টুটুনের প্রতিজ্ঞা
এখন হয়েছে কী, ক্লাসে মাস্টারমশায় যেই ঠাট্টা করে বলেছেন, বেগুন মানে কোনও গুণ নেই, খেলে চুলকোনা হয়,–অমনি কথাটা বড়বড় কান পেতে শুনেছে টুটুন। আর যেই শুনেছে, অমনি কান থেকে কথাটা গিয়ে মাথার মধ্যে ঢুকেছে। বেগুনের কোনও গুণ নেই–বেগুন খাওয়া কখনও উচিত নয়।
ড্রয়িংয়ের খাতায় অনেক কালি-টালি ঢেলে অনেক কষট করে একটা বেগুন এঁকেছিল টুটুন। একটুখানি লাউয়ের মতো দেখতে হয়েছিল বটে, তবু ওটাকে বেগুন বলেই মনে হওয়া উচিত কারণ বেগুনে রঙের লাউ কি কোনও দিন কেউ দেখেছে? আজ স্কুল থেকে ফিরে ড্রয়িংয়ের খাতাটা খুলেই যেন টুটুনের সারা গায়ের মধ্যে চিড়বিড় করতে লাগল। তখুনি টুটুন ছবিটাকে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলল।
পরের দিনটা ছিল রবিবার। আর সেদিন খেতে বসেই একটা ভীষণ গণ্ডগোল বেধে গেল।
বাড়িতে একটা মস্ত ইলিশমাছ এসেছে আর টুটুন তো ইলিশমাছ খেতে ভীষণ ভালোবাসে। অবিশ্যি গাদার মাছে খুব কাঁটা, তা সে খেতে পারে না। মা তাকে পেটির মাছই দেন।
রবিবারে মা-ই রান্না করেন, ঠাকুর শুধু সেদিন জোগান দেয়। আজও মা ইলিশমাছের ঝোলটা নিজের হাতে যত্ন করে বেঁধেছেন আর একটা বড়ো পেটি দিয়েছেন টুটুনকে খেতে। কিন্তু সেই পেটির সঙ্গে কী সর্বনাশ–দুটুকরো বেগুন।
টুটুন অমনি লাফিয়ে উঠে বললে, আমি বেগুন খাব না।
মা বললেন, কচি বেগুন–খা। ভালো লাগবে।
টুটুন মাথা নেড়ে বললে, না–খাব না। বেগুন খেলে চুলকোনা হয়।
মা হেসে বললে, তোকে ডাক্তারি করতে হবে না, তুই খা।
না।
মা তখনও হাসছিলেন, বললেন, তোকে তো আর এক সের বেগুন পুড়িয়ে খেতে বলছে কেউ। খেয়ে নে টুটুন–গোলমাল করিসনি।
না–না।
মার হাসি বন্ধ হয়ে গেল।
খাবি না?
না।
মা এমনিতে ছোটখাটো আর হাসি-হাসি হলে কী হয়, কলেজে প্রফেসারি করেন কিনা–আসলে মেজাজটা খুব কড়া। তখুনি সেই মস্ত মাছের পেটিসুদ্ধ বাটিটাকে সরিয়ে নিলেন। বললেন, তবে খেয়ো না। কিন্তু বেগুন না খেলে মাছ পাবে না, এ-ও তোমাকে বলে দিচ্ছি।
টুটুনের দুঃখে কান্না আসছিল, কিন্তু তখন মনে পড়ল, তার এগারো বছর বয়েস হল, সে পুরুষ মানুষ, এখন তার জেদ হওয়া উচিত। বেশ, মাছ আমি খাবই না। চোখের জল চেপে, ডাল-তরকারি-ভাজা দিয়ে খেয়েই উঠে গেল সে।
তারপর সারাদিন মন খারাপ-ভীষণ মন খারাপ! মা-ও এমন যে তাকে আর একবার সাধলেন না পর্যন্ত। ঠিক আছে।–বেগুন সে আর খাবেই না সারাজীবন।
সেদিন বিকেলে টুটুন তাই ফরসা জামা পরল না, ভালো করে চুল আঁচড়াল না, যে দুধরুটি তার বরাদ্দ তার অর্ধেকটাই বাড়ির লোভী হুলো বেড়াল কার্তিককে খাইয়ে দিলে। (কার্তিক মাসে জন্মেছিল কিনা–তাই ওই নামটা) তার পরেই সুড়ৎ করে চলে গেল তার বন্ধু অতনুদের বাড়িতে।
অতনুর মা ওকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন। বললেন, আয় আয়, তোর কথা ভাবছিলুম। তুই যখন বাড়ি যাবি, তখন একটা জিনিস সঙ্গে দেব তোর। তোর মাকে দিস।
এখন, অতনুদের দেশ হল জয়নগরে। সেখানে খুব ভালো মোয়া তৈরি হয় আর প্রায়ই এক-আধ হাঁড়ি দেশ থেকে আনা মোয়া টুটুনদের বাড়ি যায়। টুটুন তখন অতনুর সঙ্গে ক্যারাম খেলছিল। শুনেই তার টিপ ফসকে স্ট্রাইকারটা গর্তে গিয়ে পড়ল। টুটুন বললে, কী দেবেন মাসিমা, মোয়া বুঝি?
অতনুর মা হেসে বললেন, না, মোয়া নয়। আজ দেশ থেকে খুব বড় বড় বেগুন এসেছে–তাই গোটা চারেক দিয়ে দেব সঙ্গে।
বেগুন!
শুনেই টুটুনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এখানেও সেই সর্বনেশে বেগুন! অতনুর মা পাটিসাপটা পিঠে ভাজছিলেন কিন্তু টুটুনের মনে হল, পাটিসাপটার চাইতে খারাপ জিনিস আর কিছু নেই। তক্ষুনি টুটুন উঠে পড়ল।
অতনু খেলায় জিতছিল কিনা, তাই টুটুনকে টেনে ধরল।
–এই কোথায় যাচ্ছিস?
–একটা ভুল হয়ে গেছে ভাই এক্ষুনি আসছি
— বলেই দৌড়। এমন দৌড় যে, রাস্তার একটা রিকশাওয়ালা তাকে ভীষণ বকল।
এই খোকাবাবু, অ্যাইসা দৌড়ো মৎ রাস্তামে কেতনা গাড়ি হ্যায়—
কিন্তু টুটুন কোনও কথা শুনল না। ছুটতে ছুটতে ছুটতে শেষে হৃষীকেশ পার্ক পেরিয়ে একেবারে বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে ছোটপিসিমার বাড়িতে।
অবিশ্যি ছোটপিসিমার বাড়িতে টুটুনের যেতে বারণ নেই। মোটে একটা বড় রাস্তা পেরুতে হয় কিনা। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখানে থেকে ফিরে আসা চলে।
পিসেমশাই সেদিন কোথায় যেন মাছ ধরতে গেছেন ফিরতে রাত হবে। তাই ছোটপিসিমা একা একা তাঁর দেড় বছরের ছেলে–মানে টুটুনের পিসতুতো ভাই কিংকংকে নিয়ে বসেছিলেন আর উল বুনছিলেন। অবিশ্যি কিংকং নাম বলে সে আসলে দেখতে খারাপ নয়–তার ভালো নাম দীপঙ্কর বেশ মিষ্টি আর গোলগাল চেহারা।
কিংকং একটা কাঠের বাঘ নিয়ে তার মুণ্ডটা চিবুচ্ছিল, আর তার মুখ থেকে লাল পড়ছিল। একটু আগেই কেঁদেছিল নিশ্চয়, তাই কাজল-টাজল গলে গালে-টালে লেগে গিয়েছিল। ছোটপিসিমা একটা বেতের মোড়ায় চটি পায়ে দিয়ে বসে উল বুনছিলেন–কিংকং মধ্যে মধ্যে চটি ধরে টানাটানি করলে আঃ বলে পা সরিয়ে নিচ্ছিলেন।
ছোটপিসিমা বললেন, আয় টুটুন–আয়। বৌদি ভালো আছে–ছোটা ভালো আছে? বৌদি টুটুনের মা আর ছোটদা তার বাবা।
টুটুন জানাল, সবাই ভালো আছে, এমন-কি কার্তিক পর্যন্ত ভীষণ ভালো আছে। তার পর টুটুন অনেকক্ষণ পর্যন্ত খেলা দিল কিংকংকে হালুম হালুম করে বাঘের ডাক ডেকে তাকে ভয় দেখাতে চাইল। কিন্তু কিংকং কি আর ওতে ভয় পায়? শাদা শাদা ছোট-ছোট দাঁতে তার কী খিলখিল হাসি।
তার পরে যখন ছোটপিসিমার ঝি মণিমালা এসে কিংকংকে জোর করে দুধ খাওয়াতে নিয়ে গেল, তখন ছোটপিসিমা উল রেখে উঠলেন। বললেন, খিদে পেয়েছে টুটুন?
খিদে নিশ্চয় পেয়েছে। এমনিই তো দুপুরে ভালো করে সে খায়নি, বিকেলে রুটি-দুধ তো সবটাই গেছে কার্তিকের পেটে। তবু টুটুন বললে, না, খিদে পায়নি।
ছোটপিসিমা বললেন, আচ্ছা–বোস। আমি আসছি।
তিনি রান্নাঘরে উঠে গেলেন, স্টোভ জ্বাললেন, কী যেন ভাজতে লাগলেন। টুটুনের খিদেটা ক্রমেই বাড়তে লাগল, একবার ইছে হল তিনি কী ভাজছেন দেখে আসে। কিন্তু টুটুন জানে, পুরুষ মানুষের রান্নাঘরে যেতে নেই। টুটুন বসে বসে পিসেমশায়ের একটা ইংরেজী পত্রিকা নিয়ে তার রঙিন ছবি দেখল। একটা সাদা কালো বেড়াল যাচ্ছিল প্রাচীর দিয়ে তাকে চুক চুক-আ-আ করে ডাকল, সে একবার ম্যা-আও বলে সাড়া দিয়ে কোথায় যেন লাফিয়ে চলে গেল। আর টুটুনের খিদে বাড়তে লাগল–দারুণ বাড়তে লাগল, মনে হল, কতদিন যেন তার খাওয়া হয়নি।
তখন ছোটপিসিমা একটা প্লেটে কী যেন গরম ভাজা নিয়ে ঢুকলেন। তার গন্ধেই টুটুনের মন দুলে উঠল। পিসিমা হেসে বললেন, ভালো বেগুন এসেছে, কটা বেগুনি ভাজলাম তোর জন্যে।
এখানেও বেগুনি! টুটুন গুম হয়ে রইল।
তার পরে কী হল? টুটুন এক দৌড়ে পালিয়ে গেল সেখান থেকে? আর নানা! খিদের মুখে কি আর অমন প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে কেউ?
আর তা ছাড়া কে না জানে–গরম বেগুনি খেতে ভালো লাগে, ভীষণ ভালো লাগে।