2 of 2

তিনতলার ঘর – রমানাথ রায়

তিনতলার ঘর – রমানাথ রায়

তিনতলা বাড়ি। একতলায় তিনখানা ঘর। একটা রান্না ঘর। একটা বসার ঘর। আর একটা শোবার ঘর। শোবার ঘরে আমার বুড়ি থাকে, নাতি নাতনি থাকে। দোতলায়ও তিনখানা ঘর। একটা ঘরে বড় ছেলে থাকে, বড় বউ থাকে। আর একটা ঘরে ছোট ছেলে থাকে, ছোট বউ থাকে। বাকি ঘরটায় আমার মেয়ে থাকে। কিন্তু তিনতলায় মাত্র একখানা ঘর। সে ঘরে আমি একা থাকি।

সব সময় একা থাকতে ভাল লাগে না। বুড়ির সঙ্গে এক একদিন কথা বলতে ইচ্ছে করে।

সকালে নাতনি চা নিয়ে আসে। তার হাত থেকে চা নিয়ে একটা চুমুক দিই। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করি: তোর ঠাকমা কি করছে?

—চা খাচ্ছে।

—চা খাওয়া হলে পাঠিয়ে দিস।

—আচ্ছা।

তারপর নাতনি যাবার জন্যে দরজার দিকে পা বাড়ায়। আমি তাকে এই সময় আবার জিজ্ঞেস করিঃ কি বলবি বলত!

—বলব তুমি ডাকছ।

—হ্যাঁ…খুব দরকারি কথা আছে।

নাতনি চলে যায়। আমি চা খেতে থাকি। চা খাওয়া হলে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে দিই।

একটু পরে চায়ের কাপ নিতে নাতনি আবার ঘরে ঢোকে। আমাকে জানিয়ে দেয়: ঠাকমা এখন আসতে পারবে না।

—কেন?

—কুটনো কুটছে।

—কুটনো কুটছে কেন? তোর মা কি করছে?

—রাঁধছে।

—কাকিমা?

—আটা মাখছে।

—পিসি?

—পড়ছে।

—তুই?

—এবার পড়তে বসব।

আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। আমি আর কিছু জানতে চাই না। শুধু বলি: কুটনো কোটা হলে একবার আসতে বলিস।

নাতনি চায়ের কাপ নিয়ে চলে যায়! আমি চুপচাপ ইজিচেয়ারে বসে থাকি। আমার ঘরের সামনে ছাদ। ছাদে রোদ ছড়িয়ে থাকে। আমি আর রোদে যাইনা। ঘরে নানা বই আছে। মাঝে মাঝে দু-একটা বই খুলে পড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে পারি না। পড়তে ইচ্ছে করে না।

বেলা বাড়তে থাকে। আমি একা একা বসে থাকি। বুড়ি আসে না। বুড়ির ওপর আমার রাগ হয়। বুড়ি আজকাল কি রকম হয়ে গেছে। বুড়ি আগে এ রকম ছিল না। যা বলতাম তাই শুনত। এখন ছেলেমেয়ে, বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে আছে। আমার কথা আর মনে পড়ে না। আমার কথা ভুলে গেছে। একটু পরে নাতি এক গ্লাস দুধ আর আধ প্লেট সুজি নিয়ে আসে। টেবিলে রেখে দেয়।

আমি জিজ্ঞেস করি: তোর পড়াশুনো নেই?

—পড়ছিলাম তো।

—তাহলে পড়া ছেড়ে উঠে এলি কেন?

—ঠাকমা বলল যে।

—ঠাকমা নিজে আসতে পারল না?

নাতি কথার উত্তর না দিয়ে যাবার জন্যে দরজার দিকে পা বাড়ায়। তাকে এই সময় বলিঃ তোর ঠাকমাকে একবার পাঠিয়ে দে। কথা আছে।

—আচ্ছা।

নাতি চলে যায়। আমি একটু একটু করে সুজি খাই। সুজি খাওয়া হলে দুধ খাই। দুধ খেয়ে আবার চুপচাপ বসে থাকি।

একটু পরে নাতি দুধের গ্লাস আর সুজির প্লেট নিতে আবার ঘরে ঢোকে। আমাকে জানিয়ে দেয়ঃ ঠাকমা এখন আসতে পারবে না।

—কেন?

—রুটি সেঁকছে।

—রুটি সেঁকা শেষ হবে কখন?

—আমি কি করে বলব?

আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। আমি আর কিছু জানতে চাই না। শুধু বলি: রুটি সেঁকা হলে একবার আসতে বলিস। নাতি চলে যায়। আমি চুপচাপ বসে থাকি।

বেলা বাড়তে থাকে। ঠিক বারোটা বাজলে আমার খিদে পায়। আমি স্নান করে নিই।

ছোট বউ ভাতের থালা আর জলের গ্লাস নিয়ে আসে। টেবিলে রেখে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করি: তোমার শাশুড়ির রুটি সেঁকা হয়েছে?

ছোট বউ হাসতে হাসতে বলে: হ্যাঁ।

—এখন কি করছে?

—স্নান।

ছোট বউ তারপর যাবার জন্যে দরজার দিকে পা বাড়ায়। তাকে এই সময়ে বলি: স্নান হলে শাশুড়িকে একবার আসতে বোলো।

—আচ্ছা।

ছোট বউ চলে যায়। আমি খেয়ে দেয়ে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ি।

বেলা বাড়তে থাকে। এক সময় আমার ঘুম পায়। আমার চোখের পাতা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসে। হঠাৎ আবার পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ছোট বউ ভাতের থালা গ্লাস নিতে ঘরে ঢোকে। আমাকে জানিয়ে দেয়: মা এখন আসতে পারবে না।

—কেন?

—শুয়ে পড়েছেন।

কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগে। আমার বুড়ি আর সে রকম নেই। এখন ভীষণ বদলে গেছে। এখন আমাকে দুটো ভাত দিয়েই নিশ্চিন্ত থাকে। আমার কাছে একবার আসার প্রয়োজন বোধ করে না।

ছোট বউ টেবিল মুছে ভাতের থালা গ্লাস নিয়ে চলে যায়। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি।

ঘুম থেকে উঠতে বিকেল হয়ে যায়। চোখ মুখ ধুয়ে ইজিচেয়ারে বসে থাকি। এক সময় মেয়ে চা নিয়ে আসে। আমি তার হাত থেকে চা নিয়ে একটা চুমুক দিই। মেয়ে ঘর ঝাঁট দেয়। বিছানা ঠিক করে।

আমি চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করিঃ আজ কলেজ গিয়েছিলি?

—হ্যাঁ।

—কখন ফিরলি?

—একটু আগে।

—পরীক্ষা কবে?

—দেরি আছে।

এরপর কি জিজ্ঞেস করব তা মাথায় আসে না। তাই একটু পরে আচমকা জিজ্ঞেস করে বসিঃ তোর মা কি করছে?

—মা বাড়ি নেই।

—কোথায় গেছে?

—জানি না।

—ফিরবে কখন?

—কিছু বলে যায়নি।

আমি এবার চুপ করে যাই। মেয়ে ঘরের কাজ শেষ করে। আমারো চা খাওয়া শেষ হয়। তারপর মেয়ে চায়ের কাপ নিয়ে যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ায়। এই সময় তাকে বলি: তোর মা বাড়ি ফিরলে একবার আসতে বলিস।

—আচ্ছা।

মেয়ে চলে যায়। আমি একা বসি থাকি। বেলা পড়ে আসে। সন্ধে হয়। চারদিকে অন্ধকার বেড়ে যায়।

বড় ছেলে হয়তো এতক্ষণে বাড়ি ফিরেছে। ছোট ছেলেরও বাড়ি ফেরার সময় হল। বিয়ের আগে ছোট ছেলে রাত করে বাড়ি ফিরত। এক একদিন বারোটা বেজে যেত। কত বলা হয়েছে এ নিয়ে। কিছু হয়নি। এখন কিছু বলতে হয় না। এখন সন্ধে হলেই বাড়ি ফেরে। তবে আমার ঘরে উঁকি দিতে আসে না। না বড় ছেলে, না ছোট ছেলে। ওরা অফিস যায় আর বাড়ি ফেবে। কোনওদিন বউকে নিয়ে সিনেমা যায়। কোনওদিন বাড়িতে বসে গল্প করে। মাঝে মাঝে ওদের কথা ভেসে আসে। হাসি ভেসে আসে। এক একদিন আমার নীচে নেমে যেতে ইচ্ছে করে। ওদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার কথা কে শুনবে? আমার কি বলার আছে?

দেখতে দেখতে রাত বাড়তে থাকে। আমি ঘরে আলো জ্বালিয়ে বসে থাকি। দু-একটা বই খুলে পড়ার চেষ্টা করি। পড়তে পারি না। পড়তে ইচ্ছে করে না। ছাপার হরফ আর আমার ভাল লাগে না। আমার কফি খেতে ইচ্ছে করে। ঘর থেকে ডাকিঃ বড় বউমা! বড় বউ আমার কথা শুনতে পায় না। আমি এবার ডাকি ছোট বউমা। ছোট বউ আমার কথা শুনতে পায় না। আমি তারপর একে একে মেয়েকে ডাকি, ছেলেদের ডাকি, নাতি-নাতনিদের ডাকি। কেউ সাড়া দেয় না। কেউ আমার কথা শুনতে পায় না। শেষে বুড়িকে ডাকি। বুড়িও সাড়া দেয় না। বুড়িও আমার কথা শুনতে পায় না।

রাত বাড়তে থাকে। আমার আর বসে থাকতে ভাল লাগে না। শুয়ে পড়ি। ঘরে আলো জ্বলতে থাকে।

এক সময় বড় বউ রুটির থালা আর জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে আসে। টেবিলে রেখে দেয়।

আমি উঠে জিজ্ঞাসা করি: তোমরা কি করছিলে?

—কেন?

—আমি তোমাদের এত ডাকলাম।

—কই! শুনতে পাইনি তো।

এর কি উত্তর দেব? কি উত্তর আছে? ক’ বছর আগে হলে ঠিক শুনতে পেত। এখন না শুনলেও চলে। আমি তাই চুপ করে থাকি।

বড় বউ জিগ্যেস করেঃ কিছু বলছিলেন?

—একটু কফি খাব ভেবেছিলাম।

—এখন করে আনব?

—যাক, আর দরকার নেই।

বড় বউ একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ায়। এই সময় তাকে জিগ্যেস করিঃ তোমার শাশুড়ি কি সারাদিন খুব ব্যস্ত!

—কেন?

—সারাদিনে একবার ওপরে আসার সময় পেল না।

—এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বড় বউ চলে যায়। আমি আস্তে আস্তে রুটি চিবোতে থাকি। আমার অনেক কথা মনে পড়ে। সে বহু বছর আগের কথা। তখন আমি আর বুড়ি প্রতিদিন রাত্রিবেলা একসঙ্গে খেতে বসতাম। কেউ কারও আগে একা একা খেয়ে নিত না। খেতে খেতে আমাদের গল্প হত। কথা হত। তখন এই বাড়ি ছিল একতলা। তখন আমরা এক ঘরে থাকতাম। তারপর ছেলেমেয়ে হল। তারা বড় হতে লাগল। ঘরের দরকার হল। একতলা বাড়ি দোতলা হল। আমি দোতলায় উঠে এলাম। বুড়ি একতলায় থেকে গেল। দোতলায় এল না। তখনও আমরা প্রতিদিন রাত্রিবেলা এক সঙ্গে খেতে বসতাম। তারপর একে একে ছেলেদের বিয়ে হল। আবার ঘরের দরকার হল। এবার আর ছেলেমেয়ের জন্য নয়, আমার জন্যে। আমি তিনতলায় ঘর করে উঠে এলাম। বুড়ি একতলাতেই থেকে গেল। আমরা তারপর আর রাত্রিবেলা একসঙ্গে খেতে বসি না। আমি আর নীচে নামতে পারি না। নীচে নামলে আর ওপরে উঠতে পারি না। আমার এখন কষ্ট হয়। হাঁফ ধরে।

খেয়ে দেয়ে হাত মুখ ধুয়ে বুড়ির জন্যে বসে থাকি। রাত বাড়তে থাকে।

একটু পরে বড় বউ এসে আবার ঘরে ঢোকে। বড় বউ জানিয়ে দেয়ঃ মা এখন আসতে পারবেন না।

—কেন?

—খেতে বসেছেন।

আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। আমার আর কিছু জানার নেই। বড় বউ টেবিল মুছে থালা গ্লাস নিয়ে চলে যায়।

আমি কিছুক্ষণ একা একা চুপচাপ বসে থাকি। তারপর এক সময় দরজায় খিল তুলে দিই। আলো নিভিয়ে দিই। মাথার দিকে জানলা খুলে শুয়ে পড়ি। আমার ঘুম পায়। আমার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে। একটু পরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। দরজায় কে যেন জোরে কড়া নাড়ে। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিই। দেখি অন্ধকারে বুড়ি একা দাঁড়িয়ে, আছে।

এখন আমি কি বলব?

১৫ জানুয়ারি ১৯৭৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *