তীর্থের পথে – ১৭

১৭

রাজপ্রাসাদ দেখে চোখ কপালে উঠে যায়। এ যে সত্যিই কল্পলোকের রাজপুত্রের প্রকাণ্ড প্রাসাদ! গঙ্গার কিনার ঘেঁষে। সারি-সারি পলতোলা মর্মর স্তম্ভ, উপরে ঊর্ধ্বমুখ সহস্রদল। ‘কোরিন্থিয়ান-কলাম’ ও বেচারি কোথায় দেখেছে এর পূর্বে যে, বুঝবে? দ্বিতলে সারি-সারি পাখি-খড়খড়ির গবাক্ষ। সেটা লাট বাহাদুরের আবাস। একতলায় পর্যায়ক্রম কক্ষ, মহাফেজখানা। প্রাচীর-বেষ্টিত প্রকাণ্ড উদ্যান, কেন্দ্রস্থলে ফোয়ারা। তার মাঝখানে একটি অপূর্ব নারীমূর্তি—আহা! হাতদুটি ভাঙা! এত এত খরচ করেছে, আর ঐ সুন্দরী মর্মরমূর্তির ভাঙা হাতদুটি মেরামত করায়নি, কেন, গো? এ প্রশ্নের জবাব রূপেন্দ্র জানেন না। মহাপণ্ডিত তিনি, কিন্তু জানেন না—কেন ঐ ভাঙা হাত দুটি মেরামত করা যায় না, যাবে না। বস্তুত ভাস্কর ওর হাত দুটি আদৌ গড়েনি—কারণ ও যার ছায়ামূর্তি সেই গ্রীক ন্যুড, অ্যাসকুইলিন ভেনাসে ভগ্ন অবস্থাতেই যে পাওয়া গেছিল। সে-কথা রূপেন্দ্র কেমন করে জানবেন?

উদ্যানের অপরপ্রান্তে দু-একটি বিচ্ছিন্ন মোকাম—অতিথিশালা। তারই একটা তখন গাঙ্গুলীমশায়ের বন্দোবস্তে রূপেন্দ্রের দখলে।

সিংদরোজার কাছেই দুজনে অবতরণ করেছেন। অশ্বাবাসরক্ষক অশ্বটিকে নিয়ে গেছে। পদব্রজে ওঁরা অতিথিশালার দিকে অগ্রসর হয়ে আসেন। একতলা বাড়ি। দুটি মাত্র কক্ষ। সংলগ্ন স্নানাগার। খিদমদগার অগ্রসর হয়ে আসে। সেলাম করে। রাধারানীর হাত থেকে পোঁটলাটা নেয়।

প্রথমটি অভ্যর্থনা কক্ষ, ভিতরে শয়নাগার। প্রকাণ্ড পালঙ্ক, একটি মেজ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকটি কেদারা। একটি আরাম-কেদারা। পুষ্পপাত্রে কুসুমস্তবক সুবিন্যস্ত।

সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। খিদমদগার খাশগেলাসের বাতিদানে আলো জ্বেলে দিল। গবাক্ষগুলি রুদ্ধ—সন্ধ্যার ঝোঁকে না হলে ঝাঁকঝাঁক মশা ঢুকে পড়ে।

মেজ-এর উপর ভৃঙ্গার, পানপাত্র। নির্মল পানীয় জল।

পরিচারকটি জানতে চাইল, নৈশাহারের কী জাতীয় ব্যবস্থা হবে।

রূপেন্দ্র দুজনের মতো নিরামিষ আহার্যের বন্দোবস্ত করতে বললেন। লোকটা বিদায় নিল। রূপেন্দ্র তার পিছন পিছন বার হয়ে এসে বললেন, সে লোকটা এসেছে?

—জী নহী! বহু রহিম ওস্তাগর ন?

—হ্যাঁ। তার আসার কথা আছে। এলে, তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে আমাকে খবর দিও।

—যো হুকুম, সরকার।—লোকটা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

ঘরে ফিরে এসে দেখেন রাধা মেঝের উপর বসে আছে।

—ও কী! ওখানে বসেছ কেন? কেদারায় উঠে বস। ওরা দেখলে কী ভাববে! রাধা চট করে উঠে দাঁড়ায়। কী করবে, কী বলবে যেন ঠাওর পায় না। রূপেন্দ্র বলেন, গা ধোবে? পাশের ঐ ঘরটা গোসলখানা। হাণ্ডায় জল আছে, গামছাও আছে। এই বাতিটা নিয়ে যাও বরং।

ফাল্গুনের শেষ। শীতের ভাবটা নেই। রাধারানী খুশি হল। ঘামে সে ভিজে গেছে। পোঁটলাটা নিয়ে সে গোসলখানায় ঢুকে পড়ে। রূপেন্দ্র ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিলেন আরাম কেদারায়। অনতিবিলম্বেই শ্রান্ত দেহে নিদ্রাগত হন। কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন জানেন না, হঠাৎ ললাটে একটি পেলব স্পর্শ লাভ করে চোখ মেলে তাকান। রাধারানীর স্নান সারা। সামান্য প্রসাধনও করেছে। না, শৃঙ্গার নয়, প্রসাধন! তিলকসেবা করেনি, তবে ধম্মিল্ল বেঁধেছে। ইতস্তত করতে করতে শেষমেশ পুষ্পপাত্র থেকে একটা নাম-না-জানা বিদেশী ফুল তুলে গুঁজে দিয়েছে চূড়ো করে বাঁধা কবরীবন্ধনে।

রূপেন্দ্র ওর সেই বাসকসজ্জা দেখে খুশিয়াল হয়ে ওঠেন। আবৃত্তি করেন :

“বাসঃ সূক্ষ্মং বপুষি ভুজয়োঃ কাঞ্চনী চাঙ্গদশীর্
মালাগর্ভঃ সুরভি মসৃণৈর্গন্ধতৈলেঃ শিখণ্ডঃ।
কর্ণোত্তংসে নবশশিকলানির্মলং তালপত্রং
বেশং কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গবারাঙ্গনাম।।”

রাধা এতক্ষণে মেনে নিয়েছে। গোঁসাই -ঠাকুর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—মঞ্জুর ঘর ওরা ভাঙছে না! ধরা যদি দিতেই হয় তাহলে ধরাকে সরাজ্ঞানই বা করবে না কেন? মঞ্জুর তো পড়ে আছে সারাটা জীবন—ওর জীবনে, হ্যাঁ! এটাই তো প্রথম ফুলশয্যা! হয়তো এটাই শেষ! আকৈশোর তো দাঁতে দাঁত দিয়ে অগণিত পিশাচের বলাৎকার সহ্য করে এসেছে এতদিন! তাই জানতে চায় ঐ সংস্কৃত শ্লোকের ব্যাখা। রূপেন্দ্র বলেন, দেহে সূক্ষ্মবসন, ভুজবন্ধে সুবর্ণ অঙ্গদ, সুগন্ধ তৈলসুরভিত মসৃণ কেশদামে যূথির মালিকা, কর্ণে নবশশিকলার ন্যায় তালপত্রের কর্ণাভরণ—বঙ্গললনার এই বাসকসজ্জা কার না মনোহরণ করে?

বক্তা আর শ্রোতা দুজনেই জানেন, এ বর্ণনার সঙ্গে রাধার সজ্জার কোন মিল নেই। কিন্তু এ কথাও জানেন, তাতে শেষ পংক্তিটা উচ্চারণে কোনও বাধা নেই। সে কথাই বলে রাধা, একজনের মনোহরণ করলেই যথেষ্ট।

রূপেন্দ্র ফস্ করে বলে বসেন, কেন? ফরাসডাঙায় এসেও আর একজনের কথা তোমার মনে পড়ছে না, রাধা?

কেমন যেন চমকে ওঠে। বলে, মানে? কার কথা বলছ?

—ফরাসডাঙায় তোমার চেনা-জানা কি কেউ নেই?

এক ফুঁয়ে যেন প্রদীপটা নিবে গেল। বলে, সে হতভাগার কথাও বলেছে মুখপুড়ি?

–বলেছে। তখনি তো বললাম আমি, তোমার সব কথা জানি।

রাধা বসে পড়ল ওঁর আরামকেদারার হাতলে। বললে, তার কথা আজ থাক!

–কেন গো? রাম-দার কথা কি তোমার একটুও মনে পড়ে না?

চোখ দুটি জলে ভরে এল। তবু ঝরে পড়ল না। অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে বললে, অহেতুক কেন দাগা দিচ্ছ আমাকে? সে তো আর তে।মার মতো অসাধারণ নয়। তার স্ত্রী আছে, সংসার আছে,

—তুমি নিশ্চিত জান?

—না, তা জানি না। আন্দাজ করতে পারি।

—তোমার ধারণাটা ভুল রাধা। আমি ফরাসডাঙায় এসে তার খোঁজ করেছি। দেখা পেয়েছি।

শিহরিত হয়ে ওঠে এবার। উঠে দাড়ায়। বলে, তুমি তাকে দেখেছ?

—হ্যাঁ। আজই সকালে।

কী যেন প্রশ্ন করতে গেল। পারল না। আঙুলে অঞ্চলপ্রান্তটা অহেতুক জড়াতে থাকে।

—সে নিজেও একই অসুখে ভুগছে।

চকিতে মুখ তুলে তাকায়, একই অসুখে! মানে?

যে অসুখে তুমি ভুগছ! তাই সে আজও বিয়ে করতে পারেনি। সে ভুলতে পারেনি তার ছেলেবেলার সঙ্গিনীকে : শিউলী।

আর ধরে রাখা গেল না। ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ল এবার। লজ্জা পেল না সে জন্য। অশ্রুআর্দ্র দু-চোখ মেলে বললে, এ কথাটা কাল সকালে বলা চলত না?

রূপেন্দ্র বিস্মিত। কেন, কেন? এখন বলায় কী ক্ষতি হল?

–বোঝ না? আমি… আমি যে আজ স্বাভাবিক হতে চাইছিলাম। এরপর সে পরীক্ষা—

কথাটা শেষ করতে পারে না।

ওর হাতদুটি ধরে নিজের দিকে টেনে আনেন। বলেন, সে যদি রাজী থাকে তাহলে কি পরীক্ষাটা তার সঙ্গেই করে দেখতে পার না?

কথাটা এমন কিছু দুর্বোধ্য নয়। কিন্তু যেন ওর মাথায় ঢুকল না। অর্থহীন দৃষ্টি মেলে শুধু তাকিয়ে থাকে। রূপেন্দ্র পুনরায় বলেন, আজ সকালে সে আমাকে কী বলেছিল জান? বলেছিল, ‘পারলে একমাত্র শিউলীই পারে এই আধখানা মানুষটাকে আবার একটা গোটা মানুষ করে তুলতে।’ তুমি কি চেষ্টা করে দেখবে না, রাধা?

মাথাটা নিচু করে বলে, আমি তো তাকে ঠকাতে পারব না ঠাকুর। সে তো জানেই কত-কত পিশাচের…এ ফুলে তো আর পুজো হয় না।

–হ্যাঁ, জানে। সে কথাও তাকে বলেছিলাম। তার জবাবে সে কী বলল জানো? বললে, আমি তো কাফের নই বাবুজী। আল্লারসুলের কানুনে এটা স্ত্রীলোকের কোন পাপই নয়। তার কী কসুর বলুন?

রাধা প্রত্যুত্তর করে না।

রূপেন্দ্রই প্রশ্ন করেন, প্রেমের জন্য কি তুমি ধর্মত্যাগ করতে পার না?

রাধারানী নেতিবাচক গ্রীবাভঙ্গি করল।

রূপেন্দ্র বিস্মিত হয়ে বললেন, ধর্মত্যাগ এতই অসম্ভব তোমার পক্ষে? তোমার রাম-দার চেয়েও সেটা বড়?

এবার মুখ তুলে চোখে-চোখ রেখে জবাব দিল, সে-জন্যে নয়। আমি মুসলমান হয়ে যেতে পারি না। তাহলে সেই শয়তান কাজীটার কাছে আমাদের দুজনেরই হার হবে। এই তো চেয়েছিল সে।

—কিন্তু রামানন্দকে প্রায়শ্চিত্তের কোন বিধান কি পণ্ডিতেরা দেবেন?

—দিলেও সে তা মানবে কেন? সে তো পাপ করেনি কিছু। কিসের প্রায়শ্চিত্ত? আমিই বা তাকে তা করতে দেব কেন?

ঠিক তখনই দ্বারে কার করধ্বনি হল।

রূপেন্দ্র দ্বার খুলে বাহিরে এলেন। খিদমদগার বললে, রহিম আ গয়া।

রূপেন্দ্র বেরিয়ে এলেন বাইরে। আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদ। ফিকি দিয়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে। অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল রহিম ওস্তাগর। রূপেন্দ্র এগিয়ে এসে তার হাতটা তুলে নিলেন। বললেন, রহিম। ঐ ঘরে শিউলী আছে। সে জানে না তোমার আসার কথা। সে তোমার প্রত্যাশাতে নেই। যাও। আর শোন। তুমি রাতটা এখানেই থাকবে। দুজনের খাবার ওরা দিয়ে যাবে।

—সেকি! আপনি? আপনি কোথায় থাকবেন?

—আমি মাহেশ ফিরে যাচ্ছি। কাল সকালে এসে শুনব তোমরা কোন সিদ্ধান্তে এলে! আমার মনে হয় মেরীমাতা তোমাদের দুঃখ বুঝবেন।

রূপেন্দ্র পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন অশ্বাবাসের দিকে। রহিম অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। আজব মানুষ ঐ কবিরাজ! বাঁকের মুখে রূপেন্দ্র মিলিয়ে যেতে সে অতিথিশালার দিকে ফিরল।

উন্মুক্ত দ্বারপথে দেখতে পেল সেখানে অনির্বাণ শিখায় একটা প্রদীপ জ্বলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *