৬
হরিপালে এসে দলটি পৌঁছাল পড়ন্ত বেলায়। অপরাহ্ণকালে। ওঁরা আশ্রয় নিলেন গ্রামপ্রান্তের হাটতলায়। হরিপাল একটি অতি প্রাচীন এবং এখনো বর্ধিষ্ণু গণ্ডগ্রাম। ব্ৰাহ্মণ, কায়স্থ, গোপ, জল-অচল—নানান জাতির বাস, বিভিন্ন পল্লীতে। গ্রামের ঠিক বাহিরে প্রশস্ত মাঠের মাঝখানে হাটতলা—এখন সম্পূর্ণ জনহীন। সপ্তাহে মাত্র একদিন এখানে জমায়েত হয় পঞ্চগ্রামের মানুষ–ব্যাপারি আর হাটুরে। সকাল থেকেই সার বেঁধে আসে গো-গাড়ির মিছিল। মধ্যাহ্নকালে ‘প্রচুর জনসমাগম। হাটতলায় বাঁশের খুঁটির উপর উলুখড়ের দোচালা—প্রায় শতহস্ত পরিমাণ দৈর্ঘ্যের; কিন্তু প্রস্থে অত্যন্ত অল্প। দুজন ব্যাপারি পিঠোপিঠি বসতে পারে মাত্র। হাটুরেদের সচরাচর কেনাবেচা করতে হয় খোলা আকাশের নিচে। হাটবারে অপরাহুকাল পর্যন্ত চিৎকার চেঁচামেচিতে হাটতলা সরগরম; তারপর সন্ধ্যার আগেই সব ভোঁ-ভাঁ। পুরো ছয়দিন তা জনশূন্য
দেখা গেল দলের সবাই করিৎকর্মা। ভ্রাম্যমাণ দলটির সকলে যে-যার কর্তব্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। জনা-ছয়েক বরাতি অশ্বতরের পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে সাজিয়ে ফেলল। দলপতির জন্য পেতে দিল মাদুর। দু-জন গেল জল আনতে, আরও দু-তিনজন কাঠের উনানে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। ও-বেলা কাঁচা ফলার হয়েছে, এ-বেলা অন্নসেবার আয়োজন। বাদবাকি সবাই একতারা, ক্ষমক, খঞ্জনী নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হয়ে গেল—নামগান শোনাতে আর ভিক্ষা করতে। কুসুমমঞ্জরীও রাধারানীর সঙ্গে রান্নার জোগাড়ে গেল।
হাটতলা নির্জন দেখে কর্তামশাই রূপেন্দ্রর কাছে ঘনিয়ে এসে বললেন, তখন যে কথাটা বলা হয়নি এবার তাই বলে নিতে চাই—আউল-বাউলদের অন্তরঙ্গ কথা।
এবার কিন্তু রূপেন্দ্র নিজেই আপত্তি তোলেন, থাক না কর্তামশাই। আমি বহিরাগত, পথ-চতি সঙ্গীমাত্র। আপনি নিজেই তখন বললেন, এই সাধনমার্গের কথা যথা-তথা বলা বারণ-
কর্তা-মশাই ওঁকে বাধা দেন, ‘যথা-তথা তো বলছি না ধন্বন্তরি মশাই! যতই নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুন, আমি সব জানি, সব জানি!
–কী জানেন?
কর্তা-মশাই এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে ফিফিস্ করে বলেন, আপনি একজন শাপভ্রষ্ট সিদ্ধপুরুষ!
—ভাবে
রূপেন্দ্র স্তম্ভিত। এমন আজব কথাটা শুনতে হবে তা আন্দাজ করতে পারেননি।
—কেন্দুবিশ্বের মেলায় আমি সমস্ত বিবরণ শুনেছি! রূপনগরের অশ্বারোহী ফৌজ কী- দামোদরে ভেসে গেল!
—কী ভাবে?
—ওরা যখন দামোদর অতিক্রমণ করছিল তখন আপনি মন্ত্রোচ্চারণ করেন! তৎক্ষণাৎ দামোদরে এসে যায় অকাল ষাঁড়াবাড়ির বান! গোটা ফৌজ ভেসে গেল। শুধুমাত্র সেনাপতির রণহস্তী নলগিরি এসে লুটিয়ে পড়ল আপনার শ্রীচরণে!
বজ্রাহত হয়ে গেলেন রূপেন্দ্রনাথ! লোকগাথার কী অপরিসীম মহিমা। লৌকিক ক্রিয়াকলাপকে অলৌকিকত্ব দানের কী বিচিত্র প্রবণতা! বছর ঘোরেনি, অথচ তিনি উপকথার নায়ক হয়ে গেছেন মুখে-মুখে! এমনকি ‘হেরম্বদাস’-এর নামটাও পরিবর্তিত হয়ে গেছে বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী অনুসারে।
তিনি যতই দৃঢ়স্বরে প্রতিবাদ করতে যান ততই কর্তামশাই সকৌতুকে মাথা নেড়ে বলতে থাকেন, জানি, জানি, এটাই যে সিদ্ধপুরুষের লক্ষণ! তাঁরা কিছুতেই স্বীকার করতে চান না তাঁদের অলৌকিক বিভূতির কথা!
উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে হল। কর্তা-মশাই এর পর নিম্নস্বরে বলে গেলেন তাঁদের সাধনমার্গের গুপ্ত কথা। তাঁর অন্তরে যে সংশয় জেগেছে, যে সন্দেহের দোলায় দুলছেন—তার নিরাকরণের পথটি উনি খুঁজে পেতে চান এই সিদ্ধপুরুষের নির্দেশে। দৈবাৎ যখন সাক্ষাৎ পেয়েছেন তখন তিনি কিছুতেই এ সুযোগ ছাড়বেন না। সব কথাই তিনি খুলে বললেন—বাউল-তত্ত্ব আর ‘সহজী’-পন্থীদের মতপার্থক্যের কথা, কী তাঁর সংশয়, কোন বিষয়ে তিনি পরামর্শ চাইছেন :