৯
বালকের কৌতূহলের মাথামুণ্ডু হয়তো সব সময় থাকে না। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে বালকের ঐ বিচিত্র কৌতূহলটির একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। তাহলে রূপেন্দ্র-কুসুম উপাখ্যান ছেড়ে তোমাদের নিয়ে যেতে হবে অতীতকালে। হরিপাল জনপদের প্রতিষ্ঠাকালের ইতিকথায়। এই মাতৃমূর্তির আদিম ইতিহাসটা না জানলে বালকের ঐ বিচিত্র প্রশ্নটা, আর ঘোষালমশায়ের আতঙ্কের তাৎপর্যটা ঠিক মতো ধরা যাবে না। এসব আমার বানানো গল্প নয় গো! রীতিমতো বইপত্র ঘেঁটে কাহিনীটি সংগ্রহ করেছি। কিছুটা পেয়েছি ‘দিগ্বিজয় প্রকাশে’, কিছুটা জেলা-ভিত্তিক গেজেটিয়ারে, কিছুটা পূর্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত-’বাংলায় ভ্রমণ’ গ্রন্থে (হ্যাঁ গো, তোমরা বিশ্বাস করবে তো—দুই খণ্ডে 1940 সালে প্রকাশিত সেই রেক্সিন-বাঁধাই 200+331 531 পৃষ্ঠার গ্রন্থটির মোট মূল্য ছিল দেড় টাকা!) এবং বেশ কিছুটা শ্রীসুধীরকুমার মিত্রের ‘হুগলী জেলার দেবদেউল’ আর ‘হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থগুলি থেকে। স্বীকার করি—তার সঙ্গে মিশেছে অধম কথাকোবিদের কল্পনা :
****
গৌড়ে তখন হিন্দু রাজত্ব। পাল বংশের আমল। সে সময়ে গৌড়াধিপতি সম্ভবত ধর্মপালের পুত্র দিগ্বিজয়ী দেবপাল। পালবংশীয় নৃপতিগণের কয়েকটি শাখা বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করদ-রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। হুগলী জেলার রাজা হরিপাল প্রতিষ্ঠিত রাজ্যও তার মধ্যে একটি। তাঁর পিতা কুলপাল সতীদেবীর বরে ভাগীরথীর পশ্চিমকূলে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ছিল দুই পুত্র; জ্যেষ্ঠ হরিপাল ও কনিষ্ঠ মহিপাল। বৃদ্ধ বয়সে রাজা কুলপাল তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রকে ডেকে বললেন, আমি তোমার অনুজ অহিকেই আমার সিংহাসন দিয়ে যাব বলে মনস্থ করেছি। এ বিষয়ে তোমার কী অভিমত?
হরিপাল ছিলেন শালপ্রাংশু মহাভুজ বীর। যেমন তাঁর দৈহিক ক্ষমতা, শস্ত্রশিক্ষা, তেমনি উদার হৃদয়। তিনি যুক্তকরে বললেন, আপনার আদেশই শিরোধার্য পিতৃদেব। আমার অভিমতের তো কোনও প্রশ্ন ওঠে না।
মহারাজ বললেন, ওঠে। এ সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছি জান? অহি নাবালক। কিন্তু তুমি মহাবীর্যবান সাবালক। তোমাকে আমি সৈন্যসামন্ত দিচ্ছি, নিজ বাহুবলে তুমি একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা কর এবং বংশানুক্রমে ভোগ কর। অনুজ অহি তোমার ছত্রছায়াতেই এখানে রাজত্ব করবে। এ বিষয়ে তোমার কী অভিমত?
—আমি প্রস্তুত মহারাজ!
পিতার আশীর্বাদ নিয়ে হরিপাল তখনই যুদ্ধ যাত্রা করলেন এবং পিতার জীবিতকালেই সিঙ্গুরের পশ্চিমে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন : ‘মহাগ্রাম’। তাই কালে হল : হরিপাল। দেবভাষায় না শুনলে তোমরা হয়তো ভাববে কথাকোবিদ বানিয়ে বানিয়ে ‘গপ্পো’ শোনাচ্ছে।
সুতরাং অবহিত হও :
“সতীদেব্যা বরেণৈব ভীমভুজবলপুত্রকঃ।। ৬৭৭
কুলপালো দেশশালো বিখ্যাতঃ পশ্চিমে তটে।
কুলপালস্য দ্বৌপুত্রৌ হরিপালো অহিপালকৌ।। ৬৭৮
জ্যেষ্ঠঃ সিঙ্গুর পশ্চিমে স্বনামবসতিং কৃত।
‘হরিপালো’ মহাগ্রামো হট্টবাপীসমন্বিতঃ।। ৬৭৯” —দিগ্বিজয়প্রকাশ।
কী? এবার বিশ্বাস হল তো?
সে আমলে ঐ হরিপাল গ্রামের কিনার ঘেঁসে দু-দুটি নদী প্রবাহিত। একটির নাম কৌশিকী, অপরটি বিমলা। বাস্তবে দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রাচীন দামোদর। তা সে যাই হোক, ঐ জনপদ প্রতিষ্ঠা করার পর বেশ কয়েকঘর মানুষ এসে ওখানে বসবাস শুরু করল—ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সদ-গোপ। অচিরেই জনপদটি সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠতে থাকে। নির্মিত হল মন্দির, চতুষ্পাঠী, পণ্যবিণী, হাটতলা, অসংখ্য ভদ্রাসন।
কিন্তু একটি উপদ্রব (লগেই ছিল। কৌশিকী নদীর কিনার ঘেঁষে ছিল এক অরণ্য। আর সেখানে বাস করত একদল দুর্ধর্ষ ডাকাত। জাতে তারা চণ্ডাল। রঘু-চাড়াল তাদের সর্দার। অসীম বলশালী আর অত্যন্ত দুঃসাহসী। রাজা হরিপাল বহু আয়াসেও ঐ ডাকাতদলকে ধরতে পারেননি। গ্রামপ্রান্তে কৌশিকী নদীর শ্মশানে ছিল এক প্রাচীন ডাকাতে কালী—তার নাম ‘চণ্ডালী-মা’। রঘু ডাকাত প্রতিবার ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে তাঁর পূজা করে যায়। হরিপালে পণ্যবাহী সার্থবাহের দল রঘুডাকাতের আতঙ্কে এ রাজ্যে বাণিজ্যে আসতে সাহস পায় না। প্রায়ই ডাকাতের দল তাদের ধনসম্পদ লুটেপুটে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়—রঘুর ডাকাতির আর এক মর্মন্তুদ বৈশিষ্ট—সর্বস্ব লুটে নেবার পর সে একটি হতভাগ্যকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ঠিক যেভাবে চণ্ডালেরা বাঁশ থেকে ঝুলিয়ে নিয়ে যায় শূকর। ঐ ডাকাতে-কালীর যূপকাষ্ঠে বন্দীকে বলি দেওয়া হয়! মাঝে মাঝেই শোনা যায় সেই মৃত্যুভীতের করুণ আর্তনাদ—আরণ্যক অন্ধকার ভেদ করে আসছে। এই পরিবেশে কি রাজ্যের সমৃদ্ধি সম্ভব?
হরিপাল বহু চেষ্টা করেও ডাকাত দলকে ধরতে পারেননি। সে আজ এখানে তো কাল ওখানে। দু একবার ওঁর সৈন্যদলের সঙ্গে ডাকাতদলের প্রত্যক্ষ সংগ্রামও হয়েছে। দু-পক্ষেই হতাহত হয়েছে। রঘু-ডাকাত ঘায়েল হয়নি। জনশ্রুতি, ওর হাতে ঐ চারহাত প্ৰমাণ লাঠিগাছখানা থাকলে তাকে ঢিল মারা যায় না। বিদ্যুৎবেগে ঘূর্ণমান যষ্টি-প্রাকারে প্রতিহত হয়ে লোষ্ট্রখণ্ড ফিরে আসে। রঘু এ অঞ্চলের দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল।
১৭শ শতাব্দী তারপর একদিন। সূর্য তখন, তুলারাশিতে। কার্তিক মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী। রাজা হরিপালের কাছে সংবাদ এল লুট হয়েছে দ্বারহট্টী গ্রামের চণ্ডী ঘোষ-এর গদী। সর্বস্ব লুট করে ডাকাতেরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে তাঁর কিশোর বয়স্ক হতভাগ্য পুত্রকে। গ্রামের অনেকেই শুনেছে সেই কিশোরের ‘অরণ্যরোদন’।
হরিপাল সিদ্ধান্তে এলেন! এই সুযোগ! দুদিন পরেই কালীপূজা। সেই পুণ্য তিথিতে নরবলি দানের মহাপুণ্য অর্জন করতে চাইছে রঘু। তিনি গোপনে সৈন্য সমাবেশ করলেন। আন্দাজ করলেন—কালীপূজার সন্ধ্যারাত্রে আক্রমণ করলে ঐ চণ্ডালী-মায়ের মন্দিরে সদলবলে রঘুডাকাতের সাক্ষাৎ পাবেন।
হরিপালের অনুমান নির্ভুল। সমস্ত অরণ্যভূমি বেষ্টন করে, পলায়নের প্রতিটি ছিদ্রপথ রুদ্ধ করে রাজা হরিপাল হানা দিলেন মায়ের মন্দিরে।
কিন্তু অতর্কিতে কার্যসিদ্ধি হল না। ওপক্ষও সজাগ ছিল। নিঃশব্দে নীরন্ধ্র অমাবস্যা রাত্রে অগ্রসর হচ্ছিলেন সসৈন্য; কিন্তু অকস্মাৎ অরণ্য মধ্যে কোথায় যেন শঙ্খধ্বনি হল। আর তৎক্ষণাৎ অরণ্যের এ-প্রান্তে ও-প্রান্তে শোনা গেল দুন্দুভি নিনাদ। মন্দিরের গর্ভগৃহে যে ঘৃতপ্রদীপটা জ্বলছিল এতক্ষণ, তা দপ্ করে নিভে গেল।
অন্তরীক্ষ থেকে যেন দৈববাণী হল : শুরে হরি-রাজা! তুই মোরে দ্যাখতি লারছিস্। তোরা শহুরে মনিষ্যি—আঁধারে দ্যাখতে পানে! কিন্তুক মুই তোরে দ্যাখতে পাই! পেত্যয় না হয় তো বল্–এক বাণে তোরে ফুঁড়ে দিই!
রঘুডাকাতের কণ্ঠস্বর! হরিপাল বোঝেন, এ ওর ত্রাসসঞ্চারী মিথ্যা আস্ফালন। এ নীরন্ধ্র অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। দেখা সম্ভবপর নয়। কিন্তু মশাল জ্বালা চলবে না—তাহলেই তাঁদের বাণবিদ্ধ হতে হবে। হরিপাল গর্জে ওঠেন, রঘু! তুই চণ্ডী ঘোষের ছেলেটাকে তুলে এনেছিস?
—হঁ রে! তারে বলি দিব আজ! তা হুঁ রে রাজা—তুইও তো হেঁদু! মায়ের পূজায় বাধ সাছিস্ কেনে রে?
রাজা বললেন, আজ কালীপূজা। আমি মায়ের পূজা করতে এসেছি। তুইও তো হিন্দু রে রঘু! তুই আমাকে রুখছিস্ কোন অধিকারে?
অরণ্যভূম যেন কেঁপে-কেঁপে উঠল দুঃসাহসী ডাকাতের অট্টহাস্যে। রঘু হাসি থামিয়ে বললে, ফ্রন্দিটো ভালই ঠাউরেছিস্ রাজা! কিন্তু এ যে চণ্ডালী মা! এ ঠাঁইয়ে তুই কেন্ রে?
হরিপাল বললেন, না! মা সবারই মা! আমি এ রাজ্যের রাজা। মায়ের পূজার অগ্রাধিকার থাকে রাজার!
রঘু ফিরিয়ে দেয় জবাব, না রে রাজা! চণ্ডালী-মা রাজা-পেরজা মানে না! যার গায়ে তাগৎ বেশি তারই পূজা নেয়!
—তবে সেটাই প্রমাণ কর! তোর তাগৎ আমার চেয়ে বেশি! বল, কী নিয়ে লড়বি? তরোয়াল, লাঠি না মল্লযুদ্ধ?
রঘু এককথায় মেনে নিল। দু-পক্ষই মায়ের নামে শপথ করলেন। দ্বন্দ্বযুদ্ধে স্থির হবে মায়ের পূজার অগ্রাধিকার কার। দুপক্ষের ধানুকীরা বৃক্ষান্তরালে আত্মগোপন করে রইল ধনুকে আকর্ণ জ্যা আকর্ষণ করে। কোন পক্ষ তঞ্চকতা করলে তৎক্ষণাৎ ফুঁড়ে দেবে! অরণ্যভূমে জ্বলে উঠল মশাল। রঘু-ডাকাত বেছে নিয়েছে যাতে তার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা : লাঠি!
মন্দিরের চাতালে দণ্ডায়মান হলেন দুই যোদ্ধা। দুজনের হাতেই চারহাত-প্রমাণ লাঠি। দর্শকেরা অদৃশ্য। সবাই বৃক্ষান্তরালে। রঘু ডাকাতের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। নিম্নাঙ্গে শুধু মালকোচা—সাঁটা খেটো ধুতি। রাজা খুলে রাখলেন তাঁর রাজ-পরিচ্ছদ। দুজনে দাঁড়ালেন মুখোমুখি!
নেপথ্যে বেজে উঠল ভেরী। যুদ্ধারম্ভের ঘোষণা!
রঘু-চাড়াল প্রচণ্ড বলশালী। লাঠি খেলায় তার অসীম পারদর্শিতা। আন্দাজ করেছিল লড়াইটা ‘ফতে’ হতে অদৃশ্য দর্শকদের চোখে পলক পড়বে না। কিন্তু তা হল না। তার প্রতিটি আঘাত প্রতিহত হয়ে ফিরে এল। রাজা হরিপাল যেন এক মন্ত্রঃপূত যষ্টিপ্রাকারের দুর্গে আশ্রয় নিয়েছেন! তিনি ক্রমাগত আত্মরক্ষামূলক লড়াই করে চলেছেন। একবারও প্রত্যাঘাত করছেন না। রঘু একটু বিস্মিত হয়ে পড়ে—লোকটা দুধ-ক্ষীর-ননী খেয়ে মানুষ! এমন লাঠির খেলা সে শিখল কবে? আর লোকটা ক্রমাগত আত্মরক্ষামূলক লড়াই করছে কেন? কই, সে তো একবারও ‘শির তামেচা সামালকে’ হেঁকে তেড়ে এল না। ক্রমে স্বেদবিন্দু ফুটে ওঠে রঘুর ললাটে। এক লাফে তিন-পা পিছিয়ে গিয়ে বলে, তু লড়ছিস না কেনে রে রাজা?
হরিপালও তিন-পা পিছিয়ে গিয়ে বলেন, লড়ছি না? বলিস্ কী রে রঘু? একবারও ছুঁতে পারলি আমাকে?
—কিন্তুক তু তো খালি ঠেকাইছিস্! এক তরফা! কেনে?
রাজা হেসে বলেন, উপায় কি? আমি রাজা, তুই যে প্রজা! আজ বছরকার দিনে কি তোকে ঘায়েল করতে পারি? তুই যে আমার ছেলের মতো রে!
তোর ছাওয়াল! মুই তোর ছাওয়াল! তবে দ্যাখ্!
ক্ষিপ্ত শার্দুলের মতো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে রঘু ডাকাত সজোরে আঘাত হানল রাজমস্তক লক্ষ্য করে। আর ঠিক তখনই হরিপালের যষ্টি বিচিত্র ভঙ্গিতে একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করল গগনমার্গে। যেন বিদ্যুতের একটা ঝলক!
দেখা গেল রঘু-ডাকাতের যষ্টি হস্তচ্যুত হয়েছে। বহুদূরে ছিটকে পড়েছে। রাজা সে পথটা আড়াল করে দাঁড়ালেন! নিরস্ত্র রঘু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছা করলে হরিপাল সেই মূহূর্তে রঘুকে শুইয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করলেন না। বললেন, যা। কুড়িয়ে নিয়ে আয় তোর লাঠি! নিরস্ত্রকে আমি আঘাত করি না।
রঘু হঠাৎ নতজানু হল। হোক ডাকাত! তবু সে তো লাঠিয়াল! বললে, না রে রাজা! রঘুও যে কারও দয়ায় জান বাঁচায় না! লাঠি কুড়ায়ে আনব কোন কালামুয়ে? মার! মোর শিরটো ফাট’য়ে দে!
হরিপাল নিজের লাঠিটাও ছুঁড়ে ফেলে দিলেন দূরে। নিরস্ত্র নৃপতি রঘুকে অতিক্রম করে উঠে গেলেন মন্দিরের গর্ভগৃহে। পরমুহূর্তেই ফিরে এলেন তিনি। তাঁর কোলে মূর্ছিত কিশোরের দেহ। তার হাত-পা বাঁধা। রাজা বললেন, তোর লোকজনদের ডাক। এবার আমি মায়ের পূজা করব। তুইও আয়। নরবলি নয়, ছাগবলি হবে এখানে! বাচ্চাটার মুখে-চোখে জল দে। ভয়ে মূৰ্চ্ছা গেছে!
রঘু ডাকাত সদলবলে যোগ দিয়েছিল হরিপালের সৈন্যবাহিনীতে। হরিপাল মায়ের মন্দিরটি নতুন করে গড়ে দিয়েছিলেন। ‘চণ্ডালী-মা’ নামটা কালে পরিবর্তিত হয়ে গেল : মা বিশালাক্ষী।
দেবী চতুভুর্জা, উচ্চতা প্রমাণ-মানুষের চেয়েও বড়। কণ্ঠে মুণ্ডমালা। “দেবী শবোপরি ‘আড়বিঘা’, মহাকালের উপর দক্ষিণ পদ ও বিরূপাক্ষের মাথার উপর বামপদ দিয়ে দণ্ডায়মানা তাঁর দু-পাশে আছেন জয়া ও বিজয়া। দেবীর পদতলে পাদপীঠের উপর পাঁচটি অসুরের মুণ্ড অবস্থিত।”
তারপর শতাব্দীর একপাদ অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজা হরিপাল এখন বৃদ্ধ। অনেক অনেক কীর্তি স্থাপন করেছেন তিনি। হরিপাল রাজ্যও সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছে। রঘু এখন আর ডাকাত নয়, রাজার এক বিশিষ্ট সেনানায়ক। বহুবার রাজার সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। পর্ণকুটির নয়, পাকা বাড়িতে সে স্ত্রীপুত্র নিয়ে বাস করে। একজন সম্পন্ন অমাত্য।
তারপর একদিন। রঘু তার কিশোরপুত্রটির বিবাহ দিয়ে গ্রামে ফিরছিল। দুটি পাল্কিতে বর আর নববধূ, অশ্বপৃষ্ঠে বরযাত্রী দল—যারা এককালে ছিল এ অঞ্চলের কুখ্যাত ডাকাত, এখন রাজ-সেনাবাহিনীর বেতনভুক সৈন্য। বেশ কিছু পদাতিক। সে দলে মশালধারী আর বাজনদার। ভিন গাঁ থেকে বরযাত্রী দল শোভাযাত্রা করে এগিয়ে যাচ্ছিল সেনাপতির বর্তমান আবাসে। হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন রঘু : রুখ্ যা!
তাঁর দলবলকে বললেন, বেটা-বেটা বউ নে ঘরকে ফিরছি, সবার আগে সাবেক মায়েরে পেন্নাম করি আসি। তোরা আগায়ে যা, ঘরকে যেয়ে বল্ কেনে, এখনই আসপ আমরা।
পুত্র ও নববধূর পাল্কি নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে শ্মশানের দিকে মোড় নিলেন রঘু। মনে পড়ল, বহুদিন তিনি আসেননি চণ্ডালীমায়ের ‘থানে’। এখন এ দেবীর পূজার আয়োজন রাজসরকার নিয়ন্ত্রিত। মন্দিরকে নতুন করে গড়েছেন রাজা মশাই। নিয়োজিত হয়েছে পুরোহিত, দেবোত্তর ভূখণ্ড দান করেছেন—প্রায় দুইশত বিঘা আমন ধানের জমি। প্রতি অমাবস্যায় ছাগবলি ব্যবস্থা, অন্যান্য দিন নিত্যপূজা।
মন্দিরের কাছাকাছি যখন এলেন তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। স্থানটা নির্জন। সন্ধ্যারতি সেরে পুরোহিত দ্বারে শিকল দিয়ে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন। অরণ্যপ্রান্তে পাল্কি বাহকদের রুখলেন রঘু। অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নিজেও অবতরণ করলেন। পুত্রকে আহ্বান করেন, নামি আয় বাপ্, পায়ে হাঁটে যাতি হবে। তুম্মো আইস, মা জননী।
পুত্র নির্দেশমতো নেমে এল পাকি থেকে। তবু জানতে চাইল, কেন বাবা?—‘কেন’ কি শুধাস্ রে পাগলা! মায়ের থানে পাল্কি চাপি যাতি হয়? আয়। পদব্রজে এগিয়ে গেলেন তিনজন। পাল্কি-বাহকেরা অপেক্ষা করল। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলতে থাকেন। নববধূ বালিকা মাত্র—অষ্টম বর্ষীয়া, পুত্রটি কিশোর। রঘুর মনে কৌতুক জমলো। দ্রুতপদে প্রায় দৌড়েই অগ্রসর হলেন। পুত্রকে বললেন, তাড়াহুড়া নাই, ধীর কদমে আগুয়ে আয়।
পুত্র এবং তার নববধূকে এই আরণ্যক নির্জনতায় বোধকরি কিছু সুযোগ দেবার ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে খুশিয়াল মানুষটার। একলাই উঠে এলেন মন্দির-সোপান বেয়ে। শিকল খুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন। মা যেন শীর্ণা! মা যেন অনশনক্লিষ্টা!
রঘুনাথ প্রণিধান করলেন তার হেতু। করজোড়ে বললেন, কী করব ক মা? রাজা যে বারণ করিছে। নরবলি হতে দিবেনি। ছাগমাসে কি তোর অভর প্যাট ভরে না রে পাগলি?
“মা প্রত্যুত্তর করবার সুযোগ পেলেন না। নবদম্পতি ততক্ষণে এসে পৌঁচেছে। কিন্তু রঘুনাথের প্রত্যয় হল মায়ের তৃতীয় নয়নে স্পষ্ট ভ্রুকুটি। দুটি হাত জোড় করে মনে মনে বললেন, দিব্যি করলম রে মা, তোরে আনি দিব তু যা চাপ্। কিন্তু কারেও বলবি না। গুপনে কাম সারপি, হুঁ?
ঁমায়ের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠল।
রঘুনাথ ওদের বললেন, পেন্নাম কর। মায়েরে দক্ষিণা দে!
তখনই খেয়াল হল। তিনি তো সিক্কাটাকার থলিটা নিয়ে আসেননি। সেটা রাখা আছে পাল্কিতে। পুত্রকে বললেন, টুক্ বসি থাক। মুই যাপ আর আসপ।
দ্রুতপদেই ফিরে গেলেন পাল্কির কাছে। পাল্কিবাহক মুনিষগুলো ছিলিম ধরিয়েছিল। কর্তাকে ফিরে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি ছিলিমটা লুকালো। রঘুনাথ পাল্কি থেকে টাকার থলিটা তুলে নিলেন। আজ এই আনন্দের দিনে তিনি যেন সেই হারানো দিনগুলোতে ফিরে যেতে চান। তাই পাল্কিবাহক দলের সর্দারকে বলেন, হেই তারকে! ছিলিমটো অ্যাক্কেবারে শ্যাস্ করি দিনি। পুজো দে আস্যে মুইও টুক্ সেবা করপ নে!
বাহক-সর্দার তারক সরমে যেন মাটিতে মিশে যায়।
দ্রুতপদেই ফিরে এলেন রঘুনাথ। ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়েছে।
কিন্তু এ কী? মন্দিরে তো ওরা নেই! মন্দিরের দ্বার খোলা। জনমানব নেই সেখানে। এদিক-ওদিক খুঁজলেন। কাকস্য পরিবেদনা। বেরিয়ে এলেন বাইরে। অরণ্যের দিকে ফিরে হাঁকাড় পাড়েন শিবঅঅঅঅ!
কিশোরপুত্র শিবনাথ সাড়া দিল না। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। একটু আগে যে খুশিয়াল ভাবটা ছিল—যে মন নিয়ে তারককে বলেছিলেন ছিলিমে গঞ্জিকা কিছু অবশিষ্ট রাখতে, সে মনটা হারিয়ে গেল। তিলতিল করে ফিরে আসছে তাঁর বংশানুক্রমিক চণ্ডালে রাগ। একটা আক্কেল থাকবে তো? বাপ রয়েছে নাগালের মধ্যে, জানে যে এখনি ফিরবে—অথচ এরই মধ্যে কচি বউটাকে নিয়ে এই ভরসন্ধ্যে বেলা লুকোচুরি খেলছিস্!
আবার দিলেন হুঙ্কার : শি—বঅঅঅ―!
প্রতিধ্বনিই ফিরে এল শুধু।
প্রতিবর্তী-প্রেরণায় কাজ। পঁচিশ বছরের অনভ্যাস, তবু জাতে ডাকাত তো! ডানহাতের তালুটা ওষ্ঠাধরে লাগিয়ে ‘কুক’ দিয়ে উঠলেন হঠাৎ: আ—বাবাবাবা!
পাল্কিবাহকেরাও ওঁর প্রাক্তন চেলা-চামুণ্ডা। দূর থেকে ভেসে এল তাদের প্রতিধ্বনি : আ—বাবাবা! -ভয় নাই কর্তা! শুন্ছি! মোরাও আলাম বলে!
পরক্ষণেই বনজঙ্গল ভেদ করে ছুটে এল আট-দুকুনে ষোল বেহারা।
তন্নতন্ন করে খুঁজল সবাই। সারা বন। সারা শ্মশান! কোথায় কে?
হঠাৎ তারক স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চেপে ধরল কর্তার হাত।
মায়ের দিকে তর্জনী তুলে বলে, ইডা কি বটেগ কর্তা?
–কী?
কর্তা মায়ের দিকে তাকালেন। তাই তো! মায়ের নাকে তো নথ ছিল না! ওটা তাহলে কী? গোলাকৃতি রূপার নথের মতো! কিন্তু না! নাসিকা থেকে তো ঝুলছে না! গোলাকার বস্তুটা আটকে আছে মায়ের ওষ্ঠাধর প্রান্তে। রঘুনাথ এগিয়ে এলেন। বৃত্তাকার ধাতব বস্তুটায় তর্জনীটা বাঁকিয়ে একটা মোক্ষম টান দিলেন! ছিঁড়ে বেরিয়ে এল সেটা মায়ের মুখ থেকে!
একটা চাবির ক্ষুদ্রাকার রৌপ্যবলয়! তাতে দু-তিনটি কুঞ্চিকা। আর তার সঙ্গে ঢাকাই খাসা মসলিনের একটা ছিন্নাংশ। ঘোর রক্তবর্ণের। যে শাটিকা পরিধান করে নববধূ এতক্ষণ আসছিল পাল্কি চেপে তারই একটা টুকরো!
কিন্তু … কিন্তু সেটা তো ছিল নীলাম্বরী! এ তো ঘোর লাল!
পরক্ষণেই প্রণিধান করলেন হেতুটা। সেই ছিন্ন অঞ্চলপ্রান্ত থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে রক্ত। নীলবর্ণের খাসা-মলিন ঘোর রক্তবর্ণের হয়ে গেছে একটি হতভাগিনী বালিকার শোণিতে! ঁমায়ের করাল দংষ্ট্রার নিষ্পেষণে! বরবধূ ঁমায়ের জঠরে!
মরণান্তিক একটা জান্তব আর্তনাদ করে রঘুনাথ লুটিয়ে পড়লেন চণ্ডালী মার চরণমূলে! মূর্ছিত হয়ে!
মূর্ছা ভাঙল তিনদিন পরে, কিন্তু জ্ঞান ফিরল না। রঘুনাথ ঘোর উন্মাদ হয়ে গেছেন। বেঁচে ছিলেন আরও তিন বছর, কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায়—বদ্ধ উন্মাদ! সম্ভবত তাঁর ভারসাম্যহীন অন্তরে ও-প্রশ্নটা আদৌ জাগেনি—চণ্ডালী মা কি ভুল বুঝেছিলেন? ওঁর সেই মনে-মনে বলা প্রতিশ্রুতিটায় : দিব্যি করলম্ রে মা! তোরে আনি দিব তু যা চাপ্। কিন্তু কারেও বলপি না, গুপনে কাম সারপি! হঁ?
রাজা হরিপাল কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল রইলেন। তাঁর রাজ্যকালে ওখানে আর নরবলি হয়নি। হল পরবর্তী জমানায়। তাও কালে-ভদ্রে। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অপরাধীকে আর ফাঁসিকাঠ থেকে ঝোলানো হত না। এতে সাপও মরে, অথচ লাঠিটাও ভাঙে না।
কিন্তু মানুষের মনে একটা আতঙ্ক জেগেই থাকে। হরিপাল গ্রামে ইতিমধ্যে আরও অনেক মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে সর্ববিখ্যাত 1873 সালে প্রতিষ্ঠিত রাধাগোবিন্দজীর মন্দির। রায়বংশের প্রতিষ্ঠা করা পোড়ামাটির আটচালা দেউল। ফলে ভদ্র গ্রামবাসী সেই সব মন্দিরেই পূজা দিতে যায়। শ্মশানকালী ক্রমে ক্রমে উপেক্ষিতা হয়ে পড়তে থাকেন। পূজার অধিকার ফিরে পেল চণ্ডালেরা। তারা ছাগবলির সঙ্গে শূকরবলির প্রবর্তন করল—ফলে, বিশালাক্ষী পুনর্মূষিক হয়ে পড়লেন কালে : চণ্ডালী-মা! তবু যে ব্রাহ্মণ পুরোহিত -বংশ দেবোত্তর ভোগ করেন তাঁরা নিত্যপূজার ব্যবস্থাটা বজায় রেখেছেন—না হলে দেবোত্তর ভোগ করতে পারবেন না।
কালের রথচক্র পাক খায়। আবার নতুন যুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ ফিরিয়ে আনতে চায় প্রাচীন—প্রথা। মাঝে মাঝে নিখোঁজ হয়ে যায় ভিন গাঁয়ের পথ-চতি মানুষ!
রূপেন্দ্রনাথ সঙ্গিনীর হাত ধরে এসে বসলেন মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দিরে। দু-হাত উঁচু পোতা—চুন-সুরকির মাজা-মেঝে। প্রাচীর নাই। চারি দিকেই খোলা-মেলা। মোটা মোটা তাল-খুঁটির উপর তালের রলা। তার উপর শালকাঠের চাল-সাঙা। উপরে উলুখড়ের বাঙলা আটচালা। নিপুণ ঘরামির হাতের কাজ—পাড়, পাটি, বাখারি, শারক, শলা-ফোঁড়ের ঠানানি। উপরে বরফি আকারে তল্লা বাঁশের চৌখুপি। কালবোশেখী ঝড় তো ছাড়—শালিক পাখিও তুলে নিয়ে যেতে পারে না উলু ঘাসের একটি কাঠি!
ম্লান জ্যোৎস্নার আলো। মুঠো-মুঠো জোনাক জ্বলছে। দূরে যে চিতাটা জ্বলছিল সেটা নিবে গেছে। একটু আগেই কলসি ভেঙে শ্মশানযাত্রীরা ফিরে গেছে গৃহে : ‘বিমুখাঃ বান্ধবাঃ যান্তি, ধর্মস্তিষ্ঠতি কেবলম’!
রূপেন্দ্র সঙ্গিনীকে বললেন, তুমি শুয়ে পড়। আমি জেগে আছি। ঘুম আসছে না আমার!
মঞ্জরী শুয়ে পড়ে—ওঁর জানুতে মাথা রেখে। বলে, সারাদিন এতটা হেঁটেছ, ঘুম আসছে না কেন?
রূপেন্দ্র জবাব দিলেন না। মঞ্জরী বুঝতে পারে। বলে, কাজটা বোধহয় ঠিক হল না। হাটতলায় রাতটা থেকে গেলেই ভাল হত। না হয় একটু দূরে শুতাম আমরা!
ঐ কথাই ভাবছিলেন তিনিও। কী যেন একটা অস্বোয়াস্তি বোধ করছেন। তাঁরও মনে হচ্ছে : কাজটা ভাল হয়নি।
এই তো কিছুক্ষণ আগেই মঞ্জরী বলেছিল ঐ দলটিকে ত্যাগ করে ওঁরা ব্লাকি পথ পৃথক ভাবেই যাবেন। কিন্তু এখন সেই ভ্রষ্টাচারী সহজপন্থীদের সান্নিধ্যই কামনা করছে সে। হোক ভ্রষ্টাচারী—তবু তো তারা মানুষ! এটা যে মৃত্যুর ওপারের রাজত্ব—এই জনমানবহীন শ্মশানভূমি। যে হতভাগ্যদের বলিদান করা হয়েছে অশান্ত সেই পরিচয়-হারা প্রেতাত্মার দল যে এখানে পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে মরছে! ঐ যে জোনাকিগুলো বারে বারে মিটমিট করে ওঁদের দুজনকে দেখছে তারা কি সেই প্রেতাত্মার চোখ?
শ্মশানের দিক থেকে সমস্বরে ভেসে এল যামঘোষের আর্তনাদ, যেন ওরা সমবেতভাবে সেই কথাটাই বলতে চায়: ‘তফাৎ যাও! সব ঝুট হ্যয়!’
হঠাৎ কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল মঞ্জরী, ওটা কী?
তার তর্জনীসঙ্কেতে ঘুরে দেখলেন। নদীর ওপারে একটা আলোর পিণ্ড জলের উপর নেচে বেড়াচ্ছে। মরা নদী। জলজ উদ্ভিদ পচে একটা ভ্যাপসা গন্ধ ভেসে আসছে। রূপেন্দ্র বললেন, ও কিছু নয়, আলেয়া!
মঞ্জরী ওঁর হাতটা দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরল। রূপেন্দ্র সান্ত্বনা দিলেন, ভয়ের কিছু নেই মঞ্জু, ও একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। বদ্ধ জলাশয়ে আপনা থেকেই অমন আগুন জ্বলে, আপনা থেকেই নিবে যায়।
তাই গেল। আগুনের গোলাটা যেন জলে ডুবে গেল!
রূপেন্দ্রনাথ ওকে আবার জোর করে শুইয়ে দিলেন। আচ্ছন্নের মতো পড়ে রইল মঞ্জরী। এ পরিবেশে সে কিছুতেই ঘুমাতে পারবে না। রূপেন্দ্র একটা তাল খুঁটিতে ঠেশ দিয়ে বসলেন। তাঁর বার বার মনে হচ্ছিল—এ শ্মশানভূমি আদৌ জনহীন নয়। এখানে অনেক-অনেক দর্শকের সমাবেশ ঘটেছে। এমন নবদম্পতিকে তারা যে অনেক দিন দেখেনি। এখানে কেউ রাত্রিবাস করে না। দর্শকদের দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তারা ওঁদের দেখছে। হয়তো ভাবছে—তাদেরও ছিল এমন আনন্দঘন দাম্পত্য জীবন। সে জীবনে অকস্মাৎ ছেদ পড়েছিল ঘাতকের খড়্গাঘাতে। অতৃপ্তির হাহাকারটুকু সম্বল করে তারা দেহাতীত মৃত্যুরাজ্যে রওনা হতে বাধ্য হয়েছিল এক-দিন।
কিন্তু সেই ছেলেটি হঠাৎ মঞ্জরীর আঁচল ধরে টান দিয়েছিল কেন? অজানা-অচেনা এক ভিনদেশী তীর্থযাত্রিণীর অঞ্চলপ্রান্তে চাবি বাঁধা আছে কিনা সে বিষয়ে তার কিসের কৌতূহল? পুরোহিত-মশাই বলেছিলেন—‘বালকের ছেলেমানুষী’। তাই যদি তাঁর ধারণা, তাহলে হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন কেন তিনি? প্রহার করলেন কী কারণে ঐ ছেলেমানুষীর জন্য? ঐ ‘চাবি’র গভীরে কি রয়ে গেল কোন অজ্ঞাত রহস্য? কোন্ রুদ্ধদ্বারের সেই কুঞ্চিকা? নাকি চাবির প্রসঙ্গ নিছক একটা অছিলা মাত্র? ছেলেটি তার দিদির বয়সী ঐ সুন্দরী অচেনা মেয়েটিকে সাবধান করে কিছু বলতে চেয়েছিল। কী কথা? ‘সব ঝুট হ্যয়, তফাৎ যাও!’
দ্বিতীয়ত সেই ঘোষাল মশাই! অপ্রকৃতিস্থ বলে তো মনে হয়নি তাঁকে! পূর্বমূহূর্তে তিনি বলেছিলেন—তাঁর গৃহে স্থানাভাব হবে না, হলেই বা কী? এমন নির্জন শ্মশানে তিনি ওঁদের দুজনকে রাত্রিবাস করতে দেবেন না। অথচ পুরোহিতমশায়ের ধমক খেয়েই তিনি সম্পূর্ণ বদলে গেলেন। কাঁপছিলেন থরথর করে। কেন? কেন?
আর সবচেয়ে বড় কথা ঐ পুরোহিতের আচরণ। তিনি নিজেও অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। আগন্তুকদের ললাটে রক্ততিলক পরিয়ে দেওয়ারই বা কী তাৎপর্য? বলেছিলেন, ‘এটাই প্ৰথা!’
প্রথা! অর্থাৎ?তন্ত্র-উপাসকের বংশ! এভাবে রক্ততিলক কপালে এঁকে দেবার কী তাৎপর্য তা তো তাঁর অজানা নয়! কিন্তু এখানে তার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? তাঁরা দুজন কিছু উৎসর্গ করা ছাগশিশু নন!
সহসা অন্য একটা আশঙ্কা জাগল। তাঁর মনে পড়ল—শ্মশানকালীর পূজা সাধারণত করে ডাকাতের দল। অজানা-অচেনা দেশ। এদের কিছু দুরভিসন্ধি নেই তো? কিন্তু ওঁরা এসেছেন খালি হাতে। মঞ্জরীর সারা দেহে এক রতি সোনা নেই। শুধু শাঁখা আর নোয়া, আর কিছু ইলামবাজারী গালার চুড়ি। কিন্তু না! ভুল হচ্ছে! কুসুমমঞ্জরী অপূর্ব সুন্দরী! ক্রীতদাসীর হাটে তার বাজারদর যথেষ্ট! ওদের দুরভিসন্ধির মূলে সে-রকম কিছু নেই তো! অথবা …!
হ্যাঁ, সেটাও অসম্ভব নয়। ডাকাতের দল শ্মশানকালীর পূজায় নরবলি দিয়ে থাকে। পুরোহিত কি তাদের কাছ থেকে মোটা হাতে দক্ষিণা পান? তাতেই কি ঐ রক্ততিলক চিহ্ন? সেজন্যই কি তাঁর সর্বদেহ ছিল বেপথুমান!
হঠাৎ মনে পড়ে গেল—তিনি নিরস্ত্র। অন্তত একখানা বংশদণ্ড পাশে নিয়ে বসা উচিত ছিল। চাঁদের আলো এখনো আছে। হয়তো শ্মশানে খুঁজলে তা পাওয়া যায়; কিন্তু মঞ্জরী তাঁর কোলে মাথা রেখে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আহা, তার কাঁচা ঘুমটা—-
ঠিক তখনি কে যেন তাঁর কর্ণমূলে বলে উঠল : ‘কারেও বলপি না, গুপনে কাম সারপি! হঁ?
রীতিমতো চমকে উঠেছেন। কেউ তো কোথাও নেই। মঞ্জরীও ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে। বললে, কিছু বললে?
—না তো!
—আমার মনে হল তুমি বললে, ‘কাকেও কিছু বলবি না, গোপনে কাম সারবি।’–বলনি?
রূপেন্দ্রনাথের দেহের সমস্ত রোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠেছে। অসীম সংযমে তিনি বললেন, না তো! আমি তো কিছু বলিনি। তুমি স্বপ্ন দেখেছ বোধহয়।
মিথ্যাভাষণ নয়। কিন্তু সত্যভাষণ কি? মিথ্যার আশ্রয় না নিলে তাঁর বলার কথা : ওকথা আমি বলিনি; কিন্তু শুনেছি!
কিন্তু রূপেন্দ্রনাথের বিশ্বাস : সত্য শুধুমাত্র শিব-এর দিশারী! রাতের এখনো অনেকটা বাকি। যে সত্যকথায় ঐ মেয়েটি মনোবল হারিয়ে আতঙ্কে মূর্ছিতা হয়ে পড়বে তা মিথ্যা—মিথ্যা—মিথ্যা!
প্রেতযোনিতে বিশ্বাস করেন না রূপেন্দ্রনাথ ভেষগাচার্য! তাঁর মনে হল, এ কারও কারসাজি! কে বা কারা ওঁদের ভয় দেখাতে চাইছে। যাদুকরেরা দূর থেকে এমনভাবে ধ্বনি নিক্ষেপ করতে পারে যাতে শ্রোতার মনে হয় কথাটা কর্ণমূলে বলেছে কেউ! এ তেমনই এক ভোজবিদ্যা! বললেন, আমার এমন খালি হাতে বসে থাকাটা ঠিক নয়। ওঠ! একটা অস্ত্ৰ চাই!
—অস্ত্র? এই বিজন শ্মশানে অস্ত্র কোথায় পাবে?
—মায়ের চালচিত্রের পিছনে মন্দিরপ্রাচীর থেকে একটি খড়্গ ঝুলতে দেখেছি। সেটা নিয়ে এসে বসব। তুমি আমার সঙ্গে চল! তোমাকে একা ফেলে রেখে যাব না।
মঞ্জরী প্রতিবাদ করতে পারে না। কথাটা অযৌক্তিক কিছু নয়। সভয়ে ওঁর হাতটা চেপে ধরে। রূপেন্দ্র তাকে বলেন, হাত ছেড়ে দিতে। সে যেন ওঁর পিছন-পিছন আসে, ওঁর উপবীতটা আঙুলে জড়িয়ে। বলেন, তুমি যাদের ভয় পাচ্ছ মঞ্জু, তারাও ব্রাহ্মণের উপবীতকে ভয় করে! ভয় কী? আমি তো আছি!
দুজনে নেমে আসেন নাটমন্দির থেকে। নামতে গিয়েই কিসে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। কিছু নয়, ওটা হাড়িকাঠ! কিন্তু এত বড়? মহিষবলি হয় না কি এখানে? এঃ! হাতটা আঠা-আঠা হয়ে গেল! বোধহয় রক্ত মাখা ছিল! কাপড়ে মুছে নিলেন হাতটা। পায়ে পায়ে উঠে এলেন মন্দির-চাতালে। মঞ্জরী শক্ত করে ধরে আছে ওঁর উপবীতগাছ!
শিকল খুলে দিলেন। বাইরে জ্যোৎস্নালোক। ভিতরে নীরন্ধ্র অন্ধকার। কপাট দুটি খুলে ভিতরে কিছুই দেখতে পেলেন না। কিন্তু আরতির সময় খড়্গটিকে কোনখানে দেখেছিলেন তা স্পষ্ট মনে আছে। অন্ধকারেও সেটি হাড়ে হাড়ে খুঁজে পাবেন। তবু অপেক্ষা করলেন। চোখটা অন্ধকারে সইয়ে নেওয়া দরকার। না হলে পূজার তৈজসপত্রে পদস্পর্শ হতে পারে। উন্মুক্ত দ্বারপথে দাঁড়িয়ে রূপেন্দ্রনাথ উপবীতটা আঙুলে জড়িয়ে নীমিলিত নেত্রে অষ্টোত্তর শতবার গায়ত্রীমন্ত্র জপ করলেন।
এবার তাকিয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, অন্ধকারে চোখ অনেকটা সয়ে এসেছে। সম্মুখেই পড়ে আছে কোশাকুশির পাত্রটা। হাত বাড়িয়ে গঙ্গাজলে হাতটা ধুয়ে নিলেন। সঙ্গিনীর ও নিজমস্তকে পবিত্র গঙ্গোদক সেচন করলেন। জানতে চাইলেন, মন্দিরের ভিতরটা দেখতে পাচ্ছ মঞ্জরী?
—হ্যাঁ পাচ্ছি। ঐ তো শবাসনে মহাদেব; কিন্তু মাকে দেখতে পাচ্ছি না!
সেই জন্যই ঐ প্রশ্ন। বস্তুত রূপেন্দ্রও দেখতে পাচ্ছেন না মাতৃমূর্তিকে। বললেন, সেটাই স্বাভাবিক মঞ্জু। মহাদেব গৌরকান্তি, তাই এই অস্পষ্ট জ্যোৎস্নালোকে তাঁকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ঁমা যে ঘোর মসীবর্ণা—এই স্বপ্নালোকে তিনি তো অদৃশ্যই থাকবেন। দাও তোমার ডান হাতটা দাও!
–কেন?—প্রশ্নটা করল, হাতটাও বাড়িয়ে দিল।
রূপেন্দ্র ওর ঘর্মস্নাত হিমশীতল হাতটি অর্পণ করলেন শায়িত মহাদেবের চরণে।
বললেন, বাবার চরণস্পর্শ করে এখানে বসে থাক। ভয় কী? এর চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় কি দুনিয়ায় আছে? আমি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খড়্গটা সংগ্রহ করে আনি।
এবারও প্রতিবাদ করল না মঞ্জরী। এই কয়মাসেই সে রূপেন্দ্রনাথের স্ত্রী থেকে যেন উন্নীত হয়েছে—একবগ্গা-ঠাকুরের সহধর্মিণীতে। দুহাতে চেপে ধরল বাবার চরণ।
রূপেন্দ্র দেওয়াল হাড়ে হাড়ে চলে গেলেন মাতৃমূর্তির পিছন দিকে। অনুমান নির্ভুল। প্রাচীরে একটি কীলক থেকে প্রলম্বিত অবস্থায় মায়ের একটি খড়্গ। হাত বাড়িয়ে সেটা নামালেন। ডাকেন, মঞ্জু?
—উ?
—যা খুঁজছি তা পেয়ে গেছি। এখন কি “মাকে দেখতে পাচ্ছ? ভয় নেই। আমি এখনই আসছি।
পুনরায় নীরন্ধ্র অন্ধকারে মন্দির-প্রাচীরে হাত বুলাতে বুলাতে ফিরে আসতে থাকেন। হঠাৎ তাঁর মনে একটা প্রশ্ন জাগল। এই ঘোর অন্ধকারে এতটা সময় অতিবাহিত করার পরেও কেন মাতৃমূর্তির কোনও আভাসই পাচ্ছেন না? তাঁর একার দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি। মঞ্জু ও পাচ্ছে না! সেই ঘনান্ধকারে রূপেন্দ্রনাথ তাঁর দক্ষিণ হস্তটি বাড়িয়ে দিলেন। মন্দির-তলের দুই-হস্ত উপর দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে হস্তসঞ্চালনে একটি আনুভূমিক বৃত্ত রচনা করলেন।
বজ্রাহত হয়ে গেলেন রূপেন্দ্রনাথ!
যে উচ্চতায় উনি আনুভূমিক বৃত্তে হস্তচালনা করেছেন তাতে মায়ের পৃষ্ঠদেশের স্পর্শ পাওয়ার কথা! কিন্তু তিলমাত্র বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে নীরন্ধ্র অন্ধকারে তাঁর হস্ত শূন্যে একটি অর্ধচন্দ্র রচনা করল! তার অর্থ?
অর্থ একটাই! শবাসনে শায়িত মহাদেবের বুকের উপর সেই নগ্নিকা নৃমুণ্ডমালিনী নাই!! এই প্রথম সংযম হারালেন রূপেন্দ্রনাথ! অকস্মাৎ গর্জে উঠলেন তিনি। মন্দিরের প্রাচীরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল তাঁর ভর্ৎসনা—ঐ নিরুদ্দিষ্টার উদ্দেশ্যে :
—কাকে ভয় দেখাচ্ছিস্ রে! আমরা তিনপুরুষে তন্ত্রসাধক! জ্ঞানত কখনো অন্যায় করিনি! তেমন ঁমায়ের সন্তান নই আমি! শোন্ :
উদাত্তকণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকেন :
“ধ্যায়োদ্দেবীং বিশালাক্ষীং তপ্তজাম্বুনদ প্রভাম্।
চতুর্ভুজাং অম্বিকাংচণ্ডীং খড়গং-খেটক-ধারিণীং।।
নানালঙ্কার ভূষিতাং রক্তাম্বর ধরাং শুভাং।
সদা ষোড়শ বর্ষীয়াং প্রসন্ন্যাস্যাং ত্রিলোচনাং।।
মুণ্ডমালাবলীরম্যাং পীনোন্নত পয়োধরাং।
শবোপরি মহাদেবীং জটা মুকুট মণ্ডিতাং।।
শত্রুক্ষয়করীং দেবীং সাধকাভীষ্টদায়িকাম্।
সৰ্ব্বসৌভাগ্য জননীং মহাসশৎ প্রদাং স্মরেৎ।।”
—শুলি? আমি সেই মহাদেবী-জননীর সন্তান! আমার “ মা নগ্নিকা ‘শ্মশান’কালী নন, দিগম্বরী ‘জগৎ-পালিকা’ আদ্যাশক্তি! তিনি ভক্তকে ভয় দেখান না! অভয় দেন! যা—শ্মশানে নেচে বেড়াগে যা! আমি তোকে পরোয়া করি না।
ক্রোধে কম্পিততনু রূপেন্দ্রনাথ ফিরে আসেন মন্দিরের সামনের দিকে। হামাগুড়ি দিয়ে। ডাকেন, মঞ্জু?
সাড়া নেই! মঞ্জরী মূর্ছিতা হয়ে পড়ে আছে মহাদেবের চরণপ্রান্তে!
দাঁত দিয়ে চেপে ধরলেন খড়গটা। সংজ্ঞাহীনা সঙ্গিনীর দেহটা তুলে নিলেন দুহাতে! সেই প্রথম দিনটির মতো! আহা! যেন মূর্ছিতা কবুতরটি!
আবার তাকে নাটমন্দিরের চাতালে শুইয়ে দিলেন। কোশাকুশির গঙ্গোদক ছিটিয়ে দিলেন তার মুখে। একটু পরেই জ্ঞান ফিরে এল। উঠে বসল। বললে, তুমি তখন বকাবকি করছিলে কাকে?
রূপেন্দ্রনাথ হেসে ফেলেন। বলেন, তোমাকে নয়, মঞ্জু!
—তা বুঝেছি। কিন্তু মাকেই বা ভর্ৎসনা করলে কেন? মা-কে কি গাল দিতে হয়?
—হয়! সন্তানের ভুল হয়, আর মায়ের হয় না? তেমন তেমন ভক্তের হাতে পড়লে ভগবানেরও অবস্থা কাহিল হয়। না হলে স্বয়ং নারায়ণ কেন ভৃগুপদচিহ্ন বুকে ধারণ করবেন? বল? তুমি কবিরঞ্জন রামপ্রসাদের নাম শুনছে?
—না, কে তিনি?
এক মহাসাধক। মা কালীকে তিনি বলেছেন—‘এবার কালী তোমায় খাব। তোমার মুণ্ড-মালা ছিঁড়ে নিয়ে অম্বলে সম্বরা দিব।’
মঞ্জরী হেসে ওঠে। বলে, ও মা! এমন বিশ্রি কথাটা বলতে পারলেন তিনি?
—হাঁ! শুধু বলেই থামেননি, গানে সুর দিয়ে তিনি ঐ গান মাকেই নিত্যি শোনান।
খড়্গখানি হাতে পেয়ে রূপেন্দ্রনাথ অনেকটা মনোবল ফিরে পেয়েছেন। মাকে ভর্ৎসনা করে পেয়েছেন তৃপ্তি! ‘বেটি’র কী দুঃসাহস! তাঁকে ভয় দেখাতে চায়!
মঞ্জরী হঠাৎ উঠে বসে, ঐ দেখ কারা যেন আসছে!
রূপেন্দ্র খড়্গাখানি বাগিয়ে ধরে উঠে দাঁড়ান। মঞ্জরীও দাঁড়ায় তাঁর পাঁজর! ঘেঁসে। সত্যিই মশাল হাতে কারা যেন গ্রামের দিক থেকে এগিয়ে আসছে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা। তাদের মধ্যে পুরুষটি চিৎকার করে ডাকল : কোবরেজ মশাই!
ওঁকেই খুঁজছে। রূপেন্দ্র সাড়া দিতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ক্ষিপ্রবেগে মঞ্জুরী ওঁর মুখ চেপে ধরে।
কী হল? ওরা আমাদেরই খুঁজছে। আমাদের দলেরই লোক …
–হোক! তিনবার ডাকুক। চতুর্থবার সাড়া দিও!
রূপেন্দ্র বুঝতে পারেন এই অনুরোধের মর্মার্থ। ‘নিশির ডাক’! প্রথম তিনবার ডাকলে সাড়া দিতে নেই। চতুর্থবার ডাকবার ক্ষমতা নেই সেই অপদেবতার।
রূপেন্দ্র বললেন, ‘নিশির ডাক’ একটা কুসংস্কার! আমি তা মানি না!
—আমি মাথার দিব্যি দিচ্ছি কিন্তু!
—আমি যদি কখনো তোমার পরামর্শের বিরুদ্ধে যাই তাহলে যুক্তিতর্কে আমাকে স্বমতে আনবার চেষ্টা কর, মঞ্জু! মাথার দিব্যিতে কোন লাভ নেই! ওটাও একটা কুসংস্কার! আমি মানি না!
রূপেন্দ্রনাথ সাড়া দিলেন।