তীর্থের পথে – ১৮

১৮

পাখির পালকের মতো হালকা মন দিয়ে রূপেন্দ্রনাথ ফরাসডাঙা থেকে অশ্বারোহণে প্রত্যাবর্তন করলেন মাহেশে। রাত তখন প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত। পথ জনমানবহীন। এ সকল স্থানে সন্ধ্যা সমাগমের পরেই ঘনিয়ে আসে নৈঃশব্দ্য। প্রথম প্রহরের শিবাধ্বনিও হয়ে গেছে। রূপেন্দ্র তাঁর ব্রত নির্বিঘ্নে উদ্‌যাপন করেছেন :

“যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভিজাব না!”

চরক তাঁর প্রথম অধ্যায়ের নবম সূত্রেই নির্দেশ দিয়েছেন,

“মৈত্রী কারুণ্যমার্তেষু শক্যে প্রীতিরূপেক্ষণ
প্রকৃতিস্থেষু ভূতেষু বৈদ্যবৃত্তিশ্চতুর্বিধাঃ।।”

—যে আর্ত, যে ব্যাধিগ্রস্ত, তাকে করুণা করতে হবে, তার সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, কিন্তু সে হবে বন্ধুর মতো—এভাবেই বৈদ্য আরোগ্য-বিষয়ে তার আস্থা, তার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারেন। তাই এনেছেন ভেষগাচার্য! রাধারানীর সঙ্গে বন্ধুত্বের, শুধু পরমমিত্রের নয়, নাগরের মতো ব্যবহার করে তাকে আশ্বস্ত করেছেন। অথচ “দাক্ষং সৌচম্ ইতি জ্ঞেয়ং বৈদ্যগুণ চতুষ্টয়ম্”—নির্দেশও অতিক্রম করেননি। বৈদ্য তাঁর অন্তরের শুচিতা, আত্মপবিত্রতা সর্বদা রক্ষা করবেন। রাধারানীর রোগনির্ণয় তিনি ঠিকই করেছিলেন—”বিপ্রকৃষ্ট- রৌদ্রভৈরবাদ্ভূতবিষ্ট বীভৎস বিকৃতাদিরূপদর্শনং মিথ্যাযোগঃ”—তার অন্তরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যেহেতু ঘটনাচক্রে নরনারীর মধুর দৈহিক মিলনের কিছু “উগ্র, ভয়ঙ্কর, অদ্ভুত এবং অতিশয় ঘৃণাজনক বিকৃতাদি মিথ্যারূপ” তার সামনে বারে বারে মেলে ধরা হয়েছিল। তিনি নিজেই তাকে স্বাভাবিকতার মালভূমে উন্নত করতে পারতেন; কিন্তু মঞ্জুর অজ্ঞানে সে কাজ করতে তাঁর কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছিল। তাঁর মতে স্বামীস্ত্রীর সমান দায়—একমুখীন পবিত্রতা রক্ষায়! পরম করুণাময়ের কৃপায় সুসময়ে সে দায়িত্ব রামানন্দ দত্তকে অর্পণ করে আসতে পেরেছেন। ঔষধ ও পথ্যের বিধান দিয়েছেন, সেটা সেবন করাবে ঐ রহিম ওস্তাগর

মঞ্জুকে কি খুলে বলবেন সব কথা?

চরক ঋষির স্পষ্ট নিষেধ আছে: “নান্যং রহস্যমাগময়েৎ।”

‘আর্তের গোপন কথা কদাচ তৃতীয় ব্যক্তিকে জানাবে না।’ হোক সে তোমার নিকটতম বন্ধু অথবা ধর্মসঙ্গিনী। মঞ্জুকে সে কথা জানানোর অধিকার তাঁর নাই। শুধু চরকের নির্দেশ নয়, তাঁর বিবেকেরও তাই নিৰ্দেশ!

অন্দর-মহলে পদার্পণমাত্র ছুটে এল তুলসী। মাথা থেকে উষ্ণীষটি খুলে নিয়ে বললে, আহা! রাজপুত্রের মুখটি শুকিয়ে গেছে!

রূপেন্দ্র বলেন, যাবে না? সারাদিন কতটা অশ্বারোহণ করেছি তা তুমি কী জানবে? তোমাদের ঐ ঘোড়াটাকে জিজ্ঞেস কর।

তুলসী বললে, লিঙ্গে ভুল হল জামাইবাবু! ওটা ঘোড়া নয়, ঘোটকী।

—তা হবে। আমি খেয়াল করিনি!

প্রগলভা শ্যালিকা একটা দ্বর্থবোধক রসিকতা করল, সেটাই তো আমাদের মনোবেদনার হেতু, জামাইবাবু! কার পিঠে কখন চাপছেন তাও আপনাদের নজর হয় না!

ফুলপিসি এগিয়ে আসেন। বলেন, ওকে আর বিরক্ত করিস না তো। জিরুতে দে! হ্যাঁ বাবা, ছান করবে নাকি? এত রাত্রে গা ধুলে ঠাণ্ডা লাগবে না তো?

রূপেন্দ্র জানালেন তা সত্ত্বেও সারাদিনের এই ধূলিধূসরিত দেহটা পরিমার্জনা না করলে তার তৃপ্তি হবে না। তুলসী বললে, একটু গরম জল করে দিই বরং।

রাত্রে অনিবার্যভাবে প্রশ্নটির সম্মুখীন হতে হল, রাধাদি কী বলল?

—তোমাকে না নিয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হল। উপায় কী? তবে দলের সঙ্গে আবার তো ত্রিবেণীঘাটে দেখা হবে।

রাধারানীর সঙ্গে তখন যে দেখা না-ও হতে পারে এ প্রসঙ্গটা উহ্য রইল। সেটা চাপাই পড়ে গেল মঞ্জুর পরবর্তী যোজনায়। বললে, তোমার সঙ্গে হবে। আমার সঙ্গে হবে না।

—কেন? দোলপূর্ণিমার পর আমরা তো সেখানেই যাব।

—না গো। এত হাঁটতে আমার কষ্ট হয়। তুমি একাই তীর্থদর্শন করতে থাক। আমি মাস ছয়েক এখানেই থাকব।

—ছয় মাস! কেন? কী হল তোমার?

–বললাম তো এখনি—অত হাঁটতে আমার কষ্ট হয়। সেটা উচিতও নয়।

এজন্যই বোধহয় চরকের নির্দেশ—অতি প্রিয়জনের চিকিৎসা নিজে করতে নেই!

রূপেন্দ্র ওর রোগনির্ণয় করতে পারলেন না। বললেন, বেশ তো, কিছুদিন না হয় বিশ্রাম নাও; আমি ভাগীরথীর দুই পারে তীর্থদর্শন সেরে আসি। কিন্তু সে তো পক্ষকালের ব্যাপার। ছয় মাস তোমাকে থাকতে হবে কেন?

মঞ্জু কী একটা কথা বলতে গেল। পারল না। এতবড় সংবাদটা কীভাবে জানাবে যেন বুঝে উঠতে পারছে না। নিজে সে নিঃসন্দেহ। আকৈশোরের একটা জৈবিক চক্রাবর্তনই যে শুধু বন্ধ হয়েছে তাই নয়, আরও কিছু লক্ষণ নজরে পড়েছে তার। ক্ষুধামান্দ্য, বিবমিষা! আশা করেছিল ভেষগাচার্য নিজেই তা বুঝে ফেলবেন। মুখ ফুটে তাঁকে কিছু বলতে হবে না। কিন্তু তিনি নজরই করতে পারছেন না।

রূপেন্দ্র পুনরায় বলেন, বেশ তো। অন্যান্য তীর্থে না যাও, ত্রিবেণীতে তো যাবে গুরুদেবকে প্রণাম করতে?

মঞ্জুর মুখটা রক্তবর্ণ ধারণ করে। নত নেত্রে সে নিশ্চুপ বসে থাকে।

—কী হল জবাব দাও? যাবে না?

—যাব। এখন নয়। পরে!

—ছয় মাস পরে?

ইতিবাচক গ্রীবা সঞ্চালন করে নীরবে।

—তোমার কী হয়েছে বল তো? দুজনে যাব, এমন কথাই তো ছিল?

–তা ছিল। এখন ভাবছি—দুজনে নয়, তিনজনে একসঙ্গে যাব।

–তিনজনে! তৃতীয় জন আমি কোথায় পাব?

মঞ্জু দু-হাতে মুখটা ঢেকে বললে, আমার কাছে!

–তোমার কাছে?

—হ্যাঁ! আত্মদীপ!

এর পরেও বুঝবেন না এতবড় মূর্খ নন! রীতিমতো চমকে ওঠেন। দুহাতে ওকে আকর্ষণ করে বলেন, সত্যি? তুমি নিশ্চিত?

ওঁর বুকে মুখ লুকিয়ে মঞ্জু কোনক্রমে শুধু বলতে পারে—হুঁ!

চুমায় চুমায় মঞ্জুর দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম।

তীর্থের পথে – ১৮
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *