১২
সিঙ্গুরে ওঁরা রাত্রিবাস করেননি। আট ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় এসে পৌঁছালেন ফ্রেডরিকনগরে। ভাগীরথীতীরে।
ফ্রেড্রিকনগর সে-আমলে দিনেমারদের অধিকারে। ডেনমার্কের রাজার নামে এই জনপদের নাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম-পাদে জনপদটি ইংরাজ বেণেদের বিক্রয় করে দিনেমার কোম্পানি ভারত শোষণের আশা ত্যাগ করে চলে যায়। পরে এর নাম হয় শ্রীরামপুর। তার আদালতের নিকটে গোরস্থানে কিছু সমাধিফলক ভিন্ন দিনেমার শাসনের কোন চিহ্ন আজ ঐ জনপদে নাই।
যাত্রীদলটি অবশ্য এই ফেরঙ্গভূমে ঘাঁটি গাড়েনি। নিকটেই হিন্দু ভূস্বামীদের পাশাপাশি দুখানি বর্ধিষ্ণু গ্রাম—মাহেশ আর বল্লভপুর। মাহেশের রথ সুবিখ্যাত। মনে আছে নিশ্চয়, ‘রাধারানী’ ঐ মাহেশের রথের মেলাতেই হারিয়ে যায়। এই ফ্রেডরিকনগর—বলা উচিত ‘শ্রীরামপুর’, বঙ্গসাহিত্যের এক তীর্থ। আমাদের কাহিনীকালের পরবর্তী জমানায় এখানেই পাদরী মার্শম্যান, ওয়ার্ড এবং কেরী সাহেব বাংলা ছাপাখানায় প্রথম সংবাদ-পত্র ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশ করেন। এখানেই আছে তাঁদের তিনজনের সমাধি। শ্রীরামপুরের ছত্রপুরী, বা চাতরা পল্লীতে সে-আমলেও ছিল একটি শীতলা মন্দির—চাতরার-মা। ওঁরা কিন্তু এসে আশ্রয় নিলেন বল্লভপুরের রাধাবল্লভ-মন্দিরে। বোধকরি বৈষ্ণব বলে।
রাধাবল্লভের মূর্তিটি ভাস্কর্য-শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন।
এই মূর্তির বিষয়ে একটি লোকগাথা আছে।
এ পল্লীটির আদি নাম : আক্না। কৃত্তিবাসী রামায়ণে ‘আক্না’-গ্রামের উল্লেখ আছে। সুতরাং পাঁচ-ছয় শত বছরের প্রাচীন গ্রাম তো বটেই। ষোড়শ শতাব্দীতে ঐ আক্না গাঁয়ের নাম পরিবর্তিত হল—যখন রুদ্ররাম পণ্ডিত সেখানে প্রতিষ্ঠা করলেন রাধাবল্লবজীউর আটচালা মন্দির। আক্না হয়ে গেল ‘রাধাবল্লভপুর’।
রুদ্ররাম ছত্রপুরীতে মাতুলালয়ে থাকতেন। তাঁর মাতুলগৃহে ছিল একটি অপূর্ব নিমকাঠের শ্রীগৌরাঙ্গ মূর্তি। জনশ্রুতি, ভাস্কর শ্রীগৌরাঙ্গদেবকে স্বচক্ষে দেখেনি, কিন্তু 1650 খ্রীষ্টাব্দে গুপ্তিপাড়া মঠে শ্রীচৈতন্যদেবের যে মূর্তিটি স্থাপিত হয় তারই অনুকরণে দক্ষ ভাস্করের গড়া এই দারুমূর্তি। রুদ্ররামের মাতুল ছিলেন বৈষ্ণব, কিন্তু রুদ্ররাম স্বয়ং শাক্ত বংশের সন্তান। একদিন রুদ্রকে ঐ দারুময় গৌরাঙ্গদেবের মূর্তির সম্মুখে ধ্যানস্থ দেখে মাতুল তাঁকে তিরস্কার করে বলেন, তুমি ঘোর শাক্তবংশের সন্তান, এঁর পূজার অধিকার তোমার নাই।
রুদ্ররাম নিদারুণ দুঃখিত হন। বিনা প্রতিবাদে তিনি গৃহত্যাগ করেন। ঘোর অরণ্যে একাকী তপস্যায় নিরত থাকেন। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে একদিন অন্তরাল থেকে আবির্ভূত হলেন এক দণ্ডী সন্ন্যাসী। ধ্যানভঙ্গে তাঁকে দেখেই শিহরিত হয়ে ওঠেন রুদ্রপণ্ডিত। এ কে? মাতুলালয়ে যে নিম্বকাষ্ঠের দারুময় মূর্তিকে দেখেছেন এ তো সশরীরে তিনি!
সন্ন্যাসী বললেন, কী চাস্?
রুদ্র পণ্ডিত বললেন, যা পেলে চাওয়ার অন্ত হয়, তাই চাই প্রভু।
—কিন্তু তিনি তো বহুবর্ণা। কী রূপে তাঁকে দেখতে চাস্—রাধাবল্লভ, শ্যামসুন্দর, না নন্দদুলাল?
রুদ্রপণ্ডিত মনস্থির করে উঠতে পারেন না। সত্যই তো, তাঁর ইষ্টদেবতা—কে? যে মোহিনী রূপে তিনি শ্রীরাধিকার নয়ন-বল্লভ হয়েছিলেন, না যে শ্যামরূপে তিনি এই প্রপঞ্চময় জগতে সুন্দরের মূর্ত প্রতীক? অথবা যে বাৎসল্য মাধুর্যে তিনি নন্দ-যশোদার হৃদয় জয় করেছিলেন? তাঁর নয়নে তখন দরবিগলিত ধারায় আনন্দাশ্রু। সন্ন্যাসী বলেন, শোন, তোকে গুপ্তধনের সন্ধান বলে দিচ্ছি : গৌড়েশ্বরের শয়নকক্ষের দ্বারদেশে পশ্চিমপার্শ্বে একটি কষ্টিপাথর আছে। তার ভিতর অন্বেষণ করে দ্যাখ। যাঁকে পাবি তিনিই তোর ইষ্টদেব। তাঁকে পেলেই চাওয়ার অন্ত হবে।
রুদ্রপণ্ডিত সাষ্টাঙ্গে প্রণত হলেন। গাত্রোত্থান করে দেখেন—সন্ন্যাসী অন্তর্হিত।
রুদ্রপণ্ডিত গৌড়ে এলেন। তখন সুলতানী আমল। সুলতানের প্রধান অমাত্য একজন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব—তিনিই মহামন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সব কথা খুলে বললেন। বিস্মিত হলেন মহামন্ত্রী। বলেন, হ্যাঁ, নির্দিষ্টস্থানে একটি বৃহদায়তন কষ্টিপাথর আছে বটে; কিন্তু কই তার ভিতর কোন দেবমূর্তি তো কখনো দেখিনি। আচ্ছা লক্ষ্য করে দেখব।
পরদিন প্রস্তরখণ্ডটি নিরীক্ষণ করতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মহামন্ত্রী। স্পষ্ট দেখতে পেলেন—পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়েছে সেই প্রস্তরখণ্ডে, আর তাতে ঘর্মের মুক্তাবিন্দু ফুটে উঠেছে। পাথরের স্বেদস্রোত! এ তো অলৌকিক!
প্রস্তরখণ্ডের নিকটে মহামন্ত্রীকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে সুলতান কৌতূহলী হয়ে ঘনিয়ে এলেন। বলেন, অমন করে কী দেখছেন আপনি?
মহামন্ত্রী কৌশলে কার্যসিদ্ধি করতে চাইলেন। বলেন, জাঁহাপনা, এই দেখুন! এই কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তরখণ্ডটি অশ্রুবিসর্জন করছে! একে অবিলম্বে মুক্তি দিন, না হলে রাজ্যের অমঙ্গল হতে পারে।
সুলতান তৎক্ষণাৎ স্বীকৃত হলেন। বলেন, এ পাথরখানা এখনি নিয়ে যান।
মহামন্ত্রী লোক দিয়ে সেই বিরাট কষ্টিপাথরখানি স্বগৃহে নিয়ে এলেন।
গৌড়ের প্রখ্যাত এক হিন্দু ভাস্করকে তিনি ডেকে পাঠালেন। পাথরখানা দেখালেন। বলেন, দেখুন, এ থেকে কি কোনও মূর্তি নির্মিত হতে পারে?
ভাস্কর বললেন, একখানা নয়, মহামন্ত্রী। আমি দেখতে পাচ্ছি ঐ কষ্টিপাথরের ভিতর তিনখানি মূর্তির সমাহার ঘটেছে। তিনটিই পুরুষ মূর্তি।
মহামন্ত্রী এবং রুদ্ররাম বিস্মিত। বলেন, কই, আমরা তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আপনি কী করে দেখছেন?
—ঁগুরুর কৃপায়। শিল্পীর সাধনায়। ভাস্করের ধ্যানে!
—কোন দেবতার মূর্তি প্রত্যক্ষ করছেন আপনি? বর্ণনা দিন।
—তিনটিই শ্রীকৃষ্ণের। তাঁর তিন অপরূপ রূপ। এক : যেরূপে তিনি শ্রীরাধিকার মনোহরণ, করেছিলেন : রাধাবল্লভ! দুই : যে শ্যামরূপে তিনি ‘সত্য-শিব’এর সঙ্গে ‘সুন্দররূপে সম্পৃক্ত : শ্যামসুন্দর! তিন : যে রূপে তিনি বাৎসল্যরসে জননীবক্ষে ক্ষীরসমুদ্রে তুফান তোলেন : নন্দদুলাল!
রুদ্ররামের দেহ কদম-ফুলের মতো রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে! এই তিন দেবতার নামই তো করেছিলেন সেই মহাসন্ন্যাসী!
ভাস্কর বলেন,..মহামন্ত্রী, আপনি নির্বাচন করে বলুন কোন মূর্তিখানি চাইছেন?- আমি বিনা পারিশ্রমিকে সেটি উৎকীর্ণ করে দেব; কিন্তু বাকি প্রস্তর-খণ্ড আমার হবে। আমার পারিশ্রমিক।
মহামন্ত্রী বলেন, এ প্রস্তাবে আমি সম্মত নই, ক্ষোদকাচার্য! আমি কাঞ্চনমূল্যে আপনাকে পারিশ্রমিক প্রদান করব। তিনটি মূর্তিই আমার চাই।
অগত্যা তাই। তিনটি মূর্তিই উৎকীর্ণ করলেন ভাস্কর—তিনটিই অপূর্ব।
মহামন্ত্রী রুদ্রপণ্ডিতকে বলেন, একটি আমি রাখব, বাকি দুটি আপনি নিয়ে যান। কোনটিকে আপনি দেবেন বলুন?
রুদ্রপণ্ডিত বলেন, নির্বাচন আপনি করবেন মহামন্ত্রী। আপনার অনুগ্রহ ভিন্ন এ সম্পদ আমি কিছুতেই লাভ করতাম না; দ্বিতীয়ত ক্ষোদকাচার্যের পারিশ্রমিক আপনিই সম্পূর্ণ প্রদান করেছেন। নির্বাচনের অধিকার আপনারই।
মহামন্ত্রী বলেন, ও-কথা বলবেন না, আপনি তপস্যায় সন্তুষ্ট করে দেবতার নিকট থেকে এই বিচিত্র সন্দেশটি সংগ্রহ করেছেন। যা হোক, আপনার ইচ্ছানুসারে আমি এই ঁনন্দদুলাল মূর্তিটিকেই আমার কাছে রাখলাম। আমার স্বগ্রামে এঁর প্রতিষ্ঠা করব। বাকি দুটি আপনার।
গৌড়ের অনেক সৎ-বৈষ্ণব ওঁর কাছ থেকে যে-কোন একটি মূর্তি ভিক্ষা করলেন। কিন্তু মনস্থির করতে পারলেন না রুদ্ররাম। স্থির করলেন যুগলমূর্তিই প্রতিষ্ঠা করবেন নিজ গ্রামে।
আর্থিক সঙ্গতি সামান্য। সিদ্ধান্তে এলেন, একটি পর্ণকুটির নির্মাণ করে উভয় মূর্তিই স্থাপন করবেন। কিন্তু দৈব যার সহায়, তাঁর আবার কিসের অভাব! মন্দিরের ভিৎ খনন করতে গিয়ে লাভ করলেন এক ঘড়া আকবরী মোহর!
শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত ব্যয় করলেন মন্দির নির্মাণে! যুগলমন্দির সমাপ্ত হলে সাড়ম্বর প্রতিষ্ঠার আয়োজন হল। দেশ-দেশান্তরের বৈষ্ণবাচার্যদের আমন্ত্রণ করলেন রুদ্ররাম—নবদ্বীপ, কাটোয়া, শান্তিপুর, ত্রিবেণী, তেঘরা, সপ্তগ্রাম।
এমনকি নিমন্ত্রণ রাখতে উপস্থিত হলেন স্বয়ং বীরভদ্র-আচার্য।
প্রভু নিত্যানন্দতনয়—‘নেড়া’-সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। তখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ। কিন্তু অশক্ত নন। আচার্য বীরভদ্র গোস্বামী বললেন, রুদ্র.! একটি কথা বলি বাবা, কিছু মনে কর না। দেবতার বরে যুগল দেবমূর্তি পেয়েছ। দুর্লভ প্রাপ্তি! কিন্তু তার একটিকে রাখ, একটি দান কর। না হলে সাধনা ঐকান্তিকতা লাভ করবে না।
ব্যথিত হলেন রুদ্ররাম। প্রতিপ্রশ্ন করেন, আপনার কি সিদ্ধান্ত এ দেউল যথেষ্ট বৃহৎ নয়? দুটি মূর্তির স্থান হবে না?
—ঠিক তাই! এ দেউলে একের বেশি দেবতার স্থানাভাব!
ভ্রূকুঞ্চিত হল রুদ্ররামের। বলেন, দেখা যাক। সত্যই যদি স্থানাভাব হয়, তাহলে তিনিই আমাকে স্বপ্নাদেশ দেবেন।
বীরভদ্র সহাস্যে বলেন, কিন্তু তিনি ‘কিনি’? রাধাবল্লভ না শ্যামসুন্দর? কে তোমাকে স্বপ্নাদেশ দেবেন?
রুদ্ররাম বিরক্ত হয়ে বলেন, দেখা যাক কার কৃপা হয়। কেউ না দিলে বুঝব যে, স্থানাভাব হচ্ছে না।
—তোমার যেরূপ অভিরুচি, বাবা।
প্রায় এক দশক পরের কথা। বীরভদ্র গোঁসাই-এর শতবর্ষ পূর্ণ হতে তখনো কিছু বাকি। এই সময় রুদ্ররামের পিতৃবিয়োগ হয়। পিতৃশ্রাদ্ধেও তিনি বৃহৎ আয়োজন করেছেন। অনেকানেক পণ্ডিত সমাগত হলেন। তার ভিতর অতি বৃদ্ধ বীরভদ্র গোঁসাইজী।
কিন্তু শ্রাদ্ধের পূর্বরাত্রি থেকে শুরু হয়ে গেল অকাল বর্ষণ। মাঘ মাস, বৃষ্টির কোনও আশঙ্কা ছিল না। ফলে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। সমস্ত পণ্ড হবার উপক্রম! সমবেত পণ্ডিতেরা বললেন, পারলে একমাত্র ঐ সিদ্ধপুরুষই রক্ষা করতে পারেন। উনি ‘মেঘবন্ধনবিদ্যা”, আয়ম্ভ করেছেন।
রুদ্ররাম যুক্তকরে তাঁরই শরণ নিলেন।
বৃদ্ধ বললেন, হ্যাঁ, ব্যবস্থা তো সহজেই করা চলে। তোমাকে আমি ঐ ‘মেঘবন্ধনমন্ত্রটি’ শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি তোমার ইষ্টদেবের নিকট ঐকান্তিক নিষ্ঠায় প্রার্থনা মন্ত্রটি উচ্চারণ করলেই বারিপাত বন্ধ হবে।
রুদ্ররাম করজোড়ে বলেন, বলুন প্ৰভু?
—কিন্তু মুশকিল এই : তুমি ‘ঐকান্তিক’ হবে কী করে? তোমার ইষ্টদেবের যে যুগলমূর্তি! ধ্যানে তো একজনকেই দেখতে হবে!
রুদ্ররাম বলেন, ওঁরা দুজনেই কি এক নন?
—নিশ্চয়ই। শ্যাম-শ্যামা-শিব-সরস্বতী মায় আল্লাহ্ও তিনি। বল, কে তোমার ইষ্টদেব?
রুদ্ররাম লুটিয়ে পড়লেন পরমসাধকের চরণে। বলেন, বুঝেছি প্রভু! লোভ আর মোহের বশবর্তী হয়ে অনেক সৎ বৈষ্ণবকে প্রত্যাখ্যান করেছি। আর করব না। শ্যামসুন্দরকে আপনি নিয়ে যান। আমার বর্তমান সাধনা শুধু রাধাভাবের।
বীরভদ্র বলেন, মনে আছে বাবা? তুমি প্রশ্ন করেছিলে, ‘দেউল কি যথেষ্ট বড় নয়?’ আমি জবাবে বলেছিলাম, ‘ঠিক তাই।’ তুমি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সেদিন। বোঝনি, আমি এই দেউলটার কথা বলেছিলাম, বাবা।
বলিরেখাঙ্কিত তর্জনীটি তিনি স্পর্শ করালেন রুদ্ররামের পাঁজরে।
বীরভদ্রের অলৌকিক ক্ষমতায় শ্রাদ্ধকার্য সুসম্পন্ন হল।
সেই থেকে আক্না গ্রাম হয়ে গেল : রাধাবল্লভপুর।
বীরভদ্র প্রতিষ্ঠা করলেন “শ্যামসুন্দরকে স্বগ্রামে—অপূর্ব সে মন্দির, আজও অটুট—ভাগীরথীর পরপারে : খড়দহে।
‘খড়দহ’ নামটা কী করে হল জান তো? তাও জান না? কিছুই জান না দেখছি দিদিভাই-দাদুভাইরা! বুড়োকে বকিয়ে বকিয়ে মারছ। বার-বার খেই হারিয়ে যাচ্ছে আমার। যা হোক, জান না বললে যখন, তখন শোন বলি :
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আদেশে প্রভু নিত্যানন্দ গার্হস্থ্যধর্মে দীক্ষা নিলেন। নবদ্বীপের নিকটস্থ শালিগ্রামের পণ্ডিত সূর্যদাস সরখেলের দুটি কন্যা—বসুধাদেবী আর জাহ্নবীদেবীকে একযোগে পত্নীত্বে বরণ করলেন। গৃহিণী হলে গৃহ আবশ্যিক। এতদিন অবধূতের শয়নের ব্যবস্থা ছিল হট্টমন্দিরে। এখন আর তা চলে না। গঙ্গাতীরের এক গ্রামে দুই পত্নীকে নিয়ে উপনীত হলেন প্রভু নিত্যানন্দ। শুনলেন, স্থানীয় ভূস্বামী গঙ্গাতীরে আছেন। তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে সামান্য ব্রহ্মোত্তর ভূখণ্ড প্রার্থনা করলেন।
জমিদার-মশাই তখন ইয়ারবন্ধুদের নিয়ে জমিয়ে বসেছেন মৎস্য শিকারে। বললেন, শুনেছি আপনি এককালে অবধূত ছিলেন, অর্থাৎ সন্ন্যাসী! আপনি ‘বে’ করলেন কোন আক্কেলে? আগে সেটাই আমাকে বুঝিয়ে বলুন।
প্রভু নিত্যানন্দ বিনয়ের অবতার। তৃণাদপি সুনীচ। জিজ্ঞাসুকে কখনো প্রত্যাখ্যান করেন না। করজোড়ে বললেন, অবধূত দুই প্রকার—শৈব ও বৈষ্ণব। মহানির্বাণতন্ত্র মতে তার চারি প্রকার শ্রেণীবিভাগ, যথা ব্রহ্মাবধূত, ধীরাবধূত, শৈবাবধৃত ও কূলাবধূত। শেষোক্ত শ্রেণী কুলাচার ধর্ম-মতে অভিষিক্ত থাকেন। তিনি গৃহাশ্রমে সাধন-ভজন করেন। আমি পরম প্রভুর আদেশক্রমে বর্তমানে সেই কুলাবধৃত। আপনি আমাকে সামান্য ভূখণ্ড দান করলে…
জমিদার-মশাই, ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ও-সব তত্ত্বকথা আমাকে শোনাতে আসবেন না। সন্ন্যাসী হবার পরেও যখন বে-করতে পেরেছেন তখন গঙ্গাগর্ভে ভদ্রাসনও নিশ্চয় নির্মাণ করতে পারবেন। ঐখানে আপনি আপনার ভদ্রাসনটি নির্মাণ করে বংশানুক্রমে ভোগ করতে পারেন।
হুঁকো-বরদার তখন এক-আঁটি জ্বলন্ত খড়ের সাহায্যে তাঁর ছিলিমে অগ্নি-সংযোগে ব্যাপৃত ছিল। জমিদার-মশাই তার হাত থেকে জ্বলন্ত খড়ের আঁটিটা কেড়ে নিয়ে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে বললেন, ঠিক ঐখানে। জলের মধ্যে!
নিত্যানন্দ করজোড়ে বললেন, তাই হবে প্ৰভু!
মোসায়েবের দল অট্টহাস্যে কেয়াবাৎ দিয়ে ওঠে।
নিত্যানন্দ ভ্রূক্ষেপ করলেন না। খড়-দড়ি-বাঁশের এন্তাজামে গেলেন। জমিদার-মশাই বয়স্যদের বললেন, পাগলটাকে তোমরা বাধা দিও না। দেখাই যাক না—রগড় কতদূর গড়ায়।
রগড় যতদূর গড়ালো তাতে সকলের চোখ কপালে ওঠে। প্রজ্জ্বলিত খড়ের আঁটিটি যেখানে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল সেখানে জেগে উঠল একটা চর। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল তা। নিত্যানন্দ সেখানেই নির্মাণ করলেন তাঁর ভদ্রাসন : খড়দহ গ্রামে।
গ্রামটির উৎপত্তি এই অলৌকিক ঘটনায়।
মজার কথা, মাত্র আড়াই ক্রোশ দূরে ‘সাঁইবেনা’ গ্রাম। গৌড়েশ্বরের মহামন্ত্রীর আদি নিবাস সেখানেই নির্মিত হয়েছে “নন্দদুলালজীর মন্দির।
অর্থাৎ সেই কষ্টিপাথরের ভিতর লুক্কায়িত ত্রি-মূর্তির—গৌড়ের ক্ষোদকাচার্য যাঁদের দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর ধ্যানের দৃষ্টিতে, তাঁরা কাছাকাছিই আছেন আজও। ভাগীরথীর পশ্চিমপারে রাধাবল্লভ আর পুব-পারের পাশাপাশি গাঁয়ে “শ্যামসুন্দর আর “ নন্দদুলালজী। মাঘী-পূর্ণিমার পুণ্য তিথিতে পর্যায়ক্রমে তিন-দেবতার দর্শন নাকি মহাপুণ্য কাজ
যতদূর মনে পড়ছে—নিতান্ত বাল্যকালে ঐ তিন দেবতাকেই একত্র ঝুলনে দুলতে দেখেছি। কৃষ্ণনগর রাজবাটিতে—বারোদোলের মেলায়। নামগুলিই শুধু মনে আছে : রাধাবল্লভ, শ্যামসুন্দর, নন্দদুলাল। তাঁরা পর্যায়ক্রমে রাধাবল্লভপুর, খড়দহ আর সাঁইবেনার বাসিন্দা কিনা তা বাপু হলপ করে বলতে পারব না। খুব সম্ভবত তাই।
‘রাধাবল্লভজী’ মন্দির-প্রতিষ্ঠার পূর্বোক্ত কাহিনীটি রূপেন্দ্রনাথ যাত্রাপথেই সকলকে বিবৃত করতে করতে এসেছেন। কর্তামশাই তাই নিদান হেঁকেছেন—তাঁরা ফ্রেডরিকনগর বা শ্রীরামপুরে রাত্রি যাপন করবেন না। আশ্রয় নেবেন ঐ গ্রামে। রাধাবল্লভপুরে। শোনা গেল, সেই দেবোত্তর সম্পত্তিতে একটি সুবৃহৎ যাত্রীনিবাস আছে। তীর্থযাত্রীরা তিন তিথি সেই ধর্মশালায় আশ্রয় পেতে পারে।
আরও একটি আকর্ষণ ছিল। স্বীকার করতে সঙ্কোচ হয়—তবু বলব, সাধনভজন করছেন বলে ওঁরা তো নির্লোভ সন্ন্যাসী নন। রবি-বাউলের ঐ পংক্তিটা—‘সেরা রস রসনায়’ তখনো রচিত হয়নি বলে কি তত্ত্বটা তাঁদের না-জানা? এ মন্দিরে বাল্যভোগে একটি বিচিত্র-প্রণালীতে প্রস্তুত ভোগ নিবেদন করা হয়—আহা যেন অমৃত। শোন বলি :
‘লোচিকা’-র নাম নিশ্চয় শুনেছ? মিহি গোধূমচূর্ণের ঘৃতপক্ক পিষ্টক। সে তো সে-আমলে অনেকানেক বৈষ্ণব-আখড়ায় ভোগের জন্য প্রস্তুত হত। এ তারই এক রকমফের। পিষ্টকের দুটি পরতের ভিতর পাচক কী-জানি কী-করে প্রবিষ্ট করিয়ে দেয় আর্দ্রক-মৌরী-হিঙ্গু-জীরা-সুরভিত ‘ডাইল’-এর এক অনুপান। ঘৃতভর্জিত এই বিশেষ পিষ্টকটি সে আমলে গৌড়মণ্ডলের মাত্র দুইটি দেবমন্দিরে ভোগার্থে প্রস্তুত হত। প্রথমত মুর্শিদাবাদ কান্দির সিংহ-পরিবার প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে, দ্বিতীয়ত এখানে। দুইটি দেববিগ্রহের একই অভিধা : রাধাবল্লভ। পিষ্টকটি পরবর্তীকালে শুধু বৈষ্ণব বাবাজীদেরই নয়, সাধারণ গৌড়বাসীর কাছেও বড়ই আদরণীয় হয়ে পড়ে। এখন তার বহুল ব্যবহার।
তোমরা হয়তো তার নামটি শুনে থাকবে : ‘রাধাবল্লভী’!