ঠগী – তুলসী সেনগুপ্ত
কালো কোটটাকে পালটাবার নামও করে না সীতানাথ উকিল। গায়ে দিয়ে বিয়ের সময়কার পাওয়া ড্রেসিং টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে দেখে। কোটটার মতো আয়নাটারও রং চটে আছে। সেদিন এক মক্কেলকে সঙ্গে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে ঢুকতে গিয়েই দেখে লুঙ্গি পরা একটা লোক হাড় জিরজিরে চেহারা, ছুঁচলো দাড়ি নিয়ে ফ্যাসফেসে গলায় বলে চলেছে, ঘড়ির ব্যান্ড সাফ করো, আয়না সাফ করো, আলমারির কাচ সাফ করো। থমকে দাঁড়ায় সীতানাথ উকিল। দেখে, প্ল্যাসটিকের চাদরের ওপৰ ডাঁই করা কিছু তুঁতে রঙের গুঁড়ো। লোকটা নিজের মনেই কথাগুলো বলে যাচ্ছে আর একটা একটা করে সিকি আধুলি টাকা সেই গুঁড়োয় ঘষে ন্যাকড়া দিয়ে পুঁছে পুঁছে ঝকঝকে করে তুলছে। সীতানাথ পকেটে হাত ঢোকাল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই হাতটা পকেট থেকে বের করে নিয়ে মক্কেলকে বলল, ‘এক প্যাকেট কেনো তো হে!
লোকটা সম্মোহিতের মতো পকেট থেকে খুচরো বের করে দাম মেটালে সীতানাথ বলল, ‘এদের বহুদিন ধরেই খুঁজছিলাম, পাইনি। আজ বাড়ি গিয়ে আয়না, আলমারির কাচ পরিষ্কার করব।’
লোকটা হাসল সামান্য। ঝাঁ ঝাঁ রোদুর, গায়ের চামড়ায় ফোসকা পড়ার উপক্রম। লিন্ডসে স্ট্রিটের মোড়েই ফলের রসের বেশ কয়েকটা দোকান। সুন্দরী মহিলা, অধিকাংশই অবাঙালি, সঙ্গে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে দোকানগুলোর সামনে ভিড় করে আছে। বড় সেয়ানা চোখ সীতানাথের। লাট্টুর মতো চোখের মণি ঘুরিয়ে মেয়েদের দেখল। মুহূর্তেই সীতানাথের বুক গলা শুকিয়ে গেল, বড় পিপাসা, বড় পিপাসা! সঙ্গের লোকটাকে বলল, বড় পিছিয়ে আছে শ্যামবাজার, বুঝলে। এমন দোকান ও-সব জায়গায় কেন যে হচ্ছে না বুঝি না। আনারসগুলো বেশ সুন্দর করে কেটেছে, কী বলো। একটু রস-টস খাওয়াও দেখি।’
লোকটা একটু অবাক হল। কেননা, আধ ঘণ্টাও হয়নি, মেট্রো সিনেমার পাশের চায়ের দোকানে বসে পর পর দু’ কাপ চা খেয়েছে সীতানাথ। প্রতিবারই পকেটে হাত দিয়েই বের করে নিয়েছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে কী করে পেটে ঠাণ্ডা আর গরম ঢোকায় বোঝে না লোকটা।
ভুরু কুঁচকে লোকটাকে দেখে সীতানাথ বলল, ‘তোমাকে দু’চারটে কথা বলব, মনে রেখো’।
দোকানে বসে বসে মোক্ষম দু’চারটে পয়েন্ট বলে সীতানাথ নির্বিকার ভঙ্গিতে। লোকটা যা যা মনে ভেবেছে ঠিক তার উল্টোটা এমনভাবে বলল যেন মনে হল, লোকটারই দোষ। ভয়ার্ত গলায় কিছু বলতে যাবে অমনি সীতানাথ যেন পেয়ে বলে, ‘ভাবছ তোমায় ফাঁসাচ্ছি, বলেই হেঁ হেঁ করে হাসল। মিনিট কয়েক চোখ বুজে থেকে বলল, ‘তা হলে শোন, কথাটা শেষ না করেই সীতানাথ পাইনঅ্যাপেল জুসের অর্ডার দিল। জিগ্যেস করল, ‘তুমিও খাবে তো?’
লোকটা সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, ‘না, এই মাত্তর চা খেলুম’।
সীতানাথ উত্তরে বলল, ‘ভয় কী। এখনই তো তোমার জেল হচ্ছে না। খেয়ে নাও’।
লোকটা মনে মনে হিসেব কষে দেখল, ফি ছাড়াই বাড়তি দশ টাকা ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে। লোকটা মিনমিনে গলায় বলল, ‘বেশি পয়সা তো আর নেই উকিলবাবু’।
সীতানাথ দাবড়ে ওঠে। বলে, ‘মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি করেছ, এখন টাকা নেই, টাকা নেই নেই করছ কেন?
লোকটি সীতানাথের হাত ধরে বলল, ‘যা আছে তা দিয়ে ওষুধ কিনতে হবে’।
সীতানাথ হো হো করে হেসে বলে, ‘ওষুধ, তা ভাল। দিশি না বিদিশি?’
‘মা কালীর দিব্যি। মা-র অসুখ। ওষুধ কিনব। তা চুলোয় যাক। আপনি খান।’ লোকটা বলল।
‘ছ্যা, ছ্যা তোমার মা-র রক্ত খাবো। এমন ছোটলোক সীতানাথ উকিল নয়’।বলেই ফের উঠে দাঁড়ায় সীতানাথ।
লোকটা ঘোড়েল মুখ করে বলল, “মাইরি গুল মারছিলুম। সেই থেকে আপনি আমার পকেট ফাঁসাচ্ছেন’।
‘ফাঁসাচ্ছি? আমি কি শালা বসন্ত উকিল যে লোক ঠকাব।’ ক্ষ্যাপাটে গলায় বলে সীতানাথ, ‘আমায় ছেড়ে বরং ওই বসন্ত উকিলের কাছেই যাও। চামড়া ছাড়িয়ে যখন ঘেয়ো কুকুর করে দেবে তখন এসো’।
বেয়ারা কাছে আসতেই লোকটা একটুও দেরি না করে দু গেলাস পাইনঅ্যাপেল জুসের অর্ডার করল।
সীতানাথ বসে বসে কোটের বোতাম খুলল। কোটের কলার সামান্য পেছনে টেনে হাওয়ায় গা শুকিয়ে নিচ্ছিল। এতেও আরাম পাচ্ছিল না দেখে, কোটটা গা থেকে খুলতে গিয়েই বোটকা গন্ধ নিজেই টের পেল। মাঝে মাঝে ভাবে, কোটটাকে এবার পালটালে হয়, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে, নাহ; এই রংচটা কোটটাই ওর অভিজ্ঞতার সাইনবোর্ড। নতুন দেখলেই লোকে ভাবে, এ লাইনে সবে এসেছে। আর তার মানেই হল, শূন্য ঘরে একা একা বসে মাছি মারা আর মশা তাড়ানো। অ্যাডভোকেট হওয়ার চেষ্টাও দু’ একবার করেছিল, পারেনি। সে কি আজকের কথা! সেই প্রথম যৌবনে রক্ত যখন টগবগ করত, তখন। কোটটাকে এবার গা থেকে খুলে চেয়ারের হাতলে রাখল সীতানাথ। সোমবার বলে ইস্তিরি করা জামাটা বেশ ধপধপে। পাখার হাওয়ায় এসময় বেশ আরাম বোধ করল সীতানাথ। লোকটা ত্যাঁদড় চোখে তাকিয়ে থেকে ফিক ফিক করে হেসে বলল, ‘আমাদের বয়সকালে আপনি না স্যার কাত্তিক ছিলেন’। বলেই হাসল।
সীতানাথ এবার পকেট থেকে ঘেমো রুমাল বের করে ঘাড় আর গলা ভাল করে মুছে নিয়ে বলল, ‘মেয়েছেলেটা খুব ডাগর বুঝি?’
পাইনঅ্যাপেল জুসের গেলাস দুটো দুজনের সামনে রেখে বেয়ারা চলে গেলে পর লোকটা নিজের গেলাসটা সীতানাথের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খুব জোর বাতাস বইলে গাছের ডালপালা যেমন এপাশ ওপাশ করে, আমারও হয়েছিল তেমনি। মাইরি বলছি, প্রথমে আমি চেয়েও দেখিনি,’ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘রক্তটাই আমার খারাপ’।
সীতানাথ অমনি বলল, ‘বেড়ে বলেছ। তা তোমার জন্মদাতারাও কী এমন কাণ্ড করেছিল? যাক গে যাক, ওসবে আমার কী দরকার।’ বলেই নিজের গেলাসটা শেষ করে দ্বিতীয় গেলাসটা ধরতে গিয়েই বলল, ‘তুমি খাবে না?’
‘না স্যার, হজম হবে না, পেট ফাঁপবে।’ লোকটা স্পষ্ট জবাব দিল।
দ্বিতীয় গেলাসে চুমুক দিয়েই বলল সীতানাথ, ‘খেলে পারতে’। একটু থেমে বলল, ‘ডেঁয়ো পিঁপড়ে দেখেছ, কুটুস করে কামড়ায়, অনেকক্ষণ ধরে জ্বলে।’
লোকটা বোকা চোখে সীতানাথের দিকে চেয়ে রইল। বলল, ‘এ কথা বলছেন কেন স্যার’?
চোঁ করে গেলাসের অর্ধেকটা শেষ করে সীতানাথ রহস্যের হাসি হাসল। বলল, ‘মেয়েছেলেরাও ওরকম। বেশ লাগে দেখতে। কিন্তু বড্ড জ্বালায়। হাড়ে দুব্বোঘাস গজিয়ে ছাড়ে’।
বঁড়শিতে মাছ গাঁথলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমনি সুখ আর আনন্দ হতে থাকল লোকটার সে সময়। বলল, ‘মাইরি বলছি স্যার, এ কামড়ে বড় বড় রুই-কাতলাও গোত্তা খেয়ে পড়ে, আমরা আর কী।’
সীতানাথ গেলাসটা শেষ করে উদাস চোখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টেবিলগুলোর দিকে চেয়ে চোখ বুলোয়। অদ্ভুত লাগে সে সব দেখতে। কিছুই বোঝার উপায় নেই, কে গেরস্ত, কে লাইনের!
লোকটা টুসকি হেসে বলল, ‘সত্যি বলছি স্যার, আপনার মতো লোক যদি সক্কলে হত তো আমরা বেফয়দা ঝামেলায় পড়তাম না।’
সীতানাথ বলল, ‘ছাড়ান পেয়েই ফের আর এক জায়গায় গোত্তা মারতে, তাই না। তোমাদের জন্যেই মা-বোনের ইজ্জত নেই রাস্তাঘাটে’।
লোকটা বলে, ‘সকলে মা-বোন হলে বউ করব কাকে স্যার। সবাই কি মা-বোন হয়?’
খাঁটি কথা। সীতানাথ এক সেকেন্ড ভাবল। জিজ্ঞেস করল, ‘মেয়েটার বাপ কী করে?’
লোকটা একটুও দেরি করল না। বলল, ‘বাপ হয়ে শালা মেয়ের কাছ থেকে দালালি নেয়। এমন বাপ দেখেছেন কখনও?’
‘বহুত! বহুত!’ সীতানাথ জবাব দেয় মুহূর্তে। বলল, ‘অমন দু-একজনকে যে এখন তোমার সাক্ষী জোগাড় করতে হবে।’
লোকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুহূর্তে। বলল, ‘সব শালা সাধু-সন্নেসীর বাচ্চা; কী করি বলুন তো?’
সীতানাথ ওর কথা শুনে হো হো করে হাসল। বলল, ‘বুঝেছি। কেউ তোমার পাশে দাঁড়াবেনা। এত বুদ্ধি নিয়ে তোমার এ দশা হল কেন!’
‘সব কপাল স্যার। আর এক গেলাস জুস বলি।’ লোকটা একটু চেপেই ধরল যেন সীতানাথকে। বলল, ‘মিছিমিছি এ সব জুস ফুসে পয়সা খরচ করে কী লাভ। একটা ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকে চট করে দুটো মেরে দি চলুন?’
সীতানাথ এবার চোখ বড় করে দেখল লোকটাকে। বলল, ‘টোপ দিচ্ছ, দাও। আমাদের কি বেচাল হয়ে বাড়ি ফেরা চলে। তোমার মতো তো আর রক্তে দোষ নেই আমার।’
লোকটির মুখে খৈ ফোটে যেন। বলে, ‘আমাদের রক্তে একটু কালচে ছোপ আছে, আপনাদের হচ্ছে গে লাল টকটকে।’ কথা কটি বলেই মুচকি হাসতে থাকে লোকটা।
ও কথায় বেশি গুরুত্ব দিল না সীতানাথ। বলল, ‘আমার কনসালটেনসি ফিটা এবার ছাড়ো তো চাঁদ’।
মিইয়ে গেল লোকটা। বলল, ‘মা-র অসুখ, দিশি, বিদিশি কিছু একটা তো লাগবেই। বলি কী, আগামী বিষ্যুৎবার, মাইরি বলছি, পাই পয়সা সব মিটিয়ে দেবো’।
সীতানাথ হেসে বলল, ‘আমাদের লাইনে ধার চলে না। ধার দিয়েছ কী, ঢালু পাড়ের মতো জল হুড় হুড় করে নেবে যাবে। ধানাই-পানাই ছেড়ে আসলি কাজটা করে ফেল তো চাঁদ।
লোকটা কিন্তু করল না। পাঞ্জাবির ভেতরের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক তাড়া নোট বের করে গুনে গুনে সীতানাথ উকিলের হাতে দিয়ে বলল, ‘এ ঠিকানাটা রেখে দিন সময় পেলে একবার পায়ের ধুলো দেবেন।’
আর দেরি না করে লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ল সীতানাথ।
হেটো কাপড় পরা, গালে দিন পনেরোর না-কামানো দাড়ি, পাকানো চেহারা নিয়ে সীতানাথের বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে লম্বা মতন প্যাসেজের মধ্যে ঢুকে সামান্য পর্দা সরিয়ে বলল, ‘আমি মিন্টুরানির বাপ’।
সীতানাথ আপাদমস্তক লোকটাকে দেখে নিয়ে বলল, ‘ভেতরে আসুন। মিন্টুরানির বাপ বললেই কী হল; ও সব কথা কি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হয়!’
লোকটার বেশি আড়ষ্টতা নেই। টান টান ভঙ্গিতে ঘরের মধ্যে ঢুকে মুখোমুখি বসল সীতানাথের। এরপরে খুব সেয়ানা চোখে ঘরের সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল।
সীতানাথ কোনও কথাই বলছিল না। লোকটাকে দেখছিল শুধু। দু নম্বরি, না, সাচ্চা এটাই খুঁজে দেখছিল সেসময়। সীতানাথের টেবিল কোর্ট কাচারির কাগজে ভর্তি। একটা বার্লির কৌটোয় দাঁত খোঁচানোর কাঠি, পাখির পালক। কৌটো থেকে একটা পাখির পালক তুলে নিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগল সীতানাথ। আরামে চোখ বুজে এল ওর।
মিন্টুরানির বাপ বলল, ‘অনেক খোঁজ-পাত্তা করে আপনার কাছে এয়েচি। মাখন দাসের কেস তো আপনিই নিয়েছেন। ও শুয়োরের বাচ্চাকে আপনি বাঁচাবেন কেন? আপনার কী জাত-ধম্ম, ন্যায়-অন্যায় নেই।’
বড় করে চোখ মেলল সীতানাথ। বলল, ‘উকিলের আবার জাত-ধম্ম কী, এ্যাঁ। একটু কেশে বল তো ব্যাপারটা কী?’
মিন্টুরানির বাপ বলল, ‘কাশাকাশির কী আছে। ওই মাখন দাস মিন্টুরানিকে সিনেমায় নামাবে বলে শেষ করল। প্রথম যখন এল তো হারামজাদার মুখে রা ফোটে না। ভাবলাম, ঘুরুক দু’চারদিন; মিন্টুরানির যদি একটা হিল্লে হয় তো লাথি মেরে দূর করে দেব বজ্জাতটাকে’।
সীতানাথ প্রশ্ন করল, ‘তা লাথিটা কে মারলে? মাখন দাস তো দু’চারদিন ঘোরেনি, দু বছর ঘুরেছে মিন্টুরানিকে নিয়ে। এই দু বছরে মাখন দাসের কত পকেট কাটা গেছে জানো? কালীঘাটে গিয়ে মিন্টুরানিকে শাঁখা পরিয়েছে, সিঁদুর দিয়েছে, তা এসব কি জানা আছে ধম্মপুত্তুরের?’
‘এ্যাঁ, আমরা জানলাম না, পাড়া পিতিবেশি জানল না, কেউ জানল না, বে হয়ে গেল!’ মিন্টুরানির বাপ অবাক চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে কিছুই যেন হয়নি এমন ভঙ্গি করে বলল, ‘তা আর বড় কথা কী! মানসে বে করে, পশুতে তো আর করে না। তবে জামাইসোনা মিন্টুর খোরপোস দেবে না কেন?
সীতানাথ ওর ওকালতি জীবনে অনেক ঘোড়েল দেখেছে, মিন্টুরানির বাপ যেন সকলকেই ছাপিয়ে গেল। চোখ দুটো একেবারে স্থির হয়ে গেল সীতানাথের। পরক্ষণেই ওর ভেতরের উকিল সীতানাথ উকি মেরে ধমকে উঠল, ‘আহাম্মক, কথা বেচে খাও, এখন সব গুলিয়ে ফেলছ কেন?’ অমনি চটকা ভাঙল সীতানাথের। মিন্টুরানির বাপের চোখে চোখ রেখে ভুরু দুটোকে বার কয় নাচিয়ে একেবারে সদাশিব ভঙ্গিতে শুধোল, ‘খোরপোসটা কার শুনি?’
চেয়ারের ওপরে পা দুটোকে তুলে শেয়ালে চোখে এদিক ওদিক চেয়ে ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ‘অমন ডাগর মেয়ের সব স্বত্ব কি ছেড়ে দেওয়া যায়? ছেড়ে দিলে আমার চলবে কিসে?’
সীতানাথ জিগ্যেস করল, ‘তোমার বউ তো বছর দশেক আগে তোমার খপ্পর থেকে মরে বেঁচেছে। জবর দখল জায়গায় থাকো। নেশাভাং কী কী করো? মেয়েছেলের দোষ আছে নাকি তোমারও?’
মিন্টুরানির বাপ বলল, ‘এই অঘ্রাণে ছেচল্লিশ পার হল। ভরা যৌবনে বউ মরে গেল। বলেন উকিলবাবু, মানুষের দেহে কাম ক্ষুধা তো থাকবেই। সন্নেসী তো নই।’
সীতানাথ বলল, ‘তা বেশ। আমাকে কী করতে হবে?’
মিন্টুরানির বাপ বলল, ‘ও শালা মাখন দাসের’ বলেই জিব কাটল। ‘জামাইসোনাকে শালা বলে ফেললাম। সঙ্গ দোষে মুখ খারাপ হয়ে গেছে উকিলবাবু। বলি কী, মাখনের অনেক পয়সা। এমন একটা কিছু পথ করে দিন যাতে আমার আপনার পকেটেও কিছু আসে।’
‘মিন্টুরানির কী হবে?’ সীতানাথ জিজ্ঞেস করে।
লোকটা পালটা প্রশ্ন করল, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি মাখনের না আমার মিন্টুরানির উকিল?’
সীতানাথ সহজ উত্তর দিল, ‘পয়সা তুমি কার? তা পয়সা বলল, যার পকেটে তার। বুঝেছ কিছু?’
‘বুঝিনি আবার!’ বলেই জোরসে হাঁটু নাড়াতে লাগল মিন্টুরানির বাপ।
দৃশ্যটা বড় অশোভন ঠেকল সীতানাথের চোখে। ধমকে বলল, ‘পা নামিয়ে ঠিক হয়ে বসো।’
মিন্টুরানির বাপ সোজা হয়ে বসল। সীতানাথের কথাটা পুনরাবৃত্তি করে বলল, ‘পয়সা তুমি কার, যার পকেটে তার। আমি রাজি। কাল পরশু একবার আসবোখন কেমন?’
দেয়ালে টাঙানো মাটির মা-কালীর মুণ্ডুটার দিকে হাত জোড় করে কী যেন বলল সীতানাথ। পরে একসময় ধীর গলায় বলল, ‘আমার একটা কাজের লোকের দরকার। তোমাকে আমার বড় মনে লেগেছে। মুহুরি আর কি! পড়াশুনো কিছু করেছ বলে তো মনে হয়। পারবে না?’
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল মিন্টুরানির বাপ। ফের গ্যাঁট হয়ে চেয়ারে বসে বলল, ‘ওসব ছ্যাঁচড়া কাজে খাটুনি খুব। এখন হাত-পা ছড়িয়ে সুখে বাকি দিন কাটাব, বুঝলেন না উকিলবাবু। বলি কী মিন্টুরানিকে আমার হেফাজতে আনিয়ে দিন, আর ওই সোনার চাঁদের কাছ থেকে কিছু টাকা, ব্যাস, আর কিছু চাই না আমার’। উঠে দাঁড়িয়ে বেশ স্পষ্ট গলায় বলল, ‘টাকা না থাকলে শেয়াল-কুত্তার জীবন। ভালমতন রফা করতে পারলে, ভাগটা আপনার ভালই হবে উকিলবাবু।’ বলেই গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিন্টুরানির বাপ।
আলমারির মাথায় নজর পড়তেই চমকে গেল সীতানাথ। দেখল, দিন পনেরো আগে মাখন দাসের পয়সায় কেনা পরিষ্কার করার প্যাকেটটা পড়ে আছে। আয়নার কাচ পরিষ্কার করবে বলেই কেনা। কিন্তু সেই যে রেখে দিয়েছে, মনেও পড়েনি আর। ভাল করে ঘরের চারপাশটা দেখে নিল সীতানাথ। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় হলদেটে ছোপ নজরে পড়ল। আইনের বইগুলো যে সব আলমারিতে থাকে তার অধিকাংশ কাচই ভাঙা, যাও দু একটা আছে ধুলোয় ভরে গেছে, মনে পড়ল, আজই তো মিন্টুরানি ছাড়া পাবে। মুখ টিপে হাসল সীতানাথ। কেমন কৌশলে সব বন্দোবস্ত করে দিল। স্পষ্ট দেখতে পেল, ও, মাখন দাস আর মিন্টুরানির বাপ একই পথ ধরে হাঁটছে।
মাখন দাস হাসছে ওকে দেখে, ও হাসছে মিন্টুরানির বাপকে দেখে। আর মিন্টুরানি ওদের সকলকে দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে।
হাসুক, মিন্টুরানির বাড়িতে আজ সীতানাথের নেমন্তন্ন। ভাল করে চুল কলপ করতে হবে। নব কাত্তিক সেজে মিন্টুরানির ঘরে না গেলে কি চলে?
২৭ ডিসেম্বর ১৯৮১