ডাক
প্ল্যাটফর্ম-এ দু-চারজন মানুষ তিন-চারটে কুকুর এবং একজন ফেরিওয়ালা, জনা কয়েক বেকার। উঠবেও দু-একজন নামবেও তাই। মধ্যপ্রদেশের কয়লাখাদান এলাকার অত্যন্ত ছোট্ট জায়গাটা এইরকমই। ট্রেনটা এসে গেল। দু-মিনিট স্টপেজ। প্ল্যাটফর্ম বলতেও এই জঙ্গুলে জায়গাতে কিছু নেই, রুখু কাঁকরময় জমি থেকেই উঁচু সিঁড়িতে পা দিয়ে উঠতে-নামতে হয়। শ্রীতমা এখন স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারেন না। হাঁটু দুটিতে জোর পান না একেবারেই। লাঠি নিয়ে চলতে হয়। তাই শালিখ লাঠিঠা ওঁর হাত থেকে নিয়ে প্রায় কাঁধে করেই শ্রীতমাকে দিল থার্ড ক্লাস স্লিপারে। দরজাতে দাঁড়ানো দুজন মানুষ অবশ্য প্রৌঢ়াকে হাত ধরে ভেতরে টেনে নিলেন। শ্রীতমার লাঠিটা উঁচু করে তুলে ধরলেন শালিখ। ওঁরাই টেনে নিলেন সেটা। শালিখ একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, একটু দেখবেন ওঁকে। আপনারাও হাওড়াই যাবেন কি?
জি হাঁ। কোই ফিক্কর মত কিজিয়ে বাবা, মাহিজি কা দেখভাল করেগা হামলোগোঁনে। একেলি যা রহা হ্যায় ক্যা?
জি হাঁ।
এবারে শালিখ বলল, ট্রেনটা ছেড়ে দিল। শ্রীতমা মনে হল, দরজার কাছে এসে কিছু একটা বলতে চাইলেন, কিন্তু সময়াভাবে পারলেন না। শালিখ লাফ দিয়ে ট্রেনের সিঁড়ি থেকে নেমে পড়লেন। আগেকার স্টিমইঞ্জিনের ট্রেন আর নেই যে ধুস-ধুস-ধুস করতে করতে ‘রেডি, গেট সেট, গো’ ইঙ্গিত পেয়ে ধীরে ধীরে চলা আরম্ভ করে গতিজাড্য বাড়াবে ধীরে। শালিখও আগের শালিখ নেই। তাঁরও হাঁটু কটকট করে। তবে শ্রীতমা বয়েসে তাঁর বছর তিন-চারের ছোটো। তা ছাড়া মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে তাড়াতাড়ি বুড়োও হয়ে যায়। শালিখ প্ল্যাটফর্ম-এ দাঁড়িয়ে দেখলেন ট্রেন-এর পেছনের লাল বাতিসমেত গার্ডসাহেবের কামরাটিও গভীর জঙ্গলের মধ্যে ক্রমশ সরু হয়ে আসা রেলের লাইন দুটোর ওপরে একসময়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলেন ফাঁকা হয়ে যাওয়া প্ল্যাটফর্ম-এ।
কে গেলেন? আপনার ওয়াইফ কি?
হঠাৎই কে যেন বলে উঠলেন শালিখ-এর কানের পাশে।
নতুন আসা এই মিরিমাড় স্টেশানের স্টেশানমাস্টার সর্বদমনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।উত্তর কলকাতার বাসিন্দা এই উত্তর চল্লিশের সর্বদমন ঘোষ মানুষটাকে প্রথম দর্শনেই খারাপ লেগেছিল শালিখবাবুর। বড়ো বেশি কৌতূহল মানুষটির। আর তাঁর জগৎটাও বড়ো বেশি ছোটো। আজকাল সংসারে এমন ইতর, ক্ষুদ্রমনা পুরোপুরি গন্তব্যহীন মানুষই বেশি দেখা যায়। একজন ভদ্রলোকের পক্ষে অন্যের ব্যাপারে কতখানি কৌতূহল শোভন সে-সম্পর্কেও কোনো ধারণাই নেই মানুষটির। তা ছাড়া বড়ো বেশি পরনিন্দা-পরচর্চা করেন। যাঁর নিজের জীবনেই কোনো গন্তব্য নেই, তিনি সকালসন্ধে বিভিন্ন গন্তব্যে রওনাও করাচ্ছেন খয়েরি সরীসৃপের মতো নানা ট্রেনকে। তাঁর মানসিকতা কিন্তু এমনই এক পর্যায়ের যে, শ্রীতমা যে শালিখবাবুর ঠিক কে, তাই শোনবার জন্যেই সর্বদমন আকুলিবিকুলি করছেন। কিন্তু সত্যি কথা বললেও তা হজম করার মতো ঔদার্য সর্বদমনবাবুর কখনোই হবে না। ছোটো জায়গাতে বাস করা, ছোটো বৃত্তের ঘেরাটোপের মধ্যে সাধারণ একজন অর্ধশিক্ষিত মানুষকে শ্রীতমা তাঁর কে হন, তা বলে কোনো লাভও হত না। কারণ, মানুষ-মানুষীর মধ্যে ‘হাজব্যাণ্ড-ওয়াইফ’ ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্কও যে আদৌ থাকতে পারে সে-সম্বন্ধে এমন গন্ডিবদ্ধ মানুষের কোনো ধারণাই নেই। তাই, শালিখ মুখে কিছু না বলে হ্যাঁ-ও বোঝায়, না-ও বোঝায় এমনইভাবে মাথাটা নাড়লেন। শ্রীতমা যেদিন মিরিমাড়-এ আসেন তখন সর্বসন্ধিৎসু সর্বদমন স্টেশানে ছিলেন না।
সর্বদমনবাবু বললেন, দেখেই বুঝেছিলাম। এখনও এত সুন্দরী। যৌবনে কীরকম যে ছিলেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
তার পর বললেন, আপনারা তো মেসোমশায়, যৌবনে ‘মেড ফর ইচ আদার’ কম্পিটিশানে নাম দিতেও পারতেন।
সামান্য পরিচিত মানুষদের মেসোমশাই বা কাকাবাবু সম্বোধন শালিখের একেবারেই পছন্দ নয়। বাঙালিরা ছাড়া অন্য কোনো প্রদেশীয় মানুষদেরই সম্ভবত এতজন স্বামীবিচ্ছিন্ন মাসি অথবা এতজন ভ্রাতাময় পিতৃদেব হয় না।
শালিখবাবু কিছু না বলে, মাস্টারমশাইকে নমস্কার জানিয়ে এগোলেন।
প্রয়োজন যে একেবারেই বোধ করেন না, তা নয়, তবুও লাঠি নেন না শালিখবাবু। যতদিন বাঁচেন কারো ওপরেই নির্ভরশীল হতে চান না। এমনকী লাঠির ওপরেও নয়। সন্ধে নেমে যাবে একটু পরেই। তাড়াতাড়িতে টর্চটাও আনেননি। কৃষ্ণপক্ষ এখন। আর দু-দিন পরেই কালীপুজো।
কালীপুজোর দিন শ্রীতমার মেয়ে এবং জামাই তাঁর কাঁকুড়গাছির দু-কামরার ফ্ল্যাটে আসবে নাতি-নাতনিকে নিয়ে। নিজে হাতে লুচি আর পাঁঠার মাংস রেঁধে খাওয়াবেন শ্রীতমা। সঙ্গে আলুবোখরার চাটনি। তাঁর নাতনি এ-চাটনি খেতে খুব ভালোবাসে। আসবে মানে, আসবার কথা আছে। শেষপর্যন্ত আসবেই যে, তা জোর করে বলতে পারেন না।
শ্রীতমা ভালো করেই জানেন, তাঁর জামাই, সমাজের যে-তলার বাসিন্দা, তার জীবনযাত্রা যেরকম, ওল্ড আলিপুরের লনওয়ালা বাড়ি থেকে তাজবেঙ্গল, টলি এবং ক্যালকাটা ক্লাবের পরিমন্ডল থেকে ওপেল গাড়িতে করে বেরিয়ে কাঁকুরগাছির বিবর্ণ পাঁচিল এবং বারান্দাতে লুঙ্গি, শায়া, গামছা এবং আণ্ডারওয়ার ঝোলানো পায়রার ঘরের মতো ফ্ল্যাটগুলিতে ঢুকতে তার গা ঘিনঘিন করে। তাঁর মেয়ে পরমারও নিশ্চয়ই করে। তবু পরমারা আসে বছরের ওই একটি দিনই দয়া করে পুজোর পরে, যে-বছর দেশে বা বিদেশে কোথাও হলিডে করতে না যায়। শ্রীতমার ওই এল আই জি ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীর ছেলে-মেয়েরা ঝকঝকে মেটালিক রঙের লাল ওপেল গাড়িটা ঔৎসুক্যের আধিক্যে আঁচড়ে-কামড়ে দেয়। অন্য গ্রহ থেকে উড়ে আসা ইউ এফ-ওর মতো সে-গাড়ির গায়ে হাত বুলোয়। গাড়ির পালিশ নষ্ট হয়ে যায় তাতে। মেয়ে-জামাই প্রায়ই বিরক্ত হয় যদিও, মুখে কিছু বলে না। শ্রীতমার কাছে নিজেই চালিয়ে আসে জামাই। কোম্পানির ড্রাইভারকে দেখাতে চায় না, তার শাশুড়ির এই দৈন্যদশা। সবই জানেন শ্রীতমা। তাঁর মুখের হাসি এসবে একটুও অমলিন হয় না। মুখে কিছুই বলেন না। নাতিটাকে দেখতে ইচ্ছে করে বড়ো….. তাই….।
শ্রীতমার একমাত্র ছেলে শুভম স্টেটস-এর বস্টনে থাকে তার মেক্সিকান স্ত্রীকে নিয়ে। তাদের ছেলে-মেয়ে নেই। খুবই দায়িত্বের চাকরি। ছুটিছাটা পায়ই না। পেলেও হাওয়াই বা বারমুডাজ বা ইজিপ্ট-এ হলিডে করতে যায়। এবারে ভারতের কাছেই মালডিভস-এ এসেছিল। কাছেই। তবু এদের টাইট স্কেজুল-এর জন্যে কলকাতাতে আসার সময় করতে পারেনি। টাকাপয়সাও পাঠায় না কিছুই। শ্রীতমাও চান না। মেয়ে জোর করেই বছরে চারজোড়া শাড়ি, শায়া, জামা দেয়। দিব্যি চলে যায় শ্রীতমার। নিজের পেনশন এবং অনিকেত-এর সঞ্চয়ের ওপরে যা সুদ পান তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। টাকা তো কাগজই হয়ে গেছে। কিন্তু এই বয়েসে পৌঁছে খাদ্যের চেয়ে ওষুধের খরচই বেশি। তবু দিন কেটে যায়। কাটাতে হবে বলে। সংসারের চিড়িয়াখানার নানা খাঁচার মোটা মোটা লোহার গরাদগুলো বাইরে থেকে খালি চোখে দেখা যায় না কিন্তু এই বৃদ্ধজীবনের সঙ্গে চিড়িয়াখানার জন্তুজানোয়ারের বদ্ধজীবনের তফাত বিশেষ নেই।
শ্রীতমা থার্ড ক্লাস স্লিপারের জানলার পাশে বসে এসব কথা ভাবছিলেন। দু-পাশে শুধু জঙ্গল, লাল মাটি, ছিপছিপে নদী, মেঘের মতো পাহাড়শ্রেণি শেষবিকেলের ম্লান হলুদ আলোতে ভারি স্বপ্নময় দেখাচ্ছে। স্বামী অনিকেত-এর সঙ্গে একবার রেণুকুট-এ গেছিলেন বেড়াতে। সেখানেও এমন পাহাড়-বন ছিল, রিহাণ্ড বাঁধ। তখনকার দিনে স্কুলমাস্টারি করে অনিকেত বা তাঁর নিজের পক্ষেও এর চেয়ে বেশি বেড়ানো সম্ভব হয়নি। তবে দার্জিলিং এবং পুরীতে একবার করে গেছিলেন। নিজেরা নিজেদের নানাভাবে বঞ্চিত করেও একমাত্র ছেলে ও একমাত্র মেয়েকে যে, ‘মানুষের মতো মানুষ’ করে তুলতে পেরেছিলেন সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু অনিকেত বলতেন, আমরা ফালতু শিক্ষক তমা, ছেলে-মেয়ে দুটোকে পুথিই পড়ালাম শুধু, তাদের চরিত্র গঠন করতে পারলাম না। মানুষের যদি চরিত্রই না থাকে তবে শুধু চেহারাতে মানুষ হলেই কি কেউ মানুষ হয়? তবে ছেলে-মেয়েরা দুজনে যার যার ক্ষেত্রে কৃতী হয়েছে। তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অন্ত নেই। এর চেয়ে বেশি চাইবার আর কী-ই বা থাকে সন্তানদের কাছে মা-বাবার?
শ্রীতমা ভাবেন, সন্তান আর ইনশিয়োরেন্স পলিসি তো এক নয়। স্নেহ সততই নিম্নগামী। ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে কোনো বাবা-মায়েরই কিছু প্রত্যাশার থাকে না। তাদের সুখই বাবা-মায়ের সুখ। যদি আজকালকার কোনো ছেলে-মেয়ে বাবা-মায়ের জন্যে কিছু করে, সেটা প্রমত্ত ঝড়ে ঝরে-পড়া আমেরই মতো, অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি, হিসেবের বাইরের WINDFALL। তার দাম অপরিসীম। কিন্তু অন্য মা-বাবাদের কথা বলতে পারেন না শ্রীতমা কিন্তু তাঁর কিছুমাত্রও প্রত্যাশা নেই কারো কাছ থেকেই। প্রার্থনা করেন, এই আত্মসম্মানটুকু নিয়েই যেন যেতে পারেন।
শ্রীতমা জানলা দিয়ে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ার থেকে বাঁচার জন্যে গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন। একটুপরেই অন্ধকার হয়ে গেলে, জানলা বন্ধ করে দিতে হবে। শীত কিন্তু করছে না একটুও। পাঁচটা দিন শালিখদার কাছে কাটিয়ে শ্রীতমা যেন জীবনের এক অন্য মানে খুঁজে পেয়েছেন। কেন জানেন না, তাঁর আবারও খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে। অনিকেত চলে গেছেন আজ বারো বছর। একযুগ। শালিখদা অনিকেতেরই বন্ধু। শ্রীতমা ভাবছিলেন, সংসারে বন্ধু বলে যাদের আমরা জানি তাদের মধ্যে সকলেই কি বন্ধু? শ্রীতমা শালিখ সেনকে শ্রদ্ধাই করে এসেছেন চিরদিন। শ্রদ্ধার মধ্যেও যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে, সেকথা তেমন করে বুঝতে বুঝতে জীবন তাঁর শেষ করে ফেললেন যে একথা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছেন উনি। শালিখও কোনোদিন মুখ ফুটে কিছু বলেননি। আজকে শালিখ-এর এই নি:শব্দ কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ডাককে উপেক্ষা করেন, এমন জোর কি তাঁর অনেক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত বুকে আছে? কী করবেন, জানেন না শ্রীতমা। কে জানে! কলকাতাতে এই হয়তো তাঁর শেষবারের মতো যাওয়া। কালীপুজোর পরে পরেই হয়তো ফিরে আসবেন উনি এখানে। বাকিজীবনটা কাটিয়ে দেবেন শালিখের সঙ্গেই।
কথাটা মনে হতেই হাসি পেল তাঁর। তাঁর এখন তেষট্টি আর শালিখের সাতষট্টি। ‘বাকিজীবন’ বলতে এখনও কিছু আছে কি? যতটুকু আছে, যদি থাকে, তাকেই পরম মমতাতে প্রলম্বিত করে নেবেন দুজন একা মানুষ। শরীর এখন প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছে। কিন্তু মন আছে তরুণই।
শেষ বিকেলের উষ্ণতাকে সুগন্ধি বালাপোশেরই মতো শরীর-মনে জড়িয়ে নিয়ে সেই সুগন্ধের ওম ও শিশির-ঝরা কবোষ্ণ রাতগুলি একে-অন্যকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে কেটে যাবে রমরম করে। শ্রীতমা এসব ভাবতে ভাবতে যেন কলেজের মেয়ে হয়ে গেলেন। উনিশ বছরের লেডি ব্রাবোর্ন-এর শ্রীতমা।
২
বসিরের ছেলে ইয়াসিন গোরুবাছুরগুলোকে জঙ্গল থেকে নিয়ে এল। অন্ধকার হয়ে গেছে।
এত দেরি করলি কেন ইয়াসিন? শালিখ জিজ্ঞেস করলেন।
জানিস না, বাঘ আছে জঙ্গলে?
বড়ো বাঘে প্রধানের একটা গোরুকে ধরেছে। তাইজন্যে আজ সকলের গোরুই ভয়ে এদিক-ওদিক ছাটকে গেছিল। খুঁজে পেতে আনতে দেরি হল। তাই।
তোকে যদি ধরত?
তা ধরতে পারে।
তাড়াতাড়ি যাবি, দিনে দিনে ফিরবি।
হুঁ।
বাঘে গোরু ধরবে না? বাঘের যা খাদ্য, তা না পেলে বাঘ কী করবে? শালিখ বললেন। আম্মির গাড়ি কি চলে গেল?
ইয়াসিনের আব্বা বসির জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ।
আবার আসবেন তো?
কেন? এখানে আসবেন কেন বারে বারে? এখানে ওঁর কে আছে?
আমরা তো আছি আব্বা। আমাদের জন্যে আসবেন। উনি এলে আপনারও খুব সুবিধে হবে, আনন্দ হবে। দেখবেন ফতিমা, আমি আর ইয়াসিন মিলে তাঁকে কত যত্নআত্তি করি। জানি না, আসবেন কি না।
এলে তো চিরজীবনের মতোই আসতে হয়। তোরা চিঠি লেখ সকলে।
উর্দু কি আম্মি বুঝবেন?
আমি তর্জমা করে দেব। কথা বুঝতে, ভাষা না জানলেও চলে। আমার চিঠির সঙ্গে তোদের চিঠিও জুড়ে দেব। লিখলে, আজ রাতেই লিখে ফেল। আমিও আজ রাতেই লিখব। আর শোন বসির, ফতিমাকে বলবি রাতে আমি কিছুই খাব না। দুপুরে আজ বড়ো দেরিতে খাওয়া হয়েছে। বেশি খাওয়া হয়েছে।
দুধ-খইও খাবেন না?
না। ইসাবগুল খাব শুধু। শোবও তাড়াতাড়ি।
কাল স্কুল আছে। মনে আছে তো?
হ্যাঁ আব্বা, মনে আছে।
কী শীত, কী গ্রীষ্ম রাতে গরম জলে চান না করলে ঘুম হয় না শালিখ-এর। চান-টান করে উঠে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নিজেকে ভালো করে দেখলেন।
একবার। বহুবছর পরে। বুড়ো তো হয়েছেনই, চুল পাতলা হয়ে গেছে। পেটের কাছে মেদ হয়েছে। চোখ নিষ্প্রভ, কিন্তু তার মধ্যে আয়নায় প্রতিফলিত আলোতে দেখলেন যে, তাঁর মুখে কেমন একটা আলগা দীপ্তি লেগেছে। মেয়েদের মুখে বিয়ের পরে পরে যেমন লাগে। শ্রীতমার সঙ্গে যখন ওঁর প্রথম আলাপ হয়, তখন শ্রীতমা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে পড়তেন, থার্ড ইয়ারে। শ্রীতমা প্রায়ই বলতেন তখন, ময়দানে বা বটানিকাল গার্ডেনে, শালিখ দেখলে, One for Sorrow, Two for Joy কথাটা কেন মনে পড়ল তা জানে না শালিখ। কিন্তু অবশ্যই পড়ল। মনে পড়াতে তাঁর মনে, একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। একলা শালিখ কি বুড়োবয়েসে এসে দোকলা হবেন? কে জানে, কী হবে! মানুষের জীবন প্রথম বর্ষণের পরে পাহাড়ি নদীরই মতো। খড়কুটো, বহুবর্ণ লতাপাতা, নুড়ি-পাথর সব ভাসিয়ে নিয়েই যে যায় সে শুধু তাই নয়, কখন যে-কোথায় কোন বাঁক নেয় তা, খরস্রোতা হঠাৎ ঘুমভাঙা পাহাড়ি নদীরই মতন জীবনও জানে না।
গরম চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে বসলেন। শালিখ চিঠিটা এখনই লিখে না ফেললে পরে হয়তো আর লেখাই হবে না। সব কিছুই বলার বা লেখার একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে, হয়তো দেওয়ারও, সেই সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলে ঋণের মেয়াদেরই মতো কথা বা চিঠির বা উপহারের মেয়াদও ফুরিয়ে যায়। তামাদি হয়ে যায়, সেইসময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে, জীবনের খতিয়ানের নাজাই খাতে তা লিখে দিয়ে, তা বাতিল করতে হয়।
মিরিমাড়
ধৌরি, মধ্যপ্রদেশ
রবিবার
কল্যাণীয়াসু শ্রী,
এখন তুমি বোধ হয় চলন্ত ট্রেনে বসে রাতের খাওয়া খাচ্ছ। ফতিমা পরোটা আর গুলহার কাবাবটা ভালোই করে। তোমার জন্যে আরও বেশি যত্ন নিয়ে করেছে। আশা করি, তোমার ভালোই লাগবে। খাবার-জল আর-একবোতল দিয়ে দিলে ভালো হত। শোয়ার সময়ে মাফলারটা গলাতে জড়িয়ে শুয়ো। মহাকাল রেঞ্জ-এর নীচের খাদের মধ্যে দিয়ে ট্রেনটা যখন যায়, তখন ঠাণ্ডা আরও বেশি লাগে। মনে পড়ে, তোমার ক-টি প্রিয় পঙক্তি ছিল রবীন্দ্রনাথের, আমার মুখে শুনতে ভালোবাসতে তুমি খুব। ‘রাতের রেলগাড়ি, দিল পাড়ি, গাড়িভরা ঘুম, রাত নিঝুম।’
তোমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে ফিরে আসতে আসতে কত কথাই যে মনে আসছিল শ্রী, তা কী বলব। তোমার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। তোমাদের কলেজের ফেস্ট ছিল। একটি ডিবেটও হয়েছিল। আমি ডিবেটের ফাইনালে গেছিলাম আমার এক বন্ধুর বোন (সে স্কটিশ চার্চ-এ পড়ত) তার সঙ্গে। আশ্চর্য। তার নামটা পর্যন্ত আজ আর মনে নেই অথচ তোমার সঙ্গে সে-ই আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। আমি তখন প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরেজিতে গ্র্যাজুয়েশান করে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে এম এ পড়ছি। তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে মনে হয়েছিল, জন্মাবধি তোমাকেই যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। তোমার দীর্ঘ গ্রীবা, তোমার উজ্জ্বল দুটো চোখ, তোমার হালকা ছাই-রঙা শাড়ি, অত্যন্ত সুরুচিবান অথচ কমদামি গয়না, তোমার স্মার্ট অথচ নরম ইংরেজি উচ্চারণ মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে, আমাকে অভিভূত করেছিল।
তার পরের কথা তো তুমি জানোই। আমি যদি শিলচরে লেকচারারশিপ নিয়ে চলে না যেতাম, তাহলে সম্ভবত তোমার সঙ্গে অনিকেতের নৈকট্য হত না। তোমরা বড়োলোক ছিলে। তোমার বাবা যে গরিব আমাকে পছন্দ করতেন না, তা বুঝতে পারতাম। তুমিও তো কখনো একটিও চিঠি লেখোনি তখন আমাকে। অনিকেত তখন ডক্টরেট-এর জন্যে তৈরি হচ্ছিল। আমার চেয়ে সুদর্শনও ছিল। তার সঙ্গে আমি পারবই বা কেন?
সেই পরাজয়ের মধ্যে লজ্জা হয়তো ছিল কিন্তু গ্লানি ছিল না কোনো। তবু, আমাকে এমন করেই বিবশ করেছিলে যে, তোমাকে ভুলে যাওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ‘এনক’ আর ‘আর্ডেন’-এর মধ্যে কাকে যে মেয়েদের চিরন্তন পছন্দ তা সেদিনই জেনেছিলাম, যেদিন ডাকে তোমার বিয়ের চিঠিটা পেয়েছিলাম।
তার পরে সব যোগাযোগই ছিন্ন হয়ে গেছিল। তোমার বিরুদ্ধে এক অন্ধ অভিমান বুকে নিয়ে তোমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগই আর রাখতে চাইনি। অনিকেত দুই সন্তান রেখে অনন্তলোকে চলে গেছিল তা আমি জানতামও না। এখন বুঝি যে, তার পর থেকে তুমি অনেকই করেছ, আজও করছ। আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলে তখন, তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। ‘শ্রীতমা প্রাইমারি স্কুল’-এর কথা তুমি এখানকার গণেশ ব্যানার্জির কাছে অ্যাকসিডেন্টালি না শুনলে এবং আমার এখনকার ঠিকানাতে চিঠি না লিখলে, এ-জীবনে যোগাযোগই হয়তো আর হত না।
আমার স্কুলের নাম তোমার নামে কেন দিলাম তা পরে তোমাকে বলব। বাগান করা ছাড়া ছোটো ছেলে-মেয়েদের পড়ানো এবং তাদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার মতো আনন্দ আমি আর কিছুতেই পাইনি। আমার জীবনের সব সঞ্চয়ই মধ্যপ্রদেশের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গোন্দ বাইগাদের এবং কিছু মধ্যপ্রদেশীয় মুসলমানদের ছেলে-মেয়েদের মানুষ করার জন্যে ব্যয়িত হয়ে গেছে। আরও টাকার দরকার। তাই ইনকামট্যাক্স-এর ‘আশি জি’ ধারাতে যাতে দানের ওপরে ছাড় পাই, গণেশকে পাঠিয়েছিলাম ভোপালের আয়কর দপ্তরে, ডিরেক্টর অফ এগজেম্পশন-এর কাছে। সেখানেই তোমার প্রতিবেশী রাজেন ঘোষ-এর সঙ্গে গণেশের দেখা না হলে আমাদের এই পুনর্মিলন আদৌ সম্ভব হত না।
চলে এসো শ্রী, কলকাতার পাট চুকিয়ে দিয়ে বাকিজীবন আমার কাছেই থাকবে বলে এসো। তোমার লা-মার্টস আর লোরেটোতে পড়া নাতি-নাতনিরা তোমার যত আপন তার চেয়ে অনেকই বেশি আপন অনেক নাতি-নাতনি তুমি তোমার নামাঙ্কিত স্কুলে পাবে। তোমার নিজের নাতি-নাতনিরা কোনো মালটিন্যাশনাল কোম্পানির সি ই ও হওয়ার সাধনাই করবে। ভালো থাকা, ভালো খাওয়াই এখন মনুষ্যজীবনের সাফল্যের পরাকাষ্ঠা। তারা আমেরিকান হবে, তারা ভারতীয় হবে না। আসল ভারতবর্ষ গ্রামেই আছে, পাহাড়ে-জঙ্গলে। সেই অজগর এখনও ঘুমিয়ে আছে। তাকে না জাগাতে পারলে, এই দেশের কোনোই ভবিষ্যৎ নেই।
মানুষের মতো মানুষই শুধুমাত্র নিজের জন্যেই বাঁচে না। শুধুমাত্র নিজের জন্যে বাঁচে শুধু জানোয়ারেরাই। প্রকৃত মানুষ সব সময়েই বাঁচে পরের জন্যেই। কিছু মানুষের কাঁধ চওড়া করে পাঠান এখানে বিধাতা, অন্যদের বোঝা বইতে। তারাই মনুষ্যপদবাচ্য মানুষ।
চলে এসো শ্রী। জীবনের যেটুকু বাকি আছে আমরা নতুন নতুন গাছ লাগাব, ফুল ফোটাব, বাজরা, আর মকাই, ধান আর মটরশুঁটির খেতে ঘুরে বেড়াব, মাটির কাছাকাছি থাকব। আর এই শিশুদের যথার্থ ভারতীয় করে তোলার সাধনাতে নিয়োজিত করব আমাদের। বাঙালি নয়, আসামি নয়, বিহারি নয়, ওড়িয়া নয়, যথার্থ ভারতীয়ত্বে সম্পৃক্ত ভারতীয়। আমার আর তোমার প্রেম আবার নতুন করে পাপড়ি মেলবে এখানে, ম্যাগনোলিয়া গ্র্যাণ্ডিফ্লোরারই মতো। তার গন্ধ ছুটবে দিকে দিকে। আমরা দুজনে সেই সুগন্ধের কান্ডারি হব।
জীবনের বছরগুলো উদ্দেশ্যহীনভাবে ক্ষয় করা আর বাঁচা সমার্থক নয় শ্রী। প্রতিমুহূর্তে তোমার চলার পথের দু-পাশে নতুন নতুন ফুল ফুটিয়ে যেতে পারার নামই মনুষ্যত্ব। আমি অথবা তুমি শুধুমাত্র আমরা অথবা তোমরাই নই, আমরা আমাদের দেশের। চলে এসো, আমার প্রথম যৌবনের প্রেমিকা শ্রীতমা, প্রকৃত ভারতীয় হিসেবে আমরা আমাদের বাকিজীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সার্থক, ফলপ্রসূ করে তুলি। এর চেয়ে বড়ো পরিপ্লুতি একজন প্রেমিক ও প্রেমিকার জীবনে আর কীই বা হতে পারে? শারীরিক মিলনের সাধ আমাদের দুজনেরই হয়তো আছে কিন্তু সাধ্য হয়তো আর নেই। আমাদের মন-মিলন, শরীর-মিলনের চেয়ে অনেক বড়ো হবে। এসো, তোমার একলা শালিখদাকে জীবনের শেষে এসে দোকলা করো। তুমিই না বলতে, একলা শালিখ দেখলেই, One for sorrow two for Joy? এসো, আমরা যৌবনে ফিরে গিয়ে, এই সুন্দর জীবনে, একটামাত্র জীবনকে নতুন করে মালা পরাই।
এসো, এসো, এসো শ্রীতমা। এসো, আমরা দুজনে মিলে এই হতভাগ্য, বঞ্চিত, দেশের জন্যে কিছু করি। মিথ্যের ফুলঝুরি ফোটানো বক্তৃতাবাজদের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচাই।
ইতি—
তোমার শালিখদা
দ্রুতগামী ট্রেনের মধ্যে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুলেন শ্রীতমা। ঘুমের মধ্যে মনে হল কোনো পুরুষকন্ঠ যেন তাঁর নাম ধরে বড়ো আদরে, বড়ো স্নেহে তাঁকে ডাকছে, ছেলেবেলায় তাঁর মা যেমন করে ডাকতেন।