টানাটানি
একটা সর্বাধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক সংসার তৈরি করব আমরা।
প্রশান্ত এই কথাটি বলে চায়ের কাপে নিশ্চিন্ত চুমুক চালাল। ঝাপসা সকাল। প্রচণ্ড বৃষ্টি। পাট করা বাজারের ব্যাগ পাশে। তার পাশে ফোল্ডিং ছাতা। ছাতায় এ বৃষ্টি আটকাবে না। প্রমীলা উদবিগ্ন মুখে আর একটা আসনে। সামনে শার্সি বন্ধ জানলা। ঘুটঘুটে কালো একটা আকাশ। প্রমীলা বৃষ্টি একটুও ভালোভাসে না। বৃষ্টি মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে। জল, কাদা প্যাচপ্যাচ। কাপড় জামা শুকো না। সর্ব অর্থে একটা বাজে ব্যাপার। উত্তরবঙ্গের সেই বন্যার স্মৃতি, মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়।
প্রমীলা গম্ভীর গলায় বললে, ‘কীরকম?’
প্রশান্ত বললে, ‘নতুন শতাব্দী। সব কিছু এমনভাবে বদলে যাবে পুরোনোর ছিটেফোঁটাও থাকবে না। নতুন রকমের মানুষ, সমাজ, জীবন বিশ্বাস!’
‘হাত পা, মাথাওয়ালা মানুষ থাকবে তো!’
‘তা থাকবে।’
‘ব্যস। তাহলে যা আছে তাই থাকবে। সাধারণ মানুষের সংসারে বিজ্ঞান। তোলা উনুনের বদলে গ্যাস। রেডিয়োর জায়গায় টিভি। পাম্পে করে জল ছাতে তুলে নীচে নামানো। ঠোঙার বদলে প্লাস্টিকের ব্যাগ। রুটির বদলে চাউ। ডিমপাড়া মুরগির বদলে ডিম না পাড়া মুরগি। এই তো তোমার বিজ্ঞান।’
প্রশান্ত বিজ্ঞের হাসি হেসে বললে, ‘কিছুই জানো না। এটা যেমন দু:খের সেইরকম আনন্দেরও। বেশ নিশ্চিন্ত থাকা যায়। শুনে রাখো, মানুষের সঙ্গে আর মানুষের প্রতিযোগিতা নয়, প্রতিযোগিতা কম্পিউটারের। মানুষকে কম্পিউটার হতে হবে। তা না হলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে নর্দমায়।’
‘কম্পিউটারের মতো হলে কী হবে?’
‘ধরো আমি একটা কম্পিউটার। তুমি একটা কম্পিউটার। দুজনে বিয়ে করে সংসারী হয়েছি। সকালে উঠে বোতাম টেপামাত্রই, ঝট, তুমি চা নিয়ে এলে। আজ একরকম চা, কাল একরকম নয়। প্রত্যেকদিন ক্লাস ওয়ান।’
প্রমীলা বললে, আর আমি উঠে কোন বোতাম টিপলে তুমি ঝট করে চা নিয়ে আসবে?’
‘কম্পিউটার সম্পর্কে তোমার কোনও আইডিয়াই নেই। কম্পিউটারের মেমারি বলে একটা জিনিস থাকে সেইখানে ভরে দেওয়া হয় প্রাোগ্রাম। কর্তব্য তালিকা। তুমি হলে ফিমেল কম্পিউটার আমি হলুম মেল। তোমার মেমারিতে ঠিক সকাল সাড়ে ছ’টায় চা করা, আমার মেমারিতে ঠিক সাড়ে ছ’টায় চা খাওয়া।’
‘এই মিলেনিয়ামে ওটা উলটে যাবে ভাই। হাজার বছর ধরে তোমরা মেয়েদের সেবাদাসী করে রেখেছ। আর চলবে না। এইবার তোমরা হবে সেবাদাস।’
‘আমি এখনও শেষ করিনি ম্যাডাম। মেল কম্পিউটারের মেমারিতে কী কী থাকবে শোনো। ঠিক আটটায় ব্যাগ বগলে বাজারে ছোটা। ফিমেল কম্পিউটারে ঠিক আটটায় রান্না চাপানো। ন’টার সময় মেল কম্পিউটার পিঁপ-পিঁপ করে সিগন্যাল দেবে। ফিমেল কম্পিউটার ঝটাপট খাবার দেবে—ভাত, ডাল, ভাজা, মাছ, চাটনি। এরপর ফিমেল কম্পিউটার নিজের মতো চলবে। কিন্তু সেখানেও প্রাোগ্রাম থাকবে। সময়ের বেহিসাবে খরচ চলবে না। ঘরদোর পরিষ্কার, ইনটিরিয়র ডেকরেশান, বিছানা পরিপাটি করা, জামাকাপড় ওয়াশিং মেশিনে কাচা। ইস্ত্রিরি করা। পরদা পালটানো। ফুলদানির ফুল পরিবর্তন করা। ঝুল ঝাড়া, ছবির কাচ পরিষ্কার করা। ফোন অ্যাটেন্ড করা। দরকারি খবর ডাইরিতে লিখে রাখা। নিজের বান্ধবীকে ফোন করলে কম্পিউটারের টাইমার চালু রাখা। ঠিক এক মিনিট তারপরেই পিঁপ। আর বান্ধবী যদি করে যতক্ষণ খুশি কথা বলে যাও। কম্পিউটারে এই প্রাোগ্রামিংটা অবশ্যই যেন থাকে।’
‘আর ফিমেল কম্পিউটার যদি চাকুরে হয়?’
‘তাহলে তো হয়েই গেল। সে হয়ে গেল মেল কম্পিউটার। তখন আর ঘর সংসার রইল না। বাড়ি হয়ে গেল মেস বাড়ি। আমি যখন দাড়ি কামাব, তুমি তখন চুলের জট ছাড়াবে। বাড়িতে তালা। ছেলেপুলে হলে আয়া। কারও ওপর কারও থাকবে না মায়া।’
‘তারপর কম্পিউটার যখন বুড়ো হবে!’
‘বাতিল। আমেরিকায় যেসব গাড়ি বুড়ো হয়ে যায় ‘ গো-ভাগাড়’-এর মতো ‘গাড়ি-ভাগাড়ে’ দূর করে টান মেরে ফেলে দেয়। তারপর বুলডোজার দিয়ে মড়মড়িয়ে তালগোল পাকিয়ে গলিয়ে লোহা করে ফেলে।’
‘আমরা তো লোহা নই।’
‘দেহটা হাড়-মাসের, মনটা লোহার। তোমার মনে প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা আছে?’
‘না নেই।’
‘তবে?’
‘তোমার মনে আছে?’
প্রশান্ত বললে, ‘টাকার মতো। নেই, তবু পেতে চাই। প্রেম নেই কিন্তু চাই, পেতে চাই। জীবনে কেউ একজন থাকবে, কবিতার মতো, গানের মতো, আমার নয়ন তোমার নয়নতলে মনের কথা খোঁজে।’
‘আর আমি যদি বলি, তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে / আমায় শুধু ক্ষণেক তরে / আজি হাতে আমার যা কিছু কাজ আছে / আমি সাঙ্গ করব পরে।’
‘বুঝলে প্রমীলা রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে বাঁচা যাবে না। শোনো অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া, সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া—
‘তাহলে বলি, আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে, চাও কি—/হায় বুঝি তার খবর পেলে না।’
‘এইবার ছোট্ট করে একটা কাজ করে দাও। বিরক্ত হয়ে না, প্রেমসে।’
লাগাও।’
‘খাটটাকে জানালার কাছ থেকে সরাতে হবে। বর্ষা এসে গেছে।’
‘তার মানে টানাটানি?’
‘কমরেড। সংসার মানেই যে টানাটানি। বাতাও ভাই, কেয়া, হোগা। ক্যায়সে হোগা।’
‘বৃষ্টি ধরে গেছে। আকাশে সামান্য সামান্য নীলের উঁকি। প্রশান্ত ব্যাগ বগলে রাস্তা। বেশ চমৎকার লাগছে। জায়গায় জায়গায় জল জমেছে। শৈশবটা ফিরে পেলে ওই জমা জলের ওপর দিয়ে ছপাৎ ছপাৎ করে অবশ্যই যেতে হত। না গিয়ে উপায় ছিল না। আকাশের উঁকি মারা নীলের মতো শৈশব, কৈশোর, যৌবনের টুকরো টুকরো স্মৃতি ভেসে এসে ভেসে চলে গেল। তখন যারা ঘিরে ছিল, এখন তারা সব দূরে। বন্ধুরা জীবিকার সন্ধানে বেশিরভাগই বিদেশে। যারা দেশ ছাড়েনি তারা সংসারী। সংসার গিলে ফেলেছে। আত্মীয়স্বজনরা প্রায় সবাই আকাশে। মোড়ের মাথায় হরিদাসবাবুর বাড়ি। তিনি একসময়ে প্রশান্তর শিক্ষক ছিলেন। মারা গেছেন। খুব শ্রদ্ধেয় মানুষ। এখনও সবাই তাঁর নাম করেন। বাড়ির সামনে ছোটখাটো একটা ভিড়। ভিতরে কোলাহল। হরিদাসবাবুর দুই ছেলে তাদের বৃদ্ধা মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। প্রায় দরজার কাছ অবধি এনে ফেলেছে। বৃদ্ধা কাঁদছেন, আর বলছেন, ‘মাকে ফেলে দিবি। আর ক’বছরই বা বাঁচব।’ বড় ছেলে টানছে, ছোটটার হাতে একটা চটের ব্যাগ। ছোট বউ অভিনেত্রী। বড়র বউ টেলিফোন অপারেটর। বড়র ব্যাবসা। ছোটটা বউয়ের ম্যানেজার।
প্রশান্ত বললে, ‘আপনারা দেখছেন, কিছু বলছেন না?’
উত্তর এল, ‘পারিবারিক ব্যাপার। বাড়ির কাজের মেয়েটেয়ে হলে খাল খিঁচে দিতুম।’
বৃদ্ধার চোখে চশমা। ফ্রেমটা বহুকালের পুরোনো। এক সময় টকটকে ফরসা ছিলেন। এখন তামাটে। প্রশান্ত যখন ছাত্র, তখন ইনি ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী। সেই সময় কত গল্প, গান, ইয়ার্কি। ছোট ব্যাগটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় ছোটবউ টকটক করে বাড়ি ঢুকছে। দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল। ব্যাগটা স্বামীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বৃদ্ধার শীর্ণ হাতটি ধরে বললে, ‘কোথায়, কোথায় যাবেন আপনি? আমার কাছে থাকবেন। দেখি কার ঘাড়ে ক’টা মাথা। চলুন ভিতরে।’ আমাদের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘নাটক শেষ।’ কোথা থেকে এক কিশোর এসে কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘সত্যি। দিদি সত্যি। দিদাকে তুমি তুলে নিলে।’ বলছে আর কাঁদছে। কাঁদছে আর বলছে। প্রশান্ত ভাবছে—এও সেই টানাটানি। মনে মনে মেয়েটিকে প্রণাম করে বারকয়েক উচ্চারণ করল, ‘মা’।