তমোনাশের মন – অদ্বৈত মল্লবর্মণ
দূর ছাই। জায়গাটা তাকে ছাড়তেই হবে। তমোনাশ রায়ের আর একটা দিনও ইচ্ছা করে না এখানে থাকতে। কি নিয়ে থাকে সে এখানে? কি আছে এখানে?
ভোঁস ভোঁস করে এক-একটা ট্রেন আসে; হাত-পা ছুড়ে যেন অচল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কোনটা পাঁচ মিনিট, আর কোনটা দু মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে আবার স্টার্ট দেয়। ক্ষুদ্র প্ল্যাটফর্মে সংখ্যায় অপ্রচুর যাত্রী-যাত্রিণীরা ভিড় করে। বেরোবার একটা লোহার গেট আগলে তমোনাশ আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারা তার সঙ্গে বোঝাপড়া করে, কাকুতি করে, আবার বচসাও করে, বলে, ধনেখালির টিকেট করে ফকিরের হাটে কেন নেমেছি, শুধুচ্ছো বাবু! আমরা গরীব, আমরা খেতে পাই না, এক বেলা খাই তো দুবেলা উপোস করে থাকি। আমরা খাই না খাই তাতে তোমার কি? তাতো বলবেই। কিন্তু তোমার কি! তা, তোমার নয় তো কার! তুমিই তো টিকেটবাবু।
চেনা লোক বলেই অত সাহস! সত্যি এরা গরীব। ধনেখালির খামারে উলুখড় কেটে নামায়। সাত-আট দিন পর পর বাড়ি আসে।
আর একদল আসে। দু স্টেশন দূর থেকে ট্রেনে উঠে সপ্তাহে দুবার করে এরা এই স্টেশনে নামে। শনিবারে আর মঙ্গলবারে ফকিরের হাট বসে। এরা বস্ত্র-ব্যবসায়ী। সামান্য ইংরেজি-বাংলা লেখাপড়া জানা। বলে, উইদাউট টিকেটে আসবো না তো কি করব মশাই। চেকাররা গুটিশুদ্ধ চেনা। অত গামছা তোয়ালে ছেড়েছি কি হাওয়ার গলায় দড়ি বাঁধবার জন্যে? তাছাড়া দশ মাইলের ভিতরে, ট্রেনে চড়ি রোজ দুবার! ফকিরের হাটের বাঁধা পসারি। এসব কথা ছেড়ে দিলেও মশায়ের সঙ্গে হপ্তায় দুবার করে দেখা! উঁ, বললেই হল! উইদাউট টিকেটে যেতে পাব না!
অদ্ভুত যুক্তি! বস্ত্র ভেট দিয়ে এরা ট্রেনবাবুদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে রেখেছে। এদের বেলা তাই সবাই রুদ্ধকণ্ঠ। তমোনাশ বায়ের শুধু তমোনাশ হয় না।
কথার তোড়ে বিভ্রান্ত তমোনাশের দৃষ্টি ওদের গমনরত পথে ওদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাওয়া করে। তমোনাশ ভেবে পায় না, দুনিয়ার মানুষ মানুষ হবে কবে। এ পথ দিয়ে অনেকে হাটে যায়। শাকসব্জীর চুপড়ি মাথায় করে গরীব চাষিরা, আর জেলেরা যায় মাছের ঝাঁকা কাঁধে করে। দেখতে দেখতে তার কাছে সব পুরনো হয়ে গেছে।
তমোনাশ হাটের দুইটি রূপ প্রত্যক্ষ করে। এক, কঠোর বাস্তবের রূপ, আর এক বিলাসীর রূপ। শুধু উদরের প্রয়োজন নিয়ে ঘুরলে সব মানুষ পাগল হয়ে যেত। নিত্যকার মাছ-ভাতের উপাদান নিয়ে যারা ঘর্মাক্ত কলেবরে সারা দিন দাঁড়িপাল্লা চালিয়ে অনেক কথা হাত-মুখ ও নাড়ীর অনেক শক্তি অপচয় করে গলদঘর্ম হয়, তাদের উপহাস করেই যেন হাটের প্রত্যন্তে পসরা সাজিয়ে বসে মনোহারী দোকানদাররা। একখণ্ড চট বিছিয়ে তার উপর বেসাতির জিনিসগুলি গোছায়। লাল, নীল, হলদে, সবুজ রঙের নানা রকম শস্তা দামের সাবান। নানা রঙের রাশি রাশি পুঁতির মালা। কত রঙের কাচের চুড়ি। সুঁচ গুলিসূতা, আর রুইমাছ ধরার সরু বঁড়শি। এরা সারি সারি বসে। শোরগোল নাই, ব্যস্ততা নাই, অত দরদস্তুর নাই। কেনে যারা তারা ফাউ চেয়ে ধিক্কৃত হয় না। হাটের এ অংশ বড় বিলাসী, বড় খেয়ালী।
গ্রাম্য রেল স্টেশনের চাকরিতে নূতনত্ব নেই, একথা বলবে কে। কে বলতে পারে, এ চাকরি-জীবন একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন! ভিক্টর হিউগো আর তার ছেলে সেক্সপিয়ারের গ্রন্থাবলী পড়ে, আর সমুদ্র দেখে বন্দীজীবনের বারো বছর কাটাতে পারেন যদি, তুমি কেন পারবে না, ট্রেন-ভরা যাত্রী দেখে, তাদের চাঞ্চল্য, হাসিকান্না, তাদের ওঠানামা দেখে সারা চাকররি-জীবনটা না হোক জীবনের আরো কয়েকটা দিন? এই স্টেশন ও এই চাকরির উপর তার চরম বিতৃষ্ণার মধ্যেও এসব কথা সে ভাবে মাঝে মাঝে
এক বন্ধু একদিন বলল—ভালো লাগছে না, তুমি বলছো কি তমোনাশ? ফকির হাটের ছোট স্টেশন। তাতে দিনে পাঁচবার আর রাতে তিনবার গাড়ী যাতায়াত করে। এর ভিতরে কতো যাত্রী, কতো যাত্রিণী। তাদেব জীবনে কত ট্রাজেডি আর কমেডি। তাদের মনের ভিতর কত আশা, কত উদ্দীপনা, আর কত নৈরাশ্য! এ তো বাস্তব উপন্যাস। এর চেয়েও কি মন-গড়া কথায় ভর্তি নাটক-নভেল বেশি রোমাঞ্চকর? বন্ধুর এতগুলি কথা তমোনাশের কানে যে যায়নি, তা বুঝতে পেরেই বক্তা চুপ করলে, কিন্তু তার শেষ কথাটি তোনাশের কানকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
বন্ধুটি আরো বলল,—তোমার খালি ভাবান্তবই দেখছি তমোনাশ। এভাবে এখানে পড়ে থাকা তোমার ভালো নয়। শরীর খারাপ করতে পারে। তোমার এখন দুটি কাজ করা দরকার, প্রথম মাস দুয়েকের ছুটি নিয়ে আত্মীয়দের পরিবেশে থাকা, আর দ্বিতীয়তঃ ভালো দেখে একটি মেয়েকে বিয়ে করা।
বিয়ে করা নিয়ে ভাবতেই ভালো লাগে। কিন্তু তার ধকল সামলানোর কথাতেই যত ভয়। পাঁচ-আত্মীদের ভিতর যারা মানুষ, তাদের অত ভাবতে হয় না। গোড়াতেই যে কাউকে হোক কড়ে আঙুলে জড়িয়ে, নিজের সঙ্গে তাকে ভাল লাগিয়ে নিয়ে অনেকগুলো মানুষের কলরবপূর্ণ ভরভরাট সংসারে সুখে-দুঃখে দিন কাটানো যায়। সেই একরকমের জীবন। অত শত ভাবার, কনের রূপ-গুণ অত শত বিশ্লেষণ করার দরকার ঐ জীবনে কখনো আসে না। এই গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে পড়বার সুযোগ যে তমোনাশের আসেনি, এটা ভেবে এখনো তার স্বস্তিই বোধ হচ্ছে। এটা সত্যিই ঘটে গেলে সে সামলাতে পারত না। তা যে হয়নি, তমোনাশের মনে হয়, এ যেন বিধাতার নির্মল আশীর্বাদ।
কাজেই বিয়ে করা তার চলে না।
আত্মীয়-স্বজনের কাছেও তার যাওয়া চলে না। কেননা, এক সময়ে তার যখন টাকাকড়ি ছিল না, যাদের সে আত্মীয় বলে দাবি করতে পারত, তারা তাকে দেখতে পারেনি। আজ তার অনেক টাকা হয়েছে অর্থাৎ গরীবদের কাছে অর্থের যে পরিমাণকে অনেক মনে হবে, সে টাকা তার হয়েছে। তাই দেখে আত্বীয়েরা যে তাকে অতিরিক্ত আদর দেখাবে, একথা সত্য। কিন্তু সে আদর সে সইবে কেমন করে?
একদিনের একটা দৃশ্য তোমোনাশের মন থেকে আজো মুছে যায়নি।
সেদিন বিকালের ট্রেন। অনেকগুলি যাত্রী নামল, এগিয়ে এল বেরোবার গেটের দিকে। তমোনাশ এক-এক করে ছাড়পত্র আদায় করে তাদের বাইরে যাওয়ার অধিকার দিতে লাগল। মন বেশ প্রসন্ন ছিল সেদিন। সকলের শেষে এগিয়ে এল তিনজন যাত্রী। অপরাধী যাত্রী তারা তিনজনেই। সকলের শেষে পঞ্চাশোর্ধ্বের ফতুয়াও নাই। অদ্ভুত এক জড়ত্বকে প্রাণপণ বলে ঠেলে ঠেলে যেন সে এগিয়ে আসছে। বৃদ্ধের সঙ্কটখানা চট করে বুঝে নিয়ে বললে, আর একখানা টিকেট কই?
পশ্চাতে আর একটি কাপড়ের পুঁটুলি। পা থেকে মাথা অবধি সাদা থান কাপড়ে ঢাকা। ঘাড় নীচু করা। তাই মুখ দেখা যায় না। অনেকগুলি কথা বলতে গিয়ে বৃদ্ধ বিশেষ কিছুই বলতে পারল না। কিন্তু তমোনাশের যা বোঝবার প্রয়োজন ছিল, তা সে বুঝে নিল—সবকিছু বেচে বিয়ে দিয়েছিল। সেই জামাই মরেছে। শাশুড়ি আর দেবরেরা অলক্ষুণে বলে একে খুব মেরেছে। গলায় দড়ি না হয় কলসী দিতে আদেশ করেছে। এসব না পারে তো বাপের বাড়ী চলে যাক এ-ও বলেছে। একদিন দুটো খেতে দিয়ে দুদিন উপোস রেখেছে।
তা না হয় রেখেছে। কিন্তু একখানা টিকেট করেছেন, আর একখানা করলে কি মাথা যেত?
তা যেত না। কিন্তু পয়সা কোথায়। খবর পেয়ে হাঁটাপথে যাই। মা মরা ঐ একটিমাত্র ধন। ওদের না হয় কেউ নয়, কিন্তু বুড়োর যে অনেকখানি। হাঁটিয়ে তো আনতে পারি না। চেয়ে চিনতে একখানা টিকেটের ভাড়া জোগাড় করেছি, কিন্তু আর একখানার জোটেনি।
জোটেনি তা কি করব। রেল কোম্পানি দানসত্র খুলে বসেনি। বিনা টিকিটে রেলে চড়লে জেলে যেতে হয় তা জান?
জানি। কিন্তু জেনেও এ না করে উপায় ছিল না বাবু।
ছিল না। ব্যস। তা আমি কি করব?
আপনি যে টিকেটবাবু। আপনি ছেড়ে দিলে রাখে কে? আর আপনি ধরে রাখলেই বা বাঁচায় কে?
বটে, খুব যে কথার তোড়! আমিই যেন রেলের মালিক।
মালিক না হলেও এই ছোট ফকিরহাট স্টেশনখানাতে তমোনাশ দুচারজন বিনা টিকেটের যাত্রীকে ছেড়ে দিলে সত্যি কেউ আটকায় না।
ছেড়ে দেবার প্রবৃত্তি জাগবার সঙ্গে সঙ্গে তার মন-মেজাজও বিগড়ে যেতে লাগল। গলায় অস্বাভাবিক জোর এনে গর্জন করে উঠল: যাও, যাও। বেরোও।
নিজের রুক্ষস্বর ধিক্কার হয়ে নিজের কানেই ফিরে এল, যখন দেখল পাশ্চাতের কাপড়ের পুঁটুলিটি নিমেষে সচল হয়ে উঠেছে এবং বঙ্কিম গ্রীবা, ঋজু এবং দুটি চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার সুন্দর মুখের বেদনার্ত রেখাগুলি চোখের ইঙ্গিতের সঙ্গে মিশে যেন মিনতি জানিয়ে বলছে, তুমি অমন করে তাড়াচ্ছ! কেন তুমি কি দেখছ না, আমরা কত অসুখী। আমাদের কত কষ্ট।
মুখখানা ধীরে ধীরে আবার নীচু হয়ে ঢাকা পড়ে গেলে তমোনাশের মনে হল, তার দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তমোনাশের মনে হয়েছে, তার মন বড় অপূর্ণ, আর তার চারদিকে ভরে আছে তবু নিশ্চিদ্র, নিঃসীম নৈরাশ্য। এই বহু অনুভূত নৈরাশ্যের অত্যাচারে তৃতীয় আসামীকে তমোনাশ ক্ষমা করতে পারেনি। সে এক হাফ-টিকেটের ছেলে। স্টেশনমাস্টারের কোঠায় টেনে নিয়ে তার কচি গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসানো এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত কবে, কাঁদবার আগে নিজেই কেঁদে ফেলে নিজের ব্যাগ থেকে পাঁচটা টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বিদায় করেছে।
তমোনাশের মনে সেদিন একটুও সন্দেহ রইল না যে, তার মাথা খারাপ হতে বাকি নেই।
না, এখানে আর একদিনও থাকা যায় না। কি দেখে তমোনাশ রায় থাকবে এখানে? কি এখানে আছে! ট্রেন আসে আর যায়; যাত্রীরা উঠে আর নামে; ফকিরের হাট বসে আব ভাঙে। আর প্রতিদিন একই রকম ঐ আদিম বিশ্রী সূর্যটা ওঠে আর অতি বিশ্রীভাবে ডুবে যায়। তমোনাশ এসব ছেড়ে-ছুড়ে আর কোথাও যাবে।
অনেকের যাওয়ার জায়গা থাকে অনেক। তমোনাশের কিন্তু একটিমাত্র জায়গার কথাই বিশেষভাবে মনে পড়ল। রেলে পনেরো কুড়িটা স্টেশন পার হয়ে, অনেকটা পথ নৌকায়, আর কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে বর্ষায় ভুলে যাওয়া এক মাসির ঘরে আশ্রয় নিল। মাসি প্রথমে ঠিক বোনপোকে চিনতে না পারলেও পরম চেনার ভান করে তার শিক্ষিত চাকুরে বোনপোকে খুব খাতির যত্ন করে।
তমোনাশের মন একটু একটু করে ভরে আসতে লাগল—চারদিকের স্বচ্ছন্দ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আপনি সে রসায়িত হয়ে উঠতে লাগল। এখানে পুবের গাঁয়ের নারিকেল গাছের মাথায় যে সূর্য ওঠে বর্ষার নদীর জলে তা ভেঙে শতখান হয়ে সন্ধ্যায় মুঠা মুঠা আবীর ছড়িয়ে দিয়ে অলসভাবে ডুবে যায়। রাতে যে চাঁদ ওঠে, সাপলাফুলেরা তাকে বুকে করে চোখ বুজে আত্মসমাহিত হয়ে থাকে। সন্ধ্যায় কাঁসর-ঘণ্টা বাজে, জোরে পাখিদের গান হয়। গহীন রাতে হয় একজন মানুষের গান। যে গায় তমোনাশ তাকে দেখেনি। কিন্তু যা গায়, তা শুনে শুনে তার আশ মেটে না। শুধু কান পেতে শোনে।
গাঁয়ের লোকেরা খুব সকালে ঘুমায়। একদিন তমোনাশের চোখে ঘুম ছিল না। বাইরে এসে ডালিমতলার পথটাতে পায়চারী করছিল। দেখল সে রাতে আরো একজনের চোখে ঘুম নেই। পরের দিনও দেখল তার চোখে তেমন ঘুম নেই। তারপর থেকে রোজই দেখত ভগবান বোজই তার চোখে রাতের ঘুমটুকু কেড়ে নিয়েছেন। শুনে শুনে তার মনে প্রশ্ন জাগে—এসব গান যে গাইছে সে কি চিরবঞ্চিতা? নৈরাশ্য কি তার সারা জীবনেব আকাশ থেকে সবটুকু আলো কেড়ে- কুড়ে নিয়ে নীরন্ধ্র অন্ধকারে তার ইহ-পরকাল লেপেপুছে একাকার করে দিয়েছে? কিন্তু তার মনের কি কামনার শেষ নেই, কান্নার কি সমাপ্তি নেই! তার ভাঙা কপালের টুকরোগুলো তো মনের অনুভূতির বৈচিত্র্য একটুও মলিন করতে পারেনি? এক একটা গানের বাঁধা কথা ও বাঁধা সুরের ভিতর দিয়ে যেন হাজার রকমের অনুভূতি আত্মপ্রকাশ করছে!
একদিন রাতের বুকে চাঁদ ছিল না। চারদিক নিঝুম। তমোনাশ শুনছে সেই গানের কথাগুলি:—শত বৎসরের পর শত জনমের পর তুমি এসেছ। আমার স্বপ্ন ভেঙে গেল। জেগে আর ঐরূপ দেখলাম না। দুয়ারের বাইরে এসে দেখি সারাটি রাত খালি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আমি কাঁদছি, আমার রাত কাঁদছে—কেঁদে কেঁদে রাত বিদায় নিচ্ছে—দেখি শুকপাখীরাও কাঁদছে। তোমায় আমি পেলাম না আর কেউও তোমায় পেল না। জীবন থাকতে পেলাম না, পাব কি না তাও জানি না।
আর এক রাতে শুনতে পেল: ঐ তো ফুলের পালঙ্ক রইল, আমার কালাচাঁদ এল কৈ?
এসব চিরকালের প্রশ্ন সুরে সুরময় হয়ে তার কানে এসে জানিয়ে গেল—এ তোমারি বুকের ভার, এতদিন তা ভাষা পায়নি, নিভৃত মনে ছিল। আজ ভাষাও পেয়েছে সুরও পেয়েছে।
দিনের আলোতে তমোনাশ প্রশ্ন করে; ও বাড়ীতে অনেক রাতে গান গায়—মেয়েটা কে গো মাসি?
বিনোদিনী। তিনকুলে কেউ নেই। শিশুকালে মরেছে স্বামী, এখন যৌবনকালে গায় তারই বিচ্ছেদের গান। নিজে গান বাঁধে নিজের সুরে গায়—গায় আর সূতা কাটে। সেই সূতা বেচে পেট চালায়। কারো সঙ্গে কথা কয় না। দূরে দূরে বাড়ী বলে তার গান আর কেউ শুনতে পায় না। শুনি কেবল আমি।
হ্যাঁ, কেবল তুমিই শোন আর কেউ শোনে না।
আর শুনেছিস দেখি তুই!
তোমাদের এইসব গ্রাম্য গান শুনতে আমার সব সময়েই ভালো লাগে। ওস্তাদি নেই, কিন্তু আন্তরিকতা আছে। মনে হয় যেন কলজের রস সুর হয়ে বেরিয়ে আসছে।
মাসি ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
বোনপোর মনের খবর মাসি কতটুকু পেয়েছে তা প্রকাশ পায় নি। পরের দিন দেখা গেল বুড়ি তার বাতের শরীরে রান্নার অসামর্থ্য জানিয়ে সেই বাড়ীর রাতের মেয়ে বিনোদিনীকে ডেকে এনেছে রান্নায় সাহায্য করার জন্য। তমোনাশ খেতে বসে তাকে দেখতে পেল।
সেইদিন রাতের গহনে তরুণীর ঢেলে দেয়া যে সুরময় কথাগুলি বিভ্রান্ত তমোনাশের মর্মে এসে প্রবেশ করল তা এই: ও আমার রাজা, যে সময়ে তুমি রাজ দরবারে যাও, আমি তখন রাঁধি, আমার উনুন কাঁচা আমার কাঠ ভিজা। আমি কাঁদছিলাম, কেন কাঁদছিলাম জানি না, জিজ্ঞাসা করাতে অক্লেশে বললাম, ধোঁয়ার জন্য কাঁদছি। আমি যমুনায় নাইতে গেছি। কুক্ষণে বাতাস এসে আমার মাথার কাপড় উড়িয়ে নিল—আর তুমি আমার মুখ দেখে ফেললে, কি লজ্জার কথা! তোমায় পাওয়ার দাবী করতে পারি না। তাই তোমার বদলে তোমার বাঁশী রেখে দেব। হয় আমায় তোমার বাঁশী দাও, না হয় আমায় সঙ্গে নাও, না হয় আমায় তোমার আপন দাসী কর।
পরের দিন তমোনাশ কোনও ভূমিকা না করে সোজাসুজি মাসিকে জানায়: বিনোদিনীকে বিয়ে করব।
বলিস কি তমো! ও যে বিধবা!
তা হোক বিধবা। তুমি তাকে জিজ্ঞেস কর বিয়েতে সে মত দেবে কি না?
এই অসহায়া মেয়েটির প্রতি মাসির দরদ কম ছিল না। বাউণ্ডুলে বোনপোটিকে দেখা শোনা করবার জন্য একজন দরকার। ঐ প্রশ্নও কিছুদিন থেকে তার মনে জাগছিল। সে অনাড়ম্বর বিবাহের আয়োজন সাড়ম্বর ঘোষণায় সবাইকে জানিয়ে দিল।
বুড়ি যেদিন বিনোদিনীর কানে বিয়ের প্রস্তাব তুললো, সেদিন থেকে বিনুর কাজের তালিকা বদলে গেল। এখন সে রাতে গান গায় না। ফুলের মালা গাঁথে আর রুমালের কোণে ফুল তোলে। আগে গান গাইতে গাইতে তার চোখ ঝরত। এখনও ঝরে। তবে ঝরার কারণ আলাদা।
আর আর সব গ্রামবাসীরা শুনতে পেলো এবং শুনে বিস্মিত ও আনন্দিত দুইই হল যে, বুড়ির চাকুরে বোনপো নিজে যেচে বিনোদিনীকে বিয়ে করছে। খুদ-কুড়ানী সুতা কাটুনী বিনোদিনী রাজরাণী হবে।
বিয়ের আগের কয়দিন গান শুনতে না পেয়ে তমোনাশের মনে আগের শূন্যতা উঁকি ঝুঁকি মারছে। নিজেকে সে নিজে প্রশ্ন করেছে: আমি চাই কাকে? তাকে না তার গানকে? তার জন্যে তার গানকে চাই বা তার গানের জন্য তাকে চাই?
বিয়ের দিন পর্যন্ত এর বেশি কিছু তমোনাশ ভাবতে পারেনি।
শুভ দৃষ্টির সময় বধুর সুন্দর মুখখানি তৃপ্তির অপূর্ব ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল দেখে তমোনাশ একটু বিমনা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে তৃপ্তিকে আড়াল করে কোন এক বেদনার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠায় সে বধূর সিক্ত আয়ত চোখ দুটিতে সিক্ত নিজের চোখ দুটি অবগাহন করিয়ে নিয়ে ভাবল, বধূর চোখ দুটি বড় মধুর, কিন্তু কখন বুঝি তাতে জোয়ার এসে পল্লব-তটদুটিকে উদ্বেলিত করে তোলে।
বিয়ের দুদিন পর রাতে তমোনাশ বধূকে কাছে টেনে নিয়ে বললে গান গাও।
আশা ও আনন্দে নববধূবেশিনী বিনোদিনীর বুক ভরে উঠল। বলল—
কি গান গাইব?
সেই গান, যে গান অনেক রাতে গাইতে।
ও-গান আমি ভুলে গেছি। আর এমন দিনে ও-সব অলক্ষুণে গান গায় না।
বধুর চোখে মুখে তৃপ্তি ও কৌতুকের এক স্বচ্ছ বিদ্যুৎ যেন খেলে গেল। তার প্রাণ আজ কানায় কানায় পূর্ণ। পূর্ণতার গৌরবে প্রিয়তমের কোলের উপর নিজেকে লুটিয়ে দিয়ে বললে, ও-গান তুমি কোনদিন শুনতে চেয়ো না যেন। সে-মন আমার কি এখনো থাকতে পাবে ভাবছ? সেই একদিন, আর আজ তোমাকে পেয়ে আমার সব পাওয়ার সাধ মিটেছে। ও গান আমি কি গাইতে পারি?
তমোনাশ বিস্মিত হল না,—স্তম্ভিতও হল না—স্বপ্নভঙ্গের শূন্যতা নিয়ে শুধু এদিক ওদিক চাইতে লাগল। তার চোখমুখের অস্বাভাবিক ভাব দেখে ভীতা হয়ে বধূ তার পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে বলল: ওগো আমায় তুমি নাও। আমি তোমার, আমি চিরকালের তোমার। আমার থেকে কি আমার সেই গান বেশি সত্য হল— বড় হল।
দার্শনিক মন তমোনাশকে দিব্যদৃষ্টি দিয়ে গেল, কাঁটায় বুক ফুঁড়িয়ে গানের মধু ঢালা যে পাখীর স্বভাব, ফুলের পাঁপড়ির কোমলতায় গা ঢেলে দিয়ে সে পাখী সে সুর হারিয়ে ফেলে।
দূর ছাই। এ জায়গাটা ছাড়তেই হবে। এখানেও সবকিছু তমোনাশের নিতান্ত বৈচিত্র্যহীন লাগছে। জলের উপর চাঁদ-সূর্যের খেলা, আর আত্মসমর্পিতা নারীর বুকে পুরুষের খেয়ালী মনের ঢেউ তোলা— দুই-ই সমান অকিঞ্চিৎকর, সমান অবান্তর। এ আর ক’দিন একটা মনকে বেঁধে রাখতে পারে। গভীর সত্য কি এমন আছে তাতে? তমোনাশ এখানে আর থাকতে পারবে না, সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে সে অন্য কোথাও চলে যাবে!
১১ আগস্ট ১৯৪৬