তিন মিনিটের গল্প
বুঝলি, আজ একটা দুসেরী রুই ধরেছি।–আঃ–যা আরামে খেলুম, সে আর তোকে কী বলব।
–দুসেরী রুই? কোথায় পেলি রে? কোথাও বাইরে থেকে ধরে এনেছিলি বুঝি?
বাইরে যাব কোন্ দুঃখে। এখানেই পেয়ে গেলুম।
বলিস কী! কোন পুকুরে?
–ঘোষেদের পোড়ো বাড়িটার ভেতর একটা ডোবা আছে, দেখেছিস? যেখানে কটা ঝুপসি গাছ রয়েছে?
–কেন দেখব না? কালও তো ওখানে একটা ঘুড়ি গিয়ে পড়েছি, ঢুকে নিয়ে এলুম।
–ওই ডোবা থেকেই মাছটা পেয়েছি।
–আঁ, ওই ডোবায়? গুল দেবার আর জায়গা পাসনি? ওতে মাছ? একটা গুগলিও তো আছে বলে মনে হয় না। ঢিল-পাটকেল ছুঁড়লে এক-আধটা ব্যাঙ-ট্যাং লাফিয়ে ওঠে, দেখেছি। ওখানে মাছ? চালিয়াতি করতে হলে অন্য কোথাও যা–আমার কাছে সুবিধে হবে না।
আহা-হা, আগেই খেপছিস কেন? আগে শোন-ই না ব্যাপারটা।
কী আবার শুনব? যা খুশি তাই বলবি আর সে কথা আমায় বিশ্বাস করতে হবে? থাম-থাম।
–আচ্ছা, থামছি। কিন্তু তুই নিজেই জানিসনে, কী হারাচ্ছিস।
বলে যা তবে। দেখি গুলবাজি কতটা চালাতে পারিস।
গুলবাজি? আচ্ছা, কান পেতে আগে শুনে যা সবটা।
বুঝলি, সাত আট দিন মাছ খাইনি, মেজাজটা একেবারে সপ্তমে চড়ে গেল। এমন কি বাড়ির বেড়ালটা পর্যন্ত এত খেপে গেল যে, খামকা সকাল বেলায় এসে আমার পায়ে খাক করে কামড়ে দিলে। তখন ভাবলুম, এসপার কি ওসপার। ওই ঘোষেদের ডোবাতেই গিয়ে ছিপ ফেলব, আর কিছু না পাই, ব্যাঙই ধরে আনব গোটাকতক। ফরাসীরা তো ব্যাঙ খায়, আর বেশ ভালোই খায় বলে শুনেছি।
ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর, চারদিক খাঁ খাঁ করছে। যাকে বলে ঠিক দুক্কুর বেলা, ভূতে মারে ঢ্যালা। সেই সময়েই ছিপ নিয়ে বেরুলুম। যাতে লোকে দেখতে না পায়, ঠাট্টা-ফাট্টা না করতে পারে।
গিয়ে দেখি, বৃষ্টির জলে ডোবাটা খানিক ভরেছে, নীলচে নীলচে শ্যাওলা ভাসছে তাতে, ব্যাঙাচি ল্যাজ-ট্যাজ নিয়ে সাঁতার কাটছে, মাঝে মাঝে কিসে যেন আবার ভুড়ভুড়ি কাটছে। জলটায় থেকে থেকে আবার কী যেন বিচ্ছিরি গন্ধ উঠছে! দেখেই মন ব্যাজার হয়ে গেল। মাছ তো মাছ-তার একটা আঁশ পর্যন্ত এতে পাওয়া যাবে না।
চেয়ে দেখলুম, কেউ কোথাও নেই। শুধু কালো-মতন একটা ষণ্ডা লোক ময়লা একটা গামছা পেতে গাছতলায় ভোঁস ভোঁস করে ঘুমুচ্ছে আর ফর ফর করে নাক ডাকাচ্ছে।
তা ডাকাকগে–আমার কী! আমিও একটা ঝুপসি-মতন গাছের নীচে বসে পড়লুম, তারপর বার কয়েক তারা-তারা-ব্রহ্মময়ী বলে জলে বঁড়শি ফেললুম।
ফেলেছি তো ফেলেইছি–ফাতনা নট নড়নচড়ন। আরে মাছ থাকলে তো খাবে! বসে বসে মাজা ধরে গেল, ফাতনার দিকে চেয়ে চেয়ে চোখ টনটন করতে লাগল, রেগেমেগে ভাবতে লাগলুম, খামকা এমন ধাষ্টামোও করে।
তা হলে দুসেরী মাছ উঠল কোত্থেকে?
ধেত্তেরি, দাঁড়া না একটু। অত বকর বকর করলে চলে? আমি তো বসেই আছি। ইদিকে আবার কোত্থেকে দুটো ফড়িং এসে হাজির হয়েছে, বসবার আর জায়গা পেলে না, খালি ফাতনার দিকেই তাক!
বসে থাকতে থাকতে ফড়িংগুলোর ওপরেই রাগ হতে লাগল। রাগ হতে হতে পিত্তি জ্বালা করতে লাগল। তখন ওগুলোকে তাড়াবার জন্যেই ঘ্যাঁচ করে বঁড়শিতে এক টান।
–তারপর? মাছ উঠে এল?
না–মাছ নামল।
–নামল। সে কী? কোত্থেকে নামল? হি-হি-হি
খুব হাসছিস যে। আচ্ছা, আর একটু শোন।
-যেই টান মেরেছি, বুঝলি–বঁড়শি সোজা গিয়ে গাছের ঝাঁকড়া ডাল-পাতার মধ্যে আটকে গেল! যতই টানি কিছুতেই আর নামে না। শেষে মরিয়া হয়ে দাঁত মুখ সিঁটকে যেই আর একখানা পেল্লায় টান মেরেছি–অমনি ঝ-র-র–আমার পিঠের ওপর ঝপাং।
কী ঝপাং?
–শূন্য থেকে একটা বিরাশী সিক্কার কিল। ব্যস, আমি চিতপটাং।
–তাপ্পর? কে কিল মারল? ভূতে?
না রে, না–একটা দুসেরী রুই মাছ। গাছ থেকে ধপাং করে আমার পিঠে নেমে পড়েছে।
–গাছ থেকে দুসেরী রুই মাছ! হা-হা-হা-হো-হো-হো, আর হাসাসনি প্যালা, খিল ধরে মরে যাব। তুই নিশ্চয়ই গাঁ
খবরদার, যা-তা বলিসনি! চুপ করে শুনে যা! মাছটা পড়ল–আমি উঠে বসলুম, আর হাঁ করে রামছাগলের মতো চেয়ে রইলুম সেদিকে। আর তখন
–কখন?
–সেই ষণ্ডা লোকটা–যে ময়লা গামছা পেতে ঘুমুচ্ছিল, সে উঠে পড়ল তড়াক করে। চোখ মিটমিট করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল আমার দিকে। তারপর ফিসফিসিয়ে বললে, গাছে মাছের ঝুড়িটা লুকিয়ে একটু ঘুমুচ্ছিলুম, সেখান থেকেও মাছ টেনে নাবালে! তোমারই বরাত জোর। যা হোক–ওটা তোমায় দিলুম–বাড়ি গিয়ে খেয়ো, কিন্তু কারুকে বোলো না–কোনও পুলিশ-টুলিশকেও না।
বলেই তড়বড় করে গাছে উঠে, কোত্থেকে মস্ত একটা মাছের চুবড়ি নামিয়ে, সেটায় চট ঢাকা দিয়ে চট করে যে কোনদিকে হাওয়া দিলে, আর আমি দেখতেই পেলুম না।