ত্রয়ী
একটি মহিলার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার পর কয়েক মুহূর্ত সে যদি অপলক তাকিয়ে থাকে, মুখ ফিরিয়ে না নেয়, তবে তার কী মানে হতে পারে?
চেনা? অন্য কোনও চেনা লোকের সঙ্গে মিল পেয়েছে? অনুপম আগে কখনও এ-মহিলাকে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। তার নিজের মুখখানা এমন কিছু দর্শনীয় নয়। ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে অনুপম দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল রাস্তার উলটো দিকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের বারান্দার নীচে। একটু আগেই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তা সে অফিসে বসে বুঝতে পারেনি। অফিস থেকে একবার বেরুলে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। রাস্তা পার হতে গিয়ে সে খানিকটা ভিজেও গেছে।
বারান্দার নীচে অনেক মানুষ। বর্ষার দিনে মানুষ দু-দলে বিভক্ত। যারা ছাতা নিয়ে বেরোয়, যারা। বেরোয় না। অনুপমের ছাতা ব্যবহার করার অভ্যেসই নেই।
মহিলাটি হাঁটছিল একটা লাল রঙের ছাতা নিয়ে।
রাস্তায় তখনও জল জমেনি। লাল ছাতাধারিণীও এল রাস্তা পেরিয়ে, তারপর বাসস্টপের দিকে যেতে-যেতে একবার মুখ তুলতেই দেখতে পেল অনুপমকে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে কী দেখল অনুপমের মুখে।
বয়েস হবে চল্লিশ-বেয়াল্লিশ, পাতলা গড়ন, গায়ের রং ফরসা নয়, আবার কালোও বলা যায় না, মুখখানা সুশ্রী। সাধারণত পুরুষরা সরাসরি তাকায়, মেয়েরা মুখ নীচু করে। এ-মহিলার দৃষ্টিতে কোনও আড়ষ্টতা ছিল না।
অনুপম চোখ দিয়ে মেয়েটিকে অনুসরণ করল।
সে বাসস্টপের দিকে গেলেও, পরপর দুটি ভিড়ের বাস দেখে আবার হাঁটতে লাগল ময়দানের দিকে। তারপর চলে গেল চোখের আড়ালে।
পঞ্চাশ বছর বয়েস হয়ে গেলে মানুষ আস্তে আস্তে অনেক কিছু ভুলতে শুরু করে। শীতকালের গাছের মতন অনেক পাতা ঝরে যায়। অনুপম মাত্র দেড় মাস আগে পঞ্চাশে পা দিয়েছে। তবে ভুলে যাওয়া মানে একেবারে হারিয়ে যাওয়া নয়, স্মৃতির অতলে নাকি সব কিছুই থাকে, কিছু কিছু আবার উদ্ধার করাও যায়।
অনুপম এই মহিলার মুখখানি উদ্ধার করার চেষ্টা করল। নাঃ, কিছুতেই মনে পড়ল না। যদি আগে পরিচয় হয়ে থাকে, একটি মেয়ে তাকে মনে রেখেছে, অথচ অনুপম ভুলে গেছে, এটা অস্বাভাবিক
মনে করতে না পারলে অস্বস্তি কাটে না। অনুপমের অস্বস্তি রয়েই গেল।
ব্যাঙ্কে বেশ উঁচু চাকরি করে অনুপম। কিছুদিন আগেও তার নিজের গাড়ি ছিল, বিক্রি করে দিয়েছে। চাকরিটা আর তার ভালো লাগছে না। কিছুদিন ধরেই তার মনে একটা বিচিত্র বাসনা উঁকি মারছে। চাকরি ছেড়ে, কলকাতা শহর ছেড়ে কোনও একটা ছোট্ট পাহাড়ি শহরে একা-একা বাকি জীবনটা কাটালে কেমন হয়?
অনুপম অবশ্য সাধুসন্ন্যাসী হতে চায় না। আশ্রমটাশ্রমের দিকে তার ঝোঁক নেই। শুধু শহরের জীবনটা দিন-দিন তার অসহ্য লাগছে।
অনুপম আত্মবিশ্লেষণ করে এর কারণটাও বোঝার চেষ্টা করেছে।
শ্রীপর্ণার প্রতি রাগ থেকেই কি তার এমন বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে? শ্রীপর্ণা তার স্ত্রী, স্ত্রী ছিল প্রায় দশ বছর, তারপর ছবছর ধরে সেপারেশন। সম্প্রতি শ্রীপর্ণা ডিভোর্স চেয়েছে। আপত্তি করার কোনও প্রশ্নই নেই, সঙ্গে-সঙ্গে তার সম্মতি জানিয়ে দিয়েছে উকিলকে। শ্রীপর্ণা আবার বিয়ে করবে। করুক না।
অনুপম জানে, তাদের বিচ্ছেদের ব্যাপারে তার নিজেরও দোষ ছিল যথেষ্ট। কিছুদিন বেশি মদ্যপান শুরু করেছিল, মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরে কাঁচুমাচু হয়ে থাকার বদলে খুবই রুক্ষ ব্যবহার করত শ্রীপর্ণার সঙ্গে। কোন স্ত্রী তা সহ্য করবে মাসের-পর-মাস? একবার নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আছাড় খেয়ে সাংঘাতিকভাবে মাথা ফাটিয়েছিল অনুপম।
শ্রীপর্ণা রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও অনুপম ক্ষমা চায়নি, তাকে ফিরিয়ে আনতে যায়নি। বরং ভেবেছিল আত্মহত্যার কথা।
সে অবস্থাটা কাটিয়ে উঠেছে অনুপম। এখন আর অত মদ খায় না। আত্মহত্যার কথাও ভাবে না। কিন্তু শ্রীপর্ণা অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাকে বিয়ে করতে চলেছে, অনুপমের কোনও বান্ধবী নেই। ইচ্ছে করলেই সে একাধিক নারীকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠতে পারত। শ্রীপর্ণার নিজেরই পিসতুতো বোন দীপা ঘনঘন আসতে শুরু করেছিল তার বাড়িতে, দীপাও ডিভোর্সি, তাকে ভালোও লাগত অনুপমের। কিন্তু দীপা খেলা চায়নি, সংসার চেয়েছে। একজনকে ডিভোর্স করে তারই বোনকে বিয়ে করার ব্যাপারটা অরুচিকর বোধ হয়েছিল অনুপমের।
তার শরীরের চাহিদা ছিল, মন টানেনি।
এই মহিলাটি কে? চোখ দুটি টানা-টানা, গভীর দৃষ্টিতে কিছু কি বলতে চেয়েছিল?
এ-দেশের পুরুষদের একলা থাকার সুযোগ দেয় না আত্মীয়স্বজনরা।
শ্রীপর্ণা চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই অনুপমের দিদি তাঁর দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে উঠেছিলেন অনুপমের ফ্ল্যাটে। প্রায় মায়ের বয়েসি দিদি, স্বামীর মৃত্যুর পর জলে পড়েননি, জামাইবাবুর অবস্থা যথেষ্ট সচ্ছল ছিল, নৈহাটির শ্বশুরবাড়িতে দিদির দুটি আলাদা ঘর ছিল। সুতরাং দিদি আশ্রিতা হয়ে আসেননি, ভাইকে দেখাশুনো করাবার জন্য এসেছেন। অনুপমের সেটা মোটেই পছন্দ হয়নি, কিন্তু দিদিকে ফিরিয়ে দেবেই বা কী করে?
দিদির ধারণা, তিনিই অনুপমের মদের নেশা ছাড়িয়েছেন। যদিও সেটা মোটেই ঠিক নয়।
সেই মহিলাটির সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল প্রায় একই জায়গায়। বেশ নাটকীয়ভাবে।
আজও বৃষ্টি পড়ছে, তবে তেমন জোরে নয়, অনুপম দাঁড়িয়েছিল হোটেলের পোর্টিকোর নীচে। কাল রাত থেকে তার সামান্য জ্বর এসেছে, মিনিবাসের বদলে ট্যাকসিতেই যাবে ঠিক করেছে।
অনেকক্ষণ ধরে ট্রাফিক জ্যাম, মাঝে-মাঝে ইঞ্চি-ইঞ্চি করে এগুচ্ছে গাড়িগুলো, এসময় ট্যাকসি পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
হঠাৎই একটা ট্যাকসির দিকে চোখ পড়তেই সে দেখল, এক রমণী, অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। সে দিনের সেই নারী।
আজ রমণীটি হাতছানি দিয়ে অনুপমকে ডাকল।
পুরুষের প্রবৃত্তিই এই, কোনও নারীর সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে সে-ই অগ্রণী ভূমিকা নেবে। অচেনা কোনও মেয়ের সঙ্গেও কোনও পুরুষ প্রথম কথা বলতে পারে, কোনও নারীর তা মানায় না। কোনও নারী আগ বাড়িয়ে আগ্রহ দেখালে পুরুষের সন্দেহ হয়।
অনুপমেরও মনে হল, এ মেয়েটা বেশ্যা নাকি?
অনুপম মুখটা ফিরিয়ে নিল।
আবার একটু পরে তাকিয়ে দেখল, তখনও ট্যাক্সিটা এগোতে পারেনি, রমণীটি একইভাবে চেয়ে আছে।
অনুপম এবার ট্যাক্সির কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল, আপনি আমাকে কিছু বলছেন?
আপনি কেমন আছেন?
ভালো আছি। কিন্তু আপনাকে তো…
আপনি তো অনুপম, যদি আমার ভুল না হয়। অনেকটা রোগা হয়ে গেছেন আগের থেকে—
এটা কোনও পথের নারীর সংলাপ নয়। নাম জানল কী করে? সত্যি অনুপম একসময় বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছিল।
আমায় চিনতে পারেননি তো? মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। আপনি কোথায় যাবেন? আপনাকে খানিকটা এগিয়ে দিতে পারি—
রমণীটি ট্যাক্সির দরজা খুলে দিয়েছে।
আর দ্বিধা না করে উঠে পড়ল অনুপম।
তারপরই কথা নেই বার্তা নেই, হুহু করে কেঁদে ফেলল রমণীটি। দুহাতে মুখ ঢাকল।
অনুপমের হতভম্বের মতন অবস্থা। অনেকদিন সে কোনও রমণীকে এত কাছ থেকে কাঁদতে দেখেনি।
একটু পরে রুমাল দিয়ে চোখ মুখে রমণীটি ধরা গলায় বলল, আমি দুঃখিত, হঠাৎ খুব সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছিলাম। এর আগেও এখানে একদিন আপনাকে দেখেছি। সেদিনও কথা
বলার খুব ইচ্ছে হয়েছিল—
আপনি কে?
আমি রুমা। আপনি তো মানসের বন্ধু…
সঙ্গে-সঙ্গে একটা বিদ্যুৎ ঝলক। স্মৃতির গহন থেকে উঠে এল সবকিছু।
মানসের বান্ধবী সেই রুমা? অবশ্য অনুপম রুমা নামটা যতবার শুনেছে, সেই তুলনায় দেখা হয়েছে খুব কম। তাও তো আট-ন বছর আগেকার কথা।
অনুপম বলল, আপনি তো কলকাতায় ছিলেন না।
আপনি আমার খোঁজ করেছিলেন কখনও?
হ্যাঁ। তখন একবার…আপনার এক ভাই আছে না, তপন? তপনই বলেছিল—
আমি একটা চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম সিমলা। কয়েক মাস আগে ট্রান্সফার হয়ে এখানে। এসেছি। আপনি সেই বাড়িতেই আছেন?
সেই বাড়িতেই। মানে, আপনি তো কখনও আমার বাড়িতে আসেননি।
যাইনি, কিন্তু জানি। মানসের কাছে শুনেছি আপনার বাড়িতে খুব আড্ডা হত। যে ঘরে আড্ডা। হত, সেই ঘরটা একবার আমার দেখার ইচ্ছে হয়।
আসবেন একদিন আমার বাড়িতে। আড্ডা অবশ্য অনেকদিন বন্ধ।
এখন আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমার সঙ্গে যাবেন?
কোথায়?
আমি যেখানে থাকি। মানে, এটা আমার নিজের বাড়ি নয়। আমাদের বাড়ি ছিল চন্দননগরে। আমার মামার একটা ফ্ল্যাট আছে যোধপুর পার্কে। মামা সবাইকে নিয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন, ফ্ল্যাটটা খালি পড়েছিল বলে আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন।
কয়েক মিনিট আগেও অনুপম যাকে চিনতে পারেনি, সেই নারী যদি নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, তবে তাকে নির্লজ্জ উপ্যাচিকা মনে হতেই পারে।
কিন্তু অনুপমের তা মনে হল না। মানসের নামের উল্লেখই সব ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে।
অনুপম বলল, চলুন। আমার সেরকম কোনও কাজ নেই এখন। আপনি একা থাকেন?
হ্যাঁ। মা-বাবা চলে গেলেন, দাদারা চন্দননগরেই আছেন।
আপনি আর বিয়ে করেননি?
আর মানে? আমার কি একবারও বিয়ে হয়েছিল?
না, তা নয়।
নাঃ, বিয়ে-টিয়ে করা হয়ে উঠল না। এখন এত বয়েস হয়ে গেছে, ওসব কথা আর ভাবি না। একা থাকা অভ্যেস হয়ে গেছে।
যোধপুর পার্কে পৌঁছতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হল তিনতলায়। সারা বাড়িটাই ফাঁকা মনে হয়। ওপরের সিঁড়ি একেবারে অন্ধকার।
চাবি দিয়ে দরজা খুলে রুমা বলল, সকালে একটি কাজের মেয়ে আসে। ঘর পরিষ্কার করে দেয়। নিজের রান্না নিজেই করে নিই। কাজের লোকের রান্না আমার পছন্দ হয় না। আপনি চা খাবেন তো?
খাব।
সঙ্গে ডিমের ওমলেট করে দিতে পারি।
তার দরকার নেই, শুধু চা হলেই হবে।
আপনি তো ডিম খুব ভালোবাসেন।
অনুপম হাসল। যে রমণীকে সে চিনতে পারেনি, সে তার বাড়ির আচ্ছার কথা জানে। তার খাদ্য পছন্দের কথা পর্যন্ত জানে।
ফ্ল্যাটটি দামি আসবাবপত্রে সাজানো। রুমার মামা বেশ অবস্থাপন্ন বোঝা যায়। বৃষ্টি এখনও বন্ধ হয়নি। বসবার ঘরের একটা জানলা খোলা ছিল, বৃষ্টির ছাঁট এসে মেঝেতে পাতা কার্পেট ভিজিয়ে দিয়েছে।
একটা লম্বা ব্রাশ এনে রুমা সেখানটা পরিষ্কার করতে লাগল।
অনুপম জিগ্যেস করল, রুমা, তুমি কী চাকরি করো?
সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্টসে। আপনি তো সেই ব্যাঙ্কেই আছেন?
হ্যাঁ।
চাকরি ছেড়ে যে ব্যাবসা করার কথা ছিল? তা আর শুরু করলেন না?
আমার একার পক্ষে…নাঃ, আর ইচ্ছেই করল না। তোমাকে আমি চিনতে পারিনি, তার কারণ তোমাকে দেখেইছি খুব কম, তা ছাড়া মাথার চুল এত ছোট করেছ, যতদূর মনে পড়ে তোমার খুব চুল ছিল, কোমর ছড়ানো–
এখন তো কেউই আর বড় চুল রাখে না। চুল কেটে ফেলার অনেক সুবিধে। আমি তো ভাবছি আরও ছোট করব, পুরুষদের মতন। আপনিও তো তখন গোঁফ রাখতেন?
মাথায় চুল কমে গিয়ে যখন টাক পড়তে শুরু করল, তখনই গোঁফটা বাদ দিলাম। টাক মাথায় গোঁফ রাখলে হাস্যকর দেখায়।
আপনার এমন কিছু টাক পড়েনি। চুল পাতলা হয়ে গেছে, কপালটা চওড়া দেখাচ্ছে। তবু কিন্তু আপনাকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছি। শ্রীপর্ণা কেমন আছে?
শ্রীপর্ণার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছিল কখনও?
না। তা হয়নি। আপনি তো কখনও আপনার বাড়িতে আমাকে যেতে বলেননি।
বাঃ! তুমি চন্দননগরের মেয়ে, কলকাতায় কম আসতে। তোমাদের বাড়ি খুব কনজারভেটিভ ছিল, সন্ধের আগেই তোমাকে ফিরে যেতে হয়। তোমাকে আমাদের কফি হাউসের আড্ডাতেই পাওয়া যায়নি, বাড়িতে নিয়ে আসার সময় পেলাম কোথায়? মানসই যখন তখন চলে যেত চন্দননগরে।
দাঁড়ান, চা-টা নিয়ে আসি।
অনুপম সাদা দেওয়ালের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইল।
তার মনটাও যেন ওই দেওয়ালের মতন হয়ে গেছে। এক একটা ছবি ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে সাদা রঙে।
চা নিয়ে এল রুমা। দুটো কাপ দুরকম। রুমারটা কালো, অনুপমের জন্য কাপটা বেশ বড়, নীল রঙের।
রুমা অনুপমের কাপটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওটা কতদিনের পুরোনো। ভাঙেনি কিন্তু। চন্দননগর থেকে সিমলা নিয়ে গিয়েছি, মাঝখানে কিছু দিন চন্ডীগড়ে ছিলাম, সেখানেও, তারপর আমার সঙ্গে কলকাতায় এসেছে।
অনুপম একটা চুমুক দিয়ে কাপটা সাবধানে রাখল টেবিলের ওপর। তার হাতে যেন না ভাঙে। সে বুঝতে পেরেছে।
দেওয়ালে কোনও ছবি নেই।
অপ্রত্যাশিতভাবে রুমা হঠাৎ বলল, আপনার হাতটা আমি একবার ছোঁব? ওই হাতেই তো মাথা রেখে…এর মধ্যেও কোনও নির্লজ্জতা নেই। অনুপম হাতটা বাড়িয়ে দিল। একজন মানুষের জন্য কতজন মানুষের জীবন বদলে যায়।
অনুপমের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল মানস। দুজন পুরুষের মধ্যে যদি সত্যিকারের বন্ধুত্ব হয়, তা হলে তো নারী-পুরুষের সম্পর্কের চেয়েও অনেক গভীর হতে পারে।
একেবারে বাচ্চা বয়েস থেকে মানস আর অনুপম একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। যৌবনে যখন ওরা একসঙ্গে ঘোরাফেরা করত, তখন ওদের সমকামী বলে সন্দেহ করা অস্বাভাবিক ছিল না। প্রতিদিন দুজনের দেখা হতেই হবে।
অনুপমের তুলনায় মানস ছিল অনেক বেশি উচ্ছল, প্রাণবন্ত। পড়াশুনোতেও বেশি ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে দুজনেই চাকরি নিয়েছিল বটে, কিন্তু মানস প্রায়ই বলত, ধ্যাৎ, রোজ দশটা-পাঁচটার গোলামি করে জীবন কাটাব নাকি? ঠিক পাঁচ বছরের মাথায় চাকরি ছেড়ে দেব।
প্রথমে ঠিক করেছিল, দুজনেই বিদেশে গিয়ে আরও পড়াশুনো করবে। দুজনেই আমেরিকার দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতির সুযোগ আর স্কলারশিপও পেয়ে গেল, কিন্তু মানসের যাওয়া হল না। তার মা তখন অন্ধ হয়ে আসছেন, ছেলেকে ছেড়ে তিনি কিছুতেই থাকতে পারবেন না। মানসের যে আর কোনও ভাইবোনও নেই।
মানস যাবে না বলে অনুপম গেল না। মানস অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল, কথা বন্ধ করে দেবে বলে শাসিয়েছিল, নিজে অনুপমের জন্য পাসপোর্টের ফর্ম এনে দিয়েছিল, অনুপম তার জেদ ছাড়েনি। বিদেশে যায়নি বলে তার কখনও অনুতাপ হয়নি।
তারপর দুজন মিলে একটা ব্যবসার পরিকল্পনা করেছিল।
ছোট ব্যাবসা, এক লক্ষ টাকা মূলধন। মানসের দমদমের বাড়িটার একতলায় সাজিয়ে নেওয়া। হয়েছিল কারখানা ও অফিস ঘর। ইনভার্টার বানানো হবে, তখন কলকাতায় ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে। ব্যাটারি-ইনভার্টারের প্রচুর চাহিদা। মানস বিজ্ঞানের ছাত্র, সে দেখবে প্রোডাকশান আর। অনুপম দেখবে হিসেব ও বিক্রি।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে সেই আলোচনা, সেই স্বপ্ন। মোট চারজন কর্মচারী লাগবে, মানস ঠিক করেছিল, তার মধ্যে দুজনকে নেওয়া হবে দমদমের মূক-বধির বিদ্যালয়। থেকে। শিখিয়ে দিলে এক জায়গায় বসে বসে একটা জিনিসের সঙ্গে আর-একটা জিনিস জোড়ার কাজ ওরাও পারবে। দুজন প্রতিবন্ধী পাবে উপার্জনের সুযোগ। ছেলেদুটিকে বাছাও হয়ে গিয়েছিল।
খালি একটা ব্যাপার মানস আর অনুপম করতে পারেনি। বিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই শ্রীপর্ণার সঙ্গে অনুপমের পরিচয়। মানস রুমাকে তারও আগে থেকে চেনে। কিন্তু রুমা ঠিক করেছিল, তার দিদির বিয়ে না হলে সে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না। তার দিদি কিছুতেই ঠিক মানুষটিকে খুঁজে পায় না। এ দিকে শ্রীপর্ণার মা খুবই অসুস্থ ছিলেন বলে তিনি ওর বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনুপম দ্বিধা করলেও মানসই জোর করে ওদের রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করে দেয়। সেদিন কী দারুণ হইচই করেছিল মানস, একগাদা ফুল নিয়ে এসেছিল রেজিস্ট্রারের অফিসে, ছুড়ে-ছুড়ে পুষ্প বৃষ্টি করছিল ওরা দুজনে সই করার সময়। শ্রীপর্ণা আর অনুপমকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, মাথার ওপর একটা রুমাল চাপা দিয়ে বলেছিল, এবার শুভ দৃষ্টি হয়ে যাক!
রুমার দিদি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে ফেলল এক পাঞ্জাবি যুবককে। তারপর আর বাধা রইল না। তবে রুমাদের বাড়ি থেকে শুধু শুকনো রেজিস্ট্রি বিয়েতে আপত্তি ছিল, রীতিমতন ঘটা করে বিয়ে হবে। মন্ত্রট পড়ে, শুভদিন দেখে। নেমন্তন্নর চিঠিও ছাপা হয়ে গেল।
তারপরেই সেই অর্থহীন ঘটনাটা ঘটল। শুধু অর্থহীন নয়, কোনও ব্যাখ্যা নেই। একটা দুর্ঘটনা, কিন্তু এরকম দুর্ঘটনার কথাও কেউ কখনও শোনেনি। একে কি নিয়তি বলা যায়? একটা মূল্যবান জীবনের এমন অপচয়!
ট্রেনে করে দুই বন্ধু ফিরছিল জামশেদপুর থেকে। জুন মাস, প্রচণ্ড গরম, বর্ষা আসবে-আসবে করেও দেরি করছে। কামরাটায় ভিড় ছিল খুব, অনেকেই বসার জায়গা পায়নি, অনুপম আর মানস দাঁড়িয়ে ছিল। খোলা দরজার কাছে। তখন সবসময় ব্যাবসার আলোচনা, ব্যাঙ্ক থেকে। আরও ঋণের ব্যবস্থা করেছে অনুপম, সে জন্য মানস তাদের বাড়িটা বন্ধক রাখার জন্য মাকে রাজি করিয়ে ফেলেছে। ব্যাবসাটা কতখানি সার্থক হবে, তার ঠিক নেই, তবু ঝুঁকি তো নিতেই হবে।
কথার মাঝখানে মানস একবার বলল, দাঁড়া, একবার বাথরুম থেকে আসছি। বাইরের দিকে তাকিয়েছিল, সে ঘুরে দাঁড়াল।
তারপর কী হল, ঠিক বোঝা গেল না।
ভি সি আর-এ ছবি রিওয়াইন্ড করে দেখার মতন দৃশ্যটাকে পরে অন্তত একশোবার দেখেছে। অনুপম। তবু ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি। বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই আর মানসকে দেখা গেল না। পেছন দিক থেকে হাওয়ার ঝাপটা লাগলেও তো এরকম হওয়ার কথা নয়, তবু কী করে সে পড়ে গেল বাইরে? প্রত্যেক দিন কত ট্রেনে কত লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে যায়, কেউ তো পড়ে না, মানসের মতন একজন শক্ত সমর্থ যুবক কেন পড়ে যাবে? সে ভুলোমনা, অসাবধানী ধরনেরও নয়।
অনুপম কিছু বোঝাবার আগেই আরও দু-তিনজন লোক চেঁচিয়ে উঠে চেন টেনে দিয়েছিল। ট্রেনটা থামল খানিকটা দূরে। সেখান থেকে ছুটে আসতে-আসতে অনুপম ভাবছিল, মানসের বড় জোর হাত-পা ভাঙবে, আর কিছু ভয় নেই, সদ্য একটা স্টেশন থেকে ট্রেনটা ছেড়েছে, তখনও গতি খুব বাড়েনি। আর কিছু হতেই পারে না।
কাছে এসে দেখল, মানস চিত হয়ে পড়ে আছে, তার চোখ খোলা, সারা শরীরে কোনও রক্তের চিহ্ন নেই। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে, আকাশটা লাল, সেই লাল রঙের আভা লেগেছে মানসের মুখে, রক্ত নয়। অনুপম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভেবেছিল, যাক, বিশেষ কিছু হয়নি।
অনুপম বসে পড়ে মানসের মাথাটা কোলে তুলে নিল। জিগ্যেস করল, কী রে, কোথায় লেগেছে? বেশি লাগেনি তো?
মানস বলল, অনুপম, এ কী হল রে? রুমার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না?
সেটাই মানসের শেষ কথা।
আরও অনেক যাত্রী নেমে দৌড়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে বলেছিল, সুইসাইড। সুইসাইড। আই হ্যাভ সিন ইন মাই ওন আইজ। ভদ্রলোক ইচ্ছে করে লাফিয়ে পড়লেন।
একদম বাজে কথা। একজন সুস্থ, সবল মানুষ, যার চোখে ভবিষ্যতের অনেক স্বপ্ন, যে তার অনেকদিনের প্রণয়িণীকে বিয়ে করতে যাচ্ছে আর সতেরো দিন পর, ব্যাবসা শুরু করার সব ঠিকঠাক, ঘনিষ্ঠতম বন্ধু তার পাশে দাঁড়িয়ে, সে হঠাৎ আত্মহত্যা করতে যাবে কেন?
একটা জীবনের জন্য কতগুলো জীবন নষ্ট হয়ে যায়।
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি, বাবা-মায়ের জীবিত অবস্থায় সন্তানের মৃত্যু। মানসের মা আর বেশিদিন বাঁচেননি। ইনভার্টারের ব্যাবসা আর শুরুই হল না। মূক-বধির ছেলে দুটির জীবিকার সুযোগ নষ্ট হয়ে গেল। অনুপম তার পর থেকেই প্রচণ্ড মদ্যপান শুরু করে। তার ফলেই তার বিবাহ-বিচ্ছেদ। আর রুমা, রুমার সঙ্গে দেখা করার সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি অনুপম, ওদের চন্দননগরের বাড়িতে একবার গিয়েছিল বটে, রুমাই তখন কারুর সঙ্গে কথা বলছিল না।
তারপর অনুপম কখনও রুমার খোঁজ করেনি। একটা অপরাধবোধ তাকে পেয়ে বসেছিল, সে দাঁড়িয়েছিল মানসের একেবারে পাশে, সে কোনওরকমে মানসকে বাঁচাবার চেষ্টা করেনি কেন? তারই হাতের ধাক্কা লেগে কি মানস পড়ে গিয়েছিল? সেরকম ধাক্কা লাগেনি। তবু লোকে তো এরকম ভাবতেই পারে!
এতদিন পর রুমার সঙ্গে দেখা, রুমাই প্রথম কথা বলেছে তার সঙ্গে।
অনুপমের হাতটা একবার ছুঁয়ে রুমা একটু দূরে গিয়ে বসল।
এতক্ষণের মধ্যে সে আর রুমা কিন্তু একবারও মানসের নাম উচ্চারণ করেনি।
কিন্তু মানস যেন উপস্থিত রয়েছে সেখানে। রুমার সঙ্গে অনুপমের একমাত্র যোগসূত্রই তো মানস। দুজনের দৃষ্টির আড়ালে অব্যক্ত মানস যে-দুজন মাত্র মানুষ মানসকে সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছে, মানসের জন্য যাদের জীবন বদলে গেছে, তারা আজ মুখোমুখি।
কে-কাকে সান্ত্বনা দেবে? ওরা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। নিস্তব্ধতা দিয়ে ওরা তর্পণ করছে মানসের।
বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই, এখানে কতক্ষণ বসে থাকবে অনুপম?
সে উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল। কাচের শার্শিবন্ধ। বাইরে প্রায় কিছুই দেখা যায় না। শুধু কাচের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা লাগার শব্দ হচ্ছে।
আমি এবার যাই, রুমা?
আপনি চায়ের সঙ্গে কিছুই খেলেন না। রাত্তিরে খেয়ে যাবেন আমার সঙ্গে? একটু মাংস রান্না করা আছে।
না, আজ থাক। আর-একদিন না হয় আসব।
আচ্ছা।
দরজার কাছে জুতো খুলে রেখেছে অনুপম। সেখানে এসে সে জুতোর ফিতে বাঁধতে লাগল। রুমা কাছে এসে বলল, আবার একদিন…অনেকক্ষণ।
কথা শেষ করতে পারল না, দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে সে কেঁদে উঠল। এতগুলি বছর পরেও এত কান্না জমে আছে তার? ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কাঁপছে সারা শরীর।
এইরকম অবস্থায় একটি নারীকে ফেলে চলে যাওয়া যায়? অথচ কী কথা বলবে সে। তারও চোখ জ্বালা করে উঠছে।
সে রুমার পিঠে হাত রাখল।
সঙ্গে-সঙ্গে রুমা ঘুরে দাঁড়িয়ে অনুপমের বুকে চেপে ধরল তার মুখ। অনুপমের জামা ভিজে যাচ্ছে।
দুই করতলে বৃষ্টিভেজা ফুলের মতন রুমার মুখখানি ধরে বলল, আর কেঁদো না, শান্ত হও—
রুমা মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। মুখখানা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ঠোঁট দুটিতে এ কীসের। ব্যাকুলতা! এসময় ওই ওষ্ঠাধর একটি চুম্বন দাবি করে। একমাত্র চুম্বন দিয়েই রমণীটির কান্না থামানো যায়।
একথা অনুপমেরও মনে পড়ল, নিজের মুখটা নামিয়ে আনতে গিয়েও থমকে গেল। এ কী করছে সে? মানসের দয়িতাকে চুমু খাবে, এর চেয়ে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা আর হতে পারে? রুমাও। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে?
রুমার দু-কাঁধ চেপে ধরে রুক্ষ স্বরে সে বলল, এ কী করছ? চোখ মুছে ফেলো। ওখানে গিয়ে বসো।
রুমাকে সে টানতে-টানতে এনে বসিয়ে দিল সোফায়। এবং তার অসাবধানে কনুইয়ের পাশের টেবিলে রাখা নীল কাপটা মাটিতে পড়েগিয়ে ভাঙল ঝনঝন শব্দে।
অনুপম মেজাজ শান্ত করে অপ্রস্তুত অবস্থায় বলল, ইস, তোমার এতদিনের কাপটা ভেঙে ফেললাম!
নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে রুমা। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল, তাতে কিছু হবে না, একদিন-না-একদিন তো ভাঙতই।
কিন্তু নিজের ওপর আবার হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেছে অনুপমের। এসময়ে তার ভাষার মাত্রাজ্ঞান থাকে না।
সে বলল, শোন রুমা, একটা স্পষ্ট কথা বলি। মানস নেই, এটা একটা চরম সত্যি। তাকে আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু তার জন্য বছরের পর বছর, এরকমভাবে বসে থাকা অস্বাস্থ্যকর। অ্যাকসিডেন্টের ওপর তো মানুষের কোনও হাত নেই। এটা আমাদের মেনে নিতেই হবে। এখন তার জন্য সবসময় তোমার কান্নাকাটি করা…কেন নিজের জীবনটা নষ্ট করবে? সহজ হও, স্বাভাবিক হও!
রুমা আড়ষ্টভাবে বলল, তাই তো হয়েছি।
না, হওনি। তোমার আবার বিয়ে করা উচিত ছিল।
আবার বিয়ে? অনেক মেয়ে তো চাকরি করে। একা-একা জীবন কাটায়।
তাদের কথা আলাদা। তুমি শুধু-শুধু স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে আছ! হ্যাঁ মাঝে-মাঝে তো মনে পড়বেই, তবু নিজের জীবনটা…তোমার সঙ্গে আমার দেখা না হলেই ভালো ছিল, আবার পুরোনো দুঃখ উথলে উঠবে। আমার আর না আসাই ভালো, তুমি আর রাস্তাঘাটে আমাকে ডেকো না—
আচ্ছা! আর ডাকব না।
ঝট করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল অনুপম।
রাস্তায় বেরিয়ে অনেকদিন পর তার আবার মদ্যপানের তীব্র ইচ্ছে জেগে উঠল। এখন দোকান বন্ধ হয়নি, একটা বোতল কিনে নিয়ে এল বাড়িতে।
দিদির সঙ্গে ভালো করে কথাও বলল না। রাতে কিছু খাব না বলে দরজা বন্ধ করে দিল নিজের ঘরের।
এখন রাগে তার গা জ্বলছে। কীসের জন্য রাগ?
নীল রঙের কাপটা নিশ্চয়ই মানসের ছিল। সেটা সে ভেঙে ফেলেছে।
কে যেন ফিসফিস করে বলল, ভেঙেছিস, বেশ করেছিস। তুই ভাঙলে কি আমি রাগ করতে পারি?
মানস!
অনুপম এবার হাসল। এখন সে হয়তো মানসকে দেখতেও পারে। আগেও মদ খেয়ে খুব নেশা করার পর মানসের কথা শুনতে পেত, মানস এসে তার পাশে দাঁড়াত।
অনুপম ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে না। আত্মার অবিনশ্বরতায় তার একটুও আস্থা নেই। সে জানে, মানস আর কোথাও নেই, একটা অত্যন্ত বাজে দুর্ঘটনায় সে চিরকালের মতন হারিয়ে গেছে।
কিন্তু মানস রয়ে গেছে তার মনের মধ্যে। সে-ই মানসকে ফিরিয়ে আনে, তাকে দিয়ে কথা বলায়, মানসকে অবয়ব পর্যন্ত দেয়।
তার মন থেকেই বেরিয়ে এসে মানস তাকে বলে, কেন শুধু-শুধু নিজেকে নষ্ট করছিস অনুপম! ব্যাবসাটা শুরু করলি না? সব ঠিকঠাক ছিল, অন্য পার্টনার নিতে পারতিস! তুই সব ছেড়ে-ছুড়ে কলকাতা থেকে চলে যেতে চাইছিস। কিন্তু তুই তো সন্ন্যাসী হতে পারবি না, তাহলে অন্য কোনওখানে গিয়ে শান্তি পাবি না।
আজ রুমাকে যখন কঠোর কথাগুলো বলেছে, তখন মানস ভেতর থেকে তাকে বাধা দিচ্ছিল।
রুমার চোখে অনুপম আর কিছুই নয়। সে যেন মানসেরই প্রতিমূর্তি। অনুপমের দিকে তাকিয়ে সে মানসকেই দেখছিল।
মদের গেলাসে চুমুক দিয়ে অনুপমের রাগ বাড়তে লাগল। শুধু নিজের ওপরে নয়, রাগ হচ্ছে। মানসের ওপরেও! কেন মানস বোকার মতন অমনভাবে মরল, কেন সে সব তছনছ করে দিয়ে গেল?
জানলায় কাছে এসে দাঁড়িয়েছে মানস। তার প্রিয় জিনসের শার্ট গায়ে। চুল ঠিক মতন আঁচড়াত না কোনওদিন।
অনুপম বলল, তুই আর কোথাও নেই রে মানস। আমি জানি। এই জানাটাও যে কত কষ্টের!
মানস হাসছে।
অনুপম বলল, আমিই তোর এই চেহারাটা তৈরি করেছি। তোকে যে আমি দেখতে পাচ্ছি, এটাও আমার ইচ্ছে থেকে হয়েছে। কিন্তু তুই কেন হাসছিস, তা তো বুঝতে পারছি না।
মানস বলল, দুঃখের রং কী বল তো অনুপম? সব রংই একসময় সাদা হয়ে যায়। আমিও ভেবেছিলাম আমার সঙ্গেও আর রুমার দেখা হবে না। না দেখা হওয়াই তো ভালো ছিল, তাই না? তবুও দেখা হয়ে গেল। রুমাই নিজে থেকে…।
শুধু রুমা নয়, তুইও ওকে ডেকেছিলি।
আমি ডেকেছিলাম? না, না, আমি তো ওকে চিনতেই পারিনি।
চুল ছোট করে হেঁটে ফেলেছে, তাই প্রথমটায় চিনতে পারিসনি। কিন্তু এর আগে রাস্তার অন্য কোনও মেয়েকে দেখে হঠাৎ তোর রুমার কথা মনে হয়নি?
সেরকম তো হতেই পারে।
শ্রীপর্ণার কথা মনে পড়েনি, অন্য মেয়েকে দেখে রুমার কথাই মনে পড়েছে।
আমি আর রুমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না।
তুই ছাড়া এ পর্যন্ত আর কোনও পুরুষকে রুমা ছোঁয়নি।
সেই জন্যই তো আমার আর দেখা না করা উচিত।
মানস আবার হাসল।
অনুপম টেবিলে এক চাপড় মেরে বলল, হাসছিস কেন? আমি তোকে তৈরি করেছি, তবু হঠাৎ হঠাৎ তোর হাসির কারণ বুঝতে পারছিনা।
কেন আমাকে তৈরি করেছিস অনুপম? বরং আমাকে মুক্তি দে!
ব্লেড দিয়ে কি স্মৃতি চেঁছে ফেলা যায়? না, না, মানস, আমি তোকে কিছুতেই মুক্তি দিতে চাই না। যতদিন বাঁচব, তুই আমার বুকের মধ্যে থাকবি। আর কেউ দেখতে পাবে না। শুধু আর একজন দেখতে পাবে।
বেশি মদ্যপান করলে একসময় ঘুম এসে যাবে, কিংবা জ্ঞান চলে যায়। কিন্তু আজ সে জেগে রইল সারা রাত। মদ খাওয়া বন্ধ করেও কথা বলতে লাগল মানসের সঙ্গে।
ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে-সঙ্গে সে বেরিয়ে পড়ল, একটা ট্যাকসি নিয়ে ছুটে এল যোধপুর পার্কে। কেন এল, তা সে নিজেই জানে না।
সে বাড়িটার সদর দরজা বন্ধ।
অনুপম দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার উলটোদিকে।
খানিকবাদে দুধের বোতল হাতে বেরিয়ে এল একজন কাজের লোক। অনুপম তার পাশ দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।
তিনতলায় এসে দরজায় বেল দেওয়ার পর একটুও অপেক্ষা করতে হল না। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে দরজা খুলে দিল রুমা। একটা শুধু ঢোলা রাত-পোশাক পরা। এর ওপর কিছু চাপা না দিয়ে। কোনও নারী কাজের মেয়েকেও দরজা খোলে না।
প্রথমে কিছুই বলতে পারল না অনুপম।
পাজামার ওপর শার্ট পরা, অনুপম বাইরে বেরুবার মতন পোশাক পরেনি। চুল আঁচড়ায়নি, দু চোখের নীচে কালি, ছাই রঙের মুখ।
রুমাই তার দু-হাত ধরে বলল, এসো।
খসখসে গলায় অনুপম বলল, আমি কিছুতেই মানসের জায়গা নিতে পারব না তোমার কাছে। সেই কথাটাই বলতে এলাম।
ম্লান, দুঃখী গলায় রুমা বলল, তুমি ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই!