প্রথম দিন :
আজ দিল্লিকে সত্যি চেনা যায়নি। বিকেলে বেরিয়েছি। মনে হচ্ছিল ছুটির দিন বুঝি। অথবা হরতাল চলছে। কিছু রাস্তা তো পুরোই ফাঁকা। নীতি মার্গে গিয়ে গাড়ি থামালাম। মনে হচ্ছিল উত্তর ইউরোপের কোনও সুনসান শহর বুঝি। রাস্তা পড়ে আছে একা। হঠাত্ হঠাত্ দু’একটা গাড়ি নিস্তব্ধতার গায়ের ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে কোথাও চলে যাচ্ছে। উত্তর ইউরোপের কিছু কিছু দেশের জনসংখ্যাই কোথাও কোথাও এক কোটি নয়। আর দিল্লি শহরের জনসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল শহর দিল্লি। টোকিওর ঠিক পরেই রয়েছে দিল্লি। দিল্লিকে ঠিক এরকম শান্তশিষ্ট মানায় না।
বিকেলের যে সময়টায় আমি বেরিয়েছিলাম শহরে, সে সময় ট্রাফিকের যন্ত্রণায় গাড়িকে থেকে থেকে ঝিমোতে হয়। যেখানে পৌঁছোতে আমার অন্যদিন দেড় ঘণ্টা খরচ হয়, সেখানে পৌঁছোতে আজ লাগলো কুড়ি মিনিট। তার মানে এই জোড়-বেজোড়ের ফর্মুলা ভালো কাজ করছে। একদিন জোড় নাম্বারের গাড়ি চলবে, পরদিন বেজোড় নাম্বারের গাড়ি চলবে। এই নিয়মটি দিল্লির নিজস্ব নয়। কয়েক বছর আগে বেইজিং এই নিয়ম চালু করে ভালো সুফল পেয়েছে। দিল্লিও সুফল পেলো প্রথম দিন। তবে লোকেরা বলছে, আজ অনেকের ছুটি ছিল, সামনের সপ্তাহে বোঝা যাবে এই জোড়-বেজোড় ফর্মুলা আদৌ কাজ করবে কি না। আজ দূরদর্শনের এক সাংবাদিক-বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো, ও বললো সোমবারে ও মেট্রো চড়ে অফিসে যাবে। এর আগে কোনওদিন মেট্রোতে অফিসে যায়নি, এবার শুরু করবে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অন্যের গাড়ি চড়ে অফিসে গিয়েছেন আজ, যেহেতু তাঁর গাড়ির নম্বর বেজোড়। পর্যটনমন্ত্রী তো বাইক চালিয়ে অফিসে গেছেন। ভাবতেই ভালো লাগছে দিল্লিকে বায়ুদূষণ থেকে মুক্ত করার জন্য শেষ অবধি ভালো একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং সচেতন অনেক নাগরিকই নিয়ম মেনে চলছেন।
বিশ্বের এক নম্বর দূষিত শহর দিল্লি। আগে শীর্ষে ছিল বেইজিং। বেইজিং দূষণ কমিয়ে এক নম্বর থেকে সরে গেছে। উঠে এসেছে দিল্লি। পুরোনো ডিজেল গাড়ি নিষিদ্ধ না করলে চলছে না। এসব গাড়ি থেকেই দূষণ ছড়ায় বেশি। বাতাসে দূষণ এত ভয়ংকর যে মানুষ ফুসফুসের অসুখে ভুগতে শুরু করেছে। ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য আর সিগারেট ফোঁকার প্রয়োজন নেই। দিল্লির হাওয়া খেলেই ক্যান্সার ধরবে। হাওয়ায় কারসিনোজেন উড়ছে। এমন কোনও দিন নেই যেদিন আমি দিল্লির রাস্তায় হেঁটেছি কিন্তু কাশিনি বা নির্বিঘ্নে শ্বাস নিতে পেরেছি। সেদিন এক ফার্মেসিতে ঢুকে দেখলাম মাস্ক বিক্রি হচ্ছে। অনেকে এখন মাস্ক পরে চলাফেরা করে।
জমাট বাঁধা, দূষিত, ভারী হাওয়া থমকে থাকে দিল্লিতে। আকাশ এখানে আর নীল নয়। মানুষের চেহারাও আর স্পষ্ট নয়। কীরকম ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে এই শহর। শীত আসে। শীতের পিঠে চড়ে প্রবল দূষণ আসে। দীর্ঘ গ্রীষ্মের পর শীত উপভোগ করা হয়ে ওঠে না। দিল্লির কনকনে শীতের চেয়েও দূষণের দুশ্চিন্তায় কাঁপি বেশি। আরও মেট্রোর লাইন বাড়ুক। আরও পাবলিক বাস বাড়ুক। মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তরা বিত্তের অহংকার ভুলে মেট্রো, বাস, বাইক ব্যবহার করুন। বড় রাস্তার কিনার ঘেঁষে সাইকেলের রাস্তা করে দেওয়া হোক, দিল্লির মানুষ সাইকেলে যাতায়াত করুন। আজ দিল্লিকে দিল্লি বলে চেনা যায়নি। মানুষ যে দূষণমুক্ত দিল্লি চাইছে, আজই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আজ খুব কম লোকই জোড় নম্বরের গাড়ি বের করেছে রাস্তায়। ১৫ দিন এই নিয়ম চলবে। আশা করছি এই নিয়মটি আরও দীর্ঘকাল চালু রাখা হবে যতদিন দিল্লির হাওয়া পাকাপাকিভাবে বিশুদ্ধ হচ্ছে।
বার্লিন শহরের কথা মনে পড়ছে। ওখানে সাইকেল যারা চালায়, তাদের মূল্য অনেক বেশি। এমন কোনও রাস্তা দেখিনি, যেখানে সাইকেলের জন্য আলাদা রাস্তা নেই। স্টকহোমে দেখেছি অনেক মন্ত্রীই সাইকেল চালান। বায়ুদূষণ নেই, তারপরও ভবিষ্যতে যেন দূষণ না হয়, সেই চেষ্টা করেন। এমন সচেতন নাগরিক আমরা কি দিল্লিতে পাবো? অথবা নাগরিকদের পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করার দায়িত্ব কি সরকার নেবেন? নাকি ফুসফুসের ব্যাধির পেছনে দেশকে ঢালতে হবে শত-কোটি টাকা আর চেয়ে চেয়ে আমাদের নিরুপায় দেখতে হবে মানুষের অকাল মৃত্যু?
দ্বিতীয় দিন :
আমার গাড়ির প্লেটে জোড় নম্বর। বেজোড় নম্বরের দিনে গাড়ি বের করছি না। আমার সঙ্গে সিকিউরিটি পুলিশ থাকে। ভিআইপি বলে আমাকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু আমার অধিকার নেই জোড়-বেজোড়ের নিয়ম ভাঙা। গ্যাসে চলে যেসব গাড়ি, মেয়েরা যেসব গাড়ি চালায়— সেসব চলতে পারবে রাস্তায় যে কোনও দিন। ভিআইপিদের এই অধিকার নেই। এই নিয়মটি আমার বেশ ভালো লেগেছে। ভিআইপিদের ভগবান মানার অভ্যেস অনেকের। ভিআইপিদের সাত খুন মাফ। কিন্তু অরবিন্দ কেজরিওয়াল ভিআইপিদের বাড়তি সুবিধে দিচ্ছেন না। শহরে হাজার হাজার ভিআইপি। ভিআইপিরাই দূষণ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট।
বড় বড় লাক্সারি ডিজেল গাড়ির নির্মাতা অনুরোধ করেছেন যেন তাদের গাড়ি থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন করেছে, তোমাদের গাড়ি থেকে কি অক্সিজেন নির্গত হয়? ডিজেল গাড়িই যত নষ্টের মূল। বিশেষ করে পুরনো হওয়ার পর। কিন্তু ডিজেল গাড়ির ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসার কথা ভাবছে, বায়ুদূষণ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। ব্যবসায়ীদের এই সমস্যা, জীবনকে গুডবাই বলতে পারে, প্রাচুর্যকে নয়।
জোড়-বেজোড়ের নিয়মটি এ অবধি মন্দ চলছে না। রাস্তায় ট্রাফিক কম। দূষণও খানিকটা কমছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা তো বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষবে না। তারা দুর্নীতির চেষ্টা যে করেই হোক করবে। দুর্নীতির দেশে দুর্নীতি না চলে কি উপায় আছে। এর মধ্যেই গ্যাস স্টেশনের লোকেরা সিএনজি স্টিকার বিক্রি করতে শুরু করেছে। না, গ্যাসে যাদের গাড়ি চলে তাদের কাছে নয়। যাদের গাড়ি গ্যাসে চলে না, তাদের কাছে। প্রতি সিএনজি স্টিকার ২৮০০ টাকা। ২৮০০ টাকা খরচ করে প্রতিদিন গাড়ি চালাবার সুযোগ পাচ্ছে তারা। এইসব দুর্নীতি বাদ দিলেও দিল্লির অধিকাংশ মানুষ জোড়-বেজোড় নিয়মটি মেনে চলছে। পাবলিক বাসে আর মেট্রোতে ভিড় আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। মেট্রোর লাইন বাড়লে আর পাবলিক বাস বাড়লে দিল্লি আরও দূষণ রোধ করতে পারবে, এই বিশ্বাস আমার।
মেট্রোতে ভিড় বাড়ছে। কখনও মেট্রোয় চড়িনি আমি। দিল্লির মেট্রো শুনেছি খুব সুন্দর, ঝকঝকে। এর মধ্যেই একদিন মেট্রো চড়ার ইচ্ছে আছে।
জোড় নম্বরের দিন গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু লক্ষ করেছি বেজোড় নম্বরের কিছু গাড়ি দিব্যি আমার গাড়ির গা ঘেঁষে চলে গেল। লক্ষ করলাম কোনও মেয়ে ড্রাইভিং সিটে নেই, গ্যাসে চলার গাড়ি নয়। মেডিক্যাল ইমারজেন্সি? হতে পারে। এও হতে পারে মালিক দু’হাজার টাকা জরিমানা দিয়েও আজ গাড়ি চালাবে পণ করেছে। কিছু কিছু মানুষ এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না বায়ুদূষণ দূর করা কী রকম দরকারী। আমি কি বেজোড় নম্বরের দিনে গাড়ি চালাচ্ছি না দু’হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে বলে? না তা কিন্তু নয়, আমি চালাচ্ছি না বায়ুদূষণ কমানোর জন্য। গাড়িটা ব্যবহার করতে হয় নিরাপত্তার জন্য। নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা না থাকলে সাইকেল চালাতাম। শিওর।
তৃতীয় দিন :
রাত আটটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত জোড়-বেজোড় নম্বরের যে কোনও গাড়িই চলতে পারে দিল্লির রাস্তায়। কাল তাই আটটার পর বেরিয়েছি। মানুষ চাইলে বায়ুদূষণ বাড়াতে পারে, মানুষই চাইলে কমাতে পারে এটি। শুনেছি ঢাকায় দূষণও বেশি, ট্রাফিক জ্যামও বেশি। কোথাও যেতে হলে নাকি দু’তিন ঘণ্টা ট্রাফিকে আটকে থাকতে হয়। ঢাকা কি পারে না দিল্লির মতো জোড়-বেজোড় ফর্মুলা প্রয়োগ করতে? ঢাকায় মেট্রো নেই, কিন্তু পাবলিক বাসের সংখ্যা তো বাড়াতে পারে! সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি তা জানি, কিন্তু লাক্সারির চেয়ে সময়ের মূল্যও তো বেশি। কী দরকার প্রতিদিন গাড়ি বের করে! ঢাকায় তো হেঁটে হেঁটেই অনেক জায়গায় চলাফেরা করা যায়। কিন্তু ফুটপাত আছে কি শহরে? থাকলেও হয়তো দখল হয়ে গেছে।
সাইকেলের পথ? সম্ভবত নেই। সরকারের তহবিলে টাকা পয়সা নেই যানজট আর দূষণ দূর করার? ফুটপাত পরিষ্কার করার, সাইকেলের জন্য সরু পথ তৈরি করার, ভালো পাবলিক বাসের সংখ্যা বাড়ানোর? আমার বিশ্বাস, সরকারের ক্ষমতা আছে কিন্তু ইচ্ছে নেই। সরকারি লোকেরা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের জগত্ দেখেন। তাদের গাড়ি যানজটে দাঁড়িয়ে থাকে না। সুতরাং তাঁরা না বুঝলেও তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব জনগণের নেওয়া উচিত। বাচ্চা না কাঁদলে নাকি মা-ও দুধ দেয় না। তাহলে কাঁদুক জনগণ। চিত্কার করুক।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৭ জানুয়ারি, ২০১৬