1 of 2

তৃষ্ণা – নবেন্দু ঘোষ

তৃষ্ণা – নবেন্দু ঘোষ

জল যে কত দামী জিনিস তা বুঝলাম মালাডে এসে। মালাডে দাদা থাকেন। এক বছর আগে তিনি কলকাতা থেকে বম্বে বদলি হয়ে এসেছিলেন। দাদার বম্বের সংসার দেখবার লোভ অনেকদিন ধরেই হয়েছিল, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তাই অফিস থেকে যেদিন আমার ছ’ মাসের জন্য ডেপুটেশনে যাওয়ার প্রস্তাব এল, আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

মালাড শহর এলাকার বাইরে। সুতরাং শহরের সবরকম দাক্ষিণ্য এখানে নেই। জলাভাবটাই সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে। কল নেই। কুয়োর জল ফুটিয়ে খেতে হয়। কিন্তু মার্চ থেকে কুয়ো শুকোতে আরম্ভ করে, মে মাসে অধিকাংশই শুকিয়ে যায়। জল জল হাহাকার ওঠে চারদিকে। কুয়োর চারদিকে তখন সর্বধর্ম ও সর্বশ্রেণীর ভিড় জমে। মেয়েপুরুষ, ছেলেবুড়োরা সবাই আসে। কুয়োর চারদিকে টিন, বালতি, কলসী আর ডেকচির কিউ পড়ে যায়। তার কোন সময়-অসময় নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন চলে জল তোলার পর্ব।

আমি এলাম মার্চ মাসে। তালুফাটানো গরম তখন বম্বেতে। এসেই বুঝলাম যে জল ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না।

দাদার বাংলোর চারদিকে তিন-চারটি দোতলা চওল। ব্যারাকের মত একটা ঘর আর একটা রান্নাঘর নিয়ে নিচে-ওপরে কুড়িটি পরিবার থাকে। চওলগুলির একটি মাত্র কুয়ো—তা যখন শুকিয়ে যায়, তখন চওলের মেয়েরা দাদার কুয়োতে জল নিতে আসে। তাছাড়া বাংলোটার ঠিক পেছন দিকে ছোট্টমত একটা বস্তি আছে, তার বাসিন্দারা তো সারা বছরই জল নেয়। বাংলোতে এত ভিড় হওয়ার কারণ কুয়োটা মস্ত বড় এবং কখনো শুকোয় না।

রোজ সকালে বম্বে যাই, ঘণ্টা তিনেকের জন্য একবার হেড অফিসে হাজিরা দিয়ে আবার দুটো-তিনটে নাগাদ ফিরে আসি। কাজের চাপ নেই। এখানে কতকগুলো কাগজপত্র দাখিল করেছি, তা দেখিয়ে কতকগুলো রিপোর্ট ও প্ল্যান নিয়ে ফিরে যেতে হবে আমাকে। সুতরাং প্রচুর অবকাশ!

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় আড় হয়ে বই বা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ভোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেই কুয়োর ধারটা দেখতে পাওয়া যায়। সব সময়েই দু-তিনজন মেয়েপুরুষ কুয়োর ধারটাতে দাঁড়িয়ে আছে, জল তুলছে, গল্প করছে। রাতের বেলা যখন আমার ঘরে আলো জ্বলে আর মেহেদির বেড়ার ছায়াতে কুয়োর ধারটা অন্ধকার হয়ে ওঠে, তখনো জল তোলার শব্দ পাই। মাঝে মাঝে শেষ রাতে যখন ঘুম ভেঙে যায়, তখনো দড়ি বালতি আর চুড়ির এক সম্মিলিত শব্দ কানে ভেসে আসে। জলের জন্য মানুষের যে তৃষ্ণা তাকে চব্বিশ ঘণ্টাই অনুভব করি।

তখন কি জানতাম যে, এই তৃষ্ণা লক্ষ করতে করতেই একদিন টের পাব যে, জীবনে আরো তৃষ্ণা আছে। জল, বাতাস আর আলোর জন্য যে তৃষ্ণা, তার চেয়েও তীব্র, তার চেয়েও শক্তিশালী এক তৃষ্ণা।

কিন্তু তার আগে দাদার ড্রাইভার বাসুদেবের কথা বলে নিই। বাসুদেব বিহারের লোকে, বয়স সাতাশ-আটাশ হবে। ছোটবেলাতেই বাপ-মাকে হারিয়ে সে সংসারে একা ভেসে পড়ে। তারপর নানা কাজ করে শেষে ড্রাইভার হয়ে সে দাদার সঙ্গে চলে এসেছে। লম্বা দোহারা গড়ন বাসুদেবের, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে সে ভালবাসে। রূপ না থাকলেও রুক্ষ একটা শ্ৰী আছে তার।

বাড়ির সবাই হাসাহাসি করে তার বাংলা বলার চেষ্টাতে। অনেক হাঁটাহাঁটি করে বাড়ি ফিরে এসে সে একদিন বলল, “হঁটে হঁটে থকে গেছি মা—”

বউদি হাসিখুশি মানুষ, হেসে খুন হন বাসুদেবের কথায়। দাদা গম্ভীর মানুষ, হাসির কথাতেও হাসি পায় না তাঁর। কিন্তু একা হাসতে ভালো লাগে না বউদির। ফলে আমাকে সব কথা শুনতে হয়, হাসতে হয়, দাদার গাম্ভীর্যের জন্য বেশি হেসে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়।

সেদিন রবিবার। দুপুরে সবে ঘুম এসেছে, এমন সময় বউদি ঘরে এলেন, এসে আমার মাথা ধরে ঝাঁকুনি।

“এই—এই ঠাকুরপো—”

“না বউদি, ঘুম পাচ্ছে―”

“আরে শোনই না―শোন―”

বাধ্য হয়ে তাকালাম। বউদি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে লাগলেন।

“হাসছ যে!”

“হাসছি কি আর সাধে ভাই―হিহিহি―ঐ বাসদেওটা―”

“আবার কি বাংলা কথা বলেছে?”

“বাংলা নয় ঠাকুরপো― বাসদেও এখন অন্য পাঠ পড়ছে—প্রেমের পাঠ—”।

“কি?”

“হ্যাঁ―দেখ না, জানালা দিয়ে বাইরে দেখ―”

তাকালাম। কুয়োর ধারে তখন ভিড় নেই। আমগাছের ছায়াটা নিবিড় হয়ে পড়েছে কুয়োর ওপর। সেখানে একটি পেতলের কলসী কুয়োর পাড়ে রেখে একটি মেয়ে বাসুদেবের সঙ্গে গল্প করছে।

মেয়েটিকে আগেও লক্ষ করেছি। পেছনকার বস্তিতে থাকে―মারাঠী ছুতোরের মেয়ে। নাম গঙ্গা, বয়স কুড়ি-একুশ হবে। ভোর সকালে, নিঝুম দুপুরে আর সন্ধের ম্লান আলোতে ওরা দুই বোনে জল নিতে আসে। দুই যমজ বোন। অবিকল এক রকম দেখতে ওরা, তবে গঙ্গা একটু ছিপছিপে আর যমুনা একটু মোটা। গঙ্গার মুখে-চোখে একটা বিষণ্ণ ছায়া, যমুনা হাসিখুশি। গরিবের মেয়ে কিন্তু রুচি আছে ওদের, মারাঠী হিন্দী লিখতে পড়তেও জানে, শাড়ি পরার কায়দা থেকে চলাবলার ভঙ্গীটিতে কোথায় যেন একটা শ্ৰী আছে ওদের। বউদির সঙ্গে এর আগে বারকয়েক কথা বলতে দেখেছি। বৌদি নিজেই একদিন তারিফ করেছিলেন ওদের। সেই দুজনের একজন। গঙ্গা।

প্রশ্ন করলাম, “যমুনা কোথায় গেল?”

বউদি বললেন, “যমুনা আগে কলসী ভরে জল নিয়ে গেছে। এখন থেকে এই তো হবে। যমুনা আসবে তো গঙ্গা যাবে, আবার যমুনা যেতে না যেতেই গঙ্গা ফিরে আসবে―”

একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “ওই বাসদেওটার মধ্যে কি দেখল মেয়েটা?”

বউদি হাসলেন, “সে কি করে বলব ভাই? তবে কি এমন বড়লোক ওরা যে বাসদেওকে ছেড়ে তোমার মধ্যে কোন কিছু দেখবার মত স্পর্ধা হবে ওর?”

“ছিঃ বউদি―

“সত্যি কথা বলছি ভাই। তাছাড়া আমাদের ড্রাইভারের গুণটাই বা কি কম? আশি টাকা মাইনে পায়, দেখতে শুনতে ভালই, বাংলাও মন্দ বলে না―”

হেসে ফেললাম, “তোমার বউদি খালি হাসিঠাট্টা-”

বউদিও হাসলেন, বললেন, “কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা ঠাকুরপো। কই, এতদিন তো বুঝতে পারিনি―”

আমি বললাম, “ওইটে নাকি বোঝা যায় না বউদি―পণ্ডিতেরা বলেন যে, বীজের অঙ্কুরিত হওয়া যেমন, এ ব্যাপারটা ঠিক তাই। নিঃশব্দ, অদৃশ্য। দর্শকদের চোখে যেমন হঠাৎ একদিন ধরা পড়ে, তেমনি নায়ক-নায়িকারাও তা হঠাৎই একদিন বুঝতে পারে―”

তাই বটে। প্রথম প্রথম প্রেমকে অনুভব করা যায় না। নিঃশব্দে, তিলে তিলে, অনুভূতির শিরা বেয়ে বেয়ে অদৃশ্য আখরে কথাটা লিখিত হতে থাকে। তারপর হঠাৎ একদিন সেই লেখা পড়া যায়, বোঝা যায়। তারপর তা উপচে পড়ে। যত সংযমই থাক না কেন, তাকে আর লুকোনো যায় না। ত্রস্ত চোখের অনুসন্ধানী চাউনি, গ্রীবা বাঁকিয়ে ফিরে ফিরে চাওয়া, অকারণ হাসি, অসংলগ্ন কথা, সময়ে-অসময়ে গুনগুন করা, কথা বলতে বলতে আঁচলে গেরো বাঁধা আর খোলা, হাতের নাগালের মধ্যে কোন ফুল বা পাতাকে পেলে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলা আর মাঝে মাঝে বোকার মত কোন কাজ করা। সবকিছুর ভেতর দিয়ে একই কথার বারংবার ঘোষণা হয়―ভালবেসেছি।

বাসুদেবের মধ্যেও পরিবর্তন এল।

দাদাকে মাঝে মাঝে গাড়ি চড়তে গিয়ে ডাকতে হয়। সেই ডাক শুনে অন্যান্য চাকরেরা আবার হাঁক পাড়ে। তখন বাসুদেব ছুটে আসে, মাথা চুলকে অপরাধকে ঢাকার জন্য বলে, “ধোতি পেহেনছিলাম হুজুর―”

বউদি মুচকি হাসেন।

বেশভূষাতেও বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায় বাসুদেবের। সযত্নে টেরি কাটে সে, প্রায় রোজই পাটভাঙা ধুতি পরে। বউদির কাছ থেকে ইস্ত্রিটা চেয়ে নিয়ে রোজই জামাকাপড় ইস্ত্রি করে। সন্ধের পর বাসুদেবের গা থেকে সস্তা এসেন্সের গন্ধও মাঝে মাঝে টের পাওয়া যায়।

বউদি হেসে বলেন, “হতভাগার কাণ্ড দেখেছ ঠাকুরপো?”

কিন্তু হতভাগা আরো অনেক কাণ্ড করতে লাগল। দুপুরবেলাটা বাসুদেব থাকে না, দাদাকে নিয়ে শহরে যায়, আর ফেরে সেই বিকেলে। মাঝখানেই এই ক’ ঘণ্টার অনুপস্থিতিটা সে পুষিয়ে নিতে চায় সকালে আর সন্ধ্যাতে। সারাক্ষণ কুয়োর ধারে সে প্রহরীর মত বসে থাকে। যখন ভিড়টা কমে আসে, তখুনি আসে গঙ্গা। কলসী রেখে কুয়োতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। সলজ্জ ভঙ্গীতে মৃদুকণ্ঠে কথা বলে আর মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক ত্রস্ত চোখে দেখে নেয়।

কি কথা বলে ওরাই জানে। একটাও শুনতে পাই না আমরা, অনুমানও করতে পারি না। শুধু এইটুকুই বুঝি যে, কথার আর শেষ নেই। অনাবশ্যক, অপ্রয়োজনীয়, তুচ্ছ আর সাধারণ কথাও ওদের কাছে উপভোগ্য আর অসাধারণ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু বাসুদেবের ব্যাপার আমাদের ক্রমেই বিরক্ত করে তুলল। সেদিন সন্ধেবেলায় বাজার থেকে বাড়ি ফেরবার সময় বস্তির পাশ দিয়ে বাংলোতে ফিরছিলাম। দেখলাম যে, গঙ্গাদের বাড়ির সামনে দাদার গাড়িটা দাঁড়ানো আর বাড়িটার বারান্দায় বসে বাসুদেব খুব গল্প জমিয়েছে দুই বোনের সঙ্গে।

বাড়িতে গিয়ে কথাটা বউদিকে বললাম।

বাসুদেব ফিরতেই বউদি কৈফিয়ত চাইলেন।

বাসুদেব মাথা চুলকে বলল, “উধার দিয়ে আইসছিলাম তো বিঠলদাসজী বুলাল―”

“বুলাল!” বউদি ধমকে উঠলেন, “দেখ বাসদেও, আমরা কানা নই―”

বাসুদেব মাথা নিচু করে রইল।

“বেশি বাড়াবাড়ি ভালো নয়, বুঝলে? বিঠলদাস বা তার মেয়ে, যার সঙ্গে ইচ্ছে গল্প করগে কিন্তু আমাদের গাড়ি নিয়ে যেয়ো না ওদিকে―”

তারপর বাসুদেব আর গাড়ি নিয়ে যায়নি। কিন্তু বউদির ধমকে নেশা তার একটুও কমল না, বরং বেড়েই চলল।

দিন কাটতে লাগল। জলের জন্য মালাডে হাহাকার বেড়ে চলল। লোকেরা গল্প করতে করতে হিসেব করে পনেরোই জুনের কত দেরি, কবে আরব সাগর থেকে মৌসুমী মেঘের পুঞ্জ আকাশ ছেয়ে ফেলবে সবাই হিসেব করে আর কুয়োর ধারের ভিড় বাড়ে।

আজকাল গঙ্গা আর যমুনা একসঙ্গে আসে না। জল নিতে এসে একপাশে দাঁড়িয়ে থেকে বাসুদেবের সঙ্গে একা গল্প করে গঙ্গা। তারপরে যারা আসে তাদের জল নেওয়া কখন হয়ে যায়। আবার নতুন লোকে আসে। তবু গঙ্গা নড়ে না। শেষে বাসুদেবই তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

সেদিনও তেমনি গল্প চলছিল। হঠাৎ যমুনা এসে হাজির হল, এসে গঙ্গাকে বকতে শুরু করল। বাসুদেব কি একটা বলতে গেল কিন্তু যমুনা রুখে এল তার দিকে। গঙ্গা তাড়াতাড়ি চলে গেল।

বউদি একটু বাদে এসে বললেন, “ঈর্ষা―”

বুঝলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, “কার কথা বলছ বউদি?”

বৌদি মুখ বিকৃত করে বললেন, “ঐ খুঁড়িদের কথা বলছি―ঐ যমুনা মেয়েটা সব বুঝতে পেরেছে, অনবরত বাধা দেয় ও, গঙ্গাকে বকে, বাসদেওয়ের ওপর ওর ভয়ানক রাগ―”

“তার মানে যমুনাও কি―”

“তা কেন? কিন্তু কোন একজনকে ভালবেসেছে সেটাও তো অসহ্য মনে হতে পারে―”

হেসে বললাম, “এ যে রীতিমত উপন্যাস বউদি―”

“আর বোলো না ভাই―হতভাগা জ্বালিয়ে খেল। আমি তো ভয়ে ভয়ে আছি। তোমার দাদা জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না।”

পরদিন একটু নজর রাখলাম। বউদির কথাই ঠিক। যমুনা বোনকে আগ্‌লে আগ্‌লে বেড়াচ্ছে। বাসুদেব কাছে এলেই তার চোখ জ্বলে ওঠে, মুখের ওপর যেন বিষ ছড়িয়ে পড়ে। কলসী কাঁখে চলে যেতে যেতে বিচিত্র ও বিষণ্ণ এক দৃষ্টি মেলে গঙ্গা বাসুদেবের দিকে তাকায়।।

যমুনা তাড়া দিয়ে ওঠে, “পেছন ফিরে কি দেখছিস অত, অ্যাঁ? বাড়ি তো সামনের দিকে।”

আমি বাইরের ঘরে শুই। ঘরের মেঝের ওপর বাসুদেব শুত। কিন্তু সেদিন লক্ষ করলাম যে বাসুদেব শোয়নি।

পর পর ক’দিন ধরেই তাই লক্ষ করলাম।

শেষে কৌতুহল সামলাতে না পেরে রাঁধুনী বামুন পাঁড়েজীকে জিজ্ঞেস করলাম কথাটা। পাঁড়েজীর সঙ্গে বাসুদেবের বেশ ভাব।

পাঁড়েজী বলল, “এখানে শোবার জায়গা হয় না বলে বিঠলদাসের বাড়িতে গিয়ে শোয় বাসুদেব―”

বউদিকে বললাম কথাটা। বাসুদেবের তলব হল।

বাসুদেব বলল, “দাদাবাবু ঘরে শোন, আমার এখানে শুতে লাজ করে―”

বউদি চটে গেলেন, “লজ্জা! বটে! তা ওখানে কি ঘরে শুতে দেয় তোমাকে?”

“জী না―বারান্দামে শুতি―”

“তা এ বাড়ির বারান্দা কি দোষ করল? পাঁড়েজী রান্নাঘরের বারান্দায় শোয়, সেখানেও তো শুতে পার। খবরদার, তোমার এসব বাড়াবাড়ি আমি সহ্য করব না বাসদেও, বাবুকে বলে দেব। আমি তোমাকে ও বাড়ি গিয়ে শুতে নিষেধ করছি, বুঝলে?”

“জী―”

বাসুদেব সেদিন আমাদের বারান্দাতেই শুল। বউদির কথা অগ্রাহ্য করবে কোন সাহসে?

কিন্তু পাঁড়েজী এক ফাঁকে আমার কাছে আড়ালে বলে ফেলল, “আজ মাজী না বললেও ও বাড়িতে শুত দাদাবাবু―”

“কেন পাঁড়েজী?”

“ঐ যম্‌না― ও নাকি কাল রাতে গঙ্গার সঙ্গে বাস্‌দেওকে বাত বলতে দেখেছে―দেখে বাসদেওকে ভয় দেখিয়েছে, বলেছে আজ থেকে শুতে গেলে বিঠলদাসকে নালিশ করবে―”।

ব্যাপারটা বুঝলাম। বউদির কথাই ঠিক। ঈর্ষা। মানব-হৃদয়ের কয়েকটা নির্দিষ্ট পথ আছে, কতকগুলি আইনকানুন আছে, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার কয়েকটা নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে যাকে জাতি ধর্ম বর্ণ আর শ্রেণীর গণ্ডিতে দিয়েও বদলানো যায় না। সব মানুষই যে এক তা তখুনি টের পাওয়া যায়। আর এক বলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম আমি।

সেদিন রাতে ঘুম ভেঙে গেল। বড় গরম। উঠে লাইট জ্বেলে ফ্যানটা চালিয়ে দিলাম। তেষ্টা পেয়েছিল, এক গেলাস জল গড়িয়ে খেলাম, তারপর গেলাসটা ধুয়ে জলটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। বারান্দায় বাসুদেবের খালি বিছানা পড়ে আছে। বাসুদেব নেই।

প্রায় শেষরাতে ফিরে এল সে। ব্যাপারটা বোঝা এমন কঠিন নয়।

তবু হাতেনাতে ধরতে ইচ্ছে হল।

পরদিন জেগে রইলাম।

আমাদের বাড়ির সব শব্দ রাত বারোটা নাগাদ থামল। ঘরের বাতি নিবিয়ে অন্ধকারে উৎকর্ণ হয়ে বসে রইলাম।

কতক্ষণ কেটেছে মনে নেই। কুড়ি, পঁচিশ, চল্লিশ মিনিটও হতে পারে। বাইরে ঝিঁঝির ডাক ছাপিয়ে মাঝে মাঝে কয়েকটা কুকুর ডাকল। কুকুরের ডাক ছাপিয়ে চৌকিদারের লাঠি-ঠুক্‌ঠুক্‌ শোনা গেল। তারপরে একসময়ে বারান্দায় পায়ের শব্দ পেলাম। পা টিপে জানালার ধারে গিয়ে দেখলাম যে বাসুদেব বারান্দা থেকে নেমে গেল।

দরজা খুলে আমিও বাইরে বেরোলাম। নেশা চাপল। যে ভালবাসা মানুষকে পাগল করে, দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য করে সেই ভালবাসাকে চাক্ষুষ দেখতে ইচ্ছে হল।

বাগানটা পেরিয়ে পেছনকার ফটক খুলে বাসুদেব বস্তির রাস্তাটা ধরল, তারপর ডানদিকে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হল।

আমিও এগোলাম।

বিঠলদাসের বাড়িটা জীর্ণ। কাঠ আর টিনের দেয়াল, টালির চালা। তার পেছনে কলাগাছের ঝাড়। সেখানেই বাসুদেবকে আবিষ্কার করলাম দূর থেকে। সে একা দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একটা ছোট্ট ঢিল ফেলল সে একটা জানালার ওপর। জানালাটা খুলে গেল। অস্পষ্ট একটা মুখ।

মিনিটখানেক বাদে গঙ্গা বেরিয়ে এল। বাসুদেব তাকে বুকে টেনে নিল।

অস্পষ্টকন্ঠে তারা কি বলতে শুরু করল তা বুঝলাম না। তবু সরতে পারলাম না।

হঠাৎ আর একটা নারীমূর্তিকে দেখতে পেলাম আমি। বাসুদেব আর গঙ্গা বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়াল। যমুনা!

যমুনার গলা দিয়ে যেন বিষ ঝরল, “ছি ছি ছি―তুই এত নীচে নেমেছিস দিদি!―” বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “চেঁচিয়ে পাড়া জড় করে তোমায় খুন করাতে পারি বাসুদেব, কিন্তু আজ তা করব না। এরপর আর কোন দিন তোমায় দেখতে পেলে তোমাকে–”

“ওখানে কে রে?” হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এল। বাসুদেব চমকে উঠল। গঙ্গা বলল, “যাও—পালাও বাসুদেব―”

বাসুদেবের আগে আমিই পালিয়ে এলাম। বুঝলাম যে হয় বিঠলদাস না তো ছেলে দামোদর জেগে উঠেছে।

ঘরে বসে বুঝতে পারলাম যে বাসুদেব তার বিছানায় ফিরে এসেছে। আমি শুয়ে পড়লাম কিন্তু ঘুম আর আসতেই চায় না। বাসুদেবের কপালে এবার দুঃখ আছে।

বাইরে দেশলাই জ্বলল। বিড়ির গন্ধ ঘরে ভেসে এল। বুঝলাম বাসুদেবেরও ঘুম আসছে না।

বউদিকে খবরটা জানালে বউদি হয়ত খুশিই হতেন, কিন্তু তবু বাধল। চেপে গেলাম।

কিন্তু আমি চাপলেও বিঠলদাসেরা চাপবে কেন? বাইরের ঘরে আমরা যখন চা খেতে খেতে গল্প জমিয়েছি ঠিক সেই সময় দরজার গোড়ায় বিঠলদাস আর তার ছেলে দামোদর এসে হাজির হল।

“হুজুর―”

দাদা তাকালেন। আমি শঙ্কিত হলাম।

বিঠলদাস সব কথা খুলে বলল। দামোদর রাগে কাঁপছে মনে হল।

দাদার চোখমুখ কুটিল হয়ে উঠল। বউদিও কেমন যেন হয়ে গেলেন।

সব শুনে দাদা বললেন, “আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বিঠলদাস―এর পরেও যদি বাসুদেব বাড়াবাড়ি করে তো আমি ওকে ছাড়িয়ে দেব। তখন তোমরা যা ইচ্ছে তাই কোরো―”

বিঠলদাস আর তার ছেলে চলে গেল।

দাদার ডাকে বাসুদেব এসে দরজার পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।

দাদা কট্‌মট্‌ করে তাকালেন তার দিকে। তারপরে তিনি যা বললেন তার সারাংশ হল এই যে, বাসুদেবকে তিনি ভবিষ্যতে আর ক্ষমা করবেন না। আর কোন অভিযোগ তাঁর কানে এলে তিনি তাকে চাবকিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন।

ঘোষণা জানিয়ে দাদা ভেতরে চলে গেলেন। তাঁর অফিস যাবার বেলা হয়েছে।

বউদি বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, “ব্যাপার অনেকদূর গড়িয়েছে বাসদেও―এবার সাবধান হয়ো। আর বলিহারি যাই মেয়েটাকেও বাবা―আচ্ছা বদমাস তো!”

হঠাৎ বাসুদেব বউদির পায়ের কাছে এসে বসে পড়ল, বসে কেঁদে ফেলল, “উ বাতটো বুলেন না মা―গঙ্গার মত ভালো লেড়কী খুব কম মিলে—”

বউদি রাগতে গিয়েও রাগতে পারলেন না, আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। পরে গম্ভীর হয়ে বললেন, “বেশ, বুঝলাম যে ভালো মেয়ে, তা কি করবে তুমি? বিয়ে করবে?”।

বাসুদেব মাথা নাড়ল, “আপনি বুলে ঠিক করে দেন না মা―”

“হুঁঃ—আমার ভারি দায় পড়েছে। ওসব পাগলামি ছাড়ো বাস্‌দেও, যাও তৈরি হওগে—”

তবু উঠল না বাসুদেব, বলল, “লেকিন হামি তো কুছু অন্যায় করি নাই মা―হামি ওকে পীয়ার করি―”।

“থামো তো বাস্‌দেও, আর জ্বলিও না বাবা—”

বউদি বাসুদেবের ভাষা শুনে হাসি না চাপতে পেরে সরে পড়লেন।

আমি বললাম, “তুমি কেমনধারা পুরুষমানুষ হে বাসদেও, কাঁদছ কেন?”

বাসুদেব চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল, ধরা ধরা গলায় বলল, “কান্তে কি হামি মাংগি দাদাবাবু―লেকিন ফিরভি—”

কথা অসমাপ্ত রেখেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার কথা শুনে আমি হাসব না কাঁদব ভেবে পেলাম না।

সন্ধেবেলায় বউদি চা নিয়ে এলেন ঘরে।

বললাম, “খুব তো হেসেছিলে প্রথম প্রথম―এখন তোমাদের ড্রাইভারের কাণ্ড দেখলে তো―”

বউদি একটা চেয়ারে বসে বললেন, “সত্যি, তখন অত ভাবিনি। এখন ভাবতে বিশ্রী লাগছে। যাই বল, গঙ্গা মেয়েটা কিন্তু বেশ ভদ্র―অথচ―”

আমি বললাম, “অথচ অবাক ব্যাপার এই যে, সেই ভদ্র মেয়েটিও ওর জন্য পাগল―”

“আমার বিশ্বাস হয় না―”

“শোন তাহলে”―

সেদিনকার রাতের ঘটনা বললাম আমি।

বউদি অবাক হলেন, “সত্যি!”

মাথা নেড়ে বললাম, “কি জানো বউদি পণ্ডিতদের কথাই ঠিক―সুন্দরীরা পশুদেরই ভালবাসে―”

বউদি একটা কড়া প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময়ে পাঁড়েজী দৌড়ে ঢুকল ঘরে।

“মাজী বাসদেওয়ের শির ফুঁড়ে দিইয়েসে ওরা―”

“কারা?”

বউদির পেছন পেছন আমিও ছুটে বাইরে বেরোলাম। বারান্দাতে বাসুদেব গোঙাচ্ছে। পাশে দু-তিনজন অপরিচিত লোক আর বাড়ির ঝি ও চাকর। কপালটা ফেটে রক্ত পড়ছে বাসুদেবের, হাত-পা ছড়ে গেছে। একটু একটু করে শুনে বোঝা গেল যে, বাসুদেব যখন বস্তির রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিল তখন দামোদর দু-তিনজন সঙ্গী নিয়ে তাকে ঘেরাও করেছিল।

পাঁড়েজী ফিসফিস করে বলল, “বাসদেওকে যখন ওরা পিটছিল তখন বিলিদাসের বাড়িতেও কান্না শোনা যাচ্ছিল। বোধ হয় ঐ গঙ্গা কাঁদছিল—”।

বউদি খুব রাগ করলেন বাসুদেবের ওপর, “কেন? কেন গিয়েছিলে ঐ বস্তির রাস্তায়? আর কোন রাস্তা নেই বেড়াবার?”

দাদা এসে সমস্ত শুনে বিঠলদাসদের ওপর চটে গেলেন। বটে, নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। সেই সঙ্গে বাসুদেবকেও আর এক দফা বকুনি দিতে ভুললেন না তিনি।

বউদি গজগজ করতে করতে তুলল, টিংচার আইডিন আর ব্যাণ্ডেজ নিয়ে এলেন। বললেন, “দাও তো ঠাকুরপো, এই হতভাগা রোমিওকে একটু ব্যাণ্ডেজ করে দাও। হতভাগার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠেছি, এবার ওকে তাড়াতে হবে―”।

হতভাগা বিনীত ভঙ্গিতে, মৃদু কণ্ঠে গোঙাচ্ছিল। বউদির কথায় এতটুকুও বিচলিত হল না সে। তার চোখ তখন অন্য কিছু দেখছিল, আর তার কানে বোধ হয় একটি মেয়ের কান্নার শব্দ তখনো ভেসে ভেসে আসছিল। এমন একটি মেয়ে যে তাকে ভালবাসে, তার জন্য কাঁদে।

রাতে ভাবছিলাম।

বাসুদেবের মধ্যে কি খুঁজে পেল তারা? কিংবা এরই নাম বুঝি প্রেম?

কিছুতেই ঘুম এল না। বাসুদেবের কথা ভেবে নয়। সে চিন্তা থেকে নিজের চিন্তায় কখন সরে গিয়েছি তা খেয়াল ছিল না। না ঘুমোলেও রাতের অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে থাকলে যে বিচিত্র ঘুম-ঘুম একটা প্রলেপ দেহে মনে ছড়িয়ে থাকে তারই ফলে রাত কত গভীর হল তা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে উঠে বসলাম।

চুড়ির শব্দ!

জানালার ধারে গিয়ে দেখললাম যে, বাসুদেবের বিছানার পাশে গঙ্গা এসে বসেছে, বাসুদেবের বুকের ওপর মাথা রেখে চাপা গলায় কাঁদছে।

বাসুদেব তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে বলল, “কেঁদো না, ও ঘরে দাদাবাবু শুয়ে আছে―”

কান্নায় বুজে গেছে গঙ্গার গলা, তবু তার কথা বোঝা গেল, “আমার জন্যই তোমার এত কষ্ট―”

বাসুদেব বলল, “তোমার জন্য কষ্ট পেয়েছি বলেই তো তোমার দাম বুঝতে পারছি―তোমার অনেক দাম গঙ্গা, তোমার জন্য প্রাণও দেওযা যায়―”

একটু চুপ করে থেকে সে আবার বলল, “অথচ কি আমার দাম? অশিক্ষিত ড্রাইভার আমি, পৃথিবীতে কেউ কোথাও নেই।”

“আমি বা কি বাসুদেব? গরিব মারাঠী মেয়েদের অবস্থা তো তুমি জানো না। বুড়ী হয়ে যায়, তবু তাদের বিয়ে হয় না—সে যে কী জ্বালা―”

“গঙ্গা—”

“কি?”

“আমি ভেবেচিন্তেই দেখেছি।”

“কি?”

“তুমি আমাকে ভুলে যাও।”

“ভালবাসা আমার কাছে খেলা নয় বাসুদেব। আমি সমস্ত দুঃখের জন্য তৈরি।”

“কিন্তু আমি যে তৈরি নই গঙ্গা। না না তুমি যাও, আমাকে আর লোভ দেখিও না।”

“লোভ!” গঙ্গা বিদ্যুদ্‌বেগে উঠে দাঁড়াল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “তাহলে চল্লাম”―

বাসুদেব জবাব দিল না। গঙ্গা পা বাড়াল। বাসুদেব নড়ল না। গঙ্গা চলতে লাগল, সিঁড়ির ধাপে পা রাখল।

হঠাৎ অস্ফুট ডাক বেরিয়ে এল বাসুদেবের গলা থেকে। যেন তার আর্ত আত্মা ডেকে উঠল।

“গঙ্গা―”

থমকে দাঁড়াল মেয়েটা। বাসুদেব উঠে দাঁড়াল। গঙ্গা ঘুরল।

“গঙ্গা―”

দু’জনে ছুটে এল পরস্পরের দিকে। যেন দুটো উন্মত্ত ঢেউ।

বাসুদেব বলল, “আমাকে মাপ কর, মাপ কর গঙ্গা। তুমি জানো না তোমার ওপর আমার কী লোভ, কী প্রচণ্ড লোভ। তোমায় চলে যেতে বলছি! কিন্তু তোমায় ছাড়া যে বাঁচতেও পারব না গঙ্গা―”

তারপর তাদের উন্মত্ত আবেগ দেখে লজ্জা পেয়ে নিজের বিছানায় সরে গেছি। সময় কেটেছে। শেষ রাতে চাঁদ উঠেছে, চাঁপা ফুলের গন্ধ পশ্চিমের বাতাসে ঘরের ভেতর ভেসে এসেছে। ঘুমিয়েছি।

অনেক বেলায় কড়া রোদের আঁচে আর বউদির ডাকে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম যে টেবিলের ওপর ধূমায়িত চা। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ছিল। তাড়াতাড়ি চা নিয়ে চুমুক দিলাম। ওদিকে কুয়োর পাড়ে তখন ভিড়। জলকামীদের কলরব আর জল তোলার শব্দ। তৃষ্ণাকে জয় করবে বলে টলমল শীতল জলের জন্য তাদের সে কী প্রাণান্ত প্রয়াস!

আজকাল গঙ্গা আর জল নিতে আসে না। আসে যমুনা।

কিন্তু পর পর আরো দু’রাত বাসুদেবের কাছে এল গঙ্গা। তারপর তৃতীয় রাত থেকে বন্ধ হল তার আসা।

ক’দিন বাদে পাঁড়েজী সেদিন বিকেলে এসে বলল, “এই বাসদেওটা একেবারে পাগলা হইয়ে গিয়েছে হুজুর―”

“কেন? কি হল?”

“ওরা আজ ঐ মেয়েটিকে দুসরা কোই জগাহ পঠায়ে দিয়েসে। লড়কীটার কোন আত্মীয়-বাড়ি। খবরটা পাওয়ার পর থেকে বাসদেও খালি কাঁদছে―”

কি আর বলব। কাঁদুক। বাসুদেবের কপালে দুঃখ থাকলে খণ্ডাবে কে?

একটু বাদেই বাসুদেবকে দেখতে পেলাম। কুয়োর ধারে, আমগাছটার তলায় অন্ধকারে বসে আছে আর কাঁদছে।

তার কান্না রাতেও শুনলাম। কিন্তু কি করব?

বউদিকে বললাম কথাটা।

বউদি বললেন, “গেছে? আপদ দূর হয়েছে। কাঁদুক ক’দিন, তারপর সব ভুলে যাবে।”

কিন্তু বাসুদেব যে ভুলবে তা মনে হল না। যতই দিন কাটতে লাগল ততই বাসুদেব গম্ভীর হয়ে উঠতে লাগল। তার পোশাক-পরিচ্ছদ আর বেশভূষা মলিন হয়ে উঠল, চুলদাড়ি বড় হয়ে তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর মত চেহারা হয়ে গেল তার। কথা বলে না সে, যন্ত্রের মত কাজ করে আর কুয়োর ধারে বসে থাকে।

যমুনা এখনো জল নিতে আসে, কিন্তু সে একা আসে না, তার মায়ের সঙ্গে আসে। বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে তাদের দু’চোখে আগুন জ্বলে আর তাকেই উদ্দেশ করে মারাঠী ভাষায় কি সব শাপশাপান্ত করে। কিন্তু বাসুদেব তাদের কথা শুনতে পায় না, তাদের দিকে তাকায়ও না।

দাদা মাঝে মাঝে ধমকান। বউদি কত বোঝান। কিন্তু বাসুদেবের কোন পরিবর্তন হয় না। সে যেন এক দুশ্চর তপস্যা শুরু করেছে।

তার সেই তপস্যার বীজমন্ত্র শুনতে পাই আমি। অনেক রাতে।

কেঁদে কেঁদে আওড়ায় বাসুদেব। “গঙ্গা গঙ্গা গঙ্গা―”

মানুষের সুখ-দুঃখের তোয়াক্কা করে না দিনরাতের চাকা। তাই দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেল। সবার হিসেব করা শেষ হল। আরব সাগর থেকে জলভরা মেঘে একদিন আকাশ কালো হয়ে গেল। তারপর বৃষ্টি নামল। শুকনো মাটির ওপর জলের আলপনা দাগ কাটল। তৃষ্ণার্ত পৃথিবী নিঃশেষে লেহন করল সেই রসধারা।

কিন্তু কুয়োর ধারে ভিড় কমল কি? নিত্যকার তৃষ্ণার উনিশ-বিশ হল মাত্র। আর কিছু নয়।

এরই মধ্যে একদিন পাঁড়েজী খবর দিল, “গঙ্গা লওটকে এসেছে দাদাবাবু—সেই আত্মীয়-বাড়িতে নাকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। ওরা অতিষ্ঠ হয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে।”

বাসুদেবকে লক্ষ করলাম। তার তপসা শেষ হয়েছে। হঠাৎ একদিন সে দাড়িগোঁফ নির্মূল করে ফেলল। এতদিন বোঝা যায় নি যে, কত রোগা হয়ে পড়েছে লোকটা। গঙ্গা এসেছে তবু কিন্তু তাকে খুশি মনে হল না। গুরুভার এক চিন্তা যেন সারাক্ষণ পাষাণ হয়ে তার ওপর চেপে আছে।

যমুনা এখনো জল নিতে আসে। যুবতী, সুশ্রী মেয়ে সে, কিন্তু পাকা বুড়ীর মত মাঝে মাঝে বাতাসের উদ্দেশে বলে, “কলেরা হয়ে মরবে, কুষ্ঠ হয়ে মরবে―শেয়াল কুকুরে কামড়ে কামড়ে খাবে―”

কার এমন পরিণামের কথা সে বলে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু কে কি বলবে? কি হবে বলে?

বউদি একদিন বললেন,“বাস্‌দেওটার জন্য চিন্তা হয় আজকাল। ঐ বিঠলদাসেরা এখনো আগুন হয়ে আছে। শুনছি আবার নাকি মারধরের আয়োজন করছে।”

আমি অবাক হলাম, “আবার কেন? ও ব্যাপার তো চাপা পড়ে গেছে―গঙ্গা তো আসেও না।”

“আসবে কি? ওকে নাকি তালাবন্ধ করে রাখে―”

“বেচারী!”

বাসুদেব সন্ধের পর কাজ না থাকলে মাঝে মাঝে বাইরে যায়। কোথায় যায় বুঝি না। মাঝে মাঝে রাতের বেলা খায় না সে। বউদি কত বকেন, তবু ফল হয় না। মাঝে মাঝে পাঁড়েজী আর বাড়ির ঝি’র সঙ্গে কি সব পরামর্শ করে সে। কিছু বুঝি না। বুঝবার জন্য চেষ্টাও করিনি। বাড়ির ড্রাইভারের প্রেমের ব্যাপার নিয়ে এর বেশি কৌতূহল প্রকাশ করাটা বোকামিই হবে।

সেদিনটা রবিবারই হবে। দাদা বাড়ি ছিলেন। দু-তিনজন প্রতিবেশী এবং স্থানীয় দু’জন বাঙালী ভদ্রলোক এসেছিলেন। তাঁরা গল্পগুজব করে সবে গেছেন এমন সময়ে বিঠলদাস আর তার ছেলে দামোদর এসে হাজির হল।

হাউমাউ করে কেঁদে পড়ল বিঠলদাস, বলল, “আমার গঙ্গা নিখোঁজ বাবুজী—কাল মাঝরাত থেকে—”।

দাদা সব শুনলেন, বললেন, “তা আমি কি করব—পুলিসে খবর দাও—”

“আপনিই বিহিত করুন হুজুর—আপনার ড্রাইভার নিশ্চয়ই জানে।”

বাসুদেব এসে মাথা ঝাঁকাল। পাঁড়েজী প্রভৃতি সবাই সাক্ষ্য দিল যে, বাসুদেব রাতে কোথাও যায়নি।

দাদা বিঠলদাসকে বললেন, “পুলিসে খবর দাওগে বিঠলদাস। আব দোষ তো তোমাদেরই—মেয়ে সামলাতে পারো না।”

বিঠলদাসেরা উত্তেজিত অবস্থায় চলে গেল। পুলিসেই খবর দেবে তারা। বিশ্রী ব্যাপার। আর এক দফা কড়া বকুনি খেল বাসুদেব। এখন যদি পুলিস এসে বাড়িতে জেরা শুরু করে? তাহলে!

বউদি বাসুদেবকে আড়ালে ডেকে বললেন, “সত্যি কথা বলেছে তো? হ্যাঁ বাস্‌দেও, জানতে না কিছু?”

মাথা নিচু করে বাসুদেব মাথা নাড়ল, “না মা—”

দিন গেল রাত হল। তার পরের দিন।

বাসুদেবের শরীর খারাপ। দাদা একাই ড্রাইভ করে গেলেন অফিসে। আমার কাজ ছিল না বলে আমি আর বাড়ি থেকে বেরোলাম না, কোনান ডয়েলের একটা বই নিয়ে বসে গেলাম।

পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাসুদেব, পাঁড়েজী আর ঝি’র দিকে তাকিয়ে আজ একটু অবাক হলাম। কেমন যেন উত্তেজিত, চিন্তিত ও চঞ্চল মনে হচ্ছে ওদের। ব্যাপার কি? মাঝে মাঝে তিনজনে মিলে আবার কি সব জটলা করছে! কিন্তু পরক্ষণেই কোনান ডয়েল ব্যাপারটা ভুলিয়ে দিল। শেরলক্ হোমসের কাণ্ডকারখানা পড়তে পড়তে এক সময়ে বিকেল হয়ে গেল। স্কুল থেকে বাচ্চারা কলরব করতে করতে ফিরে এল। বউদি চা নিয়ে এলেন। বাইরে সূর্যের আলো ক্রমে ক্রমে রাঙা হয়ে মিলিয়ে এল। পরিচিত হর্নটা বাজিয়ে দাদার গাড়ি এসে বাড়িতে ঢুকল। সন্ধ্যার অন্ধকারে চাঁপার গন্ধ বাতাসে তীব্র হয়ে ভাসল। আর আকাশের গায়ে চাঁদ নেই বলে তারারা আসর জাঁকিয়ে তুলল।

কিন্তু আরব সাগর থেকে যে একখানি কালো মেঘ ক্রমে সারা আকাশকে ছেয়ে ফেলার জন্য অন্ধকারে শ্বাপদের মত এগিয়ে আসছিল তা টের পাইনি। টের পেলাম অনেক পরে। রাত তখন সাড়ে এগারোটা মত হবে। হঠাৎ জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, তারাদের আসর কখন ভেঙে গেছে। ঘন কালো মসিলেখায় আকাশ অবলুপ্ত।

কয়েক মিনিট বাদেই আকাশ কাঁপিয়ে মেঘ ডাকল, বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। তারপর হুহু করে পুবের বাতাস এল আর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। হাওয়ায় ঘরের ভেতর জলের ছাট আসতে লাগল। জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। তবু শীত শীত করতে লাগল। অথচ ঘরে কোন চাদর নেই গায়ে দেবার।

বউদি তখনো জেগে ছিলেন। বসে বসে চিঠি লিখছিলেন। দাদা অফিসের ফাইল ঘাঁটছিলেন অন্য ঘরে।

ভেতরের করিডোরে দেখলাম পাঁড়েজী, বাসুদেব আর ঝি বসে গল্প করছে। এখনো চলছে ওদের ফিসফিস কথা!

“বউদি, ভারী শীত করছে, একটি ব্যবস্থা কর।”

বউদি মুখ তুললেন, “ওঃ, তোমায় বুঝি চাদর দিইনি। চল দিচ্ছি, এখানে চট করে ঠাণ্ডা লেগে যায়, একটু সাবধান থাকাই ভাল।”

বউদি বেরোলেন। করিডোর পার হয়ে সাজঘরে গেলেন। আমি করিডোরেই দাঁড়িয়ে রইলাম।

বাসুদেব ওরা আমায় দেখে একটু নড়ে বসল। ওদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে দেখে আমি একটু বিরক্ত হয়ে উঠলাম।

“কী অত কথা হচ্ছে হে তোমাদের? তোমরা শোবে না?”

বাসুদেব শুকনো গলায় বলল, “এখনো ভি নিন্দ্ আসছে না দাদাবাবু”—

হঠাৎ অস্ফুট আর্তনাদ ভেসে এল সাজঘর থেকে।

“ঠাকুরপো—ঠাকুরপো—”

“কি হল বউদি?”

ঘরের ভেতরে ছুটে গেলাম, বউদিও ছুটে বেরিয়ে আসছিলেন। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন তিনি, কাঁপছেন।

“বউদি!”

ঘরের কোণের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বউদি বললেন, “দেখ তো, ওখানে কেউ লুকিয়ে আছে—”।

“সেকি!”

দরজার পাশে ছাতাটা ঝুলছিল, সেইটি হাতে নিয়ে আমি কোণের দিকে এগোলাম। একটা ছোট টেবিলের ওপর লেপকাঁথা থাক করে সাজানো ছিল। তার পেছনটাতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম যে, একটা চাদর ঝুলে পড়েছে কোণটায়, যেন কিছু ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ভালো করে তাকিয়ে বুঝলাম যে কেউ বসে আছে। চোর।

একটানে চাদরটা সরিয়ে ফেললাম।

বউদি অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, “গঙ্গা!”

গঙ্গা একবার ভয়ার্ত দৃষ্টি তুলে আমার দিকে তাকাল, তারপরেই দু’হাতে মুখ ঢাকল।

আর ঠিক সেই সময়েই বাসুদেব ছুটে এসে বউদির পা জড়িয়ে কেঁদে উঠল।

“ওকে কিছু বুলবেন না মা —ওর কোহিভি দোষ নাই—”

দাদার পায়ের আওয়াজ এগিয়ে এল কাছে।

“কি হয়েছে?”

প্রশ্ন করেই ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন তিনি।

“একি!”

বউদি কোন জবাব দিলেন না।

বাসুদেব হাতজোড় করে দাদার সামনে উঠে দাঁড়াল, “আপনি হামার অন্নদাতা বাপ হুজুর—ওকে কুছু কহিয়েন না, সারা দোষ হামার।”

“চোপরাও শুয়ার—” দাদা গর্জে উঠলেন, “রাস্কেল, তোর জন্য আমি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ব? হতভাগা বেইমান, এত বলেও তোকে ঠিক করতে পারলাম না।”

দু’চোখ বেয়ে তখন বাসুদেবের জল নেমেছে। দরজার ওদিকে পাঁড়েজী আর ঝি-টা শঙ্কিত মুখে তাকিয়ে আছে।

“কবে থেকে আছে ওখানে?” দাদা প্রশ্ন করলেন।

বাসুদেব বলল, “কাল রাত থেকে।”

“তাহলে তুই সকালে মিছে কথা বলেছিলি! তোরা সবাই?”

পাঁড়েজী ও ঝি অপরাধীর মত সরে গেল সেখান থেকে।

দাদা আমার দিকে তাকালেন, “যা তো, পুলিসকে ডেকে নিয়ে আয়, এসব প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না”।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কোণ থেকে সেই অবনতমুখী গঙ্গা ছুটে এসে দাদার পায়ে লুটিয়ে পড়ল, “দোহাই বাবুজী, আমাদের পুলিসে দেবেন না—”

দাদা বললেন, “নিশ্চয়ই দেব—”

বউদি বললেন, না—”

দাদা ঘুরে দাঁড়ালেন, “কি বলছ তুমি!”

বউদি গঙ্গাকে তুলে দাঁড় করালেন, তারপর বললেন, “ওর দিকে তাকিয়ে দেখ।” আমরা তাকিয়ে দেখলাম। এতটুকুও বুঝতে কষ্ট হল না যে, গঙ্গা মা হতে চলেছে। বউদি বললেন, “আমিও মেয়েছেলে, আমিও মা, তোমরা সবাই আজ ওকে কোন অপমান করলে আমি তা সইব না। ওদের ছেড়ে দিতে হবে।”

দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে দাদা প্রশ্ন করলেন, “কিন্তু পুলিস?”

‘পুলিসের কাছে আমি জবাবদিহি দেব। বাসুদেব, তুমি তৈরি হয়ে নাও। ছি ছি ছি, একথা আমাকে বললে কি হত রে হতভাগা? ঐ ঘরের কোণে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে বসে আছে মেয়েটা! ঠাকুরপো, তুমিই ওদের স্টেশনে ড্রাইভ করে নিয়ে যাও, নইলে হয়ত জ্যান্ত আর মালাড ছেড়ে বেরোতে পারবে না।”

দাদা নিরুত্তরে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেশ বোঝা গেল যে, তিনি বউদির সিদ্ধান্তে মোটেই সায় দিতে পারলেন না।

বউদির পায়ে লুটিয়ে পড়ে বাসুদেব বলল, “মাজী—আপনি আমার আপনা মাসে ভী কম নেহি।”

কথাটা এতটুকুও অতিরঞ্জিত মনে হল না। বউদির সেই মহিমময়ী ও করুণাময়ী মূর্তি আমি আর জীবনে ভুলব না। সেই সঙ্গে বাসুদেবের অসহায় মুখ আর তার গর্ভবতী মারাঠী প্রেয়সীর শীর্ণ, পাণ্ডুর ও বিষন্ন মুখচ্ছবিও চিরকাল আমার মনে জমা হয়ে থাকবে।

বউদি নিজের কয়েকটা শাড়ি আর ব্লাউজ গঙ্গাকে পেটিলা বেঁধে দিলেন, তাকে যত্ন করে খাওয়ালেন। তারপরে বাসুদেবের মাইনে চুকিয়ে, তার হাতে আরো পঁচিশটা টাকা বেশি দিয়ে তাদের বিদায় দিলেন।

এতদিন বাসুদেব গাড়ি চালাত। আজ আমিই ওকে আর গঙ্গাকে গাড়ি চালিয়ে স্টেশনে নিয়ে গেলাম। তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। সারা মালাড দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছ।

ট্রেনে চড়ে বাসুদেব ছলছল চোখে বলল, “গরিবদের ইয়াদ রাখবেন দাদাবাবু—”

ভারি সুন্দর ভঙ্গীতে গঙ্গা হাতজোড় করে নিঃশব্দে প্রণাম জানাল। ট্রেন ছেড়ে দিল।

পরদিন আকাশ তখন পরিষ্কার, রৌদ্রোজ্জ্বল। বেশ গরম লাগছিল।

জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, কুয়োর পাড়ে তেমনি ভিড়। এত বৃষ্টিতেও মানুষের জলের তৃষ্ণা মেটেনি। সেই ভিড় দেখতে দেখতে হঠাৎ বাসুদেব আর গঙ্গার কথা মনে পড়ল। এখন তারা কোথায় কে জানে! কে জানে কোন শহরে গিয়ে তারা নীড় বাঁধবে, উদাসীন পৃথিবীর কাছে কতটুকু সহানুভূতি পাবে তারা! কে জানে ওদের কপালে কত দুঃখ আছে!

কুয়ো থেকে জল তুলছে একটি মেয়ে। তার চুড়ির ঠুনঠুন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। বালতিভরা টলমল তৃষ্ণার জল। জলের তৃষ্ণা। কিন্তু এই তৃষ্ণাই কি শেষ তৃষ্ণা? এর চেয়েও বড়, এর চেয়েও মর্মদাহী আরো তৃষ্ণা কি নেই? আর অন্তহীন এই অসংখ্য তৃষ্ণার নাম কি জীবন?

১৩৬১ (১৯৫৪)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *