তানসেন (১৫০৬–১৫৮৫) – কিংবদন্তির গায়ক
যাঁর গান আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরাত এবং আগুন ধরাতে পারত বলে কথিত আছে, এমনই ছিল যাঁর গানের মহিমা, তাঁর নাম তানসেন। তিনি ছিলেন দিল্লির বাদশাহ্ আকবরের রাজসভার গায়ক। আকবরের নবরত্ন সভার শ্রেষ্ঠ রত্ন। তাঁর আসল নাম আতা আলি খাঁ। তানসেন ছিল উপাধি।
এখানেই শেষ নয়। এরও একটা অতীত ইতিহাস আছে। আতা আলিও তানসেনের সত্যিকার নাম নয়। আতা আলি হওয়ার আগে তাঁর নাম ছিল রামতনু বা তন্না। তানসেনের জন্ম হয়েছিল এক হিন্দুর ঘরে। পিতার নাম ছিল মাকরান্দ পাণ্ডে বা মুকন্দ পাণ্ডে। গোয়ালিয়র থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে। মুকন্দ পাণ্ডের একমাত্র পুত্র ছিলেন তানসেন। জন্ম ১৫০৬ সালে।
তানসেন বাল্যে সংগীতে দীক্ষা ও শিক্ষা লাভ করেন কাশীর বিখ্যাত ভক্তিসংগীত রচয়িতা স্বামী হরিদাসের কাছে। স্বামী হরিদাস ছিলেন শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদ গায়ক ও ধ্রুপদ রচয়িতা। ইংরেজিতে ধ্রুপদ বলতে বোঝায় ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত।
হরিদাস স্বামীর কাছে সংগীতশিক্ষা লাভ করে তানসেন আসেন রেওয়ার মহারাজা রাজারামের দরবারে।
সম্রাট আকবর যখন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তানসেনের ভাগ্য খুলে যায়। সম্রাট নিজে ছিলেন একজন সংগীতজ্ঞ। সংগীতের প্রতি ছিল তাঁর সবিশেষ আকর্ষণ।
তানসেনের অপূর্ব কণ্ঠলহরীর কথা ছড়িয়ে ছিল সারা ভারতে। তাঁর সংগীত প্রতিভার কথা শুনতে পেলেন সম্রাট আকবরও। ফলে তিনি ডেকে পাঠালেন তানসেনকে। তিনি মুগ্ধ হলেন তাঁর গানে, সেই থেকেই তানসেন সসম্মানে ঠাঁই পেলেন সম্রাট আকবরের রাজসভায়। সম্রাট আকবর খুশি হয়ে নিজের গলার বহুমূল্যবান কণ্ঠহার পরিয়ে দিলেন তানসেনের কণ্ঠে।
আর সেইদিন থেকেই আতা আলি খাঁ হয়ে গেলেন তানসেন। সম্রাট নিজেই তাঁকে তানসেন উপাধি দিলেন। তানসেন মানে সুরলহরী দিয়ে যিনি চেতনা ফেরাতে পারেন। রামতনু কেমন করে আতা আলি খাঁ হলেন তারও একিট কিংবদন্তি আছে। শোনা যায়, মুসলমান এক কন্যাকে বিয়ে করে তিনি মুসলমান হয়ে যান, আর তখনি তাঁর নাম হয় মুহম্মদ আতা আলি খাঁ।
দিল্লির রাজদরবারে আসার পর তানসেন ছিলেন সম্রাট আকবরের একান্ত প্রিয় সাথি। তিনি তানসেনকে অত্যধিক ভালোবাসতেন। শোনা যায়, তানসেন যেদিন সম্রাট আকবরের সভায় প্রথম সংগীত পরিবেশন করেছিলেন, সেইদিন সম্রাট তাঁকে যে কণ্ঠহারটি দিয়েছিলেন, তার দাম ছিল সেকালের মূল্যে প্রায় ১৮,০০,০০০.০০ টাকা।
অনেক সময় সম্রাট আকবর শুধু সামনাসামনি বসে গান শুনে তৃপ্ত হতেন না। তিনি শুনতে চাইতেন তানসেনের আপন খেয়ালে গাওয়া আপন প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত সংগীত। সেই গান শোনার জন্য তিনি এক মজার কাণ্ড করতেন। তিনি গভীর রাতে ছদ্মবেশে একাকী চুপিচুপি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন তানসেনের ঘরের পেছনে। তানসেন নিজের ঘরে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে যে গান গাইতেন, সম্রাট তা-ই মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। কিন্তু লুকিয়ে শুনতে গিয়েই তিনি একদিন ধরা পড়ে গেলেন তানসেনের কাছে। সেদিন ও সম্রাট তানসেনকে বহু মূল্যবান রত্নহার দিয়ে সন্তুষ্ট করেছিলেন। কিন্তু রত্নহার লাভ করেই নয়, তানসেন বেশি খুশি হয়েছিলেন তাঁর সংগীতের প্রতি স্বয়ং সম্রাটের এই অনুরাগ ও শ্রদ্ধার কথা জানতে পেরে।
সম্রাট আকবরের রাজসভায় আরও নামজাদা গায়ক ও সংগীতজ্ঞ ছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন মিয়া খোদাবক্স, জ্ঞান খাঁ, দারিয়া খাঁ, মিয়া মসনদ আলি খাঁ, বাবা রামদাস, সুরদাস, নবাৎ খাঁ, রাজবাহাদুর এবং আরও অনেকে। কিন্তু সম্রাট সবার চেয়ে ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন তানসেনকে। তিনি সবসময় ছায়ার মতো বিচরণ করতেন সম্রাটের সঙ্গে। আর সম্রাটও তাঁর অপূর্ব সংগীত শ্রবণ করেই বিচরণ করতেন সংগীতের অপার্থিব ভাবজগতে।
রাজদরবারে তানসেনের অভূতপূর্ব সাফল্য ও সম্রাটের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করার ব্যাপারটি অনেকের কাছেই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই ঈর্ষার কোপানলে তাঁকে একাধিকবার পড়তেও হয়েছিল। এ নিয়ে প্রচলিত আছে অনেকগুলি কিংবদন্তি।
ওই যে বলা হয়েছে, তানসেনের খ্যাতি এবং প্রতিপত্তি অনেকের মনে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল—তাই কেমন করে তানসেনকে জব্দ করা যায়, সম্রাটের সামনে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করা যায়, তার ষড়যন্ত্র চলতে লাগল গোপনে গোপনে।
অবশেষে ষড়ন্ত্রকারীরা মনে মনে এক ফন্দি আঁটল। সংগীতে অনেকগুলো সুর বা রাগ আছে, তার মধ্যে অন্যতম রাগ হল দীপক। তাঁরা জানতেন, এই দীপক রাগ গেয়ে তানসেন আগুন ধরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তার আবার বিপদও আছে। সেই সুরের আগুন তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই তাঁর আগুনেই তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হলো।
কিন্তু দীপক রাগ তানসেন গাইতেন না। এ রাগের বিপদের কথা তাঁর জানা ছিল। তাঁর গুরু স্বামী হরিদাসেরও নিষেধ ছিল।
ষড়যন্ত্রকারীরা জানতেন, তাঁরা নিজেরা অনুরোধ করলে কাজ হবে না। তাই কথাটা স্বয়ং সম্রাটকে দিয়ে বলাতে হবে। সম্রাটের অনুরোধ ফেলতে পারবেন না তানসনে। আর তা হলেই কাজ হাসিল হবে।
তাই একদিন রাজদরবারের সংগীতানুষ্ঠানের সময় তাঁরা সম্রাটকে অনুরোধ করলেন, জাঁহাপনা, আজ আমরা তানসেনের কণ্ঠে দীপক রাগ শুনতে চাই, আপনি আদেশ করুন তাঁকে।
সম্রাট কিন্তু কিছু জানতেন না। তিনিও সরল বিশ্বাসে তানসেনকে অনুরোধ করলেন দীপক রাগ গাইতে। তানসেন প্রথমে অস্বীকার করেছিলেন এই বিপজ্জনক রাগ গাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু সম্রাট বিশেষ করে অনুরোধ করাতে তিনি আর না বলতে পারলেন না।
এ ছাড়া আরও একটা ব্যাপার ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে যে একটা ষড়যন্ত্র চলছে, তা তিনি টের পাচ্ছিলেন। তাঁকে জব্দ করার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু তিনিও হেরে যাবার পাত্র ছিলেন না। তিনি নিজের শক্তিতেই এই ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে চাইলেন।
তবে তিনি এর জন্য কিছুদিনের সময় চাইলেন। সময় নিলেন প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। এই বিপদের মোকাবেলা কেমন করে করতে হবে, তা তিনি জানতেন।
তানসেনের ছিল এক মেয়ে চার ছেলে। এঁরাও ছিলেন পিতার যোগ্য সন্তান। প্রত্যেকেই ছিলেন প্রথম শ্রেণীর সংগীত শিল্পী।
তিনি জানতেন, দীপক রাগ গাওয়ার পর যখন আগুন জ্বলবে তখন সেই আগুন নেভানোর জন্য গাইতে হবে মেঘমল্লার রাগ। কিন্তু তিনি একাই তো আর দু-ধরনের গান গাইতে পারবেন না!
ফলে তিনি তাঁর নিজের কন্যা এবং ওস্তাদ হরিদাসের কন্যাকে মেঘমল্লার গানে তালিম দিতে লাগলেন। কারণ, তিনি যখন দীপক গেয়ে আগুন জ্বালাবেন, তখন তারা মেঘমল্লার গান গেয়ে সেই আগুন নেভাবেন। তানসেনের এই পূর্বপ্রস্তুতির খবর বাইরে কেউ জানতেই পারলেন না।
এদিকে নির্দিষ্ট দিনে রাজদরবার একেবারে লোকে লোকারণ্য। রাজা-বাদশা- আমির-ওমরা-সৈন্যসামন্ত ও প্রজাদের সবাই এসেছেন। মাঝখানে বসে আছেন স্বয়ং সম্রাট আকবর। যথাসময়ে বসল গানের আসর। শত্রুপক্ষের ধারণা, হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তানসেনের জীবনলীলা শেষ হয়ে যাবে।
তানসেন এসে সত্যি সত্যি শুরু করলেন দীপক রাগ। গান শুরু হওয়ার পর এক সময় সমস্ত মোমবাতিতে আগুন ধরে গেল। সভা হয়ে উঠল অগ্নিময়। আর তখনই ‘তানসেনের নিজের শরীরেও আগুন ধরে গেল। অবস্থা দেখে সবাই ছুটে পালাতে লাগলেন।
তানসেন নিজেও ছুটলেন বাড়ির দিকে। সেখানে তাঁর নিজের কন্যা আর গুরুকন্যা মেঘমল্লার গাইছেন। মেঘমল্লার রাগে আকাশ থেকে নামতে শুরু করেছে বৃষ্টির সুশীতল ধারা। তানসেন সেই ধারায় শীতল করলেন নিজের শরীর। কিন্তু তবু সহজে রেহাই পাননি, এই ঘটনার পর তিনি নাকি দীর্ঘ ছয়মাস শয্যাশায়ী ছিলেন।
তানসেনের গান নিয়ে এ ছাড়াও অনেক অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে। তিনি যেমন দীপক গেয়ে আগুন ধরাতে পারতেন, মেঘমল্লার গেয়ে নামাতে পারতেন বৃষ্টির ধারা, তেমনি দরবারি গান গেয়ে ভালো করতে পারতেন রোগীর দুরারোগ্য ব্যাধি। তিনি গান গেয়ে দিনের আলোকে আঁধার করে দিয়ে রাত নামাতে পারতেন, আবার রাতের আঁধারকে দূর করে দিনের আলোয় ভরিয়ে দিতে পারতেন চারদিক। তাঁর গানে ছিল অলৌকিক ক্ষমতা। শুধু গানে নয়, যন্ত্রসংগীতেও ছিল তাঁর অসীম দক্ষতা।
এই মহান সংগীতসাধক ৮০ বছর বয়সে ১৫৮৫ সালে পরলোকগমন করেন। তানসেনের মৃত্যু নিয়েও প্রচলিত আছে একটি কিংবদন্তি। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পুত্র এবং শিষ্যদের বলে গিয়েছিলেন—আমার মৃতদেহ মাঝখানে রেখে তোমরা সবাই একে একে গান গাইবে। যার গানে আমার ডান হাত ওপর দিকে উঠবে, সে-ই হবে আমার যোগ্য উত্তরসুরি। এই পরীক্ষায় জয়ী হয়েছিলেন তানসেনের কনিষ্ঠ পুত্র বিলাস খাঁ। তানসেনের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বিলাস খাঁই সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।