ঝকমারির মাশুল – মনোরঞ্জন দে
আমার নিরুপদ্রব শান্ত জীবনে ছন্দপতন ঘটল। পাঁচ-পাঁচটা বছর একনিষ্ঠ সৎ কর্মচারী হিসেবে সুনাম অর্জন করার পর হঠাৎ কেন যে এমন দুর্বুদ্ধি ঘাড়ে চেপে বসল, তা আজও বুঝতে পারি না। মনকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য মাঝে-মাঝে ভাবি, ভবিতব্যকে বোধহয় স্বয়ং বিধাতাও খণ্ডন করতে পারে না—আমিও পারিনি। আর পারিনি বলেই আমার আজ এই দুর্দশা।
কত লোককে দেখেছি টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে। টাকা যেন তাদের কাছে মুড়ি-মুড়কির মতো। আমার চোখের সামনে কত লোক রাতারাতি ভুঁইফোঁড় হয়ে উঠেছে। দেখেছি, আর আমার চোখে জ্বালা ধরে গেছে। হতাশ হয়ে ভেবেছি, ছ্যাকড়াগাড়ির ঘোড়ার মতো এভাবেই কি জীবনটা ধুঁকতে-ধুঁকতে কাটিয়ে দিতে হবে আমাকে? ভাগ্যের কাছে এভাবেই কি নির্বিবাদে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকব? না, তা চলবে না। কিছু একটা করতেই হবে আমাকে। জীবনটাকে ফুলে-ফলে ভরিয়ে তুলতে হবে। এ জন্যে যত বড় ঝক্কিই আসুক না কেন, তার মোকাবিলা করতে হবে। হায়, তখন যদি কেউ আমাকে সাবধান করে দিত! কেউ যদি বলে দিত—এ-পথে যেয়ো না। এ-পথে শান্তি নেই, সুখ নেই। এ-পথে গেলে তোমার ভাঙা কপাল আরও ভাঙবে!
এখন বুঝতে পারি, চাকরির শেষ ছ’টি মাস যে-সমস্ত পরিকল্পনা করেছি, তাতে সৌভাগ্যের ভিত স্থাপন করিনি, বরং কবরই খুঁড়েছি। ব্যাঙ্কে চাকরি করেছি, আর সুযোগ খুঁজেছি মোটা টাকা বেমালুম লোপাট করে দেওয়ার। হাজতঘরের কথা কি ভাবিনি? তাও ভেবেছি। কিন্তু বামাল গ্রেপ্তারের কথা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি। নেহাৎ যদি ধরাই পড়ি, না-হয় জেল খাটব। আর ধরা যে পড়বই তাতেও কোনও সন্দেহ ছিল না। সুবোধ কয়েদি হিসেবে জেলারের মন জয় করবার কথাও চিন্তা করে রেখেছিলাম, যাতে করে হাজতবাসের মেয়াদ দু-তিন বছর মাপ হয়ে যায়। শাস্তি ভোগ শেষ হলে যখন বেরিয়ে আসব, তখন চুরি করা টাকা একান্তই আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হবে—তাতে কারও কোনও ভাগ থাকবে না। বাকি জীবনটা পরের গোলামি না করেও প্রাচুর্যের মধ্যে কাটিয়ে দিতে পারব।
আপনারা ভাবছেন, সবটাই বুঝি পাগলের প্রলাপ—পরিকল্পনাটা কার্যে রূপায়িত করা বুঝি একেবারেই অসম্ভব! আমি কিন্তু মোটেই তা ভাবিনি। অসম্ভবকে সম্ভব করতে কীভাবে উঠে-পড়ে লেগেছিলাম, সে-কথাই এবার শুনুন। অবশ্য পুরো ছ’টি মাস লেগেছিল তিল-তিল করে জবরদস্ত একটা পরিকল্পনা গড়ে তুলতে।
বিজলি ছিল আমারই সহকর্মিণী—সহধর্মিণীও বটে। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা বলতে-বলতে কখন যেন সে আমার ওপর বেশ কিছুটা অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। প্রতিদানে তার ওপর অনুরাগ দেখানোর মতো মনোভাব আমার তখন ছিল না। আমার মাথায় তখন কামিনী অপেক্ষাও কাঞ্চনের চিন্তা চরকিবাজির মতো বোঁ-বোঁ করে ঘুরছিল। একসঙ্গে গঙ্গার ধারে বসে থাকবার সময় কত কথাই না কলকলিয়ে বলে যেত সে। কিছু আমার কানে ঢুকত, কিছু ঢুকত না। সে প্রায়ই বলত, টাকা নাকি হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তাকে ধরতে জানা চাই। অর্থাৎ, আমার রোজগারের টাকা আমাদের বিবাহিত জীবন-যাপনের পক্ষে যৎসামান্য বলেই মনে হত তার। তার বাড়ি ছিল হলদিয়ায়। সেখানে নাকি ছোটখাট একটা শহরের পত্তন হতে চলেছে। সেখানে নাকি বিরাট একটা পরিবর্তনের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এসব কথা প্রায়ই শুনতাম তার মুখে।
তাকে আমার প্রয়োজন ছিল। তাই ভাব জমিয়ে রাখলাম বাধ্য হয়ে। রূপ তার আহামরি কিছু না হলেও একটি রূপবান পুরুষকে কাত করবার পক্ষে যথেষ্ট। অন্যসময় হলে হয়তো তার ভ্রমরকৃষ্ণ দীর্ঘ কুন্তল এবং ডাগর-ডাগর চোখ দুটি দেখেই মজে যেতাম। হয়তো বা কোনও দুর্বল মুহূর্তে বলেও বসতাম, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে—।’
বিজলি যখন এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে হলদিয়ায় চলে গেল, তখনই আমার বহু-প্রতীক্ষিত পরিকল্পনাটি ষোলোকলায় পূর্ণ হল। যাওয়ার দিন সন্ধেবেলা বহুক্ষণ গঙ্গার ধারে আমার গা ঘেঁষে বসেছিল সে।
বলেছিল, ‘তোমার মুরোদ কত এবার টের পাওয়া যাবে। বাবার কাছে গিয়ে বীরপুরুষের মতো বলতে পারবে যে, আপনার মেয়েটিকে আমার চাই!’
আমি বলেছিলাম, ‘আমার কী দরকার, তুমিই তো বলতে পারো তোমার বাবাকে।’
‘তুমি আস্ত একটি বুদ্ধির ঢেঁকি। মুখ ফুটে বলতে আমার বুঝি লজ্জা করবে না?’
‘আচ্ছা, আমিই না হয় বলব।’
তারপর বহুক্ষণ আমরা নিতল স্তব্ধতার মধ্যে চুপচাপ বসেছিলাম। গঙ্গার হাওয়া উত্তাল হয়ে উঠেছিল। নবযৌবনা নারীর বিলোল কটাক্ষ ক্ষণে-ক্ষণে বিদ্ধ করছিল আমাকে। কিন্তু আমার মন তখন সেখানে ছিল না—ভবিষ্যতের ভাবনায় বিভোর হয়ে গিয়েছিল।
বিজলি শুক্রবার হলদিয়ায় চলে গেল। সে চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মন থেকে তার স্মৃতি সাময়িকভাবে মুছে ফেলে দিলাম। সমস্ত মনটাকে কেন্দ্রীভূত করলাম পরের শুক্রবারের দিকে। মতলব হাসিল করবার চরম দিন সেটি।
জীবন এগিয়ে চলল। ধীর ছন্দে এসে হাজির হল সোমবার। ব্যাঙ্কে ক্ষুদ্র সঞ্চয় যা ছিল তুলে নিলাম। সুদ নিয়ে সর্বসাকুল্যে সাতশো টাকার মতো হবে।
মঙ্গলবার বিজলির পত্র পেলাম। তার বাবা নাকি আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। শনিবার আমাকে অবশ্য হলদিয়ায় হাজির হতে অনুরোধ করা হল। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে পালটা জবাব দিলাম আমি।
বৃহস্পতিবার রাত্রে অনেকগুলি জিনিস কিনলাম আমি। যেমন—একটি মাটি সরানোর বেলচা, কিছুটা ভারী ফয়েল পেপার, জলের ফ্লাস্ক, বড় টর্চলাইট, মাঝারি আকারের একটা চামড়ার সুটকেস, ক্যাম্বিসের থলে ইত্যাদি। হলদে রঙের কিছুটা চটও জোগাড় করে রাখলাম। প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসগুলি ক্যাম্বিসের থলেতে ভরে নিলাম। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে দিনসাতেকের জন্যে একটা মোটরগাড়ি ভাড়া করেছিলাম আগেই। তারই পেছন দিকে মালপত্রগুলো বোঝাই করে নিলাম।
শুক্রবার গাড়িসমেত হাজির হলাম নিজের অফিসে। খালি সুটকেসটাকে বয়ে নিয়ে গেলাম নিজের কাউন্টারে। পাশের কাউন্টারের সহকর্মী বলে উঠল, ‘খুব তোড়জোড় দেখছি যে—যাওয়া হচ্ছে কোথায়?’
আচমকা প্রশ্নে কেমন যেন চমকে উঠেছিলাম। সামলে নিয়েই উত্তর দিলাম, ‘আর বলেন কেন! হলদিয়া থেকে বিজলির চিঠি এসেছে। আমার কাল নাগাদ সেখানে পৌঁছনো চাই-ই চাই।’
‘বেশ তো, যান না।’
গিয়েছিলাম আমি ঠিকই, কিন্তু হলদিয়ায় নয়। কীভাবে গিয়েছিলাম, সে-কথা মনে হলে এখন সবই যেন স্বপ্নের মতো লাগে। আমাদের ব্যাঙ্কে একই সারিতে পরপর যে-দশটি কাউন্টার ছিল তাদের সবার শেষেরটি ছিল আমার। কাউন্টারের দেওয়ালে ছিল একটি কুলুঙ্গি, আর মেঝেতে ছিল একটা ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট। তিনটে বাজার সঙ্গে-সঙ্গে কাউন্টারও বন্ধ হল, আর ঝাড়ুদারও এসে হাজির আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য। আমার অলক্ষিতে আমার পেছনে তার উপস্থিতি আমি আশাই করতে পারিনি। ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখেই চমকে উঠলাম।
দাঁত বের করে সে হেসে ফেলল, ‘হে-হে, আজ আমি একটু আগে বেরিয়ে যেতে চাই কিনা, তাই এখনই ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটটা পরিষ্কার করে দিয়ে যাচ্ছি।’
বাস্কেটের পাশেই চামড়ার খালি সুটকেসটা রাখা ছিল। সেটিকে ধরে সরিয়ে রাখবার চেষ্টা করতেই আমার মুখ শুকিয়ে গেল, সে-ও অপ্রস্তুত হল দারুণ। আকারের তুলনায় সুটকেসটার ওজন ছিল খুব কম। অথচ ওটাকে ভারী মনে করে প্রথমেই অত্যধিক বলপ্রয়োগ করার ফল হল এই যে, হঠাৎ পেছন দিকে ছিটকে পড়বার উপক্রম হল তার।
আমি অনুযোগের সুরে বললাম, ‘কত আর ওজন হবে বলো, আছে তো একটা পাজামা, আর একটা টুথব্রাশ।’
সে খানিকটা বোকার মতো হেসে নিজের কাজ সেরে চলে গেল। আমি স্বস্তির শ্বাস নিলাম।
পাঁচটা বাজবার আগেই ক্যাশবাক্স জমা দিয়ে বেরিয়ে গেল সবাই। রইলাম শুধু আমি। আমার ক্যাশবাক্স ইতিমধ্যে খালি হয়ে গিয়েছিল—বাক্সের সমস্ত টাকা সযত্নে সুটকেসে ভরে নিয়েছিলাম। খালি ক্যাশবাক্স নিয়ে ভল্টের দিকে এগোনোর সময় বন্দুকধারী দারোয়ানটি আমার দিকে কটমট করে তাকিয়েছিল। তার দৃষ্টি কিছুটা নরম করবার জন্যে বললাম, ‘কী হে হীরালাল, কেমন আছ?’
‘তবিয়ত আচ্ছা নেহি, হুজুর।’
‘দাঁড়াও, ক্যাশবাক্সটা রেখে আসি, তারপর তোমার সঙ্গে কথা বলব।’
ফিরে এসে সুটকেসটা তুলতেই বোঝা গেল, বড্ড বেশি ভারী হয়ে গেছে সেটা।
দারোয়ান পুরোনো কথার খেই ধরে শুরু করল, ‘আপ তো হলদিয়ামে যা-হি রহে হেঁ, মেরে ভাইকো জরুর মেরা সেলাম ভেজ দিজিয়েগা। আউর কহিয়েগা, আগলে মাহিনেমে ম্যায় রুপেয়া ভেজুংগা।’
‘ঠিক আছে, বলব।’
‘আউর কহিয়েগা, দেশোয়ালী কি চিঠঠি আয়ি হ্যায়—জায়দাদ কা চিন্তা মত করনা।’
‘আচ্ছা।’
‘এ ভি কহিয়েগা, চিঠঠি মে লিখ্যা হ্যায় কে মেরা এক লড়কি হুয়ি হ্যায়।’
‘আচ্ছা বাবা, বলব।’
আর অপেক্ষা না করে সুটকেস নিয়ে সদর দরজার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। দারোয়ানজি আবার মনে করিয়ে দিল, ‘ভুলিয়েগা মাত।’
‘না, ভুলব না।’ উত্তর দিলাম।
আমার মন ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। ব্যাঙ্কের মোটা টাকা ডাকাতি করে নিয়ে পালাচ্ছি আমি—এই চিন্তা মনে উদিত হওয়ামাত্র পা দুটো দৌড়োনোর জন্যে উসখুস করতে লাগল। অতি কষ্টে দৌড়নোর ইচ্ছা থেকে নিজেকে সামলে নিলাম।
সুটকেসটা মোটরের পেছনে রেখে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করছিল। গাড়ির বেগও বেড়েই চলেছিল। কিন্তু মনের সঙ্গে মোটেই এঁটে উঠতে পারছিল না সে—মন যেন ছুটতে চাইছিল জেট প্লেনের গতিতে।
পথে নানারকম বাধা—লাল আলোর শাসানি, পুলিশের হাত দেখানো, পথচারীদের ভিড়। তবুও বেহালা পৌঁছতে খুব বেশি বিলম্ব হল না। সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে এল, তখন ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে আমার গাড়ি ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে ছুটে চলেছে। বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আমাকে কেউ অনুসরণ করছে কি না। থামলাম একেবারে ফলতা গিয়ে। নদীর পাড়ে নিরিবিলি জায়গায় গাড়ি দাঁড় করালাম।
দ্রুত হাতে সুটকেস থেকে টাকাগুলো বের করে নিলাম। পোশাক-আশাক সব ভরে নিলাম সুটকেসে। নোটের তাড়াগুলো গুনে-গুনে ক্যাম্বিসের থলেতে পুরে নিলাম। পুরো বিশ লাখ টাকা। কিছু পরিষ্কার পাথরের কুচিও ভরতে হল, যাতে করে বান্ডিলটা প্রায় গোলাকার দেখতে হয়। ফয়েল পেপার দিয়ে নোটের পুঁটলিটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলাম। ঝড়-বাদল কীট-পতঙ্গ প্রভৃতির হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যে এই ব্যবস্থা। সবার শেষে বাঁধা হল চট এবং দড়ির সাহায্যে। তারপর মাটি দিয়ে এমনভাবে রাঙিয়ে দিলাম, যেন বড় একটা মাটির ঢেলা ছাড়া আরে কিছুই মনে না হয়। গভীর পরিতৃপ্তিতে বান্ডিলটাকে নেড়ে-চেড়ে পরখ করলাম অনেকক্ষণ ধরে।
জায়গাটার নাড়ি-নক্ষত্র আমার নখদর্পণে। টাকার তোড়াটা কোথায় পোঁতা হবে আগেই ঠিক করা ছিল। এমনকী গর্তও খুঁড়ে রেখেছিলাম কয়েকদিন আগে। জায়গাটার সম্বন্ধে বিশেষ সুনাম ছিল না। লোকেরা পারতপক্ষে সেখানে যেত না। তবুও নিজে যাচাই না করে জায়গাটার নির্জনতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইনি। একনাগাড়ে পনেরো দিন সেখানে আস্তানা গেড়েছিলাম। একটি জনপ্রাণীকেও পথ ভুলে সেখানে যেতে দেখিনি। এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গাই তো আমার উদ্দেশ্যসিদ্ধির প্রকৃষ্ট স্থান!
কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে অন্ধকারকে ফালি-ফালি করে কেটে আমার টর্চ আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। এক হাতে বেলচা, অপর হাতে নোটের বান্ডিল।
মানুষ-প্রমাণ গর্তটার মধ্যে বান্ডিলটাকে ছুড়ে দিয়ে বললাম, ‘বিদায় বন্ধু! অহল্যার মতো পাথর হয়ে পড়ে থাকো কয়েকবছর। আমিই আবার উদ্ধার করে নিয়ে যাব তোমাকে। আমার সঙ্গে তোমার জীবনও ধন্য হয়ে উঠবে তখন। বিদায়! বিদায়!’
টর্চটাকে জ্বালিয়ে মাটিতে রেখে ত্রস্ত হাতে বেলচা চালাতে লাগলাম। ঝপাঝপ মাটি গিয়ে পড়তে লাগল গর্তের ভেতর। কাজ সাঙ্গ হলে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম, কোনও ত্রুটি আছে কি না। না, এখানে যে গর্ত খোঁড়া হয়েছিল বোঝবার উপায় নেই। দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে তো আর কথাই নেই।
এখন সম্পূর্ণ নিজের স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে আমাকে। নিজের স্মৃতিশক্তির ওপর বিন্দুমাত্র অনাস্থা আমার কোনওকালেই ছিল না। তবু সাবধানের মার নেই। বটগাছটার ওপর ছুরি দিয়ে যে-সাঙ্কেতিক চিহ্নগুলো লিখে রেখেছিলাম, বেশ কয়েকবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম তার ওপর। টর্চের জোরালো আলোয় জায়গাটার নকশা মনে গেঁথে নিলাম আরও একবার।
মোটরে ফিরে গিয়ে সুটকেস ছাড়া সন্দেহজনক সব ক’টি জিনিসই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিলাম। হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম! মাটির সামান্যতম দাগও জুতো থেকে মুছে দিলাম কাপড় দিয়ে ঘষে-ঘষে। কারণ, আমি জানতাম, মাটির নমুনা দেখেই সুদক্ষ বিশেষজ্ঞের পক্ষে জায়গার হদিশ পাওয়া সম্ভবপর।
মোমিনপুরে যখন ফিরে গেলাম, তখন রাত দশটা বাজে। ট্রাম-বাসের আনাগোনা কমে এসেছে। পথে-পথে সেই শ্বাসরোধী ভিড় আর নেই। টিউব লাইটের আলোয় কলকাতাকে এত অপূর্ব দেখাচ্ছে যে, আর কখনও এমন রূপ দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হইনি। হয়তো সাফল্যের আনন্দে নেশা জেগেছিল।
ভালো একটা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। ভেতরে ঢোকার আগে গাড়ির স্পার্ক-প্লাগ আলগা করে দিয়ে গিয়েছিলাম।
রেজিস্ট্রি খাতায় নাম-ধাম লিখে বয়ের হাতে নিজের সুটকেসটা ঝুলিয়ে দিয়ে তার পিছু-পিছু নিজের কেবিনের দিকে চললাম। মোটা বকশিস দেওয়াতে মুহূর্তে বয়ের মধ্যে বেশ সমীহপূর্ণ আচরণ লক্ষ করা গেল।
কিছুক্ষণ পরে নীচে নেমে এসে ম্যানেজারের অনুমতি নিয়ে ফোন করলাম হলদিয়ায়। ফোন ধরল বিজলির বাবা।
বলল, ‘আপনি কে?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘আমার নাম বিমান মিত্র—আপনার মেয়ের সহকর্মী।’
‘ও, আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন?’
‘কালীঘাট।’
‘হলদিয়ায় আসার কথা ছিল, তার কী হল?’
‘আর বলেন কেন—মোটরটা বিগড়েছে।’
‘আচ্ছা, আমি বিজলিকে ডেকে দিচ্ছি।’
বিজলি ফোন ধরেই গর্জে উঠল, ‘নাঃ, তোমার মতো বাউন্ডুলে ছেলে জীবনে দেখিনি। নিশ্চয়ই এখানে আসার কথা বিলকুল ভুলে বসে আছ?’
‘না।’
‘তবে? আবার কারও সঙ্গে পিরিত হয়েছে নাকি?’
‘মেলা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না।’
‘না, করবে না! এদিকে আমরা সবাই তোমার আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছি, আর তুমি এতক্ষণে সবে কালীঘাটে। তুমি কথা ঠিক রাখতে পারবে না, আর এ-জন্য আমাকে ভুগতে হবে? এঁদের কাছে এখন মুখ দেখাই কী করে বলো তো?’
‘এঁরা আবার কারা?’
‘এঁরাই তো তোমাকে হাতকড়ি পরানোর জন্যে বসে আছেন।’
‘তার মানে? ইয়ার্কি ভালো লাগে না—যা বলবার পরিষ্কার করে বলো।’
‘এই সামান্য কথাটার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারছ না? এঁরা হচ্ছেন আমার আত্মীয়-আত্মীয়া। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা যে পাকা হয়ে গেছে, এঁরা তা জানেন। তোমার ফটো দেখে সবাই পছন্দ করেছেন তোমাকে। প্রাথমিক মনোনয়ন হয়ে গেছে, এবার তুমি এলেই পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তা তুমি আসছ কখন?’
‘আজ তো আর হচ্ছে না—গাড়ি বিগড়ে বসে আছে। সারাতে পারলে কাল নাগাদ পৌঁছতে পারি। আমি কালীঘাটে বাঙালি হোস্টেলে উঠেছি। তুমি বরং কাল সকালে একবার ফোন কোরো।’
খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমেই গেলাম গাড়ির কাছে। স্পার্ক-প্লাগ আবার যথা জায়গায় সংযোগ করে দিলাম। এবার ডিস্ট্রিবিউটারটা খুলে ফেললাম। রোটরের তলা থেকে স্প্রিংটাকে সরিয়ে নিলাম। তারপর ইগনিশান ওয়ারের মধ্য দিয়ে এমনভাবে একটা সাধারণ পিন ঢুকিয়ে দিলাম যাতে পিনের অগ্রভাগ মোটরের সংস্পর্শে আসে। ডিস্ট্রিবিউটার যথাস্থানে লাগিয়ে মনে-মনে বললাম, মোটরের মেকানিকও এবার সহজে বুঝতে পারবে না গোলযোগটা কোথায়।
স্থানীয় মোটর মেরামতের কারখানায় ফোন করতেই একজন মেকানিক এসে হাজির হল। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও গোলযোগটা ধরতে পারল না। অগত্যা ট্রাক পাঠিয়ে গাড়িটাকে নিয়ে যাওয়া হল কারখানায়। বিকেলবেলা গ্যারেজ থেকে ফোন এল। আমাকে জানানো হল, মোটরটা ঠিক করতে হলে আরও একদিন সময় দিতে হবে। আমি এককথায় রাজি হয়ে গেলাম।
বিজলি ফোন করতেই জানালাম, ‘গাড়িটার দোষ ধরা যাচ্ছে না। মনে হয়, সোমবারের আগে কিছু হবে না। অগত্যা তোমার ওখানে যাওয়ার কর্মসূচি বানচাল করতে হল। কারণ, সোমবার হলেই তো আবার অফিসে ছুটতে হবে।’
বিজলি সব কথা শুনে কেঁদে ফ্যালে আর কী। ওর জন্যে মনে-মনে বেশ দুঃখ অনুভব করলাম। কিন্তু আমি তখন নিরুপায়। একবার মনে হল, ওকে সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। ও যাতে ভেঙে না পড়ে সেটা দেখাও আমার কর্তব্য। পরেই ভাবলাম, লাভ কি মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে? আঘাত তো ওকে পেতেই হবে—দু-দিন পরে না হয়ে সেটা না হয় আগেই হল।
ম্যাগাজিন পড়ে আর রেডিয়ো শুনেই রোববারটা কেটে গেল। বিকেলে আমার গাড়ি এসে হাজির। মেকানিক বলল, ‘দেখুন দাদা, আপনার গাড়িটা হঠাৎ খারাপ হয়েছে বললে ভুল বলা হবে। কেউ দুষ্টুমি করে অমন করেছে।’
আমি বললাম, ‘হয়তো তাই হবে। আমি যখন হোটেলে চা খাচ্ছিলাম, তখন কোনও বদমাশ ছোঁড়া এমন করেছে কি না কে জানে। নিরীহ লোকদের উত্যক্ত করবার শয়তানী বুদ্ধি অহরহই এদের মগজে চক্কর খাচ্ছে। যাক, আপনি যে গলদ ধরতে পেরেছেন, এজন্যে ধন্যবাদ।’
পাওনা মিটিয়ে দিয়ে লোকটাকে বিদায় দিলাম। মুখে কিছু না বললেও সন্দেহের দৃষ্টিতে অপাঙ্গ নিরীক্ষণ করে লোকটা চলে গেল।
গাড়িটাকে তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সোমবার যথাসময়ে অফিসের কাজে যোগদান করলাম। সবকিছুই যেন কেমন অদ্ভুত বলে মনে হতে লাগল। সবাই যেন ফিসফিসিয়ে কী সব বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে। সকলের চোখে চকিত বঙ্কিম চাউনি। আমিই যেন তাদের সমালোচনার মূল বিন্দু। এমনকী, বচনবাগীশ কালো মোটা ভদ্রলোকটিও আমার সঙ্গে অন্যান্য দিনের মতো অযাচিত আলাপে মেতে উঠলেন না। দারোয়ানপ্রবরও জানতে এল না তার ভাই কোনও কুশল সমাচার পাঠিয়েছে কি না।
ব্যাঙ্কের কর্মমুখর পরিবেশের মধ্যে যেন সত্যিই ছন্দপতন ঘটেছে। অথচ বাইরে থেকে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। কাঁটায়-কাঁটায় দশটায় ব্যাঙ্কের দরজা খুলেছে। লোকেরা যথারীতি ভিড় করেছে কাউন্টারের সামনে। টাকা-পয়সার লেনদেনও হয়েছে নিয়মমাফিক। সবকিছুই স্বাভাবিক। তবু যেন কেমন একটু থমথমে গাম্ভীর্য সর্বত্র। অর্কেস্ট্রা পার্টির ঐকতান সঙ্গীতের মধ্যে যেন দু-একটা সুর বেসুরো লাগছে।
তিনটের সময় দারোয়ান দরজা বন্ধ করে দিল। তিনটে পনেরোর মধ্যে কাজ সেরে বাইরের লোকজন সব চলে গেল। সাড়ে তিনটের সময় প্রেসিডেন্টের মহিলা সেক্রেটারি আমার সামনে এসে হাজির।
তিনি জানালেন যে, ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট আমাকে ডাকছেন। বলার ভঙ্গি গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং দৃষ্টি মাটির ওপর দৃঢ়নিবদ্ধ। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না তিনি।
তাঁর পিছু-পিছু যাওয়ার সময় আমিও কোনও দিকে তাকাতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। তবে অনুভবে বুঝতে পেরেছিলাম, বিশ-পঁচিশ জোড়া চোখের উদভ্রান্ত দৃষ্টি আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।
কেতাদুরস্ত সাহেবি পোশাকে প্রেসিডেন্ট বসেছিলেন একটা রিভলভিং চেয়ারের ওপর। মুখখানা তাঁর বিষাদ-মাখানো—যেন বহুদিন যাবৎ কোষ্ঠবদ্ধতায় ভুগছেন তিনি। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের দু-পাশে দুজন লোক বসেছিলেন। পুলিশি পোশাক পরা না থাকলেও তাঁদের নির্লিপ্ত অভিব্যক্তিহীন মুখ দেখেই বুঝেছিলাম যে তাঁরা পুলিশেরই লোক।
কোনওরকম ভূমিকা না করেই প্রেসিডেন্ট বলে বসলেন, ‘দেখুন বিমানবাবু, বিশ লাখ টাকার হিসেব মিলছে না আমাদের। আপনি যে সরিয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখন ভালোয়-ভালোয় সেটা বের করে দিন। আমি কথা দিচ্ছি, আপনার শাস্তির মেয়াদ যাতে কম হয় আমি যথাসাধ্য সেই চেষ্টাই করব।’
আমি যেন দুম করে আকাশ থেকে পড়লাম। আমার গলা শুকিয়ে গেল, শুকনো ঢোক গিললাম। শূন্য দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ প্রত্যেকের মুখের ওপর দিয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। আচমকা একটা মানসিক আঘাতে কথা হারিয়ে ফেললাম। অন্তত এমন ভাব দেখালাম যেন কথাটা আমার বোধগম্য হয়নি। তারপর প্রথম ধাক্কা সামলে উঠে হতভম্বের মতো বললাম, ‘টাকা! কীসের টাকা? আপনি কি কোনও টাকা চুরির অপরাধ আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছেন নাকি?’
শান্ত গলায় প্রেসিডেন্ট উত্তর দিলেন, ‘দেখুন, দোষ অস্বীকার করে কোনও লাভ হবে না। টাকাটা আপনিই নিয়েছেন। এখন বলুন, কী করেছেন সেই টাকাটা দিয়ে? আপনাকে আমি অভয় দিচ্ছি—লঘু শাস্তির বিধান দেওয়া হবে আপনার ক্ষেত্রে। আমার ওপর আপনি ভরসা করতে পারেন।’
আমি ক্রোধভরে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘কী মজার ব্যাপার! টাকা সম্বন্ধে কিছুই জানি না আমি, অথচ আমাকে দোষ স্বীকার করতে হবে? কোন অধিকারে আপনি আমাকে দোষী সাব্যস্ত করছেন?’
পুলিশ অফিসারদের একজন উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, ‘দেখুন মিস্টার, আপনি যে এরকম একটা উত্তর দেবেন আমরা তা জানতাম। আমরা এও জানতাম, আপনাকেই আমাদের হাতকড়ি পরাতে হবে। আপনার মতন লোকদের কীভাবে ঘাঁটাতে হয় আমাদের ভালোভাবেই জানা আছে। প্রথমে আপনারা সবই অস্বীকার করেন। তারপর বড় ঘরে গিয়ে বাপ-বাপ বলে সব স্বীকার করে ফেলেন। কেন দাদা ঝামেলা পাকাচ্ছেন? আগেভাগে সব স্বীকার করে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।’
আমি তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে বসলাম। আমাকে বাধা দিয়ে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, সাধ করে বিপদ ডেকে আনছেন আপনি, আমি আর কী করতে পারি বলুন?’
খুট করে একটা শব্দ হতেই দেখি হাতে হাতকড়া লেগে গেছে আমার।
জনপ্রবাদ আছে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে একশো আট। কথাটা যে কতদূর সত্য অচিরেই সেটা হাড়ে-হাড়ে টের পেলাম। স্বপক্ষের উকিলের সঙ্গে বিপক্ষের উকিলের তুমুল তর্কযুদ্ধ হল। আমার কথার কোনও হেরফের নেই, আগাগোড়া একই কথা বললাম—টাকা সম্বন্ধে কিছুই জানি না আমি। আমার বিপক্ষে প্রচুর সাক্ষী হাজির হল। স্বপক্ষে শুধু তিনজন—বিজলি, তার দিদি এবং বাবা। তাদের বক্তব্য, শনিবার হলদিয়ায় আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। শুক্রবার বিকেলে আমি যাত্রাও করেছিলাম। কিন্তু গাড়ির যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
মামলার প্রথম কয়দিন বিজলি একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখত আমাকে। আমার মতো ভালো ছেলে দুর্বিপাকে পড়ে যে কাঠগড়ার আসামী সেজেছি, এজন্যে সহানুভূতির অন্ত ছিল না তার। কিন্তু পঞ্চমদিন থেকেই তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করলাম। আমি তার দিকে তাকালেই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে লাগল। বুঝলাম, তার মধ্যেও সন্দেহ সংক্রামিত হয়েছে। অপর সকলের মতো সেও আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করে বসে আছে।
সরকারি সাক্ষী মানা হল অনেককে। প্রথমেই এলেন হোটেলের ম্যানেজার। বেঁটেখাটো চেহারা। উদর বর্তুলাকার, যেন একটি প্রকাণ্ড ভূমণ্ডল পেটের ভেতর সেঁধিয়ে আছে। তিনি বললেন যে, হোটেলে ঢোকবার সময়ও আমার গাড়িটি চমৎকার কাজ দিচ্ছিল, পরে সেটা হঠাৎ বিগড়ে যায়। আমি যে হলদিয়ায় ফোন করেছিলাম সে-কথাও তিনি বললেন।
মোটর মেকানিকও অনেক কথাই বলল। গাড়ির যান্ত্রিক গোলযোগও নাকি ইচ্ছাকৃত। আমি নাকি তাকে বলেছিলাম যে, কোনও দুষ্ট ছেলের কাজ সেটা। আমি যখন হোটেলে চা খেতে ঢুকেছিলাম, তখনই নাকি ব্যাপারটা ঘটেছিল। মোটর স্প্রিং নাকি স্থানচ্যুত হয়েছিল এবং মোটরের ইঞ্জিনে একটা পিন ঢুকিয়ে শর্ট সার্কিট করে দেওয়া হয়েছিল। তার মতে, এ-জাতীয় গোলযোগ থাকলে কোনও গাড়ি একচুলও এগোতে পারে না।
এরপর এল ঝাড়ুদার এবং দারোয়ানের সাক্ষ্য। তাদের সাক্ষ্যই এক্ষেত্রে বেশি মূল্যবান। ঝাড়ুদার আমার সুটকেসটাকে শনাক্ত করল। উকিল তাকে জেরা করল, ‘যখন তুমি সুটকেসটাকে সরিয়ে একপাশে রেখেছিলে, তখন এটাকে ভারী মনে হয়েছিল কি?’
‘একদম না।’
‘পুলিশ সুটকেসটাকে খুলে তার ভেতর অনেক কিছুই পেয়েছে। যেমন, একজোড়া শার্ট, একজোড়া পাজামা, একটা প্যান্ট, আয়না-চিরুনি, সেফটি রেজার বক্স এবং একজোড়া চটি। তোমার কি মনে হয়, এই জিনিসগুলো তখন ওই সুটকেসটাতেই ছিল?’
‘একেবারেই না—সুটকেসটা বিলকুল ফাঁকা ছিল।’
এরপর এল দারোয়ানের পালা। সে বলল যে, আমাকে সে গাড়িতে ওঠার আগে পর্যন্ত লক্ষ করেছে। আমার চলার ভঙ্গি দেখেই তার মনে হয়েছিল যে, সুটকেসটি খুব ভারী। গাড়ির পেছনে ওটাকে রাখবার সময় আমি যে দুটি হাতই ব্যবহার করেছিলাম, এ-কথাও বলতে ভুলল না।
আরও ভালোভাবে প্রমাণ খাড়া করবার জন্যে আমাকে খালি সুটকেস নিয়ে হাঁটতে বলা হল প্রথমে। তারপর বিশ লাখ টাকার সমান ওজনের জিনিস ভরে দিয়ে সুটকেসটা হাতে নিয়ে হাঁটতে বলা হল। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও দুবারের চলার ভঙ্গি একইরকম করতে পারলাম না।
আমি অবশ্য আগাগোড়া দোষ অস্বীকার করে গেলাম। বেকসুর খালাস যে পাব না তা জানতাম। অবশেষে রায় বেরুল—দশ বৎসরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলাম।
হাজতবাসের প্রথম দিনেই বিজলি আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। আমি বিব্রত বোধ করলাম। কারণ, তার আচার-আচরণে স্পষ্টই সন্দেহের ভাব দেখা গিয়েছিল।
সে বলল, ‘আমি তোমাকে প্রাণ দিয়েই ভালোবাসতাম, এবং এখনও বাসি। কিন্তু এ কী বিশ্রী কাণ্ড ঘটে গেল বলো তো?’
‘তুমি এখনও আমাকে সন্দেহ করছ দেখছি।’
‘আচ্ছা, তুমিই বা এত একরোখা কেন বলো তো? ভুল না হয় একটা করেই ফেলেছ। এখন বলে ফেললেই তো হয়, টাকাটা কোথায় রয়েছে। হাজতবাসের মেয়াদ অনেক কমে যাবে তাহলে।’
‘তোমাকে তারা গুপ্তচরবৃত্তি করতে পাঠিয়েছে নাকি? দ্যাখো, একটা কথা বলে রাখি—আমার ভালো-মন্দ আমি ভালোই বুঝি। আমার ভাগ্যকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, তোমাকে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি শুধু একটা অনুগ্রহ করো—আর কখনও আমার সামনে এসো না। তোমাকে আমি কোনওদিনও ভালোবাসতে পারিনি।’
ব্যস, সেদিনই বিজলির সঙ্গে সমস্ত সংস্রব ছিন্ন হয়ে গেল।
সময়—সময়—সময়! অনন্ত অপার বিশ্বচরাচরে অবাধ প্রবাহে অতিবাহিত হয়ে চলেছে সময়। খাওয়া, ঘুম, কাজ আর কাজ, খাওয়া, ঘুম। সীমাহীন একঘেয়ে পুনরাবৃত্তির জোয়ারে হাবুডুবু খাচ্ছি জেলের ভেতরে। সময়কে যেন শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছে এখানে—যেন একচুল এদিক-ওদিক নড়বার জো নেই। ছকবাঁধা জীবন। মেশিনের মতো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এখানকার প্রতিটি মানুষের জীবন। বড়ই একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন তার চলার পথ। কতবার যে সূর্য উঠল আর কতবার অস্ত গেল, হিসেব রাখিনি। কতবার গাছে ফুল ফুটল আর ঝরে গেল, বলতে পারব না।
জেলের দুর্বিসহ জীবন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। অবশেষে তার হাত থেকে রেহাই পেলাম। মেয়াদ শেষ হল। জীবনের দশটি মূল্যবান বছর কারাপ্রাচীরের অন্তরালে কাটিয়ে দিলাম।
জেলারের সঙ্গে করমর্দন করে বেরিয়ে এলাম। পাখিদের কলকাকলি যেন কানে মধু বর্ষণ করল। হিল্লোলিত ডালপালার মর্মরধ্বনি নয়া জীবনের প্রতিশ্রুতি দিল। জলজ্যান্ত মানুষটা এতকাল যেন মরে ছিলাম। এবার ভাগ্যলক্ষ্মী নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবে। যেখানে যাব সেখানেই আমার জয়জয়কার হবে। আর এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা অক্লেশে সহ্য করা তো এই দিনটির জন্যেই।
আমার সাতশো টাকা ফেরত পেলাম। ফেরত পেলাম সুদসমেত। অল্প টাকার ঘর ভাড়া নিলাম। একটা হোটেলে ছোটখাটো একটা চাকরিও জুটিয়ে নিলাম। ঝরঝরে একটা মোটরগাড়িও ভাড়া নিলাম।
আমি জানতাম, আমার পেছনে ফেউ লেগে থাকবে। তাই যা করবার সাবধানে করতে হবে আমাকে। দু-দুবার বহুদূর বেড়িয়ে এলাম মোটরটাতে চেপে। একবার গেলাম গ্র্যান্ড টাঙ্ক রোড ধরে, আরেকবার কলকাতা-দার্জিলিং রোড বরাবর। প্রত্যেক জায়গায়ই বিরাট পরিবর্তনের জোয়ার এসেছে। নতুন-নতুন সুদৃশ্য ইমারতগুলি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠলাম একদিন। কালের করাল হাত থেকে আমিও তো রেহাই পাইনি! নিজেই যে চিনতে পারছি না নিজেকে!
দু-মাসে দশবার বাড়ি পালটালাম। বেড়াতে লাগলাম এলোমেলো। একবার গ্র্যান্ড টাঙ্ক রোড ধরে যাওয়ার সময় লক্ষ করলাম, একটা হেলিকপ্টার আমাকে অনুসরণ করছে। মনে-মনে ওদের নির্বুদ্ধিতায় হাসলাম একচোট। যে-লোকটা দশ-দশটা বছর অপেক্ষা করতে পেরেছে সে এই মুহূর্তেই আহাম্মকের মতো এমন কোনও কাজ করবে না যাতে মতলব ফেঁসে যায়।
অবশেষে বহু-প্রতীক্ষিত দিনটি এসে গেল। সকাল থেকেই সেদিন বাদলা হাওয়ায় সারা কলকাতা ব্যতিব্যস্ত, বৃষ্টির ছাটে পথ চলা দায়। এমন দুর্যোগের দিনে মোটরগাড়িই হোক আর হেলিকপ্টারই হোক আমাকে অনুসরণ করতে পারবে না। ‘দুর্গা-দুর্গা’ বলে বেরিয়ে পড়লাম অভীষ্টের সন্ধানে।
ডায়মন্ডহারবার রোডের মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে পরীক্ষা করলাম, ফেউ পিছু লেগেছে কি না। কোনও গাড়িকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা একেবারেই ত্যাগ করলাম। তিনবার থামার পরেও সন্দেহজনক কিছুই নজরে এল না।
বারবার থেমে-থেমে ফলতার নদীর পাড়ে যখন হাজির হলাম তখন হৃৎস্পন্দন রীতিমতো বেড়ে গেছে। আর কিছু দূরেই আমার গুপ্তধন লুকোনো রয়েছে। বিশ লাখ টাকা! আমার জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত ধন! যার কথা চিন্তা করে জীবনের সমস্ত দুঃখ-গ্লানি-তাপ ভুলে আছি, যার জন্যে সুরূপা নারীকেও পায়ে ঠেলেছি। আবেগে গাল বেয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
এক-পা দু-পা করে এগোতে লাগলাম। বিগত দশ বছরে দেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এই অজ পাড়াগাঁয়েও বিরাট-বিরাট সব অট্টালিকা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ওই তো সেই জটাজুটধারী বটগাছটা ধ্যানগম্ভীর মূর্তিতে এসব পরিবর্তনের নীরব সাক্ষী। আর এ কী! ওই জায়গাটাতেই তো আমার বহু-স্মৃতি-বিজড়িত গুপ্তধন রক্ষিত ছিল! তারই ওপর আজ দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক অট্টালিকা!
পায়ের তলার পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল। চোখে অন্ধকার দেখলাম। এত সাধের স্বপ্ন এক লহমায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! প্রবল হতাশায় হু-হু করে কান্না পেল আমার। আর ঝোড়ো বাদলা হাওয়া গাছে-গাছে শনশন আওয়াজ তুলে বিদ্রপ করে ফিরতে লাগল আমাকে।
মাসিক রোমাঞ্চ
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫