তীর্থের পথে – ১৪

১৪

শ্রীভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায় মাহেশ-এর একজন বিখ্যাত বাসিন্দা। বোধ করি সর্ববিখ্যাত। ধনে মানে, প্রতিপত্তিতে। তিনি হচ্ছেন ফরাসডাঙার প্রখ্যাত দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর প্রধান নায়েব। ইন্দ্রনারায়ণ সমগ্র রাঢ়খণ্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, রানী ভবানী অথবা বর্ধমানরাজের অপেক্ষা অর্থকৌলীন্যে বোধহয় ন্যূন নন। সেই ইন্দ্রনারায়ণের দক্ষিণহস্ত ইচ্ছা করলে হাতে মাথা কাটতে পারতেন। বোধকরি কাটতেন না—জল্লাদেরা নিষ্কর্মা হয়ে যাবে আশঙ্কায়।

ইন্দ্রনারায়ণ যেমন দুপ্লেক্সের[১] দক্ষিণহস্ত, ভবতারণও তেমনি দেওয়ানজীর দক্ষিণহস্ত সপ্তাহে পাঁচদিন থাকেন ফরাসডাঙ্গায়, দেড় দিন মাহেশ-এ। প্রতি সপ্তাহান্তে আসেন শনিবার সন্ধ্যায়, ফিরে যান সোমবার প্রত্যুষে। হেতুটি মর্মান্তিক—তাঁর গৃহিণী, মঞ্জুর ফুলপিসিমাতা-ঠাকুরাণী সেই ফেরঙ্গদেশে বসবাস করতে অস্বীকৃতা। কৌতুককর সংবাদটি হচ্ছে এই—ভবতারণ শনিবার অপরাহ্ণে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে সর্বপ্রথমেই ‘বার-মহলে’র একটি স্নানাগারে গঙ্গাজলে স্নানপর্ব সারেন। কী গ্রীষ্ম কী শীত! পট্ট বস্ত্র পরিধান করে গৃহে প্রবেশের ছাড়পত্র পান। ম্লেচ্ছদেশের অনাচার তাঁর ভদ্রাসনে বরদাস্ত করেন না মাতঙ্গীদেবী এবং নিভাননী। ভবতারণের দুই পত্নী। শনি-রবি তিনি ভিন্ন-ভিন্ন শয়নকক্ষে নিশাযাপন করে সোমবার প্রত্যুষে পাল্কি-চেপে ফরাসডাঙ্গায় ফিরে যান।

[১. প্রায় সমকালীন এই বিদেশী ভদ্রলোক ফরাসী-চন্দননগরের গভর্নর-জেনারেল হয়েছিলেন 1744 খ্রীষ্টাব্দে। অর্থাৎ আমাদের কাহিনীকালের দুই বৎসর পরে। কিন্তু ঐ অসাধারণ চরিত্রটিকে সেই অপরাধে এড়িয়ে যেতে মন সরল না। ইতিহাস তথা আপনাদের কাছে এই সজ্ঞান-অ্যানাক্ৰনিজম্-এর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।]

নবদম্পতির আদর-আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি হল না। পরিচয়মাত্র ওঁরা সাড়ম্বরে অভ্যর্থনা শুরু করলেন। সেদিন রবিবার—নিতান্ত ঘটনাচক্রে গাঙ্গুলীমশাই ভদ্রাসনে উপস্থিত। কিন্তু ঐ—গাঙ্গুলী-মশাই বিধাতার মতো অনুদার, ব্যাধের মতো উদার নন! মঞ্জরীকে পুরললনার দল টেনে নিয়ে গেল অন্দরমহলে, আর রূপেন্দ্র ‘বার-মহলে’ খাতিরযত্ন পেতে থাকেন। ‘বড় দুখে সুখলাভের সম্ভাবনা রইল না।

ভিতর-মহল থেকে কিছু ক্রন্দনরোলও কর্ণগোচর হল। ও কিছু নয়—শোনা গেল বর্গী হাঙ্গামার সময় মঞ্জুর খুড়োমশাই নিহত হয়েছেন। তাঁর পত্নী পুত্রকন্যাদের হাত ধরে বাপের বাড়ি চলে গেছেন। সংবাদ শ্রবণে রূপেন্দ্রনাথ অধোবদনে ব্যথিত মুখভঙ্গি করে নীরব রইলেন। যে পূজ্যপাদ খুড়াশ্বশুর রূপেন্দ্রর ধর্মপত্নীকে কুমারী অবস্থায় মোহান্ত মহারাজের লীলাকুঞ্জে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁর এবম্বিধ অকালমৃত্যুতে সত্যই তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়নি; কিন্তু সৌজন্যের নির্দেশে তাঁকে শোকাভিভূত হবার অভিনয় করতে হল।

জলযোগের পালা মিটলে রূপেন্দ্রনাথ সবিনয়ে আর্জিটা পেশ করলেন তাঁর পিসাশ্বশুরের কাছে : এবার অনুগ্রহ করে ওঁকে ডেকে দিন। আমাদের অনেকটা পথ ফিরে যেতে হবে। পিসাশ্বশুর বলেন, সে কী বাবাজী! তা কী হয়? তোমরা এলে, কদিন থাক, বিশ্রাম নাও। তারপর তীর্থভ্রমণে যেও। সামনেই দোলযাত্রা—তার পূর্বে কি তোমার শাশুড়ী-ঠাকরুণ ছেড়ে দেবেন ভেবেছ?

দেখা গেল গাঙ্গুলীমশায়ের আশঙ্কা অমূলক নয়। সংবাদটা অন্দরমহলে প্রেরণ করার অনতিকাল পরেই একটি অবগুণ্ঠনবতী এসে বড়কর্তার কাছে নিবেদন করল, জামাইবাবুকে ওঁরা ভিতরে ডাকছেন।

—ঐ দেখ! ডাক এসে গেছে। যাও গিয়ে শোন ওদের বক্তব্য।

অবগুণ্ঠনবতীর পিছন পিছন অনেকটা পথ যেতে হল। দুই মহলের মাঝখানে যে বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ তাতে হা-ডু-ডু খেলা যায়। অন্দরমহলের সীমানায় পৌঁছানো মাত্র রূপেন্দ্রর অবস্থা হল সপ্তরথীবেষ্টিত অভিমন্যুর মতো, অথবা তার বাপের, প্রমীলা রাজ্যে পদার্পণের পরে। দুই পিসিমা—একটি নকল, তখনো তাঁদের ঠিকমতো চিনে ওঠা যায়নি, তদুপরি তাঁদের দুই জা, তিন ননদ, পুত্রবধূ—সর্বোপরি রূপেন্দ্রের দুই শ্যালিকা! সে এক সুন্দরীদের হাট। কে যে প্রণম্যা আর কার প্রণাম গ্রহণ করতে হবে ঠাওর হয় না।

যাহোক, শিষ্টাচার অবসানে মাতঙ্গী—এতক্ষণে তাঁকে ফুলপিসিমা বলে চিহ্নিত করা গেছে—বললেন, এ কী শুনছি বাবা রূপেন্দ্র! মেয়েটা অ্যাদ্দিন পরে বাপের বাড়ি এল…

রূপেন্দ্র তখন সে প্রমীলারাজ্যে সকলকেই দেখছেন, অথচ যেন ‘কাউকেই’ দেখতে পাচ্ছেন না—অর্থাৎ যার সুবাদে এ রাজ্যে প্রবেশ। তিনি বোধহয় অন্তরাল থেকে মজা দেখছেন। অনেক কথাবার্তার পর স্থির হল, রবিবারের রাতটা দুজনকে মাহেশে কাটাতে হবে। পরদিন রূপেন্দ্র একলাই প্রত্যাবর্তন করবেন রাধাবল্লভপুরে। সহযাত্রীদের যা বলার আছে বলে আবার ফিরে আসবেন। দোল পূর্ণিমা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। তারপর এই মাহেশকে ঘাঁটি করে ওঁরা দুজনে ভাগীরথীর দুই তীরে তীর্থ পরিক্রমা করবেন।

মঞ্জুর পিসতুতো বোন—প্রায় সমবয়সী—রূপেন্দ্রকে কানে কানে বলে গেল, জামাইবাবু যে ভয় পাচ্ছেন তা অমূলক। এটা আপনার শ্বশুরবাড়ি, বর্ধমান নয়।

রূপেন্দ্র বলেন, মানে?

বলেই মনে মনে জিব কাটেন। তুলসী সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। বললে, এই সরল কথাটার মানেও বলে দিতে হবে? তবে আপনি কেমনতর দিগ্‌গজ পণ্ডিত? মানে হচ্ছে—এখানে ‘চখা ওপারে চখী এপারে’ হবে না?

রূপেন্দ্র শ্যালিকার কানবালা-শোভিত প্রত্যঙ্গের নাগাল পাওয়ার আগেই সে হাওয়া। বোঝা গেল, মঞ্জু ইতিমধ্যেই বোনকে জানিয়েছে বর্ধমানে কীভাবে নাকাল হতে হয়েছিল।

গুরুপাক নৈশ-ভোজনের পর তুলসী প্রতিশ্রুতি মতো রূপেন্দ্রকে পৌঁছে দিল তাঁর শয়নকক্ষে। বিরাট পালঙ্কে মশারি-ফেলা নির্জনতায় হারানো মানিক ফিরে পেলেন। দীর্ঘদিন পরে পাওয়া গেল ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতার সুযোগ।

এ অধম কথাশিল্পীও ভারতচন্দ্রের গুণগ্রাহী; কিন্তু তার মানে এ নয় যে, তাঁকে প্রতিপদেই অনুসরণ করতে হবে। অনেক কষ্টে সিঁদ কেটে আমাদের সুন্দর নায়ক এতদিনে বিদ্যালাভ করেছেন; তার পরের একদণ্ডের ঘটনাচক্র অনুমান-নির্ভরই থাক না বাপু! এস, আমরা বরং বিরহতাপ-জর্জরিত সেই মিলন রাত্রির বর্ণনা ঘণ্টাখানেক পর থেকে শুরু করি :

রাধারানীর প্রসঙ্গ উত্থাপনমাত্র মঞ্জু বলে ওঠে, দিদি বড়ই দুখিনি! হ্যাঁ গো—শাস্তরে কোন বিধান-টিধান নেই? রহিমকে শুদ্ধি করে নেওয়া যায় না?

রূপেন্দ্র বলেন, রহিম! রহিম আবার কে?

—বাঃ! যার জন্যে রাধাদির আজ এই আতান্তরি। রহিম ওস্তাগর।

রূপেন্দ্র আকাশ থেকে পড়েন।

দেখা গেল—রাধা আর মঞ্জরী এই কয়দিনের সান্নিধ্যে খুবই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে। মঞ্জু তাকে খুলে বলেছে তার সব কথা, সব কথা। বাল্য, কৈশোর, প্রথম যৌবনের সেই বিভীষিকাময়ী দিনগুলোর কথা; তারপর তার মূর্ছারোগ, গো-গাড়ি চেপে সোঞাই আসা। শেষমেষ ভিষগাচার্যের হাত থেকে প্রথমে গরল ও পরে অমৃতলাভ! এমনকি ফুলশয্যা রাত্রের সেই বিড়ম্বনার কথাও। অপরপক্ষে রাধারানীও নির্বিচারে মেলে ধরেছে তার ইতিহাস। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলেছে তার সব কথা, সব কথা!

এমনটা বোধহয় হয়। রাধারানী ঐ মঞ্জুর ভিতর আবিষ্কার করেছে এক ‘বিপ্রতীপ-রাধা’কে। শুরুটা দুজনেরই এক! ঘটনাচক্রে শেষটা ভিন্ন রকম! হয়তো হতভাগিনীর অবচেতন মনে জেগেছে প্রশ্নটা : মূর্ছা রোগটা তো তারও হতে পারত! দু-বছর আগে। তাহলে হয়তো রাধাই গো-গাড়ি চেপে রওনা হত সোঞাইমুখো—ঐ আগুনবরণ ছেলেটার হাত থেকে তাহলে রাধাই প্রথমে গরল আর পরে অমৃতভাণ্ড লাভ করত!

মানুষ যা চায় তা পায় না। যা পায় তা চায় না—ভুল করে পায়! এই চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়ার নামই দুনিয়াদারী। যাকে ঐ রবি-বাউল বলেছেন, ঘড়া ঘড়া অশ্রু ঢেলে মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে হয়। তারপর “মনেরে আজ কহ যে/ভালমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।”

কিন্তু অমৃততিয়াসী কি পারে নীলকণ্ঠ শিবের মতো হলাহল পান করতে—‘সহজে?’

অন্তত রাধা তা পারেনি। রাধারানীর অতীত জীবনের চুম্বকসারটা এই জাতের :

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *