ডাক্তার-ডাক্তার
আমার মতো দুঃসাহসী লেখক আজকাল সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ কিছুদিন হল ভয়ংকর বুকের ব্যামোয় আমার জীবন সংশয় দেখা দিয়েছে, বস্তুত আমি বেঁচে আছি কয়েকজন দয়ালু ও মহানুভব ডাক্তার মহোদয়ের অসীম কৃপায় ও ভালবাসায়। অথচ সেই আমি, অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন কাণ্ডজ্ঞানহীন ‘কাণ্ডজ্ঞান’ লেখক, এর মধ্যেই শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকদের নিয়ে রসিকতায় মত্ত হলাম।
অনেকদিন আগে আমাদের কালীঘাটের পুরনো পাড়ায় আমাদের স্থানীয় ডাক্তারবাবুর চেম্বারে বসে আছি। ডাক্তারবাবু প্রৌঢ়, আমার সঙ্গে বয়সের ঢের তফাত কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্ব দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রোগী ও চিকিৎসকের মামুলি কথাবার্তা, প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি শেষ হলে তাঁর সঙ্গে আমি সিনেমা, রাজনীতি, সাহিত্য ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে গল্পগুজব করতাম।
একদিন তখন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। শেষ রোগী বিদায় নিয়েছে, আমি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কাকের কামড়ে বিষ আছে কি না, থাকলে জলাতঙ্ক হতে পারে কি না এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। দু’দিন আগে সকালবেলায় কী এক অজ্ঞাত কারণে হাজরা পার্কে, (তখন পার্কটির এমন শোচনীয় অবস্থা হয়নি), একটা কাক সহসা উত্তেজিত হয়ে পর পর চার-পাঁচজন নিরীহ বায়ুসেবীকে কামড়িয়ে দেয়; এই অস্বাভাবিক ঘটনাই সেদিন আমাদের এই অদ্ভুত আলোচনার কারণ। সে যা হোক, আমাদের আলোচনার মধ্যেই এক সুবেশ যুবা ডাক্তারবাবুর চেম্বারে প্রবেশ করলেন। তাঁর পরনে ঝকঝকে দামি পোশাক, পায়ে মসৃণ অ্যামবাসাডর জুতো, হাতে দামি বিলিতি হাতঘড়ি, আঙুলে হিরের আংটি।
যুবকটি আমাদের ওই কাকের আলোচনার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে ডাক্তারবাবুকে নমস্কার করে বললেন যে, ‘ডাক্তারবাবু, আপনাকে বহু ধন্যবাদ। আপনার চিকিৎসার জন্যে আমি খুব কৃতজ্ঞ।’ ডাক্তারবাবুর কাছে অনেক রোগী আসে, ডাক্তারবাবুর স্মৃতিশক্তিও খারাপ নয়, কিন্তু তিনি এই কৃতজ্ঞ ব্যক্তিটিকে চিনে উঠতে পারলেন না। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না তো, আপনার কখনও চিকিৎসা করেছি কি আমি?’
যুবকটি মৃদু হেসে বলল, না, আমার চিকিৎসা নয়, আপনি আমার মামার চিকিৎসা করেছিলেন, তাই কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি।’
ডাক্তারবাবু আরেকটু বিচলিত হলেন, ‘আপনার মামা?’
যুবকটি বলল, আমার মামা হলেন রায়বাহাদুর স্বর্গীয় শশধর পাল। তিনি তো আপনার হাতেই মারা গেলেন। মামার তো কেউ নেই, আমি একমাত্র ভাগ্নে, আমিই সমস্ত সম্পত্তি পেয়েছি। আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অপরিসীম।’
অবশ্য সমস্ত ডাক্তারবাবুর ভাগ্যে এমন কৃতজ্ঞ রোগী জোটে না। একজন রোগীকে ডাক্তার ফোন করেছিলেন, ‘খগেনবাবু, আপনার যে বাতের চিকিৎসা করেছিলাম তার জন্যে আপনি আমাকে চেক দিয়েছিলেন। দুঃখের কথা, সেই চেকটি ব্যাঙ্ক থেকে ফেরত এসেছে।’ টেলিফোনের ওপার থেকে নির্বিকার খগেনবাবু জবাব দিলেন, ‘কী আর করা যাবে বলুন। আপনি যে বাতের ব্যথার চিকিৎসা করেছিলেন, সে ব্যথাটাও ফেরত এসেছে।’
অধিকাংশ চিকিৎসকই অধিকাংশ সময়ে সুজন ও সুরসিক। বহু মৃত্যু, বিপর্যয় ও মহামারীর মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁরা ঠান্ডা মাথায়, অকম্পিত হাতে কাজ করেন। তবে এর মধ্যে দু’-একজন মারকুটে ডাক্তারও আছেন। আর সবচেয়ে দুঃখের কথা, রোগীরা মারকুটে ডাক্তারদের বেশি পছন্দ করেন। নরম ডাক্তারদের চেয়ে মারকুটে ডাক্তারদের পসার অনেক তাড়াতাড়ি হয়। ভবানীপুরে একজন মারাত্মক গোলমেলে ডাক্তার ছিলেন, তাঁর নির্দেশ, পথ্যাদি ঠিকমতো না মানায় প্রত্যহ একাধিক রোগী তাঁর হাতে চড়চাপড় খেত। আমি স্বচক্ষে দেখেছি তাঁর এক গলাব্যথার রোগী পাঞ্জাবি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বরফ দেওয়া লস্যি খাচ্ছিল, তিনি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ওই দৃশ্য দেখে রোগীর হাত থেকে কাচের গেলাস কেড়ে নিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ভেঙে ফেলেন।
এই চিকিৎসককে তাঁর এক রোগী একবার বলেছিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমার যে জ্বরটা ছাড়ছে না। আপনি বললেন, আমার টাইফয়েড। কিন্তু টাইফয়েডের চিকিৎসায় তো কিছু হল না। আমার নিমুনিয়া হয়নি তো?’ ডাক্তারবাবু গর্জে উঠলেন, ‘নিমুনিয়া? নিমুনিয়া কেন?’ মূমূর্ষু রোগী ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘আমাদের অফিসের রামবাবুর ডাক্তারেরা টাইফয়েড বলে চিকিৎসা করল। কিছু ধরতেই পারেনি, শেষে রামবাবু মারা গেলে জানা গেল নিমনিয়া হয়েছিল।’ ডাক্তারবাবু আরও গর্জে উঠলেন, ‘ও রামবাবু-ফামবাবু ছাড়ুন। আমি যদি কারও টাইফয়েডের চিকিৎসা করি সে টাইফয়েডেই মারা যাবে; নিমুনিয়ায় নয়।’
এসব অভিজ্ঞ চিকিৎসকের কথা বেশি বলে লাভ নেই। বরং দু’একজন তরুণ চিকিৎসকের কথা বলি। বছর দশেক আগে একদিন কলেজ স্ট্রিটের ট্রামে ধর্মতলায় আসছি, হঠাৎ গোলদীঘির সামনে কয়েকটি তরুণ যুবক দৌড়ে এসে ট্রামে উঠলেন, তারপর বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগলেন, ‘আমাদের ডাক্তার ডাকুন, ডাক্তার ডাকুন।’ যাত্রীরা হতভম্ব, এক প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা, তোমাদের কী হয়েছে? ডাক্তার ডাকতে বলছ কেন?’ একটি উৎফুল্ল যুবক আরেকবার বুক চাপড়িয়ে উত্তর দিলেন, ‘আমাদের ডাক্তার বলে ডাকুন। আজ এম বি বি এস-এর রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমরা পাশ করেছি, ডাক্তার হয়েছি।’
জানি না, সেই সদ্য স্নাতক নবীন চিকিৎসকেরা লাল ফিতে আর ঘোরানো সিঁড়ি, হাসপাতালের নোংরা বারান্দা আর প্রাইমারি হেল্থ সেন্টারের নিরুপায় সীমাবদ্ধতার মধ্যে দমবন্ধ দাঁড়িয়ে এখনও বুক চাপড়িয়ে বলেন কি না, ‘আমাদের ডাক্তার ডাকুন, আমাদের ডাক্তার ডাকুন।’
দুঃখের কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, চিকিৎসকদের নিয়ে দু’-একটি বিলিতি মজার গল্প আরেকবার বলা যাক।
ডক্টর হোয়াইট ডক্টর গ্রিন সাহেবকে মোটেই পছন্দ করেন না, গ্রিন ডাক্তারের নাম শুনলে হোয়াইট সাহেবের আপাদমস্তক জ্বলে যায়। একদিন হোয়াইট ডাক্তারের কাছে একজন চিকিৎসার জন্যে এসেছেন, হোয়াইট সাহেব তাঁকে প্রশ্ন করলেন, এর আগে আর কাউকে দেখিয়েছেন কি না। রোগীটি জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে হ্যা, গ্রিন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম।’ গ্রিনের নাম শোনামাত্র ডক্টর হোয়াইট উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, ‘সেই মূর্খ, স্টুপিড গ্রিন হাতুড়ে আপনাকে কী কুপরামর্শ দিল?’ হতবাক রোগী একটু থেমে থেকে তারপর নিচু গলায় বললেন, ‘স্যার, ডক্টর গ্রিন আমাকে পরামর্শ দিলেন আপনার কাছে এসে দেখাতে।’
পরের গল্পটি বড় বিপজ্জনক। এক রোগী সার্জনের কাছে অপারেশন করাতে এসেছে। অপারেশন টেবিলে শুয়ে রোগী ডাক্তারবাবুকে বলছে, ‘ডাক্তারবাবু, আমার এই প্রথম অপারেশন। আমার কেমন ভয় ভয় করছে।’ সার্জন সাহেব বললেন, ‘আপনি ঠিক আমার মনের কথা বলেছেন। আমারও এটা প্রথম অপারেশন। আমারও কেমন ভয় ভয় করছে।’
আরেকটি অপারেশনের গল্প আরও মর্মান্তিক। একটি সার্জন রোগীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ‘আপনার এই অপারেশনটা খুব জটিল। দশজনের মধ্যে ন’জনই মারা পড়ে। তবে আমার হাতে এখন পর্যন্ত ন’জন সবসুদ্ধ মারা গেছে। তাই মনে হয় আপনার বাবার সম্ভাবনা সেন্ট পারসেন্ট, শতকরা একশো।’
এই গল্পটি অনেকে এই পর্যন্ত জানেন। কিন্তু এক বিখ্যাত শল্যবিদের কাছে এর পরের অংশটুকু শুনেছি। অপারেশন টেবিলে রোগী তাঁর অপারেশনের গুরুত্ব ও সম্ভাব্য পরিণতি হৃদয়ঙ্গম করে সার্জন সাহেবের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে, সার্জন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার কি কিছু বলার আছে?’ রোগীটি ক্ষীণ কণ্ঠে মিনমিন করে বললেন, ‘আমার প্যান্ট আর জুতো জোড়া দয়া করে ফেরত দিন, আমি বাড়ি ফিরে যাই।’
তবে তেজস্বী রোগীরও অভাব নেই। ডাক্তারকে আক্রমণ করছে, হাসপাতাল ভাঙচুর করছে— এ রকম খবর এখন প্রতিদিনের কাগজে। সেই অসভ্যতা রসিকতারও অযোগ্য। কিন্তু সেই যে রোগীটি সার্জনকে বলেছিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, দেখবেন আমার পেটের কাটার দাগটা যেন অন্তত আট ইঞ্চি হয়।’ সার্জন বলেছিলেন, ‘অপারেশনের জন্যে যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু কাটতে হবে, শুধু শুধু আট ইঞ্চি কাটতে যাব কেন?’ সাহসী রোগীটি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু অন্তত আট ইঞ্চি চাই। এর জন্যে যা লাগে আমি দেব।’ কৌতূহলী সার্জন সাহেব বললেন, ‘ব্যাপারটা কী বলুন তো?’ রোগীটি অপারেশন টেবিলে উঠে বসে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘দেখুন, সারা জীবন ধরে শুনে যাচ্ছি আমার শ্যালির ছয় ইঞ্চি লম্বা অপারেশনের দাগ আর আমার শাশুড়ির সাড়ে সাত ইঞ্চি, আমার কাটা দাগটা অন্তত আট ইঞ্চি করবেন, স্যার।’