ্চা নিয়ে। আপনাকে বলেছি।’

‘এ তো হতেই পারে। মামার কাছে তো আসতেই পারে।’

বনবিহারী কীরকম দিশেহারা হয়ে গেলেন। ও.সি. কি বলতে চাইছেন?’

‘আপনার ভাগনিজামাই আর ভাগ্নী কি এখানে কিছুদিন থাকবে?’

‘না ভাগনিজামাই কাল সকালে ফিরে যাবে। ওকে চাকরিসূত্রে বিদেশে যেতে হচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ভাগনিকে রাখতে অসুবিধে বলে আমার কাছে রেখে যাচ্ছে।’

‘বাঃ খুব ভালো হল। ডাক্তারবাবু, আপনি আমার উপকার করুন। প্লিজ। আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব!’

‘আমি কীভাবে—!’

‘বলছি। কাল সকালে জামাই চলে যাবে বললেন, তাই তো?’

‘হ্যাঁ।

‘কাল দুপুরে আপনি আপনার ভাগনিকে নিয়ে একটা রিকশায় চেপে জঙ্গলে যাবেন। ওকে বলবেন জঙ্গলটা দেখার মতো, তাই দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন। আপনি প্রৌঢ মানুষ, একটু হেঁটে ক্লান্তি বোধ করবেন। ওকে বলবেন চারপাশে ঘুরে বেড়িয়ে দেখতে। তারপর ওকে নিয়ে ফিরে আসবেন।’ ও.সি. বললেন।

‘এতে কি লাভ হবে? বনবিহারী অবাক হলেন।

‘যে ছেলেটা ওই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে যদি আপনার ভাগনিকে দেখতে পায় তাহলে, আমরা ধারণা, আলাপ করার চেষ্টা করবে।’

‘সেকি! আপনি কি বলছেন? ছেলেটা উগ্রপন্থী—!’

‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, পুলিশের বিরুদ্ধে ওরা উগ্র। কিন্তু সুন্দরী মেয়েকে দেখলে এত নরম হয়ে যাবে যে ওকে ধরতে আমার অসুবিধে হবে না।’ ও.সি. বললেন।

‘কিন্তু, আপনি ওকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে বলছেন?’

‘একটা ছাগলকে যখন ফাঁদের মধ্যে বাঘের টোপ হিসেবে রাখা হয় তখন সে বুঝতে পারে মৃত্যু আসন্ন। ভয়ে কাঁপতে থাকে। আপনার ভাগনি টেরও পাবে না যে আমাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে।’

‘না অফিসার, আমার ভালো লাগছে না।’

‘ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে বাঁচান।’ ‘আশ্চর্য! ছেলেটা হয়তো তখন জঙ্গলের অন্য প্রান্তে থাকবে। সে দেখতে বা জানতেই পারবে না মামণিকে। এটা ভেবেছেন?’

‘হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। একটা জঙ্গলে একা কোনও মানুষের পক্ষে বেশিদিন বাস করা সম্ভব নয়। তার খাবার দরকার। ঘুম দরকার। আমার মনে হচ্ছে এই ছেলেটি জঙ্গলের ভেতরে কাঠ কুড়োতে আসা আদিবাসীদের সাহায্য পাচ্ছে। তাই পুলিশ রেইড করলেই সে জেনে যাচ্ছে এবং গোপন আস্তানায় চলে যাচ্ছে। পুলিশের কথা যদি সে জানতে পারে তাহলে একজন সুন্দরী মহিলা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই খবরটাও তার কাছে পৌঁছে যাবে বলে আমার ধারণা।’ ও.সি. বললেন।

‘মামণির যদি কোনও ক্ষতি হয় তাহলে আমি কি জবাব দেব!’

‘কোনও ক্ষতি হবে না। তাছাড়া আপনাকে তো রোজ ওকে নিয়ে জঙ্গলে যেতে বলছি না। শুধু কাল দুপুরে, একবার চলুন।’

ও.সি. বনবিহারীকে নিয়ে জিপে উঠলেন। তখন সন্ধে নেমে গেছে। বনবিহারীর বাড়ির সামনে তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে ও.সি. বললেন, ‘আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে তাই আর আপনার ভাগনিজামাই-এর সঙ্গে আলাপ করলাম না। ডাক্তারবাবু, মনে রাখবেন আমি শুধু নিই না, ফিরিয়েও দিই। আপনার বিপদে আমি আপনার পাশে থাকব।’

জিপ চলে গেল।

আধা অন্ধকারে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই চিৎকার শুনতে পেলেন বনবিহারী, ‘ডাক্তার—বা—বু।’

অবাক হয়ে দেখলেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে সুনয়নী সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘মরে যাচ্ছি ডাক্তারবাবু। আপনার কথা শুনে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, উঃ কি ব্যথা, কি ব্যথা!’

‘আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে যাবে। চেষ্টা ছাড়বেন না।’

‘হুঁ! আচ্ছা, আমি আপনার চেয়ে কত ছোট। আমাকে আপনি বলবেন না তো। আপনার মুখে আপনি শুনলে বড় লজ্জা করে।’

বনবিহারী মুখ ফেরালেন, ‘আচ্ছা, আসি।’

‘আপনার চাকরটা খুব বেয়াদব। বাচ্চাটাকে দেখতে গিয়েছিলাম, বলল, মা-বাচ্চা দুজনেই নাকি ঘুমাচ্ছে। এই সময় কোন মা ঘুমায়?’ সুনয়নী পেছন থেকে বললেন।

বনবিহারী জবাব দিলেন না। কথায় কথা বাড়ে। একেই তাঁর বুকে এখন ঝড় চলছে। এই ঝড় কি করে থামানো যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *