তালা
সেই যে টর্চলাইটের গল্পে আমাদের পুরনো কালীঘাট বাড়িতে চোরের কথা লিখেছিলাম, সেই চোর সে-রাতে টর্চলাইট ফেলে পালিয়েছিল। তারপর কিন্তু সে দু’-এক সপ্তাহের মধ্যে ওই ফেলে যাওয়া টর্চলাইটের শোকেই হোক বা অন্য কারণেই হোক আমাদের বাড়িতে আবার ফিরে আসে।
অবশ্য এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে সেই একই চোর আসেনি পরের রাতে, অন্য কোনও নতুন চোর এসেছিল। তবে সাধারণত এ রকম হয় না, এক চোর যে বাড়িতে বা যে এলাকায় চুরি করে অন্য চোর সেখানে যায় না। তবু আমাদের বাড়ির ঢিলেঢালা ভাব অন্য কোনও নতুন চোরকেও প্রলুব্ধ করেছিল এমন হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।
সে যা-হোক আমাদের এ দফার প্রসঙ্গ চোর বা টর্চলাইট নয়, এবারের প্রসঙ্গ তালা।
অনেকে হয়তো আমাকে দুঃসাহসী ভাবছেন, কারণ অল্প কিছুদিন আগেই শ্রীযুক্ত সুভো ঠাকুর অতিশয় রোমাঞ্চকর একটি নিবন্ধ লিখেছেন, বার্ষিক সংখ্যা আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩৯১, ‘তালার তল্লাশে।’ সেখানে সুভো ঠাকুর ব্যাঘ্ৰোপম, নর্তকীসদৃশ এমনকী সংগীতপরায়ণ বিচিত্র সব তালার কথা বলেছেন।।
আমার বিদ্যাবুদ্ধিতে এসবের মধ্যে যাব না। আমরা শুধু আমাদের নিজেদের তালার কথা বলব।
তখন কালীঘাটের ভগ্নগৃহে শুধু আমি আর আমার দাদা থাকি। দু’বেলা হোটেলে খাই, সকালে একটি কাজের মেয়ে এসে ঘর ঝেড়ে, জল তুলে দিয়ে যায়। আমাদের আর্থিক অবস্থা অতি সঙ্গীন; জিনিসপত্র, দ্রব্যসামগ্রী বলতে প্রায় কিছুই নেই। তালার দরকার খুব ছিল না কিন্তু আমাদের তালাটি আমরা দু’ভাই পেয়েছিলাম উত্তরাধিকার সূত্রে। দেশবিভাগের আগে পূর্ববঙ্গে আমার মাতামহের পাটের ব্যবসা ছিল। সেই পাটের গুদামের তালা। অতিকায় আকার এবং ভারী ওজন। তালাটির গায়ে লেখা ছিল, হবস অ্যান্ড ব্রাদার্স, লক অ্যান্ড কি ম্যানুফাকচারার্স, লন্ডন ১৮৭২। নীচের দিকে লেখা সেভেন লিভারস এবং পিছনে একটি নম্বর XY218 (এক্সওয়াই ২১৮)।
আমার স্বর্গত মাতামহ দেশবিভাগের পর প্রায় কিছুই আনতে পারেননি গ্রাম থেকে, শুধু এক বাক্স তালা এনেছিলেন। ওইরকম ভারী ভারী তালা প্রায় তিরিশ-চল্লিশটি। তিনি যে বাক্সে ওই তালাগুলি (সঙ্গে আর অল্প কিছু জিনিস) এনেছিলেন সেই বাক্সটি স্টিমারঘাটে বা রেলস্টেশনে কোনও একজন কুলির পক্ষে উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি।
মাতামহ কলকাতা আসার পর আত্মীয়-পরিচিতদের মধ্যে তালাগুলি বিলিয়ে দেন। ভাগে আমি আর দাদাও একটি তালা পাই। এই মহামূল্যবান তালাটি লাভ করে অগ্রজ মহোদয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ফিরে এল। কিন্তু কিছু পরে খেয়াল হল, তালা আনা হয়েছে কিন্তু চাবি কই !
সেই দিন তৎক্ষণাৎ দাদা আবার ছুটে গেল মাতামহের কাছে চাবি আনতে। মাতামহ খুব ধমকে দিলেন, ‘তোমাদের লোভ বড় বেশি। আমরা অল্প বয়সে এমন ছিলাম না। তালা পেয়েছ তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। আবার চাবি চাইছ ?’
দাদা বলল, ‘চাবি ছাড়া তালা দিয়ে কী হবে’ মাতামহ এ কথায় খুবই বিস্মিত হলেন, ‘তোমরা কি তালাটা ব্যবহার করবে ভেবেছ নাকি ?’ দাদা গুম মেরে গিয়ে বলল, ‘তবে ?’ ‘তোমাদের পূর্ববঙ্গের মাতুলালয়ের পবিত্র স্মৃতি। সারাজীবন ওই তালাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করবে, পুজো করবে।’
বিহুল দাদা ফিরে এল। পরের দিন চতুরতর আমি গেলাম। আমাকেও পূজনীয় মাতামহ প্রায় একই রকম কথা বললেন। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা গোলমেলে। মাতামহ তড়িঘড়িতে বাড়ি ছেড়ে আসতে গিয়ে তালাগুলো নিয়ে এসেছেন। কিন্তু চাবিগুলো, কোথায় আলাদা করে রাখা ছিল, সেগুলো ফেলে এসেছেন। যদি তিনি আবার গ্রামে ফিরে যেতে পারেন এবং চাবিগুলো পান, তা হলে তালাগুলো ব্যবহারযোগ্য হবে, না হলে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই ব্যবহৃত হবে।
আমরা বুঝে ফেলেছিলাম মাতামহের আর দেশে ফেরা হবে না, সুতরাং দাদা সিদ্ধান্ত নিল এ তালা রেখে কোনও লাভ নেই, তার চেয়ে আদিগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসা ভাল।
সেই সময় আমাদের মহিম হালদার স্ট্রিটের পাড়ার শেষপ্রান্তে একজন বিলেত ফেরত পাগল থাকতেন, তিনি কোনও কোনও ঠান্ডার রাত্রিতে বাড়ির সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে উদাত্ত গলায় গাইতেন,
‘লন্ডন টন্ডন গ্লাসগো,
গো ওয়েন্ট গন গো।’
দাদা যখন গঙ্গায় তালা ফেলতে যাচ্ছে তাঁঁর দেখা, কিঞ্চিৎ শুনে তিনি বললেন, ‘হবস কোম্পানির তালা গঙ্গায় ফেলতে যাচ্ছ ! এ তো টেমসে ফেলতে হবে। না হলে মহাপাপ হবে।’
আমার দাদা, চিরকাল খুব সাহেব ভক্তি ছিল তার, দাদা তালা নিয়ে ফিরে এল। হবস কোম্পানির বিলিতি তালা গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া মহাপাপ না হোক, অন্যায় হবে সেটা দাদা বুঝতে পেরেছিল।
শেষে আমরা দু’ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এত বড় তালা ফেলে রেখে লাভ নেই। আর এই ভাঙা বাড়ির সদর দরজায় যদি তালাটা ঝোলানো যায় তা হলে বাড়ির চেহারা খুব খোলতাই হবে। আমাদের একটা মরচে ধরা বারো আনা দামের টিনের তালা ছিল। আমরা ঠিক করলাম পাটগুদামের তালাটায় চাবি বানিয়ে নিয়ে অই পুরনো তালাটাকে ফেলে দেব।
এত বড় তালার চাবি সাধারণ তালা মেরামতওলারা কেউ বানাতে চাইল না। সেই বিলেত ফেরত পাগল বললেন, যদি তালাটা রেজিষ্ট্রি পার্সেল করে লন্ডনে হবস কোম্পানির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যায় তা হলে তারা বছর দুয়েকের মধ্যে চাবিশুদ্ধ পাঠিয়ে দেবে।
ডাকঘরে, জিপিওতে, কাস্টমস অফিসে অনেক ঘুরলাম বিলেতে তালা পাঠানোর কী নিয়ম, চাবিসুদ্ধ তালা ফেরত আসারই বা কী নিয়ম, কত শুল্ক, কত মাশুল, কত টিকিট—কেউ কিছু বলতে পারল না।
তখন আমরা একটা বুদ্ধি বার করলাম। আমরা মানে দাদারই বুদ্ধি, আমি শুধু সায় দিলাম। বাইরের দরজায় টিনের তালাটার নীচে একটা পেরেক লাগিয়ে এই বড় তালাটাও ঝুলিয়ে দেব। বাইরে থেকে মনে হবে দুটো তালা লাগানো রয়েছে।
অবশ্য আমাদের এই চাতুর্য খুব কাজে লাগেনি। দরজায় ডবল তালা দিয়ে দু’-চারদিন পরে একদিন রাতে আমি আর দাদা চেতলাহাটে রামযাত্রা শুনতে গেছি। ফিরে এসে দেখি বাড়িতে আবার চোর এসেছিল। সমস্ত উলোট-পালোট, তবে কিছুই পায়নি, নিতে পারেনি। শুধু যাওয়ার সময় সদরের হবসের অচল তালাটা নিয়ে গেছে, টিনের ঠুনকো তালাটি ফেলে গেছে ফুটপাতে।
দাদা খুব দুঃখিত হল। এত বড় পারিবারিক মর্যাদার জিনিস চোর নিয়ে গেল—যেন কোহিনুর বা ময়ূর সিংহাসন হাতছাড়া হয়েছে। কিন্তু দাদাই আবার তালাটা উদ্ধার করল। সতর্ক দৃষ্টি ছিল দাদার, একদিন কালীঘাট বাজারে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর চোখে পড়ল এক বন্ধু মুদির দোকানের দরজায় সেই তালাটি লাগানো। সেই হবস অ্যান্ড ব্রাদার্স, লন্ডন ১৮৭২ থেকে দুশো আঠারো নম্বর পর্যন্ত দাদা তালা উলটিয়ে মিলিয়ে দেখল। তারপর পাশের দোকান থেকে খোঁজ নিয়ে একেবারে মুদিওলার বাড়িতে। মুদির ছেলের বিয়ে তাই দু’দিন দোকান বন্ধ রেখেছে।
দাদা যখন বিয়েবাড়িতে পৌঁছাল তখন সদ্য বধূবরণ হচ্ছে। মুদিপুত্র বাসি বিয়ে সাঙ্গ করে নববধূ নিয়ে বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। দাদা এরই মধ্যে একটু আড়ালে মুদি ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে সরাসরি বলল, ‘আমাদের হবসের তালাটা আপনার দোকানে কেন লাগানো রয়েছে !’ কথাটা শুনে দোকানদারের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তারপর স্বগতোক্তি করলেন, ‘তখন রামুকে মানা করেছিলাম’, বলে তিনি, ‘রামু রামু’ বলে চেঁচাতে লাগলেন।
রামুই বর, সে এইমাত্র বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থাকে এসেছে। সে উঠোনের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আড়চোখে নববধূর সৌন্দর্য পান করছিল। তার কপালে এখনও চন্দনের ফোঁটা জ্বলজ্বল করছে, একটু আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে সাজিয়ে দিয়েছে। তাঁতের ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি, সোনার আংটি, বরের সাজসজ্জা ছাড়ার এখনও সে ফুরসত পায়নি।
পিতৃদেবের কর্কশ আহ্বান শুনে রামু এগিয়ে এল। বাবার সামনে দাঁড়াতেই নববিবাহিত পুত্রকে বাবা তেড়ে এলেন, ‘যাও এবার জেল খাটো। এক শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে, আরেক শ্বশুরবাড়িতে যাও।’ রামু কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তখন দাদা বলল, ‘আমাদের তালাটা।’ তালার কথা বলতেই রামুর মুখও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রামুর বাবা এবার কোমর থেকে দুটো চাবি বার করে রামুকে দিয়ে বললেন, ‘শোবার ঘরের তালাটা নিয়ে দোকানে লাগিয়ে দাও। আর এই ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমা চেয়ে তালাটা ফেরত দিয়ে দাও। পায়ে ধরে ক্ষমা চাও।’
সদ্যবিবাহিত রামুকে দাদা পায়ে ধরার অমর্যাদা থেকে রেহাই দিল। রামুর বাবা দাদাকে দই-মিষ্টি খাওয়ালেন, ইত্যবসরে রামু দোকান থেকে তালাটা নিয়ে এসেছে।
শুধু তালা নয়, সঙ্গে একটা চাবি। দোকানদারই বোধহয় কোনওভাবে বানিয়ে নিয়েছিল।
দাদা বলেছিল, ‘যতদিন রামুর স্বভাবচরিত্র না পালটায় এ তালা ব্যবহার করবি না। ওর কাছে আরেকটা চাবি থাকতে পারে।’ রামুর স্বভাবচরিত্র পালটানোর আগেই আমরা পাড়া পালটেছি। দাদাও বহুদিন নেই। কিন্তু হবসের তালাচাবি আছে, এখনও আমরা নিরাপদে ব্যবহার করি।