১৬
পরদিন সকাল। রূপেন্দ্র আর গাঙ্গুলীমশাই অশ্বারোহণে এসেছেন ফরাসডাঙ্গায়। এখন হঠাৎ তোমরা রূপেন্দ্রকে দেখলে চিনতে পারতে না। তাঁর গায়ে কুর্তা, অকফলাশোভিত মুণ্ডিত-মস্তক নয়, মাথায় পাগড়ি। এটা তুলসী জোর করে পরিয়েছে ওঁকে। মুণ্ডিতমস্তক ব্রাহ্মণ যে অশ্বারোহী হয় না তা নয়, রূপেন্দ্র সেভাবেই গ্রাম-গ্রামান্তরে চিকিৎসা করতে যেতেন; কিন্তু তুলসী রাজী হয়নি। ফরাসডাঙ্গার ফেরঙ্গ-পরিবেশে সে বড় বেমানান। উপরোধে মানুষ ঢেঁকি পর্যন্ত গিলে থাকে আর এক্ষেত্রে সুন্দরী শ্যালিকার বিশেষ উপরোধ! নিজে হাতে ওঁর মাথায় পাগড়িটা বেঁধে দিয়েছে। মঞ্জরী সকৌতুকে লক্ষ্য করেছে। দুজনে অশ্বারোহণে যখন মাহেশ ত্যাগ করে গেলেন—ওরা দুই বোন পাকাবাড়ির ছাদ থেকে লুকিয়ে দেখেছে। মঞ্জুর নিশ্চয় মনে পড়েনি সেই উদ্ধৃতিটা—সেটা রচিতই হয়নি তখন, ‘রাজপথ দিয়ে চলে এত লোকে/এমনটি আর পড়িল না চোখে/আমার যেমন আছে।।’
ফরাসডাঙায় ফরাসী-রাজত্ব। তার কর্ণধার তখন যোসেফ ফ্রাঁসোয়া দুপ্লেক্স। ভারতবর্ষে এসেছেন 1720 সালে; ফরাসী চন্দননগরে ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইণ্ডিয়া কাউন্সিলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়েছিলেন বছর দশেক পরে। 1741-এ তিনি চন্দননগরে পূর্বভারতের ফরাসী উপনিবেশের গভর্নর জেনারেল। অর্থাৎ পূর্ববৎসর। ভারতীয় স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে তিনি উপেক্ষিত—যেহেতু অন্তিমে ফরাসী জাতি নয়, ইংরাজই ভারত দখল করেছিল। অন্যথায় রবার্ট ক্লাইভ-এর তুলনায় তিনি ছিলেন সব দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ। পণ্ডিচেরী, কর্নাটক আর চন্দননগরে তিনি যে শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন তা ছিল ইংরাজ অথবা নবাবের চেয়ে উৎকৃষ্টতর। তাঁর সততা ছিল সমকালের এক দুর্লভ দৃষ্টান্ত। তাঁর আমলে ইংরাজ আর ফরাসীদের মধ্যে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু ও শেষ হয়; 1746-এ ফরাসী সেনাপতি লা-বুর্দোনে ইংরাজের হাত থেকে মাদ্রাজের শাসনক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় আর গোপনে তা ব্রিটিশ ঈস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রত্যর্পণ করতে রাজী হয়ে যায় প্রচুর উৎকোচের বিনিময়ে। উৎকোচের পরিমাণটা ছিল চল্লিশ হাজার ব্রিটিশ স্টার্লিং। বলা বাহুল্য, সেটা দুপ্লেক্স আর লা-বুর্দোনের মধ্যে বাঁটোয়ারা হবার কথা। সমকালীন প্রথাকে দুপ্লেক্স নস্যাৎ করেন। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। লা-বুর্দোনে দেশে ফিরে যায় এবং ব্যাস্টিলে বন্দী হয়। দুপ্লেক্স নিজের শেষ কপর্দক পর্যন্ত ব্যয় করে এবং প্রচুর ঋণ করে যুদ্ধ চালিয়ে যান। 1754 সালে তাঁকে দেশে ফিরে যাবার আদেশ দেওয়া হল। নয় বৎসর পরে নিতান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে এই অবহেলিত মহানায়কের মৃত্যু হয়। ফরাসী সরকার তাঁর প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে অস্বীকার করেন। হেতুটি সহজবোধ্য : দুপ্লেক্স অন্তিমে পরাজিত। ভারত ফরাসী উপনিবেশ হয়নি!
এই দুপ্লেক্স তখন ফরাসডাঙা বা ফরাসী চন্দননগরের শাসক।
ভবানীচরণ সহজেই সন্ধান জোপাড় করতে পেরেছেন। রহিম ওস্তাগর যার পালিতপুত্ৰ সেই আকবর ওস্তাগর ফরাসী সেনাবাহিনীর পোশাক বানায়। সে-জাতীয় পোশাক বানানোর কায়দা এদেশের ওস্তাগরেরা জানত না! বস্তুত সেলাই করা জামার প্রচলনই ছিল না তার পূর্ব জমানায়, এই গৌড়মণ্ডলে। মুসলমানদের আগমনের পর সেলাই করা জামা-কাপড়ের প্রচলন শুরু হয়েছে বটে, কিন্তু আঁটোসাটো ফরাসী কুর্তার প্রচলন ছিল না। তাই আকবর ওস্তাগরের নাম সবাই জানে।
নায়েব-নাজিরের হুকুম পেয়ে দেখা করতে এল রহিম। বছর সাতাশ-আঠাশ। বলিষ্ঠগঠন। মুসলমানী সাজ, গায়ে মেরজাই, মাথায় সফেদ-টুপি। আভূমি নত হয়ে সেলাম করল রূপেন্দ্রকে। ঘরে তখন তিনি একলাই। বললেন, তোমার নাম রহিম? আকবর ওস্তাগরের পালিত-পুত্র তুমি?
—জী, জনাব।
—কোথায় দেশ তোমার?
–রূপনগর, খোদাবন্দ। অজয়ের ধারে, বর্ধমান-ভুক্তিতে। কী কসুর হল আমার?
–‘কসুর’ হয়েছে ধরে নিচ্ছ কেন? বিশেষ একটা কারণে আমি তোমার খোঁজ নিচ্ছি। তুমি ঐ রূপনগরের গঙ্গাপ্রসাদ বসুর কন্যা শেফালীকে চেন?
লোকটা স্বতই আতঙ্কগ্রস্ত হল। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ঐ উষ্ণীষপরা রাজপুরুষটির দিকে। তার অন্তরে তখন কী-জাতের তুফান তা বোঝা গেল না। ক্রমে তার দৃষ্টি নত হল। বললে, চিনতাম! শেফালী মারা গেছে হুজুর। তার কথা কেন?
—মারা গেছে! তুমি নিশ্চিত জান?
—না হুজুর। নিশ্চিতভাবে জানি না। জানতে চাইও না। এসব কথা কেন আমাকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করছেন?
রূপেন্দ্রনাথ স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। তুমি যেতে পার।
তবু স্থানত্যাগ করল না লোকটা। বললে, আপনি যে-কথা জানতে চেয়েছেন তা আমি বলেছি। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব তো আপনি দিলেন না, খোদাবন্দ? কেন আমাকে ডেকেছিলেন?
—আমি ভুল করেছিলাম রহিম। আমি খুঁজছিলাম রামানন্দ দত্তকে। তোমাকে নয়। তাকে জানাতে যে, শিউলী মরেনি!
এবারও দেরী হল জবাবটা দিতে। তবু বললে, বুঝতে পারছি, আপনি অনেক কথাই জানেন। আমার কাছে সে মৃত—এটা হক কথা নয়, হুজুর?
—আমি তা ভাবিনি! তুমি জানালে, তাই এখন জানতে পারলাম।
—শুনেছি, সেই রূপনগরের মঠ বর্গীতে লুট করেছিল। শিউলী যে মারা যায়নি, তা আমি জানতাম না।
—না, সে জীবিতা। কোথায় আছে তা আমি জানি। তুমি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাও?
—কী লাভ খোদাবন্দ? সেও দাগা পাবে। আমিও!
—তুমি সাদি করেছ? সন্তানাদি কী?
—জী, না। আমি আজও সে পাপ করিনি।
উৎসাহে সোজা হয়ে বসেন। বলেন, পাপ কাজ! কী বলছ? সাদি করা পাপকাজ?
—জী, না। তা বলিনি। কিন্তু কী দরকার তৃতীয় একজনকে এ জটিলতার মধ্যে টেনে আনার? সে তো আমাকে সাদি করে সুখী হবে না!
রূপেন্দ্র ওর হাতখানা চেপে ধরেন। বলেন, রামানন্দ! তাই যদি হবে তাহলে তুমি কেন আজ তাকে গ্রহণ করতে পারছ না? সে অনেক দাগা পেয়েছে, অনেক নির্যাতন সয়েছে। কিন্তু সেও তো সাদি করেনি? তোমার পথ চেয়ে আছে!
রহিম তার হাতখানা টেনে নিল না। বললে, সে কি রাজী হবে ধর্মত্যাগ করতে?
—যদি হয়, তুমি কি তোমার কুসংস্কারকে ত্যাগ করতে পারবে?
—কুসংস্কার! তার মানে?
—রাধারানী বহুভোগ্যার জীবন কাটিয়েছে এতদিন! তা তুমি জান!
মাথা খাড়া করে রহিম বললে, আমি তো কাফের নই গরিবপরবর! আল্লারসুলের দরবারে সে অপরাধের কোন শাস্তির বিধান তো নেই। তাছাড়া সে দুর্ভাগ্য তো হয়েছে রাধারানীর—তাকে আমি চিনি না। আমরা শিউলীর কথা আলোচনা করছি হুজুর! … সে এখন কোথায়?
রূপেন্দ্র একটু ভেবে নিয়ে বললেন, তুমি কি যে-কোন শর্তে তাকে গ্রহণ করতে স্বীকৃত?
—যে কোন শর্তে, মানে?
—আমি জানি না, সে ধর্মত্যাগ করতে স্বীকৃতা হবে কি না। জানি না হিন্দু পণ্ডিতেরা তোমাকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে কোনও শুদ্ধির মাধ্যমে…
রহিম মাঝখানেই বাধা দিয়ে ওঠে, মাপ করবেন। আমি রাজী নই। আমি কোনও পাপ করিনি। প্রাণধারণের জন্য খাদ্যগ্রহণ পাপ কাজ নয়! প্রায়শ্চিত্তের কোনও বিধান আমি মানব না!
—ঠিক কথা, রামানন্দ …
—মাপ করবেন হুজুর। আমাকে রহিম নামেই ডাকবেন।
—তাই ডাকব, রহিম! কিন্তু একটা কথা বল। আজ তুমি রহিম, কিন্তু এককালে তুমি তো রামানন্দ ছিলে। এ কথা কি বুঝবে না—কেন শেফালী মুসলমানী হয়ে যেতে পারে না?
—তাহলে আর উপায় কী বলুন? আমি প্রায়শ্চিত্ত করব না—সে আমার ধর্ম গ্রহণ করবে না। সেক্ষেত্রে …
—না, না, সে তো তার কথা বলেনি এখনো। আমি কেমন করে জানব? আমি কি জানি : সব কথা শোনার পর কোনটা তার কাছে বড় হয়ে উঠবে—প্রেম, না ধর্ম? তুমি এক কাজ কর। আজ সন্ধ্যায় এখানে এস। আমি জেনে এসে তোমাকে জানাব।
—একটা কথা শুধু বলুন—আপনি কে? আপনার কী গরজ? আপনি তাকে কী করে চিনলেন?
—এখন নয়, রহিম। সে-কথাও পরে বলব। তুমি এস এখন।
আদাব জানিয়ে রহিম প্রস্থান করছিল। আবার তাকে ফিরে ডাকলেন, রহিম!
—জী?
—সব কথা তোমাকে এখনি বলতে পারছি না। তবু দু-একটা কথা বলা দরকার। আমি একজন কবিরাজ। শিউলীর চিকিৎসা করছি …
—ওর কী হয়েছে?
—মানসিক ব্যাধি। ওর মনের একটা অংশ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে। মস্তিষ্কবিকৃতির কোনও লক্ষণ নেই—কথাবার্তা চাল-চলনে সে নিতান্ত স্বাভাবিক। কিন্তু যে তাকে বিবাহ করবে তাকে জানিয়ে রাখা উচিত নরনারীর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধটাকে সে ঘৃণার চোখে দেখে।
—রহিম বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। বললে, সেটাই তো স্বাভাবিক, কবিরাজমশাই। যে অত্যাচার তার উপর দিয়ে গেছে …
রূপেন্দ্র ওর হাতটি আবার টেনে নিয়ে বললেন, তুমি পারবে! তুমি নিশ্চিত তাকে আবার স্বাভাবিক করে তুলতে পারবে। চেষ্টা করে দেখবে, রহিম?
রহিমের চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। বলে, বাবুজী, জানি না আপনি আমাদের কথা কতদূর জানেন—কিন্তু এটা কেন বুঝছেন না, একমাত্র সেই হতভাগীই পারে এই আধখানা মানুষটাকে আবার একটা গোটা মানুষ করে তুলতে। এ তো শুধু দেওয়া নয় হুজুর! এ যে দেওয়া আর নেওয়া! আমরা দুজনেই তো ভুগছি! একই অসুখে!
—আরও একটা কথা! আমি যদি তোমাদের দুজনকে কোনও গীর্জায় নিয়ে যাই? তোমরা কি খ্রীস্টান মতে বিবাহ করতে পার না?
–সে রাজী হলে পারি। কারণ আন্দাজ করছি পাদরী সাহেব আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলবে না! পাদরী তো আর কাফের নন!
.
—সেদিনই অপরাহ্ণ কাল। অশ্বারোহণে রূপেন্দ্র রাধারানীকে নিয়ে ফিরে আসছিলেন রাধাবল্লভপুর থেকে ফরাসডাঙ্গায়। প্রকাণ্ড আরবীয় অশ্ব, অনায়াসে দুইজন আরোহীর ভার বহনে সক্ষম। রাধারানীকে নিয়ে আসতে হবে বলে এই ‘উচ্চৈঃশ্রবা’-কেই বেছে নিয়েছিলেন ফরাসী-সরকারের মন্দুরা থেকে। রাধারানী বসেছে সামনে, বাঁ-দিকে, দু-পা ঝুলিয়ে। ডানহাতে একটা পোঁটলা, অপরহস্তে শিথিলবন্ধনে বেষ্টন করে ধরে আছে রূপেন্দ্রের কটিদেশ। অশ্ব আস্কন্দিত গতিছন্দ লাভ করলেই সেই বন্ধনটি প্রতিবর্তী-প্রেরণায় দৃঢ় আলিঙ্গনে রূপান্তরিত হয়ে যায়। রূপেন্দ্র বোঝেন, এটা ঐ বৈষ্ণবীর প্রগলভতা-জনিত কারণে নয়, নিতান্ত প্রাণ ধারণের তাগিদেই মাঝে-মাঝে তার পীবর-প্রত্যঙ্গ নিষ্পেষিত হচ্ছে ওঁর কবাটবক্ষে।
রাধারানীর ধারণা, ওরা দুজনে আসছে মাহেশে। সে-কথাই বলেছিলেন রূপেন্দ্ৰ কর্তামশাইকে। বলেছিলেন রাধারানী যদি ফিরে না আসে তাহলেও যেন তিনি চিন্তিত না হন; কারণ রোগিণীর নিরাময়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করছেন। ব্যবস্থাটা যে কী জাতীয়, তা বুঝে উঠতে পারেননি কর্তামশাই। তবু আপদ বিদায় হওয়ায় তিনি নিশ্চিন্ত—বিশেষ, মেয়েটি যখন নিজেই রূপেন্দ্রের সঙ্গে চলে যেতে স্বীকৃতা হল।
রূপেন্দ্রকে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিল রাধারানী, এ কী, এ কী! এ তো প্রত্যাবর্তন নয়, এ যে আবির্ভাব! গোঁসাইঠাকুর! তুমি রাজপুত্তুর হয়ে গেলে কেমন করে?
—কর্তা-মশায়ের কাছে শোননি, আমি সিদ্ধপুরুষ? বহুরূপীর মতো আমার রঙ বদলায়!
—তাই তো দেখছি! কিন্তু যুগলে আসার কথা ছিল যে, রাজপুত্তুর!
—না! সে বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে। তোমার পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে নাও!
তাই বামদিকের সড়ক ছেড়ে রূপেন্দ্র যখন দক্ষিণ দিকের রাজপথ ধরলেন তখনই রাধারানী প্রশ্ন করেছিল, এ কী! এদিকে কেন? আমারা কোথায় যাচ্ছি?
সড়ক যেখানে দ্বিধাবিভক্ত, সেখানে আছে নবাবী পূর্তবিভাগের পথনির্দেশ—সাদা বাঙলায়—কোন দিকে মাহেশ এবং কোনদিকে ফরাসডাঙা। রাধারানী নিরক্ষরা নয়, তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, তাদের গতিমুখ এখন ফরাসী চন্দননগর।
রূপেন্দ্র বললেন, আমরা যাচ্ছি তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে প্রাণ-ভোমরার সন্ধানে!
—কিন্তু এমন তো কথা ছিল না গোঁসাই?
—গোঁসাই! গোঁসাই কে? এখন আমি রাজপুত্তুর!
—মানছি, কিন্তু রাজকন্যার পথ যে বাঁদিকের সড়কে?
রূপেন্দ্র বললেন, “এক ঘরে যদি না পোষে তায়/ঘরে ঘরে ফিরে পায় কি না পায়।” রাধারানী চুপ করে যায়। বোধকরি হঠাৎ আতঙ্কগ্রস্তা হয়ে পড়ে। হয়তো তার মনে হয়, কাজটা ভাল হয়নি। এভাবে মানুষটাকে উত্তেজিত করা। ভুল বোঝানো।
ভুল? তা সে নিজেও জানে না! কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল! নিজের কাছে স্বীকার করতে আর লজ্জা কী? পরিচয় পাওয়ার পূর্বেই ঐ আগুনবরণ মানুষটাকে দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেছিল! প্রথম দিনই। দূর থেকেই। তারপর পরিচয় পাওয়া মাত্র যে-কথাটা ওর মনে পড়েছিল—কী লজ্জা!—সেটার কথা মঞ্জুকেও মন-খুলে বলতে পারেনি : মূর্ছা রোগটা তো তারও হতে পারত! তারপর ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছে। মনের যে অংশটা দুমড়ে-মুচড়ে অষ্টাবক্র হয়ে যায়নি—হঠাৎ লক্ষ্য করেছিল সেই অংশে একটা ছোট্ট চারা গাছ! দু-তিন দিনের ভিতরেই সে চারাগাছে দেখা দিয়েছিল কাঁচা কিশলয়, গোপন বৃত্তে মুঞ্জরিত হয়েছিল কচি পুষ্প-কোরক। গানে-গানে দল মেলে ফুটে উঠতে চেয়েছিল সেই কুসুমকলিকা। কিন্তু তাই বলে মঞ্জুর ঘরভাঙার কথা তার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না—সে কথা সে স্পষ্টাক্ষরে জানিয়েও দিয়েছিল গোঁসাই ঠাকুরকে।
কাজটা ঠিক হয়নি। ও পুরুষ। মানবে কেন? প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাওয়ার পরেও?
রাধারানীর মন তখন দ্বিধাবিভক্ত! বুঝেছে—এ ওদের অভিসার! অবৈধ অভিসার! গোঁসাই আজ বেপরোয়া রাজপুত্তুর : ‘চোরের কি কভু নিবৃত্তি আছে!’
কিন্তু! নিজের মনটাকেই কি চিনতে পেরেছে রাধারানী? সে তো জানে তার সীমারেখা! কাব্যে, গানে, লাস্যে, হাস্যে প্রণয়কথা এক জিনিস, আর…
শেষ সময়ে যদি ঐ অষ্টাবক্র-মনটা পথ রুখে দাঁড়ায়!
অশ্বের গতি স্তিমিত হয়ে এল একটি নাকা-চৌকির সম্মুখে। পথের সামনে এড়োএড়ি করে একটি বাঁশ বাঁধা। তার একপ্রান্তে দড়ির বাঁধন; অপরপ্রান্তে ভারী পাথর-বাঁধা হাঁসকল! কী ব্যাপার? পথ রুদ্ধ কেন?
এটাই কানুন। এটা ফরাসী-চন্দননগরের শহরসীমান্ত। ও-প্রান্ত ফরাসী সরকারের শাসনাধীন। নাকাচৌকীর পাশেই একটি ছোট গুমটি ঘর। তার সম্মুখে পগ্গ মাথায় একজন রক্ষী, ঘরের ভিতর টকটকে লালমুখো এক সাহেব।
—পথে আগড় দেওয়া কেন?—জানতে চাইল রাধারানী।
—আমরা নগরসীমান্তে পৌঁচেছি। ছাড়পত্র দেখাতে হয় এখানে।
রূপেন্দ্র অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করলেন। রাধার কটিদেশ বেষ্টন করে তাকে ভূতলে নামিয়ে আনলেন। সাহেবের চোখের সামনে এভাবে অবতরণ করতে সলজ্জ হয়ে পড়ে।
সহাস্যবদনে ঘর ছেড়ে বাইরে বার হয়ে এল ফরাসী যুবক। এমন রাঙামুখো মানুষ রাধা সারাজীবনে দেখেনি। আর তার সাজপোশাকেরই বা কী বাহার! ঊর্ধ্বাঙ্গে খাটো কুর্তা, নিম্নাঙ্গে যে পরিচ্ছদ—ব্রিচেস্―তা আগে কখনো দেখেনি। মাথায় বিরাট টুপি, তাতে আবার কী একটা পাখির পালক লটকানো। কোমরবন্ধে শুধু তরবারীই নয়, পিস্তলও।
মাথা থেকে টুপিটা খুলে ওঁদের দুজনকে বলে, বঁ সোয়ে!
রূপেন্দ্র নমস্কার করে প্রত্যভিবাদন করেন : বঁ সোয়ে’!—কথাটার মানে না জেনেই। ‘নমস্কারে’–’নমস্কার’, ‘রাম-রাম’-এ ‘রাম-রাম’, ‘শুভসন্ধ্যায় যদি ‘শুভসন্ধ্যা’ প্রত্যভিবাদন হয়, তাহলে ‘বঁ সোয়ে’-র ক্ষেত্রেই বা নিপাতনে সিদ্ধ হতে যাবে কেন?
সাহেব বলে, আঁত্রে, আঁত্রে, সিল ভূ প্লে-
এবার আর হালে পানি পান না। তবে ওর দুটি হাতের মুদ্রায় বোঝা যায় বক্তব্যটা, আসুন, আসুন, অনুগ্রহ করে ভিতরে আসুন।
রূপেন্দ্র বিনাবাক্যব্যয়ে জেব থেকে তাঁর অনুমতিপত্রটি বার করে দেখান। পিসেমশাই সেটা ওঁকে দিয়ে রেখেছেন; বলেছেন, প্রয়োজনে সেই সনাক্তিকরণ পত্রটি দেখাতে হতে পারে। সাহেব দেখে খুশি হল। হড়বড় করে কী যেন অনেকটা বলে গেল তার মাতৃভাষায়। রূপেন্দ্র উপায়ান্তরবিহীনভাবে না-য়ের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আধা-সংস্কৃত আধা-বাঙলায় বললেন, ফরাসী নাহং বেদ!
লোকটা বুঝল। সেও নীরবে তার দুটি হাত বাড়িয়ে দিল ফরাসী চন্দননগরের দিকে, যে ভঙ্গিতে কন্যাকর্তা বরযাত্রীদের ‘আস্তাজ্ঞা-হোক’ জানায়।
অর্থাৎ রূপেন্দ্র নগরে প্রবেশ করতে পারেন।
রূপেন্দ্র পুনরায় যুবতীর কটিদেশ বেষ্টন করে অশ্বারূঢ়া করতে চাইলেন। রাধা বাধা দিল। বললে, ঐ সাহেবের চোখের সম্মুখে নয়। চল, একটু পায়ে হেঁটে আড়ালে যাই। মুখপোড়া ভাববে আমি বুঝি তোমার বিয়ে করা বউ।
কোথাও কিছু নেই লালমুখো আকাশ-ফাটানো হাসি হাসল। মাথা থেকে টুপিটা পুনরায় খুলে বিচিত্র ভঙ্গিতে দোলাতে দোলাতে বললে, আশাতে মাদমোয়াজেল! মুখপুড়া কিছু-কিছু বুঝিল! কমপ্রিহেন্দ্।
—ও মা গো। সাহেব বাঙলা বোঝে।—রাধারানীও এখন রাঙামুখো।
হাঁটতে হাঁটতেই নাকা-চৌকির এলাকাটা পার হয়ে এলেন দুজনে। বাঁক ঘুরতেই একেবারে নির্জন প্রান্তর। শুধু পথের ধারে নয়ানজুলিতক্ গাছ-গাছালির ঘন আচ্ছাদন। রূপেন্দ্র ডাকেন, এবার এস। ঘোড়ার উপর বসিয়ে দিই।
—না।—রাধারানী সড়কটা পার হয়ে একটা সাঁকোর পাঁচিলের উপর গিয়ে বসল।
—কী হল আবার?
—আগে বল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
—বললাম তো। আমার রাজপ্রসাদে। ফরাসডাঙায়।
ফরাসডাঙায় রূপেন্দ্র ভেষগাচার্যের রাজপ্রাসাদ থাকার কথা নয়। এটা জানা আছে। হয়তো সেখানে কোন পান্থশালায় একটা কামরা ভাড়া করেছে। সেখানেই নিয়ে গিয়ে ওকে তুলতে চায়। হেতুটা সহজবোধ্য। রাধারানী বলে, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
–কেন নয়? এটাই তো তুমি মনে-মনে চাইছিলে, রাধা।
হঠাৎ রুখে ওঠে। বলে, না। তাহলে তুমি ভুল বুঝেছ আমাকে। আমি তো সেদিন বলেছিলাম গোঁসাঞ, মঞ্জুর ঘর ভাঙতে চাইছি না আমি।
—আমিও তো সেটা চাইছি না, রাধা।
—তাহলে মাহেশের বদলে আমাকে এখানে নিয়ে চলেছ কেন?
রূপেন্দ্র অশ্বটিকে গাছের ডালে বেঁধে ওর পাশটিতে এসে বসলেন, বললেন, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না, রাধা? আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে পারি? তোমার, অথবা মঞ্জুর? জেনে শুনে?
—তাহলে আমাকে কেন নিয়ে চলেছ ফরাসডাঙায়? মাহেশে কখন যাব?
—কাল সকালে। রাতটা এখানে কাটিয়ে।
হঠাৎ ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল রাধারানী। বললে, তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ ঠাকুর। আমি—- মামি… তুমি যে আমার সব কথা জান না।
রূপেন্দ্র ওর হাতদুটি তুলে নিয়ে বললেন, আমি তোমার সব কথা জানি, শেফালী!
–শেফালী?
—হ্যাঁ। আমি তো সেই ছোট হুজুর নই! আমাকে ভয় কী?
হঠাৎ অশ্রুআর্দ্র মুখখানি মেলে ও আকুলভাবে বলে, তা তুমি পারবে?
–কী?
–এক বিছানায় শুয়েও…যদি আমার মন হঠাৎ বিষিয়ে ওঠে…
রূপেন্দ্র ওর করমুষ্টি আকর্ষণ করে ওর কপালে একটি চুম্বনচিহ্ন এঁকে দিলেন, বললেন, সে গত্মবিশ্বাস আমার আছে, রাধা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেন তোমার গাত্রস্পর্শ করব? তুমিই না লেছিলে, আমি—অসাধারণ!
হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল! আত্মবিস্মৃত হয়ে রাধারানী সবলে আকর্ষণ করে ধরল রূপেন্দ্রকে। ার ওষ্ঠাধরে এঁকে দিল সুনিবিড় এক চুম্বনচিহ্ন। দীর্ঘ সময় ধরে। পরমুহূর্তেই আলিঙ্গন-মুক্ত য়ে দু-হাতে মুখ ঢাকল।
রূপেন্দ্র অবিচলিত। ব্রত উদ্যাপন করছেন তিনি। অনাসক্ত থাকার ব্রত।
পুনরায় ওর হাত ধরে আকর্ষণ করেন। বলেন, এবার এস।
—তুমি রাগ করনি?
—তোমার কি তাই মনে হল?
—না। কিন্তু…
—কিন্তু কী?
—বোঝ না যেন! তোমার ভাবখানা ছিল—না আবাহন, না বিসর্জন
রূপেন্দ্র মনে মনে অস্বস্তি বোধ করেন। মেয়েটা বুঝে ফেলেছে! প্রখর বুদ্ধিমতী সে। এমন নিরাসক্ত থাকলে চলবে না। সক্রিয়ভাবে নিরাসক্ত হতে হবে।
রাধারানী বলে, কী ভাবছ, সত্যি করে বলবে?
—বলব! তোমার চুমু খাওয়া দেখে মনে হল—জীবনে তুমি এই বোধহয় প্রথম কোন পুরুষমানুষকে চুম্বন করলে—আযৌবনের তৃষ্ণা নিয়ে।
রাধা সলজ্জে মুখ নিচু করে বললে, কথাটা কিন্তু ঠিকই। এই প্রথম।
—এর আগে কখনো খাওনি?
—না! আমাকে খেয়েছে, আমি খাইনি। যেমন এখন তুমি আমাকে খেলে না। এবার রূপেন্দ্রই ওকে সবলে আকর্ষণ করে টেনে আনেন।
“অধরের কানে যেন অধরের ভাষা,
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে—
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে।।”
তীর্থযাত্রা। তীর্থ শেষ নয়। এ তো শুধু কুসুমচয়নের পর্যায়।
এর পরিণতি “মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে।”
কঠিন সে পরীক্ষা সম্মুখে!