তত্র সর্বাণি তীর্থানি
ঠাকুর বলেছিলেন, রানী রাসমণি জগদম্বার অষ্ট সখীর এক সখী; তাঁর পূজার প্রচারের জন্যে এসেছিলেন, এসেছিলেন তাঁর মহিমা প্রচারের জন্যে। দুশ বছরের পারে এসে আমরা যোগ করছি—ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ যা বলেছেন তা যথার্থ এবং অভ্রান্ত; এছাড়াও আরো কিছু, তা হলো—রাসমণি ছিলেন নারীর আধুনিক রূপের এক আদর্শ, চিরকালের অনুকরণযোগ্য একটি মডেল। ঠাকুর দেখিয়ে গেলেন, ধর্ম কি! সমস্ত সংস্কারমুক্ত আদর্শ হিন্দুধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে গেলেন। জীবের মধ্যে শিবকে প্রত্যক্ষ করতে বললেন। বললেন : “যত মত তত পথ।” বেদান্তের আধুনিক রূপ তিনি খুলে দিলেন। সেই আলো-হাতে স্বামীজী উঠে দাঁড়ালেন বিশ্বধর্মমহাসম্মেলনের মঞ্চে। ভারতধর্ম হয়ে গেল বিশ্বধর্ম।
আর এই ধর্ম যে-বেদিতে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই বেদিটি নির্মাণ করে মার্জনা করেছিলেন রানী রাসমণি। সাড়ম্বরে সামান্য একটি মন্দির তিনি প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি ইতিহাসের প্রয়োজনে ইতিহাস রচনা করতে এসেছিলেন। তিনি মানবী; কিন্তু তাঁকে এখানে পাঠিয়েছিলেন মহাকালের কর্ত্রী। তাঁকে আমরা কালীও বলতে পারি; কারণ কালকে যিনি কলন করেন তিনিই কালী। তা নাহলে দুশ বছর আগে বাংলার অখ্যাত এক গ্রামে, অখ্যাত এক পরিবারে তাঁর আবির্ভাব, তাঁর বিকাশের ধারার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
মহাকালের ঐ পাদে ইতিহাস যে-পথে মোড় নেবে তা ঠিক করাই ছিল। প্রয়োজনীয় চরিত্রগুলি একে একে এসে গেল। আদর্শ গ্রন্থে নেই, উপদেশে নেই। আদর্শ আছে জীবনে। কর্মে তার প্রতিফলন। জীবনকে অনুসরণ করে গ্রন্থ। ধর্মও মানুষকে কেন্দ্র করে, ইতিহাসও তাই। যেমন মূর্তি দেবতা নন, দেবতা হলেন মানুষের মন, মানুষের ভাবনা, মানুষের জীবনদর্শন। দেব অথবা দেবীমূর্তিতে ঘনীভূত হয়ে আছে ইতিহাস, জীবনমুখী আদর্শ, ত্যাগ, বৈরাগ্য, তিতিক্ষা, নির্ভরতা, শান্তি, সখ্যতা। সভ্যতার ইতিহাসকে হাজার হাজার বছর গড়াতে দিয়ে কাল হঠাৎ থমকে দাঁড়াল পর্যালোচনার জন্যে। এইবার মানুষকে ভাবতে হবে—জীবনের সঙ্গে ধর্মের সমন্বয় কিভাবে হবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে ধর্মের মিলন হবে মানবজীবনের কোন্ ভূমিতে দাঁড়িয়ে। এই পরীক্ষা হবে কোথায়? হবে প্রাচ্যে। গঙ্গাতীরবর্তী অখ্যাত এক গ্রামে। এই সমন্বয়কারী ধর্মের ভিত্তি কে নির্ধারণ করবেন? অখ্যাত এক রমণী।
শ্রীচৈতন্য এসেছিলেন নবদ্বীপে। মানবকল্যাণে সেই কালে প্রয়োজন ছিল দুটি অস্ত্রের—প্রেমভক্তি ও বিদ্রোহের। বিদ্রোহ কেন? অত্যাচারীর অশুভ শক্তির নিয়ন্ত্রণে প্রেম নয়, প্রয়োজন বিদ্রোহের। সংস্কার যদি বন্ধনের কারণ হয়, নিপীড়নের কারণ হয়—সে শাস্ত্রের অনুশাসনই হোক আর রাজাদেশই হোক, বিদ্রোহে চুরমার করে দিতে হবে। সংস্কার না হলে প্রতিষ্ঠা হয় না। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত না করে পারা যাবে না—
“দেবতা এলেন পর-যুগে
মন্ত্র পড়লেন দানব দমনের
জড়ের ঔদ্ধত্য হলো অভিভূত
জীবধাত্রী বসলেন শ্যামল আস্তরণ পেতে।
ঊষা দাঁড়ালেন পূর্বাচলের শিখরচূড়ায়,
পশ্চিমসাগরতীরে সন্ধ্যা নামলেন মাথায়
নিয়ে শান্তিঘট।” (‘পৃথিবী’)
মহাপ্রভু বলছেন : “পাষণ্ডী সংহারিতে মোর এই অবতার/পাষণ্ডী সংহারি ভক্তি করিমু প্রচার।।” বিশাল শরীর, সিংহের মতো বিক্রম, প্রবল হুঙ্কার, আবার কুসুমের মতো কোমল, সঙ্কীর্তনানন্দে বিভোর, দরবিগলিতাশ্রু। সঙ্কীর্তন-মণ্ডপে প্রবেশ করে কাজি মৃদঙ্গ ভেঙে, সব লণ্ডভণ্ড করে ফতোয়া জারি করলেন—নবদ্বীপে তাঁর চৌহদ্দিতে নাম-সঙ্কীর্তন চলবে না। নিষেধ অমান্যকারীকে বেত্রাঘাত করা হবে। হিন্দুরাও এসে নালিশ করে গেল—এ কি বিধর্মিতা! ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কালী, তারা, দুর্গা ভেসে গেল, দিবারাত্র কেবল কৃষ্ণ কৃষ্ণ। এ পাপ কবে যাবে! গয়া থেকে ফিরে এসে এ যে বড় বাড়াবাড়ি করছে, কাজিসাহেব!
মহাপ্রভু সব শুনে হুঙ্কার ছাড়লেন, তাই না কি! তাহলে চল সবাই, পাষণ্ডী সংহারি। নবদ্বীপের সমস্ত গৃহে আজ রাতে জ্বলবে আলো। যেখানে যত খোল আর করতাল আছে নিয়ে এস। জ্বালাও মশাল।
“লক্ষকোটি দীপ সব চতুর্দিকে জ্বলে।
লক্ষকোটি লোক চারিদিগে হরি বোলে।।
*
করতাল মন্দিরা সভার শোভে করে।
কোটি সিংহ জিনিয়া সভেই শক্তি ধরে।।”
বৃন্দাবনদাস লিখছেন : “ক্রোধে হইলেন প্রভু রুদ্রমূর্তিধর।” আজ আমি কাজির ঘরদ্বার সব পুড়িয়ে দেব। মহামিছিল। মহাকীৰ্তন। সমগ্র নবদ্বীপবাসী নেমে পড়েছেন পথে। আলোয় আলোময়। নেতা শ্রীচৈতন্য। বৃন্দাবনদাস বলছেন : “কি শোভা হইল সে বলিতে শক্তি কার!” প্রবল বন্যায় কাজি ভেসে গেলেন। পরাভূত হলেন।
মহাপ্রভু এক হাতে প্রেম অন্য হাতে আধ্যাত্মিক শক্তি বিকিরণ করেছেন। আধ্যাত্মিক শক্তির দুটি দিক—দুটি ফলা। এক ফলায় নিজের তামস কাটে, তমোগুণ নাশ করে। আরেক ফলায় বাইরের অশুভ, বিরোধী শক্তিকে খানখান করে। সেখানে অদ্ভুত এক অহঙ্কারের প্রকাশ যাকে অনেক সময় রজোগুণ বলে ভুল হতে পারে, ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ যাকে বলছেন, সত্ত্বের অহঙ্কার। অহঙ্কার খারাপ। অহঙ্কারেরও তিনটি সত্তা। তম, রজ এবং সত্ত্ব। ঠাকুর বলছেন, সাত্ত্বিক আমি-র যে অহঙ্কার, সেই অহঙ্কার ভাল। মাথা নত করব একমাত্র তাঁর কাছে, আর কারো কাছে নয়। ঠাকুরের সেই সাপের গল্প। ছোবল মারতে বারণ করেছি, ফোস করতে তো বারণ করিনি। আধ্যাত্মিকতা মানুষকে ক্লীব করবে না, করবে চাবুক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাম, মহাপ্রভু, শ্রীরামকৃষ্ণ, যীশু, স্বামীজী— —সব একধারা। অনন্য শক্তির আণবিক বিস্ফোরণ। জীবসত্তার নিউক্লিয়াসকে আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে বিশ্লিষ্ট করতে পারলেই সেই ভয়ঙ্কর শক্তির উন্মোচন। গীতায় বর্ণনা আছে। অর্জুন দেখেছিলেন, ভগবান দর্শন করিয়েছিলেন কৃপা করে
“অনাদিমধ্যান্তমনন্তবীর্য-
মনন্তবাহুং শশিসূর্যনেত্রম্।
পশ্যামি ত্বাং দীপ্তহুতাশবক্ত্রং
স্বতেজসা বিশ্বমিদং তপন্তম্।।’
পরীক্ষামূলক প্রথম আণবিক বিস্ফোরণ দেখে বৈজ্ঞানিকেরা অভিভূত হয়ে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় এর উপমা খুঁজেছিলেন—”ব্রাইটার দ্যান থাউজ্যান্ড সানস।”
রাসমণির প্রসঙ্গে এত কথা আসছে কেন? তিনি কি অবতার ছিলেন? না। তিনি ছিলেন সামান্য এক নারী। হালিশহরের দরিদ্র এক পরিবারে তাঁর আবির্ভাব। কিন্তু যে-শক্তি শ্রীরামকৃষ্ণ-অবতার হিসাবে আবির্ভূত হবেন, তিনি ছক সাজাচ্ছিলেন। ছকটা এত বড়, খেলাটা এত জমজমাট হবে যে, প্রথমদিকে বোঝার উপায় ছিল না কোন্ চরিত্র কোথায় কেন আসছেন! ঝড় আসার আগে একটা নিম্নচাপ তৈরি হয়। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, দ্রুত বাতাস, অবশেষে প্রবল ঝড়। সেই ঝড় তার গতিপথে কাকে কাকে সঙ্গী করবে, ঝড় চলে না গেলে খতিয়ে দেখা অসম্ভব।
মহাপ্রভু নবদ্বীপে অবতরণ করলেন। পুঞ্জীভূত হতে থাকল শক্তি। নবদ্বীপ তুলকালাম করে বেরিয়ে পড়ল চৈতন্যের রেলগাড়ি। মানুষের দীনতা, ক্ষীণতা, সঙ্কীর্ণতা, সংস্কার, বিশ্বাস সব উড়ে গেল ঝড়ে এঁটোপাতার মতো। সব বেবাক উড়ে চলে গেল। প্রসন্নপ্রাতে মানুষ বেরিয়ে এল দাওয়ায়। “নবাঙ্কুর ইক্ষুবনে এখনো ঝরিছে বৃষ্টিধারা।” সেই ধারা হলো নতুন ধর্ম, নতুন বিশ্বাস, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, প্রেম, ভক্তি। সেই প্রবল বাতাসে প্রকৃতি হলো দূষণমুক্ত। এই ঝড়ের আরোহী কারা ছিলেন! হোমড়াচোমড়া তেমন কেউ নয়। শ্রীদাম, সুদাম, বলরামের মতোই সামান্য মানুষ। রাঢ়ের একচাকা গ্রামের নিত্যানন্দ। শ্রীবাস দিলেন তাঁর অঙ্গন খুলে। গৌরাঙ্গের দরবার।
এইখানে একটা কথা আছে, মহাপ্রভু অবতার। তিনি শক্তিপুঞ্জ। সেই শক্তির প্রকাশ বৃন্দাবনদাস বর্ণনা করেছেন :
“মধ্যখণ্ডে কাজির ভাঙিয়া ঘরদ্বার।
নিজশক্তি প্রকাশিয়া কীর্তন অপার।।
পলাইলা কাজি প্রভু গৌরাঙ্গের ভরে।
স্বচ্ছন্দে কীর্তন করে নগরে নগরে।।”
কিন্তু যবন হরিদাসের শক্তি কোথা থেকে এল? কোন্ গোমুখী থেকে? সেই একই ফাউন্টেন হেড। আধ্যাত্মিকতা। তোমারি নাম নিতে নিতে।
“কৃষ্ণের প্রসাদে হরিদাস মহাশয়।
যবনের কি দায় কালের নাহি ভয়।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলিয়া চলিলা সেইক্ষণে
মুলুকপতির আগে দিল দরশনে।।”
মুলুকপতি কাজী বললেন : “কৃষ্ণ নাম ছাড়। তুমি যবন। তোমার ধর্ম আলাদা।” ধর্ম আবার আলাদা হয় কি করে! রঙ-বেরঙের জামা, হরেক কায়দায় কাটা। কাপড় তো সেই একই সুতোয় বোনা। মূলে সেই তুলো। শোন কাজী, সারকথা—
“শুন বাপ সবারই একই ঈশ্বর।।
নাম মাত্র ভেদ কহে হিন্দুয়ে যবনে।
পরমার্থে এক কহে কোরানে পুরাণে।।
এক শুদ্ধ নিত্যবস্তু অখণ্ড অব্যয়।
পরিপূর্ণ হৈয়া বৈসে সবার হৃদয়।।”
ভোলা ময়রা আসরে অ্যান্টনিকে আক্রমণ করেছেন জাত তুলে—ওরে ফিরিঙ্গি জবরজঙ্গি পারবে না মা তরাতে।/তুই যীশুখ্রীস্ট ভজগে যারে শ্রীরামপুরের গির্জেতে।। অ্যান্টনি হেসে হেসে উত্তর দিচ্ছেন—শুরুতে সব ভিন্ন ভিন্ন, অন্তিমে সব একাঙ্গী। আর লালন? তিনিও বললেন সেই এক কথা :
“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে!
*
ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারীলোকের কি হয় বিধান?
বামন যিনি পৈতার প্রমাণ,
বামনী চিনি কি ধরে।।
কেউ মালা, কেউ তসবি গলায়,
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়
জেতের চিহ্ন রয় কার রে।।”
হরিদাসের কথায় কাজীর বোধোদয় সম্ভব নয়। সেই পরশমণির ছোঁয়া তিনি পাননি। সেই কৃপা! “যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম্।” কাজী বলেছিলেন : “বাইশ বাজারে বেড়ি মারি।/প্রাণ লহ আর কিছু বিচার না করি।।” পাইকরা চাবুক মারছে। “দুই তিন বাজারে মারিলে লোক মরে।/ বাইশ বাজারে মারিলাম যে ইহারে।। মরেও না আরো দেখি হাসে ক্ষণে ক্ষণে।”
ধর্ম মানুষকে এই সহনশীলতা, এই সাহস, উপেক্ষার এই শক্তি যোগায়। জীবশরীরে আলাদা একটা মেরুদণ্ডের সংযোগ ঘটায়। যীশুও তাঁর অনুগামীদের এই কথাই বলতেন। অতুলনীয় সেই উপদেশ। দেওয়ালে লিখে রাখার মতো— “They were to die to live, lose to find, give to gain.” আর এই সত্যেরই প্রতীক আমার ‘Cross’। “If any man will come after me, let him deny himself and take up his cross daily and follow me.”
হরিদাস সেই পথেই মহাপ্রভুকে অনুসরণ করেছিলেন। নিবেদিতা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দকে। রাসমণি সেই পথেই এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের বৃত্তে। আগে-পরের প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর। এ কোন সাধারণ জাগতিক ব্যাপার নয়। এখানে কাল অচল। এলিয়টকে উদ্ধৃত করা যায়, বড় চমৎকার সহজবোধ্য কয়েকটি লাইনে –
“Time present and time past
Are both perhaps present in time future
And time future contained in time past
If all time is eternally present
All time is unredeemable.”
বিশ্বরূপ দর্শন করে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছেন : “আপনি কে?” ]
“আমি কে? ‘কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো’ আমি প্রবৃদ্ধ কাল!”
“তাহলে তো আপনি ‘অনাদিমধ্যান্তম্’। আদি, মধ্য, অন্ত কোনটাই নন। “ সেই একই বিশেষে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর আট বছর আগে এসেছিলেন। প্রথম জীবনে ছিলেন তান্ত্রিক সন্ন্যাসী। হয়ে গেলেন পরম বৈষ্ণব। শুধু বৈষ্ণবই হলেন না, মহাপ্রভুর ভাবধারার একটা জোয়ার এনে দিলেন বঙ্গদেশে। রাসমণি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রায় ৪৩ বছর (রানী রাসমণির জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩; শ্রীরামকৃষ্ণের ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬) আগে এসেছিলেন। সুন্দরী মেয়ের বড়লোকের নজরে পড়ে পুত্রবধূ হওয়ার ঘটনাকে আমাদের সংস্কারে বলে ভাগ্য। আগে এমন হতো। এখনো এমন হয়। তাঁর আবির্ভাবের ৬২ বছর পরে জানা গেল কে তিনি, কেন তিনি এবং কোন্ লীলার তিনি সহচরী এই ৬২ বছরের সময়সীমায় তিনি আরো ধনী হয়েছেন। স্বামীকে হারিয়েছেন, আবার জামাতা হিসাবে এমন একজনকে পেয়েছেন যিনি রামকৃষ্ণদেবের ‘রসদ্দার’ হবেন। দুজনের কেউই জানেন না, মধ্য উনবিংশ শতাব্দীতে কোন্ ঘূর্ণীতে তাঁরা আকৃষ্ট হবেন, কোন্ বাতাস লাগবে তাঁদের মহাজনী পালে! যতক্ষণ না মঞ্চে শ্রীগদাধর চট্টোপাধ্যায় আসছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা জমিদার। ইংরেজের কলকাতায় তাঁরা চকমেলানো বাড়িতে—লোকজন, পাইক, বরকন্দাজ নিয়ে বসে আছেন। আর জানা যাচ্ছে, রাসমণি ধার্মিক, তেজস্বিনী, সৎক্রিয়াশীলা, একজন ‘এবল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’। স্বামী রাজচন্দ্রের অকালমৃত্যুর পর আশঙ্কা জেগেছিল—রাসমণি কি পারবেন এই অতুল বৈভব সামলাতে? প্রিন্স দ্বারকানাথ প্রস্তাব দিলেন, ‘রানীর ইচ্ছা থাকলে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমি নিতে পারি।’ ‘কালীপদ-অভিলাষী’ রানী রাসমণি জানালেন, যা সামান্য বিষয়কর্মাদি আছে, তা তাঁর জামাতা মথুরমোহনের সাহায্যেই তিনি চালাতে পারবেন। এ হলো তাঁর আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা আর দূরদর্শিতার একটি দিক।
দ্বিতীয় দিক—তাঁর চরিত্রের অনমনীয়তা, সততা আর আধ্যাত্মিকতা। সাত্ত্বিকতার আধারে রজোগুণের ফোঁস প্রকাশ—ইংরেজ সরকারের দলননীতির সামনে তিনি মাথা তুলে দাঁড়ান। ফণা বিস্তার। নিজের আত্মগরিমাকে খাটো না করা। তোমার হাতিয়ার ক্রাউন, আমার হাতিয়ার ন্যায়-নীতি। যা অন্যায়, যা অত্যাচারের সামিল তার বিরুদ্ধে আমি দাঁড়াব। কিভাবে লড়াইটা হবে? হাতিয়ার? বুদ্ধি। ইংরেজীতে বললে বলতে হবে—’কানিং’। তোমার আইন দিয়েই তোমাকে পরাস্ত করব। ইংরেজ সরকার রানীর কূটচালে পরাভূত হয়েছিলেন। গঙ্গার বিস্তীর্ণ এলাকায় মৎস্যজীবীরা রানীর কৃপাতেই বিনা করে মাছ ধরার সুযোগ পেয়েছিলেন। সবাই বলতে লাগলেন :
“ধন্য রানী রাসমণি রমণীর মণি।
বাঙ্গলায় ভাল যশ রাখিলেন আপনি।।
দীনের দুঃখ দেখে কাঁদিলে জননী।
দিয়ে ঘরের টাকা পরের জন্যে বাঁচালে পরাণি।।”
যেখানে আইনের কূটচাল অচল, সেখানে রানী খড়্গহস্ত। ফ্রী-স্কুল স্ট্রীটের গোরা সৈন্যরা মত্ত অবস্থায় রাসমণির বাড়ি আক্রমণ করেছিল। রানী হাতে খাঁড়া তুলে নিয়েছিলেন। স্বামীজী হিন্দু-রমণীর মধ্যে এই বীরত্ব, এই স্বয়ম্ভরতাই দেখতে চেয়েছিলেন। বিজ্ঞান বলছে ‘কজ অ্যান্ড এফেক্ট’। অর্থাৎ কি কারণে কি ঘটছে! রাসমণি প্রকৃতই ‘কালীপদ-অভিলাষী’ হয়েছিলেন। তা নাহলে চরিত্রে এমন বিচক্ষণতা ও বীর্যের সমন্বয় ঘটত না। স্বামীজী বলছেন : “সর্বশক্তিমত্তা, সর্বব্যাপিতা, অনন্ত দয়া—সেই জগজ্জননী ভগবতীর গুণ। তিনিই কালী। তাঁকে আরাধনা করলে সেই গুণাবলীর অংশীদার হওয়া যায়। রানী রাসমণির চরিত্রে সেই লক্ষণ প্রস্ফুটিত।”
রাজশক্তিকে অর্থে, প্রতিরোধে বশীভূত করা যায়; কিন্তু হিন্দু পুরোহিতদের কুসংস্কার আর সেই সংস্কারজনিত নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির উপায়! ইংরেজীতে বলে, “কাস্টমস ডাই হার্ড’। মরতে চায় না, সরতে চায় না। হিন্দুধর্মের এই অচলায়তন মহাপ্রভু ও স্বামীজী ভাঙতে চেয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ উপেক্ষা করেছিলেন। পাত্তা দেননি। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতো বলতে চেয়েছিলেন :
“মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্ৰতিজানে প্ৰিয়োঽসি মে।।”
আমার কাছে এস, আমাকে দেখ, অনুসরণ কর, আমার কথা শোন। নতুন বিশ্বাস, ধর্ম, অনুশাসন আপনিই তৈরি হবে। আলো আসতে দাও। একটা দেশলাই কাঠি জ্বাললে হাজার বছরের অন্ধকার নিমেষে চমকে উঠবে। বলেছিলেন : “হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে যাব।” জীবনের শেষবেলায় জলের বিশ্ব জলেতে মেলাবার প্রাকমুহূর্তে বলেছিলেন : “যিনি রাম, যিনি কৃষ্ণ, তিনিই ইদানীং এই দেহে রামকৃষ্ণ।”
রাসমণি আর মাত্র ছয়বছর পরে চলে যাবেন। স্বপ্নাদিষ্ট মন্দির নির্মিত হয়েছে। ভবতারিণী বেদিতে স্থাপিত। কে প্রতিষ্ঠা করবে? মৃন্ময়ীকে চিন্ময়ী করবে কে? পুরোহিতকুল এক দুর্লঙ্ঘ বাধা। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা পথ – আগলে আছে। ব্রাহ্মণ পূজারী সেবার ভার নেবে না, অন্নভোগ হবে না।
গদাধর বসে আছেন ঝামাপুকুরে, দাদার টোলে। পূর্ণ যুবক। রানীর সমস্যার সমাধান দিলেন রামকৃষ্ণাগ্রজ রামকুমার। মঞ্চে প্রবেশ করলেন গদাধর। এই ভূমিতেই তিনি হবেন শ্রীরামকৃষ্ণ। প্রথমে তিনি দর্শক। সংশয়ান্বিত। দেখছেন, পরীক্ষা করছেন—এই সেই সাধনপীঠ কিনা! এই রাসমণিই কি সেই অষ্ট সখীর এক সখী! এই কি সেই শ্রীবাস-অঙ্গন! বিত্ত-বৈভব দেখছেন। বড় মানুষের জামাইটিকে দেখছেন। অগ্রজ রামকুমারের বৈধী সেবা দেখছেন। তিনি যেমন দেখছেন, মা ভবতারিণীও তাঁকে দেখছেন। তখনো তিনি রাসমণির কালী। রামকৃষ্ণ তাঁর কোলে চড়ে বসেননি।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ হিন্দুর দশবিধ সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। ব্রাহ্মণের পালনীয় কর্মাদি সম্পর্কে তখনো তিনি সচেতন। সর্বাধিক যা মানতেন তা হলো আহারশুদ্ধি। সেই কারণে দাদা রামকুমার জগদম্বার অন্নভোগ গ্রহণ করলেও প্রথমে তিনি তা করেননি। পিতার সংস্কার তখনো তাঁর মনে—অশূদ্রযাজিত্ব, অপরিগ্রাহিত্ব।
মা ভবতারিণী দেখছেন, যুবক গদাধর দূরে সরে আছে। বাগানে আছে, মন্দির-চাতালে আছে, গঙ্গার ধারে আছে। চিন্তায় আছে, সংশয়ে আছে। ঝামাপুকুরের টোল উঠে যাবার দুশ্চিন্তায় আছে। মা ভবতারিণী তাঁকে লম্বা সুতো দিয়ে রেখেছেন। বড় মাছ একটু খেলিয়ে তুলতে হয়।
ঘটনার যদি ব্যাখ্যা খুঁজতে হয়, তাহলে দুটো পথ আছে—স্থূল ও সূক্ষ্ম। স্থূলমার্গে দুটি মাত্রা—কার্য এবং কারণ। সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা অন্যরকম, জড়বাদীদের পছন্দ হবে না। সেখানে আছে—”সকলি তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি, তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি।” আছে খুব বিশ্বাসের কথা—
“মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্।
যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম্।।”
তুলসীদাস এই সত্যকে তাঁর একটি দোঁহায় কাব্যসুষমামণ্ডিত করেছেন। উদ্ধৃতির আনন্দ সংযত করা যায় না—
“রাম ঝরোখে বয়ে কর, সব্কো মুজরা লে।
জ্যায়সা যাকে চারি, অ্যায়সা উকো দে।।”
এই জগৎকে যদি একটা গৃহ ধরা যায়, তার উচ্চতম বাতায়নে বসে আছেন ভগবান শ্রীরাম। তিনি দেখছেন, তিনি দিচ্ছেন, তিনি করাচ্ছেন। ভবতারিণী জমিদার মথুরমোহনকে বলছেন, আমার চোখে তুমি ঐ আত্মমগ্ন সুদর্শন যুবকটিকে দেখ। ও কালের নায়ক হবে। আমি পাষাণী, ও আমাকে জাগাবে। শুধু আমাকে নয়, এই দেবালয় শুধু এক জমিদারের খেয়াল হয়ে থাকবে না, হবে ইতিহাসের প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে নতুন ভাবরাশি বিস্ফোরিত হবে। সম্পূর্ণ নতুন এক ধর্ম তৈরি হবে আগতকালের মানসিকতার প্রয়োজন মেটাতে। সংস্কার সব খুলে পড়ে যাবে। পুরোহিতরা সঙ্কুচিত হবেন। বিধান সব পালটে যাবে। যুক্তি, তর্ক, বুদ্ধি, বিশ্লেষণ, বিজ্ঞান মিলিত হবে একাধারে। “ধ্বংস ভ্রংশ করি বাহিরিবে” শাশ্বত বিশ্বাস। তোমাদের ঐ বেশকারী সেবকটিকেই দিনকয়েক পরে সেবা করতে হবে। রামকুমার নিমিত্তমাত্র। সে তোমার বৈষয়িকতাকে মুচড়ে দেবে। লাল জবার গাছে সাদা জবা ফুটিয়ে দেখিয়ে দেবে, ‘উয়ো ভি হো সকতা।’ তোমাদের রানীর গালে সপাটে এক চড় মেরে বুঝিয়ে দেবেন, একমনের আধ ছটাক কম হলেও রাধারানী পার করেন না। “কায়েন মনসা বুদ্ধ্যা।” সামান্য একটু ফেঁসো থাকলে ছুঁচে সুতো ঢুকবে না। আমি, তোমরা, তাঁরা সবাই তাঁরই জন্যে। কালের মাটিতে বীজ অপেক্ষা করছিল। বারকোশে চিনির রস। সব এসে পড়বে তাতে। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, দ্বৈত, অদ্বৈত, ব্রাহ্ম, বৈদান্তিক, টিকিনাড়া পণ্ডিত; তারপর যিনি একটিমাত্র বিশ্বাসের সুতো ফেলে মিছরিখণ্ডটি চিরকালের মতো জমিয়ে দিয়ে যাবেন, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ, কালে যিনি অভিহিত হবেন ‘অবতার বরিষ্ঠ” বলে। ‘রামকৃষ্ণ ক্যারাভ্যানের’ সদস্য তোমরা। বল—”স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিণে।” বল—”তত্র সর্বাণি তীর্থানি প্রয়াগাদীনি তত্ৰ বৈ!”