তীর্থের পথে – ১৫

১৫

রাধারানীর বাল্য ও কৈশোরস্মৃতিতে অবিমিশ্র আনন্দ। কুসুমমঞ্জরীর চেয়ে তা অনেক বেশি সৌভাগ্যের দ্যোতক। তার বাবা-মা, ভাই-বোন সবই ছিল। বাবা গঙ্গাপ্রসাদ ছিলেন জিম্বা-তালুকদার, মধ্যস্বত্ব-ভোগী। জাতে বঙ্গজ কায়স্থ—কৌলীক উপাধি বসু। জিম্বা-তালুকদার পেশাগত উপাধি। সে-আমলে জমিদারের অধীনে একাধিক মধ্যস্বত্ব-ভোগী পদ ছিল—লাখরাজদার, যারা খাজনা দিত না, নিষ্কর ভূমি ভোগ করত, প্রায়শই ব্রহ্মোত্তর। তালুকদার, পত্তনীদার, গাঁতিদার, জোতদার প্রভৃতি। সরাসরি কিছু কৃষিজীবীকেও জমির বন্দোবস্ত দেওয়া হত, তাদের বলা হত রায়ত। রায়তেরা কখনো অস্থায়ী, অর্থাৎ কোফা বন্দোবস্ত; কখনো বা স্থায়ী বর্গাদার। তালুকদারেরা জমিদারের অধীনস্থ হয়েছিল পরবর্তী-জমানায়। পলাশীযুদ্ধের প্রাক্কালে তালুকদারেরা সরাসরি নবাব-সরকারে খাজনা জমা দিত—জমিদারের মাধ্যমে নয়; বলা যায় ছোটমাপের জমিদার। কারও বা মৌরসী স্বত্ব, অর্থাৎ পুরুষানুক্রমে ভোগ্য অধিকার, কারও বা মোকররী স্বত্ব—অর্থাৎ খাজনার পরিমাণ নির্দিষ্ট। আবার কারও বা ‘সোনায়-সোহাগা’—মকররী-মৌরসী স্বত্ব যা নির্দিষ্ট খাজনায় বংশানুক্রমে ভোগ্য। জিম্বা-তালুকদারেরা ঐ তালুকদারের অধীনে। তা, অতসব তত্ত্বকথা আলোচনা করার প্রয়োজন নাই—মোট কথা, গঙ্গাপ্রসাদের আর্থিক সচ্ছলতা যথেষ্টই ছিল। ধর্মে বৈষ্ণব, রূপনগরের বাসিন্দা।

জীবনের প্রথম নয়টা বছর কেটেছে পার্বত্য ঝরনার মতো—নেচে-কুঁদে। সে হাঁটতে গেলে ছুটতো, কথা বলতে গেলে গান গেয়ে উঠত। রাজহাঁসের মতো গায়ের রঙ, বুলবুলের বুকের ধুপুকানির মতো ঠোঁটদুটি, মাথায় টাকা-টাকা চুল দুধরাজ-রঙের অর্থাৎ শুধু কুচকুচেই নয় চিকচিকে। আর প্রকৃতি খঞ্জন-পাখির মতো। দোষের মধ্যে নয় বছর বয়সেই তার দেহগঠন একটু পুরম্ভ। তা হোক, পাড়ায় সে ছিল ডাকসাইটে সুন্দরী।

ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহান্তে অমাবস্যা তিথি। শিবচতুর্দশীর পর দিন। অর্থাৎ মৌনী অমাবস্যা। পঞ্জিকার নির্দেশ এই পুণ্যতিথিতে গঙ্গাস্নানে অক্ষয় পুণ্য। তা অজয়ের তীরে গঙ্গা কোথায় পাবে? ওরা অজয়েই স্নান করে—অবগাহন স্নানই বিধেয়। রাত্রিপ্রভাতে, শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ : মাধবপক্ষ—যার পরিণাম পূর্ণিমায় মাধবের রঙ-দোল।

সেই পুণ্যতিথিতে সহধর্মিণী আর কন্যাকে নিয়ে ভোর-ভোর স্নানে এসেছেন গঙ্গাপ্রসাদ। অমাবস্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে, পুব-আকাশে তখনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে শুকতারা। মৌনী অমাবস্যার ‘মন্তম্বরা-স্নান’ উপলক্ষ্যে সেই সাত-সকালেই অজয়ের ঘাটে সমবেত হয়েছে অনেক স্নানার্থী। এ ঘাট মোহন্ত মহারাজের প্রাসাদ-সংলগ্ন; নাম ‘মহারাজের ঘাট’।

স্ত্রী-পুরুষদের পৃথক ঘাট। গঙ্গাপ্রসাদ স্নান সমাপনান্তে এসে দেখলেন স্ত্রী-কন্যারও অবগাহন সুসম্পন্ন। গৃহিণী একগলা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছেন ঘাটোয়াল পাণ্ডাজীর বৃত্তাকার ছত্রতলে; আর কন্যা বসে আছে হাঁটু গেড়ে। পাণ্ডাজী তার ললাটে চন্দনছাপ লেপন করছেন।

সহসা পথের দিক থেকে শোনা গেল এক কলরোল : হট যাও! হট যাও! গঙ্গাপ্রসাদ প্রাচীর সই-সই হয়ে পথ দিলেন। একটি ছোট শোভাযাত্রা এগিয়ে আসছে। শোভাযাত্রার সম্মুখে মোহন্ত-মহারাজের মঠের ধ্বজাধারী কয়েকজন, কিছু ঢাক-ঢোল-শিঙাবাদক। তার পিছনের সুসজ্জিত এক বিশাল রণহস্তী। সবাই তাকে চেনে : হেরম্বদাস।

মোহন্ত মহারাজ স্বয়ং এসেছেন গঙ্গাস্নানে। তাই এত কলরব, এত ঢাক-ঢোল-শিঙ্গা। গজরাজ পা মুড়ে বসল ঘাটের কিনারে। মই লাগানো হল। নেমে এলেন স্থূলকায় বৃদ্ধ মোহন্ত-মহারাজ। পরিধানে পট্টবস্ত্র, গলায় গোড়েমালা, মেদের মৈনাক! গজগমনে অগ্রসর হলেন ঘাটের দিকে। সসম্মানে দুই সারি হয়ে মানুষজন পথ দিল।

হঠাৎ গতিরুদ্ধ হল বাবাজীর। হেলতে-দুলতে এগিয়ে এলেন ঘাটোয়ালের দিকে। পাণ্ডাজী গাত্রোত্থান করে দণ্ডবৎ হল। বালিকা তখনো নতজানু—অবাক চোখে দেখছে। প্রণাম করতেও ভুলে গেছে। গোঁসাইজী ওর চিবুক ধরে ওর ভ্রমধ্যে কী যেন দেখছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। বলেন, কী নাম রে তোর রাধারানী?

—শিউলী…মানে, শ্রীমতী শেফালী বসু।

—না, তুই রাধারানী। এ কার মেয়ে?

শেষ প্রশ্নটা পাণ্ডাজীকে। সে হাত তুলে ওর মাকে দেখিয়ে দেয়। গঙ্গাপ্রসাদ ভীড় ঠেলে অগ্রসর হয়ে আসেন। বলেন, আমার কন্যা, প্রভু।

–কত বয়স?

—আজ্ঞে আট পার হয়েছে। নবমবর্ষ চলছে।

—অ! বিবাহ দিয়েছিস্?

—আজ্ঞে না। সম্বন্ধ পাকা হয়ে আছে। বৈশাখে দেব। আপনি অনুমতি দিলেই।

এক গাল হাসলেন মোহন্ত মহারাজ। বললেন, দিলাম না!

—আজ্ঞে?

বুঝলি না? অনুমতি দিলাম না! এর গৌরীদান হবে না। ষোড়শ বর্ষে এর বিবাহ বিধেয়। ওর ভূমধ্যে আমি সুলক্ষণ দেখতে পেয়েছি। এ মেয়ে মহাসৌভাগ্যবতী।

কপর্দকহীন মানিকচাঁদের ভূমধ্যে তার কোটিপতি হবার সম্ভাবনা দেখেছিলেন তিনি। সবাই তা জানে।… কিন্তু তাহলে রামানন্দ দত্তের বাবাকে কী বলবেন? সম্বন্ধটা ভেঙে দেবেন? প্রতিবেশী দত্তমশায়ের কাছে যে বাকদান করা আছে। রামানন্দ ছেলেটিও খুব ভাল—যেমন বিনয়ী, বুদ্ধিমান, তেমনি সুন্দর। সে যেন ঘরের ছেলে হয়ে গেছে।

সবিনয়ে সে কথাই নিবেদন করেন যুক্তকরে, শিউলীর সম্বন্ধ যে হয়ে আছে প্রভু। কথা দিয়েছি আমি।

—শিউলী! শিউলী কে? বলছি না—ওর নাম রাধারানী।

—আজ্ঞে হ্যাঁ। বলছিলাম কি যে, ঐ রাধারানী বাকদত্তা…

অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন গোঁসাইজী : বাকদত্তা! বলিস্ কী রে! বাকদানের আগে আমার অনুমতি নিইছিলি?

গঙ্গা পাষাণমূর্তি! এ কী হতে চলেছে? বালিকার গাল দুটি টিপে ধরে লালসাজর্জর কণ্ঠে বলে ওঠেন, আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি রে—আহা! “পহিলে বদরিসম পুন নবরঙ্গ/দিনে দিনে অনঙ্গ আগোড়ালো অঙ্গ।।”

শিউলী জোড়া-পায়ে পিছিয়ে যায়, খঞ্জন পাখির মতো। বলে, আমাকে ছুঁয়ো না। তোমার হাত নোংরা।

হা-হা করে আবার হাসি। মেদবহুল মধ্যদেশে সে হাস্য তরঙ্গ তোলে। বৃদ্ধ বলেন, ওরে তোরা শোন! রাইরানী কী বলছে শোন। আমার হাত নাকি…

কথাটা শেষ হয় না। নজরে পড়ে নিজের হাত। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে অবতরণের সময় সত্যই তাঁর তালু কালিমালিপ্ত হয়েছে। পট্টবস্ত্রে হাতটা মুছে ফেলে হাঁকাড় পারেন : অঙ্কুর!

সশস্ত্র দেহরক্ষী অক্রুর সর্দার এগিয়ে এসে দণ্ডবৎ হয়। তাকে বলেন, রাইরানীকে তার কুঞ্জে পৌঁছে দিয়ে আয়।

গঙ্গাপ্রসাদের দিকে ফিরে পাদপূরণ করেন, কাল দেখা করিস! কথা আছে। বুঝলি?

হ্যাঁ, বুঝেছেন। সবটা না হলেও, অনেকটা। না হলে নজরবন্দী হয়ে স্নানান্তে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে হবে কেন? পাছে ঐ গোরোচনা গোরী জনারণ্যে হারিয়ে যায় তাই এই সাবধানতা। অক্রুর চলেছে বাড়িটা চিনে রাখতে।

শিউলীর মায়েরও বাকরোধ হয়ে গেছে। মৌনী অমাবস্যার স্নানান্তে যেন মৌনী! অন্তরে জাগছে সেই অব্যক্ত হাহাকার যা বাঙ্ময় হয়ে উঠবে আরও দুশ’বছর পরে সত্যেন্দ্রনাথের কলমে:

“হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে, ওরে!
হারিয়ে গেছে বোল্-বলা সেই বাঁশী।
হারিয়ে গেছে কচি সে মুখখানি
দুধে ধোয়া কচি দাঁতের হাসি!
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলি ফুলের রাশি।।”

পরদিন বিস্তারিত নির্দেশ পেয়ে বজ্রাহত হয়ে গেলেন গঙ্গাপ্রসাদ। রাজা শান্তনুও পারেননি প্রতিবাদ করতে, যখন গঙ্গাদেবী তাঁর সন্তানকে ডুবিয়ে দিতেন গঙ্গায়। কিন্তু তাঁর বুকফাটা কান্নায় কেউ বাধা দেয়নি। গঙ্গাসাগরে কন্যা বিসর্জন দেবার প্রথা তখনও চালু—কিন্তু সমাজ অত অনুদার নয়। সন্তানহারা কাঁদলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় না। গঙ্গাপ্রসাদ আরও দুর্ভাগা। চোখের জল ফেলা মানা! দু-হাত তুলে কন্যার মৃত্যুতে হরিসংকীর্তনে যোগ দিতে হবে : ‘বল হরি! হরি বল!’ চোখে জল এলে যেন বোঝা না যায় এ আনন্দাশ্রু নয়!

পূর্ববৎসর গোঁসাইজী পুরীধামে তীর্থে গিয়েছিলেন। দেখে এসেছেন, কলিঙ্গের নানান মন্দিরে ‘সুতনুকা” দেবদাসীদের। তারা ওঁর মঠের সেবাদাসীদের মতো যৌবন-সম্বল শুধু নারীমাংসপিণ্ডই নয়—চৌষট্টি কলায় পারদর্শিনী। প্রেমালাপে সুরসিকা, শৃঙ্গারে কামোদ্দীপিনী, সঙ্গীতে কিন্নরী, নৃত্যে স্বর্গনটী! কাঞ্চনমূল্যে তেমনই দু-একটি বরনারীকে সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন। সফলকাম হননি। পুরোহিতেরা সম্মত হয়নি। কলিঙ্গরাজের বদান্যতায় তাদের অর্থাভাব নাই। তাই এই বিকল্প আয়োজন—স্থির করেছেন : নিজ ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি করবেন কিছু : গোপিকা!

‘গোপিকা’ বোঝ তো? শৈবমন্দিরে প্রধান দেবদাসীকে বলে ‘রুদ্রাণী’, বিষ্ণু-মন্দিরে সে : ‘গোপিকা’! কাঞ্চনমূল্যে গোপিকা ক্রয় করা যায়নি বটে কিন্তু আমদানি করেছিলেন একটি ‘গোপালিকা—জোগতি। ‘জোগতি’ অর্থে প্রাক্তন দেবদাসী। যৌবন বিকিয়ে যাবার পর তারা নবীন যুগের দেবদাসীদের নানান বিদ্যায় পারদর্শিনী করে তোলে। গাঁয়ের আনপড় সুন্দরী বালিকাকে ঘষে মেঝে এই মণিকারেরা তৈরী করে সুদক্ষা কিশোরী দেবদাসীতে। অন্তিমে তার যাদুদণ্ডে সেই কিশোরী রূপান্তরিতা হয়ে যায় যৌবনভারনম্রা সকলকলাপারঙ্গমা গোপিকায়। প্রেমকূজনে রাজনটী, সঙ্গীতে গীতভারতী, নৃত্যে উর্বশী আর সুরতক্রিয়ায় মদনজয়ী রতিদেবীতে।

নগর প্রান্তের এক নিভৃতকুঞ্জে বন্দিনী হল নবমবর্ষীয়া বালিকা। সে বন্দিআবাসে মাত্র দুজন। আবাসিক—বর্ষীয়সী জোগতি আর তার বালিকা শিক্ষার্থিনী। প্রাচীর বেষ্টিত একতলা মোকাম—কারাগারই বলা চলে। বাবা-মা-ভাই-বোন, সই-সয়া কেউ দেখা করতে আসে না। কানুন নেই। সাধনা হওয়া চাই একনিষ্ঠ—নির্বান্ধব পরিবেশে। শুধু গবাক্ষপথে বালিকা দেখতে পায় ফটকের কাছে পাহারা দেয় দাড়িয়ালা এক বন্দুকধারী শাস্ত্রী। দেখে কিছু কাক, চড়াই, শালিক—ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে কখনো বা ল্যাজঝোলা হাঁড়িচাচা, হলুদবরণ বেনেবউ বা দীর্ঘপুচ্ছ মসীকৃষ্ণ দুধরাজ! আর বাগানে নাচানাচি করে ফেরে কিছু কাঠবিড়ালী।

জোগতি প্রৌঢ়া নয়, প্রায় বৃদ্ধাই। মনটা নরম। যত্ন নিয়ে শেখায় নাচ আর গান, মুখে মুখে শোনায় নানান তত্ত্বকথা, অক্ষর পরিচয় করায়। রতিরঙ্গের অন্তরঙ্গ কথা শেখানোর সময় হয়নি এখনো।

জানলার ধারে বসে অবকাশের দৈনিক বরাদ্দ ব্যয়িত হয় স্মৃতিচারণে। হোক নবমবর্ষীয়া, তবু তার স্মৃতিভাণ্ডারে কত-কত জমা হয়ে আছে। বাবার কথা, বোনের কথা, ভাই-এর কথা। মায়ের সোহাগ। আর সেই পাগলটার কথা : রামু।

মনে পড়ে ‘পুন্যিপুকুর’ ব্রতের কথা। ‘পুন্যিপুকুর’ নয়, কথাটা ‘পূর্ণিপুকুর’। বৈশাখ মাসে যাতে পুকুরে জল না শুকোয়, গরমিতে গাছ না মরে যায়, তাই এই ব্রত। ছোট ছোট মেয়েরা বাড়ির আশপাশে ছোট্ট একটা চৌকোণা পুকুর খোঁড়ে—ধর, এক হাত লম্বা, আধ-হাত চওড়া, তিন-চার আঙুল গভীর। তার মাঝখানে পুঁততে হবে বেলগাছের ডাল, তারপর ঢালো জল, যতক্ষণ না শুষে নেবার পরেও পূর্ণিপুকুর টেটম্বুর হয়ে ওঠে। তারপর সকালবেলা ‘উপুস’ করে ঠিক ‘দুকুর বেলা পুজো করতে হয়। পুকুরের চার কোণায় জুঁই, বেল, টগরের অঞ্জলি দিয়ে মন্তর পড়তে হবে :

পুন্যিপুকুর পুষ্পমালা
কে পূজে রে ‘দুকুর’ বেলা?
আমি সতী লীলাবতী,
ভাই-এর বোন পুত্রবতী।
হয়ে ‘পুত্তুর’ মরবে না,
‘পিরথিবীতে’ ধরবে না।”

রামু ওর খিদ্‌মদ্‌গার। পুঁচকে বান্ধবীর হুকুমে পুকুর খুঁড়েছে, বেলের ডাল আর পূজার ফুল নিয়ে এসেছে। মায় শিউলী ‘উপুস’ করছে বলে সকাল থেকে দাঁতে কুটোটি কাটেনি। শিউলী ভিজে চুল পিঠে এলিয়ে জোড়-হাতে ছড়া কেটে-কেটে পুকুরে ফুল ছিটায় আর রাম্ টুম্‌-টুম্‌ হয়ে বসে থাকে সমুখে। যেন তাকেই পুজো করা হচ্ছে।

একদিনের কথা মনে পড়ছে, বছর তিনেক আগেকার কথা। তখন শিউলীর ছয়, রামুর নয় সেদিন রামুর একটা বেয়াড়া প্রশ্নে সব নয়-ছয় হয়ে গেল। রামু হঠাৎ বললে, অ্যাই শিউলী? তুই ছড়ায় ও-কথা বলিস্ কেন রে? ‘ভাই এর বোন পুত্রবতী?

শিউলী রুখে উঠেছিল—ঈস্! কী বিচ্ছিরি কথাবার্তা তোমার রাম-দা। ‘ছড়া” কী? একে বলে ‘মন্তর’। বুঝলে?

—তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুই কি পুত্রবতী?

—হ্যাঁ গো মশাই! আমার তিনটে কাঠের পুতুল, একটা মাটির! আমার দুই মেয়ে, দুই ছেলে।

—মানছি। কিন্তু মন্তরের ঐখানটা—‘আমি সতী লীলাবতী!

—তাতেই বা অসৈরণ কতাটা কী বলেছি? আমি কি অসৎ?

—দূর পাগলি! ‘সতী’ মানে বুঝি তাই? ‘সতী’ মানে যে বরকে ভালবাসে! তোর তো বরই নেই, ভালোটা বাসবি কাকে?

টোবা-টোবা গাল দুটো পাকা-আপেল। ছয় বছরের বালিকা। ধমক দিয়ে ওঠে, দাঁড়াও! জেঠিমাকে বলে দেব! তুমি আমাকে ‘অসভ্য–কতা’ শেখাচ্ছ!

মাকে ডরায় রামানন্দ। বলে, আয় বাপ্! ‘বর’ কতাটা কি অসভ্য কতা? ‘ভালবাসা’ কি মন্দ-বাসা? খারাপ কতা?

নোলক সমেত মাথা দুলিয়ে শিউলী বলে, জানি না। দিক্ কর না দিনি! আমাকে থির হয়ে পুজো-পাঠ কর্তে দাও!

আজ এই নবমবর্ষীয়া ভাবী-গোপিকার হাসি পায় সে-সব কথা মনে পড়লে। এখন সে অনেক-অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। অনেক সইয়ের সয়া এসেছে যে ওর। শুনেছে সেইসব সয়া-ওলা ভাগ্যবতীদের কাছে—‘বর’ কতাটা অসভ্য নয়, কিন্তু বরেরা মাঝে-মাঝে ভারী অসভ্যতা করে। দ্যাখ্-না-দ্যাখ্ ফটাস্ করে চুমু খেয়ে বসে। মায় দিনমানে! পাত্রীর মালিকানা পেলেই স্থান-কালের কথা ভুলে যায়। আর ঐ ‘ভালবাসা’ কতাটা? সরম হয় স্বীকার করতে, কিন্তু—না, ওটা মন্দ নয়, কতাটা সোন্দর!

সাত আর আট—এ দুটি বছরেও রাম-দাকে সাক্ষীগোপাল করে বেরতো করেছে। তবে মন্তরের বিশেষ বিশেষ পংক্তি ‘উরুশ্চারণ’ করত না। মনে মনে গুনগুনাতো। রাম্ হাসত মুখ লুকিয়ে। প্রকাশ্যে নয়—তাহলেই পিঠে গুম্-গুম্ হবে! হাসত দু-হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে। পিঠটা ফুলে-ফুলে উঠত। আর লজ্জায় শিউলীর মুখখানি হয়ে যেত শিউলী-বোঁটা রঙের।

আগামী বৈশাখে তার ব্রত সমাপনের শেষ মাহেন্দ্রক্ষণ আসার কথা ছিল—পুন্যিপুকুর হয়ে ওঠার কথা পুণ্যে টে-টম্বুর, পূর্ণিপুকুর পরিণত পূর্ণতার সার্থকতায়। লীলাবতী হত সত্যিকারের সতী—সীতা : রামানন্দের হৃদয়লীনা।

কালে—লাজে বাঁচি না—হয়তো পুত্রবতীও হত!

হল না। সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গেল লঙ্কেশ্বর! এক মৌনী অমাবস্যায় সে মুখ সম্ভাবনা হয়ে গেল চির মৌন।

কেটে গেল পাঁচ-পাঁচটা বছর। বালিকা হল কিশোরী। ‘নবরঙ্গ’ এখনো হয়নি, তবে নব রঙ্গ তো বটে! বদরির কাল অতীত। কিশোরীবক্ষে জেগেছে যুগল কৌতূহল। ‘কস্তুরী-মৃগ’ হবার জমানা—আপনাতে আপনি বিভোর। পূর্ণিমায় পৌঁছাতে তখন সেই চতুর্দশীর এক-তিথি বাকি : প্রত্যক্ষ অনুভূতির জ্ঞান! পরোক্ষে তার শিক্ষা সম্পূর্ণ। জোগতি ওকে শিখিয়েছে চার-ষোল চৌষট্টি কলা—ঐ এক-কলা বাকি : হাতে-কলমে! জোগতি-মাসির মঞ্জুষায় ছিল ‘কুট্টিনীমতমে’র এক ওড়িয়া অনুবাদ। তাল পাতার পুঁথিতে—হাতে লেখা সচিত্র পুস্তিকা! সুর করে পড়ে শোনাতো—ওড়িয়া শব্দের আড়াল আবডালে সব কথা বোঝা যেত না, ছবি দেখেও না বুঝলে প্রশ্ন করতে সরম হত। মাসিও ইচ্ছা করেই অনুক্ত রাখত। ছড়া কেটে বলত :

“রসবতী মোর প্রতি যাদু কিলা!
গোটা পান দিয়ে গোটা সুপুরিয়ে
মুচুকিরি হাসি কিরি মোর হাতে দিলা।”

তার শাঙ্করভাষ্য হচ্ছে : এ বিদ্যায় শেষ শিক্ষা শুধু দিতে পারে নাগর। যখন রসবতী মৃদু হেসে তার হাতে তুলে দেবে গুবাক-সুপারীর গুরুদক্ষিণা!

তখনই সেই নিভৃত নিকেতনে ঘুর-ঘুর করতে দেখা গেল একজনকে। নামটা জানে না রাধারানী—সবাই তাকে ডাকত : ছোট-হুজুর। মোহন্ত মহারাজের ভাইপো না ভাগ্নে কী যেন হয়। সেনাবাহিনীর সেনাপতি। অসীম তার ক্ষমতা। দ্বাররক্ষককে অনায়াসে বশীভূত করল উৎকোচে; কিন্তু পদ্মকলির নাগাল পেল না মুগ্ধ ভ্রমর। লঙ্কেশ্বরের লাঞ্ছনা থেকে অশোকবনে জানকীকে কোনও চেড়ি রক্ষা করেছিল কি না বাল্মীকি লিখে যাননি; কিন্তু সেই লম্পটের পাশবিকতা থেকে রাধারানীকে নিরাপত্তা দিয়েছিল ঐ সামান্যা নারী। সামান্যা—তবু অসামান্যা! ভয় দেখিয়ে তাকে জয় করা গেল না, লোভ দেখিয়ে লুব্ধ। ছোট হুজুর তার গলার শতনরী খুলে দিয়েছিল জোগতির হাতে—সসম্ভ্রমে সেটি ওরই পদমূলে নামিয়ে রেখে জোগতি বলেছিল, মুই নেমকহারাম ন-আছি ছুট-হুজুর!

ছোট হুজুর হাসতে হাসতে বলেছিল, নেমকহারামির কথা উঠছে কেন? আমি তো তাঁরই লোক। জোগতি তার পাকা চুলে ভরা মাথাটি নেতিবাচক ভঙ্গিতে নেড়েছিল শুধু!

—ঘটঘট্ করে মাথা তো নাড়ছ, ঐ মাথাটা যদি কেটে নামিয়ে দিই ঘাড় থেকে? কে রক্ষা করবে তোমাকে?

করজোড়ে বলেছিল, মোর ধম্ম আজ্ঞে!

ছোট হুজুর কিন্তু অন্য জাতের খবর পেয়েছিল। কে এক দুঃসাহসী লৌণ্ডা আসে রাতের আঁধারে। প্রাচীর ডিঙিয়ে প্রবেশ করে প্রাঙ্গণে—তার গুপ্তচর স্বচক্ষে দেখেছে—প্রহরী জানে না, কিন্তু জানে ঐ জোগতি। আপত্তি করে না। সে পাহারা দেয়—চোখের আড়াল হতে দেয় না, তবে শ্রুতিসীমার বাহিরে থাকে সে। কে সেই দুঃসাহসী? আর কী মন্ত্রে সে বশীভূত করেছে ঐ বৃদ্ধাকে?

ছোট হুজুর তো ছাড়, রাধারানীও সেটা আন্দাজ করতে পারে না। মানে, তখন পারত না। আজ—কুসুমমঞ্জরীকে গল্প করার সময় বুঝতে পারে। কোন মন্ত্রে রামানন্দ বশীভূত করেছিল বৃদ্ধাকে।

মঞ্জরী ‘জানতে চেয়েছিল—কেন গো রাধাদি?

—আজ বুঝতে পারি, কারণ আমি নিজেই আজ প্রাক্তন গোপিকা। আজ কেউ ঐ অবস্থায় পড়লে আমিও কি সুযোগ করে দেব না? ঐ বৃদ্ধাও কি একদিন অতিক্রম করে আসেনি তার বয়ঃসন্ধির সেই অবাক দিনগুলি—তার প্রাকদেবদাসী জীবনে? তখন তার যৌবনের মৌ-বনে কি গুনগুন করতে আসেনি কোন লুব্ধ ভ্রমর?

শেফালী বলত, এভাবে লুকিয়ে দেখা করতে এস না রাম-দা। ধরা পড়লে তোমাকে…

–ধরা পড়ব না রে! ঠিক একদিন পালিয়ে যাব তোকে নিয়ে। সবুর কর—

সবুরে মেওয়া ফলেনি। ধরাই পড়ে গেল শেষ পর্যন্ত। ছোট হুজুর ওকে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াবার প্রস্তাব দিয়েছিল; কিন্তু মোহন্ত মহারাজ বৈষ্ণব। তিনি স্বীকৃত হননি। অপরাধীকে তুলে দিয়েছিলেন কাজী সাহেবের হাতে। আর ঐ সঙ্গে এক থলে মোহর! বাদীর উৎকোচের পরিমাণেই যে সে-আমলে নির্ধারিত হত আসামীর শাস্তির পরিমাণটা।

আশ্চর্য! এক থলে মোহর হজম করে কাজী সাহেব বিচারে অতি লঘু দণ্ড বিধান করলেন সেই পরস্বাপহরকের : তিনমাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড।

মাত্র তিন মাস! তাও বিনাশ্রমে!

ছোট হুজুর তড়পায়—কাজী-শালা দু-তরফা ঘুষ খেয়েছে!

তা সে খায়নি কিন্তু। কাজীসাহেব একটু নতুন খেলায় মেতেছিল। পরিকল্পনাটি খাশা। বিনাশ্রম কারাদণ্ড বটে তবে বন্দীর আহার এক পদ—কাফেরদের নিষিদ্ধ চতুষ্পদী! শুধুমাত্র শূলপক্ক গো-মাংসের শিককাবাব। দেখা যাক—কদিন না খেয়ে থাকিস্।

শিককাবাব কাজীসাহেবের বড় মন-পসন্দ। বন্দীর শিককাবাবটা কেমন জমে তাই সে দেখবে। মাংস বন্দীর, শূল তার হুকুম, উত্তাপ জঠরাগ্নির! পঞ্চম সপ্তাহে ভেঙে পড়ল তরুণের মনোবল। সেদিনই মুক্তি—তখন কঙ্কালসার মানুষটা চলৎশক্তিহীন। দুনিয়ায় সে একা। নির্বান্ধব। কাজী সাহেব কৌশলে বাকি জীবনের জন্য গোটা দুনিয়াটাই রূপান্তরিত করে দিয়েছে কারাগারে। স্বগৃহে তার স্থানাভাব। স্বগ্রামে তার প্রবেশ নিষেধ। রামানন্দ—না, কারাগার থেকে যে কঙ্কালটাকে ওরা মুক্তি দিয়েছিল তার নাম রামানন্দ নয়, রহিম-মিঞা—এখন সে থাকে ফরাসডাঙায়। আকবর ওস্তাগরের পালিতপুত্র : আবদুল রহিম ওস্তাগর! রাধারানী তার খবর জানে না আর, চোখেও দেখেনি। সে আজ পাঁচ-সাত বছর আগেকার কথা। এতদিনে হয়তো সংসার পেতেছে। কার কাছে যেন শুনেছিল—ওর বিবিজানের নাম, ফতিমা।

এরপর শুরু হল তার নিজের নির্যাতন।

অভিষেক!

লালসা-জর্জর লোলচর্মার তির্যক প্রয়াস। মোহন্ত বোষ্টম মানুষ, শিককাবাব সেবা করা সম্ভবপর নয়—‘ঘ্রাণেন’ অর্ধভোজন তার ‘মনপসন্দ’ নয়—অগত্যা বিকৃতকাম!

তবে ছয়মাসের মধ্যেই নিষ্কৃতি পেল। নতুন সাধন-সঙ্গিনীর প্রয়োজন হয়ে পড়ল বাবাজীর। প্রসাদ দিলেন ছোটহুজুরকে। সেখানেও বিড়ম্বনা। ছয়মাসও টিকতে পারেনি। ছোটহুজুরের অরুচি হয়নি, কিন্তু ছুকরি যে সহযোগিতা করতে কিছুতেই রাজী হল না। কেমন করে হবে? সে যে জানে, ঐ লম্পটটার জন্যই রামুদা আজ রহিম মিঞা—গ্রাম থেকে নির্বাসিত। রাতের পর রাত বলাৎকারে সন্তুষ্ট হবার মানুষ নয় ছোট হুজুর। অগত্যা আবার হাতবদল। তবে নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিতে ভুল হয়নি। আখমাড়াই কলে ওকে নিষ্পেষিত হতে, পাঠিয়ে দিল। এমন ব্যবস্থাপনা করল…

কান্নায় ভেঙে পড়েছিল রাধারানী। মঞ্জুর হাত দুটি ধরে বলেছিল, কী হবে তোর শুনে? বলতে আমারও কষ্ট, শুনতে তোরও! সে-সব কথা শুনতে চাসনে আর।

মঞ্জু বলেছিল, থাক দিদি! ওকথা থাক!

শিউরে উঠেছিল মনে-মনে। এমনটা তো তারও হতে পারত। রাধারানীর মধ্যে সে দেখতে পেয়েছিল এক বিপ্রতীপ—মঞ্জুকে।

রোগ নির্ণয় করা গেছে।

পুরুষ-প্রকৃতিই বল অথবা ‘য়াং-য়িঙ’—সৃষ্টিতত্ত্বের সেই অমৃতময় আদিম সত্যটার এ জাতীয় কদর্য রকমফের হলে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা আন্দাজ করা শক্ত নয় ভেষগাচার্যের পক্ষে। বোঝেন—কতকগুলো বিকৃতকাম পাষণ্ড যখন ওকে নিয়ে আখমাড়াই কলে পিষেছে তখন শুধু ওর দেহটাই দুমড়ে-মুচড়ে শেষ হয়নি, গেছে মনটাও। নরনারীর দৈহিক-মিলন ওর কাছে এক বিভীষিকার ন্যক্কারজনক প্রতিচ্ছায়া। ওর মনের একটা অংশ সুরত-বিমুখ, কিন্তু আর একটা অংশ? যেটিকে পাঁচ-পাঁচটি বসন্তে গড়ে তুলেছিল সুদক্ষা জোগতি—পদাবলী কীর্তন গানে, কাব্যকথায়, নৃত্যভঙ্গিমার আত্মনিবেদনে? তা আছে অটুট। তা দেহাতীত প্রেম—তার যে মৃত্যু নাই। তা যে ‘নিকষিত হেম! কামগন্ধ নাহি তায়।’ তাই আজও সে খঞ্জনি বাজিয়ে গাইতে পারে—‘গায়ে দিয়ে হাত, মোর প্রাণনাথ অন্তরে বাঢ়ল সুখ!’ কিন্তু ‘গা’ বলতে করমুষ্টির শেষ সীমান্ত। আর একটু ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেই ওর অন্তরে জেগে ওঠে বিক্ষোভ, জঠরে বিবমিষা। কে জানে, হয়তো বরাতিরা সবাই এতদিনে জেনে ফেলেছে রহস্যটা। ঐ নির্যাতিতার করুণ ইতিহাস। ওর ঐ শম্বুকবৃত্তির নিদারুণ হেতুটা। ওরা তাকে করুণা করে। টানাটানি করে না। জানে, ঐ আখের ছিড়েটায় আর কোন রস-কষ নেই—যতই কেন না দৃষ্টিবিভ্রম হোক

আর সে জন্যই কর্তা-মশায়ের আশঙ্কা—আখড়ায় নতুন করে অনাচার প্রবেশ করেছে ঐ অপরূপার আগমন-মুহূর্ত থেকে। তাই সাহায্য চেয়েছেন ভেষগাচার্যের।

রোগনির্ণয় তো হল। কিন্তু নিরাময় হবে কী-ভাবে? এ রোগের কী চিকিৎসা?

.

রাত্রির তৃতীয় যাম। মাধবপক্ষ অনিবার্য নিয়মে চলেছে দোলপূর্ণিমার লক্ষ্যে। আজ শুক্লা একাদশী। নির্মেঘ আকাশে নিদ্রাহারা শশী। তার তির্যক আলো এসে পড়েছে মশারি-ফেলা নির্জনতায়। পাশে আশ্লেষশয়নে রতিক্লান্তা সীমন্তিনী—বিপ্রতীপ-রাধা। নিতান্ত ঘটনাচক্রে যে আখমাড়াই কলে যায়নি।

হয়তো রাধাবল্লভপুরের মন্দির-চাতালে চাঁদের দিকে তাকিয়ে জেগে বসে আছে বিপ্রতীপ-মঞ্জু!

ইতিপূর্বে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; মঞ্জুকে সব কথা খুলে বলবেন। রাধারানীর চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করলে তার পূর্বে মঞ্জরীর অনুমতি নেবেন। তাতে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কাটা কমবে কিন্তু এখন মতটা বদলে গেল। ফুল-পিসিমা ওকে ছাড়বেন না—একাকী তাঁকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে সেই সহজপন্থীদের আখড়ায়। সেখানে তিনি ঐ হতভাগিনীর কী-জাতের চিকিৎসা করলেন, আদৌ করলেন কি না, তা মঞ্জু কোনদিন জানতে পারবে না। জানবে—যেটুকু তিনি জানাবেন। কে জানে—সে চিকিৎসাটা কোন জাতের হবে শেষ পর্যন্ত। রাধারানীকে যদি নারীজীবনের স্বাভাবিকতার মালভূমিতে উত্তোলন করতে হয়, তাহলে হয়তো তাঁকেই সে-কাজ করতে হবে—ঠিক যেভাবে মৃন্ময়ীকে কোলপাঁজা করে তুলে নিয়েছিলেন ভূশয্যা থেকে ফুলশেযের ফুলেভরা শয্যায়। কিন্তু তারপর? কোথায় থামবেন? এবারেও কি উন্মোচন করে দিতে হবে ঐ মধ্যক্ষামার নীবিবন্ধ—যেমন করেছিলেন স্ফীতোদর মীনুর? কিন্তু সেবার সাক্ষী ছিল ধর্মপত্নীর চর্মচক্ষু। এবার? এবার তা করতে হবে—যদি সেই শেষ চিকিৎসাই করতে হয়—একান্ত নিভৃতে। হোক! তবু তা তাঁর ধর্মবোধের মর্মচক্ষুর সম্মুখে। নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায়—বুঝে নিতে ঐ অনিন্দ্যকান্তি রোগিণীর…

কিন্তু তা কি সম্ভব? তিনি তো মরমানুষ! ভেষবিদ্যায় সুস্পষ্ট নিষেধ আছে। মহামুনি চরক তা অনুমোদন করেন না—তৃতীয় ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে যুবতী নারীর দৈহিক পরীক্ষা। কিন্তু বিবেকের নির্দেশে তো চরককে ইতিপূর্বেও অস্বীকার করেছেন। এবারেও কেন করবেন না? শুধু কর্মেই তাঁর অধিকার—‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে’। ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত কর্ম। ফলের আকাঙ্ক্ষা নিশ্চয় করবেন—রোগিণীর রোগমুক্তি। সে কৃত্য শুধু পরস্মৈপদী ধাতুতে গড়া, আত্মনেপদী নয়। এ তো ঔষধ—ঐ হতভাগিনীর সেব্য। তাকে শুধু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বুঝিয়ে দিতে—দেহজ-মিলন মাত্রেই ক্লেদাক্ত নয়, কামবিকারের বহিঃপ্রকাশ নয়।

কিন্তু তা কি সম্ভব? কামবিকারগ্রস্তাকে তৃপ্তি দিতে হবে,নিজে কামতৃপ্ত না হয়ে। এ তো বাতুলের প্রলাপ! চরক ছাড়, এ তো স্বয়ং ঋষি বাৎস্যায়নেরও ধারণার বাহিরে। এক হাতে খঞ্জনি বাজে না। প্রথমের আঘাতে যদি দ্বিতীয়া স্পন্দিত হয়, তবে দ্বিতীয়ার প্রত্যাঘাতে প্রথমটিও বেপথুমান হতে বাধ্য। এ যে জাগতিক নিয়ম।

যদি হয়ই। তাতেই বা কী? সামাজিক বিধানে, নৈতিক নির্দেশে একমুখীন হবার দায় শুধু নারীর, পুরুষের নয়। মহান হিন্দুধর্মে ‘সতীত্ব’ শব্দটা একপক্ষের প্রতিই প্রযোজ্য। পুরুষের সে দায় নেই। ব্যতিক্রম যদি নিয়মের প্রতিষ্ঠাতা হয় তাহলে পঞ্চপতিপ্রিয়া পাঞ্চালী প্রতিষ্ঠা করেছেন এই মত, হিন্দু ভারতে। কাতুর পরমপতি যে কত শত রমণীকে শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে লাভ করেছে তা তার নিজেরই স্মরণ নেই। সমাজ তাতে দোষ ধরে না, কাতুর সে বাবদ কোন ক্ষোভও নেই। তাহলে মঞ্জুই বা অভিমান করবে কেন, যদি খঞ্জনির দুটি পাটিই সমানতালে বাজে? যে-হেতু তার পূর্বে রূপেন্দ্র কিছু অংবং মন্ত্র উচ্চারণ করেননি?

কে বলে দেবে? কোন শাস্ত্রে আছে এর বিধান?

স্পষ্ট শুনতে পেলেন অন্তরের অন্তস্তল থেকে প্রত্যুত্তর :

—তোমার বিবেক! ‘আত্মদীপো ভব! আত্মশরণ ভব! অনন্যশরণ ভব!’

যা অসম্ভব, যা অবাস্তব, যা হয় না—তাই তাঁর লক্ষ্য! কামকলায় তৃপ্ত করতে হবে সেই অনিন্দ্যকান্তিকে—নিজে অনাসক্ত থেকে

কী যেন গানের কলিটা গেয়েছিল সেই বাউল?

: আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভিজাবো না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *