তাইপেই
ইউরোপ-আমেরিকার কবিতা উৎসব, সাহিত্য অনুষ্ঠান, নারীবাদ-মানববাদ মানবাধিকার- ইত্যাদি অনুষ্ঠানে আজ ২২ বছর যাবৎ পারটিসেপিট করছি। কিন্তু অন্য কোথাও যদি যাই, অন্য রকম দেশে? একবার আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো তাইপেই কবিতা উৎসবে। তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেই। কবিতা উৎসবের বিশাল মঞ্চে কবিতা পড়লাম। ওখানেই শেষ নয়, পরদিন এবং তার পরদিন আমাকে আরও আরও জায়গায় আরও আরও বিষয় নিয়ে বলতে হয়েছে। তাইপেই বিশ্ববিদ্যালয়। থেকেও আমন্ত্রণ, ওখানে কবিতা পড়তে হবে, সাহিত্য নিয়ে বলতে হবে, নানারকম জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে হবে। তাইওয়ানিজ সঞ্চালক ছিলেন, একজন দোভাষী ছিলেন। ওখানেও, আমি অবাক হই, একজন শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই হবেন, আমাকে নিয়ে তাঁর বইয়ে লিখেছেন, কবিতাও লিখেছিলেন আমাকে নিয়ে,বই আর কবিতা দুটোই সেদিন দিলেন হাতে।
উৎসবের আয়োজকরা অসাধারণ লোক। একজন তো নিজেই ফিল্ম মেকার। ওঁরাই আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন হাউ সিয়াও সিয়েনএর ছবি দেখার জন্য। দোকানে নিয়ে কিনেও দিয়েছিলেন এক সেট ডিভিড়ি। হাউএর ছবি দেখার পর থেকে হাউ আমার প্রিয় পরিচালকদের তালিকায় পাঁচজনের একজন হয়ে উঠেছেন। তাইপেই ছেড়ে আসার আগের রাতে অ্যাং লীর নতুন ছবি রিলিজ হয়েছিল, সেটা দেখলাম। লাস্ট, কশন। অ্যাং লী তো আমার প্রিয় পরিচালকদের মধ্য অন্যতম একজন। তাঁর ব্রোকবেক মাউন্টেন যে কতবার দেখেছি। যতবারই দেখি, চোখ জলে ভরে ওঠে। অ্যাং লীর নিজের শহর তাইপেইয়ে বসে তাইপেইয়ের সিনেমায় অ্যাং লীর ছবি দেখার আনন্দই আলাদা। লাস্ট কশন ছবিটাও অসাধারণ। গভীর রাতে হোটেলে ফিরেছি। সারারাত কি ঘুম হয়েছিল! কী জানি!
ছবিটা আমার বডিগার্ডকেও দেখিয়েছি। ওর নামটা এখন মনে নেই। ভীষণ সিরিয়াস মুখ। সবসময় একটা ব্যাগ রাখতো হাতে, ওই ব্যাগেই হয়তো রিভলভার টিভলভার ছিল। তাকে প্রথমদিন সঙ্গে বসে লাঞ্চ খেতে বললাম, কিছুতেই রাজি হলো না। রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো, বললো, আমার ডিউটি তোমাকে প্রটেক্ট করা, তোমার সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়া নয়। প্রথম দিকে ভয়ে নীল হয়ে ছিলো মেয়ে, আমি বলেছি রিলাক্স, এখানে কেউ আমাকে মারবে না, তোমার টেনশনের কিছু নেই। ধীরে ধীরে বোধহয় বুঝেছে যে তাইপেইয়ে আমাকে মারার লোক কেউ নেই। একবার তো সমুদ্রের ধারেও নিয়ে গেলো আমাকে, প্যাগোড়া দেখলাম, মিউজিয়াম টিউজিয়ামেও গিয়েছি। তবে যাবার দিন ও একতোড়ো ফুল নিয়ে এলো আমার জন্য। নিজের নাম ঠিকানার কার্ড দিলো। আর এয়ারপোর্টে যখন আমাকে বিয়ে দিচ্ছে, আশ্চর্য, ওর চোখে জল। তাইপেইয়ের সব স্মৃতি ফিকে হয়ে আসছে, কিন্তু ওই মেয়েটির চোখের জল এখনও হীরের মতো দ্যুতি ছড়ায়। ভুলতে পারি না।