1 of 2

ডুব – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

ডুব – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

অতীনদা সবরকম লেখা লিখতে পারেন। প্রেমের গল্প বলেন তো প্রেমের গল্প। অ্যাডভেঞ্চার বলেন তো অ্যাডভেঞ্চার। খেলাধুলোর গল্প? মনে হবে, তার মতো তুখোড় খেলোয়াড় আর দর্শক জন্মায়নি। তাঁর মতো ভালো রেফারি জন্মায়নি। অলিম্পিকের রেকর্ড তাঁর মুখস্থ। আর গান? রবীন্দ্র—সংগীত? রবীন্দ্রনাথ কত গান লিখেছিলেন, অতীনদা এক নিশ্বেসে বলে দেবেন। অতুলপ্রসাদ? গড় গড় করে আবৃত্তি করার মতো, অথচ গুনগুন করে গেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি আপনাকে তাঁর গান শুনিয়ে যাবেন।

অতএব খবরের কাগজে জার্নালিস্ট হবার, যাকে বলে কোয়ালিফিকেশন, সবটাই তাঁর আছে। কিন্তু কোথাও চাকরি তিনি করেন না।

লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা, যশ—সব কিছুই তিনি পেয়েছেন। কিন্তু টাকাকড়ি যতটা পাবার কথা তার সিকি ভাগও পাননি। বরং তার জন্য যে কোনোরকম দুঃখ তাঁর আছে—তাঁর সঙ্গে মিশলে সেটা বোঝা যায় না।

কোনোদিন কারোর নিন্দে তাঁর মুখে শোনা যায়নি। যদি বলেন, অমুক লেখকের অমুক লেখা খুব খারাপ—তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, সেই লেখকের সেই লেখাটা পড়েননি?

অর্থাৎ, এক কথায়, সবাইকার ভালোর দিকটা তিনি দেখেন। না বললেও বুঝি—তিনি বলতে চান, মানুষের মন্দ দিক, মানুষের নিন্দে করার মতো লোকের অভাব নেই। তিনি, সেই সব লোকদের দলে কেন যোগ দিতে যাবেন?

আমাদের সেই অতীনদাকে সন্ধেবেলায় সস্তার একটা চায়ের দোকানে আমরা ধরে বসলাম, ‘দাদা, আপনি ভগবান বিশ্বাস করেন?’

তিনি বললেন, ‘মানুষের মধ্যে ভগবানকে বিশ্বাস করি।’

‘ভগবানের মধ্যে মানুষকে?’

‘জানি না।’

‘মানুষের মধ্যে ভূতকে?’

‘জানি না।’

‘ভূতে বিশ্বাস করেন?’

‘জানি না।’

‘আপনি তো সবরকম লেখায় সিদ্ধহস্ত—’

‘সবরকম লেখায় কেউ সিদ্ধহস্ত হতে পারে নাকি? এক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া? আর কোন দেশে কোন সেঞ্চুরিতে ক—টি করে রবীন্দ্রনাথ জন্মান— বল তো?… তবে হ্যাঁ, নানারকম লিখেছি। শুধু আধুনিক কবিতা ছাড়া।’

‘কেন?’

‘কারণ আধুনিক কবিতা লিখতে শিখতে হয়। সেটা আমি শিখতে পারিনি। কিন্তু ছোট্ট একটি আধুনিক কবিতা আমাকে এমন নাড়া দেয়, যেটা হাজার পাতার ক্লাসিক্সও আমাকে নাড়া দেয় না।’

‘কিন্তু যেকোনো পত্রিকা খুললেই তো কবিতা দেখি, যাকে বলে আধুনিক কবিতা। মনে হয় তো, আধুনিক কবিতা লেখার মতো সহজ কাজ নেই—’

অতীনদা খুব যত্ন করে কড়া একটা বর্মা চুরুট ধরালেন। চুরুটের আগায় ভালো করে আগুন ধরেছে কিনা ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে দেখলেন। তারপর লম্বা একটা টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, চুরুটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে, চায়ের পেয়ালায় এক চুমুক দিয়ে, চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আপন মনেই হাসতে লাগলেন।

আমাদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করল, ‘অতীনদা, হাসছেন কেন?’

‘হাসছি তোমাদের হাসির কথা শুনে।—কতবার তোমাদের বোঝাব যে, কবিতার দুটো লাইন মিললেই যেমন কবিতা হয় না, তেমনি কোনো লাইন না মিললেই কবিতা হয় না—না আধুনিক, না অনাধুনিক। আসল কথা মনে রেখ, সব জিনিসেরই ব্যাকরণ আছে। কুমোর যে মাটির খুরি, গেলাস, ভাঁড় বানায়, তাকে কুমোরের চাকার ব্যাকরণ শিখতে হয়। ধুনুরি, যে তুলো ধোনে, তাকে শিখতে হয় ধুনুরির ধনুকের ব্যাকরণ। তেমনি জেলেকে, চাষিকে, ঘাস—কাটিয়েকে। আর্টিস্টকে, কবিকে, অভিনেতাকে, সাহিত্যিককে।—যারা এখন আধুনিক কবিতা লিখছে বলে মনে করে—আমার তো মনে হয়, তাদের অধিকাংশরই আধুনিক কবিতার অক্ষর—পরিচয় হয়নি—ব্যাকরণ তো দূরের কথা।

আমরা প্রায় সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘অতীনদা, আপনি ভারি সিরিয়াস ডিসকাশনে চলে যাচ্ছেন—’

চুরুটে আর এক টান দিয়ে, চায়ের পেয়ালা শেষ করে, আর এক পেয়ালা কড়া গরম চায়ের অর্ডার দিয়ে তিনি বললেন, ‘সেটা তো তোমাদেরই দোষ। একটা সিরিয়াস সাবজেক্ট তোমরা পড়েছ। সেটার তো সিরিয়াস ডিসকাশন দরকার!—যাকগে, কোনো লাইট টপিক তোল। তাহলে লাইট ডিসকাশনে আসতে পারি।’

আমাদের একজন বলল, ‘অতীনদা, আপনি তো বহু গল্প লিখেছেন, কিন্তু আপনার কোনো ভূতের গল্প তো পড়িনি! সব গল্পের মধ্যেই তো প্রেমের কথা—’

অতীনদার মেজাজের তখনও যে সিরিয়াস ডিসকাশনের ঘোর কাটেনি, সেটা তাঁর উত্তর শুনেই আমরা বুঝলাম।

তিনি বললেন, ‘আসলে কি জানো, আসলে প্রেমের গল্পও যা, ভূতের গল্পও তাই। মানুষকে ভূতে না পেলে প্রেমে পড়ে না, আর প্রেমে না পড়লে মানুষ কখনো ভূত হয় না—’

আমি বললাম, ‘দোহাই অতীনদা! সন্ধের আড্ডাটা মাটি করবেন না। আমাদের একটা ভূতের গল্প বলুন।’

অতীনদার চুরুটটা নিভে গিয়েছিল। বিরক্ত হয়ে সেটা ছাইদানে রেখে আর একটা চুরুট ধরাতে ধরাতে তিনি বললেন, ‘প্রেমের গল্প লেখার চেয়ে ভূতের গল্প বানানো অনেক কঠিন। সত্যিকারের ভূতের গল্প লিখতে হলে এডগার অ্যালন পো হতে হয়। তিনি আবার অনেক বিখ্যাত কবিতাও লিখেছেন। আমি কবি নই, এডগার অ্যালান তো নই—আমি কী করে ভূতের গল্প বানাই? তবে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। এখনও সে ঘটনার কথা আমার প্রায়ই মনে হয়। কারণ কোনো যুক্তিতর্ক দিয়ে সেটার কোনো সলিউশন খুঁজে পাই না। সেটাকে ভূতের গল্প বলতে চাইলে ভূতের গল্পও বলতে পার।’

‘বলুন, বলুন।’ চারদিক থেকে শোরগোল উঠল।

আড্ডা জমেছে দেখে চায়ের দোকানের মালিক আমাদের সবাইকার জন্য আবার এক রাউন্ড চা পাঠিয়ে দিলেন।

অতীনদার চুরুটটা ততক্ষণে বেশ ভালো করে ধরেছে। সেটা টানবার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বলে চললেন—

‘জানো তো, যারা বইয়ের ব্যবসা করে, তারা সবাইকে নগদ পয়সা মিটিয়ে দেয়। কাগজওয়ালা টাকা না দিলে কাগজ দেয় না। প্রেস টাকা না পেলে ছাপে না। দপ্তরি টাকা না পেলে বই বাঁধে না। কিন্তু মজার কথা, প্রকাশকদের যাদের নিয়ে ব্যবসা, যাদের বই তারা ছাপে—তাদের প্রাপ্য টাকা দিতে গেলেই প্রকাশকদের মনে হয় খুব একটা বাজে খরচ হচ্ছে।’

তখন আমার খুবই দৈন্যদশা। সবে আমার নতুন উপন্যাসটার বেশ নাম—ডাক হয়েছে। সেটার নাম ‘জানলার আয়না’। কলেজ স্ট্রিট পাড়ার এক প্রকাশক সাতশো টাকা দেবে বলে উপন্যাসটা ছাপিয়েছে। শুনেছিলাম, বইটা হু—হু করে কাটছে। তাই, যেদিন আমাকে প্রথম কিস্তির দরুন দুশো টাকা দেবার কথা, সেদিন এগারোটা নাগাদ কলেজ স্ট্রিটের পাড়ায় গিয়েছিলাম।

যে বুড়ো লোকটি দোকান খোলে—আমারই মতোই দুঃখী লোক সে। দেখি, দোকান বন্ধ। মালিক তখনও আসেনি।

সেই বুড়ো লোকটি বলল ঘণ্টাখানেক বাদে আসতে।

কলেজ স্ট্রিটে ঘুরে কোথায় বেড়াই? কফি হাউসে গেলে অন্তত এক পেয়ালা কফি খেতে হয়। বসন্ত কেবিনে গেলে এক পেয়ালা চা। প্যারাগনে গেলে এক গেলাস শরবত।

কিন্তু কফি—চা—শরবত কিনলে টালিগঞ্জে ফেরার বাসভাড়া থাকে না।

তাই বিনা খরচায় সময় কাটাবার একমাত্র যেটা উপায় তাই করলাম। মরচে পড়া লোহার গেট ঠেলে ঢুকলাম কলেজ স্কোয়ার পুকুরের এলাকায়।

দেখি সেখানেও রয়েছে আমারই মতো দুঃখী মানুষের ভিড়। কেউ ছেলে, কেউ বুড়ো। কেউ—এক কালে যে মেয়ে ছিল, এখন হাঁটু পর্যন্ত তোলা কাপড় আর ছেঁড়া আঁচলে আব্রু রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে যে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

একটা পাগল ঘাসে গড়াগড়ি দিতে দিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে পরমানন্দে হাসছে।

লুঙ্গি—পরা একটা লোক—তার বাঁ—পা’টা কী করে কাটা পড়ে ছিল জানি না—ক্রাচ—এ ভর দিয়ে পুকুরের রেলিঙের পাশে এসে তার ক্রাচ দুটো রেলিঙে ঠেসান দিয়ে রেখে, অদ্ভুত দক্ষতায় রেলিঙ টপকে নেমে, একটা গামছা পরে পুকুরে নামল।

আর একজনের গায়ে দগদগে ঘা। সেও গামছা পরে পুকুরে নামল।

একটা ঘেয়ো কুকুর—সেটাও জলে নামল।

আর পুবদিকে দেখি কচি—কচি ছেলেরা সাঁতার কাটছে। দক্ষিণের দিকে দেখি কচি—কচি মেয়েরা সাঁতার কাটছে। মাঝ—পুকুরে দেখি পুকুরতলায়—গাঁথা, জলের ওপর মাথা—উঁচিয়ে—থাকা ক্ষয়ে যাওয়া পোস্ট ধরে সাঁতরাবার ফাঁকে দম নেবার জন্যে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে।

আমার মাথার মধ্যেটা ঝাঁ—ঝাঁ করে উঠল। এটা কি সুইমিংপুল? যেখানে নানা দুরারোগ্য অসুস্থ লোক স্নান করছে, সেখানকার জলে সাঁতার কাটছে কচি বয়সের ছেলেমেয়েরা। সেখানকার জলে কুলকুচো করছে। জলে নেমে কেউ জলবিয়োগ করছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। এবং তাদের আমি কোনো দোষ দিই না। কারণ পঁচিশ বছর স্বাধীনতার পর আমরা, সত্যি বলতে কী, কিছুই বানাতে পারিনি। বড়ো বড়ো কথা শুনি—ডিভিসি ময়ূরাক্ষী, কত কী? কিন্তু অতশত বড়োসড়ো প্রোজেক্টের কথা থাক; তোমরা সবাই তো জানো, সেগুলোর কোনোটাই একশো ভাগের এক ভাগও কাজ করে না। কিন্তু পঁচিশ বছর স্বাধীনতার পরও কলকাতার লোকেদের জলবিয়োগ করার জায়গা কেন থাকে না, বলতে পার? লাটসাহেবের বাড়ির সামনে পুলিশদেরও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ কীর্তি করতে দেখেছি।

যাক, এটা ভূতের গল্প, রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়।

কিন্তু এখন দেখছি, রাজনীতি থেকে ভূত ছাড়াবার লোক কেউ নেই।

যাকগে সিরিয়াস ডিসকাশন। যে ঘটনার কথা বলব বলেছিলাম, সেটাই বলি।

কলেজ স্কোয়ারের বসবার যেসব বেঞ্চি, সেগুলোর অত্যন্ত দৈন্যদশা। অধিকাংশ বেঞ্চিরই পিঠের দিকে ঠেসান দেবার জায়গাটা কে বা কারা কবেই খসিয়ে নিয়ে গেছে। অনেক বেঞ্চির বসবার কাঠটাও নেই। দেখি যেসব বেঞ্চিতে বসবার কাঠ রয়েছে, সেগুলোয় লোক শুয়ে। কারোর পরনে লুঙ্গি, কারোর বা হাফ—প্যান্ট আর জাঙিয়া। বেশিরভাগ লোকেরই আদুল গা। কারোর—কারোর গায়ে কুটিকুটি গেঞ্জি। কুটকুটে ময়লা।

বসবার জায়গা পেলাম না। অগত্যা কলেজ স্কোয়ারের চারপাশে ঘুরতে শুরু করলাম। মনে মনে হিসেব করছি, ক—বার চক্কর দিলে ঘণ্টাখানেক সময় কাটে।

এমন সময় হঠাৎ দেখি ডাইভ দেবার কংক্রিটের জায়গাটার উলটোদিকের একটা বেঞ্চি ছেড়ে এক আধবুড়ো লোক আড়মোড়া ভেঙে উঠল। তার মাথার নীচেকার পুঁটলি হাতড়ে একটা বিড়ি বার করল। তারপর অনেক হাতড়াতে লাগল। বুঝলাম দেশলাই খুঁজছে। দেশলাই সে খুঁজে পেল না। তাই আমার দিকে এগিয়ে এসে সে বলল, ‘ছ্যার, মাচিস আছে?’

আমিও তার ফাঁকা জায়গাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে বললাম, ‘এই নিন।’

দেশলাইটা তাকে বাড়িয়ে দিলাম।

আমি আমার হাতের খবরের কাগজটা খুললাম। তখন চৈত্র মাসের শেষ। ভারি কড়া রোদ্দুর! আমার ছাতা নেই। খালি মাথায় কলেজ স্কোয়ার দু—বার চক্কর দেওয়ায় মাথাটাও কীরকম যেন ঘুরপাক খাচ্ছিল।

সেই ডাইভ দেবার জায়গাটার সামনের বেঞ্চিতে তো বসলাম। তারপর খবরের কাগজটা খুলে ধরলাম।—আজকালকার খবরের কাগজে সবকিছু ছাপা হয়। শুনি লাখে লাখে বিকোয়। কিন্তু পড়া যায় না। পাঠ্যবস্তুর অভাবের জন্য নয়, ছাপার জন্য।

চড়চড়ে রোদে খালি মাথায় কয়েকবার কলেজ স্কোয়ার পাক দেওয়ায় আমার মাথাটাও পাক খাচ্ছিল।

খবরের কাগজের লাইনগুলো চোখের সামনে যেন নাচছিল। এমন সময় হঠাৎ সামনের পুকুরে ঝুপ করে একটা শব্দ শুনলাম।

তাকিয়ে দেখি, জলের ওপর গোলচে ধরনের ছোট্ট একটা তরঙ্গ উঠেছে। বুঝলাম কেউ একজন ডাইভ কেটেছে। সেই গোলচে তরঙ্গ ক্রমশ বড়ো হতে লাগল। তারপর পুকুরের কিনারায় বার কয়েক ছলাৎ ছলাৎ করে মিলিয়ে গেল।

আমি তাকিয়ে রইলাম।

অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু কী সর্বনাশ! কোন মানুষ জল থেকে উঠে এল না!

ভাবলাম, আমারই হয়তো ঝুপ করে শব্দ শোনাটা ভুল।

ঘড়িতে দেখি দুপুর বারোটা। অতএব সেই এক ঘণ্টা সময় পার হয়ে গেছে। তাই প্রকাশকের দোকানে গেলাম। প্রকাশকমশাই বললেন, ‘দুশো দেব বলেছিলাম। কিন্তু বাজার ভারি খারাপ। এই নিন ষাট টাকা; সামনের মঙ্গলবার সকাল এগারোটায় আসবেন। দেখি কি করতে পারি—’

মনে হল যেন কৃপা ভিক্ষে করতে এসেছি! মনে হল, কলম না চালিয়ে কোদাল দিয়ে মাটি কোপাতে শিখলে অনেক ভালো হত!

কিন্তু ইংরেজিতে একটা কথা আছে—বেগার্স আর নো চুসার্স। অর্থাৎ যারা ভিক্ষুক, তাদের ভালো—লাগা, মন্দ—লাগার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম, ভিক্ষুকদের চেয়েও লেখকরা অনেক বেশি অসহায়। ভিক্ষুকরা তো হাত পেতে সোজা ভিক্ষে চায়। লেখকরা তো চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে চাইতে পারে না।

সেই মঙ্গলবার সকাল এগারোটায় আবার গেলাম কলেজ স্ট্রিট। প্রকাশকের দোকান বন্ধ। সেই বুড়ো লোকটি আমাকে আবার বলল, ঘণ্টাখানেক ঘুরে আসতে।

আবার তাই কলেজ স্কোয়ার। প্রচণ্ড রোদ। ঘুরতে ঘুরতে সেই ডাইভ দেবার জায়গাটার সামনের বেঞ্চি থেকে হুবহু সেই আধ—বুড়ো লোকটা আড়মোড়া ভেঙে উঠে তার পুঁটলি থেকে দেশলাই খুঁজে পেল না। বিড়িটা দাঁতে চেপে আমার কাছে এসে বলল, ‘ছ্যার, মাচিস আছে?’

রোদে—রোদে খালি মাথায় ঘোরার মধ্যে যেন একটা নেশা আছে। সেই নেশার ঘোরেই লোকটাকে দেশলাই দিলাম। তার খালি জায়গায় বসলাম। তারপর কী যেন মনে হওয়ায় খবরের কাগজটা না খুলে সোজা তাকিয়ে রইলাম ডাইভ দেবার সেই কংক্রিটের স্ট্রাকচারটার দিকে।

সেদিন আমার দেখার কোনো ভুল হয়নি। সব কিছু স্পষ্ট দেখলাম। মই বেয়ে একটা লোক উঠে সবচেয়ে উঁচু জায়গা থেকে ডাইভ দেবার জন্যে তৈরি হয়েছে।

সবচেয়ে উঁচু পাটাতনের কিনারে গিয়ে লোকটা দাঁড়াল। তারপর একবার বাঁ হাত দিয়ে ডান দিকের ঘাড় আর বুক, আর ডান হাত দিয়ে বাঁদিকের ঘাড় আর বুক ঘষতে লাগল।

মানুষটা খুব একটা লম্বা—চওড়া গোছের নয়। মনে হল, ছোট্টখাট্ট ধরনের হলেও বেশ গাঁট্টাগোট্টা। তার চোখ মুখ খুব খুঁটিয়ে দেখতে না পারলেও—একটা জিনিস স্পষ্ট দেখলাম। সেটা তার বাঁদিকের বুক থেকে ডানদিকের বুক পর্যন্ত একটা ক্ষতের দাগ। মনে হল, অতীতে কোনো একদিন সে—জায়গাটায় মস্ত বড়ো একটা অপারেশন করা হয়েছিল। দাগটা সেই অপারেশনের স্টিচ করার দাগ।

লোকটাকে আমি যেরকম খুঁটিয়ে দেখছিলাম—দেখি, সেও আমাকে সেরকম খুঁটিয়ে দেখছে।

তারপর লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি হাসল। কেন জানি না, শিরশির করে উঠল আমার মাথার চুল থেকে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ পর্যন্ত।

আর তারপরেই লোকটা নিখুঁত ডাইভ কাটল।

অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের মতো সেই ডাইভ। মনে হল, শানানো একটা ছুরির মতো তার দেহ কলেজ স্কোয়ারের জলের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। আর ছোট্ট গোল একটা তরঙ্গ জলের ওপর উঠে ক্রমশ বড়ো হতে হতে মিলিয়ে গেল পুকুরপাড়ে।

লোকটার ভেসে ওঠার জন্যে রুদ্ধশ্বাসে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। লোকটা কিন্তু ভেসে উঠল না।

যে—ছেলেটি জুতো পালিশ করে বেড়ায়, তাকে প্রশ্ন করলাম, কাউকে ডাইভ কাটতে সে দেখেছে কিনা। ছাতি—মাথায় এক বুড়ো পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকেও প্রশ্ন করলাম।

তারা এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন আমি একটা ডিলিরিয়ামের ঘোরে কথা বলছি। গ্রীষ্মকালের কাঠফাটা রোদ্দুরে লোক স্নান করতে আসতে পারে। কিন্তু ডাইভিং—বোর্ড থেকে নিখুঁত ডাইভ কাটার শখ কারোর থাকে না।—এ ধরনের কীসব কথা যেন তারা বলছিল।

আবার গেলাম প্রকাশকের দোকানে। আবার ষাট টাকা যেন ভিক্ষে করে পেলাম! শুনলাম, বইয়ের বাজার খারাপ। পরের সপ্তাহে আবার আসতে বলল।

আবার পরের সপ্তাহ।

আবার প্রকাশকের দোকান বন্ধ।

আবার কলেজ স্কোয়ার। আবার সেই ডাইভিংয়ের কংক্রিটের স্ট্রাকচার। সবচেয়ে উঁচু জায়গা থেকে আবার সেই লোকটার ডাইভ কাটা—সেই নিখুঁত ডাইভ কাটা। আবার আমার সেই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করা—লোকটার ভেসে ওঠার জন্যে।

কিন্তু সেবারেও লোকটা ভেসে উঠল না।

সেই চড়চড়ে রোদে দাঁড়িয়ে জীবনে সেইবারই প্রথম মনে হল, যে—লোকটা জলে ঝাঁপায় আর তারপর জল থেকে ওঠে না, সে মানুষ হতেই পারে না। নির্ঘাৎ সে ভূত! কিন্তু কলেজ স্কোয়ারে ভূত? কেউ কবে এমন কথা শুনেছে? কে বিশ্বাস করবে? বলতে গেলেই তো লোকে আমার দিকে এমনভাবে তাকাবে যাতে মনে হবে—আমার থাকার জায়গা কলকাতা নয়, রাঁচির কাঁকে—তে।

তারপর গ্রীষ্ম শেষ হল।

বর্ষাকালের মাঝামাঝি প্রকাশকের কাছে মোটামুটি টাকা আদায় হল।

আমার আর একটা উপন্যাস বাজারে বেরোল শরৎকালের গোড়ায়। বেশ একটা হইচই পড়ে গেল। আমার নতুন উপন্যাসের জন্য নানা প্রকাশক তখন আমার বাড়িতে ঘোরাঘুরি শুরু করে দিয়েছে। যারা আগে আমায় চিনেও চিনতে পারত না, দেখি তারা আমার বাড়ি আসতে শুরু করেছে। অর্থাৎ নতুন—নামকরা লেখকের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে বলে জানাতে অনেকেই চায়।

অর্থাৎ ধরো, আমি যেন সেই ডাইভ—কাটা লোক। পুকুরে ডাইভ কাটি। অর্থাৎ লিখি। সামান্য তরঙ্গ ওঠে। ব্যস—তার বেশি নয়। ভেসে উঠতে পারি না।

কিন্তু তখন আমি রীতিমতো ভেসে উঠেছি। আর সত্যিই যে ভেসে উঠেছি, তার প্রমাণ পেলাম আমার এক ইস্কুলের সহপাঠীকে আমার বাড়িতে এসে নিমন্ত্রণ করতে দেখে। তার মামার কৃপায়—মামা ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের নামজাদা মন্ত্রী—আমার সঙ্গে বিএ পাশ করার পরেই ইউনেস্কোতে বেশ মোটা একটা চাকরি সে বাগিয়েছিল। আমেরিকায় তার আপিস। তিন বছর ছাড়া—ছাড়া সপরিবারে একবার আসে কলকাতায়। আগেও অনেকবার এসেছে। কিন্তু আমার খোঁজ করেনি।

কিন্তু এবার আমার বাড়িতে সস্ত্রীক তারা এসে হাজির। কারণ বোধহয়, কাগজে—টাগজে আমার নাম—ডাক হয়েছে শুনে। তারা বলল, পরের সপ্তাহেই তাদের আমেরিকা যেতে হচ্ছে। যাবার আগে তাদের বাড়িতে একটা পার্টির আয়োজন করেছে। ছেলেবেলার অনেক বন্ধু আসবে। আমাকে যেতেই হবে। কারণ, অমি নাকি—ইত্যাদি, ইত্যাদি—

গেলাম তাদের পার্টিতে। সে এক এলাহি কাণ্ড! খাবার—দাবার অঢেল। আর দামি—দামি স্কচ হুইস্কির যেন ফোয়ারা বইছে।

টেবিলে আমার পাশে যে—লোকটা বসেছিল, সে খুব একটা লম্বা—চওড়া গোছের নয়। মনে হল, ছোট্টখাট্ট হলেও বেশ গাঁট্টাগোট্টা।

মুখটা যেন খুব চেনা—চেনা। কোথায় যেন দেখেছি।

বুঝতেই পারছ— লোকটা সেই কলেজ স্কোয়ারে ডাইভ—কাটা লোক। যে জলে ঝাঁপ দিত কিন্তু ভেসে উঠত না।

শুনলাম, আমরা বন্ধুর সঙ্গে পরের সপ্তাহে একই প্লেনে যে যাচ্ছে আমেরিকা। সেখানেই সে নাকি একটা রেস্তোরাঁ চালায়। জমজমাট ব্যবসা।

লোকটাকে একেবারে পাশের চেয়ারে দেখে খুঁটিয়ে তাকে দেখবার সুযোগ পেলাম। তার মুখটা যে খুব একটা খারাপ, তা নয়। বরঞ্চ ভালোই বলতে হবে। কিন্তু তার মুখের মধ্যে একটা কী যেন নেই।

স্যুপ শেষ করে ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করল, ‘ক্ষমা করবেন, আপনার সঙ্গে আগে কখনো পরিচয় হয়েছিল? আপনার মুখ খুব চেনা—চেনা….’

আমি বললাম, ‘আপনাকেও আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু যদি মনে না করেন, তাহলে একটা প্রশ্ন করি—আপনার বাঁ দিকের বুক থেকে ডান দিকের বুক পর্যন্ত একটা ক্ষতের দাগ আছে কি?

চমকে উঠে লোকটা বলল, ‘কী করে জানলেন? আমেরিকায় এক সুইমিং পুলে ডাইভ কাটতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে যাই। জ্ঞান হলে দেখি, হাসপাতালে। বুক—পিঠে প্লাস্টার। পাক্কা ছ—মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল, স্টিচের দাগ এখনও মেলায়নি।

সে—রাতে আমার একেবারেই ঘুম হল না। কেবলই মনে হতে লাগল, সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কেমন যেন অশুভ একটা ইঙ্গিত আছে।

তার পরের দিন ভোরেই আমার সেই বন্ধুর বাড়ি ছুটলাম। তাকে আর তার স্ত্রীকে সব ঘটনার কথা বললাম।

আমার বন্ধু তো হেসেই সব কথা উড়িয়ে দিতে চাইল।

কিন্তু বন্ধুর স্ত্রী ভীতু মানুষ। রেস্তোরাঁর সেই মালিকের সঙ্গে এক প্লেনে কিছুতেই সে যেতে রাজি হল না।

ফলে আমার বন্ধু আমার ওপর বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে ফ্লাইট ক্যানসেল করে দু—দিন পরের ফ্লাইট বুক করল। আর রেস্তোরাঁর সেই মালিক প্লেনে উঠল তার আগেকার বুকিং অনুযায়ী।

সেই প্লেনটা দমদম থেকে রানওয়ে দিয়ে ছুটতে গিয়ে খানিক উঠে কী একটা মেকানিক্যাল ডিফেক্টের দরুন মাটিতে আছড়ে ফেটে চৌচির হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে শেষ হয়ে গিয়েছিল।

কাগজে তার কথা তোমরা পড়েছিলে নিশ্চয়ই।

কিন্তু এই সব ঘটনার কোনো মানেই আজ পর্যন্ত বুঝতে পারি না।

এটা কি ভৌতিক ব্যাপার?

নাকি ভবিতব্য?

ভূত আমি মানি না, ভবিতব্যও মানি না। তাহলে এটা কী?

অতীনদা আর একটা কড়া চুরুট ধরিয়ে আর এক রাউন্ড চায়ের অর্ডার দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *