১১
পরদিন সকালেই ওঁরা হরিপাল ত্যাগ করে দক্ষিণপুব-মুখো সিঙ্গুরে যাত্রা করলেন।
কিন্তু আমাদের সে পথে যাত্রা করতে কিছু দেরী হবে। ব্যাপারটা কী জানো?—
হরিপালে সংগৃহীত আর একটি ছোট্ট লোকগাথা না শুনিয়ে হরিপাল ছেড়ে যেতে মন সরছে না। আবার কী-ভাবে ‘চণ্ডালী-মা’ রূপান্তরিতা হলেন ‘বিশালাক্ষী’-তে। অর্থাৎ যে ঘটনায় চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল : নরবলি।
এ ঘটনা আমাদের কাহিনীর কালের প্রায় দেড়শ বছর পরের—ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদের। ততদিনে বিশালাক্ষীর মন্দির পুনরায় অরণ্যভূমের কুক্ষিগত। চারিদিকেই জঙ্গল। নাট-মন্দিরটা বিধ্বস্ত—কেউ সারায়নি। গাঁথনির ফাটলে পাখিতে নিয়ে আসা বীজ পড়ে বট-অশ্বত্থ জন্মেছে, মোটা শিকড়ের চাপে ফাটিয়েছে দেউল, ঝুড়ি নামিয়ে ঝাঁকড়াচুলো ডাইনীর মতো ঘাপটি মেরে বসেছে। শতাব্দীর সাধনায় শালশিশু জয় করে নিয়েছে শ্মশানঘাট। শত-সহস্র গ্রন্থিতে পত্রপল্লবের আলিঙ্গনে অরণ্য আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে মন্দিরচূড়া—তার মধ্যদেশে সবুজ শ্যাওলার আস্তর—পদতলে শতমূল, সহস্রমূল, শেয়ালকাঁটার আকুলি-বিকুলি। সেই নিবিড় অরণ্যভূমি ভেদ করে মাত্র দুটি বনপথ—একটি শ্মশানযাত্রীদের নিত্য আনাগোনায় বসর্পিলরূপে শায়িত, দ্বিতীয়টি পুরোহিত মহাশয়ের ভদ্রাসন থেকে মন্দিরে যাবার সোজা পথটা। জমিদারের দান করা দেবোত্তরের অধিকার আছে অটুট। ভক্ত সমাবেশ হোক না হোক ক্রবর্তী-বংশের অধিকার আছে অক্ষুণ্ণ। রোজ সকাল-সন্ধ্যায় মহাদেব চক্কোত্তি একবার করে মন্দিরে আসেন। শিকল খুলে “ মাকে ভোগ নিবেদন করেন, সন্ধ্যায় শয়নারতি সেরে আবার শকল তুলে ফিরে যান। ভক্ত বা যাত্রীর দেখা নেই—মাসে একদিনও নয়। তবে এটুকু না করলে পূজার অধিকার বজায় থাকে না—দেবোত্তর ভোগ করার স্বত্ব হারাতে হয়।
রাজা হরিপাল মায়ের সেবার জন্য প্রায় দুশো বিঘার মতো দেবোত্তরের ব্যবস্থা করে গয়েছিলেন; কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী ভূম্যধিকারীদের উপদ্রবে আর কারসাজিতে তার অধিকাংশই বেহাত। চক্কোত্তির ক্ষমতা কি যে, জবরদখলকারীদের রোখেন? বর্তমান জমিদারও উদাসীন। মায়ের সম্পত্তি রক্ষার চেয়ে ঐসব প্রতিপত্তিশালী মধ্যস্বত্বভোগীর সৌহার্দ্য তাঁর বেশী কাম্য। মহাদেব চক্কোত্তির বাস্তু-সংলগ্ন বিঘে-তিনেক জমি ছাড়া প্রায় সবই বে-দখল। ঐটুকু জমিতেই ফলে লাউ-কুমড়ো-বেগুন, আলু-মরিচ। তবে জবরদখলকারীদের চক্ষুলজ্জা আছে; তারা চক্কোত্তির সংসারে সংবৎসরের প্রয়োজনের মতো চাউল পাঠিয়ে দেয়। আর সংসার বলতে তো তিনটি প্রাণী। মহাদেব তখন চল্লিশের কোঠায়, স্ত্রী নিরুপমা ত্রিশ, আর একমাত্র পুত্র কাঙালীর বয়স আট।
সেই আট। রঘুনাথের পুত্রবধূ—সেই যার খাসা-মসলিন নীলাম্বরী ঁমায়ের কৃপায় রক্ত-চীনাংশুক হয়ে গেছিল-তার বয়সও ঐ আট ছিল না?
শুরুতে অষ্টমবর্ষীয়া বালিকা, সমাপ্তিতে অষ্টমবর্ষীয় বালক।
কাঙালীর অক্ষর-পরিচয় হয়েছে। বাপের কাছে। পাঠশালায় তাকে পাঠানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি নাই। একটিমাত্র সন্তান—কিন্তু তাকেও গুরুগৃহে পাঠাতে পারেন না। স্থির করেছেন নিজেই যেটুকু পারেন পড়াবেন। মোটামুটি অক্ষর পরিচয়, সামান্য আঁক-কষা আর কৌলীক পূজাবিধি। কাঙালী ‘আট’-এ পড়েছে। এটাই প্রশস্ত সময়। উপনয়নের। ব্রাহ্মণের আট, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বারো আর বৈশ্যের পক্ষে ষোল। প্রথমটিই শাস্ত্রোক্ত—পরের দুটি ইদানীং চালু হয়েছে। স্থির করেছেন—নিজেই দীক্ষা দেবেন—তাতে ব্যয়-সঙ্কোচ হবে। শিখিয়ে দেবেন—ত্রিসন্ধ্যাবিধি, আচমন, প্রাণায়াম, মার্জন, অর্ঘ্যপ্রদান আর উপস্থানের বিধিগুলি। এবং বলাবাহুল্য : গায়ত্রীমন্ত্র। অন্যান্য পূজাবিধি ক্রমশ শিখে নেবে। বাবা-মশায়ের সঙ্গে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা সে মন্দিরে যায়—পূজাবিধি দেখে। বুদ্ধিমান ছেলে—মন্ত্রোচ্চারণের অধিকার নেই, না হলে এখনই সে বাবার কাজ চালিয়ে নিতে পারে।
তারপর একদিন সন্ধ্যারাতে। কী তিথি তা মনে নেই, তবে আকাশে ছিল ভাঙা-চাঁদ। শয়নারতি সেরে কাঙালীকে নিয়ে ফিরে আসছিলেন ভিটেতে, হঠাৎ মাঝপথে ওঁদের রুখল একজন ভীমকায় পুরুষ। আঁৎকে উঠলেন চক্কোত্তি, কে বাবা তুমি? কী চাও?
ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, পেশীবহুল দেহ। মালকোচা সাঁটা। মাথায় বারি চুলে একটা গামছার ফেট্টি। কপালে সিক্কাটাকার মাপে রক্তবিন্দু। হাতে প্রমাণ মাপের লাঠি। নজর হল, কিছু দূরে আরও দুজন অনুরূপ অনুচর। সকলেই সসম্ভ্রমে নিচু হয়ে ওঁকে দণ্ডবৎ করল। দলপতি বললে, পেন্নাম হই ঠাকুরমোশাই। খোকারে ঘর যাতি বলেন, ছিচরণে কিছু নিবেদন করব, আজ্ঞে। মহাদেব চক্কোত্তি চোখে ওকে কখনো দেখেননি, কিন্তু আন্দাজে চিনতে পেরেছেন। প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বর্ণনা থেকে। এ অঞ্চলের কুখ্যাত ডাকাত। অঘোর চণ্ডাল। অতীতকালের বিভীষিকা রঘু-চণ্ডালের বংশাবতংস। ফেরঙ্গ সরকারের কোতোয়াল ঐ বারিচুলের ঝাঁকড়া মাথাটার উপর কত টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে যেন। গোটা হুগলী জেলার আতঙ্ক। চক্কোত্তি খোকার হাতে নৈবেদ্যর পাত্রটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ঘরে যা বাবা, আমি এখনি আসছি।
কাঙালী কী বুঝল তা সেই জানে। সভয়ে পিছন ফিরে দেখতে দেখতে সে বাড়ি ফিরে গেল।
—আমারে চিন্তি লারলেন ঠাকুরমোশা? মুই আপনকার ছি-চরণের দাস আজ্ঞে, অঘোর চাঁড়াল।
মহাদেব কাঁপতে কাঁপতে বলেন, তা এ অধমের কাছে কেন বাবা? চাল-কলা-নৈবেদ্য ছাড়া তো আমার কিছুই নাই। তবে হ্যাঁ, ঁমায়ের অঙ্গে কিছু অলঙ্কার আছে—সাত পুরুষ ধরে–জানি না, তা স্বর্ণালঙ্কার—
অঘোর “মা বিশালাক্ষীর পাল্লা-দেওয়া জিহ্বা-দংশন করল :
—ইটো কী বুলছেন আজ্ঞে? ঁমায়ের গায়ের গহনা…..
—তবে?
অঘোর পথের মাঝেই পেশ করল তার প্রস্তাব। “মা তাকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন। তিনি ক্ষুধার্তা, অনশনক্লিষ্টা—ছাগমাংসে তাঁর তৃপ্তি হচ্ছে না। রঘু-ডাকাতের উত্তরসূরী তাই ফিরিয়ে আনতে চাইছে সেই সাবেক ব্যবস্থাপনাটা
থরথর করে কেঁপে ওঠেন মহাদেব চক্কোত্তি : এটা কী বলছিস্ রে অঘোর। সে-কাল আর এ-কাল? এখন যে ফিরিঙ্গিদের জমানা। ও কাজ করা যে মানা। জানাজানি হলে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত।
—কাকপাখিতে জানবেক্ নাই ঠাউর।
—জানবে। লাস জ্বালাতে হবে না? শ্মশানে মাঝরাতে নতুন চিতা জ্বলে উঠতে..দেখলে গাঁয়ের মানুষ জানতে চাইবে না—ফৌত হল কে?
—চিতা জ্বলবেক্ না ঠাউর।
অঘোর সব কিছু চিন্তা করেছে। সবরকম ব্যবস্থা করে রেখেছে মনে মনে। তার পরিকল্পনাটি নিশ্ছিদ্র। বলির ‘পশু’ ওর করতলগত হলে অঘোর লোক মারফৎ খবর পাঠাবে। ঠাকুর-মশাই পাঁজি-পুঁথি ঘেঁটে ঐ লোক-মারফৎই জানাবেন—কোন তিথিতে রাতের কোন লগ্ন প্রশস্ত। নির্দিষ্ট তিথিতে নৌকাযোগে আসবে অঘোর। সঙ্গে বলির ‘পশু’, একটি খাটিয়া আর কয়েকজন বাহক। মধ্যরাত্রে পুণ্যকর্ম সমাধা হলে যূপকাষ্ঠের শোণিত ধুয়ে দিয়ে অঘোর একাই ডিঙি নিয়ে ফিরে যাবে; আর বাহকেরা রওনা হয়ে পড়বে মৃতদেহ নিয়ে–নিঃশব্দে। ভিনগাঁয়ে পৌঁছে ধ্বনি দেবে—‘বল হরি, হরি বোল’–ওরা চলেছে গঙ্গাতীরে, দাহ করতে। কারও সন্দেহ হবে না। “গঙ্গালাভের আসায় এই ‘নিগঙ্গা’র দেশ থেকে প্রতিনিয়তই তো চলেছে ঐ জাতের মিছিল—‘অহনি-অহনি’। ‘দাহ’ কোথায় হবে? আদৌ হবে না। যে শ্মশান ঘাটেই দাহ করতে যাও—ছিন্নশির মৃতদেহ—দাহকেরা নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। দাহ হবে না, তবে কি কবর দেবে? আজ্ঞে না। মৃতদেহেরও একটা বাজারদর আছে। ওরা বেচে দেবে! ঐ ত্রিবেণী আদ্বিসপ্তগ্রাম, কাটোয়ায় আছে তান্ত্রিক-সাধক, কাপালিক—যারা শবসাধনা করতে চায়, শব জোগাড় করতে পারে না; পঞ্চমুণ্ডির সাধনায় পিশাচসিদ্ধ হতে চায়, নরমুণ্ড পায় না। সে সব চিন্তা ‘ঠাউরমোশাই’কে করতে হবে না। আশঙ্কার কিছু নেই। ঁমায়ের ইচ্ছা পূরণ করবেন তাতে আবার ইতস্তত কিসের? আর যেটুকু বা দ্বিধাগ্রস্ততা ছিল সেটা সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত হয়ে গেল দক্ষিণার অঙ্কটা শুনে; বলি-পিছু আড়াইগণ্ডা সিক্কাটাকা।
একটি বছর কেটে গেছে তারপর। হরিপালের গ্রাম্যজীবনে দশ-বিশ বছরে এমন কিছু পরিবর্তন হয় না; কিন্তু মায়ের আশীর্বাদে মহাদেব চক্কোত্তি ইদানীং একটু সচ্ছলতার মুখ দেখছেন। বর্ষার আগে ছাদটা ছাইয়েছেন, একটি গোয়ালঘরও তুলতে হয়েছে। কী করবেন? দুধেলা গাই কিনতে হল যে একটা। কাঙালী পিটুলিগোলাই পান করেছে এতদিন—দুধের-কাঙাল ছিল সে। পণ্ডিতগৃহিণীকে একটি নাকছাবিও কিনে দিয়েছেন। গৃহিণী সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন, এসব কী করে হচ্ছে গো?
—সে-কথা জানতে চেও না! “মা অ্যাদ্দিনে মুখ তুলে তাকিয়েছেন।
চক্কোত্তি-গিন্নি সরল-বিশ্বাসে যুক্তকর কপালে স্পর্শ করিয়েছিলেন শুধু। সত্যই তো, তার সাত্ত্বিক প্রকৃতির পরমগুরু আজীবন নিরলস-নিষ্ঠায় ঁমায়ের পূজা করে চলেছেন, “ মায়ের দয়া তো হতেই পারে। শুধু খোকার উপনয়নটা এখনো হয়নি। আর একটু গুছিয়ে নিয়ে কাজে হাত দেবেন। উপনয়নের প্রশস্তকাল—বয়ঃসন্ধি। আটেই যে হতে হবে এমন কোন অলঙ্ঘনীয় কানুন নেই।
কাকপক্ষীতে টের পায়নি সত্যই। কাকেরা রাতে জেগে থাকে না। তবে প্যাচারা জানে। তারা কথা বলে না। পিট্পিট্ করে তাকিয়ে দেখে কাণ্ডকারখানা।
কোথায় যেন খচখচ্ করে বাধে। কোন শালা টের পায়নি—কিন্তু পাঁজরার ভিতরে ঐ যে একটা প্রত্যঙ্গ আছে না?—হৃদপিণ্ড?—সেটা মাঝে-মাঝে টনটনিয়ে ওঠে। বলির ‘পশুর মুখে ফেট্টি বাঁধা থাকে, তবু শোনা যায় তার প্রাণভয়ের আর্তি। সে আর্তনাদের গুমরানি অন্তরটা কুরে কুরে খায়। উপায়ান্তরবিহীন ব্রাহ্মণ কারণপানের মাত্রাটা বৃদ্ধি করে সেই অনাসৃষ্টিকে চাপা দেন।
স্ত্রী সন্দেহ করেনি, করেনি গ্রামবাসী। কিন্তু একজনের দুরন্ত কৌতূহল দিন দিন ‘হবিষা কৃষ্ণবর্থেব’ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কাঙালী। বাবামশাইকে সেই দৈত্যের মতো লোকটা সেদিন সন্ধ্যায় কী বলে গেল? তারপর সেই আজব মানুষগুলো মাঝে-মাঝেই আসে। বাপের সঙ্গে কী যেন পরামর্শ করে। দু-একবার সে এগিয়ে এসেছিল শুনতে। প্রচণ্ড ধমক খেয়ে স্থানত্যাগ করতে হয়েছে। ব্যাপারটার কোন কূলকিনারা করতে পারেনি। এটা যে নিষিদ্ধ কোন কিছু তাও বোঝেনি—তবে এটুকু বুঝেছিল যে, বাবামশাই রহস্যঘন কোন একটা কাজ লুকিয়ে করে থাকেন। আর সেটা ঐ মন্দিরকে ঘিরে।
তারপর এক দিন। অঘোরের যমদূত এসে সংবাদ দিয়ে গেল, ধরা পড়েছে একটি বালক। কাঠুরেদের ছেলে, ভিন্ন গাঁয়ের। কুড়াল কাঁধে বেওয়ারিশ জঙ্গলে কাষ্ঠাহরণে এসেছিল। তারপর থেকে সে বেপাত্তা। অনেক দূরের গ্রাম, হরিপালের কেউ কিছু জানে না, জানবে না। মহাদেব চক্কোত্তি পাঁজি-পুঁথি ঘেঁটে নিদান দিলেন : অমাবস্যা তিথির রাত্রি দুই ঘটিকা গতে শুভলগ্ন, তিনটা বত্রিশ পর্যন্ত। এতদিনে ‘ঘণ্টা-মিনিট’ বোঝে সবাই।
লোকটা জানিয়ে গেল, ঠিক মধ্যরাত্রে নৌকা এসে ভিড়বে শ্মশানঘাটে। পুরোহিতকে কেউ ডাকতে আসবে না। তিনি যেন একাই উপস্থিত থাকেন মন্দিরে।
দুজনের কেউই জানতে পারেননি এবার অন্তরাল থেকে কথাটা শুনেছে কাঙালীচরণ। ব্যাপারটা কী, তা সে বোঝেনি, এটুকু আন্দাজ করেছে অমাবস্যার মধ্যরাত্রিতে মন্দিরে কিছু-একটা ঘটবে। ভাদ্র মাস। একে অমাবস্যা,তায় সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। মহাদেব অমাবস্যার উপবাসে আছেন। গৃহিণীকে বলে রেখেছেন মধ্যরাত্রে তাঁকে মন্দিরে যেতে হবে একবার। পূজা দিতে হবে—অমাবস্যার পূজা। গৃহিণী বলেছিলেন, খোকা দুপুরে ঘুমিয়েছে, সে মশাল জ্বেলে নিয়ে সঙ্গে যাক।
—না, না, না! সে ঘুমাক। তাকে বিরক্ত করার প্রয়োজন নেই।
কাঙালী যে ঘুমায়নি, তা ওঁরা দুজনেরই কেউই জানেন না। রাত্রে জাগতে হবে বলে সে দিনে বেশ লম্বা একটা নিদ্রা দিয়ে রেখেছে।
মধ্যরাত্রে টোকা-মাথায় রওনা হচ্ছিলেন মহাদেব। গৃহিণী পিছন থেকে বলেন, একটু দাঁড়িয়ে যাও, একটা মশাল জ্বেলে দিই। যে ঘুটঘুটে আঁধার—-
খিঁচিয়ে ওঠেন চক্কোত্তি, যাই একটা শুভ কাজে, পিছন থেকে টুকে দিলে তো? গৃহিণী অপ্রস্তুত। তিনি মশাল জ্বালার আয়োজনে ব্যস্ত। তাঁর হাত থেকে মশালদণ্ডটা ছিনিয়ে দূরে ফেলে দিলেন। তারপর গৃহিণীর অবাক চাহনি লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি সামলে নেন, যাচ্ছি মায়ের কাজে! পথ দেখাবেন মা! এ পথ কি আমার অচেনা? চোখ বাঁধা হলেও তো চলে যাব! মা—মাগো!
তা বটে! গৃহিণী যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করিয়ে উদ্দেশ্যে প্রণাম করেন। সদর-দ্বারে আগড় দিয়ে খোকার পাশটিতে শুয়ে পড়েন।
ঘনান্ধকার। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টিটা থেমেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমক। পথ চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না কিছু। আর ও-কথাটাও মিথ্যা বাগাড়ম্বর নয়—চোখ বুঁজেও তিনি এ পথে যাতায়াত করতে সক্ষম।
মন্দিরের সোপান বেয়ে উঠে এসে অন্ধকারে শিকলটা খুলতে গিয়ে দেখলেন সেটা খোলাই আছে। ভিতর থেকে জড়িত কণ্ঠে অঘোর চণ্ডাল বলে ওঠে, আসুন, ঠাউর মোশা—
কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চক্কোত্তি বলেন, মন্দিরে তোরা কজন আছিস?
—মুই একাই আছি, আজ্ঞে। স্যাঙাত্রা ডিঙিতে।
—আর ‘পশুটা?
—অদের জিম্মায়।
মহাদেব ভিতর থেকে দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন। তাঁর অঙ্গরাখায় ছিল চকি। জলে ভেজেনি। আগুন জ্বাললেন। প্রজ্জ্বলিত করলেন ঘৃত প্রদীপ। পূজার নানান উপচার পোঁটলা বেঁধে নিয়ে এসেছে অঘোর। ফল, ফুল, ঘৃত, মধু, দধি, গন্ধদ্রব্যাদি। রাঙাজবা আর অপরাজিতার মালা। আর বড় একটি পাত্রে বিশুদ্ধ কারণ বারি।
চক্রবর্তী পূজায় বসলেন। কালীপূজার নানাবিধ প্রকরণ—নানান বিধি-বিধান। তার ভিতর একটি হচ্ছে : ধ্বনি! শব্দ! কাংস্য-ঘণ্টা এবং স্ফোটক। মুশ্কিল এই যে, নরবলি নিষিদ্ধ হওয়ার পর এ-জাতীয় পূজায় কাংস্য-ঘণ্টা-ধ্বনি, বা স্ফোটকের শব্দ সম্ভবপর হচ্ছিল না। ম্লেচ্ছ শাসকদের অত্যাচারে। কোন এক মহাতান্ত্রিক কাপালিক তাই বিকল্প বিধান দিয়েছেন—কালীপূজায় যদি নরবলিদানের আয়োজন হয়ে থাকে তাহলে কাংস্য-ঘণ্টা-আদি বাদ্যনিনাদ্ নিষ্প্রয়োজন—বিকল্প ব্যবস্থাই গ্রাহ্য। বিকল্প ব্যবস্থাটা কী? কাঞ্চনমূল্য? না! বিকল্প বিধানটি এই জাতের :
বলির মুহূর্তে যেন ‘পশু’র জ্ঞান থাকে। সে যেন অজ্ঞান অচৈতন্য না হয়ে পড়ে খড়্গাঘাতের পূর্বমুহূর্তে উন্মোচিত করে দিতে হবে তার মুখের বন্ধন। সে মৃত্যুভয়ে অনিবার্যভাবে আর্তনাদ করে উঠবে। সেই মৃত্যু-আর্তির ধ্বনিই কাংস্য-ঘণ্টা স্ফোটকের পরিপূরক।
কিন্তু ঘটনাচক্রে যদি বলির ‘পশু’ আর্তনাদ না করে?
এমনটা হওয়ার কথা নয়। তবু ব্যতিক্রম-হিসাবে সেই দুর্দৈব যদি উপস্থিত হয় তখন প্রজ্জ্বলিত ঘৃতদীপ শিখাটি তার ভূমধ্যের দিকে তিল তিল করে সরিয়ে আনতে হবে। কোনভাবেই যেন রক্তপাত না ঘটে। প্রাণভয়ে মূক হয়ে থাকলেও ঐ পূত দীপশিখার উত্তাপে বলির ‘পশু’ আর্তনাদ করতে বাধ্য হবে। তখনই খড়্গাঘাত!
এ সকল বিধিই জানা আছে মহাদেব চক্কোত্তির। এই এক বৎসরে—হিসাব মনে আছে তাঁর—নয়টি ‘পশু’বলিদান করা গেছে। প্রথম প্রথম যে বিভীষিকা, যে আতঙ্কে পক্ষকাল ধরে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন ইদানীং সেটা কমে গেছে। একটি অনিবার্য ঔষধও পেয়ে গেছেন যে—মাত্রাতিরিক্ত কারণবারি পান। ‘পশু’কে উৎসর্গ করে দেবার পর প্রথম দিকে তিনি স্বচক্ষে বলিদানের পুণ্যকার্যটি দেখতে পারতেন না—বিশেষ ঐ মুখের বাঁধন খুলে দেবার পর তার আর্তিটা যেন শ্রুতিপথে তীক্ষ্ণ শলাকার মতো প্রবেশ করত। তারও একটি বিকল্প ব্যবস্থা করেছে অঘোর চণ্ডাল। ওর অনুচর হতভাগ্যের মুখের বাঁধনটা আলগা করে দিলেই অঘোর নিজের মুখে দুটি আঙুল প্রবিষ্ট করে দেয় আর হুবহু অনুকরণ করে শিবাধ্বনি। তাতে দুজাতের সুবিধা। প্রথমত ঘাতকের মনোবল ক্ষুণ্ণ হয় না, দ্বিতীয়ত গ্রামবাসী দূর থেকে ঐ মৃত্যুভীত হতভাগ্যের আর্তনাদটা শুনতে পায় না।
পূজা সমাপনান্তে চক্কোত্তি বসলেন কারণপাত্রটি নিয়ে। ইতিপূর্বেও অনেকটা পান করেছেন; কিন্তু স্নায়ুতন্ত্রীগুলি এখনো সেভাবে উজ্জীবিত হয়নি। মন্দিরেই রাখা আছে একটি বালু-ঘটিকা। মাঝে মাঝে সেটিকে পরীক্ষা করছেন—মহালগ্ন যেন অতিক্রান্ত হয়ে না যায়।
ক্রমে ঘনিয়ে এল লগ্নটি। চক্কোত্তি জড়িতকণ্ঠে তাঁর যজমানকে আত্মীয়-সম্বোধন করে বললেন, যা রে শালা, এইবার নিয়ায় তোর সেই শালা ছাগশিশুকে!
অঘোরেরও বিলক্ষণ নেশা হয়েছে। সে পুরোহিতকে একটা ঠেলা দিয়ে বললে, এটা কী বললি রে বাঞ্চোৎ ঠাকুরমশা? ছাগের বাচ্চা হবেক্ কেনে রে? কচি খোকন-সোনার মাস-খাওয়াবি বলে লোভ দেখালি বিটিরে, অখন বলিস্ ছাগের বাচ্চা? শ্শালো!
ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে পড়েছিলেন চক্কোত্তি। সেই অবস্থাতেই বলেন, ওই হল। বিটি জানে কী খাওয়াব। কিন্তুক কাল কোতোয়াল-শালা শুধোলে তো ছাগশিশুই বলতে হবে, না কি বল? অঘোর জবাব দিতে পারল না। তখনই দ্বারপ্রান্তে দেখা গেল একজনকে। লোকটা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে বললে, সর্দার! সে শালা বিচ্ছু কি এদিক বাগে এয়েছে?
—কার কতা শুধাস্ রে কেলে? কোন বিচ্ছু?
—বলির ‘পশু’টো। বাঁধন খুলি জঙ্গলে ছিপাইছে।
মুহূর্তে নেশা ছুটে যায় অঘোরের। প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল অনুচরের গণ্ডদেশে। কালী-চাঁড়াল প্রতিবাদ করল না। শাস্তিটা তার প্রাপ্য। তার হেপাজত থেকে বন্দী পলায়ন করলে তাকে চপেটাঘাত সহ্য করতে হবে বৈকি! এক লাফে উঠে দাঁড়ায় অঘোর চণ্ডাল। কে বলবে পূর্বমুহূর্তে সে মাতলামি করছিল। বললে, আয়, চ, জঙ্গল ছুঁড়ে দেখি। যাবে আর কদ্দূর?
চক্কোত্তি কিন্তু উঠে বসেন না। শুয়ে শুয়েই স্বগতোক্তি করেন, যাঃ শালা। খসল দশ-দশটি সিক্কা টাকা।
অঘোর আর কালী বেরিয়ে গেল খুঁজতে। মহাদেব চণ্ডালী “মাকেই গাল পাড়তে থাকেন, অ্যাই তোর বিচার হল? সারাটি দিন মুখে কুটোটি কাটিনি, আর মাঝরাতে গাঁট কাট্লি? আড়াইগণ্ডা সিক্কা টাকা।
সব ভালো যার শেষ ভাল। আধঘণ্টাখানেক পরেই ফিরে এল ওরা দুজন। বালকটিকে পাওয়া গেছে। মন্দিরের বাহিরেই বৃক্ষান্তরাল থেকে সে দেখছিল ওদের কাণ্ড-কারখানা। অঘোর তার গামছাটা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে কাঙালীচরণের মুখটা। তার হাত-পা শক্ত করে বাঁধা। দুজনে চ্যাঙদোলা করে নিয়ে এল বলির ‘পশু’কে।
ঘরে একটি মাত্র ঘৃতপ্রদীপ জ্বলছে। সেই ক্ষীণ আলোকে মহাদেব চিনতে পারলেন না সন্তানকে। বললেন, ভয় কি রে শালা। এখনি ঁমায়ের কোলে গিয়ে বসবি। আয়, তোর কপালে ফোটা-তিলক কেটে দিই! কাঙালী হাত-পা নেড়ে কী যেন বলতে গেল, শোনা গেল না। অঘোর ওকে কোল পাঁজা করে এগিয়ে নিয়ে এল।
মহাদেব ওর মাথা পবিত্র গঙ্গোদক সিঞ্চন করলেন। গলায় পরিয়ে দিলেন রাঙাজবার একটি মালা। নিজের দক্ষিণহস্তের মধ্যমা চেপে ধরলেন খড়ো। রক্ত-ফুটে বার হতেই সন্তানের ভূমধ্যে এঁকে দিলেন রক্ততিলক। আদর করে ওর গাল দুটো টিপে দিয়ে জড়িতকণ্ঠে বললেন, লক্ষ্মী বাপ্ আমার। এ্যাই শালারা মুখের বাঁধন আলগা করে দিলেই প্রাণভরে একবার হাঁকাড় পাড়বি–’মা!’বুঝলি? তাহলেই ঁমায়ের কোল! মুখটি বুজে থাকিস না বাপ্। নইলে শালারা আগুনের ছ্যাঁকা দেবে। সে বড় কষ্ট! বড় যন্তন্না!
বালক তখন অঘোরের বাহুবন্ধে আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে।
মহাদেব ধমকে ওঠেন তাঁর যজমানকে, দেরি করছিস্ কেন শালা! এ দৃশ্য কি চোখ চেয়ে দেখা যায়? যা, কাম সারা কর!
কালী জানতে চায়, উছ্ছুগ্যু হই গেল?
–না তো দেখলি কী অ্যাতক্ষণ? শালাহ!
কালী আর অধর চ্যাঙদোলা করে বালকটিকে নিয়ে গেল মন্দির চাতালের যূপকাষ্ঠে। যদি প্রয়োজন হয় মনে করে ঘৃতপ্রদীপটি হাতে নিয়ে মহাদেব চক্কোত্তি এগিয়ে এলেন পিছন-পিছন!
হাড়িকাঠে ফেলা হল কাঙালীকে। কালী ওর হাত পায়ের বাঁধন খুলে পিছন থেকে সজোরে টেনে ধরল ঠ্যাঙ-জোড়া। গলাটা সরু লম্বা হয়ে গেলেই কাম সারার সুবিধা! অঘোর খাঁড়াখানা নামিয়ে রেখে এতক্ষণে খুলে দিল ওর মুখের বাঁধন। গলাটা এক বিঘৎ লম্বা হয়ে গেছে। তবু বাঁধন খুলে দিতেই কাঙালী আপ্রাণ প্রয়াসে আর্তনাদ করে ওঠে : বা–বা!
মহাদেব গর্জন করে ওঠেন : শালাহ্! কী বললাম এতক্ষণ? বাবা নয় রে! বল : মা—! কাঙালী তবুও বললে, বা–বা! আ–মি!
—যাঃ শালাহ্!
অঘোর চণ্ডালের খড়্গা ভীম বেগে নেমে এল যূপকাষ্ঠের দিকে!
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল চক্কোত্তির। হোক শুভকাজ! ঁমায়ের পূজা! তবু একটা মানব শিশু তো! সেই কাঠুরিয়া দম্পতি বোধ করি এখনো বনে-জঙ্গলে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের নিরুদ্দিষ্ট সন্তানকে!
ঠিক তখনই কালীচরণ সন্ত্রস্ত হয়ে ফিসফিসিয়ে ওঠে, কে যান্ আসতিছে!
দুজনেই চকিতে সে দিকে দৃকপাত করেন। ঠিক কথা! মশাল হাতে কে যেন এগিয়ে আসছে। অঘোর খাঁড়াটা বাগিয়ে ধরে। কিন্তু ও কী!
যে আগিয়ে আসছে সে পুরুষ নয়, স্ত্রীলোক!
স্ত্রীলোক! এই ঘোর অমাবস্যা রাত্রে শ্মশানভূমিতে! একা! কী চায় সে! কেন ও অমন পাগলের মতো ছুটে আসছে?
কালী স্বগতোক্তি করে, কে বটে গ! মাইয়া ছেলে বটে! ভয়-ডর নাই নি কি!
মহাদেব চক্কোত্তির নেশা ছুটে গেছে এতক্ষণে। কালী আর অঘোর ফেরারী ডাকাত—তাদের মাথার উপর পুরস্কার ঝুলছে; কিন্তু তিনি যে সংসারী মানুষ! বউ-ছেলে নিয়ে সংসার করেন! এই নরবলির একটা সাক্ষীকে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারেন না উনি হিসহিসিয়ে ওঠেন, কেলে! ধর মাগীটাকে। শালীটাকেও উছছুগ্যু করে দিই। মায়ের থানে আজ জোড়া…
কালী ততক্ষণে চিনতে পেরেছে। বলে, কী বুলছ ঠাউর! ও তো মাঠান বটে!
—মাঠান! মানে! আরে, হ্যাঁ, তাই তো।
নিরুপমা উন্মাদিনীর মতো ছুটে আসে। বলে, খোকাকে দেখেছ? খোকা?
—খোকা! কাঙালী? সে তো তোমার কাছে শুয়েছিল।
ততক্ষণে মশালের আলোয় মা দেখতে পেয়েছে যূপকাষ্ঠের ওপ্রান্তে তার সন্তানের নিমীলিতনেত্র মুণ্ডটা আর এ-প্রান্তে কাটাপাঁঠার মতো স্পন্দিত হচ্ছে বাকি দেহটা! নিরুপমা মূর্ছিতা হয়ে লুটিয়ে পড়ল যূপকাষ্ঠের উপর।
মহাদেব তখন থরথর করে কাঁপছেন! এ কী হল! এ কী হয়ে গেল! ভ্রান্তি! কী মর্মান্তিক ভ্রান্তি! বুঝলেন, কেন ঐ বলির ‘পশুটা মৃত্যুমুহূর্তে মায়ের বদলে পিতার করুণা ভিক্ষা করেছিল!
অঘোর এগিয়ে আসে এক-পা। বলে, ঠাউর! বাঁচতি চাও তো মাগের ললাটে এটা ফোঁটা কাটে অরে উচ্ছ্বগ্য করি দাও! নাইলে জানাজানি হয়ি যাবেই!
মহাদেব ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন মুহূর্তে! ব্রাহ্মণ ততক্ষণে চণ্ডাল! দ্রুতহস্তে এক খণ্ড পাথর তুলে নিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করলেন অঘোরকে লক্ষ্য করে। উন্মত্তের মতো তিনি লাফাচ্ছেন আর চিৎকার করছেন—হারামজাদা! তোদের সব কটাকে ধরিয়ে দেব। ফাঁসিতে ঝোলাবো!
অঘোর এটা আশঙ্কা করেনি। তার কপালে এসে লাগল পাথরের টুকরোটা। দরদর ধারে রক্ত ঝরল। চণ্ডালের রাগ! মত্তাবস্থায়! তার হস্তধৃত খড়্গটা নৈশ আকাশে একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করল। ছিন্নশির ব্রাহ্মণ লুটিয়ে পড়লেন মূর্ছিতা স্ত্রী ও মৃতপুত্রের দেহের উপর!
তিন-তিনটি মৃতদেহ বিক্রয় করে অঘোর চাঁড়াল কী পরিমাণ কাঞ্চনমূল্য সংগ্রহ করেছিল সেটা এই উপকথার নেপথ্য তথ্য। বাস্তবে উপকথার উপসংহার—যেটা আমি সংগ্রহ করেছিলাম—তা ভিন্ন প্রকারের।
তোমরা যদি কখনো হরিপালের চণ্ডালীমায়ের মন্দিরে—না, ওর নাম এখন মা বিশালাক্ষী—তীর্থ করতে যাও, তাহলে লোকগাথার ভিন্নতর উপসংহারটা সহজেই সংগ্রহ করতে পারবে। নেহাৎ যদি অতদূরে যাওয়া সম্ভব না হয় তাহলে সুধীর কুমার মিত্রমশায়ের ‘হুগলী জেলার দেবদেউল’ গ্রন্থে (প্রথম সংস্করণ, পৃ: ৩৯) অথবা অম্বিকাচরণ গুপ্তের ‘হুগলী’তে (পৃ: ১০৫) সে তথ্যটা পাবে। পড়ে নিও।
আমার কলমটা এমন বে-আদপ, বে-আক্কেলে, নাস্তিক, যে সেই ‘বিশ্বাসে-মিলায়ে সাঁই’ তত্ত্বটা লিপিবদ্ধ করতে পারল না। শুধু অবিশ্বাসী, একবগ্গা বলে নয়—কলমের যুক্তি : এটা অযৌক্তিক! সেই অলৌকিক উপসংহারটা নরবলি বন্ধের লৌকিক উপসংহার হতে পারে না-
“ব্রাহ্মণ-দম্পত্তির কাতর ক্রন্দনে দেবী প্রসন্না হইয়া দৈববাণীতে কহিলেন, বালক হাটতলায় খেলা করিতেছে, সেখানে খুঁজিলেই পাইবে। অতঃপর আর এখানে নরবলি হইবে না। “ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী হাটে আসিয়া তাঁহাদের পুত্রকে দেখিতে পাইয়া কোলে লইলেন, সেই অবধি এখানে নরবলি বন্ধ হইয়া গিয়াছে।”
কাহিনীর এই মিলনান্তক উপসংহারটি যদি মেনে নিতে পার তাহলে তো কথাই নেই, নাহলে মহাদেব চক্কোত্তির জন্য তোমরা কি দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলবে না? বেচারি লঘুপাপে গুরুদণ্ড পেল। নয় কি? শাস্ত্রবাক্য লঙ্ঘন তো সে একবার মাত্র করেছে। অঘোর চাঁড়ালের ঐ অন্তিম হুঁশিয়ারিটা অগ্রাহ্য করা :
‘ঠাউর! বাঁচতি চাও তো মাগের ললাটে এট্টা ফোঁটা কাট্টে অরে উছছুগ্যু করি দাও!’
ফোঁটা-কাটা বামুন হয়ে তাঁর স্মরণে থাকা উচিত ছিল শাস্ত্রীয় পবিত্র রাজধর্মের নির্দেশটা :
“আপদর্থে ধনং রক্ষেৎ দারান রক্ষেদ্ধনৈরপি।
আত্মানম্ সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি।।”।[১]
[১. আপদবিপদের জন্যই টাকার সঞ্চয়। কিন্তু গিন্নি যদি বিপদে পড়েন টাকা-কড়ি খরচ করতে পিছপাও হয়ো না বাপু। আর নিজেই যদি ফ্যাসাদে পড়, তখন কী বা অর্থ; কী বা গিন্নি! সব ছেড়ে তখন মন্ত্ৰ : চাচা! আপন প্রাণ বাঁচা!]