ডাকিনীতলার বুড়ো যখ
আমাদের বাড়ির পিছনে একটা বাগান, তারপর ধূ-ধূ মাঠ। মাঠের মধ্যিখানে ছিল একটা বটগাছ। গাঁয়ের লোক বলত ডাকিনীতলা।
ডাকিনীতলা, তার মানে ওই ধূধু তেপান্তরের একলা দাঁড়ানো বটগাছটার দিকে দুপুরবেলা তাকিয়ে থাকতুম যদি ডাকিনীটাকে দেখতে পাওয়া যায়। রোদ্দুর চনমন করত মাঠে। জন নেই, মানুষ নেই। খাঁ-খাঁ চারদিক। কথায় বলে, ঠিকঠাক দুকুর বেলা, ভূতপেরেতে মারে ঢেলা। দুপুরবেলায় ভূতপ্রেত-ডাকিনীরা পাড়াগাঁয়ের গাছগুলিতে ওঁৎ পেতে থাকে কিনা। একলা-দোকলা গাছতলায় যেই গেছ, টুপটাপ ঢিল পড়বে গায়ে। ঢিলও দেখতে পাবে না তুমি, কে ঢিল ছুড়ল তাকেও দেখবে না। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি।
অতদূর থেকে একটা ছোট্ট ছেলেকে ডাকিনীতলার ডাকিনী ঢিল ছুঁড়ে মারবে, সেই গায়ের জোর ডাকিনীটার নিশ্চয় ছিল না। বটতলায় গেলে তো!
কিন্তু ওরা নাকি সবই দেখতে পায়। যতদূরেই থাকো, চোখে পড়বেই। একদিন হয়েছে কী, দুপুরবেলা রোজ যেমন বাগানের ধারে দাঁড়িয়ে দূরে ডাকিনীতলার দিকে তাকিয়ে থাকি–সেইরকম তাকিয়ে আছি, হঠাৎ চোখ পড়ল হাজরা-মশায়ের ছেলে নীলু হাফপেন্টুল পরে খালি গায়ে মাঠের দিকে চলছে। নীলু আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। ক্লাসের সবচেয়ে ভীতু ছেলে–আবার তেমনি বেহদ্দ গোবেচারা। তাই তাকে অমন হনহন করে ডাকিনীতলার দিকে যেতে দেখে খুব অবাক হয়ে গেলুম। এই রে! নির্ঘাৎ ও মরবে। যেই যাবে কাছাকাছি ডাকিনীটা ওর গলা মটকে রক্ত চুষে খাবে।
হাঁ করে তাকিয়ে ওর কাণ্ড দেখছি, এমন সময় আমাদের কুকুর ভুলো এসে আমার পা এঁকে লেজ নেড়ে কেঁউ-কেঁউ করে উঠল। ভুলোর মতো তেজি কুকুর গাঁয়ে আর দুটো নেই। ওর গায়ের গন্ধ পেলেই মাঠের শেয়ালগুলো লেজ গুটিয়ে তল্লাট ছেড়ে পালায়। একবার এক ভালুকওলা এসেছে ভালুকের নাচ দেখাতে। ভুলো সেই নাচুনে ভালুকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরে ফেলে আর কী! অনেক কষ্টে ছাড়ানো হয়েছিল তাকে। অথচ কুকুর ভালুক দেখলে কী যে ভয় পায়, সবাই জানে।
ভুলোকে দেখে আমার সাহস বেড়ে গেল। ওর গলায় হাত বুলিয়ে বললুম, এই ভুলো! আমার সঙ্গে যাবি?
ভুলো লেজ নেড়ে সায় দিয়ে বলল–হুঁউ।
ভালুক যদি জব্দ হয়, ভুলোর পাল্লায় পড়ে ডাকিনীও নিশ্চয় জব্দ হবে। অতএব তখুনি মাঠের দিকে চলতে থাকলুম। ভুলো আমার সঙ্গে চলল, কখনও পিছনে, কখনও এপাশে-ওপাশে সে ছুটোছুটি করে এগোচ্ছিল। এদিকে সারাক্ষণ আমার চোখ রয়েছে, নীলুর দিকে। একটু পরেই দেখলুম, নীলু বটতলায় পৌঁছে গেল। কিন্তু তারপর ছায়ার আড়ালে তাকে এতদূর থেকে আর দেখা যাচ্ছিল না। আমার মাথায় তখন অনেক ভাবনা জেগেছে। এভাবে নীলু ওখানে গেল কেন? ডাকিনীটা কি গাঁয়ে এসে ওকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের ডেরায় মারতে নিয়ে গেল? সর্বনাশ তাহলে তো ওকে বাঁচাতেই হবে।
ভুলো যখন সঙ্গে আছে তখন আমার ভয় নেই। আমি জোরে হাঁটতে থাকলুম। নির্ঘাৎ বোকা নীলু ডাকিনীর পাল্লায় পড়ে গেছে।
বটতলার কাছাকাছি যেতে না যেতে ভুলো লেজ তুলে আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে হঠাৎ লম্বা একটানা ঘেউ-উ ঝাড়ল। এইতে আমার বুক একটু কেঁপে উঠল। মামার কাছে শুনেছি, জীবজন্তুরা ভূতপ্রেত ডাকিনী সবাইকে দেখতে পায়। তার মানে, আমরা যাদের দেখি না, ওরা তাদের দিব্যি দেখতে পায়। এমনকি দেখেছি, পাঁচিলের ওপাশে অচেনা মানুষ এলে ভুলো তাও টের পায় এবং বেজায় হাঁকডাক শুরু করে। রাতের আঁধারেও তো ভুলো দেখতে পায়–অথচ আমাদের আলো চাই-ই।
কাজেই ভুলো নিশ্চয় একটা কিছু অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাচ্ছে। ভয়ে-ভয়ে বললুম, ভুলোয় কিছু দেখতে পাচ্ছিস নাকি?
ভুলো আমার দিকে ঘুরে লেজ নেড়ে কুকুরের ভাষায় বলল,–হুঁউ। তারপর সে আচমকা বটতলার দিকে দৌড়াতে থাকল। দেখাদেখি, আমিও সঙ্গ নিলুম। তারপর বটতলার কাছে গিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে ডাকলুম, নীলু! নীলু!
বটতলায় কখনও ওর আগে যাইনি। কী প্রকাণ্ড গাছ! চারপাশে অনেক ঝুরি নেমেছে। গুঁড়িটাও পেল্লায় মোটা। শেকড়-বাকড় ছড়ানো রয়েছে অগুনতি। শনশন করে বাতাস বইছে। বটের পাতা কঁপছে। ভুলো মাটি খুঁকে ঘুরঘুর করছিল। নীলুর কোনও সাড়া পেলুম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মনে হল বাতাসের সুরে কে যেন গান গেয়ে কিছু বলছে। গা শিউরে উঠল। আবার ডাকলুম, নীলু! নীলু! কিন্তু কোনও সাড়া পেলুম না।
এই সময় ভুলো মুখ তুলে আবার একখানা লম্বা ঘেউ-উ ঝাড়ল। তারপর দৌড়ে গাছের ওপাশে চলে গেল। তখন আমিও গেলুম।
গিয়ে যা দেখলুম, থ বনে দাঁড়াতে হল। এক বুড়ো বসে রয়েছে। তার পাশেই একটা ময়লা কাপড়ের পুঁটলি। একটা লাঠি। তার সামনে মাটিতে বসে আছে নীলু। বুড়ো লোকটা চোখ বুজে যেন ধ্যান করছে। তার গায়ে একটা তালিমারা ফতুয়া– খুব নোংরা সেটা। মাথায় একটা পাগড়ি। তার কানে বড় বড় তামার আংটি ঝুলছে। গলায় একটা মস্ত চাদির চাকতি আছে।
এইবার মনে পড়ে গেল–আরে! এ তো সেই ম্যাজিসিয়ান! সেদিন আমাদের পাড়ায় ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। আমি আরও অবাক হয়ে গেলুম।
নীলু এতক্ষণ আমাকে দেখেও যেন দেখছিল না। আমার চোখে চোখ পড়তেই সে ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে চুপ করতে ইশারা করল। তারপর চোখ নাচিয়ে তেমনি ইশারায় ম্যাজিসিয়ানকে দেখিয়ে তার পাশে বসতে বলল।
নীলুর পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। ভুলো এসে আমার পাশে একটুখানি দাঁড়িয়ে থেকে আবার কোথায় চলে গেল।
একটু পড়ে বুড়ো ম্যাজিসিয়ান চোখ খুলল। বিড়বিড় করে কী অস্পষ্ট মন্ত্র পড়ল যেন। তারপর একটু ঝুঁকে নীলু ও আমার ওপর তিনবার ফুঁ দিন। ভয়ে বুক কাপল। এমন কেন করল ও?
তারপর লোকটা একটু হেসে মিঠে গলায় বলল,-এ ছেলেটি কে বাবা?
নীলু বলল, আমাদের পাড়ায় থাকে। বিজু, তোর নাম বল। ম্যা
জিসিয়ান হাত তুলে বলল–থাক-থাক। বিজু তো? ব্যস, ওতেই হবে।
নীলু বলল,–বিজু, তোকে কিন্তু দুটো টাকা দিতে হবে। আমিও দিয়েছি।
বললুম,–দেব। কিন্তু এখন যে নেই রে!
ম্যাজিসিয়ান বলল,–আচ্ছা, আচ্ছা এবার শোন বাবা, আমি যা করার সব করে দিয়েছি। এখন তোমাদের কী করতে হবে, বলছি। আমি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে এই গাছ থেকে একটা লাল টুকটুকে ফল পড়বে। সেই ফলটি দুজনে ভাগ করে খাবে। খেলেই তোমাদের চোখ খুলে যাবে। তখন দেখবে, আমার মতো একজন বুড়ো মানুষ এই গাছের গোড়ায় মাটি ঠেলে বেরোচ্ছে। তাকে তোমরা দুজনে টেনে তুলবে। এতে সে খুশি হবে তোমাদের ওপর। তখন বলবে-কী চাই? তোমরা বলবে তুমি যদি যখ হও, তাহলে তোমার টাকাগুলো দাও। অনেক টাকা, বাবা! শুধু টাকা নয়–কত সোনাদানা পেয়ে যাবে।
নীলু ঘাড় নাড়ল। ম্যাজিসিয়ান বলল,-তাহলে আমি চলি। কেমন?
নীলুর দেখাদেখি আমিও ঘাড় নাড়লুম। সে পুঁটলিটা কাঁধে নিয়ে ছড়ি হাতে উঠল। তারপর আচমকা হনহন করে প্রায় দৌড়তে শুরু করল। এইতে ভুলো কেন যে খেপে গেল কে জানে, দেখলুম ভুলে চেঁচাতে-চেঁচাতে তার পেছন-পেছন দৌড়াচ্ছে। আমার ভয় হল, ম্যাজিসিয়ান রেগে যায় যদি! ভুলোকে সে নির্ঘাৎ মন্ত্রের জোরে মেরে ফেলবে। আমি চেঁচিয়ে ডাকতে থাকলুম,–ভুলো! ভূলো! ফিরে আয়!
আমার ডাক শুনে ভুলো থমকে দাঁড়াল। আর এগোল না। কিন্তু ফিরেও এল না। ওখানে দাঁড়িয়ে ম্যাজিসিয়ানের উদ্দেশে রাগ দেখাতে থাকল।
নীলু চোখ নাচিয়ে বলল,-তুই কী করে জানলি রে?
বললুম,–তোকে আসতে দেখলুম যে। কিন্তু ম্যাজিসিয়ানকে কোথায় পেলি?
নীলু বলল, আজ সক্কাল বেলা রাস্তায় দেখা হয়েছিল। ও বলল, দুটো টাকা দিলে যখের ধন পাইয়ে দেবে। ঠাকুমার ঝাপি থেকে মেরে দিলুম দুটো টাকা! ওকে দিলুম। ও বলল,–ঠিক দুপুরবেলা ডাকিনীতলায় চলে এসো। এবার বুঝলি তো?
বুঝলাম কিন্তু আমি যে ওকে টাকা দিইনি। যখের ধনের ভাগ আমি পাব তো নীলু?
নীলু গম্ভীর হয়ে একটু ভেবে বলল, খবুড়োকে জিগ্যেস করব। যদি বলে, তুইও পাবি-তাহলে পাবি। জানিস তো, যখের ধন সকলের সয় না। যাকগে– আর কথাটথা নয়। চুপচাপ বসে পড়ি আয়। ফলটা কখন পড়বে কে জানে!
আমরা আর কথা না বলে গাছের গুঁড়ির কাছে চুপচাপ বসে পড়লুম।…
দুজনে বসে আছি তো আছি-ফল পড়ার নাম নেই। ভুলো আপন মনে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। কখনও গাছের দিকে তাকিয়ে লেজ নেড়ে যেন ডাকিনীটাকেই ধমক দিচ্ছে।
কিন্তু ফল পড়ছে কোথায়? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। তখনও ফল পড়ল । বটগাছে রাজ্যের পাখি এসে ততক্ষণে জড়ো হয়েছে। তারা জোর চেঁচামেচি শুরু করেছে। ভুলো এইতে আরও খেপে গেছে। চোখ গেল গাছের গুঁড়ির ওপরে একটা মোটা ডালের দিকে।
যা দেখলুম, আমার চুল ভয়ে খাড়া হয়ে গেল। ওরে বাবা! ও কে? নিশ্চয় ডাকিনীতলার সেই বুড়ো যখটা চুপচাপ বসে আছে। পিটপিট করে আমাদের দেখছে। চেঁচিয়ে উঠলুম, নীলুরে!
নীলুও দেখতে পেয়েছিল। তার মুখে কথা নেই।
ভুলো কিন্তু ভয় পায়নি। সে এবার বিরাট গর্জন করে গাছের গুঁড়ি বেয়ে ওঠার ভঙ্গিতে লম্ফঝম্ফ শুরু করল। নখের আঁচড়ে গুঁড়িতে দাগ পড়তে থাকল। সাদা আঠা দুধের মতো বেরিয়ে এল। তারপরই ওপর থেকে আওয়াজ হল—উঁ-উঁ-প!
অমনি আমি দৌড়তে থাকলুম। সোজা নাক বরাবর দৌড়লুম। কতবার আছাড় খেলুম, কত জায়গায় ছিঁড়ে গেল। তারপর দেখলুম, ভুলোও আমার সঙ্গে চলে এসেছে। পেছন থেকে নীলুর চেঁচানি শুনলুম,–বিজু! বিজু! পালাসনে।
ঘুরে দেখি, সে দৌড়ে আসছে। তখন সাহস করে দাঁড়ালুম। কাছে এসে নীলু বলল–তুই বড্ড ভীতু! ওটা হনুমান।
— অ্যাঁ! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলুম ওর দিকে।
নীলু বলল, ধুর বোকা। হনুমান দেখিসনি কখনও? হনুমান দেখেই ভয় পেয়ে গেলি?
তখন মনে পড়ল, হ্যাঁ হনুমানই উঁ-উঁ-প করে ডাকে বটে। কিন্তু অমন জায়গায় হনুমানকে কি হনুমান বলে মনে হয় কখনও? মনে তখন কিনা সেই বুড়ো যখটার ভাবনা। কাজেই হনুমান দেখেই কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।
তবে বলা যায় না, বুড়ো যখটা হনুমানের চেহারা নিয়ে আমাদের দেখা দিতেও তো পারে? কথাটা নীলুকে বললে সে তখুনি মেনে নিল। তাও পারে বইকী। ফেরার পথে কানে এল, ডাকিনীতলায় সেই যখ কিংবা হনুমান ব্যাটা যেন আমাদের অমন করে চলে আসায় বেজায় রেগে গেছে। উ-উ-প খাকোর খাক! উপ খ্যাকোর খ্যাক! খুব হাঁকডাক চালিয়ে যাচ্ছে।
নীলু বলল,–চল সন্ধে অব্দি বসে থেকে দেখি ফল পড়ে নাকি। বললুম,–পাগল! তুই যাবি তো যা।
–যখের ধনের ভাগ নিবিনে?
নাঃ! বলে ভুলোকে শিস দিয়ে ডাকলুম।