তীর্থের পথে – ৮

কুসুম বিস্মিতা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবাদ করেনি। আহ্বানমাত্র ওঁর সঙ্গে নেমে এসেছিল পথে। এখনো সন্ধ্যা রাত। শুক্লা সপ্তমী। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নালোক, তবু পথঘাট দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। হাটতলার সীমানার বাহিরে এসে জানতে চেয়েছিল, কোথায় চলেছি আমরা?

রূপেন্দ্র বললেন, শঙ্খঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছ না? ঐ মন্দিরে। মন্দির চাতালেই গিয়ে রাতটা কাটাবো।

—কেন গো? ওঁরা আমাদের খুঁজবেন না রাতে?

—না, খুঁজবেন না। কর্তা-মশাই বুঝবেন। কাল সকালেই তো আমরা ফিরে আসব। আমাদের পোটলা-পুঁটলি তো রেখেই যাচ্ছি

—তা না হয় হল; কিন্তু হাটতলায় রাত কাটাতে কী অসুবিধা ছিল?

পথ চলতে চলতে রূপেন্দ্র সংক্ষেপে জানালেন ওদের নৈশ-সাধনার কৌলিক প্রথার কথা। সে পরিবেশে রূপেন্দ্রনাথ সস্ত্রীক রাত্রিযাপন করতে অসমর্থ। সব কথা শুনতে শুনতে কুসুম স্তম্ভিত হয়ে গেল। এ-কথা তার ধারণার বাইরে। বৈষ্ণব বাবাজীদের অনেক কাণ্ড-কারখানার কথা সে জানে, রূপনগরের মোহান্ত মহারাজের আখড়ায় যে-জাতের ব্যভিচার হত তাও শুনেছিল মাসির কাছে। কিন্তু প্রতি রাতে পর্যায়ক্রমে শয্যাসঙ্গীর পরিবর্তনের কথাটায় তার কেমন যেন বিবমিষার উদ্রেক হল। বললে, রাধাদিও তাই করে?

—একা সেই নয়, সবাই। এটাই তাদের কৌলিক ক্রিয়াকলাপ। ওরা সব পুরুষের ভিতর শ্রীকৃষ্ণকে, সব নারীদেহেই শ্রীরাধিকার সন্ধান করে।

—আমরা বরং এর পর একা-একাই তীর্থে-তীর্থে ঘুরব, কেমন?

রূপেন্দ্রনাথ হাসেন। বুঝতে পারেন, কুসুমের আজন্ম-লালিত সংস্কারে এ বার্তা কী জাতের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। শ্রবণমাত্র গোটা দলটাকে সে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। বললেন, সে-কথা কাল বিবেচনা করে দেখা যাবে। আপাতত ঐ শয়নারতি শেষ হবার আগেই আমাদের মন্দিরে পৌঁছতে হবে। একটু পা চালিয়ে চল।

মন্দিরটি গ্রামের বাইরে। কোন্ দেবী বা দেবতার মন্দির জানা নেই। তবে আলোর একটা আভাস দেখা যাচ্ছে। আর শোনা যাচ্ছে শঙ্খঘণ্টাধ্বনি। পুরোহিত বোধকরি শয়নারতি করছেন। এর পর গর্ভগৃহে শিকল তুলে তিনি চলে যাবেন। তার পূর্বেই পুরোহিতের অনুমতি নিয়ে মন্দির চাতালে রাতটুকু কাটিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা চাই। কর্তা-মশাই সহজেই বুঝবেন—কেন উনি ঐ যৌথ শয়নব্যবস্থায় সামিল হতে পারলেন না। আর ভোর-রাত্রে তো ওঁরা দুজন ফিরেই আসবেন।

পথ চলতে চলতে উপলব্ধি করলেন—মন্দিরটি গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে। একটা নদীর কিনার ঘেঁষে। আরও কাছাকাছি এসে বুঝলেন—এটি একটি শ্মশান। ভাঙা হাঁড়ি, দূরে একটি চিতা জ্বলছে। দু-চারজন ঐ অগ্নিকুণ্ড ঘিরে বসে আছে। কথাটা প্রকাশ করলেন না। কুসুম যদি এটা খেয়াল না করে তাহলে তার পক্ষে না জানাই ভাল। অহেতুক ভয় পাবে।

কালীমূর্তি। পুরোহিত পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে আরতি করছেন। দুটি ছোট ছেলে কাঁসর-ঘণ্টা বাজাচ্ছে। স্থানটা বস্তুত জনমানবহীন। শুধু একজন বৃদ্ধ দোলাই গায়ে ‘অন্তরাল’-এ বসে আছেন যুক্তকরে। একমাত্র দর্শক বা ভক্ত। ওঁদের দুজনকে এগিয়ে আসতে দেখে চোখ তুলে একবার দেখলেন। তারপর নিমীলিতনেত্রে বোধকরি কালীস্তোত্র আওড়াতে থাকেন।

আরতি শেষ হল। পুরোহিত পিতলের প্রজ্জ্বলিত কর্পূর-দীপটি হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন। কাঁসরঘণ্টা বাদকদের মাথায় অগ্নিতাপ দিলেন। বৃদ্ধের দিকেও দীপাধারটি এগিয়ে ধরলেন। বৃদ্ধ দোলাই থেকে দক্ষিণহস্তটি বার করে তাপ নিলেন। তারপর পুরোহিত ওঁদের দুজনকে দেখে একটু যেন চমকে ওঠেন। দীপাধারটি বাড়িয়ে ধরেন। রূপেন্দ্র তার তাপ নিলেন, স্পর্শ করালেন কুসুমের মাথায়। এরপর চরণামৃত পান।

পুরোহিত মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওঁদের দেখছিলেন। রূপেন্দ্রকে প্রশ্ন করেন, ভিনদেশী মনে হচ্ছে? পূর্বে তো হরিপালে কখনো দেখিনি?

রূপেন্দ্র যুক্তকরে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। ভিনদেশী। বর্ধমানে বাড়ি। চলেছি ত্রিবেণীর ঘাটে তীর্থযাত্রী। কাল সকালেই সিঙ্গুর যাব।

—মাত্র দুজন? সচরাচর এমনটি তো হয় না, বাবা?

—আজ্ঞে আমরাও বড় দলে আছি। বাকিরা হাটতলায় রাত্রিযাপন করছে। শয়নারতির শব্দ শুনে আমরা দুজন দেবীদর্শনে এগিয়ে এলাম। মা যেন ডাক পাঠালেন। মূর্তি কি মহাকালীর?

–আজ্ঞে না, ইনি বিশালাক্ষী। মহাকালীরই আর এক রূপভেদ। আপনাদের দুজনের নৈশ আহার হয়েছে? মায়ের প্রসাদ আছে-

রূপেন্দ্র বললেন, আমাদের নৈশাহার সমাপ্ত হয়েছে। তবে প্রসাদের কথা যখন বলেছেন তখন ঐ নৈবেদ্যের কণিকামাত্র প্রদান করুন। …একটা কথা বাবা, আমরা দুজন যদি ঐ নাটমন্দিরে রাত্রিবাস করি তাহলে কি আপত্তি আছে?

রীতিমতো চমকে উঠলেন পুরোহিত। বললেন, আপত্তির কিছু নাই। তবে এ স্থানটি জনমানববর্জিত। আমরা এখনি দ্বাররুদ্ধ করে চলে যাব। ঐ দূরে আমার দেবোত্তর ভদ্রাসন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমার গৃহে স্থানাভাব ….

দোলাই-গায়ে এতক্ষণ নিঃশব্দে ওঁদের কথোপকথন শুনে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দৃঢ়স্বরে তিনি বলে ওঠেন, কিন্তু আমার গৃহে স্থানাভাব নেই। না হয়, কিছু অসুবিধাই হবে; তাই বলে এই শ্মশানে একা …

কুসুমমঞ্জরী অস্ফুটে বলে ওঠে, শ্মশান!

—দেখছ না মা? ঐ তো চিতা জ্বলছে!

রূপেন্দ্র পুরোহিতমশাইকে প্রশ্ন করেন, এঁর পরিচয়টা …

পুরোহিত সে-কথার জবাব না দিয়ে বৃদ্ধের দিকে ফিরে বলেন, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করেন ঘোষাল মশাই! মায়ের ইচ্ছায় এভাবে বাধা দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? শুনলেন না—উনি বললেন, ‘মা যেন ডাক পাঠালেন!’

ঘোষাল অহেতুক থর-থর করে কেঁপে ওঠেন। উঠে দাঁড়ান। লুটিয়ে পড়া দোলাইটা গায়ে জড়িয়ে যুক্তকরে রূপেন্দ্রকে বলেন, না বাবা! মিছে কথা বলেছিলাম! আমার ঘরেও স্থানাভাব! আমি চলি … তারা! তারা! মা …

যেন আকণ্ঠ কারণ-বারি পান করেছেন! টলতে টলতে বৃদ্ধ মন্দির ছেড়ে বার হয়ে গেলেন।

রূপেন্দ্র পুনরায় একই প্রশ্ন পেশ করেন, উনি কে?

—হরিপালের একজন তান্ত্রিক গৃহস্থ। বৃদ্ধবয়সে কিছুটা মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তাহলে, আপনারা দুজন ঐ মন্দির-চাতালেই রাতটা কাটাচ্ছেন? না, ভয়ের কিছু নাই। চোর-ডাকাত ত্রিসীমানায় নেই। ‘লতা’র উপদ্রবও নাই এ অঞ্চলে। কিন্তু শয্যাদ্রব্য তো কিছু দেখছি না?

—একটা রাত তো! যা হোক করে কেটে যাবে।

পুরোহিত কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। পূজার বাসনপত্র অহেতুক কিছু নাড়াচাড়া করলেন। হঠাৎ ঐ ছেলেদুটিকে বিনা কারণে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বসলেন, তোরা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা, ঘর্ যা!

ছেলে দুটি প্রায় হুড়মুড়িয়ে ঘর ছেড়ে বার হয়ে গেল।

পুরোহিত আবার আশ্বাসবাণী শোনালেন, ঁমায়ের স্থান। ভয়ের কিছু নাই! তাছাড়া জমিদার মশায়ের ব্যবস্থাপনায় পাহারাদার চৌকি দেয়। তার হাঁক শুনবেন প্রহরে প্রহরে—জাগতে রহো’! ভয় পাবেন না।

কুসুমের মুখটা রক্তশূন্য। রূপেন্দ্র বললেন, না, ভয় পাব কেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ! ঁমায়ের আহবানে এসেছেন! ঁমায়ের অঞ্চলতলে আশ্রয় নিয়েছেন!ভয় কী? আমি তাহলে চলি, বাবা-

কাঁসর-ঘণ্টা বাদক ছেলে দুটি তাড়া খেয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল বটে কিন্তু একেবারে স্থানত্যাগও করেনি। দাঁড়িয়েছিল ‘অন্তরাল’-এর স্তম্ভের আড়ালে।

পুরোহিত-মশাই এরপর যে কাণ্ডটা করলেন তার কার্যকারণ কিছু বোঝা গেল না। উনি মন্দিরদ্বারের বাহিরে একবার উকি দিয়ে দেখলেন। ছেলেদুটিকে দেখতে পেলেন না। হঠাৎ তুলে নিলেন ফলকাটার একটা বঁটি। তার ধারালো ফলায় দক্ষিণহস্তের মধ্যমাটা চেপে ধরলেন। রক্ত ফুটে বার হল। উনি প্রায় কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এসে ঐ বহিরাগত দম্পতির ললাটে রক্ততিলক এঁকে দিলেন।

বিস্মিত রূপেন্দ্রনাথ প্রশ্নটা না করে পারলেন না, এর মানে কী?

—এটাই প্রথা! আসুন, প্রণাম করুন ঁমাকে। এবার আমি দ্বাররুদ্ধ করব।

প্রণামান্তে ওঁরা তিনজনে বার হয়ে এলেন গর্ভগৃহ থেকে।

ঠিক তখনই এগিয়ে এল কাঁসর-বাদক। আচমকা কুসুমমঞ্জরীর আঁচলে একটা টান দিল। কুসুম চমকে পিছন ফেরে। বলে, ও কী করছ?

—না, মানে দেখছি, আপনার আঁচলে চাবি বাঁধা আছে কি না!

–চাবি! কেন?

পুরোহিত-মশাই ঘুরে দাঁড়ালেন। প্রচণ্ড একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন ছেলেটার মাথায়। ওরা দুজন ছুটে পালালো।

রূপেন্দ্র বলেন, কী ব্যাপার বলুন তো? ওর ঐ অদ্ভুত কৌতূহল হল কেন? আমার স্ত্রীর আঁচলে চাবি বাঁধা আছে কি না …

পুরোহিত কোনক্রমে বললেন, বালকের কৌতূহলের কি কোন মাথামুণ্ডু থাকে? আচ্ছা চলি! আপনার নামটিও জানা হয়নি … না, না, থাক … সে সব কথা কাল সকালে হবে …:

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *