দাঁত
দাঁত জিনিসটা কি সাংঘাতিক! আপনা আপনি গজায় মাড়ি ফুঁড়ে। একটা নয়, ওপর নিচে পরপর বত্রিশটা। প্রথমত ওঠার সময় সেই ছেলেবেলায়, এক পককড় জ্বালাবে। জ্বর হবে। হবে পেট খারাপ। শরীর খ্যাঁত খ্যাঁত করবে। মেজাজ তিরিক্ষি হবে। কি? না, ছেলেটার দুধের দাঁত উঠেছে। যাই হোক! ওপরে কটা, নীচে কটা যেই উঠল, শুরু হল সিরসিরিনি। শিশু তখন কামড়াতে চায়। হয় আঙুল, না হয় মায়ের স্তনবৃন্ত, কাঠের টুকরো, চামচে, টিনের কৌটো। শক্ত একটা কিছু পেলেই হল, কামড়ে-কুমড়ে শেষ করে দেবে। একটা কামড়া কামড়ি করতে করতেই বছর ঘুরে যাবে। তখন আবার পড়ার পালা। একটা, একটা করে ঝরতে থাকবে। দুধের দাঁত পড়ে গিয়ে আসল দাঁত উঠবে, যা হবে আমরণ সাথী। দুধের দাঁত দেখে বোঝার উপায় নেই আসল দাঁতের চেহারা কি হবে। প্রথমটায় হয়ত ছিল ইঁদুরের মতো। ছোট্ট-ছোট্ট সুন্দর। দ্বিতীয় দফায় হয়ে উঠল গজাল। একটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল আর একটা। কি সামনের দুটো হয়ে গেল গজদন্ত। ছেলে যখন সাবালক হল, সবাই ব্যঙ্গ করে ডাকতে লাগল—ডেন্টিস্ট।
মেয়ের দাঁতে এলোমেলো ছন্দ হলেই কেলেঙ্কারি। নাক, চোখ সব সুন্দর, হাসলে, কি কথা বললেই বিপদ। বোগড়া বোগড়া দাঁত বেরিয়ে এল উঁচু মাড়ি সমেত। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে এসেছে, দরজার আড়াল থেকে ঠোঁটে আঙুল রেখে মেয়েকে ইশারা করছেন—মনে থাকে যেন, ভুলেও হাসবে না। ঠোঁট বেশি ফাঁক করবে না কথা বলার সময়। সমস্ত প্রলোভন জয় করে, ঠোঁট টিপে প্রশ্নের জবাব দাও, তা না হলে বিয়ে কেঁচে যাবে, কি পাত্রের দাম চড়ে যাবে। পাত্রের অভিভাবকরা চালাক হলে, মেয়ের বাপ মায়ের দিকে অনুসন্ধানী চোখে তাকাবে। কারোর উঁচু দাঁত দেখলেই মেয়েকে বলবে, হাসো তো মা। দাঁতেরও উত্তরাধিকার আছে।
যুগটা বিজ্ঞানের। দন্ত চিকিৎসায় নতুন এক বিভাগ বা দিক যুক্ত রয়েছে—ফেসিওলজি। শুধু দাঁত ওপড়ানো বা গর্ত বোজানো নয়, গোটা মুখের ভূগোল পরিবর্তন করে দিতে পারেন একালের ডেন্টিস্ট। সে-ও এক মহাযন্ত্রণা। এতটুকু বাচ্চা মেয়ের গোটাকতক সামনের দাঁত পটাপট তুলে দিলেন। তারপর ঠেলে ওঠা মাড়ি যাতে আরও ঠেলা মারতে না পারে তার জন্যে পরিয়ে দেওয়া হল মেটাল ক্লিপ। পরে বসে থাকো মাসের পর মাস। জগতের সামনে সুন্দর একটা মুখ তুলে ধরবার জন্য কত কষ্ট স্বীকার। এ যুগে মানুষের মন দেখার লোক নেই। রূপটাই সব। যার মালকড়ি আছে, সে এই সব করাবে, যার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সারা জীবন সে দাঁত খিঁচিয়ে মরবে। কিছু করার নেই। সত্য মিথ্যে জানি না, শাস্ত্রের কৌশল কি না, তাও বলতে পারব না, প্রচলিত বিশ্বাস গজদন্ত হলে মানুষ সুখী হয়। ভাগ্যবান হয়। যে-সব মেয়ের মাড়ি উঁচু, তারা ভীষণ ভালো মানুষ হয়। সামনের দুটো দাঁতে ফাঁক থাকলে ধার্মিক হয়। হয় ঈশ্বর বিশ্বাসী। ছোট-ছোট, ঠাস দাঁত হলে মানুষ অহঙ্কারী আত্মকেন্দ্রিক হয়। নিষ্ঠুর হয়।
সে যাই হোক। দাঁত হল শয়তান। দাঁত নিয়ে কোনও না কোনও সময়ে নাকাল হয়নি, এমন মানুষ হাতে গোনা যায়। ও যতই সেবা যত্ন করো, মর্যাদা দাও, দাঁত তোমাকে ভোগাবেই। ওর চরিত্রটাই হল ভোগান্তির। দুবেলা দাঁত মাজে, শোওয়ার আগে পেস্ট আর বুরুশ দিয়ে খ্যাসোর খ্যাসোর করে, মিষ্টি খাওয়ার পর কুলকুচো করতে ছোটে, গরমের পর ঠান্ডা কিছু খায় না, অথচ দাঁত একটি বাধা। এক থেকে একাধিক। টক খাওয়ার পর অন্য কিছু খেতে পারে না। দাঁতে আইসক্রিম পড়া মাত্রই বাবারে মারে।
তিন রকমের শূল আছে পিত্তশূল, অম্লশূল, দন্তশূল। ব্যথা এর কাছে ছেলেমানুষ। ব্রেন সেন্টারে সোজা যেন শূলের খোঁচা। পিতার নাম ভুলিয়ে দেবার অবস্থা। একমাত্র দাওয়াই সমূলে উৎপাটন। প্রথমে ঘিনঘিনে যন্ত্রণা। দৈনিক কাজকর্ম সবই হয় তো করছি, মন কিন্তু পড়ে আছে দাঁতের দিকে। প্রথমটায় চলে টোটকা, লবঙ্গ, হরিতকি। শেষমেষ ভুক্তভোগীর পরামর্শ—যাও না বাবা, গিয়ে তুলিয়ে এস। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। ও তোমার গেলেই মুক্তি। পৃথিবীর এত কিছু উন্নতি হল দাঁতের চিকিৎসার সেই এক মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা। চেয়ারটা খুব সুদৃশ্য। অনেক টাকা দাম। সে আবার উঁচু হয় নিচু হয়। পাশেই থাকে সুদৃশ্য বেসিন; কারণ বিনা রক্তপাতে দাঁতকে বিদায় করা যায় না। দন্ত বিশেষজ্ঞ প্রথমে চেষ্টা করেন দাঁতটাকে ধরে রাখার। সে এক ভয়ঙ্কর প্রয়াস। দন্তবিদদের ঘরে থাকে ড্রিল-মেশিন। গলায় যত্ন করে বেঁধে দেবেন এক ন্যাপি, যেন শিশুকে দুধ খাওয়ানো হবে। মাথাটাকে পেছনে হেলিয়ে দেবেন। আদুরে গলায় বলবেন, বেশ বড় করে হাঁ করুন। সূচ্যগ্র ফোঁড়ক আর ফাঁড়ক যন্ত্র নেমে আসবে উপদ্রুত দাঁতের স্পর্শকাতর ভূমিতে। শলাকা ঘুরবে। কিড়কিড় শব্দে গভীর থেকে গভীরতর হবে দাঁতের গর্ত। শিউরে উঠতে থাকবে শরীর। মনে হবে দাঁত কেন হয়। সেই গর্তে চিকিৎসক ঢালবেন গলিত ধাতু। ফিল করে কিছুকাল চলবে। চিরকাল নয়। অবশেষে একটি-একটি করে উৎপাটন। প্রতিটি উৎপাটনের পর তরল পথ্য। সবশেষে নকল দাঁতে জেল্লাদার হাসি। অবশেষে ড্রয়ারের মাথায় দুপাটি খোলা দাঁত। অবয়বহীন হাসি। কিংবা দাঁত খিঁচুনি। কর্তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে মহাকাল। পড়ে আছে বার্তা দুনিয়ায় শুধু নকল দাঁতের হাসি।