তীর্থের পথে – ১৩

১৩

কর্তামশায়ের সব সংশয় ঘুচে গেছে। দামোদরের অকাল বন্যা আর ‘নলগিরিদমনের’ উপাখ্যানটি ধন্বন্তরি মেনে নেননি, বারে বারে প্রতিবাদ করে বলেছেন—এসব গালগল্প; কিন্তু হরিপালের ঘটনাটি যে ওঁর প্রত্যক্ষজ্ঞানে লব্ধ। কুসুমমঞ্জরী আর রাধারানীকে নানানভাবে জেরা করে সম্পূর্ণ তথ্যটি তিনি সংগ্রহ করেছেন। বুঝতে পেরেছেন—সেই পুরোহিত কী উদ্দেশ্যে নবদম্পতির ললাটে রক্ততিলক এঁকে দিয়েছিলেন, কাংস্যবাদক বালকটি কেন কুসুমের আঁচল ধরে টেনেছিল, আর সেই বৃদ্ধ ঘোষালমশাই হঠাৎ কেন পিছিয়ে গেছিলেন পুরোহিতের ধমক শুনে : “শুনছেন না, উনি “ মায়ের আহ্বান শুনে এসেছেন!

সিদ্ধপুরুষ না হলে, শাপভ্রষ্ট দেবতা না হলে, রূপেন্দ্রনাথ যখন প্রণিধান করলেন যে, শ্মশানকালী শবাসন ত্যাগ করে শ্মশানে নেচে বেড়াচ্ছেন তখনই তাঁর সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ার কথা। পরদিন প্রভাতে মায়ের ওষ্ঠপ্রান্তে তাহলে দেখা যেত কুসুমমঞ্জরীর অঞ্চলপ্রান্তে অনুবিদ্ধ কুঞ্চিকাটি! কিন্তু রূপেন্দ্রনাথ সংজ্ঞাহীন তো হলেনই না, উল্টে ডাকাতে-কালীকে ভর্ৎসনা করে শুনিয়ে দিলেন আদ্যাশক্তির প্রকৃত স্বরূপ কীরকম হওয়া উচিত। ভর্ৎসিতা শ্মশানকালী ভক্তের তিরস্কারে সলজ্জে ফিরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর নির্দিষ্ট শবাসনে—হ্যাঁ, সলজ্জে জিহ্বা দংশন করে।

ভেষগাচার্য—সন্দেহাতীতরূপে সিদ্ধ-পুরুষ।

তাই সুযোগ মতো তাঁর কাছে পেশ করেছেন তাঁর বর্তমান সমস্যাটি। ঐ সিদ্ধপুরুষের সমাধানটিই তিনি নির্বিচারে মেনে নেবেন।

শীতল-রুক্মিণী বিতাড়নের পর কয়েক বৎসর আখড়ায় দিন নির্বিঘ্নে কেটে যাচ্ছিল। গুরুবাক্য মেনে আশ্রমিকেরা দিনে উপাসনা, নামগান, ভিক্ষা করে; রাতে শাস্ত্রোক্ত বিধি-নির্দেশে কৈবল্যানন্দের সন্ধান করে। চান্দ্রায়ণ-ব্রত উদ্যাপনের পর বৃদ্ধও ফিরে পেয়েছিলেন মানসিক শান্তি। শীতলদম্পতির কী হল, তারা কোথায় আশ্রয় পেল, সে-সব খবর পাননি। রাসের সময় আখড়ায় নানান যাত্রীসমাগম হয়। ঐ একটি দিন সর্বসাধারণের জন্য আখড়া উন্মুক্তদ্বার। রাসলীলায় নানান উৎসব। কাঞ্চনমূল্যে খিচুড়িভোগ সেবা করতে পারে বহিরাগতরা। রাত্রি সমাগমে তারা ফিরে যায় নাম-গান শুনে। কিছু বিত্তশালী ভক্ত বিশেষ অনুমতিতে—সেটিও কাঞ্চনমূল্যে কিনা জানা যায় না—রাত্রিবাসের অনুমতি লাভ করেন। এসকল তথ্য শীতল-রুক্মিণীর যে না-জানা তাও নয়, তবু তারা রাসোৎসবে কোনবার ফিরে আসেনি। আশ্রমিকেরাও, অন্তত কর্তামশায়ের সামনে তাদের নামোচ্চারণ করেনি।

নতুন করে মুশকিল হল আড়ায় রাধারানী যোগদান করার পরে

তাকে সাদরেই গ্রহণ করেছিলেন কর্তামশাই। এ তো রীতিমতো সৌভাগ্য। রাধারানী প্রাক্তন রাইরানী। যৌবনবতী—রীতিমতো সুন্দরী। বরাতিরাও উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। শুনেছিলেন মেয়েটির করুণ কাহিনী—যেটুকু সে বিবৃত করেছে, শুধু সেইটুকুই। বিস্তারিত জানেন না। সে প্রশ্নে এককথায় ছেদ টেনে দিয়েছিল রাধা : আমি ঐ বিধ্বস্ত রূপনগরের প্রাক্তন রাইরানী। এক বৎসর মোহন্ত মহারাজের সেবা করেছি, পরে বহু-পরিচর্যাও করতে হয়েছে। এর বেশি আর কিছু বলার নেই আমার। যদি আশ্রয় না দিতে পারেন খোলাখুলি বলে দিন।

কর্তামশাই আশ্রয় দিয়েছিলেন।

তারপর এই কয়মাসে তিনি তিল তিল করে প্রণিধান করেছেন, কাজটা ভাল হয়নি। কেন, কী বৃত্তান্ত—তা ঠিক জানেন না। বুঝতে পারছেন না। এ যেন এক ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি। শুধু ঐ মেয়েটি একাই নয়, আশ্রমিক বরাতি এবং তাদের সঙ্গিনীরাও গোপনে আশ্রমিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করছে বলে আশঙ্কা হয়। পূর্ববার হেতুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন—শীতল-রুক্মিণী ছিল স্বামী-স্ত্রী; তারা সংস্কারমুক্ত হতে পারেনি। যে কোন হেতুতেই হোক, আশ্রমিকেরা গোপনে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু এবার রাধা তো একাকিনী। আশ্রমিকদের মধ্যে কোন একটি বিশেষ পুরুষের প্রতি কি সে আসক্তা? ঐ কমলকুমার? তাহলে সেটা আর সবাই কেন মেনে নেবে?

কেন তাদের ঈর্ষা হবে না? এবার আর সরেজমিনে তদন্ত করার ভরসা পাননি। গতবারের তিক্ত অভিজ্ঞতাটা স্মরণে থাকায়। আদ্যোপান্ত সমস্যাটা তিনি জ্ঞাপন করলেন রূপেন্দ্রনাথকে। তাঁর উপদেশ চাইলেন।

রূপেন্দ্র স্বতই বিব্রত বোধ করেন। বলেন, এ ক্ষেত্রে আমি কী করতে পারি? আমি বহিরাগত। দু-এক দিনের ভিতরেই আমাদের সম্পর্কের ছেদ হবে।

কর্তামশাই ওঁর হাত দুটি ধরে বলেছিলেন, আপনি শুধু বহিরাগত নন, আপনি একজন শাপভ্রষ্ট সিদ্ধপুরুষ…

রূপেন্দ্র প্রায় গর্জন করে ওঠেন, না! তা যে আমি নই, তা তো বারে বারেই বলছি।

—তাই সই! স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু আপনি ভেষগাচার্য! আমাদের আশ্রম ব্যাধিগ্রস্ত। আপনি চিকিৎসাই করুন।

রূপেন্দ্র বললেন, বেশ। আমি চেষ্টা করে দেখব।

তাঁর মনে হল, যে কোন কারণেই হোক ঐ প্রগলভা মেয়েটি তাঁকে কিছু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছে। হয়তো যে-কথা সে কর্তা-মশাইকে বলেনি, সে-কথা তাঁকে জানাতে পারে। হয়তো তিনি তাঁর শিক্ষায়, তাঁর বিদ্যায় একটা সমাধানের নাগাল পাবেন, যা ঐ মেয়েটি নিজে খুঁজে পাচ্ছে না। হতে পারে—ঐ মেয়েটি কোনও মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে, অথচ সে তা জানে না। ঠিক যেমন বর্ধমানে ঘটেছিল।

কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বিরাট অন্তরায়ও আছে। হরিপালের সেই রাত্রির শেষপ্রহরে রাধারানীর আচরণ এক বিশেষ ইঙ্গিতবাহী—সেটা যে শুধু তার চারিত্রিক প্রগলভতার প্রভাবে তা মনে হয়নি। তিনি নিজে অবিচলিত, একনিষ্ঠ আছেন, কিন্তু ও-পক্ষও কি তাই? রাধা বলেছিল, ‘কে-কোথায় দেখবে আর ভুল বুঝবে।’

রাধা যদি অন্তরের কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর পক্ষে চিকিৎসা করতে যাওয়ার মধ্যে বিপদ আছে। অবিবাহিত হলে তিনি নিঃসঙ্কোচে এ দায়িত্ব নিতে পারতেন; কিন্তু মঞ্জু যদি ওঁকে ভুল বোঝে?

বিবেকের নির্দেশে চলেন তিনি। স্থির করলেন, এ কাজের ভালমন্দ, আশঙ্কা ও লাভের কথাটা মঞ্জুর সঙ্গে প্রথমে খোলাখুলি আলোচনা করে নেবেন। তাতে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কাটা কমবে। কিন্তু নির্জনে মঞ্জুর সঙ্গে দুটো কথা বলার অবকাশই যে পাচ্ছেন না। বস্তুত সোঞাই গ্রাম থেকে রওনা হবার পর, বর্ধমানে উপনীত হবার পর তাঁর সঙ্গিনীটির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য বারেকের তরেও পাননি। বর্ধমানে বাস করতে হয়েছিল পৃথক কক্ষে, এখানেও প্ৰায় তাই। শ্মশানকালীর মন্দির চাতালের সে বীভৎস রাত্রিটা তো হিসাবের বাইরে।

সুযোগ হয়ে গেল অপ্রত্যাশিতভাবে। মঞ্জু ওঁকে বললে, আচ্ছা মাহেশ গ্রামটা এখান থেকে কাছাকাছি নয়?

—হ্যাঁ, পাশের গ্রাম। কেন বল তো?

কুসুমমঞ্জরী কারণটা জানায়। তার মনে আছে যে, তার এক পিসিমার বিবাহ হয়েছে ঐ মাহেশ গাঁয়ে। তাঁকে ও ডাকত ফুলপিসি। তাঁর স্বামীর নামটাও মনে আছে—ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায়। তবে সেটা হুগলী জেলার ‘মাহেশ’ গ্রাম কিনা, ঠিক জানে না।

রূপেন্দ্র বললেন, খোঁজ করে দেখতে দোষ কী? এত কাছাকাছি যখন এসেই পড়েছি। সত্য হলে তুমি হয় তো অনেক খবর পাবে।

দলটি যাত্রীশালায় তিন দিন থাকবে। স্থির করলেন, পরদিন ওঁরা দুজন মাহেশ গ্রামে গিয়ে গাঙ্গুলীমশায়ের তল্লাশ করবেন। যদি তাঁর দেখা না-ও পান তবু মাহেশ গ্রামটাতো দেখা হবে।

কর্তা-মশাই বললেন, মাহেশ থেকে ঘুরে আসতে আপনাদের পাঁচ-ছয় দণ্ড লাগবে। অপরাহ্ণেই ফিরে আসতে পারবেন।

রূপেন্দ্র বলেন, কিন্তু তাঁদের সাক্ষাৎ যদি পাই, আর তাঁরা যদি পীড়াপীড়ি করেন তাহলে হয়তো দু-এক রাত তাঁদের বাড়িতেই থেকে যাব। সুতরাং বিকালে আমরা ফিরে না এলে ব্যস্ত হবেন না।

—কিন্তু মনে আছে তো, পশুর পরদিন আমরা ত্রিবেণীঘাটে চলে যাব?

—আছে বৈকি। তার আগে আমি নিশ্চয় ফিরে আসব। সস্ত্রীক যদি নাও হয় তবে একাই। এরকমই স্থির হয়েছে। কর্তামশাই এরপর সদলবলে ত্রিবেণী চলে যাবেন। সেটাই তাঁদের যাত্রাপথের শেষ লক্ষ্য। অপরপক্ষে রূপেন্দ্রের ইচ্ছা ভাগীরথীর উভয় তীরে কিছু তীর্থদর্শন সেরে সস্ত্রীক যাবেন ত্রিবেণী। যদি সেখানে সাক্ষাৎ না হয় তাই দু-পক্ষই তাঁদের আদি-নিবাসের পাকা-ঠিকানা বিনিময় করে রেখেছেন। সহজিয়া পন্থীদের মূল ঘাঁটি কেন্দুবিশ্বের কাছাকাছি—কদমখণ্ডী-ঘাটের ক্রোশ-খানেক পশ্চিমে। কর্তামশাই ওঁকে বিশেষ করে নিমন্ত্রণ করে রেখেছেন রাসপূর্ণিমায় তাঁর আখড়ায় আসতে। তখনই বার্ষিক মহোৎসব।

কর্তামশায়ের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে পিছন ফিরতেই নজর হল অদূরে রাধারানী একা বসে প্রভাতী তিলকসেবা করছে। তার স্নান সারা। চুল শোকায়নি, তাই ধম্মিল্ল বাঁধা হয়নি এখনো। সমুখে ধাতব দর্পণ। ললাটে রসকলির আলিম্পন রচনায় ব্যস্ত। কথাবার্তা সবই শুনেছে। হঠাৎ ডাক দিল, এদিকে একটু আসবেন, গোঁসাইঠাকুর।

রূপেন্দ্র সেদিকে এগিয়ে যান। রাধা একটি পশমের আসন এগিয়ে দিয়ে বলে, বসুন, জপতপ হয়েছে?

—হয়েছে, কিন্তু আমি সমুখে বসে থাকলে তোমার প্রসাধনে ব্যাঘাত হবে না তো কিছু? রাধা মুচকি হেসে বলে, একে ‘প্রসাধন’ বলে না, গোঁসাই। এ হল ‘শৃঙ্গার’–’রস’-এর কথা কিছু জানা আছে? ‘দাস্য সখ্য বাৎসল্য শৃঙ্গার চারি রস/চারিভাবে ভক্ত যত কৃষ্ণ তার বশ!’

রূপেন্দ্র বলেন, আমি বেরসিক—‘রস’-এর কথা কী জানি? আমি তো বুঝি : ‘পুং স্ত্রিয়াং স্ক্রিয়াঃ পুংসি সম্ভোগং প্রতি যা স্পৃহা/সা শৃঙ্গার ইতি খ্যাতো রতিক্রীড়াদিকারণম্।।’

অপাঙ্গে দৃষ্টি হেনে রাধা জানতে চায়, তার মানেটা কী হল, ঠাকুর?

—অমরকোষ বলছেন, ‘স্ত্রীলোকের প্রতি পুরুষের এবং পুরুষের প্রতি স্ত্রীলোকের সম্ভোগকামনায় যা কৃত্য, সেই রতিক্রীড়ার উদ্যোগপর্বের নাম শৃঙ্গার’। প্রসাধনও অবশ্য তাই। তবে প্রসাধন নিতান্তই জাগতিক ব্যাপার, ‘শৃঙ্গার’-এর সঙ্গে মিশে আছে কিছু আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা—এই যা!

রাধা কপট তাড়না করে, আপনাকে পণ্ডিত্যেমো করতে হবে না। মঞ্জু কোথায়? তাকে দেখছি না যে?

—ঘাটে গেছে। স্নান করতে। আমরা দুজন একটু পরেই মাহেশে চলে যাব।

—শুনেছি! তাহলে বস দিকি শান্ত হয়ে। এই নাও, খাও! এখনো গরম আছে। খুঞ্চিপোষের আবরণ সরিয়ে সে বাল্যভোগের প্রসাদপাত্রটি এগিয়ে দেয়। তাতে কিছু কাটা ফল, আখের গুড় আর দুখানি সেই অপূর্ব পিষ্টক : রাধাবল্লভী। রাধা জানায়, আর সকলের সেবা হয়েছে; শুধু ওদের তিনজনেরটা পৃথক রাখা ছিল।

রূপেন্দ্র প্রসাদের পাত্রটা ললাটে স্পর্শ করিয়ে আহারে প্রবৃত্ত হলেন। বলেন, শুনেছি তোমাদের কানুনে পুরুষ ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’–র নৈকট্যে নেমে আসে রাতের বেলায়। আজ দেখছি এক শৃঙ্গাররতা সে কানুন দিনের বেলাতেও মানছেন না। হেতুটা কী? ঐ ‘তাহলে? .

—‘তাহলে’! মানে?

—একটু আগে তুমি বললে না : ‘তাহলে বস দিকি শান্ত হয়ে’–যখন আমি বললাম মঞ্জু স্নানে গেছে।

রাধা মুখ টিপে হাসল। অপাঙ্গে আবার দেখে নিল। বললে, আখড়ার সে কানুনটা শুধু ভদ্দরলোকের জন্য। চোরকে আবার ‘আপনি’ বলে কে?

—চোর! চোর আবার কোথায় পেলে তুমি?

রাধা তার প্রসাধনী সরঞ্জাম সরিয়ে রেখে ঝোলার মধ্যে হাতড়াতে থাকে। বার করে আনে তার খঞ্জনী-জোড়া। কোথাও কিছু নেই ঠুনঠুন করে তান ধরে :

“ললিতা কহয়ে শুনহ হরি।
দেখে শুনে আর রহিতে নারি।।
শুন শুন ওহে রসিকরাজ।
এই কি তোমার উচিত কাজ?
উচিত কহিতে কাহার ডর।
কিবা সে আপন কিবা সে পর।।

রূপেন্দ্রের আহার কার্য বন্ধ হয়েছে। ইতি-উতি তাকিয়ে দেখেন। শ্রুতিসীমার মধ্যে আছে অনেক বরাতি। তারা যে-যার তালে মগ্নচৈতন্য। বৈষ্ণবী খেয়াল-বেখেয়ালে খঞ্জনী বাজিয়ে তান ধরে; এতে ওরা অভ্যস্ত। অবাক হয় না। পদকর্তার বিশেষ পদ চয়ন করে যে মনের ভাব তির্যকরূপে প্রকাশ করা যায় তা ওদের ধারণার বাইরে। গান—গান! মোট কথা, কেউ ফিরেও চাইল না। রাধা দ্বিজ চণ্ডীদাসের জবানীতে এগিয়ে চলে :

“শিশুকাল হইতে স্বভাব চুরি।
সে কি পারে রহিতে ধৈর্য ধরি।।
এক ঘরে যদি না পোষে তায়।
ঘরে ঘরে ফিরে পায় কি না পায়।
সোনা-লোহা-তামা পিতল কি বাছে?
চোরের কি কখনো নিবৃত্তি আছে।।”

সুললিত কণ্ঠ। দরদ দিয়ে গাইছে। রূপেন্দ্র মুগ্ধ, তবু তাঁর ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় সজাগ। বৈষ্ণবী তার মোহজাল বিস্তার করতে চাইছে। পরকীয়া-প্রেম ওদের রক্তে। মঞ্জুর অনুপস্থিতেই শৃঙ্গাররতার এই প্রগলভতা। দ্বিজ চণ্ডীদাসের ঐ বিশেষ পদটি চয়নের মধ্যে একটা তির্যক ইঙ্গিত প্ৰচ্ছন্ন। ওঁর ভিষ-সত্তাকে বারে বারে হুঁশিয়ারী জানাচ্ছে তাঁর সাবধানী মন। ঐ বিলোল কটাক্ষ, এই হঠাৎ ‘তুমি’ সম্বোধন, ঐ ‘এক ঘরে যদি না পোষে তায়’-এর প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত—সবই একটিমাত্র অর্থবহ। বৈষ্ণবী নিজে মজেছে, এখন ওঁকে মজাতে চাইছে। এ পদাবলীর আকৃতি নৈর্ব্যক্তিক নয়, ঈশ্বরমুখীও নয়। অন্তরের একটা সাবধানী অংশ ওঁকে বলছে—ঐ প্রগলভাকে নিবৃত্ত করতে, আর সত্যানুসন্ধানী ভিষগ-সত্তা বলছে—তাতে ইন্ধন জোগাতে। তাহলেই বোঝা যাবে ওর অন্তরের জটিলতাটা কী জাতীয়। কেন তাকে কর্তা-মশাই মনে করছেন মানসিক ব্যাধিগ্রস্তা। আত্মবিশ্বাসে সুদৃঢ় না হলে তিনি কিছুতেই পরবর্তী রসিকতাটা করতে পারতেন না, তুমি আমাকে একটা সাধারণ চোর ঠাওরালে, রাধারানী?

—সাধারণ? না গোঁসাই। তুমি নিজেই ভাল জান : তুমি অসাধারণ! না হলে কি আমার দিন-রাত এমন একাকার হয়ে যেতে পারে? শোন, ঠাকুর—গান শোন :

আবার ঠুনঠুন করে বেজে ওঠে ওর খঞ্জনী :

“ঘর কৈনু বাহির
বাহির কৈনু ঘর,
পর কৈনু আপন
আপন কৈনু পর।
রাতি কৈনু দিবস
দিবস কৈনু রাতি,
বুঝিতে নারিনু সখি,
তোমার পিরীতি।।”

রূপেন্দ্র সিদ্ধান্তে এলেন। কর্তামশায়ের আশঙ্কা অমূলক—কমলকুমার নয়। ওর অন্তঃকরণ এতদিন ‘মনের মানুষ’ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সেও একমুখী প্রেমের কাঙাল—সর্বপুরুষে পরমপুরুষকে দেখতে পেত না এতদিন। আজ হয়তো পেয়েছে! পরশমণির সন্ধান!

এখন কোন পথে অগ্রসর হবেন? যা জানার ছিল বোধকরি জেনেছেন। আরও অগ্রসর হওয়া বিপদজনক! যা প্রাণে-প্রাণে বলার মেয়েটি তা গানে-গানে বলেছে। কী বলবেন, কী করবেন স্থির করে উঠতে পারেন না। হঠাৎ রাধারানীর একটি কথায় আবার সংযম হারালেন। ওঁর দিকে ফিরে মেয়েটি হেসে বলেছিল, ভুল বুঝ না গোঁসাই ঠাকুর। আমি তোমার ঘর ভাঙতে চাইছি না। তবে এ গান না গেয়ে শান্তিও পাচ্ছিলাম না। হয়তো তুমি বুঝলে, নয় তো বুঝলে না—তা হোক, আমার বুকের পাষাণভারটা তো নেমে গেল। ঐ কথাটাতেই সান্ত্বনা খুঁজব, ‘বুঝ লোক, যে জান সন্ধান।”

রূপেন্দ্র আত্মবিস্মৃত হয়ে ওর হাতখানি তুলে নিলেন নিজের মুঠোয়। অবাক হয়ে বলেন, কী বললে? ‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান।’ এ উদ্ধৃতি তুমি কোথায় পেলে রাধা?

—এঁর কথা তুমি জান না ঠাকুর। এ তোমার অমরকোষ নয়, এ কোন পদকর্তার লেখা গানও নয়। এ এক অখ্যাত আশ্চর্য কবির রচনা। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর।

—জানি, জানি! কিন্তু তুমি তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ কোথায় পেলে? ঐ পংক্তিটা তো মাত্র ছয় মাস পূর্বের রচনা।

রাধা অবাক হয়। কিন্তু তার মন তখন অন্যদিকে। রূপেন্দ্রের মুঠিতে তখনো বন্দিনী হয়ে আছে তার করপল্লব। সে দিকে তাকিয়ে ফের গুনগুনিয়ে ওঠে। এবার খালি গলায় :

“গায়ে দিয়ে হাত    মোর প্রাণনাথ
অন্তরে বাঢ়ল সুখ।
হাসিয়া কাঁদিয়া     আঁখি প্ৰকাশিয়া
দেখিনু বঁধুর মুখ।।”

রূপেন্দ্র সলজ্জে ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলেন, কই, বললে না? এ কাব্য কোথায় পড়েছ? দুজনের কেউই লক্ষ্য করেননি—অদূরে এসে দাঁড়িয়েছে কুসুমমঞ্জরী। পুকুরঘাট থেকে সিক্তবসনে ফিরে আসছিল সে। হয়তো নজর হত না। হল গানের কলি শুনে। তখনো রাধার হাতখানি রূপেন্দ্রের করায়ত্ত। সে নিজেই যেন লজ্জা পেল। সন্তর্পণে সরে গেল আড়ালে।

রাধা বললে, ‘বিদ্যাসুন্দর’ আমি পড়িনি, গোঁসাই। কিছু বিক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি শুনেছি শুধু। তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ পড়েছি। অসাধারণ সেই কবি। মর্মাহত হয়েছি তাঁর বিদ্যাসুন্দরের ক্লেদাক্ত পদে।

ক্লেদাক্ত পদ। এই যে বললে, তুমি তা পড়নি।

—সবটা নয়। কিছু কিছু দৈহিক মিলনের পদ মাত্র শুনেছি। ঘোরতর অশ্লীল।

রূপেন্দ্র প্রায় ধমক দিয়ে ওঠেন, কবি কয়েক বছর ধরে একটি মহাকাব্য রচনা করেছেন, আর তুমি তার দু-একটি পংক্তি পড়ে বুঝে নিলে—তা অশ্লীল?

রাধা বললে, ভাত সিদ্ধ হয়েছে কিনা বুঝে নিতে দু-চারটি তণ্ডুলকণা পরীক্ষা করাই যথেষ্ট।

রূপেন্দ্র গর্জে ওঠেন, না, তা যথেষ্ট নয়। ‘রাঁধুনি’ সে ক্ষেত্রে নির্বিচারে কিছু তণ্ডুলকণা দর্বি সহযোগে উঠিয়ে নেয়। তোমাকে সুনির্বাচিত কদন্ন পরিবেশন করা হয়েছে—প্রস্তরচূর্ণ-মিশ্রিত অপক্ক তণ্ডুল। সম্পূর্ণ কাব্যের মূল্যায়ন ওভাবে করা যায় না।

এবার ‘বঙ্কিম’-রচনা শৈলী আশ্রয় করে আমারই বলে উঠতে ইচ্ছে করছে :’ও রূপেন্দ্র! কী বলিলে! তাহা হইলে সেদিন ভারতচন্দ্রকে ও কথা বলিয়াছিলে কেন?’

রাধা জানতে চায়, আমি তা ঘটনাচক্রে শুনেছি। ওরা ঐসব অশ্লীল পদ আমাকে পড়ে শোনাতো উত্তেজিত করতে। কিন্তু মাত্র ছয়-মাস পূর্বে রচিত পুঁথির অনুলিপি তুমি কোথায় পেলে?

রূপেন্দ্র বললেন, অনুলিপি নয়, আমি পড়েছি মূল পুঁথি। কবির হস্তাক্ষরে। ভারত আমার বিশিষ্ট বন্ধু।

এবার রাধারই সব কিছু ভুল হয়ে গেল। রূপেন্দ্রর হাতটি টেনে নিয়ে বললে, কবি তোমার বন্ধু? তিনি দেখতে কেমন? কত বয়স?

রূপেন্দ্র কৌতুক করে বলেন, তোমার এই আকুলতা দেখে কবিকে আজ ঈর্ষা হচ্ছে।

একথায় প্রগলভা মেয়েটির উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু এবার আর কোন বাগ্‌বৈদগ্ধের লক্ষণ দেখা গেল না। কেমন যেন বেদনার্ত হয়ে ওঠে। বলে, অসাধারণ কবি ভারতচন্দ্র। হ্যাঁ, `কবি আমার প্রিয়জন, অথচ তাঁর কাব্যের কিছু বাছা বাছা অশ্লীল অংশই শুধু শুনেছি আমি! উপায় কী…

রূপেন্দ্র বুঝতে পারেন। কারা ঐ অংশবিশেষ শুনিয়েছে রাধাকে—ঐ রূপনগরের ক্লেদাক্ত পরিবেশে। তাদের নমুনা তো স্বচক্ষেই দেখে এসেছেন বীরনগরে। পাষণ্ডটা কী যেন বলেছিল? এ-কাব্যের প্রচার হবে সারা গৌড়মণ্ডলে! তখন নাকি কুমোরভায়াকে মূর্তি গড়ার আগে বিশেষ পল্লীতে যেতে হবে না। ঘরে-ঘরেই তেমন মাটি পাওয়া যাবে।…..ইচ্ছা করছিল, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের হাতখানা ধরে হিড়হিড় করে এখানে টেনে নিয়ে আসতেও বলতে, ঐ দেখুন মহারাজ! আপনার প্রিয় কবি কী-ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন

দুজনের কেউই লক্ষ্য করেন না—কুসুমমঞ্জরী অদূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। কাছে এগিয়ে আসবে কিনা মনস্থির করে উঠতে পারছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *