৭
“বাউল’-তত্ত্বের মতো ‘বাউল শব্দটির উৎপত্তিও রহস্যাবৃত। ক্ষিতিমোহন সেন-মশায়ের মতে বায়ুগ্রস্ত অর্থাৎ পাগলাটে ধরনের মানুষকে লোকে বাউল বলত, অথচ ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সিদ্ধান্ত ‘আউয়াল’ শব্দ থেকে প্রথমে ‘আউল’ এবং পরে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। সুনীতিকুমার বলেছিলেন, দেশজ শব্দ ‘বাউল্যাং এর গঙ্গোত্রী। আবার ইদানীং কোন কোন পণ্ডিতের মতে ‘ব’-সাধনায় ‘উল’ বা সিদ্ধিলাভ যে করেছে সেই হচ্ছে ‘বাউল’। তা এসব তো আজকালের কথা। আমাদের কাহিনীর কালে কোথায় বা ব্রজেন শীল আর কোথায় বা সুনীতি চাটুজ্জে! তা হোক, তবু তখনও বাউল সাধকেরা জানতেন ‘ব’-সাধনার কথা, এবং সেপথে কী ভাবে ‘উল’ হতে হয়!
বাউল কোন ধর্মসম্প্রদায় নয়, গুহ্যমার্গের এক বিশিষ্ট সাধনার স্তরে সিদ্ধিলাভই তাঁদের লক্ষ্য। ত্রিকোণাকৃতি ঐ ব’-অক্ষরটি প্রকৃতির দ্যোতক ত্রিবেণীর ঘাট! সেই ঘাটে জোয়ানের গোনে মীনের প্রত্যাশায় প্রহর গোণা! রজ-বীজ, নীর-ক্ষীর, রূপ-স্বরূপের ক্রিয়াচারে রসের ভেয়ানে সহজ মানুষ সেখানে মনের মানুষ খোঁজে। ব্রহ্মাণ্ড সেখানে ধরা দেয় ভাণ্ডে! ভাণ্ড কোথায় পাব? কেন? এই তো নবদ্বারী মানবদেহ! পুরুষ-প্রকৃতি দমের কাজে, রসের ভেয়ানে, অটল বীজরূপী পরমাত্মার সঙ্গজনিত মহানন্দের আস্বাদ পায়। তা, এসব হল গিয়ে তত্ত্ব কথা! তুমি-আমি বুঝব না—বুঝবে রসিকজন। সহজ ভাষায়: পরমদেবতা শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগলরূপ মানবদেহে নিত্য বিরাজমান। তাঁকে খুঁজে দেখ, পাবে। নরদেহ পরিত্যাগ করে 1. বেহুদ্দো তাকে বাইরে খুঁজতে যেও না। এ যেন কপালে চশমা তুলে,অন্ধ হয়ে চশমা খোঁজা :
“কারে বলবো কে করবে বা প্রত্যয়
আছে এই মানুষে সত্য নিত্য চিদানন্দময়।।”
বাউল সচরাচর একটি মাত্র সাধনসঙ্গিনীকে নির্বাচন করে। তারই সঙ্গে জীবন বিকায়। সাধনপদ্ধতি অতি গুহ্য ব্যাপার। তার ভিতর এমন সব ক্রিয়াকলাপ আছে যা সাধারণ মানুষের কাছে রীতিমতো বীভৎস, ন্যক্কারজনক মনে হতে পারে, যেমন ‘চারিচন্দ্রভেদ’ ক্রিয়া। কিন্তু বাউল তাকেও পবিত্র পুরুষার্থ-সাধন বলে বিশ্বাস করেন। অক্ষয়কুমার দত্ত বলছেন, “সকল কথা অন্যের জানিবার উপায় নেই; জানিলেও পুস্তকে সবিশেষ বিবরণ প্রদান সঙ্গত নহে।” মোটকথা, বাউল বিশ্বাস করেন—ঐ ঐকান্তিক প্রেম যখন পরিপক্ক হয়, তখন আর স্ত্রী-পুরুষে ভেদাভেদ থাকে না—আত্মবিস্মৃত যুগল সাধকসাধিকা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে শ্রীরাধাকৃষ্ণের পবিত্রলীলায়; বিলীন হয়ে যান :
‘তখন আপনি পুরুষ কি প্রকৃতি
নাইকো জ্ঞান কিছুই স্থিতি
অকৈতব ঠিক যেন ক্ষিতি—বাক্য নাই।।”
আউলেচাদের প্রত্যক্ষ শিষ্য ‘প্রথম কর্তা-মশাই’ এই পথেই সাধনমার্গে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তারপর তাঁর সাধনসঙ্গিনীর দেহান্তে তাঁর এক বিচিত্র উপলব্ধি হল। তাঁর মনে হল—‘বাউল’-তত্ত্ব অত্যন্ত জটিল। রাধাতত্ত্বের সঙ্গে পরকীয়া-তত্ত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাউল যদি তার একমাত্র ঐ সাধনসঙ্গিনীর দেহমন্দিরে ‘রাধা’কে খোঁজে, তবে সে পরকীয়া-তত্ত্বকে অস্বীকার করতে বাধ্য হয়। একমুখী সেই প্রেমের সঙ্গে গৃহস্থ-মানুষের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের কী প্রভেদ? দ্বিতীয়ত ঐ ‘চারিচন্দ্রভেদ’ ক্রিয়াটিকেও তিনি তত্ত্বগতভাবে স্বীকার করতে পারছিলেন না। তাঁর প্রতীতি হল—এই বিশ্বপ্রপঞ্চে তো একমুখী প্রেম স্বীকৃত নয়। পশুপক্ষী, সরীসৃপ, মৎস্য, কীটপতঙ্গ তো প্রকৃতি-পুরুষের লীলাখেলায় এই প্রাণহীন পৃথিবীকে অনায়াসে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। তাদের কাছে তো স্বকীয়-পরকীয়ার প্রভেদ নেই। এই ধারণাটা শুধুমাত্র মানুষের—সামাজিক বিধানে এই বাধা। এ বাধা উত্তরণই পুরুষার্থ!
তিনি নতুন বিধান দিলেন। সহজ সমাধান—‘সহজী’ পন্থা।
বরাতিদের অর্থাৎ শিষ্য-শিষ্যাদের প্রেম একমুখীন হতে পারবে না। সবাই কৃষ্ণ, সবাই রাধা।
বললেন, গুরু দুই প্রকার—দীক্ষা গুরু ও শিক্ষা গুরু। বিপত্নীক দলনেতা হলেন স্বয়ং দীক্ষাগুরু। তিনি শিষ্য শিষ্যাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন—বুঝিয়ে দেন সাধনমার্গের আচরণবিধি। কিন্তু নিজে তিনি ইন্দ্রিয় সংযমে অভ্যস্ত। প্রকৃতি সাধনে বিরত। কিন্তু প্রতিটি শিষ্য-শিষ্যার একাধিক শিক্ষাগুরু—এক এক রাত্রে এক এক জন। পর্যায়ক্রমে। দলভুক্ত প্রতিটি পুরুষের ভিতর সেই পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান করবে শিষ্যারা; যেমন প্রতিটি বরাতি প্রতিটি দলভুক্তা প্রকৃতির তনু-মন্দিরে খুঁজবে শ্রীরাধিকাকে। মন্ত্র হল :
“গুরু করব শত শত মন্ত্র করবো সার।
যার সঙ্গে মন মিলবে দায় দিব তার।।”
শিষ্য-শিষ্যা জোটাতে অসুবিধা হল না। অন্যান্য সম্প্রদায়ের পুরুষ কিসের টানে এসে জুটল তা অনুমান করা শক্ত নয়। পুরুষ স্বভাবতই বৈচিত্র্যসন্ধানী—‘নাল্পে সুখমস্তি’ মন্ত্রটা জানুক না জানুক, তারা গুটিগুটি এসে জুটল। শিষ্যারা এল নানান ঘাট থেকে—অধিকাংশই সমাজত্যক্তা। উপায়ান্তরবিহীন! পতিতালয়ের চেয়ে এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আশ্রয়লাভই বাঞ্ছনীয় মনে করল তারা।
দ্বিতীয় কর্তা-মশাইও এসে যোগদান করেছিলেন প্রথম যৌবনে।
দীর্ঘদিন সহজী-পন্থায় সাধনভজন করে পৃথক আখড়ায় এখন গদিয়াল হয়েছেন। ‘কর্তা-মশাই’ পদলাভ করেছেন প্রৌঢ়ত্বের সীমান্তে। অসুবিধা হয়নি কিছু। যৌবন তখন অস্তমিত। প্রথম সমস্যা দেখা দিল বছর-পাঁচেক আগে। মনে সংশয় জাগল—পথটা কি ঠিক? এ সন্দেহ জাগল একটি সদ্য আগত দম্পতিকে কেন্দ্র করে। তারা স্বামীস্ত্রী—যুগলে এসে যোগদান করল সম্প্রদায়ে, বিচিত্র হেতুতে : শীতলচন্দ্র আর রুক্মিণী
শীতলচন্দ্র সম্পন্ন গৃহস্থের সন্তান। ব্রাহ্মণ, কিন্তু সব ছেড়ে ছুড়ে সংসার ত্যাগ করে স্ত্রীর হাত ধরে পথে বার হয়েছিল। এ-ঘাট সে-ঘাট সেরে এসে পৌঁছালো ওঁদের আখড়ায়।
শীতলের বিবাহ হয়েছিল তের বছর বয়সে, ভিনগাঁয়ের এক নোলক-দোলানো নবমবর্ষীয়ার সঙ্গে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে গৌরীদানের পর রুক্মিণীর পিতৃদেব তাকে স্বগৃহেই মানুষ করেছিলেন। কন্যা বয়ঃপ্রাপ্তা হলে বৈবাহিককে সংবাদ পাঠালেন—এবার দ্বিরাগমনের আয়োজন করতে। বিবাহের অব্যবহিত পরে যদি দ্বিরাগমন হয়, তাহলে দিনক্ষণ দেখতে হয় না। অন্যথায় বৈশাখ, অগ্রহায়ণ অথবা ফাল্গুন মাসে—রবি, চন্দ্র ও বৃহস্পতি শুদ্ধ থাকলে—যাত্রোক্ত শুভলগ্নে দ্বিরাগমন প্রশস্ত। শীতলের পিতৃদেব দিনক্ষণ বিচার করে পুত্রকে পাঠিয়ে দিলেন শ্বশুরালয়ে। প্রত্যাগমন দিবসের এক সপ্তাহ পূর্বেই। অনুরোধটা সেই জাতেরই ছিল বৈবাহিক মহাশয়ের—নতুন জামাইকে কিছু আদর-আপ্যায়ন করতে চায় পুরললনার দল। শীতল তখন বিংশতিবর্ষীয় তরুণ, রুক্মিণীর যৌবনভারনম্র দেহে ষোলকলা পুরেছে। মাত্র সাতটি দিবসরজনীর সাধনা—কিন্তু তার ভিতরেই শীতলচন্দ্র তার সহধর্মিণীর মধ্যে উদ্ধার করল : শ্রীরাধাকে।
শীতলের পূজ্যপাদ পিতৃদেবের জ্যোতিষগণনায় বোধকরি কিছু ভ্রান্তি হয়ে থাকবে। দ্বিরাগমন নির্বিঘ্নে হল না। প্রত্যাবর্তনের পথে নববধূর পাল্কি রুখল একদল ডাকাত। বাধা দিতে গিয়ে শীতল মারাত্মকভাবে আহত হল। সালঙ্কারা ষোড়শী অপহৃতা হল ডাকাতের হাতে। সে আমলে জমিদারের হাতি বুড়ো হয়নি, তার গলায় ঢন্নঢনিয়ে ঘণ্টা বাজতো না—কিন্তু ঢাকিরা তখনো খালে-বিলে ঢাক বাজাতো! এ ঢাকের বাদ্যি যে সৃষ্টির প্রথম প্রভাত থেকে শেষ প্ৰলয় তক্। মারাত্মকভাবে আহত শীতলচন্দ্র তার সহধর্মিণীকে অবশ্য খুঁজে পেয়েছিল বনমধ্যে। না, তাকে খুঁজতে হয়নি, খুঁজে পেয়েছিল মেয়েটিই। নববধূর যাবতীয় স্বর্ণালঙ্কার অপহরণ করে নিয়ে গেছে ডাকাতদল। তার সঙ্গে আরও কিছু। শাঁখা-সর্বস্ব একবস্ত্রা ধর্ষিতাকে অরণ্যেই অচৈতন্য অবস্থায় ফেলে রেখে গেছে। জ্ঞান ফিরে আসার পর টলতে টলতে সে ফিরে আসে দুর্ঘটনার স্থলে। শীতল তখনো অচৈতন্য। তার মাথা ফেটে গেছে। রক্ত ঝরছে। রক্তক্ষরণ অবশ্য ঐ হতভাগিনীরও হচ্ছে তখনো—মাথা থেকে নয়, ঊর্ধ্বাঙ্গ থেকেই নয়। তবু পার্বত্য ঝরনায় শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে সে বারে বারে মুছিয়ে দিল স্বামীর ক্ষতস্থানটা। ক্রমে তারও জ্ঞান হল।
হতভাগ্য দম্পতি পদব্রজে ফিরে এল তাদের ভিটেতে, বহু কষ্টে।
তখনই শুনল মর্মান্তিক দুঃসংবাদটা! নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ঐ অপবিত্রা পুত্রবধূকে ঠাঁই দিতে পারবেন না তাঁর ভদ্রাসনে। বাপের বাড়িতেও মেয়েটিকে রেখে আসার পথ নাই। রুক্মিণীর একটি অনূঢ়া অনুজা আছে। নিগৃহীতা আত্মজাকে আশ্রয় দিলে ব্রাহ্মণকে অনিবার্যভাবে জাতিচ্যুত হতে হবে।
হতভাগিনীর সামনে তখন তিনটি খোলা পথ: পতিতালয়, ধর্মান্তরগ্রহণ অথবা আত্মহত্যা।
শীতলচন্দ্র দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিল : চতুৰ্থপথ!
স্ত্রীর হাত ধরে পথে নামল সে।
অনেক ঘাটে জল খেয়ে শেষ-মেশ কর্তামশায়ের স্নেহচ্ছায়ায় আশ্রয় পেল। তখন তাদের অবস্থা ভারতচন্দ্র বর্ণিত শিব-অন্নপূর্ণার মতো। সহজী-মতের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় মন দেবার অবকাশ নাই। বর্ষাকাল—সবার আগে চাই মাথার উপর একটা আচ্ছাদন, দু-বেলা দু-মুঠো অন্ন!
সমস্যা দেখা দিল। অন্য জাতের। অচিরেই কর্তামশাই অনুভব করলেন—‘সহজীতত্ত্ব’ ওরা মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি, করতে পারছে না। বিচক্ষণ লোক, আন্দাজ করলেন, সমাধান নিজে থেকেই হয়ে যাবে। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া জীবমাত্রের ধর্ম। মানিয়ে নিয়েছিল বলে মনেও হল। তারপর সন্দেহ জাগল। নানান সূত্রে। বুঝলেন—ওদের একমুখী প্রেম বহুধা হয়নি, হচ্ছে না। না শীতল, না রুক্মিণী। তার চেয়েও অবাক করা খবর—আখড়ার আর সব বরাতি ওদের ঐ অদ্ভুত তত্ত্বটাই মেনে নিয়েছে। নিতান্ত গোপনে। পর্যায়ক্রমে শীতল যাকে নিয়ে শয়ন করে সে যেন তার ভগিনী; রুক্মিণী যার কক্ষে রাত্রিবাস করে সে যেন তার অগ্রজ! আশ্রমিকেরা আপত্তি করে না! ঐ ধর্ষিতা মেয়েটির করুণ কাহিনী শুনে তারা, কী-জানি-কেমন করেওদের তত্ত্বটাই মেনে নিয়েছে! রুক্মিণী ‘রাধিকা’ নয়, ওদের বৌ-ঠাকরুণ!
এ কী অনাচার! আখড়ায় পাপ প্রবেশ করেছে! বিশ্বজনীন কৃষ্ণরাধা তত্ত্ব ওরা মানছে না—ঐ ওদের দুজনের ক্ষেত্রে। কর্তা-মশাই ভয় পেলেন! প্রকাশ্যে প্রশ্নটা পেশ করতে সাহস পেলেন না। যদি ওরাও প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে! আশঙ্কাটা অমূলক কিনা সেটা সবার আগে যাচাই হওয়া দরকার।
আশ্রমে কর্তামশায়ের জন্যে আছে একটি নির্দিষ্ট পর্ণকুটীর, বাদবাকি সকলের জন্য একট প্রকাণ্ড দোচালায় ছোট ছোট খুপরি। যে গৃহটির দেওয়াল নাই।
বাঁশখুঁটির উপর দো-চালা আর গবাক্ষের নিম্নতল পর্যন্ত বুকা-মুলি ততা বাঁশের বরফি-জাফরি। জানলার বালাই নেই। যেহেতু দাম্পত্যজীবনের গোপনতা নিষ্প্রয়োজন তাই গৃহনির্মাণে এই ব্যয়সঙ্কোচ। নৈশ-আহারান্তে বরাতিরা যখন সাধনসঙ্গিনীদের হাত ধরে জোড়ায়-জোড়ায় নিজ নিজ কক্ষে চলে যায় তখন বিনিদ্রনয়নে জেগে বসে থাকেন কর্তামশাই। তাঁকে দেখতে হবে, জানতে হবে—আখড়ায় অনাচার প্রবেশ করেছে কিনা। গুরুর নির্দেশ—প্রকৃতি-পুরুষের অনাবিল সাধনা অব্যাহত আছে কিনা। কৃষ্ণপক্ষের ঘনান্ধকারে ধ্বনিনির্ভর সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হতে পারে, কিন্তু শুক্লপক্ষে কিছুই গোপন থাকে না।
ঘরে ঘরে সাধনরত প্রেমিকযুগল প্রকৃতি-পুরুষের সেই আদিম সংস্কারে কৈবল্যানন্দ লাভের জন্য উদ্গ্রীব আর বৃদ্ধ নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সারারাত ঘুরে মরেন অতৃপ্ত প্রেতের মানসিকতায় বক্ষপদ সরীসৃপের ভঙ্গিতে। কোন কক্ষে কীজাতের ক্রিয়াকলাপ হচ্ছে! শুক্লপক্ষের চন্দ্রকলা যেমন ক্রমশ পূর্ণতার পথে অভিসারী, ওঁর প্রত্যক্ষজ্ঞানও তেমনি তিল তিল করে পরিণত হতে চলেছে। ক্রমে দৃঢ় প্রতীতি জন্মালো—তাঁর আশঙ্কা অমূলক নয়। রুক্মিণীকে একরাতে দেখতে পেলেন না আশ্রমিক কোন বরাতির বাহুবন্ধে পরম তৃপ্তিতে নিদ্রা দিতে। তেমনি আশ্রমের অন্য কোন নারীকেও বারেকের তরে দেখতে পেলেন না শীতলচন্দ্রের বক্ষলীনারূপে! এ কী অনাচার! এ কী পাপ!
তারপর এক রাত্রি। সেটা পূর্ণিমার কাছাকাছি। ফিনকি দিয়ে কাকজোৎস্না ফুটেছে। বৃদ্ধ জানতেন পালাবদলের পালায় পর্যায়ক্রমে সে রাত্রে শীতলচন্দ্র আর রুক্মিণী একই সাধন কক্ষে। রাত্রি তৃতীয় প্রহর। চরাচর নিস্তব্ধ। নিঃশব্দসঞ্চারী উরগের মতো চার হাতে-পায়ে এগিয়ে এলেন সেই নির্দিষ্ট কক্ষটির নিকটে। অতি সন্তর্পণে কক্ষমধ্যে দৃপাত করেই বৃদ্ধ যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েন। হ্যাঁ, সাধনতত্ত্বের গৌরীশৃঙ্গে উন্নীত হয়েছে, ওরা—”তখন আপনি পুরুষ কি প্রকৃতি/নাইকো জ্ঞান কিছুই স্থিতি—
ওরা বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত। কিন্তু তিনি? যা জানবার তা তো জেনেছেন, তাহলে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছেন না কেন? সরে যেতে পারছেন না কেন অন্তরালে? প্রচণ্ড আত্মধিক্কারে মনটা বিষিয়ে গেল! কোনক্রমে টলতে টলতে ফিরে এলেন নিজের কক্ষে। আত্মদর্শন হল যেন! এই যে পক্ষকাল ধরে একটি বৃদ্ধ অতৃপ্ত প্রেতের মতো ঘরে ঘরে উকি দিয়ে ফিরেছে সে কি সত্যই আশ্রমের হিতার্থে সরেজমিন তদন্ত করছিল? নাকি সেই হতভাগ্য ছিল যৌবনোত্তীর্ণ এক সঙ্গিনীহীন দর্শনকামী? তত্ত্বদর্শন নয়, চর্মচক্ষুর দর্শন! না হলে কেন স্বেদবিন্দু ফুটে উঠেছে তাঁর ললাটে, দ্রুততর হয়েছে নাড়ির গতি, উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সর্বদেহ।
ছি—ছি—ছি! এ কী দেখলেন! তার চেয়েও বড় কথা—দর্শনজনিত এ কী অসংযমী অধঃপতন!
শীতল আর রুক্মিণীকে পরদিন বিতাড়ন করলেন আশ্রম থেকে। নিজে চান্দ্রায়ণ ব্ৰতে প্রায়শ্চিত্ত করলেন একমাস কাল।
.
রূপেন্দ্র বলেন, তাহলে আপনার সমস্যা তো মিটেই গেছে। নিজেও প্রায়শ্চিত্ত করেছেন, অপরাধীরাও বিতাড়িত হয়েছে।
চক্ষুমার্জনা করে কর্তা-মশাই বললেন, না, ধন্বন্তরি-মশাই। সমস্যা মেটেনি। আবার নতুন জাতের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সে বিষয়েই আপনার পরামর্শ নিতে চাই। কিন্তু তার পূর্বে আমাকে বলুন—আমাদের এই সহজিয়া সাধনমার্গের মূলেই কি কোনও ভ্রান্তি আছে? বারে বারে কেন এ জাতীয় প্রত্যবায় হচ্ছে?
রূপেন্দ্রনাথ মেদিনীবদ্ধ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ চিন্তা করলেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। যারা ভিক্ষায় গিয়েছিল তারা এখনো প্রত্যাবর্তন করেনি। বরাতিরা দূরে দূরে নিজ-নিজ কাজে ব্যস্ত। কুসুমমঞ্জরী আর রাধা রন্ধনকার্যে ব্যাপৃতা। ওঁর মনে হয়—ঐ সরল জিজ্ঞাসুকে প্রত্যাখ্যান করা অন্যায় হবে। বললেন, কর্তা-মশাই, আপনার জ্ঞান গুরুমুখীবিদ্যায়। আমার গ্রন্থমুখী শিক্ষায়। বাউল-তত্ত্ব নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে চর্চা করার সুযোগ কখনো হয়নি। তবু নানান গ্রন্থপাঠে যেটুকু জেনেছি, বুঝেছি, তা আপনাকে জানাতে পারি একটি শর্তে—যদি আপনি আমার এই বিশ্লেষণটিকে কোন সিদ্ধপুরুষের আপ্তবাক্য বলে গ্রহণ না করেন। আমি সত্যই তা নই, তবে এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের চরণতলে শিক্ষালাভের সুযোগ আমার হয়েছে। তাই আমার এ-বিষয়ে যা সিদ্ধান্ত তা শুধুমাত্র আমার বিবেক-নির্দেশিত। আপনি বিচার করে নিজ সিদ্ধান্তে আসবেন।
—বেশ, তাই বলুন। প্রথমে আমাকে বলুন ঐ রাধাতত্ত্বের কথা,
–প্রথমেই বলে রাখি, ‘রাধাতত্ত্ব’টি আমার মতে : অর্বাচীন।
–অর্বাচীন-শিহরিত হয়ে ওঠেন!—কী বলছেন আপনি! রাধাতত্ত্ব!
—না–না—না! সে অর্থে বলিনি। ‘অর্বাচীন’ বা ‘অধোগত’ বলিনি আমি। অবার্চ শব্দের ঈন ভাবার্থে ‘অর্বাচীন’ বলেছি।
কর্তা-মশাই করজোড়ে বললেন, আমি সংস্কৃত জানি না, ধন্বন্তরি-মশাই!
—মানে, অপ্রবীণ, আধুনিক, নবীন। কোন প্রাচীন শাস্ত্রে শ্রীরাধিকার উল্লেখ নাই। শ্রীকৃষ্ণের প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থ হচ্ছে শ্রীমদ্ভাগবত—সেখানে কৃষ্ণপ্রেমিকা এক সখীর উল্লেখ আছে বটে, ‘রাধা’ নাম নাই। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, দেবী ভাগবত, পদ্মপুরাণ এবং নারদপঞ্চরাত্রে ‘রাধার’ উল্লেখ আছে। শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্বে ষোড়শী নবযৌবনসম্পন্না শ্রীরাধিকা ঐ সব পুঁথিতে বিষ্ণুবল্লভা, শ্ৰী বা লক্ষ্মীদেবীর গুণ ও লক্ষণযুক্তা। তিনি বৃষভানুর কন্যা নন, আয়ান ঘোষের পত্নী নন। শ্রীকৃষ্ণের মাতুলানী নন। এই পরকীয়া পরিকল্পনাটি আদিতে কে করেছিলেন বলা যায় না, তবে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দে’ প্রথম রাধাকৃষ্ণ প্রণয়লীলার পূর্ণাঙ্গ রূপটি বিকশিত হল। বসন্তরাস, মান, অভিসার, বাসকসজ্জা, বিরহ, মিলন প্রভৃতি দ্বাদশসর্গে এবং বাইশটি গীতে তাঁর রাধাকৃষ্ণ লীলা বর্ণিত। এই গীতগুলি প্রাকৃত শব্দের মিশ্রণে সংস্কৃতে রচিত। তারপর আবির্ভূত হলেন নানান পদকর্তা। খাঁটি বাঙলায় প্রথম পুঁথি বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’। শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর রাধাকৃষ্ণ-লীলার দৃষ্টিকোণ কিছু বদলে গেল। ‘দেহজ-মিলন স্থলে ‘ভাব-মিলন’। কিন্তু ‘রাধাতত্ত্বের কথা থাক। যে নামেই ডাকুন, আপনাদের,তথা বাউলদের সাধনতত্ত্বের গভীরে বাস্তবে আছে ‘প্রকৃতি-পুরুষ’ তত্ত্ব। এটি আদৌ ‘অর্বাচীন’ নয়। প্রাগার্য সভ্যতাতেও পুরুষ ও স্ত্রী জাতির লিঙ্গপূজার আয়োজন ছিল। চীনখণ্ডেও অনুরূপ ‘য়াঙ-য়িং’ তত্ত্ব অতি পুরাতন। আপনারা সহজী-পন্থার মূলে যে অভ্যুপগমটি গ্রহণ করেছেন, সেখানে কিছু সন্দেহের অবকাশ আছে। আপনার গুরুদেবের মতে প্রকৃতিতে একমুখী প্রেম অস্বীকৃত। পশুপক্ষী, বক্ষপদ, মৎস্য এবং কীটপতঙ্গরা সে বিধান মানে না, এ বাধা মানব সমাজের। প্রথম কথা—তথ্যটা নির্ভুল নয়। অনেক পশু ও পক্ষী আজীবন একমুখীপ্রেমে আবদ্ধ থাকে। তবে স্বীকার্য, তারা সংখ্যায় অল্প। দ্বিতীয়ত মনুষ্যসৃষ্ট ব্যবস্থাপনা মাত্রেই দূষণীয় এ যুক্তি গ্রাহ্য নয়। ইন্দ্রিয়-সংযম, উপচিকীর্ষা, তিতিক্ষা এগুলিও তো মনুষ্যসমাজ সৃষ্ট। ঐ যে দুজন ওখানে অন্নপাক করছে আমাদের নৈশাহারের ব্যবস্থাপনায়, এই যে কর্মবিভাগ, পারস্পরিক সাহায্য এও তো সামাজিক বিধানে। কই এ-সব তো ত্যাগ করছি না। তৃতীয় কথা : মানবসভ্যতা বিবাহপ্রথা গ্রহণ করার পর প্রেমের একমুখীন স্বরূপটা সৃষ্ট হয়েছে—সে আজ কয়েক সহস্র বর্ষের অভিজ্ঞতা। অত সহজে কি তাকে ত্যাগ করা যায়? যায় কি যায় না সেটা পরের কথা—তার পূর্বে বিচার্য : সেটা কি বাঞ্ছনীয়? শীতলচন্দ্র আর রুক্মিণী তাদের সংস্কার পরিত্যাগ করতে পারেনি, তাই আপনাদের মতে তারা ব্রাত্য। কিন্তু আমার মতে তারা আদৌ ‘ব্রাত্য’ নয়, তারা এ আখড়ার প্রচুর প্রলোভনকে জয় করে তাদের একমুখী প্রেমকে রক্ষা করতে পেরেছিল—তারা তাদের সাধনায় উত্তীর্ণ, সার্থক। তাদের সফলতা আরও উজ্জ্বল এ-কারণে যে, তারা এ আশ্রমের অন্যান্য আবাসিকদের পর্যন্ত নিজ ধর্মমতে গোপনে দীক্ষা দিতে পেরেছিল। তারাও ইন্দ্রিয়-সংযম করে ওদের একমুখী প্রেমকে সম্মান জানিয়েছে।
কর্তা-মশাই এতক্ষণ নীরবে শুনে যাচ্ছিলেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হল তা বোঝা গেল না। আখড়ায় নতুন জাতের কী সমস্যা হয়েছে সেটাও বলার সুযোগ হল না। এই সময়ে অন্যান বরাতিরা সবাই ফিরে এল।