তেরো মিনিটের বেশি সময় তাঁর নষ্ট করিনি
উনিশ শশা চৌষট্টি সালের আগস্ট মাস, এক বাঙালি বেকার ছোঁকরা আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছে। হ্যাঁ বেকার তো বটেই, আমি চাকরি-বাকরিতে জলাঞ্জলি দিয়ে সাগর পাড়ি দিয়েছিলুম। তখনও বিয়েটিয়ে করিনি, ঝাড়া হাত-পা, ভেবেছিলুম যত দিন খুশি ওই দেশে থেকে যাব। এখনকার আমেরিকার সঙ্গে তখনকার আমেরিকার অনেক তফাত, এখন আমেরিকা অনেকটা চুপসে গেছে, অর্থনীতিতে মার খাচ্ছে, জাপানের কাছে, বেকারের সংখ্যা অনেক, আর সেই ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমেরিকা ঐশ্বর্যে গর্বে মটমট করত, চাকরি-বাকরি অঢেল, ভিসার কড়াকড়ি ছিল না, আমি অন্তত বছর পাঁচেক থেকে যেতে পারতুম অনায়াসে। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, অনভ্যাসের ফোঁটা কপালে চচ্চড় করে, আমার আমেরিকা সহ্য হল না, বছর খানেক কাটতে না কাটতেই মন ছটফটিয়ে উঠল। অকস্মাৎ তল্পিতল্পা গুটিয়ে, যা থাকে কপালে বলে দিলুম দেশের দিকে লাফ।
ফেরার পথে লন্ডন। সেখানকার কোনও বাঙালিকে তখন চিনি না, পকেটে পয়সাকড়ি বিশেষ নেই, কিন্তু আছে একটি রাজকীয় নেমন্তন্ন। কমনওয়েলথ-এর কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে এ দেশের কিছু কিছু সাংবাদিক-সাহিত্যিককে বিলেত ঘুরিয়ে আনার ব্যবস্থা ছিল তখন। সেই সুবাদে আমি বিলেতফেরত, যদিও আমার বেলায় ব্রিটিশ সরকারের কিছু অর্থ সাশ্রয় হল, আমার জন্য যাতায়াতের ভাড়া দিতে হল না, কিন্তু একজন নিমন্ত্রিতের সংখ্যা বাড়ল।
হোটেলে পৌঁছবার পর সরকারি প্রতিনিধি আমাকে দশ দিনের সফরসূচি দেখালেন। সকাল বিকেল ঠাসা প্রোগাম। উইন্ডসর দুর্গ, লন্ডন গম্বুজ, মহাশয়া তুসোর নোম সংগ্রহশালা, সন্ত পলের ক্যাথিড্রাল, হাউস অব কমনসে একবেলা, স্ট্রাটফোর্ড-অন-আভন, একটি শেক্সপিয়ার ও একটি আধুনিক নাটক, এই সবই বেশ চমৎকার। সখের ভ্রমণকারীরা যা দেখে, আমি বিনা পয়সায় সেগুলি দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছি, কিন্তু এর মধ্যে দুটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা দেখে আমি আঁতকে উঠলুম, স্টিফেন স্পেন্ডার এবং টি এস এলিয়ট। ইংরিজি কাব্যের এই দুই মহারথীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার ছিল না। আমি বিখ্যাত ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে কদাচ যেতে চাই না। তার কারণ, একই সঙ্গে আমার লাজুকতা এবং গোপন অহংকার। সরকারি প্রতিনিধিকে আমি অনুরোধ করলুম, ওই দুটি সাক্ষাৎকার বাদ দিতে, তিনি ভুরু কপালে তুলে বললেন, অনেক আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে, এখন বাদ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া, ওঁরা সহজে সময় দিতে চান না, যখন রাজি হয়েছেন, সে সুযোগ গ্রহণ করতে আপনি অরাজি কেন? আমি বললুম, আমি ওদের সময় নষ্ট করতে চাই না, তা ছাড়া আমি ব্যক্তিপূজক নই, খ্যাতনামা ব্যাক্তিদের কাছে যাওয়া কিংবা তাঁদের সঙ্গে কথা বলার কোনও আগ্রহ আমার হয় না, ওঁদের দুজনকে আমি লেখার মধ্য দিয়ে যতখানি চিনি, তাই-ই যথেষ্ট। সরকারি আমলাটি তবু সফরসূচি বদলালেন না।
টি এস এলিয়টের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা ফেবার অ্যান্ড ফেবার অফিসে, স্টিফেন স্পেন্ডারের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে হবে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে একটি নামকরা রেস্তোরাঁয়। দ্বিতীয় দিন প্রচুর ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে আমার হোটেলে ফিরেছি, রাত এগারোটার একটু পরে কাউন্টারের কর্মচারীটি বেশ সচকিতভাবে বললেন, আপনার জন্য মিঃ স্পেন্ডার অপেক্ষা করছেন। অত রাতে লাউঞ্জ ফাঁকা, একটি সোফায় একজন মাত্র ব্যক্তিই বসে আছেন, এক শুভ্রকেশ প্রৌঢ়, স্টিফেন স্পেন্ডার! আমি হতবাক।
নিউ ইয়র্কে একটি ভোজসভায় স্টিফেন স্পেন্ডারের সঙ্গে আগেই দেখা হয়েছিল বলে মুখ চেনা ছিল, আমি তাঁর দিকে এগিয়ে যেতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করে অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, আমি তোমার কাছে মার্জনা চাইতে এসেছি, আগামীকালের লাঞ্চ অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে পারছি না, বিশেষ কাজে প্যারিস যেতে ইচ্ছে, আশা করি তুমি কিছু মনে করবে না।
এই সামান্য ব্যাপারটা তিনি লোক মারফত কিংবা টেলিফোনে জানাতে পারতেন, এমনকী হোটেলের কাউন্টারে একটা নোট রেখে যেতে পারতেন, সেসব না করে তিনি নিজের মুখে কথাটা আমাকে জানাবার জন্য অত রাত্রে হোটেলে এসে বসে আছেন! আমার অদ্ভুত অনুভূতি হল। কবিদের সম্পর্কে লোকের ধারণা, তারা মদ্যপ, বোহেমিয়ান ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়, কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠিত কবি যে এমন ভদ্রও হতে পারেন তা যেন প্রথম জানলুম।
এই অ্যাপয়েন্টমেন্টটি বাতিল হওয়ায় আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। সাহেবি লাঞ্চ খেতে অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে, অতক্ষণ ধরে আমি স্পেন্ডার সাহেবের সঙ্গে কী কথা বলতুম? এখন এলিয়ট সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটিও কোনওরকমে এড়ানো যায় না? এলিয়ট সাহেব বিদেশে বেশি যান না জানি, কিন্তু ওঁর তো অন্তত জ্বরও হতে পারে।
নির্দিষ্ট দিনে কাঁটায়-কাঁটায় সকাল সাড়ে দশটায় আমার সফরসঙ্গী এসে হাজির, টি এস এলিয়টের অফিসে পৌঁছতে হবে এগারোটায়। তিনি তখন ফেবার অ্যান্ড ফেবার নামে প্রকাশক সংস্থার অন্যতম পরিচালক। কিছুদিন আগেই সেই সংস্থা থেকে পাঁচজন তরুণ কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। এটা একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কারণ, বড় বড় প্রকাশনালয়গুলি তরুণদের কবিতার বই ছাপতে চায় না। সেই পাঁচটি বই ছাপা হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে অর্থাৎ সেগুলি মোটামুটি বিক্রি হলে অন্যান্যদের বইও ছাপা শুরু হবে।
যতদূর মনে পড়ে, সেই পরীক্ষা সফল হয়নি, সেই পাঁচজনের মধ্যে টম গান ছাড়া অন্যরা পরে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি।
ঘরখানি সরু লম্বাটে। টেবিলটি বেশ ছোট, কাগজপত্রের ভিড় নেই, একপাশে কিছু বই ও না খোলা চিঠিপত্র। পাতলা চেহারার এলিয়ট সাহেব মগ্ন হয়ে কিছু পড়ছিলেন, উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে অত্যন্ত নীচু গলায় বললেন, হাউ ডু ইয়ু ডু?
আমার সরকারি সফরসঙ্গী গড়গড় করে মুখস্থ বলার মতন উচ্চারণ করতে লাগলেন আমার পরিচিত। জানাবার মতন কিছুই নেই, শুধু এলেবেলে কথা। তারই মধ্যে আমি ‘কৃত্তিবাস’ নামে একটি কবিতার পত্রিকা সম্পাদনা করি শুনে তিনি সামান্য কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করলেন, কবিতার কাগজ? শুধু বাংলা কবিতা? আমি বিনীতভাবে বললুম, খুবই ছোট কাগজ, অনিয়মিত, মাত্র সাড়ে সাত শো ছাপা হয়। উনি স্বগত চিন্তার ভঙ্গিতে বললেন, সাড়ে সাত শো, সাড়ে সাত শো, নট ব্যাড….।
এর পর চলল টুকিটাকি কথাবার্তা। নিছক মামুলি, শুধুই বলার জন্য বলা, এই ধরনের স্মল টক একেবারে অর্থহীন, অকারণে একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সময় নষ্ট। আমি মনে মনে খুবই
অস্বস্তি বোধ করছি। কলকাতায় সেই আমলে টি এস এলিয়ট অনেকেরই আরাধ্য দেবতা, যে কোনও সাহিত্যঘটিত প্রসঙ্গে এলিয়টের দু-চার লাইন কোটেশন অবধারিত, কফি হাউসের বুদ্ধিজীবীরা যখন তখন দু-এক পঙক্তি এলিয়ট আওড়ায়, এ হেন কবির সামনে বসে থেকেও আমার আহামরি ভাব হল না, খালি মনে হচ্ছে কখন উঠব।
একজন মহিলা, কিংবা একইরকম পোশাকের একাধিক মহিলা এরই মধ্যে দু-তিনবার টকটক করে হাইহিলের শব্দ তুলে ঘরের মধ্যে এসে নিম্নগলায় কবিকে কী যেন বলে চলে যাচ্ছে। ‘ইন দা রুম দা উইমেন কাম অ্যান্ড গো টকিং অফ মিকেলাঞ্জেলো’!
একটি সুদর্শন যুবক এসে চা দিয়ে গেল আমাদের। আমি মনে মনে ভাবলুম, চা শেষ করেই উঠে পড়া যাবে। আমি সরাসরি এলিয়টের চোখের দিকে চাইছি না, তিনিও তাঁর দৃষ্টির মধ্যে মন দিচ্ছেন না।
‘দা আইজ আর নট হিয়ার / দেয়ার আর নো আইজ হিয়ার’…।
একটা সময়ে আমরা দুজনেই চুপ। খুবই অস্বস্তিকর নীরবতা। আমার দিক থেকে একটা কিছু বলা উচিত, তাই আমি হঠাৎ মনে-পড়া ভঙ্গিতে বললুম, বাংলায় আপনার কবিতার অনুবাদের বই বেরিয়েছে, আমাদের বিখ্যাত কবি বিষ্ণু দে অনুবাদ করেছেন, আপনি জানেন? এলিয়ট মৃদু হেসে বললেন, জানি। ভি ডে! ভিষ্ণু! ব্রাহামা-ভিষ্ণু-শিভা…এই ট্রিনিটি। আচ্ছা, তুমি বলতে পারো, ভিষ্ণু আর শিভার অনেক ভক্ত আছে, তাদের মন্দির আছে, প্রতিদিন এই দুই দেবতার পুজো হয়, কিন্তু ব্রাহমা-ও এদের সমান হলেও মন্দিরে কেন তাঁর পুজো হয় না?
আমি একটু চমকে উঠলুম। এ যে অতি কঠিন প্রশ্ন। ভারতের কোথাও হয়তো দু-একটা ব্রহ্মার মন্দির থাকতেও পারে, কিন্তু আমি দেখিনি। ত্রয়ীর মধ্যে ব্রহ্মার ভক্তসংখ্যা কেন এত কম, আর ঘরে ঘরে কেন তাঁর পুজো হয় না, সে কারণটাও তো আমি জানি না।
অকপটে স্বীকার করলুম আমার অজ্ঞতা! চা পান হয়ে গেছে, এবার উঠলেই হয়, আমি। উশখুশ করছি, এই সময় তিনি টেবিল থেকে একটা বই তুলে জিগ্যেস করলেন, দেখো তো, এটা কী ভাষার বই?
বইটি দেখে আমি চমৎকৃত হলুম। বেশ খারাপভাবে ছাপা একটি বাংলা কবিতার বই। নামটা যতদূর মনে পড়ে ‘বিষের ধোঁওয়া’ কিংবা ‘বিষের বাঁশী’, বাঁকুড়ার একজন স্কুল-শিক্ষকের রচনা। তিনি বইটি টি এস এলিয়টকে উৎসর্গ করেছেন, ভেতরে প্রায় আধ পাতা জোড়া এই ধরনের ইংরিজিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন : ইউ আর মাই গুরু অ্যান্ড আই অ্যাম লাইক একলব্য, ইয়োর মোস্ট ডিভোটেড ডিসাইপল…।
উনি সামান্য হেসে বললেন, আমি তো এই বই পড়তে পারব না।
তারপর অতিশয় ভদ্রতার সঙ্গে বললেন, তোমার কোনও কবিতার ইংরিজি অনুবাদ আনোনি? থাকলে আমি দেখতে পারতাম, এখন সঙ্গে না থাকলেও যদি পরে পাঠিয়ে দাও।
আমিও সমান ভদ্রতার সঙ্গে বললুম, আজ্ঞে না, সেরকম কিছু নেই। সেগুলো আপনাকে দেখাবার মতনও কিছু নয়। আমি উঠে দাঁড়াতেই তিনিও উঠে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর দক্ষিণ করতল বেশ নরম আর ঠান্ডা মনে হল। তাঁর চোখের নীচে খানিকটা ক্লান্তির ছাপ। হয়তো তাঁর শরীর খুব সুস্থ নয়। আমি বারো-তেরো মিনিটের বেশি তাঁর সময় নষ্ট করিনি। বিটুইন দা কনসেপশান / অ্যান্ড দা ক্রিয়েশান / বিটুইন দা ইমোশান / অ্যান্ড দা রেসপন্স/ ফলস দা শ্যাডো…।