তোমাদের কী হবে
ভয়ঙ্কর একটা উদ্বেগের নাম শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর উদ্বেগ আমাদের নিয়ে তোমাদের কী হবে! তোমাদের জীবনের ধরনটা কি করে একটু পালটাবে। উন্নত জীবনের সন্ধান তোমরা কি করে পাবে! বেঁচে থাকার আনন্দ! হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে কিভাবে একটু আলো ঢোকাবে! নিজের সাধনা, নিজের মুক্তি, নিজের ঈশ্বরদর্শনের চেয়ে এই ভয়ঙ্কর উদ্বেগটাই তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল এক মহা আবেগ। তিনি আমৃত্যু ছটফট করেছেন, নিজেকে ক্ষয় করেছেন, জ্বালিয়ে দিয়েছেন। একটা স্বঘোষিত যুদ্ধে তিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। যুদ্ধটা ছিল তামসিকতা, পাশবিকতা জড়বাদের বিরুদ্ধে। তোমরা নিজেদের নষ্ট করে ফেল না। এলে, খেলে, মরে গেলে—এই নিয়তিটাকে মেনে নিও না। সমাজ, অর্থনীতি, ইতিহাস, রাজনীতি, মানুষের হাতে মানুষের নিগ্রহ- সব মিলিয়ে যে-পৃথিবী, তার মধ্যে এসে পড়েছ, পালাবার পথ নেই ঠিকই; কিন্তু জায়গা একটা আছে, যেটা রপ্ত করে নিতে পারলে এরই মাঝে আনন্দে থাকতে পারবে। জলে কুমির আছে, হাঙর আছে। গায়ে কি মেখে নামলে তুমি আক্রান্ত হবে না? সেটা কি? সংসার ছেড়ে সবাইকে সন্ন্যাসী হয়ে পালাতে বলছি না। সংসারের দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে যারা সংসার ত্যাগ করে তারা ‘এস্কেপিস্ট’। ‘এস্কেপিস্ট’ যারা তারা ভীরু। ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’– এই কায়দার কথাটি বলে গেরুয়া ধারণ করে তুমি পলায়ন করতে পার, ফলটা কি হবে? ‘ফ্রম ফ্রায়িংপ্যান টু ফায়ার।’ কড়া থেকে আগুনে। বেদ, বেদান্ত, শঙ্কর, বুদ্ধ, শাস্ত্র তুমি পড়তে পার, তাতে তোমার কিছুই হবে না। শাস্ত্ৰদৰ্শন করতে হবে। সেই সত্যই সত্য, সে-সত্য তুমি উপলব্ধি করেছ। অন্যের উপলব্ধি নয়।
সুন্দর একটি উপমা দিলেন ঠাকুর—”যেমন টিয়াপাখি এমনি সমস্ত দিন রাধাকৃষ্ণ বলে, কিন্তু বেড়ালে যখন ধরে তখন রাধাকৃষ্ণ ভুলে গিয়ে নিজের বোল ক্যাঁ ক্যাঁ করতে থাকে।” তাহলে উপায়! সংসাররূপ কাঁঠালটিকে জ্ঞানরূপ তেল হাতে মেখে ভাঙতে হবে। ‘বিবেক হলদি’ গায়ে মেখে জলে নামলে হাঙর, কুমির ধরতে পারবে না।
‘ফিলজফি’ শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দের সমন্বয়—’ফিলোস’ (Philos) এবং ‘সোফিয়া’ (Sophia)। ‘লাভ অ্যান্ড উইজডম।’ অর্থাৎ ‘লাভ অফ উইজডম।’ জ্ঞানকে ভালবাসা। শ্রীরামকৃষ্ণ এই একটি কথার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে প্রথম দর্শনের দিনেই শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অহঙ্কারের দাঁত ভেঙে দিয়েছিলেন। একটিমাত্র প্রশ্ন, একটু বিরক্তভাবেই—”আর তুমি জ্ঞানী?” কথামৃতকারের অন্তর্জগতে ঝড় উঠল, নিজের দিকে তিনি বিচারের আলো ফেললেন। ‘সেলফ অ্যানালিসিস।’ জ্ঞান কাকে বলে! উত্তর, এখনো পর্যন্ত জানি, লেখাপড়া শিখলে ও বই পড়তে পারলে জ্ঞান হয়। শ্রীরামকৃষ্ণে এসে তিনি বুঝলেন, এই জানাটা আসলে অজ্ঞান। তাহলে জ্ঞান কি? ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান, ঈশ্বরকে না জানার নামই অজ্ঞান।
এইবার আরেক সংশয়—ঈশ্বর কি? কঠিন প্রশ্ন। আমি জানি, আমি দেখেছি, কিন্তু তোমাকে দেখাই কি করে? “কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে না পায় দরশন।” শাস্ত্র আলোচনায় তো হবে না। কূটকচালে, তর্কেও তো হবে না। পথটা যে ভিন্ন। সহজ অথচ শক্ত। ভয়ঙ্কর একটা ব্যাকুলতা চাই। “ব্যাকুলতা হলেই অরুণ উদয় হলো। তারপর সূর্য দেখা দিবেন। ব্যাকুলতার পর ঈশ্বরদর্শন।” ব্যাকুলতা, সে আর এমন শক্ত কি? শ্রীরামকৃষ্ণ সেই ব্যাকুলতা জানতেন বলেই শ্রীমকে একটা ধারণা দিতে পেরেছিলেন সহজ উদাহরণে— “তিন টান একত্র হলে তবে তিনি দেখা দেন—বিষয়ীর বিষয়ের ওপর, মায়ের সন্তানের ওপর আর সতীর পতির ওপর টান।” কাঁদতে হবে, ছটফট করতে হবে। শ্রীরামকৃষ্ণের আক্ষেপ : “মাগ-ছেলের জন্যে লোকে এক ঘটি কাঁদে, টাকার জন্যে লোকে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়, কিন্তু ঈশ্বরের জন্যে কে কাঁদছে!” আরেকটা পথ আছে, সেটা হলো—এদিক থেকে ওদিকে যাওয়া। পথটা হলো বিচারের পথ। সেটা কেমন! নিজেকে চেনো, তাহলে ভগবানকে চিনতে পারবে। ‘আমি কে’ ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়—”আমি বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি–এর কোটা ‘আমি’? যেমন প্যাজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার করলে ‘আমি’ বলে কিছুই পাইনে। শেষে যা থাকে, তাই আত্মা— চৈতন্য। ‘আমার’ ‘আমিত্ব’ দূর হলে ভগবান দেখা দেন।”
সন্দেহবাদী মাস্টারমশাই ভাবছেন, সেটা তো ‘হ্যালুসিনেশন’ হতে পারে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : “তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনা করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয়—তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ। সেই চক্ষে তাঁকে দেখে, সেই কর্ণে তাঁর বাণী শুনা যায়। আবার প্রেমের লিঙ্গ যোনি হয়।” আরেকটু পরিষ্কার করলেন এই বলে : “তাঁকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁকে চারিদিকে দেখা যায়, যেমন—প্রদীপের শিখার দিকে যদি একদৃষ্টে চেয়ে থাক তবে খানিকক্ষণ পরে চারিদিক শিখাময় দেখা যায়।”
এইতেই মাস্টারমশাইয়ের মনে খটকা—সে-শিখা তো সত্যকার শিখা নয়। শ্রীরামকৃষ্ণ অন্যের মনের মধ্যে ঢুকে যেতে পারতেন। মাস্টারমশাইয়ের মনের কথাটি পড়ে ফেলে বলছেন : “চৈতন্যকে চিন্তা করলে অচৈতন্য হয় না। শিবনাথ বলেছিল, ‘ঈশ্বরকে একশবার ভাবলে বেহেড হয়ে যায়।’ আমি তাকে বললাম, “চৈতন্যকে চিন্তা করলে কি অচৈতন্য হয়? “তোমাদের চৈতন্য হোক”–এইটিই ছিল তাঁর একমাত্র কামনা। বলছেন—সিদ্ধিলাভ, ঈশ্বরদর্শন, সমাধি—ওসব এখন তোলা থাক। অলৌকিক শক্তিলাভ, সিদ্ধাই— ওসব দুপয়সার বিদ্যে। আমার বিচারে মানুষের দুটো বিভাগ—মানুষ ও মানহুঁশ যাঁরা ভগবানের জন্য ব্যাকুল, তাঁদের ‘মানহুঁশ’ বলে; আর যারা কাম- কাঞ্চনরূপ বিষয় নিয়ে মত্ত তারা সব সাধারণ মানুষ। আমি মানুষকে ‘মানহুঁশ’ করতে এসেছি—সন্ন্যাস দিতে আসিনি, সম্প্রদায় তৈরি করতে আসিনি।
পাকা মেজর জেনারেলের মতো ব্যাটলফিল্ডটা দেখে নিলেন আগে। কাল, সামাজিক অবস্থা, প্রাচ্যে আসছে পাশ্চাত্যের তরঙ্গ, জড়বিজ্ঞান ঢুকছে, ভোগের উপকরণ বাড়ছে, ‘জেনারেশন গ্যাপ’ তৈরি হচ্ছে, বিশ্বাসের আধারে তর্ক লাফাচ্ছে, একদল শিক্ষিত হচ্ছে, বড়লোক হচ্ছে, আরেক দলের দারিদ্র্য বাড়ছে, মানুষ ক্রমশই বেহুঁশ হচ্ছে, হিন্দুধর্ম কদাচারে বিকৃত হচ্ছে। পরিপূর্ণ রণাঙ্গনটা আগে দেখে নিলেন। একে সামরিক ভাষায় বলে—’রেকনেসেন্স’। সমাজের যারা মাথা তাদের কাছে নিজেই গেলেন, নাড়াচাড়া করে দেখলেন। সমস্ত ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশলেন, কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেন, গড়ের মাঠে বেলুন ওড়া দেখলেন, গিরিশের থিয়েটার দেখলেন, বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করলেন, কেশব সেনের সঙ্গে কুক সাহেবের জাহাজে ভ্রমণ করলেন। সমাজের ‘হচপচটা’ সম্পূর্ণ উপলব্ধি করলেন আগে। এইবার লড়াই। এবারেও তাঁর ভূমিকা পার্থসারথির। পার্থ নরেন্দ্রনাথ। সাকার, নিরাকার রূপ, অরূপের দ্বন্দ্ব ছাড়। ‘সোহহম্’ বলার অধিকারী এই মায়ার জগতে কেউ নেই। ‘আমি’ থাকলে ‘তুমি’ আছে। নরেন্দ্রনাথকে দাবড়ে দিলেন—সমাধি! এত স্বার্থপর তুমি! সামনে তাকাও, দেখ আমার দৃষ্টিতে। মানুষের নতুন জাতিভেদ – বদ্ধ, মুমুক্ষু, মুক্ত, নিত্য। দেখ ধনী, দরিদ্র, পণ্ডিত, পণ্ডিতমূর্খ ও মূর্খ। প্রথম কথা— ‘খালি পেটে ধর্ম হয় না।’ দরিদ্রকে বল—কর্মই ধর্ম। ধনীকে বল—বিলিতি চ্যারিটি নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা, সেইটাই তোমার সাধনা। মুমুক্ষুকে বল— বহুরূপে সম্মুখে তোমার, সাধুসঙ্গ কর, তোমার আরাধ্য জ্যান্ত নারায়ণ। মুক্তকে বল বদ্ধকে পথের সন্ধান দিতে। খোঁচা মারতে মারতে যদি একটু চৈতন্য আসে। উট দেখাও। কাঁটাগাছ আহার। রক্তাক্ত। যৌবন যদি ভোগে যায়, বার্ধক্যে পরিবারের লাথি। আমি ঈশ্বরকে দর্শন করেছি, করেছি বলেই সকলের মধ্যে আমি নিজেকে দেখেছি। ‘কসমিক কনসেপশন।’ বদ্ধ কিন্তু মুক্ত—এইটাই আমার ধর্ম। নির্জনে নিজেকে নিয়ে নাড়াচাড়াই হলো সাধনা। যাওয়ার আগে নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন—এরা রইল, দেখিস। শ্রীরামকৃষ্ণকে বুঝতে হলে বিবেকানন্দে আসতে হবে। জাগ্রত বিবেকই হলো আনন্দ। ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ শুনেছি শিকাগোয়—”I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance.” বড় উদ্বেগ নিয়ে তিনি গেছেন। লীলাসংবরণের আগে মাস্টারমশাইকে বলেছিলেন : “শরীরটা কিছুদিন থাকত, লোকদের চৈতন্য হতো।”